শ্রাবণধারা পর্ব-২+৩

0
270

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০২
(নূর নাফিসা)
.
.
তিন কন্যার জননী মজিদা। তিন মেয়েকেই সংসারে পাঠিয়েছে কিশোরী বয়সে। বয়স তত না গড়ালেও অভাব এবং একাকিত্বেই যেন বৃদ্ধা হয়ে উঠেছে। বিধবা জীবন চলে, স্বামীর আধভাঙ্গা ঘরখানায় থাকে। জমি হতে কিছু ফসল তুলতে পারে। মেয়েরা মাঝে মাঝে কিছু দেয়। পরম করুণাময়ীর করুণায় এতেই জীবন চলে। না খায়িয়ে রাখেন না তিনি বান্দাকে। সপ্তাহ খানেক আগে এক যুবতী এসে ভিড়েছে তার ঘরে৷ এক আত্মীয়ের পরিচয়ে আরেক আত্মীয়। দূরাত্মীয়। মেয়েটাও নাকি তার মতো একাকী জীবন পাড় করছে। এই গ্রামে এসেছে কোনো কাজের ব্যবস্থায় নিয়োজিত হতে। পড়ালেখা জানা আছে। সুযোগ পেলেই কোনো সংস্থায় জড়িত হয়ে যাবে। দূরাত্মীয় বলেই অপরিচিত এই গ্রামে তার কাছে এসেছে। মজিদার ঘরে থাকার নিমিত্তে স্বল্প পরিমাণে কিছু ভাড়াও প্রদান করবে। ‘খালাম্মা’ ডেকেই যেন মন জয় করে নিয়েছে মজিদার। ভাঙা ঘরে ভাড়া তো কেউ থাকতে আসবে না। কিন্তু মেয়েটা ভালো ঘরের ভাড়া প্রদানও করতে পারবে না। তাই তার ভাঙা ঘরই প্রয়োজন। এইতো, ভাঙা বলতে ফুটো চালা আর বেড়ার নিচের অংশ মরিচায় কুড়মুড়ে। দুই কক্ষ বিশিষ্ট এই ঘরখানাই মজিদার আশ্রয়স্থল।
বাড়ির একপাশে মজিদার ঘর। অন্যপাশে তেমনই টিনের আরেকটা ঘর তার দেবর, সাত্তারের। যদিও মেরামত করা সাত্তারের ঘরখানা চকচকে এবং বারান্দা বিশিষ্ট। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে উঠুনের সাথে সাত্তারের ঘরের বারান্দার অবস্থাও নিদারুণ। আজ রোদের দেখা পেতেই সাত্তারের স্ত্রী শিরিন সকাল হতে মেরামতে বসেছে ঘর দুয়ার। বারান্দার মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে যাওয়ায় বোলে কাদা নিয়ে বসেছে লেপে দিতে। তাকে দেখে মজিদাও ঘরের পিড়া লেপে দিতে উদ্যত হয়েছে। দূরাত্মীয় শ্রাবণ মেয়েটা সকালে দোকান থেকে পরটা এনে খেয়েছিলো মজিদাকে সাথে নিয়ে। পরপরই কাঁধে ব্যাগ চেপে বেরিয়েছে কাজের খোঁজে। এই দুপুরে ফিরেছে রোদের তীক্ষ্ণতায় চোখ কুচকানো রেখে। ঘরের প্রবেশপথে পা দিতেই আটকে গেছে মাত্র লেপে যাওয়া দুয়ারে। পা তুলতেই জুতার তলাতে উঠে এসেছে মজিদার পরিশ্রম! মাত্রই পুকুর থেকে গোসল করে বাড়ি এসেছে মজিদা। শ্রাবণকে পা তুলতে দেখেই সে বুঝে গেছে কি ঘটেছে। দ্রুত পায়ে ছুটে এসে চেচায়,
“দেখছোস, দেখছোস খালি কি ডা করলো!”
দাঁত চেপে পিছু নেমে আসে শ্রাবণ।
“আমি একদম খেয়াল করিনি, খালাম্মা।”
“চোখ থাকলে তো খেল করবি।”
“আসলেই নেই। সূর্য মামা অন্ধকার করে দিয়েছে পৃথিবী।”
“মাত্র লেপাপোঁছা কইরা গোসল করতে গেলাম৷ অহনে আবার পেক ধরমু, ক দেহিনি!”
