শ্রাবণধারা পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
137

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
হেলেনা পাগলী চলে যেতেই নিচু শব্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে শ্রাবণ। ইফতেখার আবার তার হাত থেকে ছোলা নিয়ে খেতে মনযোগ দেয়। শ্রাবণ হেসে নেয় ইচ্ছেমতো। মন্দ লাগছে না তার হাসি দেখতে ও শুনতে। শ্রাবণ হাসি থামিয়ে বলে,
“আপনি এটা কোনো কাজ করলেন?”
“কি?”
“কাউকেই দাওয়াত করলেন না। আমাকেও তো দাওয়াত করতে পারতেন।”
“তোমাকে তো দাওয়াত করেই এনেছি।”
“ওটা তো বিপু ভাই করলো। আপনার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি দাওয়াত পত্রে।”
“আমিই লিখেছি।”
“আমি তো দেখিনি লিখতে।”
“তোমার সামনে বসে লেখা উচিত ছিলো?”
“নিজের নামটাও লিখতে পারতেন। সে যাইহোক, পাগল তো মিষ্টি পেলো। আমি তা-ও পাইনি। কেমন বিয়ে করলেন আপনি, বুঝলামই না। কাজী বাড়িতেই মিষ্টি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো আপনার।”
মৃদু হাসির রেখা ভাসে ইফতেখারের ঠোঁটে। শ্রাবণের চোখে এলিয়ে রাখা দৃষ্টিদ্বয়ও যেন হাসতে চায় ঠোঁটের সাথে তাল মিলিয়ে। জিজ্ঞেস করে,
“মিষ্টি খাবে?”
“এখন কেন? সময় চলে গেছে। খবর পুরাতন হয়ে গেছে।”
“তবে ছোলা খাও।”
“খাচ্ছি তো।”
একটু থেমে শ্রাবণ বলে,
“বিপু ভাইয়ের জন্য কিছু করতে হবে আপনাকে।”
“কি?”
“বিপু ভাই আপনার জন্য যা করলো।”
“আমার সামনে তো কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিপুর ব্যাপার দেখতে গেলে অনেক বাঁধা আসবে।”
“তাই বলে কিছু করবেন না?”
“ফাঁকে তালে একদিন নিয়ে চলে আসবে সে-ও, সমস্যা কি?”
খোসা ছাড়ানো হাতের ছোলা ইফতেখারের হাতে দিতে দিতে শ্রবণ প্রত্যুত্তর করে,
“কেমন খাপছাড়া কথা আপনার। মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে।”
“ওটা তো আমি হ্যান্ডেল করতে পারবো না। বিপু যখন নিয়ে চলে আসবে, তখন না হয় আমি তার সাপোর্টার হয়ে আব্বা আম্মার সামনে দাঁড়ালাম।”
“বিপু ভাই-ই কিন্তু আমাকে নিয়ে বের হয়েছিলো আপনি পর্যন্ত পৌঁছাতে।”
“তুমি যত সহজে এসে গেছো, কান্তা পারবে না।”
“তাইতো বলছি, আপনি কিছু করুন।”
“আর সব আমার ঘাড়ে কেন চাপাতে চাইছো?”
“আরে, আপনি বড় ভাই। তো আপনি করবেন না তো কে করবে? দুইটা ফ্যামিলিকে আগে থেকেই ম্যানেজ করুন, যাতে পরবর্তীতেও সমস্যা জর্জরিত না থাকে।”
“ফ্যামিলি ম্যানেজ কখনোই হবে না। দুরাশা বাদ দাও।”
“হবে না কেন?”
“বললাম না সেদিনই, সমশ্রেণীর না হলে আব্বা মানবেন না। তুমি দূরের বলে আব্বা চুপ আছে, কান্তা তো বাড়ির মেয়ে। তার সম্পর্কে জানতে আর বাকি থাকবে কে? উঠতে বসতে আব্বাকে মানহানিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।”
“তাহলে?”
“আসতে হলে পালিয়েই আসতে হবে। তাতেও খুব একটা লাভ হবে কি না, কোনো নিশ্চয়তা নেই। একে তো আব্বার মানহানির ব্যাপার। অন্যথায় কান্তার বাবাচাচাও চেয়ারম্যান বাড়িকে দেখতে পারেন না। বাড়ি এসেই দেখা যাবে হট্টগোল শুরু করবে।”
“দেখতে পারে না কেন?”
“কি আর। জমিজমা নিয়েই বিরোধ আছে। পাশাপাশি বাড়ি যখন।”
“পাশাপাশি কোথায় হলো? আপনাদের দুই বাড়ির মাঝখানেও তো আরো দুইটা বাড়ি আছে।”
“অন্যদিকের জমিজমা থাকতে পারে না? আর আমি সঠিক জানি না। সবসময় এমনই দেখে আসছি। হতে পারে এই দাদা, পাশের বাড়ির দাদা, তারপর ওই দাদা এমন করেই কোনো বিরোধ ছিল। যা ছেলেদের মধ্যেও জেগে আছে।”
“তারপর আবার উনাদের ছেলেদের মধ্যেও আছে। তাই না?”
“কই, না তো। বরং আরও যোগসূত্র দেখা গেলো বিপুর আর কান্তার।”
“কান্তার ভাইকে নাকি মেরেছেন খুব, শুনলাম।”
“ওইটা বিপুর সাথে চলতে ফিরতে লাগালাগি হয়েছে। তেমন কিছু না।”
“ইচ্ছেমতোই নাকি মেরেছেন।”
শ্রাবণ যেন জোরপূর্বকই একটু মন্দাকর দিকে ঠেলতে চাইছে চেয়ারম্যান পুত্রদ্বয়কে। ইফতেখার তার ভাবভঙ্গিতে লক্ষ্য করে বলে,
“কে বলেছে? কান্তা?”
“কান্তা বলতে যাবে কোন দুঃখে! আমি এসে খবরাখবর পেয়েছি না কিছু।”
“এখন তো তোমাকেই আমার রহস্যময়ী কিছু মনে হচ্ছে।”
“আমি আবার রহস্যময়ী হয়ে উঠার কি করলাম?”
“এই যে, খবরাখবর খুব রাখা হয়েছে।”
“বা রে! একটা জায়গায় থাকবো, পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে থাকবো না?”
“হুট করে বিয়ে করাটাও তো একটা রহস্য হতে পারে।”
“আপনিও তো করেছেন তা-ই।”
“আমি তো এতো ভেবে কোনো কাজ করি না। ইচ্ছে করলে করে ফেলি যে কোনো কিছুই।”
“আমাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করলে তা-ও করে ফেলবেন?”
মুখের নড়চড় এবং দৃষ্টির হাতড়ানো উভয়ই থেমে যায় ইফতেখারের। অল্পক্ষণের একটা মুহুর্ত জবাব পাওয়ার প্রত্যাশায় তার মুখাবয়বে তাকিয়ে থেকে হাসির মাধ্যমে কথার রেশটা সরিয়ে দেয় শ্রাবণ। পরক্ষণে বলে,
“কঠিন প্রশ্ন করে ফেললাম? আচ্ছা থাক। তবে আমার ক্ষেত্রেও তো তেমনটাই ভাবতে পারেন। হুট করেই ইচ্ছে হলো বিয়ে করতে, তাই বেরিয়ে পড়েছি।”
“তুমি এমন নও।”
“কেন?”
“তুমি ভেবে ভেবে কাজ করো।”
“কেমন?”
“এই যেমন আমার ইচ্ছে হলো হঠাৎ প্রেম করতে, প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু তুমি ভেবে তা প্রত্যাখ্যান করলে।”
“তা-ও ঠিক।”
“ঠিক যদি হয়, তবে বিয়ে কেন করলে?”
“আপনি ভালো মানুষ যে, তাই।”
“তুমি তো আমায় কাছ থেকে দেখোনি কখনো। দূর থেকে ভালো মন্দ বিবেচনা করা যায় না।”
“আপনি যদি এক পলকে দেখে নিজের জিনিস চিনতে পারেন, তবে আমি কেন ভালো মন্দ দেখতে পারবো না?”
“আমি তো নিজের পছন্দটাকে চিনেছি। তুমি ভালো, না মন্দ তা তো বিবেচনা করিনি।”
“তাই? ঠিক আছে। তবে মানছি, আমারও বিয়েতে হুট করে রাজি হয়ে যাওয়ার কারণ আছে।”
“কি?”
