শ্রাবণধারা পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
158

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
কিচিরমিচির চড়ুই আর তালগাছে বাবুইপাখির কলতানে জমে আছে ভোর। দুসপ্তাহ কেটে গেছে শ্রাবণের সংসার জীবনের। যদিও সংসারের কাজকর্ম তেমন কিছুই করা হয়ে উঠে না তার। নিজের কাজগুলো যথাযথ করে। আর মাঝে মাঝে একটু গোছগাছ। আজ রুটির খামি তৈরি করেছে শ্রাবণ নিজে। পারভীন সবজি কেটে নিচ্ছিলো। পরী ঝাড়মুছে ব্যস্ত ছিলো। পরে ঘরে বাইরে ঝাড়ু দিয়ে পরিচ্ছন্ন করে এসে হাত ধুয়ে রুটি বেলতে শুরু করলেই পারভীন সবজি রান্নায় ব্যস্ত হয়েছে। শ্রাবণ অবসর নিরিবিলিতে বাইরে হাঁটছিলো একাকী। দালান ঘরে চোখ পড়তেই যেতে ইচ্ছে হয়। মিস্ত্রিরা এখনো কাজে আসেনি। তবে দালানের কাজ এগিয়ে চলেছে যথাযথ। তাই একটু দেখতে যায় ভেতরটা কেমন বিন্যস্ত করা হয়েছে। খুঁটির ফাঁকে ফাঁকে ভেজা বালিতে হাঁটে সে। বড়সড়ই রাখা হয়েছে একেকটা রুম। শহরের মতো চাপাচাপি নেই একদম। বারান্দাও রাখা হয়েছে প্রশস্ত। শ্রাবণ সিঁড়িতে পা ফেলে ছাদেই যায়। নিরিবিলি আর খোলামেলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আকাশ ছোঁয়াটা বড্ড উপভোগ করে সে। তারউপর গ্রামের এই শীতল পরশ, পাখিদের গুঞ্জন আর প্রশান্ত নিশ্বাস! সবই তার চমৎকার উপভোগ্য। বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে এক কাপ চা চাইলেন আফজাল হোসেন। পরী চা এনে দিলে চুমুকে চুমুকে ভাবনায় মত্ত হতে লাগলেন। হঠাৎ নজর উঠে বিপরীত প্রান্তের ছাদে। নিরিবিলিতে আপন মনে হাঁটছে তার পুত্রবধূ। শুধু হাঁটছেই না। কানে মুঠোফোন চেপে রাখতেও যেন দেখছেন। ঠোঁট নড়ছে, কথায় মনযোগী হয়ে পায়চারি করছে। ছেলেরা ঘরে ঘুমায়। মেয়েটা সদ্য ঘুম থেকে উঠে হেলে দুলে তার মায়ের কাছে গেলো। পারভীন আর পরী রান্নাঘরে। অর্থাৎ, পুত্রবধূ সেই ছাদ প্রাঙ্গণে একা। ফোনটাই তার সঙ্গী। আফজাল হোসেন বারান্দায় বসে থেকে সেদিকেই দৃষ্টি গেঁথে রাখেন। চুমুকে চুমুকে কাপ খালি করেন। পরীকে ডাকেন, কাপটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। এমনি খালিদ হাজির হয়েছে মামার সামনে। সালাম দিয়েছে। জিজ্ঞেস করছে,
“দিপুর আজ সিমেন্টের অর্ডার দিতে যাওয়ার কথা। যাইবো না?”
“হুম। দশটার পরে ব্যাংকে যাইবো। তারপরে যাইবো।”
“ও, আচ্ছা। ফোন দিতাছিলাম তারে। ধরে না।”
“ঘুমায়।”
“রাস্তার কাজ আজ দুপুরের মধ্যেই শেষ হইবো মামা। সবকিছু খুব পোক্তভাবে করার চেষ্টা আমি করছি। যদ্দুর সাধ্যে কূলায়ছে, করছি। বিকেলে একবার ঘুইরা দেইখ্যা আইসেন?”
“যামু নে।”
“মামা, কইছিলাম কি… মাস তো শেষ।”
“হু, মনে আছে। ইফতি টাকা উঠাইলেই বেতন দিয়া দিমু সবার। বিকালে আসিস।”
“আচ্ছা।”
“এর খবরটা আমারে সংগ্রহ কইরা দে।”
শান্ত, গম্ভীর গলার কথাবার্তা চলছে তাদের। কার খবর তা তাৎক্ষণিক বুঝে উঠে না খালিদ। মামার স্থির চোখের অনুসরণ করে ছাদে শ্রাবণকে দেখতে পায় সে। পরক্ষণে গলার স্বর আরও নিচু করে বলে,
“সাত্তারগো বাড়িত থাকতো, মামা। মজিদা মামির দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কাজের সন্ধানে আইছিলো। তারপর ক্যামনে জানি দিপুর ঘাড়ে বইসা পড়লো। সবই বয়সের দোষ মামা। কি আর কইবেন। আর মাইনা নিছেনই যখন…”
“তোরে ওই ইতিহাস শুনাইতে বলি নাই। এইসব আমিও জানি। তার পরিবারের খোঁজ কর। ক্যামনে কই বড় হইছে, সেই তথ্য সংগ্রহ কর।”
“আচ্ছা, আমি যামু নে মজিদা মামির সঙ্গে কথা কইতে। উনি ছাড়া তো কেউ খবরাখবর দিতে পারবো বলে মনে হয় না। আসি তাইলে এখন। দিপু বের হওয়ার সময় যাওয়া লাগলে কইয়েন, যামু নে।”
খালিদ চলে যায়। আফজাল হোসেন তাকিয়েই থাকে সেদিকে। ভাবেন অনেক কিছুই। হঠাৎ আসাটাই যেন তার হঠাৎ ভাবনার কারণ। এই হঠাৎ এর পরিধিই না কত বিশাল, তার সন্দেহ। যদিও সন্দেহের নিশ্চয়তা তার নেই। তবে চেষ্টাটুকু আছে৷ তারই যথাযথ প্রয়োগ সে করে ছাড়বে। যদি উদ্দেশ্যহীন হয়, তবে তো ভালোই। আর যদি তা না হয়, তবে এর শেষটা পর্যন্ত পৌঁছানো এবং ব্যবস্থার বাস্তবায়ন তারও কর্তব্য। হোক তা কোনো চেয়ারম্যান হিসেবে কিংবা পরিবারের কর্তা হিসেবেই। ছাদ থেকেই শ্রাবণ দেখতে পায় মিস্ত্রি লোক আসতে শুরু করেছে গেইট দিয়ে। তাই নেমে আসে সাথে সাথেই। আফজাল হোসেনকেও বারান্দায় বসা অবস্থায় দেখে। ইফতেখার ঘুম থেকে উঠেছে এই মাত্র। শ্রাবণ এগোতে এগোতে বলে,
“দিনের চার ওয়াক্ত নামাজ আপনার আদায় হয়, তাই না?”
“ডেকে দিতে ফজরে।”
“আম্মা ডেকেছিলো। আপনাদের কানে পৌঁছায়নি।”
“ঘুম এখনো ভাঙছিলো না। মশার কামড়ে উঠে গেলাম।”
বড় হাই তুলে ইফতেখার। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“মশারি টানাননি?”
“হ্যাঁ। মশা ঢুকেছে কোনোভাবে।”
হাতের ফোনে চোখ যেতেই জিজ্ঞেস করে,
“এটা কার ফোন?”
“আমারই তো। দেখেননি?”
