শ্রাবণধারা পর্ব-১০+১১+১২

0
147

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১০
(নূর নাফিসা)
.
.
পারভীনের সামনেই নাশতা করতে বসেছে শ্রাবণ। থমথমে মুখের দিকে একবারের বেশি তাকায়নি সে। শুরুতেই এসে তাকিয়ে সালাম দিয়েছিলো। গোমড়ামুখে বিড়বিড়িয়ে প্রত্যুত্তর করেছে পারভীন। অথচ ইনি যে বড্ড ভালো মনের মানুষ, তা বেশ ভালো অনুধাবন করে নিয়েছে শ্রাবণ। গত রাতে তার পাশে বসে থেকে কতো খেয়াল রাখলো। মাঝরাতে একবার, ভোর রাতে একবার কপাল ছুঁয়ে জ্বর মেপে গেছে। মায়ের মমতা এই মায়ের মধ্যে আছে বলেই তো ছুঁয়েছেন তাকে। পরীও অবগত করলো, ফ্যালফ্যাল চোখে নাকি তকিয়ে ছিলো তার দিকে। আহা! বড় পুত্রবধূর মায়া শ্বাশুড়ির চোখে না লাগালে চলে? রাগটা ওই যা ছেলের কর্মকাণ্ডের উপরই। শ্রাবণের খাওয়া শেষ পর্যায়ে এলেই মুখে কথা ফুটেছে পারভীনের।
“বাড়ি কই তোমার?”
“আমার বাড়ি নেই।”
“তইলে কি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বড় হইছো?”
একটু ঠমকে উঠে পারভীনের গলা। পরী তাই দরজার পাশে থেকে মুখ ভেঙায় পারভীনের প্রতি। শ্রাবণ ঠোঁটের ধারে হাসি এলিয়ে চোখ তুলে তাকায়।
“আমি নানির কাছে বড় হয়েছিলাম শহরে। এরপর নানি মারা যাওয়ার পর মামাবাড়ি ছেড়ে নিজের দেখাশোনা নিজেই করতে শিখেছি।”
“মা বাপ কেউই নাই?”
মাথা নত করে হালকা দোলায় সে।
“ওই বাড়িতে আইছো ক্যা? তারা কি লাগে?”
“লাগে না তেমন কিছুই। গ্রামে এসেছি কোনো চাকরির সন্ধানে। মজিদা খালাম্মার কাছে ভাড়া থাকতে চেয়েছিলাম। খালাম্মা বলে ডাকতাম।”
“উনার কি ঘর আছে, তোমারে ভাড়া দিতো?”
“যে ঘরে তিনি থাকেন, সেই ঘরেই আমি থেকেছি।”
“শহর ছাইড়া গ্রামে আইছো। এই গ্রামে কি আর তেমন চাকরি পাইবা? দেখতে তো শিক্ষিতই মনে হয়। কাজটা তো করলা মূর্খের মতো। তোমার তো কিছু গেলো না। সম্মান নিয়া কানাকানি চলতাছে চেয়ারম্যানবাড়ির।”
প্রত্যুত্তর করে না শ্রাবণ। পরীর যেন খুব মনে লাগছে পছন্দের ভাবিটাকে এভাবে বলায়। তাই প্রত্যুত্তর করে বসে সে।
“হইছে, আম্মা। থামেন। ভাবিরে খালি একলা দোষী কইরেন না। ভাইজান না আনলে কি উনি আইতো?”
“তুই চুপ থাক!”
“হো, চুপই তো থাকমু। আপনাগো ভালা কইলেই খালি ভালা।”
বিড়বিড়িয়ে শ্রাবণের প্লেট নিতে আসে।
“আপনের ধুইতে হইবো না, ভাবি। দেন আমার কাছে। আপনে হাত ধুইয়া উঠেন।”
“যেদিন হতে প্লেট ধুতে শিখেছি, কোনো অনুষ্ঠান ব্যাতিত নিজের প্লেট কখনোই অন্যকে ধুতে দেইনি। এখনো দিবো না, পরী।”
নিজের প্লেট হাতে নিয়ে উঠে যায় শ্রাবণ। পরীর যেন মন ছুঁয়ে গেলো ভাবির বাক্য। মনে মনে স্বগতোক্তি করে,
“কত ভালা মানুষ! ওইযে আইতাছে আরেক চেয়ারম্যান কন্যা। পারলে তো হাতটা পর্যন্ত ধোয়াইয়া মুখটা পর্যন্ত মোছায় নেয় অন্যের মাধ্যমে!”
পরক্ষণে পারভীনের দিকে তাকিয়ে দেখে পারভীনও শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে আছে। মনটা খুশি হয়ে যায় পরীর। মন বলে,
“সৌভাগ্য মনে কইরা মাইন্না লন, আম্মা। এমন বউ পাওয়া সৌভাগ্য।”
এলো চুলে অর্পা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
“আম্মু, আমার চিরুনি কই? স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
“আমি কি জানি তোর চিরুনির খবর!”
পাশ হতে শ্রাবণ বলে দেয়,
“একটা চিরুনি আমি মাথা আঁচড়ে রেখেছিলাম ড্রয়ারে।”
“খালি ভেজাল! সব কিছুতে ভাগ বসায় নিচ্ছে!”
চোখেমুখে বিরক্তি জাগিয়ে অনুচ্চ উক্তি করে চলে যায় অর্পা। পারভীন পিছু বলে,
“ভাত খাবি না?”
“সময় নেই। নিয়ে আসো আসলে।”
শ্রাবণের একটু খারাপ লাগে অর্পার অনুচ্চ উক্তি। মেয়েটা অহংকারী বটে। পারভীন প্লেটে ভাত নিয়ে যায় মেয়েকে খায়িয়ে দিতে। শ্রাবণ বেরিয়েছে পরীর সাথে। নির্ভেজাল বারান্দার পরিবেশটা দারুণ লাগলো শ্রাবণের কাছে। গ্রিল জুড়ে কিছু অপরিজিতার লতা বেয়ে উঠলেই প্রাণবন্ত লাগতো। বারান্দার বেষ্টনী ছেড়ে উঠুনে নামতেই গোলাপ গাছে তাকায়। অসংখ্য ফুল ফুটতে শুরু করেছে। সেদিনের গোলাপ এই রঙেরই ছিলো। হয়তোবা এই গাছেরই। শ্রাবণ আধফোটা গোলাপে হাত দিতেই পরী বিস্ময়জনক গলায় বলে,
“ছিঁড়েন না কিন্তু ভুলেও। আপায় যেই! আপনার চুলও ছেঁড়া যাইতে পারে।”
যদিও শ্রাবণের ফুল ছেঁড়ার উদ্দেশ্য ছিলো না। একটু স্পর্শই করতো মাত্র। পরীর বিস্ময়কর সাবধানতাজনিত বাক্যের কারণে ঈষৎ হেসে ছিঁড়েই ফেলে। নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ টানে নিশ্বাসে। চলতে চলতে বলে,
“তাই? দেখি, আমার চুল স্পর্শ করতে পারে কি না কেউ।”
“আপনের তো মেলা সাহস!”
“একা চলতে গেলে দুর্বল হলে তো চলে না, পরী।”
“নতুন বউদের আবার এতো সাহস ভালাও না।”
“একটা ফুলই তো ছিঁড়েছি। এ-ই দোষ ধরা শুরু করলে?”
“দোষ আর কি? আপনে তো আপারে জানেন না। তাই জানাইতাছি।”
‘তোমার আপা একটা অহংকারী মেয়ে৷ ঠিক বললাম, না ভুল?”
“শতভাগ।”
“তোমার আম্মা, কড়া মানুষ। আদর করলেও হয়তো রেগেই করেন। ঠিক?”
“এক্কেবারে।”
“তোমার বড় ভাইজানের মনটা স্বচ্ছ, মাথাটা গরম। কাজকর্ম করে ধীরেসুস্থে এবং অলসতার মাঝেও।”
“একদম।”
“তোমার ছোট ভাইজান দুষ্টু, হাসিখুশি স্বভাবের। আবার উত্তেজিত হতেও সময় নেয় না। আর আমার শ্বশুর আব্বাকে কি ডাকো?”