“গায়ে থুতু পড়ার পরও যে লোক অপরিচিতের কাছে কৈফিয়ত পর্যন্ত চায় না, ফিরে তাকায় না পর্যন্ত। তাকে অনায়াসেই বিয়ে করা যায়। ওয়ান অফ পারফেক্ট ম্যান।”
ভ্রু হালকা কুচকে আসে ইফতেখারের। মনে পড়ে কিছুদিন আগের বাজারের ঘটনা। এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না, তাই মনে পড়তেও দেরি হয়নি সেই একদিনকে। জিজ্ঞেস করে,
“রিকশায় বসে তুমি থুতু ফেলেছো?”
ছোলা মুখে এঁটে নিঃশব্দে হেসে উঠে শ্রাবণ। জবাব পাওয়া হয়ে যায় ইফতেখারের। কিন্তু চোখ ফেরাতে দেরি হয়। অক্ষিগোলকের প্রেমের বর্ষন কাটে না তার। যেন বেড়েই উঠছে দিনে দিনে ক্রমে ক্রমে। রূপ নাকি মায়া ছন্দ, কোনটা তাকে বেশি টানে বুঝতে পারে না ঠিক। কিন্তু মুগ্ধতার পরশ থৈথৈ করতে থাকে ঠিকবেঠিক। দেখতেই থাকে শ্রাবণের হাসি এবং হাসির ছন্দাকে। শ্রাবণ দিনের শ্রাবণ ছন্দা। অবশিষ্ট ছোলার প্যাকেট ইফতেখারের পকেটে রেখে দেয় শ্রাবণ। অনেক্ক্ষণ হয়েছে এসেছে, বাড়ি যেতে চায় এবার। যাওয়ার সময় আরেকদিন ফুসকা খাওয়াতে নিয়ে আসতে বললো ইফতেখারকে। পরী এবং অর্পাকে সহ। তখন খাওয়ার সময় অর্পা আর পরীকে মনে পড়ছিলো তার। তারা এলেও হয়তো আরও ভালো জমতো খাওয়ার আসরটা।
তবে পরবর্তী দুপুরটা ভালো জমে গেছে। সকালে নাশতা করে বিপু বাইরে ঘুরাঘুরি করে এলো। প্রাক দুপুরে বাড়ি ফিরতেই দেখে তার অপেক্ষায় বসে আছে অর্পা, পরী। সকালে বকুল কাকা গরুর ঘাস কেটে আনলে শাপলা ফুল এসেছিলো ঘাসের সাথে। পরী তা নিয়ে অর্পার সামনে আসতেই তার আগ্রহ বেড়ে যায় শাপলা কুড়াতে। বিপু ভাইকে ধরে বসবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাজেই, বাড়ি ফিরতে না ফিরতে তাকে ঘিরে ধরেছে। বিপু মুক্তি নেওয়ার উদ্দেশ্যে বারবার বলছিলো বকুল কাকাকে নিয়ে যেতে। তাদের এক কথা, বিপুর সাথেই যাবে। পারভীন ক্রমশই বিরক্ত হচ্ছিলো তাদের কর্মকাণ্ডে। কিছুক্ষণ বকলো নিজের মেয়েকে, যে কি না পড়াশোনা বাদ দিয়ে শাপলা বিল নিয়ে পড়ে আছে! কিছুক্ষণ বকলো পরীকে। মাথায় উস্কানি দেওয়ার মূল এই পরী। শ্রাবণ তাদের সমর্থন করে বিপুকে বললো,
“এতো করে বলছে যখন নিয়ে গেলেই তো হয়, বিপু ভাই। বোনেরা এমন আবদার কি সবসময় করে? শখের সময়ও সবসময় থাকে না।”
“আপনিও যাবেন?”
“উহুম। তারা শখ করছে, তাদেরকে নিয়ে যান।”
“এই, আয়। আয়!”
খানিক বিরক্তি নিয়ে বের হয় বিপু। শর্ত একটাই। দশ মিনিটের বেশি রাখবে না। বকুল কাকার কাছ থেকে বৈঠা নেয় তাদের ছোট নৌকার। নেমে যায় বাড়ি হতে ঢালুতে। দুইটা ক্ষেতের পর থেকে বর্ষার পানি। এখানেই বেঁধে রাখা নৌকাটি। ঘাস কাটা হয় বিধায় ছড়ানো ছিটানো ঘাসে লেপ্টে আছে নৌকার পুরোটাই। পরীর কাছে দাঁড়িয়ে সে বৈঠা দেখিয়ে হুমকি দিয়ে বলে,
“পরিষ্কার কর। একটা ঘাসও যেন না থাকে।”
“আইয়া তো গোসলই করবেন। এত্ত পরিষ্কার গিরির কি দরকার?”
“চোখে দেখোছ না, কি অবস্থা? এই অপরিষ্কার নৌকায় আমি যাবোই না। যেতে হলে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কর।”
অর্পাও ঠেলে দেয় পরীকে।
“ওফ্ফ! যা তো। আমিও বসতে পারবো না এভাবে।”
“সুন্দর কইরা কন। ভাবি কি শিখায় দিছে, মনে নাই?”
“হু, যাও যাও। আসছে ভাবিওয়ালী!”
পরী উঠে ঝটপট পরিষ্কার করতে লেগে যায়। বিপু বৈঠায় ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে। হুকুম করে একটা পর্যন্ত ঘাস উপচে ফেলার। কাজ অনেকটা হয়ে এলে অর্পাকে বলে,
“ভাবিকেও ডেকে নিয়ে আয়, অর্পা।”
“ভাবি যাবে না।”
“তুই ডাকতে কি সমস্যা?”
“আবার এতোখানি হেঁটে বাড়ি যাবো!”
“হাঁটবি না যখন, উড়ে যা।”
বিপু বিরক্তিকর গলায় প্রত্যুত্তর করলে অর্পা হনহন পায়ে আবার বাড়ি আসে৷ শ্রাবণ হাতের মুঠোয় গম ছিটাচ্ছিলো উঠুনে। মুরগি, কবুতর একত্রে লেগে পড়েছে। অল্প অল্প ছিটিয়ে ফেলতে ভালোই লাগছিলো তার। অর্পা এসে বলে,
“ভাবি, চলো ঘুরতে গেলে।”
“এখনো যাওনি?”
“হ্যাঁ। যাবো। আসো, মজা হবে।”
“তোমরা যাও।”
“আরে আসো তো। এখন না গেলে আবার পাঠাবে বিপু ভাইয়া।”
“আম্মা রাগ করবে শুনলে।”
“চুপিচুপি চলে আসো।”
ঘর থেকে পারভীনের গলা আসে অর্পার জন্য।
“বেশি টইটই করতাছোস। পড়তে বইলে জ্বর ধরে, ঘুরতে গেলে ধরে না। সাঁতার কিন্তু জানোস না ঠিকমতো।”
“তাইতো ভাইয়ার সাথে যাই। ও ভাবি, তাড়াতাড়ি আসো।”
শ্রাবণের উদ্দেশ্যে কিছু বললো না, তাই শ্রাবণও আর দমে রইলো না। যাওয়া যাক শাপলা বিল দেখতে। যাওয়া হয়নি এদিকে কখনো। ছোট নৌকা। চারজনে পরিপূর্ণ। বৈঠা হাতে বিপু বসেছে এক পাশে। তাদের তিনজনকে বলেছে মাঝখানে বসতে। পড়ে টরে গেলে সে একদম ধরবে না। পাটাতনে দুজন আরাম করে বসে গেলেও শ্রাবণ বিপরীত প্রান্তের কোণে বসেছে। তার পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। সাঁতার জানা আছে। পরীও ভালো সাঁতার জানে। নৌকার কোণে বসা তার অভ্যাসও বটে। তবে ভাবির জন্য ছেড়ে দিয়েছে জায়গাটা। স্থল হতে সামনের দিকটা উঁচু হওয়ায় পানি কম। লগি দিয়ে ঠেলে ঠেলে বিপুকে যেতে হয়েছে কিছুক্ষণ। পানির গভীরতা ছুঁয়ে নিলেই আরামে বৈঠা চালাতে বসতে পেরেছে। এদিকে লতাঘাসের যানজটও কম। স্বচ্ছ পানিতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ভাসছে। পরী আর অর্পা ঝুঁকে মাঝে মাঝে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখছে। কথা বলছে, হাসছে। শাপলা ছুঁয়ে দেখার প্রত্যাশায় উত্তেজিত হয়ে আছে। মেঘ না ডাকলেও আকাশ গুমোট হয়ে আছে। রোদের দেখা না পাওয়া গেলেও দিনটা ঝরঝরে লাগছে। মোটকথা এই দুপুরে বাইরে বের হওয়ার মতোই একটা মনোরম পরিবেশ। বাতাস বইছে মাঝারি বেগে। অনুকূল যাত্রা হওয়ায় বিপুর কষ্ট লাঘব হচ্ছে। একটু বৈঠার বেগে চললে নৌকা আরেকটু এগিয়ে যাচ্ছে বাতাসের বেগে। ফেরার সময় কষ্ট বাড়বে নিশ্চিত। বিপু আবারও সাবধান করে দিচ্ছে অর্পা ও পরীকে।
“এই যে বারবার নড়ছিস, যদি খালি পড়বি। এই আমি বিপু একটাকেও ধরবো না। এই জায়গায় দুই পুরুষের দাঁড়ানো সম্ভব না।”
পরী পাজি সাথে সাথে তর্ক জুড়ে,
“এহ! ভাইজানের কথা! ওইযে, পানির নিচে মাটি দেহা যায়। এত্ত বলদ ভাইব্বেন না।”
“নাম দেখি।”
“এহন নামমু ক্যা অহেতুক?”