“উহুম। ফোন নম্বরও তো দাওনি।”
“ফোন দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না। তাছাড়া ফোনটায় সমস্যা। অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। আবার কখনো ভাগ্যের মতো খুলে যায়।”
“ফোনে তো তোমার এমনিতেও প্রয়োজন দেখি না। কার সাথে কথা বলো?”
“বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে না? একসাথে পড়াশোনা করেছি। খবরাখবর রাখতে হয়।”
“তুমি এখনো পড়ো? আমি তো ভেবেছি এমনিতেই বই পড়ো।”
“এখন এমনিতেই পড়ছি। সেমিস্টার শেষ হলো। রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি। আপনি নাশতা করবেন এখন?”
“হ্যাঁ।”
শ্রাবণ গলার স্বর একটু উঁচিয়ে পিছু ফিরে আফজাল হোসেনের উদ্দেশ্যে বলে,
“আব্বা, আপনাকে নাশতা দিবো?”
“এখন না। আধঘন্টা পরে খাই।”
“ঠিক আছে।”
শ্রাবণ রান্নাঘরে চলে গেছে ইফতেখারের নাশতা নিয়ে আসতে। আফজাল হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে ছেলেকে বললেন,
“খালিদ আইছিলো। মিলে তারে নিয়া যাওয়ার হইলে ডাকতি।”
“মিলে আমি একাই যেতে পারবো। ব্যাংক থেকে একবারে ওদিক দিয়ে সিমেন্ট অর্ডার করে চলে আসবো। চেকটা ঠিক করে রাখছেন, আব্বা?”
“হু, নিয়া যাইছ।”
বারান্দা ছেড়ে দালানের দিকে হাঁটে আফজাল হোসেন। মিস্ত্রিদের সাথে কথা বলবেন কাজকর্মের ব্যাপারে। ইফতেখার বারান্দায় দাঁড়িয়েই আড়মোড়া ভাঙে। হাতের আঙুল জড়ো করে মটকায়। শ্রাবণ প্লেটে রুটি সবজি নিয়ে এগিয়েছে অর্পার ঘরে। মন্তব্য রাখে,
“আপনার ভুঁড়ি বেড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখি। আরও সকালে উঠে হাঁটা দরকার। আগে থেকেই ফিটনেস ধরে রাখা ভালো।”
মৃদু হাসি স্পষ্ট হয় ইফতেখারের মুখে। পিছু পিছু এসে অর্পাকে দেখতে পায় না ঘরে। তাই জিজ্ঞেস করে,
“অর্পা কোথায়?”
“রান্নাঘরে। নাশতা করছে আম্মার হাতে।”
“তুমি করেছো?”
“পরে।”
“এখনই খাও। আমার সাথে।”
“আপনি খেতে থাকুন।”
পাশে বসে গ্লাসে পানি ঢেলে দেয় শ্রাবণ। ইফতেখার এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে নিজের মুখে দেওয়ার আগে শ্রাবণের মুখের সামনে ধরে। শ্রাবণ উপেক্ষা না করে হাসিমুখে নিয়ে নেয় খাবার। কিছু বলবে ভাবছিলো। এখনই বলবে কি না, তা-ও ভাবছিলো। ইফতেখার নিজের মুখে খাবার তুলে দ্বিতীয়বারের মতো আবার সামনে ধরে রুটির টুকরো। শ্রাবণ হেসে উঠে দাঁড়ায় সাথে সাথেই।
“আরে! আপনি খান। আমি আমার প্লেট নিয়ে আসছি এখনই।”
হাসিমুখে চলে যায় সে। নিজের নাশতা নিয়ে এই ঘরে হাজির হয় পুনরায়। একসাথেই নাশতা করে নিবে। খেতে খেতেই বলে,
“কিছু বলতে চাইছিলাম।”
“হুম?”
“আব্বা বলেছিলো সেদিন, কাজের সন্ধান যেন না করি। কিন্তু আমার তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার বলে মনে করি। আপনি কি বলেন? আমি কি চাকরি করবো না?”
“উহুম।”
“টুকটাক প্রয়োজন তো আমারও হতে পারে।”
“যখন যা প্রয়োজন, আমায় বলো।”
“আমার দশ হাজার টাকা লাগবে।”
শুরুতেই দশ হাজার এবং সাথে সাথেই টাকা চাওয়াতে কিঞ্চিৎ বিস্ময় যেন উপস্থিত হলো ইফতেখারের মধ্যে। খাবারের প্লেটের মনযোগ শ্রাবণের চেহারাতে বসালো। তবে স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলো,
“কেন?”
“আমার ইউনিভার্সিটির ফি বকেয়া আছে। কিছু মওকুফ করে আর কিছু পরিশোধ করে এডমিট কার্ড সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু সব তো আর হয়ে উঠেনি। সময় নিয়েছিলাম। পরিশোধ করা দরকার। দুদিন ফোন দিয়ে ফেললো।”
ইফতেখার দৃষ্টি নামিয়ে আনে প্লেটে। খাওয়ায় মনযোগ দেওয়ার আগে বলে,
“আচ্ছা।”
শ্রাবণও চুপচাপ খেতে থাকে এবার। ইফতেখার খাওয়া শেষে উঠে যাওয়ার আগে বলে,
“আবার শহরে যেতে হবে তবে?”
“যেতে তো হবেই। না গেলে কিভাবে?”
“ব্যাংকিংয়ে হয় না?”
“উহুম। আমাকে গিয়ে রিসিট দেখাতে হবে না? সমস্যা নেই, হাতে সময় নিয়ে চলে যাবো। সকাল সকাল রওনা হলে বিকেলের মধ্যেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ।”
“আচ্ছা, আমি নিয়ে যাবো। সমস্যা নেই।”
মাথা হালকা নেড়ে সম্মতি প্রদান করে খেতে থাকে শ্রাবণ। ইফতেখার বেরিয়ে গেছে। শ্রাবণ খাওয়া শেষে প্লেট রেখে আসে। বারান্দায় বিপুর সাথে দেখা। শ্রাবণকে দেখেই বিড়বিড় করে বললো,
“ভাবি, ব্যাপারটা মাকে জানানো দরকার।”
শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে,
“তো জানান।”
“আপনি আছেন কোন কাজের জন্য?”
“আমি? আমার কাজের জন্য আছি।”
মৃদুস্বরে একটু হেসে নেয় শ্রাবণ। পরক্ষণে বলে,
“সুযোগ বুঝে জানাবো৷ তবে জানাজানিটা তার দিক থেকে আগে হওয়া ভালো ভাবছি। পরিস্থিতি যে কূলেই যাক না কেন, ওদিক থেকেই যাওয়া দরকার।”
শ্রাবণ চলে যায়। বিপুর মুখাবয়বে ঘিরে দুশ্চিন্তা। কি করবে, বুঝেই আসে না যেন। প্রেম এতো না ধরি আর না ছাড়ির মতো পীড়াদায়ক হয়ে যাবে জানলে হয়তো জীবনে প্রেমে জড়াতোই না। এই যে এখন মন চাইছে আবার কান্তার দেখা পেতে, ঘরের খবরাখবর জানতে। কি না কি হলো? নতুন কিছুই না আবার ঘটলো? দুদিন যাবত কলেজেও যেতে দেখা যায় না তাকে। বিপু ডানে বামে দেখতে দেখতে এসে থামে কান্তাদের বাড়ি সম্মুখে। জড়তা-সংকোচে বাঁধা পা দুটো এগিয়ে এনে দাঁড়ায় মোটা আম গাছটায় হাত ভর করে। জনশূন্য লাগছে বাড়ি। অথচ ঘরের দুয়ার খোলা। কিন্তু কোনো মানব ছায়ার উপস্থিতি নেই। শ্রাবণ এই বাড়ি থাকতে এতোটা জড়তায় জড়াতে হয়নি তাকে। কিন্তু নিজ প্রয়োজনে এগোতে মন থেকে হাজারটা বাঁধা আসে৷ একবার মনে হয়, ডেকে উঠুক। আবার মনে হয় ট্যাপট্যাপ পায়ে দুয়ার পর্যন্তই যাক। অবশেষে সিদ্ধান্ত এলো ফিরেই যাক। ঘুরেও দাঁড়ালো। এক পা বাড়াতে না বাড়াতেই সামনে পলিতে শাকসবজি হাতে সাত্তার হাজির। চলতে চলতেই তার ভ্রু কুচকে গেছে একটু দূর হতে। নিকটবর্তী হয়েই সন্দেহভাজন গলায় জিজ্ঞেস করে,
“তুই এনে কি করছ?”