“কাকা।”
“তোমার কাকা গম্ভীর ও পোক্ত মানুষ। অপ্রকাশ্যে ভেবে হয়তো কাজ করেন বেশি।”
“আপনি তো সবই জানেন তাইলে। ভাইজান আগেই জানাইছে সব?”
“তোমার ভাইজান কিছুই জানায়নি। ওই নিজেকেই যতটুকু প্রকাশ করার, করেছে। বাকিদের ভাবভঙ্গি দেখে আমার ধারণা আরকি। আরও কেউ বাকি আছে পরিবারে?”
“ওইযে, ওইযে। খালিদ ভাইটা। ওইটারে নিয়াও কিছু কইতে পারেন। আঠার মতোই এই পরিবারে লাইজ্ঞা থাকে।”
“কি কারণে লাগে, তা তো জানি না। তবে উনাকে দেখে মনে হলো উনি তদন্তকারক। কে কোথায় কি করলো, ওইদিকে ওনার লক্ষ্য বেশি থাকে। উম্ম… মূলত দোষ খুঁজে বেড়ায় বেশি।”
“হো। এক্কেরে এমনই। আর খালি কাকার কানে কানে খোঁচায়। ওই কাকার আগে পিছে ঘুরে ঘুরে বেতন বোনাস পায়, এইডাই লাইজ্ঞা থাকার উদ্দেশ্য। যেকোনোভাবে কাকার কাছে তার ভালা সাজন চাই!”
মৃদু হেসে শ্রাবণ পশ্চিমে এগোতে থাকে ধীর পায়ে। পরী বলে উঠে,
“আরও একজন আছে তো। তার সম্পর্কেও কিছু বলেন।”
“কে?”
“ওইযে, আমাগো বকুল কাকা।”
পরীর নির্দেশিত দিকে গোয়ালে তাকিয়ে দেখতে পায় একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ। বড় বাজানের বউ দেখছিলো আড়ালে থেকে। পরী বলতেই সে দেখা বাদ দিয়ে ঝটপট কাজে লেগে পড়লো যেন। শ্রাবণ মৃদু হাসলো। গোয়ালের সামনের দিকে মোটামুটিরকম একটা জায়গা ফাঁকা বিস্তর মাঠে নামার জন্য। এপাশেও লোহার গেইট। গোয়ালের মুখোমুখি বিপরীত পাশে পাড় বাঁধাই করা পুকুর। পানি স্বচ্ছ হলেও নিচে শ্যাওলা জমায় সবুজাভ দেখাচ্ছে দূর হতে। বাড়ির বাউন্ডারি পুকুর পর্যন্ত ঘিরে রাখা। সারি সারি তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে পাড়ের ছায়া হয়ে। স্যাঁতসেঁতে আবাদি মাঠে না নেমে পুকুরের পাশটা ঘেঁষেই দাঁড়ায় শ্রাবণ। পরীকে তখনকার জিজ্ঞাসায় এখন বলে,
“বকুল কাকা বোধহয় লাজুক স্বভাবের।”
“আরে না। আস্ত কাইজ্জাখোর।”
“এই পুকুরে মাছ আছে?”
“আছিলো। শখে চাষ করছিলো বিপু ভাইজান। গতবার খাড়া ঢলকে পুকুর ভইরা সব মাছ গেছে ক্ষেতে নাইম্মা। পাড়ার লোকে চিলের লাহান পড়ছে আইয়া।”
“বৃষ্টির বহু তেজ।”
“হো। দেখেন না, ভরো ভরো হইয়া রইছে এহনই। আরে! আপনে তো ওষুধ খান নাই, ভাবি। তাত্তাড়ি যান।”
হাতে গোলাপটা দোলাতে দোলাতেই পরীর সাথে ঘরে উঠতে যায় শ্রাবণ। ব্যাগ কাঁধে মাত্রই বের হচ্ছে অর্পা। গোলাপ দেখেই রাগ হয় তার। থমথমে চোখে তাকায় শ্রাবণের মুখে। মুখোমুখি হওয়ায় শ্রাবণ মিষ্টি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“স্কুলে যাচ্ছো?”
জিজ্ঞাসার জবাব আর কি দিবে। রাগে হনহনিয়ে যেতে থাকে গেইটের দিকে। পারভীন পরীকে পাঠায় রিকশায় তুলে দিয়ে আসতে। শ্রাবণ একা একাই ঘরে আসে। ওষুধ হাতে নিয়ে দেখে সেবন করে। প্রতিবেশী এক দাদী এসেছে ইফতেখারের। চেয়ারম্যানের চাচী হয় সম্পর্কে। পারভীনকে বাইরে থেকে বারান্দায় দেখেই জিজ্ঞেস করে,
“কি গো বউ, তোর পোলায় নাকি বিয়া করছে? দাওয়াতও যেনে করলি না।”
“দাওয়াত দেওয়ার কপাল থাকলে তো দিমু।”
“কামডা করলো কি বুইড়ায়!”
পরীর সাথে তুরতুরিয়ে বারান্দায় উপস্থিত হোন তিনি।
“কই, নাতবউ? কই লুকাইছে?”
পারভীন বলে না কিছুই। পরীই আহ্লাদে টেনে নিয়ে যায় দাদীকে দেখাতে। শ্রাবণকে ওষুধ খেতে দেখে বলে,
“এই বয়সেই ওষুধ খাওয়া ধরছোস গো বুড়ি? বাকি দিন ক্যামনে যাইবো? রোগা বউ আনলো নি নাতি!”
কথার প্রতুত্তর না করে অপরিচিতকে সালাম দেয় শ্রাবণ। দাদী সালামের জবাব দিতেই কথার প্রত্যুত্তর করে পরী।
“বেশি কথা কইয়ো না, দাদী। তুমি যেনে এক্কেরে ওষুধ ছাড়া থাকো!”
”আমি তো বুড়া। নানান রোগে ধরে বুড়াগো। ওষুধ থাকবো বুড়া মাইনষের লাইগা। যোয়ানের এই দশা ক্যা?”
“এহ! যেনে যোয়ানে এক্কেরে বীরকন্যা ছিলা! ভাবির জ্বর হইছে। তাই ওষুধ লাগছে। তোমার লাহান উঠতে বইতে ওষুধ লাগে না।”
“নাতবউয়ের বাড়ি কই?”
“জ্বি, ঢাকায়।”
“ওমাগো! শহরতে ধইরা লইয়া আইছে? সাত্তারগো বাড়িত্তে না আইছে হুনছি? তাগো আবার শহরে আত্মীয় কইত্তে আইলো!”
পরী ঠমকে উঠে,
“ওই, এত্তো কথা তোমার জানা লাগতো না। শহরে হোক আর গ্রামে। নাতবউ পছন্দ হইছে কি না, হেইডা কও।”
“তুই এমন ঠমকাছ ক্যা?”
“তোমার সঙ্গে আমার জন্মান্তরের শত্রুতা যে।”
“খাড়া! তোরে বিদায় করতাছি নাগর ধইরা।”
“নাগরের লগে বাইন্ধা তোমারেই দিয়া দিমু, শালী!”
বুড়ি হাত উঠিয়ে থাপ্পড় দেয় পরীর পিঠে। সরে যায় পরী। শ্রাবণ মৃদু হাসে। বুড়ি শ্রাবণকে দেখে আবার বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পারভীনকে বলে,
“নাতি তো এক্কেরে চান্দের পরী আনছে গো, বউ।”
পাশ থেকে এখানেও পরীর আপত্তি!
“ওই বুড়ি, পরী তো আমি।”
“এই যাহ! তুই ওদিগ যাহ! কতা কইয়ে শান্তি নাই এইডার লাগি!”
পরী চলে আসে শ্রাবণের কাছে। পারভীনের সাথে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায় দাদী। ওদিকে একটু পরেই পরীকে দিয়ে শ্রাবণকে ডাকায় আফজাল হোসেন। শ্রাবণ তার ঘরের দরজার সামনে এসে সালাম দেয়। আফজাল হোসেন তাকে সোফায় বসতে বলে। ছড়ানো পা গুটিয়ে খাটে বসে আছেন তিনি। দৃষ্টি নত রেখে বসে থাকে শ্রাবণ সামনে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পরীও। আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করে,
“জ্বর কমছে?”