“কথাটা বাড়াস ক্যা অহেতুক!”
মাইর দেওয়ার ভঙ্গিতে বৈঠা তুলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নেয় বিপু। শ্রাবণ দুহাত দুইদিকে বাড়িয়ে পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে চলন্ত নৌকায়। তাদের কথাবার্তা শুনে হাসছেও। বাতাস এসে বারবার মাথার আঁচল ফেলে দিচ্ছে। আবার তুলছে সে। বিপু বৈঠার হাল ধরতে ধরতে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি সাঁতার জানেন?”
“হুম।”
“এখান থেকে বাড়ি ফিরতে পারবেন?”
বাড়ির দিকে দূরত্ব দেখে শ্রাবণ। পরক্ষণে প্রত্যুত্তর করে,
“পারবো। কিছু দূর গেলেই তো হাঁটতে নাগাল পাওয়া যাবে।”
“ঠিক আছে। যাওয়ার সময় নৌকা ডুবিয়ে দেখবো কার দম কতদূর।”
অর্পা চেঁচিয়ে উঠে,
“না…! আমি মরেই যাবো!”
“তুই মরবি জানলে এলি কেন?”
“আমি তো নৌকায় এসেছি। সাঁতার কাটতে আসিনি।”
“শখ যখন, ডুবে ডুবে শাপলা তুলবি।”
“না ভাই, না।”
শ্রাবণ হাসিমুখে প্রত্যুত্তর করে,
“তাইতো আপনাকে সাথে নিয়ে এলো।”
অর্পা সহমত হয়।
“ঠিক, ঠিক। তাইতো তোমাকে নিয়ে এসেছি। তুমিই তুলবে ডুবে ডুবে। ভাইয়া, শাপলা! শাপলা! ওইদিকে যাও।”
শ্রাবণ পিছু ঘাড় ঘুরিয়ে অর্পার ইশারা করা দিকে তাকায়। মুগ্ধ হয় শাপলা বিলের প্রতি! যতদূর চোখ যাচ্ছে, বড় বড় গোল পাতায় আচ্ছন্ন বিল দেখা যাচ্ছে। এ যেন শাপলা পাতার চাদর বিছিয়ে আছে জলবিছানার উপর। যদি ফুলগুলো ফুটে থাকতো, নির্ঘাত এই বিলকে পুষ্পরাজ্য মনে হতো। কিন্তু দুপুরের সময় তাদের লজ্জাবরণের সময়। এই প্রহরে তারা নিজের সৌন্দর্যের কপাট গুটিয়ে বিশ্রাম নেয়। সৌন্দর্য বর্ধন করতে ফুটে থাকে সকাল, সন্ধ্যা। শ্রাবণ ঘুরে বসে যায় নৌকার কোণে। এইতো, নৌকাটা একটু এগিয়ে গেলেই শাপলা ছোঁয়া যাবে। অর্পার আফসোস হয়, শ্রাবণের জায়গায় সে নেই বলে। কোণে থেকে ভাবি আগে ছুঁতে পারবে শাপলা। মনের উত্তেজনা বেড়ে আসছে তার। উঠার জন্য হালকা নড়েও উঠে,
“ভাবি, আমি তোমার কাছে আসি?”
“আসবে?”
বিপু সাথে সাথেই নিষেধাজ্ঞা অর্পন করে,
“একদম না। একদিকে ভার হলে নৌকা ডুবে যাবে।”
“এইপাশে তুমি আছো না!”
“আমি হ্যাংলা পাতলা একজন মানুষ তোদের দু-তিন জনের ব্যালেন্স ক্যামনে ধরি একা! চুপ করে বস।”
গলায় আফসোসের কান্না ভঙ্গি ঠাঁই পায় অর্পার।
“আ… আহা…। আমি শাপলা নিতে পারবো না তবে।”
“নৌকা ভেতরে গেলে সবাই-ই নিতে পারবি। চুপ করে বস।”
পরী চেঁচায়,
“ভাইজান, ওদিক দিয়া যান। ওদিক দিয়া অনেকগুলা।”
“পরী, দেখতো এইবার মাটি দেখা যায় কি না?”
পরী উঁকিঝুঁকি দেয়। পানিতে ভাসমান আকাশ ব্যতীত কিছুই দেখা যায় না। বিপুর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায় তাই। বিপু বলে,
“এই জায়গায় তোর সাত পুরুষের নাগাল আসবে না।”
“এতো গভীর?”
বিপুর বিরুদ্ধে মুখে প্রশ্ন জুড়লেও শ্রাবণের দৃষ্টি মনযোগে গেঁথে থাকে প্রথম ছুঁয়ে যাওয়া শাপলাটার দিকে। নাগাল পেতেই প্রশ্ন করতে করতে বাহারি কপাট বন্ধ রাখা শাপলা মুঠোয় ধরে ফেলে সে। বিপু তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে,
“শাপলা উঠিয়ে দেখেন কতটা গভীরতা।”
বৈঠার জোরেশোরে ধাক্কায় পানির স্বচ্ছতা কাটিয়ে বিস্তৃত শাপলা বনে ঠাঁই নেয় তাদের নৌকা। শ্রাবণের হাতের শাপলা নীড় ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে। সে পুরোটা শাপলা নৌকায় তুলে আনে। সাত পুরুষের সমান না হলেও দুই পুরুষের উপরে হবে তার দৈর্ঘ্য! শ্রাবণ নৌকায় এলিয়ে দেয় শাপলার পুরো অস্তিত্ব। তরতাজা পুরুত্বের টসটসে শাপলা। এর রুপে মুগ্ধ হয় শ্রাবণ। চোখ রাখে পরবর্তী একটা ধরার। এদিকে নৌকা হেলেদুলে উঠছে মধ্যস্থানের দুইয়ের কর্মকাণ্ডে। দুদিকে দুজন ঝুঁকে যাচ্ছে আপ্লুত হয়ে। শাপলা টেনে তোলা চাই তাদের। বিপুর ধমক কোনো কাজেই আসছে না। শ্রাবণ ধীরেসুস্থেই একটা দুইটা তুলছে আর তাদের দেখে হাসছে। বিপু সাবধান করে,
“সাবধানে। শাপলা মনে করে আবার সাপের মাথা টেনে তুলিস না।”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
“সাবধানে। শাপলা মনে করে আবার সাপের মাথা টেনে তুলিস না।”
“ভাইজান, চুপ করেন তো। সাপ উঠলে আপনের গলাতেই ছুঁইড়া দিমু আগে।”
বিপু পাশ থেকে পঁচা শাপলার গোটা তুলে ছুড়ে দেয় পরীর মাথায়।
“সাপ! সাপ!”