“কিছু না।”
মাথা চুলকাতে চুলকাতে দ্রুত প্রস্থান করে বিপু। খানিক এগিয়ে আবার পিছু ফিরে ফিরে দেখে। ঘনঘন পা ফেলতে ফেলতে অগোচরে দাঁতে দাঁত চেপে হাসে এই ভেবে যে, বলে দেওয়াই বুঝি উচিত ছিলো ‘আপনার মেয়েকে দেখি উঁকিঝুঁকি মেরে।’ সাত্তার এক মুহুর্তই দাঁড়িয়ে ছিলো বিপুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। পরক্ষণে ঘরে এসে মা মেয়েকে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখে। ভ্যান নিয়ে বের হবে, তাই শিরিন চটজলদি তার খাবারটা সামনে হাজির করে। বাইরে পানি ছিটা দিয়ে হাতটা ধুয়ে নেয় সাত্তার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছে খেতে। শিরিন তাল পাখায় বাতাস করছে গরম ভাতে। সাত্তার জিজ্ঞেস করে,
“এই ছ্যাড়াডায় একধারা উঁকি মারে ক্যা এই বাড়ি?”
“কোন ছ্যাড়া?”
“চেয়ারম্যানের পোলা। ছোটডায়।”
“আমিও দেখছি। শ্রাবণ থাকতে একাধারে আসাযাওয়া করতো।”
“হেই মাইয়া তো বাড়ি নাই এহন। আমি আরও অনেক আগেই দেখছি। আজকাও দেখছি। মতলব কি হের? হাতেনাতে ধইরা কান তলায় দুই তিন ঘা মাইরা জিগামু একদিন?”
“এইসব কি কথা কন। আন্দাজে মান্দাজে মারতে যাইবেন ক্যা?”
“কোনো মতলব ছাড়া তো আইয়া খাঁড়ায় না। আমরা কয়দিন যাই চেয়ারম্যানের বাড়ি উঁকি মারতে? হের পোলায় আয়ে ক্যা তবে? নাকি কান ধইরা টাইনা চেয়ারম্যানের সামনেই খাড়ামু? কি কছ?”
“বেশি কথা কইয়েন না তো। চুপচাপ খান৷ এইসব কোনো ঝামেলা টামেলা কইরেন না কইলাম। হেয় উঁকি মারছে, তাতে আমগো কার কি উইড়া গেছে? যার যার রাস্তা হেয় দেখেন। ঝামেলা যত্ত এড়াইয়া চলা যায়।”
“মাইয়ারে সাবধান করিস।”
আর কথা বলে না শিরিন। ক্রমশই চুপ হয়ে যায়। কিছু উত্তেজনার ভারও পড়ে মস্তক পাড়ায়। মেয়েকে সাবধান! তবে কি মেয়ের দিকে বিপু ছেলেটার চোখ যায়? এমনটা তো ভাবেনি সেভাবে। হতেও তো পারে। আবার না-ও হতে পারে। অযথা অন্যের উপর দোষ তোলাও দায়। তবে সাবধান থাকাটা মন্দ নয়। অবশ্যই থাকতে হয়। আশপাশের পরিস্থিতিও তো কত কিছু বুঝিয়ে যায়, শিখিয়ে যায়। এই যেমন নিকটতম ঘটনা শ্রাবণ আর ইফতিকেই ধরা যায়! না, না। এ হয় না। গরীবের মানসম্মান এমনিতেই তুলোধুনোর পর্যায়। তারা বড় ঘরের মানুষ। তাদের সম্মান অর্থের অংকে পরিমাপ করা হয়। গরীবের অর্থ ও সম্মান উভয়ই বহু পরিশ্রমে উপার্জন হয়। এতো সহজে ক্ষুন্ন হতে দেওয়া যায় না উপার্জন তথা অর্জন। সাত্তার প্লেট খালি করে তাতে হাত ধুয়ে নেয়। বেরিয়ে যায় ভ্যান টেনে। শিরিন প্লেট ধুয়ে ঘরে যায়। কান্তাকে মনযোগে শাক বেছে নিতে দেখে। প্লেট রেখে পাশেই পিড়িতে বসে শিরিন। একটু সাবধানতাজনিত বাক্যের প্রয়োগ করতে চায়। শাকে হাত দিয়েই জিজ্ঞেস করে,
“বিপু কি কোনো কারণে তোরে খোঁজে রে?”
কান্তা বাবার কথা সবই শুনছিলো এপাশে বসে। তাই মায়ের মুখে বিপুর কথা শুনেও বিন্দুমাত্র বিস্ময়ের কম্পন উঠে না তার মাঝে। তবে হৃদস্পন্দনটা ঢিপঢিপ তান ধরেছে। মুখটা নিশ্চুপ থাকে তার৷ শিরিন পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“রাস্তাঘাটে কোনো সময় কথা কইতে চেষ্টা করছে তোর লগে?”
তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনা কান্তার মুখে। বিপুর দেওয়া পরামর্শ বেশ মনে পড়ে। ইচ্ছে করে, এখনই বলে দেক। বিপু বলেছিলো তো, ইনিয়েবিনিয়ে না গিয়ে যেন সরাসরি বলেই দেয়। কিন্তু এর পর কি হবে, তা ভেবেই আর বলার সাহসটুকু মনে আসে না। শিরিন মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে যেন আরও চিন্তিত হয়ে যায়। সত্যিই তবে সাত্তারের ধারণা ঠিক কি না ভেবেই গম্ভীর হয়ে উঠে। গম্ভীরমুখে এবার বলে,
“কথা কছ না ক্যা?”
“কি?”
“কি জিগাইলাম, কানে যায় নাই?”
চোখ দুটো ভিজে আসে কান্তার। মাথা আরও নিম্নমুখী করে মিনমিনিয়ে বলে,
“উনি পছন্দ করে আমাকে।”
“পছন্দ করে মানে!”
কন্ঠ এবং দৃষ্টি উভয়ই ধারালো হয়ে উঠে। মননশক্তির দিক থেকেও ক্রোধান্বিত হতে সময় নেয়নি শিরিন। কান্তার মাঝে এক প্রকার ভয় জন্মে। নিজেকে লুকানোর ভয়। কিন্তু পেরে উঠে না ঠিক। শিরিন যেন লুকানো ভয়ের মুখোশটা ছিনিয়ে নিয়ে উন্মোচন করে তাকে।
“কবেত্তে পছন্দ করে? জানাস নাই ক্যা? হেয় পছন্দ করে আর তুইও করোছ? এইজন্যই বাড়ির বাইরে দাঁড়াইয়া উঁকিঝুঁকি মারে?”