এক হাতে কপাল চাপড়ে জিভ কাটে শ্রাবণ। মজিদা বলে,
“যা যা। পা উডাইয়া ঘরে যা। আবার পাড়া দেইছ না কইলাম।”
“ঘরও লেপেছেন?”
“না। দুয়ারই থাহে না। আবার ঘর!”
পা ডিঙিয়ে ঘরে উঠে শ্রাবণ। ব্যাগ রেখে বেরিয়ে এসে এবার ভালো করে দেখে কতটা বিনাশ করেছে। দুই পায়ের ছাপে উঠে এসেছে অনেকটাই। সৌন্দর্যই নষ্ট! জুটি করা চুল খোপায় বেঁধে নেয় শ্রাবণ। উঠুনে কাপড় মেলে দিচ্ছে মজিদা। শ্রাবণ এগিয়ে এসে বলে,
“খালাম্মা, কাদা অবশিষ্ট নেই? দিন, ঠিক করে দেই আমি।”
“থাক, তুই পারতি না। কালকা দিমু নে।”
“পারবো। আমি তো গোসল করিনি এখনো। এইটুকু করেই গোসলে যাই।”
ঘরের কোণে পলিথিনের উপর কাদা দেখিয়ে দিলে শ্রাবণ তা নিয়ে ঠিক করে দেয় মজিদার দুয়ার। তা দেখে অপর পাশ থেকে শিরিন বলে,
“ভালোই তো কামের। আমার দুয়ারখান লেইপ্যা দিবো কেডা?”
হাসে শ্রাবণ। মেয়েটার হাসি বড্ড সুন্দর। চেহারাও ভারি সুন্দর। উজ্জ্বল গায়ের রঙ। দেখলেই আন্দাজ করা যায় শিক্ষিত মেয়ে। কথাবার্তা চালচলন মার্জিত। শিরিনের প্রত্যুত্তরে শ্রাবণ বলে,
“দিতে হবে নাকি? আসবো?”
“না, থাক। শেষ হইয়া গেছে।”
“কান্তা কোথায়, চাচি? কলেজে গেছে?”
“হো। তুমি কইত্তে আইলা?”
“এইতো, এদিকেই একটু বেরিয়েছিলাম।”
পরপরই মজিদার উদ্দেশ্যে বলে,
“খালাম্মা, পেরেছি কি না দেখবেন না?”
ঘরের কোণে বাকিটুকু কাদা রেখে দেয় পুনরায়। মজিদা কাছে এসে দেখে।
“হো, সুন্দর হইছে। রূপে গুণে ভরা মাইয়া। আল্লাহ বাছায় রাহুক। একটা ভালা জামাই জুটুক।”
“আরেব্বাবাহ! এতো দোয়া একসাথে করলে হয়?”
“পোলা থাকলে তোরে রাইক্ষা দিতাম বেডি।”
হাসে শ্রাবণ। বলে,
“তাই? এখন কয়েকটি চটের ছালা দিন তো দেখি।”
“ছালা দিয়া কি করবি?”
“কল তলায় বেড়া দিবো। পুকুরে গিয়ে গোসল করতে লজ্জা লাগে আমার। এতো লোকজন থাকে না, খোলামেলা পরিবেশ। দিন, দিন। আপনারই সুবিধা করে দেই একটা। আমারও ভালো হবে তাতে।”
ঘরে জমা করা চটের বস্তা বের করে দেয় মজিদা। ঘরে ধান উঠলে এগুলো কাজে লাগাতো। মেয়েটা যখন চাইছে৷ নিষেধ করেনি। কলতলার একপাশে ঘরের বেড়া আছে। তাই একটা খুটি আর গাছের সাহায্যে বাকি তিন দিক ঘেরাও করে ফেললো চট বেঁধে। এবার স্বাচ্ছন্দ্যে গোসল করতে পারবে বলে বিশ্বাস শ্রাবণের। কল চেপেই বালতিতে পানি নিয়ে গোসল সারতে বিকেল হয় শ্রাবণের। খালাম্মার এই বালতিতেও ছোট্ট ফুটো ছিলো। একদিকে পানি ভরলে আরেক দিকে অর্ধেক ফুরিয়ে সারা! শ্রাবণ তাতে টেপ লাগিয়েছিলো এখানে আসার দ্বিতীয় দিন। ভেবেছিলো গোসল সেরেই কান্তার কাছে যাবে গল্প করতে। দেখা গেলো তাদের ঘরে অতিরিক্ত মেহমান। তাই আর ওদিকে যায়নি। চাচির বারান্দা বুঝি এবার নষ্ট হওয়ার পথে। যদিও চট বিছানো আছে প্রবেশপথে। শ্রাবণ মজিদাকে জিজ্ঞেস করে,
“তাদের ঘরে কে এলো গো খালাম্মা?”