“জ্বি।”
“বাড়ি কই?”
“আমার বাড়ি নেই। জন্মস্থান ঢাকায়। নানা ভাড়া থাকতো সেখানে। নানীর কাছেই বড় হয়েছি।”
“আব্বা আম্মা নেই?”
মাথা দুদিকে নাড়ে শ্রাবণ।
“ঢাকার কোন জায়গায় বড় হইছো?”
“কোনাপাড়া।”
“বাপের জেলা?”
“বাবাও ঢাকাতেই থাকতো।”
“সাত্তারের বাড়ি কি?”
“আমার সাথে উনাদের কোনো পরিচয় নেই। মজিদা খালাম্মার কাছে আশ্রয় পেয়েছি গ্রামে কাজের সন্ধানে এসে।”
“এতোদিন ক্যামনে চলতা?”
“একটা এনজিও তে চাকরি করতাম। এখন আরেকটু ভালো অবস্থায় যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
“আমি আমার পোলার কাছে এমনটা কোনোদিন আশা করি নাই। মানসম্মান নিয়া টানাটানির ব্যাপার। বউ যখন হইয়া আইছোই, চাকরি বাকরির জন্য আর দৌড়াইয়ো না। আমার পোলাগোও আমি অন্যের গোলামী খাটতে দেওয়ার ইচ্ছা রাখি না। করলে ব্যাবসা করবো৷ নিজের জমিজমা দিয়া আয় কইরা চলবো। আর তুমি তো বাড়ির বউ পরিচয়েই থাকবা। চাকরি বাকরির দরকার নাই।”
“তবে কি আমারও ব্যবসায় নিয়োজিত হওয়া উচিত?”
দৃষ্টি তুলে চাঞ্চল্যকর জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয় শ্রাবণ। মুখের উপর পাল্টা জিজ্ঞাসা বোধহয় প্রত্যাশা করেননি আফজাল হোসেন। থমথমে মুখখানা গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ দুপুরের মতো স্থির করে রাখেন। শ্রাবণ পুনরায় দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। আফজাল হোসেন বলেন,
“কোনোটাই করবা না। সংসার দেখবা। এইডাই মেয়েলোকের কাজ। নিরাপদ কাজ। ঘরের ঘরনি হওয়া সম্মানের কাজ। পুরুষ থাকতে ঘরের বাইরে নারীর পরিশ্রম দিয়া অতিরিক্ত আয়ের কোনো দরকার পড়ে নাই।”
শ্রাবণ নিরব থাকে। তাকে যাওয়ার অনুমতি দেয় আফজাল হোসেন। যাওয়ার সময় বলেও দেন,
“কারো কাছে পরিচয় বর্ননা দেওয়ার দরকার নাই। কেউ জিগাইলে বাড়ি ঢাকা কইয়া দিবা। এ-ই শেষ।”
শহুরে পুত্রবধূ পেয়ে যে শ্বশুরেরও মন গলা ভাব ব্যক্ত হয়েছে, বুঝতে অসুবিধা হয়না উপস্থিত দুয়ের। শ্রাবণ উঠে চলে যায়। পরীর সাথে আবার এসে আশ্রিত হয় অর্পার ঘরে। পরীকে জিজ্ঞেস করে,
“একমুঠ কালোজিরে এনে দিতে পারবে?”
“কালোজিরা দিয়া কি করবেন?”
“মুখটা তেতো হয়ে আছে। চিবাতাম।”
“তিতা মুখে তিতা চাবাইবেন?”
“তাইতো কালোজিরে দিয়ে এই তেতোকে ঢাকবো।”
পরী ছুটে যায় কালোজিরে নিয়ে আসতে। খাটে বসে পা ঝুলাতে থাকে শ্রাবণ। ভাবনা চেপে আছে মুখাবয়বে। পরী এসে তার হাতে কালোজিরে দিয়ে নিজের মুখেও এক চিমটি পুরে দেয়। শ্রাবণ দাতের চিপে কালোজিরে পিষতে পিষতে বলে,
“পরী, শ্বশুর আব্বার হাতের কনিষ্ঠা আঙুল বোধহয় অর্ধেক কাটা। নাহয় ছোট। আমি কি ভুল দেখলাম?”
“না। ঠিকই দেখছেন। কাইট্টা গেছে।”
“আল্লাহ! কিভাবে হলো এমন? কেউ কেটে দিয়েছে ঝগড়া করে?”
“আরে না। ভাবি যে কি কন! কাকায় যাইবো মারামারি করতো?”
“না, মানে উনি তো রাজনীতিতে জড়িত। পত্রিকায় তো কত হানাহানির ঘটনাতেই এমন দেখা যায়। এজন্য যেন মনে হচ্ছিলো এমন কিছু কি না।”
“নাহ। কাকায় তো মাত্র ছয় বছর ধইরা চেয়ারম্যান পদে হাক দিতে নামছে। এইডা বহু আগে কাইট্টা গেছে আপনাগো শহরের দিকে গিয়াই। রোড এক্সিডেন্ট নাকি হইছিলো একবার, কাকায় যখন ইয়াং বয়সের আছিলো৷ মাত্র নাকি নতুন বিয়া করছে তখন। পরিবারের মাইনষে তো ভাবছে, মইরাই বুঝি গেছে। আল্লাহ বাছাইয়া আনছে।”
“ওহ্! আঙুলটাই কাটা যাওয়ার ছিলো!”
দুঃখ প্রকাশ হলো শ্রাবণের গলায়। পরী জানায়,
“আঙুল খালি? কাকার পায়ে দেহি এত্তোবড় সিলি। পিঠে সিলি।”
“ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়েছে তবে!”
“হো।”
আরেকটু নিরব থেকে কালোজিরে চিবাতে থাকে শ্রাবণ। পরক্ষণে বলে,
“আমি তো কাপড়চোপড় কিছু আনিনি। গোসল করে পরবো কি!”
“হেইডা আমি ক্যামনে কই? ভাইজান বাড়ি থাকতে কইলেন না ব্যবস্থা কইরা যাইতো? আমার তো আর অতিরিক্ত কাপড়চোপড় নাই। আমারটা কি আর আপনে পরবেন? ওয়ারড্রব খুইল্লা দেখেন আপার কোনোটা লাগে কি না আপনের। এই বেডির এত্তো জামাকাপড়।”
“না, না। তোমার আপার সবকিছুতেই নাকি ভাগ বসিয়ে ফেলছি! তারটা আমার হবেও না। তুমি বরং তোমার আম্মার কাছ থেকেই একটা শাড়ি চেয়ে নিয়ো আমার জন্য।”
“ঠিক আছে। দেখমুনে। এট্টু জাম্মুরা খাইবেন? গাছে আছে। নিয়া আসি। শুকনা মরিচ টাইল্লা ভর্তা খাইলে ভাল্লাগবো নে জ্বরমুখে।”
“কত খেয়াল রাখো তুমি আমার। ধন্যবাদ দিতেও কম মনে হয়।”
“কি যে কন, ভাবি। আপনে বসেন৷ আমি ঝটপট নিয়া আইতাছি।”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে ঘুম হতে জেগেই দেখে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ঠান্ডা পেয়ে কড়া ঘুমে জমে গিয়েছিলো শ্রাবণ। অর্পাকে পড়ার জন্য ডাকতেই তার ঘুম ভেঙেছে। হাতমুখ ধুয়ে অবসর কাটাচ্ছে বারান্দায় পায়চারি করে। কুয়াশার মতো হালকা বৃষ্টি তাকে টানছে একটু সিক্ততায় মিশে যেতে। তবুও যাচ্ছে না দেহে এখনো অল্পস্বল্প জ্বর অবশিষ্ট থাকায়। আর কত আশপাশের মানুষগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলবে? তাই কুয়াশা অনুরূপ বৃষ্টিকে না ছুঁয়েই অনুভূতিতে উপলব্ধি করা। পাশের ঘরে হালকা চাপানো দরজায় তাকিয়ে ভেতরে মশারি টানানো দেখতে পাচ্ছে। কেউ ঘুমাচ্ছে। ইফতেখার, নাকি বিপুই কে জানে। গতকাল সকালে যে ইফতেখারকে দেখেছিলো, সারাদিন বাড়ি ফিরেনি। রাতেও ফিরেছে কি না দেখেনি। সে ঘুমানো পর্যন্ত ফিরেনি। দূরে কোথাও গেছে নাকি? মনকেই প্রশ্ন করে শ্রাবণ। পরী এসে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি, নাশতা করবেন না?”