টপ টপ করে দুই চোখ হতে দুই ফোঁটা অশ্রু বাধাহীন মাটিতে পড়ে। শিরিন মাথায় ঠুকে জবাব চায়,
“কথা কছ না ক্যা?”
“আমিও পছন্দ করি তারে। আমার বিয়া দেওয়ার হইলে তার সাথেই দিবা।”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ১৭
(নূর নাফিসা)
.
.
মায়ের কাছে পরপর কয়েকটা চড় খেয়ে ভাত খাওয়া আর হয়ে উঠেনি বেলা জুড়ে। কলেজ যাওয়ারও নাম নেই। সারাদিন গুটিসুটি মেরে বসে রইলো ঘরের এক প্রান্তে জানালার ধারে। মা-ও আজ ডাকে না, “কান্তা, ভাত খাইয়া যা!”
তারও মন চেয়ে বসে না, “দুই মুঠো ভাত গিলে আসি।” কেবলই দুঃখ গিলে যায় কিশোরী একাকী। প্রণয় পীড়ার দুঃখ।
পরী আজও শাপলা তুলে এনেছে এক মুঠ। শাপলা বিলে যায়নি যদিও। নৌকা ঠেলে নিকটতম লতাচ্ছাদিত ক্ষেত থেকেই একটা দুইটা করে কুড়িয়ে এক মুঠ সংগ্রহ করে এনেছে একাকী। পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত কাদা মাখিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছে উঠুনে। শ্রাবণের উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাবি, দেখেন শাপলা আনছি। ভর্তা করবেন নি?”
“একা একা শাপলা নিয়ে চলে এলে? বড্ড সাহস তো তোমার। তুমি না ভুতে ভয় পাও?”
“দূরে যাই নাই বেশি। ভর্তা খাইবেন নি কন।”
“দাও তবে।”
“খাঁড়ান, ধুইয়া আনি।”
পরী শাপলা ও নিজের হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার করেই বারান্দায় আশ্রিত হলো। শ্রাবণ মোড়া টেনে বসেছে বারান্দার এক কোণেই। পরী ট্যাপা পায়ে রান্না ঘরে যায়। বোল হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকায়। অল্প কিছু তেতুল আছে প্যাকেটে। আম্মা দেখলেই চেঁচানো শুরু করবে। তাই অগোচরে পেট পর্যন্ত নেওয়ার পরিকল্পনা করে। পরে জানালেও সমস্যা নেই। কিন্তু শুরুতেই সমস্যা বাঁধানোর কোনো মানে হয় না। খায়েস পূরণ করার দরকার আছে। বোলের আড়ালে হাতের মুঠোয় তেঁতুল আর লবনের কৌটা নিয়ে চলে এসেছে বারান্দায়। পারভীনকে নিজ ঘরে বিশ্রাম নিতে দেখা গেলো। তাই চুপচাপ বসে গেছে পরী শ্রাবণের পাশে। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“লুকোচুরি করা হচ্ছে যেন? আম্মাকে এভাবে দেখে এলে কেন?”
“মরিচ পোড়া দিমু, তাই।”
দাঁত বের করে হাসি দিয়ে আবার চলে যায় পরী। রান্নাঘর হতে শুকনো মরিচ পোড়ার ঘ্রাণ পাচ্ছে শ্রাবণ বারান্দায় বসে। দূর থেকে এই ঘ্রাণটা তার ভীষণ ভালো লাগে। এখনো লাগছে। সে শাপলা কুচিকুচি করে নিয়েছে। পরী মরিচ এনে দিলে নিজ হাতেই ভর্তা করেছে। আলাদা বাটিতে অর্পার জন্য রেখে বললো,
“পরী, আম্মাকে জিজ্ঞেস করে এসো খাবে কি না।”
“ধুর! আম্মা এইসব খায় না।”
“সেদিন যে খেলো?”
“ক্যামনে ক্যামনে জানি খাইছে।”
“আজও খেতে পারে। যাও, জিজ্ঞেস করে এসো।”
পরীর ইচ্ছে করছিলো না পারভীনকে জিজ্ঞেস করুক। তবুও দুয়ারে দাঁড়ালো। মন চাইছিলো না পারভীন খেতে রাজি হোক। তবুও জিজ্ঞেস করতেই পারভীন বললো এক চিমটি দিয়ে যেতে। পড়লো মহা জ্বালায়। আলাদা বাটিতে করে তার জন্য একটু এনে দেয় এই ঘরে। বাটি হাতে দিতেই পারভীন বলে,
“তেঁতুল গুলা শেষ করছত?”
“হইছে আম্মা, অহেতুক গলা বাড়াইয়েন না। আমি একলা খাই নাই। আপনেও খাইতাছেন। আপনের পুত্রবধূও খাইতাছে। খাইবো, খাইবোই। আবার হিসাব কইষা খায়।”
শেষ কথা বিড়বিড়িয়ে বলে দ্রুত প্রস্থান করে পরী। দ্বিতীয় ঝাড়ি কানে নেওয়ার কোনোরকম ইচ্ছে নেই তার। দুপুরের পরপরই ইফতেখার বাড়ি ফিরেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিলো তখন। তার পোশাকাদি বৃষ্টিতে ভেজা। ভেজা মাথার চুলগুলোও। এসেই বাবাকে খুঁজলো। না পেয়ে গোসলে চলে গেলো। ঝটপট গোসল সেরে চলে আসায় শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“এতো তাড়াতাড়ি গোসল শেষ?”
“কোনোমতে একটু পানি ঢেলে এসেছি। মাথা ব্যাথা করছে প্রচুর।”
“সে কি! কেন?”
“এমনি হঠাৎ।”
মাথা মুছতে মুছতে ঘরে চলে যায় ইফতেখার। শ্রাবণ দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
“খাবার নিয়ে আসবো?”
“উহুম। খাবো না এখন।”
বন্ধ জানালার কপাট খুলে দিয়ে বুকে ভর করে শুয়ে পড়ে ইফতেখার। শ্রাবণ দরজায় দাঁড়িয়েই চিন্তিত মুখে দেখে তাকে। পরক্ষণে পারভীনের কাছে যায়,
“আম্মা, কালোজিরার তেল না আছে? দিন তো একটু। উনার নাকি মাথা ব্যাথা করছে।”
“কার? ইফতির?”
“হ্যাঁ।”
তেলের কৌটা হাতে তুলে দেয় পারভীন। শ্রাবণ পুনরায় ইফতেখারের কাছে আসে। পাশে বসে মাথায় তেল মালিশ করতে শুরু করে। একবার শুধু চোখ খুলে দেখেছিলো সে। পুনরায় চোখ বুজে নিয়ে নিঃসঙ্গ লড়াই করছে মাথাব্যথার সাথে। খনিক বাদেই পারভীন আসে। শ্রাবণ তখনও মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো। পারভীন কপাল ছুঁয়ে দেখে দেহের তাপমাত্রা। হালকা গরম।
“জ্বর আসে নাকি! ইফতি, ভাত খাবি না?”
“পরে।”
“ক’টা ভাত খেয়ে ঘুমায় থাক?”
“না। আব্বা আসছে?”