আকস্মিক ঢিলে চিৎকার করে উঠে পরী। তার চিৎকারের ধাক্কায় অর্পা শাপলা টানতে গিয়ে নিজেই চলে যাচ্ছিলো শাপলার সাথে। বিপু সাথে সাথেই হেসে উঠে বলে,
“এইযে, এইযে যায় আরেকটা৷ ধরবো না তো। সব ফেলে রেখেই নৌকা নিয়ে বাড়ি ছুটবো।”
অর্পা কটমটিয়ে তাকায় বিপুর পানে। মনের খায়েশ মিটিয়ে শাপলা তোলা হচ্ছে না এই ভাইয়ের জন্য। একবার সাপ, একবার নৌকা ডুবিয়ে দেওয়ার ভয়, আবার ফেলে রেখে যাওয়ার ভয়! ধমক টমক তো আছেই। ভেজাল করা ব্যতীত যেন তার আর কোনো কাজ নেই। পরী প্রত্যুত্তরে বলে,
“আস্তা একটা শয়তান আপনে, ভাইজান! আপনের দোষেই তো পড়তাছিলাম! সব ফালায় রাইখ্যা যে যাইবেন, বড় ভাইজান কি আপনারে আস্তা রাখবো নতুন ভাবিরে এই বিলে ফালায় গেলে?”
“তোরা মাথায় করে নিয়া যাবি। ওইটা তোদের দায়। আমি কি আসতে চাইছিলাম?”
“নিয়া তো আইছেন আপনে।”
“এই সাক্ষী দিবো কে?”
অর্পা হাত তুলে বলে,
“আমি দিবো।”
“তুই বাড়ি যেতে পারলে তো দিবি।”
শ্রাবণ হেসে কুটিকুটি তাদের কথা শুনে। ভালোই লাগছে এই মনোরম পরিবেশ ও তাদের কথা কাটাকাটি। নাগালের সব শাপলা তোলা শেষ। বিপু ভাই ভুল বলেনি। শাপলারা যেভাবে কলি হয়ে আছে, সাপের মাথার মতোই দেখা যায় একটু দূর হতে। তাই সে বাছাই করে নিশ্চিত হয়েই টানছে শাপলা ধরে। বিপু বৈঠা ঠেলে এগিয়ে গেলেই তারা আবার শাপলা কুড়াতে ব্যস্ত। একেকজন অর্ধেকটা ভিজে গেছে শাপলার পানিতে। নৌকার হেলেদুলে উঠা তো চলছেই অনবরত। বিপু শাপলা তুলে পানিতে ধুয়ে গজগজ করে চিবিয়ে খেতে শুরু করেছে বসে বসে। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“অনেক মজা, তোতা ভাই?”
“খেয়ে দেখেন।”
“আমার এভাবে ভালো লাগে না। কাচা খেতে হলে ভর্তা করে খাই।”
“মিষ্টি শাপলা। এমনিতেও মজা।”
পাতানো শাপলা বিলের কিছুটা অংশে গমন করেই নৌকা প্রায় ভরো ভরো। আর তুলতে দেয় না বিপু। বৈঠা ঠেলে বেরিয়ে আসে শাপলাজোট ছেড়ে। অর্পা, পরী দুজনেই তার বিরোধে। তাদের মন ভরেনি। অহেতুক এতো শাপলা নিয়ে কোনো কাজ দেখে না বিপু। বাতাসের প্রতিকূলে বৈঠার ধার ধরে ধমক দেয় তাদের।
“আরে রাক্ষসের দল, এগুলো খেয়ে শেষ করে নে আগে।”
অর্পা মুখ মলিন করে বলে,
“তুমি তো আর নিয়ে আসবা না।”
“আমি তো বাজারে বেচতেও যাচ্ছি না।”
“ভাইজান, আপনে আসলেই একটা… কি কইতাম! কোনো দরদ মরদ কিচ্ছু নাই আপনের পাষান্ড মনডার ভিত্তে। আর পাঁচটা মিনিট থাকলে কি এমন ক্ষতিডা হইয়া যাইতো? নিজে না খাইতে পারতাম, তৃপ্তি মিডায়া তুইল্লা নাহয় গরুরেই খাইতে দিতাম। তা-ও কেউর পেট ভরতো।”
“আমি কি গরুর ঘাস কাটতে আসছি তোদের নিয়ে?”
“আসেন নাই, তবে তা-ই আসার দরকার আছিলো।”
“কথা কম বল।”
“আল্লাহ মুখ দিছে কথা কইতে, কেল্লাই কম কইতাম? আর একটা মুঠ শাপলাই তো তুলতাম। আপনেরে না আনলেই ভালা হইতো। বকুল কাকারই দরকার আছিলো।”
বিপু বৈঠা চলা থামিয়ে দেয়। হতাশাজনক বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। বৈঠাটা নৌকার শাপলার স্তুপের উপর তুলে রেখে আকস্মিক ঝাপিয়ে পড়ে স্বচ্ছ পানিতে। উপস্থিত সকলেই বিস্মিত হয়ে যায় তার কান্ডে। বিপু ডুব দিয়ে মাথা তুলে বলে,
“আমার যখন দরকার নাই, তোরা এইবার বাড়ি যা। আমি গেলাম।”
প্রত্যেকেই হতবাক হয়ে আছে! শ্রাবণও হা করে তাকিয়ে থেকে হেসে উঠেছে খিলখিলিয়ে। বিপু সত্যিই সাঁতার কাটতে কাটতে চলে যাচ্ছে। মাঝখানে নৌকা ভাসছে। বাতাসের ধাক্কায় ঘুরছে আর পিছু দিকে একটু একটু সরে যাচ্ছে। অর্পা কাঁদোকাঁদো চেহারা করে রাখে, ভাই এটা কি করলো! এতোক্ষণ ভয় দেখিয়ে এবার সত্যি সত্যিই গেলো! পরী হাউকাউ শুরু করেছে। বৈঠা ধরে শ্রাবণের কাছে নালিশ করছে,
“দেখছেন, ভাবি? দেখছেন খালি শয়তান বেডার কামকাজ! এহন নৌকাটা কেডা ঠেইল্লা নিয়া যাইবো, কন আপনে?”
“কি অদ্ভুত কর্মকাণ্ড! দাও তো দেখি, আমি পারি কিনা।”
শ্রাবণ বৈঠা হাতে নেয়। তার এসবে অভিজ্ঞতা নেই। ছোট নৌকার বৈঠাও ছোট এবং পাতলা। তাই তা সহজে বহন করতে পারলেও হাল ধরা অসাধ্যকর। বাতাস না থাকলে হয়তো একটু এগিয়ে নেওয়া যেতো। কিন্তু বাতাসের সঙ্গে লড়ে উঠা একদমই অসম্ভবপর। তারউপর তারা তিনজন মেয়ে। সেইসাথে তাদের চেয়েও বেশি ওজন হবে বুঝি এই শাপলা স্তুপের! তো আর কিভাবে সম্ভব এই নৌকা ঠেলে নেওয়া? শ্রাবণের হাতের বৈঠার ধারে নৌকা শুধু চরকির মতো ঘুরছে। পথ চলার অগ্রগতিতে বরং ঘটছে অবনতি। বিপু সাঁতার কাটতে কাটতে পিছু ফিরে দেখে হাসছে। সেজন্য পরী খেমটা মেজাজে তাকিয়ে বৈঠা নিতে হাত বাড়ায় শ্রাবণের দিকে।
“পারবেন না, পারবেন না। বেডা মাইষের বেডা জোর। আপনে তো দূর, আমার শক্তিতেও কূলাইতো না।”
শ্রাবণ নিজের পরাজয় মেনে বৈঠা দিয়ে দেয় হেসে। পরী ক্রুদ্ধ মেজাজে বৈঠার হাল ধরতে চেষ্টা করে। সে-ও ততটা অভিজ্ঞ না বৈঠা চালাতে। তবুও সর্বজোরে চেষ্টা করে কিছুটা ভালো ফলাফল করতে পেরেছে। নৌকা ডানে বামে বেঁকে যাচ্ছে যদিও, তবে বাতাসের সাথে মোকাবিলা করে এগোতে পারছে। বিপু হাসছে, মনের আনন্দে ভাসছে। তারা একটু একটু করে এগুচ্ছে। বিপু অনেকটা দূর পর্যন্ত এগিয়ে আবার সাঁতার কাটতে কাটতে ভীড়েছে নৌকার ধারে।
“কি? যায় না? ধাক্কা দেওয়া লাগবো?”