“আম্মাকে জিজ্ঞেস করো তো, আমি কবে থেকে রান্নাবান্নায় হাত দিবো।”
“আপনের তুলতুলে হাত এখনই রান্নাবান্নায় লাগাইয়া খসখসে বানাইয়েন না। আম্মা যতদিন রান্না করতাছে, পরী যতদিন সঙ্গে সঙ্গে থাইক্কা সহযোগিতা করাতছে, ততদিন আপনে তুলতুলে থাকেন।”
“তাই, না?”
“হো। রান্নাবান্না শেষ। নাশতা দিমু কি না কন। ওষুধ খাইতে হইবো কিন্তু আপনের।”
“আমি একটু পরে খাবো। এক কাপ চা হলে মন্দ হতো না।”
“ঘরে আদা চা সবসময় ডেক ভরা থাকে। আপনে আধা মিনিট খাড়ান। আমি এক মিনিটের মধ্যে আইতাছি।”
স্মিত হেসে পায়চারি করতে থাকে শ্রাবণ। পরী কিছুক্ষণের মধ্যেই চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয়।
“গরম করতে একটু দেরি হইছে, ভাবি।”
“ধন্যবাদ, এক মিনিটের মধ্যে চা নিয়ে আসার জন্য।”
“আম্মার এই শাড়িটায় আপনারে কত্ত মানাইছে, আপনে কি তা জানেন ভাবি?”
“তুমি এইবার নিয়ে কতবার বললে এই কথা?”
“তা তো জানি না। কিন্তু যতই দেখি, অনেক ভাল্লাগে আপনারে দেখতে। খালি দেখতেই মন চায় চোখের সামনে বসায় রাইক্ষা।”
চুমুক দেওয়া মুখের চা ফিক করে হেসে ফেলে দেয় শ্রাবণ। হেসে নেয় একটু ইচ্ছেমতো।
“এই কথা তোমার ভাইজান বললে না ভালো হতো।”
“ভাইজানের টা ভাইজান কইবো নে। আমারটা আমি কইয়া সারলাম।”
“বেশ ভালো পাম দিতে জানো তুমি।”
“ধুরু ধুরু। সত্যি কথা কইছি। যাই, থালাবাটি গুলা মাজলেই আমার কাজকাম শেষ। আম্মায় আবার রাইজ্ঞা উঠবো নে। চা খাওয়া হইলে ডাক দিয়েন। কাপ নিয়া যামু নে।”
পরী রান্নাঘরে ফিরতেই পারভীন কতক্ষণ শাসালো। বড্ড পাকামো করে সে। তুলতুলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কথা শুনেছে বিধায়ই এই শাসানো। কে বলেছে তাকে আগ বাড়িয়ে মাতব্বরি করতে? শ্রাবণ এদিকে মনযোগ দেয় প্রকৃতির ঘ্রাণে। প্রাণ হারায় কিছু উচ্ছ্বাসে। শ্বশুর বাড়িতে নতুন নতুন সময়, মন্দ যাচ্ছে না তার। এরই মাঝে যুক্ত হয় ইফতেখারের ঘ্রাণ। মোটরসাইকেলে চড়ে খালিদকে পিছু বসিয়ে বাড়ি ফিরেছে সে। শ্রাবণ তো ভেবেছিলো ঘুমাচ্ছেই বুঝি। ওদিকে খালিদ ও ইফতেখার দুজনেই বারান্দায় ঠাঁই নিতে নিতে দেখেছে তাকে। আবারও সেই সন্ধ্যার কথা মনে হয়ে যায় খালিদের৷ যতবারই মনে হয়, ততবারই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে যেন! বিপুকে নিয়ে খালিদের প্রথম সন্দেহ কান্তার উপর হয়েছিলো যদিও। ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে বিশেষ খেয়াল দিতেই শ্রাবণকে পড়ে যায় চোখে। আর দ্বিধাহীনভাবে বুঝতে পারে তুলনামূলক বেশি রূপবতী এই শ্রাবণের সাথেই তার ভাব করে দিতে কান্তাকে ঝেকে ধরেছিলো বুঝি বিপু। মাঝপথে বড্ড বেঁকে গেলো পথ! ইফতি এটা কি করলো! তাকে নিয়ে এমন কিছু একদমই অকল্পনীয় ছিলো। এই অকল্পিত কাহিনীর হতবিহ্বলতা নিয়েই মামার ঘরে প্রবেশ করে সে অনুমতি নিয়ে। ইফতেখার দুহাতে মাথার চুলের উপরিভাগ ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে শ্রাবণের দিকে। বাইরের কুয়াশা তুল্য হালকা বৃষ্টি মাথায় বসেছে কুয়াশার মতো করেই। এইযে, হাতে চুলের উপরিভাগ ঝেরে ফেলা কি অপূর্ব লাগছিলো! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তা-ই উপভোগ করছিলো শ্রাবণ। ইফতেখারের দৃষ্টিদ্বয় উপভোগ করছে শাড়ি পরহিত নারী রূপকে। একদম অন্যরকম লাগছে শ্রাবণকে। কপালে হাতের পিঠ ঠেকিয়েই বললো,
“সুস্থ হয়েছো মনে হয়?”
অধরে স্মিত হাসি এলিয়ে শ্রাবণ কাপে দৃষ্টি রেখে চা টুকু কাপের মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে পাক তুলে বলে,
“পরীর কথায় মানহানি হয়েছে বুঝি?”
“ওর কথায় আবার কিসের মানহানি। আমার ইচ্ছে হয়েছে, ডেকেছি।”
চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁট কার্ণিশে হাসি রেখে চোখে চোখ তোলে শ্রাবণ। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“এটা মায়ের শাড়ি?”
“হুম। আপনাকে দেখানোর উদ্দেশ্যে শাড়িটা বাছাই করে পরা অথচ আপনার খোঁজ নেই। কোথায় থাকেন আপনি? মনে হচ্ছে কত বছর হয়, আপনাকে দেখি না।”
পকেট থেকে টাকা, ফোন, চাবি বের করতে করতে ইফতেখার জবাব দেয়,
“আমি তো সকালেও তোমাকে দেখে গেলাম। ঘুমাচ্ছিলে।”
“কিন্তু আমি তো রাতেও আপনাকে দেখলাম না৷”
“রাত এক’টায় ফিরেছি।”
“এতো রাতে কেন?”
“ঘুরতে গিয়েছিলাম ঘোড়াশাল। ফিরতে দেরি।”
“ইশ! কত আনন্দ যাচ্ছে আপনার। আজ কিন্তু শ্রাবণেরই দিন। অথচ শ্রাবণকে রেখেই আপনি শ্রাবণধারায় ভিজে এলেন।”
কথা বুঝতে একটু সময় লাগে ইফতেখারের। বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টির দিকে দেখে আবার তাকে দেখে। জিজ্ঞেস করে,
“আজ হতে শ্রাবণ মাস?”
“বাঙালি মানুষ বাংলা দিনক্ষণের খবর রাখে না।”
হাসিতে ঠোঁট রাঙিয়ে প্রত্যুত্তর করে শ্রাবণ। ইফতেখার আবারও বাইরে দেখে। পুনরায় শ্রাবণকেও দেখে। ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলে,
“কিন্তু উভয় শ্রাবণই আজ নয়নাভিরাম।”
প্রশংসায় মুখের হাসি প্রশস্ত করে শ্রাবণ। খালি কাপটা নিয়ে যায় রান্নাঘরে। নিজ হাতে ধুয়ে রেখে আসে। ইফতেখারও রান্নাঘরের দরজায় এসে পরীকে বলে যায় দ্রুত নাশতা দিতে। পরী থালাবাটি ধুয়ে যাচ্ছিলো। শ্বাশুড়ি গেছে শ্বশুরের নাশতা নিয়ে। পরী উঠতে গেলেই শ্রাবণ বাঁধা দিয়ে বলে,
“আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ধীরে সুস্থে কাজ করো।”
শ্রাবণ নিজ হাতে প্লেটে রুটি সবজি তুলে নিয়ে যায় ইফতেখারের জন্য। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“এই ঘরে খাবেন? নাকি অর্পার ঘরে?”