“দেখতে আইছে কান্তারে।”
“ওহ্। বিয়ে দিয়ে দিবে শীঘ্রই বুঝি?”
“দেহাইতাছে তো। পাইলেই সারা। যা দিনকাল! পোলাপান স্কুল কলেজ গেলেই নাগর ধরে।”
শ্রাবণ কথায় মজা পেয়ে হাসে।
“আচ্ছা, খালাম্মা। আপনাদের এলাকার চেয়ারম্যান কেমন? ভালো সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে তো?”
“দেহায় তো ভালাই। ভিত্তে শয়তানি। পোলাগুলারেও যা বানাইতাছে!।”
“কেন? চেয়ারম্যানের ছেলেরা ভালো না?”
“আরে, হুদ্দা শয়তান! যেনে যায়, হাঙ্গামা শুরু করে। কাইয়ুমডারে একবার যা মাইর মারলো ঝগড়া লাইজ্ঞা। কোনো বিচারই করলো না চেয়ারম্যান।”
“কাইয়ুম কে?”
“কান্তার বড় ভাই।”
“ওহ্। হতেও তো পারে যে মার খেয়েছে, দোষ তারই।”
“আরে না। জানোস না। এই, কয়দিন আগেও খেলার মাডে গিয়া ঝগড়াঝাটি বাঁধাইলো। দুই তিনডারে মাইরা নাকমুখ দিয়া রক্ত বাইর কইরা ছাড়ছে। ক্ষমতা হেগো। বুঝোস না?”
“হুম। বুঝলাম।”
রাস্তার কাজ চলছে রূপনগর গ্রামের। চেয়ারম্যানের ছেলেরা স্বয়ং দাঁড়িয়েছে সবটা ঠিকঠাক চলছে কি না দেখতে। বাজারের দিকটায় বেশ ভীড়। একে তো তাদের লোক, অন্যথায় বাজারের ক্রেতা বিক্রেতার সমাগম। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পথ পেরিয়ে যাচ্ছিলো শ্রাবণ। একটু থেমে থেকে দেখেও নেয় কাজের গতিধারা। কম হলেও অর্ধশত লোক নামিয়েছে দ্রুত কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে। রাস্তা আগের তুলনায় বড় হবে মনে হচ্ছে। রাস্তা ঘেঁষা আলগা দোকানগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে বাজার ঘেঁষা চড়ের দিকের জমি বালুতে ভরাট করা মাঠে। শ্রাবণ আবার চলতে থাকে। রাস্তার পাশে বাহারি ফুলগাছের ভ্যান। কি সুন্দর ফুল ফুটে আছে একেকটা গাছে। শুভ্র বেলিতে নাক ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নেয় শ্রাবণ। চোখ খুলেই দেখে নিচে একটা ঝড়ে পড়া। শুভ্রতা মলিন হওয়ার পথে। ভ্যান ওয়ালাকে বললো,
“মামা, এটা নিলাম। হ্যাঁ?”
মাথা নেড়ে সায় দেয় ভ্যান ওয়ালা। সঙ্গে আবদারে বলে,
“খালা, একটা গাছই নিয়া যান?”