“হু, এইমাত্র এলো।”
চোখ খুলে উঠে যায় ইফতেখার। ড্রয়ার থেকে টাকার প্যাকেট নেয়। ওয়ালেট থেকে এক টুকরো কাগজও খুঁজে নেয়। পারভীন স্বগোতক্তি করতে করতে বেরিয়ে যায়,
“পোলাপান খাওয়াদাওয়া, চলাফেরার ঠিক রাখবি না। বৃষ্টি বাদলায় তাকাবি না। খালি অসুস্থ হইয়া একেকজন ঘরে পড়বি।”
পরক্ষণে ইফতেখার যায় আফজাল হোসেনের নিকট। শ্রাবণ বিছানার এক প্রান্তে বসে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে। এইযে পারিবারিক একটা মেলবন্ধন। সুখেদুঃখে সদস্যদের পাশে থাকা কতই না সুন্দর, সুখকর। ভাবতে গেলে ব্যাথাও লাগে, আনন্দও হয়। অসুস্থ হলে বাবামায়ের উত্তেজনা দেখা, মায়ের মুখে ধারালো ও ব্যাথাতুর কিছু বাক্য বোধহয় প্রত্যেকেরই শোনা। মায়েরা সেবা করলেও বকা দিয়ে করেন। মাকে পাশে না পেলেও স্মৃতিগুলো জড়িয়ে থাকে শ্রাবণ প্রাণে। ক্ষণে ক্ষণে ফুল্কে উঠে ঘটনা ক্রমে কিংবা অকারণে। বাবাকে অর্ডারকৃত সিমেন্টের ম্যামো আর টাকার হিসেব বুঝিয়ে দিয়ে ইফতেখার ফিরতেই শ্রাবণকে আনমনে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে লক্ষ্য করে। দরজা আটকে এগিয়ে আসে শ্রাবণের পাশে। ধ্যানভঙ্গ হয় তার।
“কি ভাবছো?”
“কিছু না।”
“কিছু তো অবশ্যই।”
মুচকি হাসিতেই কথা চাপিয়ে নিতে চায় শ্রাবণ। ইফতেখার শ্রাবণের হাতে টাকা দিয়ে বলে,
“তোমার দশ হাজার।”
“ধন্যবাদ।”
সৌজন্যমূলক আরও এক টুকরো হাসির উপস্থিতি ঘটে শ্রাবণের মুখে। ইফতেখার ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে পুনরায় শ্রাবণের হাত তার মাথায় তুলে আনে। ব্যাথার যন্ত্রণা দূরীকরণে ভালোই লাগছিলো তখন। নিশ্চুপ আবদারে মুচকি হেসে বিছানার কোণে শ্রাবণ টাকা গুজে রেখে আরাম করে বসে৷ মাথা মেসাজ করে দেয় ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না অনুধাবন করতে পারে ইফতেখার ঘুমিয়ে গেছে।
মাঝারি তাপমাত্রার জ্বর ঠিকই পাকড়াও করেছে ইফতেখারকে। গত বিকেল থেকে ঘুমাচ্ছিলোই আজ প্রাক-দুপুর পর্যন্ত। মাঝখানে একবার খাওয়া দাওয়ার বিরতি ছিলো মাত্র। তবে ঘুমও খুব স্বস্তির হয়নি। ভাঙা ভাঙা জ্বরযন্ত্রনাময় ঘুম। এগারোটার দিকে পারভীন ডেকে তুলে তাকে।
“ওঠ। আর কত ঘুমাবি? ওইদিকে বউ কই গেছে, সেই খেয়াল আছে?”
ভ্রু মাঝে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ে ইফতেখারের। কোনোরকম অপেক্ষা ছাড়াই জিজ্ঞেস করে,
“কে? শ্রাবণ?”
“তো আর কে?”
“কোথায় গেছে?”
“আমি কি জানি। আমার কাছে বইলা যায় কিছু? সকাল থেকে চেহারা দেখা যায় না। কোন দিকে গেছে, বলতেও পারি না।”
“কাল রাতে বাড়ি ছিলো না?”
“রাত্রে তো ছিলোই। ভোরেও নামাজ পড়লো দেখলাম। এরপর আর খবর নাই। বউ মানুষ এমন হয়? আমি না করলাম, শ্বশুর না করলো তবুও বাইরে বাইরে দৌড়াদৌড়ি করে। ক্যা? আমি কি কোনো কাজে পাঠাই তারে? এমন হুটহাট বিয়া সাইরা যে আইলো, ঘরেও তো আয়েশ কইরাই রাখতাছি। তারপরেও কথা শুনতো না ক্যা? সকাল নাই, সন্ধ্যা নাই। যখন ইচ্ছা বের হইয়া যায়। কোনো আতাপিতা মানে না। সেদিনও কতক্ষণ কাটাইয়া আইলো হেই বাড়ি। আজকাও বুঝি গেছে। আমি কয়দিন যাই বাড়ি বাড়ি গল্প করতে? আর নয়া বউ হইয়া করে তামাশা।”
পারভীন মশারি টেনে গুটিয়ে নিতে নিতে বকবক করতে থাকে। ইফতেখার উঠে বসে ধীরে ধীরে। ওষুধের ক্রিয়ায় জ্বর তেমন বজায় নেই শরীরে, কিন্তু সমস্ত শরীরই ব্যাথা হয়ে আছে যেন। উঠে বসে সে চিন্তামগ্ন হয়। ভোর হতে এতোটা সময় পর্যন্ত ঘরে নেই? শ্রাবণ এমনটা না করলেও তো পারে। কি দরকার, মায়ের পছন্দের বাইরে চলে যাওয়ার। গেলেও তো অল্প সময়ের জন্য যেতে পারে মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে।
ইফতেখার হাতমুখ ধোয়ার নিমিত্তে বাইরে আসে। পরীকে রাস্তা থেকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
“শ্রাবণ কোথায় রে?”
“জানি না তো। আমিও খোঁজতাছি ভাবিরে।”
“মজিদা কাকিদের বাড়ি গেছে হয়তো। ডেকে আয়।”
“হেই বাড়িত্তেই আইলাম। আম্মা পাঠাইছিলো। নাই মজিদা কাকির কাছে। যায়ই নাই আজকা। পাশের বাড়িও দেইখ্যা আইলাম।”
ইফতেখারের ভ্রু মাঝে এইবার দুশ্চিন্তার উপস্থিতি ঘটে। সে অর্পার ঘরে যায় দরজা ঠেলে। শ্রাবণের বই আছে এখানে। কাপড়চোপড়ও আছে। কিন্তু শ্রাবণ নেই। ইফতেখার তার কাপড়ের ব্যাগটা একটু নেড়েচেড়ে দেখে। কোনো টাকা পয়সা নেই। ফোনও নেই। শ্রাবণের কাঁধে বহন করার ব্যাগটাও নেই। সে কি টাকা পরিশোধ করতে ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলো নাকি একা একাই? কাউকে বলে গেলো না কেন? নাকি আবার এমনি কোনো প্রয়োজনে বাজারের দিকে গেলো? ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসে। হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে। মাকে জানায়, শ্রাবণ সম্ভবত তার ইউনিভার্সিটিতে গেছে ফি পরিশোধ করে। তাকে বলেছিলো আগে। পারভীন নাখোশ ইফতেখারের কথায়। বাড়ির বউ এখন সে। এমন মর্জিতে চলাফেরা কাম্য নয় তার কাছে। যেখানেই যাক, অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনবোধ তার মধ্যে কেন নেই? শিক্ষিত মানুষ, এইটুকু শিক্ষা কি গ্রহণ করা হয়ে উঠেনি? আর একা একা বাইরেই যাবে কেন? আগের জীবন যেমনই থাকুক, এখনকার হিসেব তো আলাদা। ইফতেখার কোনো কথা বলে না। মনের সন্দেহে চলে যায় বাজারের দিকে। ওদিকেই গেছে কি না আবার, দেখা যাক। ফোন নম্বরও নেই সাথে, যে ফোন দিবে। এদিকে অশান্ত পরী হায়হুতাশ শুরু করেছে বাড়িতে। ক্ষণে আফজাল হোসেনকে চা দিতে গিয়ে বিস্মিত মুখে খবর দিচ্ছে,
“কাকা, ভাবিরে তো খুইজ্জা পাওয়া যাইতাছে না। সকাল থাইকা।”
ক্ষণে বকুল কাকার কাছেই এমন উক্তি ছড়াচ্ছে।
“কাকা, বড়ভাবি হারায় গেছে।”
এমনি বকুল কাকা জানায় সে সকালেও দেখেছে ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে ড্যাংড্যাং পায়ে বড়বাজানের বউ বেরিয়ে গেছে কোথাও। তারপরও ক্ষণে বিপুর সামনেই দাঁড়াচ্ছে,
“ভাইজান, কত্ত ঘন্টা হইয়া গেছে। ভাবিরে পাই না। মসজিদে গিয়া মাইকিং করেন জলদি। আমার চিন্তা লাগতাছে।”
পরীর বিভ্রান্তিকর উক্তি শুনে বিপু মায়ের কাছে যায় জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে। পারভীন তার সামনেও ইফতেখারকে বলা কথার পুনরাবৃত্তি শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ইফতেখারের জানানো তথ্যও দিয়েছে। তাতেই ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। পরীর মাথায় ঠুকে তাই সাজা দিয়ে আসে সামান্য কারণও এমন বিভ্রান্তির সাথে প্রকাশ করায়। প্রয়োজন হয়েছে, গেছে, আবার চলে আসবে। এতে হারানো বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কি আছে?