বিপু ঘুমাচ্ছে তাই অর্পার ঘরেই চলে যায় ইফতেখার। অর্পা স্কুলের জন্য গোছগাছ করছিলো। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“পরীক্ষা?”
“হু। আমাকে দিয়ে আসবা স্কুলে।”
প্রত্যুত্তর করে না ইফতেখার। খাটের এক কোণে বসে প্লেট সামনে নিয়ে খেতে শুরু করে। তার খাওয়ার তাড়া দেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“এতো তাড়াহুড়ো কেন? কোথাও যাবেন নাকি?”
“ঘুমাবো। ভালো ঘুম হয়নি রাতে৷ ভোরেই উঠে দৌড়াতে হয়েছে রাস্তা দেখার জন্য।”
“কাজ হয়ে গেছে?”
“অনেকটা।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই হঠাৎ স্টিলের কিছু পাকা মেঝেতে আছড়ে পড়ার শব্দ ভেসে আসে বাইরে থেকে। কানে ঝিম ধরে যায় এই ঘরের প্রত্যেকেরই। পরক্ষণে আরও দুইবার বাজে। প্রথমটা অজ্ঞাত ঘটনাক্রমে মনে হলেও পরের বার বুঝতে অসুবিধা হয় না ইচ্ছাকৃত আওয়াজ তোলা হচ্ছে। ইফতেখার খেতে বসে বিরক্তিকর শব্দ করতেই শ্রাবণ বেরিয়ে বারান্দায় আসে। দেখে হাতে স্টিলের বাটি নিয়ে ভাইজানদের ঘরে উঁকি দিচ্ছে পরী। যেখানে বিপু ঘুমাচ্ছে। ওদিকে পারভীনের কণ্ঠে ধমকও ভেসে আসছে। শ্রাবণ তাকে জিজ্ঞেস করে,
“কি ব্যাপার? এমন শব্দ করছো কেন?”
পরী এদিকে ফিরে ফিসফিস করে,
“ছোড ভাইজানরে ঘুম থেকে তুলতাছি ভাবি। সেই কোন সন্ধ্যা রাইতে ঘুমাইছে, দশটা বাইজ্জা যাইতাছে। ওঠে না। আম্মায় ডাকতে কইলো। কিন্তু আমি তো জানি, এই বাড়ির নবাবগো ঘুম এমনি এমনি ভাঙে না। তাই এইসব কৌশল আমার ধরতে হয়।”
কথা শেষ করতে দেরি। হাতের বাটিতে টান পড়তে দেরি হয়নি। ঠাস করে মেরে বসেছে পরীর মাথায়। মাথায় হাত দিয়ে চিৎকার তুলে এক দৌড়ে উঠুনে নেমে গেছে পরী।
“আল্লাহ গো…!”
দরজার সামনে সদ্য ঘুম ভাঙা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাটি হাতে তাকিয়ে আছে বিপু। পরীও মুখটাকে ব্যাঙাচি করে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ দুয়ের কাণ্ডেই হতবাক! বিপু এদিকে ফিরে শ্রাবণকেও দেখতে পায়। পরক্ষণে বাটি হাতে আবার ঘরে চলে যায়। পরী মাথায় হাত ঘঁষতে ঘঁষতে এগিয়ে আসে ধীর পায়ে। শ্রাবণ তাকে বলে,
“কাজটা তোমার একদম উচিত হয়নি পরী। আমি সজাগ আছি, আমার মাথাটা পর্যন্ত ঝিম ধরে গেছে। আর সেখানে বিপু ভাই তো ঘুমাচ্ছিলোই। তোমার বড় ভাইজানও বিরক্ত হয়েছে। অর্পাও বিরক্ত। এমন তীক্ষ্ণ একটা শব্দ কানে কতটা ক্ষতি করে, জানো তুমি?”
“আপনি দেখছেন, ক্যামনে মারলো? আমার মাথাটাও ঝিম ধইরা গেছে।”
“তোমার দোষে মেরেছে।”
“হো, দোষ খালি আমারই। উপকার করলেও দোষী হই।”
“এমন উপকার করলে দোষী হতেই হবে। তাই আর এমন করো না।”
ঘরের ভেতর হতে অর্পাও পরীর প্রত্যুত্তরে বলে,
“তুই আমার হাতেও মাইর খাবি এখন। ভাইয়ের দেওয়া মাইরে কম হয়ে গেছে তোর।”
“হো, সবাই মিল্লা মারেন। মারবেনই তো। কিছু কইতাম না।”
শ্রাবণ ফিরে তাকায় ঘরের ভেতর অর্পার দিকে।
“তোমাদের মধ্যে বয়সে কে বড়, অর্পা?”
“বয়সে বড় যে-ই হোক, অপরাধটা তো দেখবা কার বড়।”
“অবশ্যই এখানে পরীর অপরাধ। কিন্তু বড় কে?”
“পরী বড়।”
“অথচ দেখো, পরী তোমায় আপা বলে ডাকে। ‘আপনি’ সম্বোধনে সম্মান করে। আর সে তোমার থেকে কয়েক বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও তুমি তাকে নাম ধরে ডাকো, তুইতোকারি করো। এটা আদৌও কোনো ভদ্রতার পরিচয় বহন করে না। কাজের জন্য সে এখানে আছে, তাই কাজের ফরমায়েশ দিবে ঠিক আছে। বড় হিসেবে একটা ভালো সম্বোধন তো করতে পারো অন্তত। এই ধরো, তুমি পড়াশোনা করে শিখছো কিছু। সেই প্রেক্ষিতেই।”
কথা বলে না অর্পা। কিন্তু ভ্রু মাঝে বিরক্তি ভাব আনে ঠিকই। মনযোগ দেয় একটু বই রিভিশনে। এই ঢংগী মেয়ে যে ভদ্র হবে না, মনে মনে তা ভেবেই ভেঙচি কেটে চলে যায় পরী। খেতে থাকলেও কথা সবই কানে যাচ্ছিলো ইফতেখারের। শ্রাবণ দরজার পাশ থেকে ইফতেখারের কাছে এগোয়। হাতের রুটিটা খেলেই খাওয়া শেষ। প্লেট খালি দেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“রুটি খাবেন আরও? নিয়ে আসবো?”
“না।”
“ছোট ছোট ভুল থেকেই কিন্তু বড় ভুলের সৃষ্টি হয়। এই ছোটখাটো বিষয়গুলো আপনারা বড়রা ঠিক করে দিতে না পারলে ছোটরা ঠিক হবে কিভাবে? এই যে, অর্পা ভাবছে হয়তো ভাবি তাকে অপমান করলো। কিন্তু আমি যে একটা ভুল ধরিয়ে দিচ্ছি, এটা মানতে তার কষ্ট হবে।”
ইফতেখার রুটি শেষ করে পানি পান করে প্লেটে হাত ধুয়ে নেয়। শ্রাবণ প্লেট হাতে তুলে নিয়েছে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ইফতেখার অর্পাকে তখন বললো,
“চলো, নামিয়ে দিয়ে আসি। পরী কিন্তু তোমায় অনেক আদর করে। ওকে আপু বলে ডাকতেই পারো। সে তো এক হিসেবে আমাদের মামাতো বোনই হয়। তাই না?”