ভ্যানের বিপরীত পাশেই একটা মোটরসাইকেল রাখা। মোটরসাইকেলের কাছে এসে আয়নাটা বাকা করে দেয় নিজের দিকে। ঝরে যাওয়া বেলি ফুলটা কানে গুজে দিতে দিতে বলে,
“যেদিন আমার একটা বাড়ি হবে, সেদিন নিবো মামা। আজ না।”
“আইচ্ছা, তাইলে নিয়েন।”
কানে ফুল গুজে চুলটাও ঠিক করে নিলো সে। পরক্ষণে আশেপাশে তাকায় কেউ দেখেছে কি না আবার তাকে। দেখেছে তো ঠিকই। চারপাঁচজন সদস্যের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ইফতেখারকে দেখলো তারই দিকে তাকিয়ে আছে কানে মুঠোফোন চেপে। থমথমে ওই চোখে তাকিয়ে শ্রাবণের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ইনিই মোটরসাইকেলের মালিক। তাই এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আছেন তার দিকে। অনুমতি না নেওয়ার বিপরীতে শ্রাবণ মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে চলে যায় সৌজন্যতায়। এতে অন্তত অনুমতি না নেওয়াটা দোষ বলে ধরে রাখবেন না। মূলত আয়না ঘুরিয়ে নেওয়ার সময়ই সেই থমথমে অক্ষিদ্বয় এদিকে পড়েছিলো।
বাড়ি ফেরার আগে একটু মাঠে পা রাখে শ্রাবণ। বাতাসে ঢেউ খেলে যাওয়া বালির চড়। রাস্তার দিকের আলগা দোকানগুলো এদিকেই তুলে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও মোটামুটি দীর্ঘ আয়তনের খোলা মাঠ। কিশোর বাচ্চারা এই রোদেলা হাওয়ায়ই অকারণে ছোটাছুটি করছে। শ্রাবণ হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে আসে। পাড় সৃষ্টি করে ভরাট করা হয়েছে চড়টাকে। যা এখন নদী হতে অনেক উঁচুতে। পাড় ঘেঁষে সারি সারি কাশবনের সৃষ্টি হচ্ছে। শরৎ এলেই তাদের সবুজ ডগায় শুভ্রকেশ গজাবে। মৌসুমের মৌ যেন একেকটা ফুল। এইযে, সে-ও বোধহয় এক মৌসুমী ফুল। যার কানেও লেগে আছে আরেক ফুলের অস্তিত্ব। বেলির ঘ্রাণ এখনো যেন নাকে ধাক্কাচ্ছে বাতাসের বেগে বেগে। মাথার ওড়না পড়ে উড়োচুলের খেলামেলা হচ্ছে বিনা অনুমতিতে। কখনো পালটা ধাক্কায় মুখে এসে লাগে কিছু। কখনো ঔদার্য বেগে ছুটে যেতে চায় পিছু বাঁধন ছেড়ে। শ্রাবণ কিছুক্ষণ সময় শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে অশান্ত নদীর স্রোতে। ওই দূরে নদী পারাপারের নৌকা দেখা যাচ্ছে ঘাটে। মাঝপথে যাত্রীবাহী নৌকাটি বড্ড বিপাকীয় অবস্থায় হেলে দুলে লড়ছে বাতাসের সাথে। বর্ষাকাল মানেই ভরো ভরো নদী। তারউপর তীব্র বাতাস আর স্রোতের প্রতিকূলতা। তবুও খাটুনিতে অবসর টানে না মাঝি। নৌকা ভিড়বে কি ওপারে? নিজের প্রতিচ্ছবি হঠাৎ নৌকায় কেন দেখা যায় এভাবে?
পরক্ষণে বাড়ি ফেরার জন্য পুনরায় পথ ধরে। কাছাকাছি এসে কান্তাকে পেয়ে যায় রাস্তায়। এই মেয়েটার সাথে অল্প সময়েই গভীর ভাব জমে উঠেছে শ্রাবণের। অবসর পেলেই সে গল্প করতে চলে আসে শ্রাবণের কাছে। বয়সে বড় হওয়ায় আপু, আপু বলে ডাকে। কিন্তু ভাবটা পুরোই বন্ধুসুলভ। শ্রাবণকে নাকি তার বড্ড ভালো লাগে। তাই ছুটে চলে আসে। কিন্তু এই মুহুর্তে শ্রাবণকে দেখে একদমই কোনো উল্লাসিত প্রতিক্রিয়া ভাসেনি মুখাবয়বে। নিজের মতো পথ চলছে অবিরত।
“কলেজ ছুটি হলো?”
মলিন মুখে কান্তা মাথা নাড়ে। শ্রাবণ নির্দিধায় প্রশ্ন তোলে,
“মন খারাপ নাকি?”
“হ্যাঁ, কিছুটা।”
“আমার তো মনে হচ্ছে অনেকটা। কি হলো?”
“হয়নি। তবে হতে দেরিও নেই বুঝি।”
“হয়নি, আবার দেরি নেই!”
কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়ে যায় শ্রাবণ। গতদিনের ঘটনায় আকস্মিক বলে উঠে,
“তোমার বিয়ে ঠিক তবে? এ তো ভারি খুশির ব্যাপার।”
“একদমই না।”
“সে কি! কেন? এখন বিয়ে করতে চাও না? নাকি ছেলে পছন্দ হয়নি। কোনটা?”
“ছেলে দেখিনি।”
“তবে?”