পরীর ইচ্ছে করে বৈঠা মেরে মাথাটাই ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু এতো দুঃসাহস তার নেই যে তাদের কাউকে সে আঘাত করতে পারে। শ্রাবণ নিরবই আছে। অর্পা তো খেমটা মেজাজে গাল ফুলিয়েই আছে। এইযে, সে ফিরে না এলে কে নিয়ে যেতো তাদের? পরী ঠেলতে ঠেলতে তো রাতই নামিয়ে আনতো! বিপু নৌকার কোণে ভর করে দুই দিকের ভারসাম্যই ঠিক রেখে উঠে আসে। ভেজা শরীরে বসে বৈঠা নেয় হাতে। পরীকে বলে,
“আর একটা কথা বলবি, এরপর দেখিস নৌকা কোন দিকে যায়। আর পরীই কোন আকাশে উড়ে যায়!”
পরী একদম চুপ হয়ে থাকে। তবে চোখে ও মনে শত রকমের বিড়বিড়ানি। বসে বসে শাপলার আঁটি করতে থাকে। অর্পা তাকে সাহায্য করছে। শ্রাবণ সেই এক কোণে বসে শাপলা ফোটাতে থাকে হাতে। একে একে কপাট খুলে লজ্জা ভাঙায় শাপলা বেগমের। ফুটে আসে লুকানো সৌন্দর্য। এইযে, ডোরাকাটা সবুজের ভেতরে লালচে সাদার বাহার। তার ভেতরে ধবধবে আলোড়ন শুভ্রতার। অতঃপর হলুদ রাঙা তার কেন্দ্র। ধাপে ধাপে ফুটিয়েছে, বিলিয়েছে মাধুর্য। এর কোনো উপস্থিত ঘ্রাণ নেই, তবুও সে রূপের বাহারে পবিত্র। যেন নিজের প্রতিচ্ছবি এই শাপলাতেও পেয়ে যায় শ্রাবণ। দুয়ের আগমনই ঘটে বর্ষায়। রূপ আছে, রূপের ঘ্রাণ হয়তো নেই কারোই। তবুও তারা বর্ষা রূপের রানী। বর্ষার জল যত ফুলেফেঁপে উঠে, তারা নিজেদের প্রবৃদ্ধির প্রয়াস তত বেশি বাড়িয়ে নেয়। জলের কূল ছেড়ে অতিমাত্রায় বাড়তে চায় না একদমই। বেশ কিছুক্ষণ মনযোগ পেতে রাখে সে শাপলার রূপে। পরক্ষণে তাকায় দূর দিগন্তে। দিগন্তের শেষ সীমায় যেন একটা মুখ ভাসে দৃষ্টি গোচরে। শখপ্রান মহাশয়ের মুখ। যাকে চাইলেই পারা যায় ছুঁতে, চোখ জুড়িয়ে দেখে নেওয়া যায় কাছ থেকে, ডাকা যায় প্রাণে শিহরণ জাগিয়ে, তৃপ্তিকর আলাপও করা যায় গোপনে রোপনে। অথচ কল্প দৃষ্টিতে কেবলই সে দূর, বহুদূরে!
নৌকা নীড়ে ফিরিয়েই বিপু বৈঠা হাতে নেমে আসে। বকুল কাকার বৈঠা বকুল কাকাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। একটা শাপলার আঁটি যদি ছুঁয়ে দেখতো সে! যার দরকার সে নিয়ে আসবে। তার এসবে দরকার নেই। শ্রাবণ স্বেচ্ছাতেই এক আঁটির ভার বহন করে বাড়ি হাঁটা ধরেছে। আরও তো অনেকগুলো বাকি। কে নিবে এতোগুলো? তারা বারবার নিতে এলেও ক্লান্ত বোধ করবে। পরী তাই অর্পার কানে ফিসফিস করে,
“আপা, বকুল কাকারে ডাকেন।”
“ডাকো তুমি।”
“আমি ডাকলে আইবো না এই বেডায়। আপনে ডাকেন, দৌড়ায় আইবো।”
অর্পা তা-ই করে। বকুল কাকাও বাড়ির সীমানা ছেড়ে নেমে যায় অর্পার ডাকে। পরী নিজে বহন করার জন্য এক আঁটি রেখে বাকি সব একত্রে বেঁধে বকুল কাকার মাথায় তুলে দিয়েছে। পারভীন বড়ই বিরক্ত তাদের কর্মকাণ্ডে। এই যে এতোগুলো শাপলা নিয়ে এলো, কি করবে এগুলো দিয়ে? চটজলদি বাড়ি পরিষ্কার দেখতে চান তিনি। শ্রাবণের আগে নিয়ে আসা ওই আঁটিটাই অল্প ভেবে তিনি নিজ হাতে নিয়েছিলেন। বকুলের মাথায় আঁটির উপর আঁটি দেখেই রেগে গেছেন। বিপু দাঁড়িয়ে আছে বাথরুমের দরজার সামনে। মাকে আরও উস্কে দিতে নালিশ করছিলো পরী আর অর্পার নামে। এগুলোতেও যে তাদের পোষাচ্ছিলো না! বাথরুম হতে ইফতেখার বেরিয়ে এসেছে গোসল সেরে। তবেই বিপু গেলো কয়েক মগ পানি ঢেলে নিতে। ইফতেখার উঠুনে নেমে এসে কাপড় নেড়ে দেয় রশিতে। শাপলার স্তুপ দেখে জিজ্ঞেস করে,
“পরী কি এগুলো বিক্রি করতে নিবে?”
আম্মার বকাঝকায় পরী এমনিতেই দমে আছে। তাই মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“শাপলায় যে এত্তো বরকত ক্যামনে আইলো, বুঝলাম না। ভাইজান, সকালে ভ্যান দেখলে কইয়েন তো পাইকারিতে দিয়া দিমু নে।”
পারভীন ধমকে উঠে বলেন,
“এক্ষণ ফালা নিয়া। সকাল তো দূর! বিকাল পর্যন্তও আমি দেখতে চাই না।”
“এমন করেন ক্যা, আম্মা? মাইনসে তরকারি পায় না খাইতো। আর আপনেরে বিনা পয়সায় আইন্না দেই, হেইডা আপনের ভাল্লাগে না।”
“আমার দরকার নাই বিনা পয়সায় খাওনের। তোর বাপ দাদার বাড়ি নিয়া দিয়া আয়।”
“তা-ও তো আপনের বাপের বাড়ি ওদিগে।”
“যা, আমার বাপের বাড়িই দিয়া আয়। তবুও দূর কর।”
পরী নিজের হাতের আঁটিটাও বারান্দার এক কোণে রাখে। বকুল কাকার বহন করা আঁটি গুলো আম্মার চোখের সামনে হতে দূর করতে পাশের বাড়ি বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বকুল কাকাও দুইটা আঁটি বেছে রাখে নিজের বাড়ি নেওয়ার জন্য। ইফতেখার কাপড় মেলে দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে যাওয়ার সময় শ্রাবণও পিছু দুহাত বেঁধে রাখা অবস্থায় বারান্দা হতে যেতে থাকে তার সাথে সাথেই হেঁটে। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“ভালোই ঘুরাঘুরি করে এলে।”
“উহুম। ততটাও ভালো না।”
“কেন?”
“শাপলারা সব ঘুমাচ্ছিলো। জেগে থাকলে ভালো লাগতো। আর আপনি পাশে থাকলে সেই ভালো লাগারা পূর্ণতা পেতো। দুজনের দিব্যি একটা প্রহর কেটে যেতো তবে ফুটফুটে বিলে। আর তা না হওয়ায় ভীষণ নেই নেই অনুভব করছিলাম।”
কথার পিঠে কথা রাখে না ইফতেখার। ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শ্রাবণ পিছু বাঁধা হাত ছেড়ে দেয়। হাতের শাপলাটা ইফতেখারের সামনে ধরে বলে,
“নেই নেই অনুভব করলেও খালি হাতে ফিরিনি। নিজ হাতে ফুটিয়েছি শাপলা বেগমকে। এটা আপনার জন্য।”
ইফতেখার ঘাড় ঘুরিয়ে শ্রাবণের মুখে তাকিয়ে হাসি দেখতে পায়। বিপরীতে নিজের ঠোঁট প্রাঙ্গণে মৃদু হাসি জাগিয়ে ফুল টা হাতে নেয়। একটু ঘুরে শ্রাবণের মুখোমুখি হয়ে তার কানে গুজে দিয়ে বলে,
“ফুল মেয়েদের অঙ্গে ভারি শোভা পায়।”
“আর মেয়েরা কোথায় শোভা পায়, জানেন?”