ভাই ভাবি মিলে বললো, অর্পার মুখমণ্ডল থমথমে হয়ে রইলো। বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উঠে চলে গেছে বারান্দায়। বাবামায়ের কাছে বলে নিচ্ছে যাওয়ার আগে। শ্রাবণ আর ইফতেখার একত্রেই বেরিয়েছে বিপুর ঘর পর্যন্ত। ইফতেখার মোটরসাইকেলের চাবি নিয়েই আবার চলে যাচ্ছে। শ্রাবণ দাঁড়ায় এখানে।
“বিপু ভাই, বাটিটা দিন।”
বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে বিপু বাটি এগিয়ে দেওয়ার। ওদিক হতে কানে ভাসে অর্পার গলা। মোটরসাইকেলে উঠতে উঠতেই ভাইকে নিচু গলায় বলছে,
“ভাইয়া, ভাবিকে ফুল ছিঁড়তে নিষেধ করো। অকারণেই ছিঁড়ে ফেলে। একটা ফুলও আমার শান্তিতে ফুটতে পারছে না কারো জন্য।”
“ভাবি ছিঁড়েছে ফুল?”
“কালকেই তো ছিঁড়লো।”
“এতো কিপ্টেমি করতে নেই৷ মাঝে মাঝে কিছু শখ আহ্লাদ পূরণের পিছু ছেড়ে দিতে হয়। সেই তো ঝরে পড়েই যাবে।”
“এহ!”
খুবই অসন্তোষ হলো অর্পা। মোটরসাইকেল চেয়ারম্যান বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শ্রাবণ মৃদু হাসছে অর্পার নালিশ প্রয়োগের উপর। বিপু বাটি হাতে বেরিয়ে বলে,
“খুব খুশি আছেন বুঝি, ভাবি।”
শ্রাবণ বাটি হাতে নিয়ে প্রত্যুত্তর করে,
“সম্বোধনের আগে ক্ষমা চাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু।”
“ওহ্, স্যরি। ভুলে গিয়েছিলাম। আবারও স্যরি।”
“ওকে। অর্পা তার ভাইয়ের কাছে বিচার দিচ্ছে ফুল ছিঁড়েছি বলে। তাই হাসছি।”
“আবার ফুল ছিঁড়েছেন!”
“আমি তো একবারই ছিঁড়লাম।”
“সেদিন অর্পার গাছের প্রথম ফুলটাই ভাই আপনার জন্য পাঠিয়েছিলো। আর সব হাত করতে হয়েছে আমাকে। এই মেয়ে ফুল পাগল। একটা ধরতে দিবে না কাউকে।”
“তা-ও ভালো। ফুলকে পছন্দ করা মানুষদের আমিও পছন্দ করি। কিন্তু আপনি বড় অপছন্দের কাজ করলেন, ভাই।”
“আমি আবার কি করলাম?”
“পরীর মাথায় যেই আঘাতটা দিয়েছেন, এতে তার সাথে মন্দ কিছুও ঘটে যেতে পারতো।”
“আমি তো এতো জোরে আঘাত করিনি। এইটা বড্ড শয়তান। কোনো ভালো উপায়ে তাকে কাজ করতে দেখবেন না। যত শয়তানি চিন্তাভাবনা নিয়ে ঘুরঘুর করে।”
“আপনি তো ভালো। তাই আপনার জন্য এটা অনুচিত হয়েছে। একটা হালকা আঘাতেও অনেক সময় মানুষের স্ট্রোক হয়ে যায়। আপনি যথেষ্ট জোরে আঘাত করেছেন। ব্যাথা অবশ্যই পেয়েছে। আল্লাহ না করুক, সে যদি এখন কোনোভাবে তেমন কোনো পরিস্থিতিতে পড়ে যেতো, আপনি কি করতেন তখন? এই ছোটখাটো দুর্ঘটনাই যদি বড় কিছুর সৃষ্টি করে ফেলে, আপনি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? এজন্য করতে হলে সাধারণ কিছুও গভীরে ভেবে করা উচিত আমাদের। আর নয়তো ছেড়ে দেওয়াই ভালো।”
শ্রাবণ থালাবাটি নিয়ে পা বাড়িয়েছে রান্নাঘরের দিকে। বিপু চুপ রয়েছে অতিরিক্ত কথা না বলে। কথার যৌক্তিকতা নিজের অপরাধ স্পষ্ট করতে চাইছে যেন। শ্রাবণ পরীকে পাঠিয়েছে বিপুর খাবার দিয়ে যেতে। পরী অনিচ্ছুক হলেও শ্রাবণকে মানতে বাধ্য হয়েছে। নাশতা করেই ওষুধ সেবন করেছে শ্রাবণ। বারবার বাইরে দেখছে। বারান্দায় হাঁটছে। একটু মজিদা খালাম্মার বাড়ি যাওয়া দরকার। তার সাথে বহন করা সম্পদ উনার ঘরে পড়ে আছে সব। ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু ঝিরিঝিরি বৃষ্টির বেগ কিছুটা বেড়ে এসেছে। এমনি ইফতেখার ফিরেছে। পিছু রাখা একটা চারাগাছ। মোটরসাইকেল বাইরে রেখে চারাগাছটি বারান্দায় এনে রেখেছে সে। শ্রাবণ কিছুটা দূর হতেই দেখতে পায় তিনটি শ্রভ্র বেলী ফুটে আছে ছোট্ট গাছটাতে। ইফতেখার এগিয়ে এলেই বলে,
“আপনি তো ভিজে গেছেন পুরো। রেইনকোট ব্যবহার করতে পারেন না?”
“কিনতে হবে।”
আধ ভেজা শার্ট খুলে বারান্দায় নেড়ে দেয় ইফতেখার। ঘরে যেতে যেতে বলে,
“অর্পার গাছের ফুল ছিঁড়ো না। তার কষ্ট হয়। এটা তোমার বেলী গাছ। ফুল ফুটলেই ইচ্ছেমতো ছিঁড়ে নিয়ো। নিজের বাড়ি হওয়ার পর কিনবে ঠিক করেছিলে না? ভালো একটা দেখতেই নিয়ে এলাম। যেখানে ইচ্ছে, লাগিয়ে দিয়ো।”
ঠোঁটে হাসি রাঙিয়ে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ। মন বলে,
“আমার তো এখন ইচ্ছে করছে আপনার মন জমিনে এই গাছটি রোপন করতে। শখ রাখতে না জানলেও শখের খেয়াল আপনি খুব রাখেন, আমার শখপ্রাণ মহাশয়! কিন্তু, এটা কি আমার বাড়ি?”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
কালো রঙের ছাতা হাতে হনহন পায়ে হাঁটছে কান্তা। পরনে কালো বোরকা হিজাব। পায়ের জুতোটাও কালো। রাস্তায় নতুন পিচ ঢালাইয়ের রংটাও ঝকঝকে কালো। বাজারের সীমানার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতেই আকস্মিক বিপুর উপস্থিতি। চলতে গিয়ে এতোক্ষণ দেখেনি। কিন্তু দূর হতে যে তার দিকে চোখদুটো গেঁথে রেখেছিলো, তা বেশ বুঝতে পারছে হঠাৎ পথের সঙ্গী হওয়ায়। নিজ হাতের ছাতাটা কান্তার ছাতায় ধাক্কা দেয়। কথা বলে না কান্তা। বিপুই শুরু করে,
“র‍্যাব বাহিনীর মতো দৌড়াস কেন?”
কান্তার পায়ের গতি যেন আরেকটু বেড়ে যেতে চাইছে তার কথায়। বিপু সমান তালে হাঁটে।
“তোর আব্বার ছাতা নিয়ে বের হইলি? বুড়া ছাতা কিশোরীর মাথায় তুলতে আছে? আমারটা নিয়ে যা। রঙিন চকচকে ছাতা।”
বিরক্ত লাগছে কান্তার। তবুও থামে না বিপু।
“মাথা থেকে পায়ের জুতাটা পর্যন্ত কালো। কেমন দেখা যাচ্ছে তোকে, জানিস? পুরাই কোকিল। তুই মানুষটাও তো কালো। শুধু চোখটা লাল।”
এখন তারা কবিরাজ বাড়ির সংলগ্ন আছে। আর তা খেয়াল করতেই বিপু মন্তব্য করে,
“ও, শ্বশুর বাড়ির পথ বলে এমন দেমাগে আমায় উপেক্ষা করে হাঁটছিস?”