“জানি না।”
ভীষণ বিষণ্ণতা চেহারায় ধারণ করে হনহন পায়ে বাড়িতে ঢুকে যায় কান্তা। শ্রাবণ চিন্তিত ভঙ্গিতে ভ্রু টানা দেয়। পা বাড়ায় খালাম্মার ঘরের দিকে। কি একবার পা ফেললো কাদায়! এখন যতবার বাইরে থেকে ঘরে যায় কিংবা ঘর হতে বাইরে আসে, ততবারই ধোকা খায়! নিজের উপর হেসে পা ডিঙিয়েই ঘরে উঠে সে। নিজেদের ঘর হতে বোরকা ছাড়িয়েই আবার এই ঘরে শ্রাবণের কাছে ছুটে আসে কান্তা। একটু আশপাশ তাকিয়েই দেখে জেঠি নেই ঘরে। তখনকার অব্যক্ত ব্যাপারটা শ্রাবণকে জানানোর জন্য সঙ্গে সঙ্গেই বলে,
“আপু, আমি জানি।”

.
“শ্রাবণধারা”
পর্ব-৩
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে নাশতার পর এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসেছেন আফজাল হোসেন। দৃষ্টি সম্মুখেই একটা পাকা ঘরের কাজ চলছে। যেহেতু সন্তানদের কেন্দ্র করে সকল সম্পত্তির সঞ্চয়, সেহেতু ঘরের নকশার ভার ছেলেদের উপরই ছেড়েছেন। কোথায় কি দরকার হিসেব জমা করে বাবার অনুমতিতে টাকা খরচ করছে। পছন্দানুযায়ী ঘর নির্মাণে মিস্ত্রিদের পাশে থেকে থেকে দুই ছেলেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ফরমায়েশ প্রদান করছে। সব মিলে ভালোই লাগছে আফজাল হোসেনের। ছেলে দুয়ের মধ্যে কখনো কোনোরকম দ্বন্দ্ব না এলেই হয়। এক ঘরে সর্বদা একত্রে থাকবে, তা-ই প্রত্যাশা। সম্পত্তি আর ক্ষমতা এক সময় বন্টন হয়ে গেলেও মনটা যেন কখনো পৃথক না হয়। বাবাকে বারান্দায় বসতে দেখে ছোট ছেলে আতাহার বিপু এসে হাজির হয় নির্মাণাধীন ঘর হতে।
“আব্বা, কিছু কথা ছিলো।”
“কি?”
“কিছু টাকা দরকার।”
“কিসের?”
“একটা খেলার আয়োজনের জন্য। ফুটবল লীগ ছাড়বো ভাবছি। অনেকদিন যাবত খেলা হয় না।”
“তুই তো প্রত্যেকদিনই খেলছ।”
“খেলছি, ঠিক আছে। মানে, আয়োজন হয় না। আগামী শুক্রবার একটা আয়োজন রাখতে চাই।”
“এক, রাস্তার কাজ ধরছি। আরেক, বাড়ির কাজ ধরছি। টাকা উড়তাছে না। দুই দিন পরপর এতো খেলাধুলার লীগ লাগাইছ না। এইগুলা সাইরা উঠি। মাস তিনেক পরে খেলার আয়োজন নিয়া হাজির হইছ।”
“কত আর লাগবো একটা খেলার আয়োজনে? এতো বড় কাজ হয় আর এইটুকুতে কি আটকে থাকবো কিছু?”
“যেইটা বুঝোস না, ওইটা নিয়া কথা বাড়াইছ না। কইলাম তো, মাস তিন পরে যোগাযোগ করিস। রাস্তার কাজ কতদূর আগাইছে, দেইখ্যা আয়। তোগো নজর রাখতে কইছিলাম ওইদিকে। এক কুড়ি ইটও যেনে চুরি না হয়। আগেরবার রাস্তার ইট নিয়া জামশেদ মেম্বার বাড়ির বাউন্ডারি দিয়া বইছিলো, মনে আছে? অথচ আমি চেয়ারম্যান বাড়ি তখন বাউন্ডারি ছিলো না। এমন কত জামশেদ যে খাপ পেতে থাকে রাস্তায়, ধরা মুশকিল। যা, ওদিক গিয়া ঘুরে আয়।”
হুকুম মোতাবেক চলে যায় বিপু। তবে মুখমন্ডলে পোষা চরম বিরক্তি। বাবা টাকা দিলো না আয়োজনের। অথচ কত প্রত্যাশা ছিলো শুক্রবারই আয়োজনটা করবে! মাস যাবত খেলে নাকি এই পরিণতি শেষে? হনহনিয়ে পথ চলতে চলতে হঠাৎ ইটের উপর হোচট খায়। সামনের দিকে দুই তিন কদম হেলে গেলেও পড়েনি নাকেমুখে উপচে। পিছু হতে কেউ বলে,
“আরে, আরে! আস্তে। এখনই তো পড়ে যেতেন!”