দুপুরের সময়টা বাইরেই ছিলো ইফতেখার। বিকেলে এসেই মাকে জিজ্ঞেস করে,
“শ্রাবণ ফিরেছে?”
“ফিরলে তো দেখতিই। খালি আন্দাজটা দেখি একেকজনের। আক্কেল বলতে কিচ্ছু নাই। সন্ধ্যা হইয়া যায়, বউ বাড়ি ফেরার খবর নাই। তোরা ঘুমা নাকে তেল মাইরা।”
“এতো টেনশন নিয়ো না। সে একা চলেফিরে অভ্যস্ত। এসে পড়বে।”
“হো, আইতাছেই তো। দেখতাছিই সব। আধুনিক যুগের আধুনিক পোলাপান তোরা। এহন পর্যন্ত অনুমতি না নিয়া বাপের বাড়ির মুখই দেখলাম না৷ আমি এক কথা তোরে জানায় দেই, তোরা যতই আধুনিক হছ না ক্যা। সংসার, সংসারই। সংসারে থাকতে হইলে নিয়মকানুন মাইনাই চলতে হইবো। আমার কথা তো কানে নেয় নাই, তুই-ই পরিষ্কার জানায় রাখিস তবে। আর এইটা চেয়ারম্যান বাড়ি। মানসম্মানের একটা ব্যাপারও আছে। মর্জিতে সব করা যাইবো না। কিছু বলিছ।”
ইফতেখার চুপ থেকে যায়। দুশ্চিন্তা তো তারও হচ্ছে। একা একা না গেলেই কি পারতো না? এতোক্ষণ লাগিয়ে দিচ্ছে, অথচ কোনোরকম যোগাযোগ নেই!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব-১৮
(নূর নাফিসা)
.
.
আরও কিছুক্ষণ কেটে যায় অপেক্ষায়। সূর্য ডুবুডুবু প্রায়। মাগরিবের সময়ও ঘনিয়ে আসছে। ঠিক এমন সময়ই ক্লান্ত শ্রাবণের ছায়াও চেয়ারম্যান বাড়িতে পড়েছে।
“আপনে আইছেন? আমি তো ভাবছি, হারাইয়াই গেছেন। ছোট ভাইজানরে মসজিদে পাঠায় দিছিলাম, মাইকিং করতে।”
শ্রাবণ বিস্মিত হয়।
“মানে!”
“হো, আপনারে পাইতাছিলাম না। তাই পাঠাইছিলাম বিজ্ঞপ্তি দিতে। একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি… ”
অভিনয় ভঙ্গিতে কণ্ঠে সুর তোলে পরী। বিপু বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে তার বিপরীতে বিরক্তিসহিত জিজ্ঞেস করে,
“আমি কখন মসজিদে গেছি?”
বিপু শুনে ফেলেছে বুঝতে পেরে জ্বিভ কেটে শ্রাবণের পিছু লুকায় পরী। পরক্ষণে বিপুর প্রত্যুত্তর করে,
“না, মানে আমি তো আপনারে যাইতে কইছিলাম। ওইটাই জানাইতাছি ভাবিরে।”
“আমি কি গেছিলাম?”
“না।”
“আগ বাড়ানো কথা বলবি, চাপায় চড় খাবি।”
শ্রাবণও কিঞ্চিৎ বিরক্তিতে তাকায় পরীর দিকে।
“তুমি যা করো না!”
ঠোঁট উল্টিয়ে বোকা বনে দাঁড়িয়ে থাকে পরী। শ্রাবণ ঘরে চলে যায়। ব্যাগটা কাঁধ থেকে রেখে বেরিয়ে আসে। হাতমুখ ধুয়। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, তাই কাপড়চোপড়গুলোও ঘরে নিয়ে যায়। পারভীন তাকে দেখেছে, কিন্তু বলেনি কিছুই। মুখটা দেখেই শ্রাবণের সন্দেহ হচ্ছে রেগে আছেন বুঝি তার উপর। তাদের দুই ভাইয়ের কাপড়চোপড় তাদের ঘরে দিতে গিয়েই দেখা পায় ইফতেখারের। খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। নিশ্চুপ থমথমে দৃষ্টিতে দেখছে শ্রাবণকেও। কাপড়চোপড় রেখে কাছে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণ। কপালে হাত ছুঁয়ে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার জ্বর কমেছে?”
গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক। ইফতেখারের মুখেও নেই জবাব। তবে পাল্টা প্রশ্ন ছুটে আসে তার দিকে।
“কোথায় গিয়েছিলে?”
“ইন্সটিটিউটে গেলাম। ফি পরিশোধ করে এলাম। আপনাকে বললাম না গতকালই?”
“আজ যে যাবে, তা কি বলেছো?”