“শ্বশুর বাড়ি” শব্দটা শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই সাথে সাথে থেমে যায় কান্তা। চোখ পাকিয়ে ফিরে তাকায় বিপুর দিকে। ক্রোধের ব্যাথায় ফাটছে সে। বিপুর হৃদয়ে যেন এই ব্যাথারা স্পর্শ করে যায় আলতো করে। কত অভিমান আর অনুরাগ জমা এই চোখে। ব্যাথা অনুভবের পরও মিথ্যে হাসি ফুটিয়ে বিপু বলে,
“ওই যে, তোর চোখ লাল। আমি একদম মিথ্যে বলিনি।”
“আমার সাথে কি? আর এক পা-ও হাঁটবেন না।”
চোখ ভিজে উঠতে দেখা যাচ্ছে। কথায় সে কি ধার! বিপু প্রত্যুত্তরহীন তাকিয়ে থাকে। কান্তা আবার হাঁটতে শুরু করলে সে-ও হাঁটতে শুরু করে। একদম পাত্তা দেয় না কান্তার নিষেধাজ্ঞা। এই কোকিল আজ কতদিন হয় তার সাথে কোকিলা কণ্ঠে কথা বলে না। একটু সুখ দুঃখের ভার ব্যক্ত করতে চায় না। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি আর মায়া জড়ানো কণ্ঠে দুটো আবদার করে না। কেন যে মনে বজ্রমেঘ আসে, বুঝেই না। কান্তা একটু সামনে গিয়েই আবার থেমে তার দিকে তাকায়।
“নিষেধ করলাম না সাথে হাঁটতে?”
“আমার পায়ে আমি হাঁটি, তোর কি?”
“তো হাঁটেন।”
“তোর ছায়ার সঙ্গী হয়ে হাঁটবো।”
“আমার ছায়ার সঙ্গী আপনাকে হতে দিবো না।”
“এমন কেন করিস? আমি কি করলাম? আমার দোষটা কি?”
“আপনার কোনো দোষ না। দোষ আমার। কোনো মায়ায় জড়ানোটাই আমার চরম দোষের। কেন আপনি আমায় ডাকলেন, কেন আমি শুনলাম, আর কেন ই বা দিনের পর দিন জ্বালাতন করছেন?”
“আমি কি জ্বালাতন করলাম? বিয়ে ঠিক করছে তোর আব্বা আম্মা।”
“বেশ তো। আপনি কিছুই করেন নাই। আপনার কিছু করতেও হবে না। আমার পিছুও নিবেন না।”
“তাইতো সঙ্গে সঙ্গে চলছি।”
“অসহ্য লাগছে!”
চোখের কোণের ব্যাথা চলতে চলতে হাতে মুছে নেয় কান্তা। বিপু পথে দৃষ্টি বুলায়। বৃষ্টি দেখে। বলে,
“বিয়ে হবে না। চিন্তা করিস না। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
গলায় জমা অভিমানী সুরে কান্তার প্রত্যুত্তর আসে,
“কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না।”
“ওই বুড়াকে পছন্দ হয়ে গেছে বুঝি?”
“আপনি জানেন, সে বুড়া নাকি?”
“আমার চেয়ে তো বুড়া।”
“ফাজলামো করবেন না। যান। নয়তো আমিই কলেজ না গিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো।”
“বাদাম খাবি?”
“আমি কি বলেছি, বাদাম খাবো?”
“তাইতো জিজ্ঞেস করছি। সাপের মতো ফোসফোস না করে একটু কোকিলের মতো গানও ধরতে পারিস। আমার নরম মনটাই তো তোকে দিয়ে দিয়েছি বিনামূল্যে৷ সেখানে এমন খাঁচকাটা গলায় কেন আঘাত করছিস?”
“আমার কারো মন লাগবে না।”
“আমার লাগবে।”
“কালো মানুষের মনও কালো হয়।”
“ও বাবা! আবার এইটাতেও ধার ধরে গেলি! মানে তোর সাথে কিছুই বলা যাবে না যেন।”
“যাবেই না।”
“আমি পিছু ফিরে গেলে সুখে থাকতে পারবি?”
ঘাড় ঘুরিয়ে অভিমানী চোখে বিপুর পানে তাকায় কান্তা। এই ছেলেটাকে পাবে না ভাবতেই তার কান্না এসে যায়। কিভাবে যে তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফেলেছিলো বছরখানেক আগে, বুঝতেই পারেনি। অথচ ছোটকালে কত খেলাধুলা করতো, বিপুর হাতে মাইরও খেতো। ঝগড়াও করতো। বড় বলে পাল্টা মাইর দিতে পারেনি যদিও, তবে বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে নালিশটুকু করে দিতো। অথচ এখনো ঝগড়া হয়, কিন্তু মারামারি আর নালিশের প্রয়োগ ধারা বদলে গেছে। তার বিরুদ্ধে নালিশ তার কাছেই দিতে হয়। কি অদ্ভুত! তাকে না দেখার ব্যাথাও নিজের মধ্যে গেঁথে নিতে হয়। বিপু তার অভিমানে ডুবি অক্ষিতারকায় তাকিয়ে মৃদু হাসে। চলতে চলতে বলে,
“ভাইয়ের বিয়েটা হয়ে গেছে। এবার আমারও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একটু চাপিয়ে চল পরিবারে। প্রকাশ করে দে ঠিকভাবে। অন্তত একটা দিক ঠিক হলেই সাহসটা করে উঠতে পারি।”
“প্রকাশ আর কি করবো? আব্বা আম্মা আগে থেকেই সাবধান করছে বারবার। আপনার উঁকিঝুঁকি দেখে না বুঝি?”
“আমার উঁকিঝুঁকিতে তো কাজ হবে না। তোকে স্পষ্ট বলতে হবে। এখন সেটা কি আমি গিয়ে করতে পারবো? তোর পরিবার, তুই ম্যানেজ করবি। আমি গেলে তো আমাকে ডান্ডা খেয়ে আসতে হবে।”
“আমার সাহসে কুলায় না। আপনিই প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।”
“মগের মুল্লুক! আমার আব্বা আম্মা যাবে তোর বাড়ি প্রস্তাব নিয়ে?”
“তো আপনি আসছিলেন কেন?”
“বয়সের নেশায় মাতাল হয়ে। এখন আমার আব্বা আম্মার তো সেই বয়স নাই। তুই তোর পরিবার ম্যানেজ কর। যুদ্ধ করা লাগলে তা-ও কর। তোর দিকটা অন্তত তুই ঠিক করতে পারলে ভাবির মতো তোকেও হুট করে ঘরে তুলে নাহয় আমার পরিবারকে ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। জায়গা না দিলেও সমস্যা নাই। তোর বাড়িতে তো তখন জায়গা হবে অন্তত।”
গোমড়া মুখে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় কান্তা। বিপু ঠোঁট কার্ণিশে হাসি ধরে। তাতেও যদি একটু হাসতো মেয়েটা! এই হাসির নাটকটুকুও নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারে না দুশ্চিন্তার চাপে। সবই বুঝে সে। বুঝে বলেই তো নিজের করে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টার উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। পকেট থেকে বাদামের প্যাকেট বের করে দেয় বিপু। কান্তা হাতে নেয় না। উপেক্ষা করতে চায়,
“কি এটা? আমি নিবো না কিছু।”
“ধর!”
ছাতায় ছাতা ধাক্কা দেয় আবারও। কান্তা পথ চলা থেমে বলে,
“ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে আমার ভয় হয়। কান্না আসে। আপনি কিছু দিতে চাইলেই আমার কান্না বাড়ে।”
“কান্না থামলেই খেয়ে নিবি। টেনশনে শুকিয়ে গেছিস একদম। খাওয়াদাওয়া বেশি বেশি করিস।”
হাতের মুঠোয় প্যাকেট নেয় কান্তা। তার চোখ এখনো ভিজে আছে। আবার মোছে।
“আপনি মেয়ে মানুষের দিকে তাকাবেন না এভাবে।”
“কিভাবে?”
“কে শুকালো, কে মোটা হলো!”
“মেয়ে মানুষের দিকে তাকালাম কই? তোকে দেখলাম।”
“আমি কি মেয়ে না?”
বিপু হাসে৷
“তোর দিকে তাকালেই কি?”
“আমি এখনো আপনার কেউ না।”
“কেউ-ই না?”