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছু দেখতে পায় শ্রাবণকে। এই মেয়েটাকে আগেও একবার দেখেছে কাইয়ুমদের বাড়িতে। শ্রাবণ তার পাশাপাশি হাঁটতে ইচ্ছুক হয়ে এগিয়ে আসে।
“এতো তাড়াহুড়ো কেন করছেন? আস্তেধীরে চললেও পথ শেষ হবে। সাথে আপনিও সুরক্ষিত থাকবেন।”
পাশাপাশি একটা মেয়ের চলা স্বস্তিতে কেমন বিঘ্নতা তুলে দেয় বিপুর। গলাটা হালকা খাঁকারি দেয় সে। মুখের বিরক্তিটুকু একদম উপস্থিত নেই। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“এদিকেই। রাস্তার নির্মাণ কাজে ইট চুরি যায় কি না, তা দেখার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ হয়েছে। দায়িত্ব পালনে যাচ্ছি।”
“তাই? চেয়ারম্যান বাড়ির দিকেও নজর রাখবেন।”
ভ্রুর মাঝে হালকা ভাজ পড়ে যায় বিপুর।
“কেন?”
“চেয়ারম্যান বাড়িতে নাকি পাকা দালান উঠছে রাস্তা নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে। যদি কোনোভাবে রাস্তার নাম করে আনা ইট ওই দালানে গেঁথে যায় তো!”
“মানে! আপনি কি বলতে চাইছেন?”
“আরে, ক্ষেপে যাচ্ছেন নাকি? আমি তো কিছু বলতে চাইছি না। আমি হচ্ছি দুদিনের জন্য আসা এই গ্রামের অতিথি। লোকমুখের সন্দেহ আপনার সাথে শেয়ার করলাম আরকি। দায়িত্বে যখন আছেন আপনি। যাইহোক, আমাকে একটা হেল্প করতে পারবেন কি?”
“কোন ব্যাপারে?”
“কবিরাজ বাড়িটা দেখিয়ে দিতে পারবেন একটু?”
“আমার এখন সময় নেই।”
“আমরা মানুষেরা এই কথাটা একদম ভুল বলি। সময় আমাদের ঠিকই থাকে। কিন্তু ব্যবহার করতে ইচ্ছাবোধ করি না। এই যেমন আপনি এখন চাইলেই একটু হেল্প করতে পারেন। প্লিজ।”
“আপনাকে হেল্প করে আমার কি লাভ?”
শ্রাবণ কিঞ্চিৎ ভাবুক হয়ে পড়ে।
“লাভ? উম্ম… সব ক্ষেত্রে লাভ কেন খুঁজতে হবে? আমিও তো আমার লাভে আসিনি। একজনের উপকার করতেই এসেছি। আপনিও কি এখানে লাভলস না খুঁজে পারেন না?”
“না।”
“করবেন না হেল্প?”
“উহুম।”
“আমি আসলে একজনের বিয়ে ভাঙতে চাইছি।”
হঠাৎ চমকে উঠে যেন বিপু। শ্রাবণ তার এভাবে তাকানো দেখে জিজ্ঞেস করে,
“ভয় পেলেন?”
শ্রাবণের চোখে দৃষ্টি রেখেই বিপু জবাব দেয়,
“না।”
“মেয়েটা বিয়েতে রাজি না। জোর করে বিয়ে দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না, বলুন?”
“কবিরাজি করে বিয়ে ভাঙাবেন?”