“আমিও জানতাম না আজই যে যাবো। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আবহাওয়া ভালো। তাই হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।”
“আমি বলেছিলাম, তোমাকে নিয়ে যাবো।”
শ্রাবণ একবার তার শান্ত অথচ গম্ভীর চোখদুটোতে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নামিয়ে আনে। নরম গলায় জবাব দেয়,
“আপনি অসুস্থ, তাই একাই গেলাম। ভোরে জানিয়ে যেতেও ইচ্ছে হলো না তাই। ভাবছিলাম অসুস্থ শরীর নিয়েই না আবার যেতে চান।”
“মাকে বলে যেতে পারতে।”
“আম্মা নামাজে দাঁড়িয়েছিলো। সকাল সকাল না গেলে জ্যামে পড়তে হবে। তাই অপেক্ষা না করে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছি।”
বিরক্তি নিংড়ে ফেলা একটা নিশ্বাস ভাসতে শোনা যায় ইফতেখারের। মুখে কোনো বাক্য জাগায় না আর। শ্রাবণও নীরব। যেন ওই মুখের প্রশ্ন পাওয়ারই অপেক্ষা আর সে তার জবাব দিতে প্রস্তুত। অথচ প্রশ্নকর্তা নীরবই। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে আবার চোখ তুলে তাকায় ইফতেখারের চোখে। ইফতেখার তার কান্ড দেখে ঠোঁট কার্ণিশে হাসি জাগিয়ে তোলে। হেলান ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বিছানা ছেড়ে। তার কার্ণিশ রাঙানো হাসি শ্রাবণের মুখেও হাসি এনে দেয়। মাগরিবের আজান পড়ছে। তাই নামাজের জন্য বের হবে ইফতেখার। শ্রাবণের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে বলে,
“মা রেগে আছেন। না বলে আর কোথাও যেয়ো না। বাড়ির বউ তুমি। একা যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। ঘরে যথেষ্ট মানুষ আছে সঙ্গে যাওয়ার মতো। বললেই ব্যবস্থা হয়ে যায়।”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“মসজিদে।”
এক পা এগিয়েও ফিরে দাঁড়ায় ইফতেখার। পকেট থেকে ফোন বের করে বলে,
“তোমার ফোন নম্বর দাও। এখনই দাও।”
শ্রাবণ ফোন হাতে নিয়ে নিজেই লিখে দেয় নম্বর। ইফতেখার ফোন পুনরায় রেখে জিজ্ঞেস করে,
“ফি দিয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
মাগরিবের নামাজের পর বাড়ি আসেন আফজাল হোসেন। নিয়ম মোতাবেক বিনা অনুমতিতেই এক কাপ আদা চা নিয়ে হাজির হয়ে যায় পরী। চায়ের কাপ হাতে নিয়েই তিনি জিজ্ঞেস করেন,
“শ্রাবণ ফিরে নাই?”
“হো, কাকা। ফিরছে। সারাদিন সূর্যের আলোতে পাই নাই, সন্ধ্যার চান্দের আলোতে ভাবিজানরে খুঁইজ্জা পাইছি। এইজন্যই নানি ওইদিন কইয়া গেছিলো, বড় ভাইজান একটা চান্দের টুকরা কুড়াইয়া আনছে।”
চায়ে চুমুক দিয়ে চোখ তুলে তাকায় আফজাল হোসেন। মুখে লাগাম টানে পরী। বেরিয়ে যেতে চায়। তিনি পিছু বলে উঠেন,
“কি করে? ডাক এই ঘরে।”
“আপারেও ডাকি? তিনিও আপনের কাছে কি জানি চাইবো চাইবো মনে হইতাছে।”
“যা বললাম, তা-ই কর।”
অর্পার ঘরে এসে হাজির হয় পরী। জায়নামাজ ভাজ করে উঠে দাঁড়িয়েছে শ্রাবণ। পরী পিছু বলে,
“ভাবিজান, যাইতেন। আপনের শ্বশুর আব্বা সালাম জানাইছে।”
জায়নামাজ রেখে পাশের ঘরে যায় শ্রাবণ। সালাম দেয় শ্বশুরকে। আফজাল হোসেন জিজ্ঞেস করে,
“কই গেছিলা?”
“জ্বি, ইউনিভার্সিটির কিছু ফি বকেয়া ছিলো। পরিশোধ করে এলাম।”
“এখনো পড়তাছো?”
“না, শেষ।”
“তা সবাইরে হয়রান করার দরকার কি? জানায় গেলেই পারতা।”
“সবাই যে এতোটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তা জানলে জানিয়েই যেতাম।”
“তোমরা শহরের মানুষ। রীতিনীতি আলাদা মনে করতে পারো। গ্রামের মানুষ অন্যরকম। পরিবারের প্রতি আলাদা টান থাকে। ঘরের লোকজন বাইরে থাকলে দুশ্চিন্তা বাড়ে।”
“আসলেই? কিন্তু আমার জানামতে তো এমনটা মনে হয় না।”
মুখের উপর অস্বীকার করাটা বেয়াদবি পর্যায় গ্রহণযোগ্য হলো আফজাল হোসেনের কাছে। শ্রাবণের মুখে তাচ্ছিল্যকর জবাব অপ্রত্যাশিতও বটে। তিনি গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থাকেন। গম্ভীর গলাতেই বলেন,
“কি মনে হয় না তোমার?”
“এই যে, আলাদা টানের কথা বললেন। গ্রামে আমার দেখা এমন কিছু পরিবার আছে, যারা ঘরের মানুষ বছর যাবত বাইরে থাকলেও খবরই রাখে না। তবে আমার এইটুকু সময় বাইরে থাকায় সবার প্রীতিটা আমারও ভালো লেগেছে। ইশ! যদি এমন গুরুত্ব সবাইকে দেওয়া হতো! যাইহোক, বাদ দেন। আরও কিছু বলবেন?”
আফজাল হোসেন একইরকম গম্ভীরতা বজায় রেখে বলেন,
“যখন ইচ্ছা, তখনই বাইরে যাইয়ো না। বউবেটির বাইরে যাওয়ার বেশিরভাগ প্রয়োজন পুরুষই করে দিতে পারে। যেটা হয়ই না, ইফতিরে সঙ্গে নিয়া যাইবা।”
“হুম।”
শ্রাবণ বের হওয়ার আগেই অর্পা প্রবেশ করেছে ঘরে। বাবার পাশে বসে বাহু জড়িয়ে আহ্লাদিত কণ্ঠে বলে,
“আব্বু, আমার এক হাজার টাকা লাগবে।”
“টাকা দিয়া কি করবা? কিছু লাগলে বলো, আনায় দেই।”
“না, টাকাই লাগবে। আমরা বান্ধবীরা একটা প্ল্যান করেছি। একটা ক্লাস পার্টি করবো। বেশিদিন তো নেই, একেকজন একেকদিকে চলে যাবে। দিবা না?”
“ক্লাস পার্টির কি দরকার? কয়দিন পর তো বিদায় অনুষ্ঠানই হইবো।”
“ধুর! বিদায় অনুষ্ঠানের সাথে পার্টির তুলনা। তুমি টাকা দিবা, ব্যাস।”
“আচ্ছা, দেখমু নে।”
“দেখবা না, না। দিবা।”
“আচ্ছা।”
রাতে বৃষ্টি হয়েছে, ভোর সতেজতার রূপ ধরে বসেছে৷ বৃষ্টিতে মুখুরিত ভুবন বাতাসের শীতল আদ্রতা গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে শ্রাবণের। গেইটের দিকে তাকিয়ে দেখে আবছা ভোরে টুপি মাথায় মসজিদ প্রাঙ্গণে ছুটে যাচ্ছে আফজাল হোসেন। এই ঘরের দরজা খোলার শব্দেই মূলত ঘুম ভেঙে গেছে শ্রাবণের। ছেলে দুটোকে ডেকে গেলেই কি পারতেন না তিনি? স্বগোতক্তি করতে করতে ব্রাশ ঠেকিয়েছে দাঁতে। পায়চারি করছে আর দাঁত মেজে যাচ্ছে। পরীটাকে ডেকেছিলো নামাজের জন্য। একবার সাড়া দিয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে গেছে দেখা যায়। পারভীনকে ওযু করতে দেখা যাচ্ছে। বাইরের বাথরুম থেকে ইফতেখারকেও ওযু করে বের হতে দেখা যায়। উঠেছে তবে সাহেব? বারান্দায় ঝুলন্ত গামছায় হাতমুখ মুছতে এলে শ্রাবণ এগিয়ে বলে,
“বাব্বাহ! আজ ভোরে জেগে উঠলেন যেন?”