“কোথায় বলতে চাও?”
“পুরুষের হৃদকুঞ্জে।”
“বড্ড নরম জায়গা।”
“তাইতো এতো আরাম-আয়েশে গুটিয়ে থাকতে চায় কোমল হৃদয় আঙ্গিনায়।”
“আঘাত পাওয়ার ভয় থাকে না?”
“পাজর আছে যে তার উপরিভাগে।”
ঠোঁট কার্ণিশে প্রশান্তি স্পষ্ট হয় ইফতেখারের। এক হাত শ্রাবণের ঘাড় স্পর্শ করে আলতো করে। ফুল গোজা কানের পাশেই ঠোঁটের উষ্ণতা ছুঁয়ে দেয় এক নিমেষে। শ্রাবণ বড্ড লজ্জা পায়। উক্ত স্থান ত্যাগ করতে চায়। ইফতেখারও তাকে বেঁধে রাখেনি। মনযোগ দিয়েছে মুখে এক চিমটি ক্রিম লাগানোর দিকে। গোসলের পর মুখের চামড়া টানটান হয়ে থাকে। একটু আধটু প্রসাধনী প্রলেপ না লাগালে চলে না। শ্রাবণ দরজার সামনে এসেও আবার ফিরে গেছে তার কাছে।
“একটু খালাম্মার কাছে যাওয়ার ছিলো।”
“কেন?”
“আমার যা আছে, সবই তো উনার কাছে। নিয়ে আসা দরকার। আম্মার দুই শাড়ি গছিয়ে নিয়েছি ইতিমধ্যে।”
“যেতে হলে যাও। কিন্তু তোমায় শাড়িতেই ভারি লাগে।”
“ইশ!”
শ্রাবণ পুনরায় যেতে থাকলে ইফতেখার পিছু বলে,
“এখনই যাচ্ছো?”
“না।”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
চেয়ারম্যান বাড়ির বাউন্ডারি ঘেঁষেই উত্তরে কবরস্থান লক্ষ্যনীয়। এটি চেয়ারম্যানেরই সম্পদ। তাদের পারিবারিক কবরস্থান হিসেবে বাড়ি থেকে আলাদা করেছেন এটিকে। রাস্তায় উত্তরে চলতে গেলেই চোখে পড়ার মতো। শ্রাবণ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এই স্থানটায় থেমেছে। মনযোগে তাকিয়েছে কবরস্থানের তিন ফুট উচ্চতার বাউন্ডারির ভেতরে। পুরনো দু-তিনটা কবর লক্ষ্যনীয়। বেশিও হতে পারে। ঠিক স্পষ্ট না যদিও। চোখের দেখায় ধারণ করা যায় মাত্র। শ্রাবণ হালকা করে ঠোঁট নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে সালাম প্রদান করে কবরবাসীদের। যেখানেই কবর চোখে পড়ুক না কেন, সালাম দেওয়াটা তার অভ্যাসে ধারণ করে নিয়েছে। মনে মনে শান্তিকামী দোয়া করে। যদি তার মৃত্যু এখানে হয়, দেহটা হয়তো এখানেই দাফন হয়ে যাবে। চেয়ারম্যান বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানের সদস্য বাড়বে। তখন পথে হাঁটতে গিয়ে কোনো পথিক তার জন্যও দোয়া করবে তো? হৃদমহলে নিরুত্তর প্রশ্ন জাগিয়ে হেঁটে যায় মজিদার কাছে। বেলা হেলে গেছে। সন্ধ্যা নামাতে প্রকৃতির যত আঁধার প্রত্যাশিত আচরণ। একা ঘরের বাসিন্দা মজিদা উঠুন হতে কাপড়চোপড় গুটিয়ে নিচ্ছে। বৃষ্টি বাদলার দিনে কাপড়চোপড়ও শুকায় না ঠিক মতো। সুবিধা দেখলেই ছুটে আসে মেলে দিতে, আবার সেই মেঘের গর্জনে ছুটে নিয়ে যেতে হয় ঘরে। বিনা পারিশ্রমিকের চাকরি যেন কাপড় ঘরে বাইরে মেলা। শ্রাবণকে দেখতেই মজিদা উঠুনে থামে। শ্রাবণ হাসিমুখে এগিয়ে আসে। সালাম দেয়। কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। মজিদা উত্তর দিলেও হাসিটা ঠিক ফুটে উঠেনি তার মুখে। ঘরে যেতে যেতে বললো,
“কি কামডা করলি বুড়ি। তোর কাছে এরুম কিছু আশা করি নাই।”
“আমার ভবিষ্যৎ তো ভাসতে ভাসতে চলছিলো, খালাম্মা। একটা স্থির ব্যবস্থা হওয়াতে কি আপনি খুশি হননি?”
“হেল্লাইগা শেষ মেষ চেয়ারম্যানের পোলার হাত ধরলি!”
“কি জানি, কেন আমার চোখে চেয়ারম্যানের ছেলেটাকেই ভালো লেগে গেলো। আর যা-ই বলেন, খালাম্মা। মানুষটা ভালোই। আমার খুব খেয়াল রাখে। দেখতেও তো সুন্দর। ঠকেছি বলে মনে হয় না। কি বলেন?”
“জানি না, তোগো বয়সের চোখ কিরুম ভালার খোঁজ রাখে। দেখতে সুন্দর হইলেই তো মানুষজন মানুষ হয় না। আমার মাইজ্জা মাইয়াডারে ডকডাক পোলা দেইখ্যা দিলাম বিয়া, হেই জামাই হইলো জুয়াখোর। আল্লাহর রহমতে জুয়াজারি কমছে বছর দুইতিন পরে, কিন্তু সিগারেট খাওয়াডা মাইয়া আমার যুদ্ধ কইরাও ছাড়াইতে পারে নাই।”
“আমার উনি তো এসব কিছুতেই নেই।”
“মারামারি খুব পারে হেই বাড়ির দুই পোলাই। আর তোর কাছে ভালা হইলে ভালাই।”
পরক্ষণে কণ্ঠ ফিসফিসে করে মজিদা জিজ্ঞেস করে,
“হের বাপ মায় তোরে গালিগালাজ করে নাই তো?”
“না তো।”
“এত্তো সোজা কইরাই মাইন্যা লইলো চেয়ারম্যান? আগেই জানাইছিলো নি?”
“না, না। জানায়নি কিছুই। একটু মন খারাপ তো হয়েছেই, ছেলে না জানিয়ে বিয়ে করেছে। তা-ও আবার একটা অচেনা, অপরিচিত মেয়েকে। অন্যথায় আর কোনো ঝামেলা টামেলা হয়নি।”
শ্রাবণ নিজের কাপড়চোপড় গুছাতে গুছাতে বললো,
“এইতো সেদিন গেলাম, অথচ কত দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছে। ভাবলাম কাপড়চোপড়গুলো নিয়ে যাই, আপনার সাথেও দেখা করে যাই। আপনার রান্নাবান্না ঠিকঠাক চলছে তো?”
“ওই চলে আরকি। তোর কতা না একলাই একলাই কত কই। মাইয়াডা আছিলো, ঘরটা ভরা ভরা লাগছিলো।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে,
“এইতো দূরে নেই, আপনার খুব কাছেই নিজের ঠিকানা হয়েছে। দেখতে ইচ্ছে হলেই যেতে পারবেন।”
“আমরা হেই বাড়িত যাই না।”
“কেন?”
“ঝগড়াঝাটি না, পূবের আমল থাইকাই।”
“কি নিয়ে ঝগড়া?”