খানিক হেসে উঠে শ্রাবণ।
“আরে না। এতো কঠিন পাপে আমি যাবো না। কবিরাজ বাড়ি নাকি ওই পাত্রের ঠিকানা। একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে দেখবো আরকি। যদি পাত্রের সদয় হয় তাতে।”
ঠোঁট কার্ণিশে মৃদু হাসি রেখে নিশ্চুপ চলতে থাকে বিপু। হঠাৎই যেন ফুপাতো ভাই খালিদের সামনে পড়ে গেলো। দিকবিক না তাকিয়ে খালিদের সন্দেহভাজন চোখকে উপেক্ষার চেষ্টায় মত্ত হয় সে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয় নিমেষে। যেন সে একা পথের পথিক। মেয়ে তো দূর, কারো সাথেই হাঁটছে না ভুলেও। এদিকে তার হাঁটার গতিতে শ্রাবণও নিজ পায়ের গতি বাড়িয়ে তার সমতালে পথ চলতে প্রস্তুত হয় কবিরাজ বাড়ি চিনে উঠার প্রত্যাশায়। মহা মুশকিল! ভাইয়ের সন্দেহের বুঝি এবার আরও গভীর সৃষ্টি! কি করে বলবে, আপনি একটু পিছু হাঁটুন। আমার ভাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে! তবুও বিড়বিড়িয়ে বলার চেষ্টা করে,
“আপনি একটু আস্তে হাঁটুন।”
শ্রাবণ বুঝতে না পেরে তার মুখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কি বললেন?”
“আস্তে হাঁটুন।”
“আস্তে হাঁটবো? কেন?”
আপদ! যেখানে অপরিচিত মনে করানোটা জরুরি সেখানে আরও মুখের উপর তাকিয়ে যেন ভাব জমানো! কিন্তু শ্রাবণ তো জানে না তার কোনো ভাই যে তাকিয়ে আছে! নিরুপায় বিপু নিজেই পায়ের গতি কমিয়ে দেয়। শ্রাবণও তার অনুরূপ! বিপু এবার স্পষ্টই বলে,
“আপনি হাঁটতে থাকুন সামনে, আমি একটু আসছি।”
“আচ্ছা।”
ততক্ষণে তারা বাজারে চলে এসেছে৷ রাস্তার বিপরীত পাশে বিপু যায় নির্মাণ কাজের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা লোকদের সাথে কথা বলতে। কাজ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, জিজ্ঞেস করেই আবার শ্রাবণকে পাঠানো পথে যায়। সবচেয়ে বেশি বিরক্তিকর এই খালিদ ভাই। তুই এসেছিস কাজে নজর রাখতে, সেখানে ভাইয়ের উপর নজর রাখা কি দরকার! অদ্ভুত! এতোক্ষণে বাজারের সীমা অতিক্রম করে যায় শ্রাবণ। বিপু পিছু ডাকে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে। শ্রাবণ ফিরে আসতেই বলে,
“আর যেতে হবে না। এইযে, এইটা কবিরাজ বাড়ি।”
“ওহ্, ওকে। ভীষণ ধন্যবাদ।”
“হুম।”
বাড়ি দেখিয়েই পিছু পথে ফিরতে শুরু করে বিপু। শ্রাবণও তার সাথেই চলতে শুরু করেছে এবারও!
“আরেহ! আপনি ফিরে আসছেন কেন?”
“দেখলাম তো। এইটাই না?”
“হ্যাঁ, এইটা। কিন্তু যে কাজে এসেছেন, তা করতে যাচ্ছেন না কেন?”
“কাজ তো আমি এখনই করবো না। চিনতে এসেছি। চেনা হয়েছে, ব্যাস। তাই চলে যাচ্ছি আবার।”
“ওহ্!”
“আর আপনি এই এই করে পিছু ডাকছিলেন, এটা কোন ধরনের অভ্যাস? কাউকে ডাকতে হলে, নাম জানলে নাম ধরে ডাকবেন। নয়তো পুরুষ মহিলা ভেদে, বয়সের তারতম্যর ভিত্তিতে আপু, ভাইয়া, আঙ্কেল, আন্টি কিছু তো একটা সম্বোধন করতে পারেন।”
আসলেই বোধহয় রাস্তায় এভাবে পিছু ডাকাটা ঠিক হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ লজ্জাবোধ হলো। শ্রাবণকে প্রত্যুত্তরে বললো,
“স্যরি।”
“ইট’স ওকে। পরেরবার খেয়াল রাখবেন।”
“আপনি তো আমার বয়সে বড় বলে মনে হচ্ছে না। নাম কি আপনার?”
“আমি? বর্ষাকালের শ্রাবণ। ঋতুভেদেই আসি, আবার চলে যাই।”
বিপু ঈষৎ হাসির ঠাঁই দেয় মুখে। শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“আপনার নাম?”
“আতাহার বিপু।”
“বাড়ি এদিকেই?”