“তুমি ডাকলে তো প্রতিদিনই উঠতাম।”
“আজ কে ডেকে দিয়েছে?”
“অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিজে নিজেই উঠে গেছি।”
মৃদু শব্দে হাসে শ্রাবণ।
“আপনি একা থাকলে প্রতিদিনই ডেকে দিতাম, যদি আমি জাগতে পারতাম আরকি।”
“আচ্ছা।”
মাথায় টুপি দিতে দিতে সে-ও চলে যাচ্ছে মসজিদের উদ্দেশ্যে। শ্রাবণ ঘরে নামাজ আদায় করে সবার আগে রান্না ঘরে এসেছে আজ। নিত্য সকালে শ্বশুর শ্বাশুড়ি চা পান করে, জানে সে। মাঝে মাঝে তারও ভোর জমে এক কাপ চায়ে। তাই আদা চায়ের ব্যবস্থা করে নিচ্ছে নিজ হাতে। পারভীন এসেই হয়তো চা করতেন আগে। পুত্রবধূ করছে তাই হাড়িতে ভাতের চাল নিতে থাকে। পরীকেও ঘুম থেকে ডেকে যায় ফাঁকেতালে। আফজাল হোসেন বাড়ি ফিরতেই চা দিয়ে যায় শ্রাবণ। নিজেও নিয়েছে এক কাপ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইফতেখারের উদ্দেশ্যে বলে,
“চা খাবেন আপনি?”
ইফতেখার আবার ঘুমাতে যাবে ভাবছিলো। চায়ের অফার পেতেই কি মনে করে বেরিয়ে এলো। শ্রাবণের হাতের কাপটাই নিয়ে নিয়েছে। মুচকি হেসে শ্রাবণ আরেক কাপ নিয়ে এসেছে। দুজনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করলো কিচিরমিচির কলতানে জমে থাকা চা ভোর। কাপের শেষ অংশ চুমুকে নিয়ে ইফতেখার বললো,
“চলো, ঘুরে আসি।”
“এখন? কোথায়?”
“চলো, গেলেই তো দেখবে।”
“কাপ রেখে আসি।”
কাপ রেখে এসে জিজ্ঞেস করে,
“এভাবেই যাবো?”
“হুম, সমস্যা নেই। কেউ দেখবে না।”
হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে শ্রাবণ। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে পরী দরজার সামনে থেকে পিছু বলে,
“কই যান, ভাবি?”
“দেখি, তোমার ভাইজান কোথায় নিয়ে যায়।”
ইফতেখার শ্রাবণের হাত ধরে পশ্চিমে হাঁটতে শুরু করেছে। গোয়ালে কর্মরত অবস্থায় বকুল কাকাকে পাওয়া গেছে। মাত্রই এসেছেন তিনি। ইফতেখার পিছু ডেকে নৌকার চাবি ও বৈঠা চায়। শ্রাবণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলে,
“নৌকা ভ্রমণে নিয়ে যাবেন?”
“কেন, যাবে না?”
“অবশ্যই।”
বৃষ্টিতে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে নৌকা। তাই বকুল কাকা এক টুকরো কাপড় দিয়েছে সাথে, মুছে নেওয়ার জন্য। প্রথমবারের মতো আজ ইফতেখারকে বৈঠা হাতে দেখেছে শ্রাবণ। বিস্তীর্ণ বিলে নৌকার দুই প্রান্তে দুজনের বিচরণ। বাতাসের শীতল স্পর্শ আর মনে জাগা প্রণয়ের তান উভয়ই সুন্দর। আরও সুন্দর বিলের দর্শনরূপ, সদ্য প্রস্ফুটিত হওয়া সকাল। অবর্ণনীয় সুন্দর নৌকার মাঝিও। ঘাস ও লতাচ্ছাদিত প্রান্তরটুকু পেরিয়ে নৌকা পানির স্বচ্ছতা ছুঁয়ে নিতেই দুষ্টুমিযোগে শ্রাবণ পানির ছিটা দেয় ইফতেখারের মুখে। ইফতেখার হাসিমুখে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। বৈঠা ক্রিয়া থামিয়ে শার্টের বাহুতে মুখ মুছে তাকিয়ে বলে,
“আমি দিলে অর্ধেক ভিজে যাবে।”
“ইশ! আমি কি আপনাকে এতোটা ভিজিয়ে দিয়েছি?”
“কিন্তু আমি ভেজাতেও পারি।”
শ্রাবণ হাসি ঠোঁটে চেপে পুনরায় দু’হাত স্বচ্ছ পানিতে নাড়াতে থাকে।
“এই জায়গাটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। সেদিন তোতাপাখি সাঁতার কাটতে নেমে গিয়েছিলো এখানে।”
“চলো তবে, আমরাও নেমে পড়ি।”
“আপনি নামেন।”
“আমি একা নামবো না। তোমাকে নিয়েই নামবো।”
“আমার এতো শখ জাগেনি সকাল সকাল ভিজতে।”
ইফতেখার দুষ্টু হেসে একদিকে ভর করে নৌকা হালকা কাত করে দেয়,
“ফেলে দেই?”
শ্রাবণ নৌকার দুই প্রান্ত আঁকড়ে ধরেছে সাথে সাথেই।
“ভয় পাই না আমি। ফেললে আপনাকেই তুলতে হবে।”
“এতো ভরসা?”
“প্রেম।”
দুষ্টু প্রত্যুত্তরের সাথে সাথে দৃষ্টি ডানে সরিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে শ্রাবণ। ইফতেখারও নিঃশব্দে হাসে তার দুষ্টুক্রিয়ায়। পুনরায় বৈঠা চালিয়ে যায় শাপলা বিলের দিকে। শ্রাবণ জানতে চায়,
“ওই পাশে ঘাসের পাকানো জট, এইপাশে শাপলার জট। তবে এইটুকু অংশ ফাঁকা কেন?”
“বর্ষার আগে মাটি কাটা হয়েছে এদিকে। তাই ঘাস জন্মেনি।”
“আপনাদের জমি নেই এদিকে?”
“এখানে নেই। ওদিকে আছে সব। ছেড়ে এসেছি।”
আজ শাপলা বিল ঘুমায় না। ঘুমের সময় হয়নি হয়তো এখনো। প্রতিটি ফুল শুভ্রতা ফুটিয়ে রেখেছে বিল জুড়ে। ওই দূরে আরও দুটো নৌকা লক্ষ্যনীয় হচ্ছে। ভোরের আলো ফুটতেই বাচ্চারা শাপলা কুড়াতে চলে এসেছে। কিন্তু এই দম্পতি শাপলা কুড়াতে আসেনি। এসেছে রাত জাগা এই তারাদের প্রভাতের শুভেচ্ছা জানাতে। এসেছে গল্পেসল্পে প্রণয়ের মালা গাঁথতে। শুভ্র শাপলা নৌকা ঘিরে রেখেছে চারিদিক থেকে। ইফতেখার নিজ প্রান্ত ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছে শ্রাবণ প্রান্তে। পাশাপাশি বসে জমিয়েছে গল্পসম্ভার। স্থির নৌকায় জানছে, জানাচ্ছে নিজেদের। গল্প করতে করতে হাতে শাপলার মালা তৈরি করছে শ্রাবণ। ইফতেখার পাশ থেকে একটা কপাট মেলে রাখা পূর্ণ শাপলা নিয়ে শ্রাবণের কানে গুজে দিয়ে বললো,
“ফুটন্ত শাপলা আর আমি সবই আছে পাশে। তবে আজ কেমন লাগছে এসে?”

চলবে।