“কত্ত কারণ। জমি নিয়া কত্ত কাড়াকাড়ি হইলো। বাড়ির সীমানা নিয়া কত্ত মারামারি হইলো। পোলাপান নিয়া লাঞ্চনা, ঝগড়া হইলো। কিছু কইলেই চেয়ারম্যানে, চেয়ারম্যানের বাপ চাচারা মারতে দৌড়ায় আইতো এই বাড়ি। পোলাগুলাও তো হেরামই হইবো। আর হেরা বড় মানুষ। ছোডগো মাড়াইয়া যাইতে পারলে তাগো ঘাড় সিধা। ক্ষমতার জোরে সবই করে।”
শ্রাবণ চুপ থাকে। আসলেই কিছু ক্ষমতাবান পাষাণ্ডের কাছে অসহায় মানুষগুলো ঠকে যায় প্রতিনিয়ত। তবে পৃথিবীতে এমনও বহু ক্ষমতাবান আছে, যারা অসহায়ের সহায় হয়ে পাশে দাঁড়ায়। হয়তোবা তাদের পরিমাণ পাষাণ্ডদের তুলনায় অতি সীমিত। ব্যাগের ভেতর পোশাকাদি আর বইপত্র নিয়ে শেষ করে শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে,
“কান্তা বাড়িতে নেই?”
মজিদা কিছুটা হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলে,
“হো। মাইয়াডার বিয়াডা না ঠিক হই হই কইরাও ভাইঙা গেলো। গত সন্ধ্যা বেলা হেই বাড়িত্তে খবর আইলেই শিরিনের মনডা ভারি হইয়া যায়। একটা মাত্র মাইয়া নিয়া কত্ত আশা। চেহারাডাও তো ডকডাক। গায়ের রঙডা একটু শ্যামলা। ভালাভোলা একটা পোলা যদি আল্লাহ মিলায় দিতো ভদ্র মাইয়াডারে। দোয়া করিস।”
“হুম।”
শ্রাবণ পাঁচশো টাকা চেপে দেয় মজিদার হাতে।
“এটা রাখুন, খালাম্মা। এই মেয়েটাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য আপনার প্রতি বড় কৃতজ্ঞ। আমার যদি অনেকটা সামর্থ্য থাকতো, তবে অনেকটাই দিয়ে যেতাম আপনাকে।”
“আরে, মাইয়া কি করে। কিছু লাগতো না। যা। দিছোত না। আর কত করে মানুষ। ভাঙা ঘরের আশ্রয় আর কি হয়। ধর।”
“না, রাখুন। দোয়া করবেন আমার জন্যও।”
“হো, ভালায় ভালায় সাবধানে থাহিস।”
“যাই তবে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।”
উঠুনে নেমে কান্তার উদ্দেশ্যে গলা ছাড়ে শ্রাবণ। দৌড়ে বেরিয়ে আসে কান্তা।
“আপু আসছো!”
ভারি উচ্ছ্বাস তার চোখেমুখে। শ্রাবণ ঠোঁটে হাসি রেখে রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। মজিদা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রাবণ চলতে চলতে ধীর গলায় বলে,
“কি অবস্থা তোমার?”
“আজকে অনেক খুশি আমি।”
“আচ্ছা?”
“ধন্যবাদ তোমাকে।”
“এতো খুশি হওয়ার দরকার নেই। ছোট ছোট বিষয়ে কম খুশি হওয়া ভালো।”
“আরে, বিষয় ছোট না৷ বড়। বড়। জানো? বিয়েটা শেষ।”
দাত চেপে নিচু স্বরে হাসে কান্তা। যেন পিছু না কেউ আন্দাজ করে। শ্রাবণের ঠোঁটের ধারে হাসির রেশ থাকলেও সে তাল মেলায় না তার হাসিতে। উপদেশমূলক বলে,
“এইটা শেষ মানেই শেষ নয়। যদি একান্তই ইচ্ছেটা ও বাড়ি পর্যন্ত গাঁথা থাকে, তবে তা-ই হবে বিয়ের শেষ। ঠিকাছে? পড়াশোনা করছো, মনযোগে করতে থাকো। ভাগ্যে কি আছে, কারোই তো জানা নেই। কিন্তু যত জানতে চাইছি, ব্যাপারটা যেন তত কঠিন হয়ে আসছে সামনে।”
“ইনশাআল্লাহ, তুমিই কিছু করতে পারবে। আমি জানি।”
“এতো নির্ভরশীল মানুষ আমি হতে চাই না, কান্তা। কারো মন ভাঙার কারণ হওয়াটা আমার জন্য নিতান্তই বড্ড কষ্টের। তবে আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করবো। দেখি, কিছু করতে পারি কি না। আসি, আমি। হুম?”
“আসবে তো মাঝে মাঝে?”
“ইনশাআল্লাহ, সুযোগ পেলেই আসবো দেখা করতে। কথা বলতে। আর হ্যাঁ, বিয়েটা ভাঙার ক্ষেত্রে আমার চেয়ে তোতাপাখির অবদান বেশি। আবার আমার জন্যও তো কতকিছু করলো সে। কিন্তু তোমার নামে নালিশ দিলো। সব দোষ নাকি তার উপর চাপাতে চাইছো।”
“দেক নালিশ।”
মিটিমিটি হাসে ভাবযোগে। জিজ্ঞেস করে,
“তুমি ভালো আছো তো ওই বাড়িতে?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আসি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি কম করো। বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করো। পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, উল্টাপাল্টা কোনো ভাবনা যেন মাথায়ও না আসে।”
উপদেশ প্রদান করে চলে আসে শ্রাবণ। চেয়ারম্যান বাড়ির গেইট ছুঁতে না ছুঁতেই মাগরিবের আজান পড়ে। আফজাল হোসেন টুপি মাথায় মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিলেন। শ্রাবণ তার সামনে পড়তেই মাথার ঘোমটাটা আরেকটু সামনে টেনে সালাম দেয়। তিনি সালামের জবাব দিয়ে মুখে এবং হাতের ব্যাগে দৃষ্টি স্থির করেন। পরক্ষণে ধীর পায়ে বেরিয়ে যান। উঠুন হতে কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছে পরী। জিজ্ঞেস করে,
“ভাবিজান, কই গেছিলেন?”
“এইতো, পোশাকাশাক নিয়ে এলাম।”
“আমারে কইতেন, লগে যাইতাম।”
“তুমি গিয়ে কি করতে?”
“ইট্টু ঘুইরাও আইতাম, লগে কাপড়চোপড় নিয়া আইতাম।”
“থাক, এতো কষ্ট করতে হবে না। আমি বেশি দূরে যাইনি।”
“সাত্তার কাকাগো বাড়িত গেলেন না? চিনি।”
“আচ্ছা।”
ঘরে এসে ব্যাগ রাখে শ্রাবণ। মাগরিবের নামাজটাও আদায় করে নেয়। কিছুক্ষণ খাটে বসে থাকে এমনি এমনি। পাশেই অর্পা পড়ছে চেয়ার টেবিলে। তার দিকেও একটু নজর রাখছে। মেয়েটা পড়ে কম, ঝিমায় বেশি। পড়তে বসে একশো একটা হাই তুলে যাচ্ছে। পরীক্ষার প্যারায় যেন ঠেলে ধাক্কিয়ে পড়ছে। পরী এসে চা দিয়ে গেলো দুজনকেই। পারভীন একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছে মেয়ে পড়ে কি না। শিক্ষক এসে প্রত্যেক দিনই কেবল নালিশ দিতে থাকে। তার পড়া হচ্ছে না। একদিনও পরিপূর্ণ পড়া দিতে পারছে না। তিনি শ্রাবণের দিকেও তাকিয়েছেন। শ্রাবণ হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আম্মা, কিছু করতে হবে?”