“না।”
“আচ্ছা।”
এক খন্ড ভারি নিশ্বাস ছাড়ে বিপু। কলেজের কাছাকাছি এসে গেছে। বিদায় নিতে চায় এবার।
“আমি যাই। ছাতা নিবি?”
“আমি বলেছি নিবো? গরিবের ঘরে জন্মাতে লজ্জা হয়নি। গরিবের ছাতা মাথায় ধরতেও লজ্জা নাই।”
“বেশি কথা বলিস, এজন্যই ভাল্লাগে না। ছাতায় কি ধনী গরিব লেখা আছে?”
“রঙে তাকালেই তো দেখা যায়।”
“হয়েছে, পন্ডিত। চুপ! তোর নিতে হবে না ছাতা। আর, টেনশন করিস না। ভাবির সাথে কথা বলতে হবে। দেখি কি হয়। বাড়িতে জিজ্ঞেস করলে লুকোচুরি না করে স্পষ্ট বলে দিবি। আর আমায় দেখলে ভদ্রলোকের মতো সালাম দিবি, হুজুরাইন। তুই নিজেই সম্মান দেস না, তোর পরিবার আর কি দিবো!”
“এহ! রাস্তাঘাটে মারামারি করে আসে সম্মান চাইতে।”
বিড়বিড় করে সে সামনে এগিয়ে গেলেও বিপু পিছু ফিরে যায়। প্রত্যুত্তর করে না তার বিড়বিড়ের। ভাবতে থাকে তাদের যোগসূত্র নিয়েই। কিভাবে যে তার পূর্ণতার যোগান দিবে, ভেবেই পায় না উপায়। কেন কান্তা শ্রাবণের মতোই কোনো আগন্তুক হয়ে এলো না তার জীবনে? কেন পরিচিতের সীমানায় তারা মন বিনিময় করে বসলো?

বিকেলে দালানের পূর্ব পাশের বাউন্ডারি ঘেঁষে বারান্দা সংলগ্ন বেলীফুলের গাছটি লাগিয়েছে ইফতেখার। রাস্তা হতে বাড়িতে প্রবেশ করলেই দক্ষিণ পাশে যেমন টিন কাঠের ঘরের সামনে দুইটা গোলাপ গাছ চোখে পড়ার মতো, তেমনই উত্তরের দিকে এই বেলী গাছটিও চোখে পড়ার মতো। শ্রাবণ আজও গোসলের পর শাড়ি পরেছে৷ নিজের কাপড়চোপড় না শুকানোর কারণে শ্বাশুড়ির আরেকটা শাড়ি সে গছিয়ে নিয়েছে নিজের করে। এটাতেও দারুণ লাগছে। যৌবনকালে যেমন রূপের লাবন্য পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, শাড়িও বুঝি এই যৌবনেই নারীতে অধিক শোভা পায়। তা-ই তো দেখাচ্ছে। আজ শ্রাবণের দিন তাই শ্রাবণকেই একটু সময় দিতে ইচ্ছে করছে ইফতেখারের। কাজের ব্যস্ততা চাপিয়ে দিয়ে সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব করে। শ্রাবণ জানতে চায়,
“কোথায়?”
“শ্রাবণ দিনে একটু এলোমেলো হাওয়ায়।”
ইফতেখারের সঙ্গে এলোমেলো হাওয়ায় ভাসতে মোটরসাইকেলে চড়ে বেরিয়ে গেছে শ্রাবণ। কিছু অব্যক্ত কথার সুর, পিছু নিয়েছে তাদের। কিছু ত্যক্ত জীবন মূহুর্ত ছুঁতে চাইছে তাদের। কিন্তু অবর্ণনীয় এক সায়রের প্রেমমায়া সঙ্গী হয়ে গেছে ততোক্ষণে। পিছু ফিরতে অনিচ্ছুক, ত্যক্ততার স্পর্শ পেতে অনীহা। মুহূর্ত বড় প্রিয়। আরও প্রিয়, মুহুর্তকে প্রাধান্য দেওয়া প্রহর। হঠাৎ বৃষ্টির মতো যুগল জীবনের প্রণয়োচ্ছ্বাসের সৃষ্টি এই প্রহরে। প্রণয়ের গুনগুন প্রবাহিত হয় বাতাসে বাতাসে। এই বাতাস বড় সুখকর। সুখকে গভীর উপলব্ধি করতে শখপ্রাণের পিঠে মাথা হেলিয়ে দেয় সুখপ্রিয়া। ইফতেখারের সেদিনকে মনে হতেই জিজ্ঞেস করে,
“খারাপ লাগছে?”
“উহুম।”
“কি খাবে?”
“শহরের পথে বের হলে বলতাম ফুচকার কথা। এখানে কি খাওয়া যায়?”
“বাজারে ফুচকা আছে তো। খাবে?”
“চলুন তবে।”
ছোট ছোট ঝাল ফুচকায় সন্ধ্যাটা আরও জমে উঠেছে দুয়ের। পরক্ষণে কিছু সময় কাটিয়ে এসেছে তাদের প্রথম গল্প জমানো স্থান বালুর মাঠে। এই জায়গাটা অকারণেই একটু বেশি ভালো লাগে শ্রাবণের। কারণ খুঁজতে গেলে হয়তোবা প্রকৃতির স্পর্শমায়াই বেশি প্রস্ফুটিত হবে। তবে ভালো লাগে। সে আশপাশের পরিবেশ নিয়েই গল্প করতে থাকে ইফতেখারের সাথে। কিন্তু আজ এই যুগলতারা এখানে হেলেনা পাগলের সামনে পড়ে গেলো। কাঁধে কয়েকটি লাঠির খুঁটি নিয়ে বাজারে দোকান হতে দুইটা বোতল কুড়িয়ে এসেছে এদিকেই। ইফতেখারকে দেখেই তাদের কাছে এগিয়ে আসে,
“এই ছ্যাড়া, তুই না বিয়া করছত? দাওয়াত দেছ নাই ক্যা?”
শ্রাবণ একটু অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে দেখে হেলেনার বেশভূষা। নদীর ওপারের মিলের বড় বড় লাইটের আলো, বাজারের দোকানপাটের কিছু আলো এবং গগনের সেই আধশশী যথেষ্ট আলোকিত রেখেছে বেশভূষা কাছ থেকে দেখে ওঠার মতো। ইফতেখার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ছোলা চিবাচ্ছিলো তখন। হেলেনার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে তার মুখের নড়াচড়া ধীর হয়ে আসে। জবাব দেয়,
“আমার বিয়েতে আমিই দাওয়াত পাইনি। তাই আপনাকেও দিতে পারিনি।”
“তোর বাপেও কি পারলো না? তোরা চেয়ারম্যান দেইখ্যা কি মনে করছ নিজেগো? আমাগো পেট নাই দাওয়াত খাওয়ার মতো? এমন ফকিন্নি চেয়ারম্যান তো জীবনে দেহি নাই। পোলার বিয়াত হামধুম করে না। কাইজ্জা লাগছত বাপের লগে? নইলে তোর লগে এরুম শত্রুতাডা করলো ক্যা?”
শুকনো গলায় দুইটা কাশি উঠে যায় ইফতেখারের। হাতের ছোলা শ্রাবণের হাতে থাকা প্যাকেটে রেখে পকেট থেকে টাকা বের করতে থাকে। হেলেনা ততক্ষণে শ্রাবণের দিকেও নজর গাঁথে। শ্রাবণ তার দিক থেকে নজর তুলে নেয় তাতেই। হালকা করে গলা খাঁকারি দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দাঁড়ায়৷ এই বুঝি তাকে নিয়েও মন্তব্য শুরু করে উল্টাপাল্টা কিছু! ইফতেখার একশো টাকা হেলেনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“দাওয়াত তো খাওয়া হলো না, এটা দিয়ে আপনি মিষ্টি খেয়ে নিয়েন।”
“হো, দে। ওইডা তোর বউ?”
“জ্বি।”
“সুন্দর অই। এই রাইতের বেলা সুন্দরী বউ লইয়া এনে কি করছ? চান্দের নজর লাগবো। ঘরে যা!”
“জ্বি, যাবো। নজর সরিয়ে আপনি আগে যান। মিষ্টির দোকান বন্ধ করে ফেলবে নয়তো।”