“চেয়ারম্যান বাড়ি।”
“ও, তবে তো চেয়ারম্যান সাহেব আপনারই প্রতিবেশি। যাক, দায়িত্ব দিয়ে প্রতিবেশীর হাক ভালোই বরাদ্দ করছেন তিনি। সম্পর্কে কি ডাকেন? চাচা? দাদা?”
“আব্বা।”
“মানে!”
বিস্ময়-বিহ্বল হয়ে যায় যেন শ্রাবণ! বিপু চলতে চলতে তার বিস্মিত মুখে তাকিয়ে বলে,
“আমি চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে।”
“ইন্না-লিল্লাহ! তখন আমি কার সামনে কি বলছিলাম!”
স্বগতোক্তি করতে করতে পায়ের গতি দিগুণ বাড়িয়ে নেয় শ্রাবণ।
“আরেহ! কি আর তেমন বললেন? এতো জোরেইবা হাঁটছেন কেন? পড়ে যাবেন তো আবার আমার মতো।”
শ্রাবণ থামে না। বিপু হাসে। শ্রাবণ যথা পথে ফিরে গেলেও সে বাজার পর্যন্তই আটকে থাকে। নির্মাণ কাজ দেখতে। রোদের আড়াল হতে মসজিদের সামনে ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে বিপু। ইটের গাঁথুনি যথাযথ হচ্ছে। খালিদ কোত্থেকে হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়ালো। বিপুর মন বলছে কি না কি বলে এক্ষুণি! কিভাবে বা কি উদ্দেশ্যে ভাইকে উপেক্ষা করা যায় তাও ভাবতে শুরু করেছিলো মাত্র। পর্যাপ্ত সময় দিলো না খালিদ। সন্দেহভাজন চোখে তাকিয়ে বিপুকে জিজ্ঞেস করে,
“মেয়েটা কে রে?”
“কোন মেয়ে?”
“যার সঙ্গে গেলি।”
“আমি চিনি না।”
“কথাও বললি, আবার বলস চিনোছ না?”
“আসলেই চিনি না। কবিরাজ বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলো, তাই দেখিয়ে দিলাম।”
“মামায় কিন্তু খুব কঠিন লোক। আউল ফাউল কিছু পছন্দ করে না জানোস। এইসব ধান্ধা ছাইড়া কাজের কাজে মন দে। বড় ভাই হয়ে এইটুকু পরামর্শ দিলাম আগ থেকেই।”
“কি মুশকিল! আমি কি ধান্ধা নিয়ে ঘুরলাম?”
“ওই ছ্যাড়া! ট্যাকা দে। ওই ছ্যাড়া! ট্যাকা দে কইলাম।”
হঠাৎ গ্রামের এক মহিলা পাগল এসে ঠমকে টাকা চাইলো বিপুর সামনে হাত বাড়িয়ে। হালকা ভয় পেয়ে গেছে বিপু। বললো,
“আমার কাছে টাকা নেই।”
“ও…ই, মিছা কতা কবি না! আমি জানি তুই চেয়ারম্যানের পোলা। তোগো পকেট ভরা ট্যাকা থাকে। দে কইতাছি। নইলে রাস্তার সব ইট তুইলা নিয়া গাঙ্গে ডুবায় দিমু।”
বিপু প্যান্টের এক পকেট টেনে বের করে বলে,
“এইযে দেখেন, আমার পকেট ফাঁকা। আমার বড় ভাইয়ের কাছ থেকে নেন।”
খালিদকে দেখিয়ে দিয়ে বিপু ছুটি নেয় ঝটপট। হেলেনা পাগলী বিপুর পথ ছেড়ে এসে খালিদকে ঘিরে ধরে। খালিদও নেই নেই বলে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু শার্ট টেনে ধরে রাখে হেলেনা। খালিদ বিশ টাকা দিয়ে মুক্তি পেতে চায়। তবুও সফল হয় না। বিশ টাকা নিবে না সে। একশো টাকার দাবি তার। নয়তো ছাড়বেই না। খালিদ ধমকে ধমকে ছাড়াতে চাইছে। পাগলীর চোখ গলা যেন সমান ক্রুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। টাকা না দিলে ইট দিয়েই মাথা ফাটাবে হুমকি। বিপু দূরে গিয়ে হাসছে তাকে ফাসিয়ে দিয়ে। পাগল, তাই রেগে কিছু করতেও পারে না খালিদ। পুরো একশো টাকাই আদায় করে ছেড়েছে হেলেনা।