নিরুত্তর চলে গেছেন পারভীন। আবার ফিরেছেন মিনিট দুই পরেই। শ্রাবণের কাছে এসে বসেছেন। হাতে এক জোড়া নতুন সিটি গোল্ডের চুরি। শ্রাবণ হাতের কাপ রেখে দিয়েছে তিনি পাশে বসার পরপরই। তাকিয়েছে চুরির দিকে। হাত টেনে এনে পারভীন চুরি দুটো দুই হাতে ঠেলে দিতে দিতে বললো,
“বউবেডি গো হাত খালি রাখলে সুন্দর দেখায় না। চুড়ি আর নাকের ফুল না থাকলে বেরাইম্মা লাগে। নাকই তো ফুডাও নাই। ফুল দেই ক্যামনে? চুড়ি হাতে রাইখো সবসময়।”
“জ্বি।”
চুড়ি মাপমতোই হয়েছে। হাত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তা দেখে যেন সন্তুষ্ট হলো পারভীন। মাঝে মাঝে বাড়িতে এক মহিলা আসে মেয়েদের সাজসজ্জার সামগ্রী আর গহনাগাঁটি নিয়ে। পারভীন বাজারে খুব একটা যায় না তাই, চুড়ি কিনতে হলে কিছুদিন পরপর তার কাছ থেকে কিনে নেয়। আরেক পরী তো আছেই৷ মহিলাকে দেখলেই পারভীনের আঁচল ধরে, “আম্মা, কানের দুল কিন্না দেন।”, “আম্মা, একটা কাজল কিন্না দেন।”, ” আম্মা, একটা আতর কিন্না দেন”। পারভীন মুখটা গম্ভীর রাখলেও এই ছোটখাটো আবদার মেটাতে কার্পন্য করে না। মাঝে মাঝে অর্পাও চায় টুকটাক। তার কানে সোনার দুল থাকায় তা চায় না ঠিক, তবে প্রায়ই লিপস্টিক আর ব্রেসলেট নেয় সে। আজ বিকেলে মহিলাটি এলেই আবার ঝেকে ধরেছিলো পরী। মনে করে শ্রাবণের জন্য চুড়ি জোড়াও নিয়ে নিলেন তিনি। পারভীন উঠে যাওয়ার আগে আরও বললেন,
“তোমার শ্বশুর তোমারে বাইরে যাইতে নিষেধ করছে। নামাজের পরে ঘরে আইসাই বলতাছে, বউ বাইরে যায় ক্যা? আমি তো তোমারে পাঠাই নাই কোনো কাজে। আগের জীবন ভুলে এইসব ঘুরাঘুরি বাদ দেও। এখন তুমি বাড়ির বউ। আর এইডা চেয়ারম্যান বাড়ি।”
“আমি জামাকাপড়গুলোই আনতে গিয়েছিলাম, আম্মা। আপনার ছেলের কাছে বলেই গিয়েছিলাম।”
“আর যাইয়ো না।”
চলে গেছে পারভীন। হ্যাঁ, না কিছুই বলেনি শ্রাবণ। তাকে আরও যেতে হবে হয়তো কত প্রয়োজনেই। সে আপাতত মনযোগ দেয় সিটি গোল্ডের চুড়িতে। ভালোই দেখাচ্ছে। একটু বেশিই ম্যাচুরিটি এনে দিয়েছে যেন এই অলংকার। বাড়ির বড় বউ! ঠোঁট কার্ণিশে হাসি ফুটে শ্রাবণের। চুড়ির নকশায় হাত বুলায়। এরইমধ্যে বাইরে কর্কশ পরীর গলা। সঙ্গে ভাসছে বকুল কাকার গলার আওয়াজও। লেগে গেছে দুজন কথা কাটাকাটির তুমুল ঝগড়া৷ শ্রাবণ বেরিয়ে ছিলো বারান্দায়। অর্পা মাথা চেপে জিদ্দি গর্জন তুলেছে মায়ের উদ্দেশ্যে। এই ক্যাটক্যাট একদম ভালো লাগে না তার। পারভীন আগে থেকেই ধমকাচ্ছিলো তাদের উভয়কেই। কে ছাড়ে কাকে? সে-ও জবাব দেয়। সে-ও জবাব দিতেই থাকে। শ্রাবণ পরীর হাত টেনে নিয়ে এলো অর্পার ঘরে। অর্পা কটমটে চোখ করে তাকায় পরীর দিকে। শ্রাবণকে বলে,
“এরে তুমি আপু ডাকতে বলছো? ছোট হইলে গলা টিপে মারতাম আমি তারে।”
“এহ, আপা! খালি আমারে কইয়েন না। হেই বেডারে গিয়া কইতে পারেন না কিছু?”
“শুরু তো তুই করছ। উনার বিচার আব্বু করবো। তোকে তো বিচারে পাওয়া যায় না। তখন লুকাস।”
“অর্পা, তুমি পড়ো।”
শ্রাবণ অর্পাকে পড়তে বলে পরীর হাত ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
“কেন লেগেছো ঝগড়া?”
“আরে হুদাত্তে। ভাতের মার দিতে গেছিলাম গরুরে। কইছি খালি, কাকা বালতিডা নেন। কয়, গামলায় রাইখ্যা আইতাম। কন খালি, হাতটা বাড়াইয়া খালি বালতিডা লইয়া যাইবো। হেইডা হেয় পারতো না। আমি কি গোয়ালে গোবরে গিয়া হাটমু এই অবেলায়? হেয় কি মশারিডা পরে টানাইতে পারতো না? ঘর থেইকা এতোখানি টাইন্না নিয়া যে দিয়া আইছি, ওইডাই তো হের সাত কপালের ভাগ্য। তিনবার কইছি, নিতে। নিলোই না। হেয় হের কাজ করেই। আলা দিছি দরজার সামনেই ঢাইল্লা। যা, আলা। গোয়াল পরিষ্কার কর গিয়া।”
“তুমি পারবে না যখন, বালতি রেখে চলে আসতে। অহেতুক ঝগড়া বাঁধিয়ে লাভটা কি হলো?”
“হুনেন, ভাবি। যত ভালা কাজই করি না ক্যা, দোষ ঘুরাইতে ঘুরাইতে সবাই আমার উপ্রেই দিবেন। জানি।”
“ঝগড়া একদিক থেকে লাগে না। দুইদিক থেকেই লাগে। বুঝতে পারছো? আমি যেন আর একদিনও না দেখি। নয়তো, আর দোষাদোষি করবো না। একদম বকুল কাকার ছেলের কাছে তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো।”
অর্পা আর শ্রাবণ সমানতালে হাসে। পরী যায় ক্ষেপে। একবার অর্পার দিকে তাকায়। আরেকবার তাকায় শ্রাবণের মুখে। শ্রাবণ কথার পরপর ফিক করে হেসেও বলে,
“বকুল কাকার ছেলে আছে কি না, তা-ও তো জানি না।”
হাসতেই থাকে শ্রাবণ। অর্পা জানতে সাহায্য করে ভাবিকে।
“আছে, আছে। তিনটা।”
“বিয়ে করেনি?”
“একটা মনে হয় করছে। আরও দুইটা বাকি।”
“বড়?”
“হ্যাঁ।”
শ্রাবণ হাত ছেড়ে দিয়ে অর্পার থেকে পরীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলে,
“তো পরী, সাবধান।”
“এহ! যাইবো নে এই পরী কাইল্লা বেডার ঘরে।”
“তো কেমন ছেলে চাও?”
“আপনে আর বড় ভাইজান যেই রকম।”
“তোমার ভাইজান তো আমার মতো না। তাই তোমার লোককেও তোমার মতো হওয়া যাবে না। একটু কম থাকাই ভালো।”
“তা-ও যাইতাম না। মইরা গেলেও ওই বকুল মিয়ারে আব্বা ডাকতাম না।”
রাগে হনহনিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায় সে। হাসে উপস্থিত দুজনেই। পরক্ষণে অর্পাও পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য হাসি কমিয়ে নিয়েছে। শ্রাবণও খাটে ফিরে নিজের একটা বই নিয়ে বসেছে। একটু পরেই ইফতেখার আসে বাড়িতে। দুজনকেই পড়ায় মনযোগী বেশে দেখতে পায়। কিছু শিঙারা নিয়ে এসেছে। দরজার সামনে থেকেই হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা অর্পার টেবিলে রেখে বলে,
“খেয়ে নে সবাই মিলে।”
শ্রাবণ চোখ তুলে তাকাতেই আবার চলে যেতে দেখেছে তাকে। অর্পা বই বন্ধ করে প্যাকেট খুলে এগিয়েছে ভাবির কাছে। শ্রাবণ পারভীনকে প্লেটে দিয়ে এসে পরীকেও ডেকে নিয়ে এলো। ইফতেখারকেও ডাকতো খাওয়ার জন্য, কিন্তু তাকে পাওয়া গেলো না। মহারাজ চলে গেছে তখন সাথে সাথেই। গরম গরম শিঙারায় ভালো একটা সময় কেটেছে ভাবি ও ননদিনীদের। গল্পস্বল্প চলেছে। এইতো, অর্পা ধীরে ধীরে কাছে আসছে শ্রাবণের।