“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ২৮
(নূর নাফিসা)
.
.
পরীক্ষাগুলো দেওয়া হলো না তাই কান্না করেছে প্রতিদিনই। আজ শেষ পরীক্ষা ছিল কান্তার। আগেরগুলো না দিলেও শেষটায় উপস্থিত হতে আবারও জোর টানে মায়ের বিরুদ্ধে। বোরকা পরে বেরিয়ে যেতে চায়। শিরিন টেনেটুনে বোরকা খুলে কতগুলো থাপ্পড় মেরেছে তাকে। কান্নার সাথে তর্ক করেছে কান্তা, মায়ের সাথে। জীবনটাকে নরক করছে বলে চিৎকার করে কতক্ষণ। সারাদিন ভাত খায়নি আর। রাতে সাত্তার বাড়ি ফিরলেই শিরিন বিচার দেয় সারাদিন না খেয়ে আছে তাই। কারণ জানতে চাইলেই এবার বলে দেয়, বিপুর প্রেমে পাগল হয়ে আজকেও বেরিয়ে যেতে চাইছিল। এরপর মেরেছে। এখন ভাত খাওয়া ছেড়েছে। বিপুর কথা শুনতেই মাথায় রক্ত উঠে সাত্তারের। মেয়ের উপর ধমকায়। শিরিন যা বলল, সত্যি কি না? বিপুর পিছু ছাড়বে কি না জিজ্ঞেস করে। স্পষ্ট জবাব দেয় কান্তা, মরে গেলেও ছাড়বে না। এই কথা বলতেই সেও ইচ্ছেমতো মারে। শিরিন নিজেই দৌড়ে গেছে তাকে শান্ত করতে। পাশের ঘর থেকে মজিদাও দৌড়ে এসেছে হইচই শুনে। থামিয়েছে দুজনে সাত্তারকে। বাবার হাতে মাইর খেয়ে রাতের ঘুম হারাম হলো কান্তার। ঠোঁটের ধার কেটে রক্ত ঝরেছে কড়া থাপ্পড়ে। লাঠির দুই আঘাতে শরীরেও ব্যথা জমে গেছে। চুলে টান পড়ায় ও নির্ঘুম রাতের কারণে মাথাটাও যন্ত্রণা করছে ভীষণ। তবুও জানালা খোলা রেখে বসে আছে বিছানায় জানালার কাছেই। আঁধার ঘরে চাঁদের আলো এসে হাঁটু জড়ানো পায়ে রশ্মি ঢেলেছে। সেই আলোতে রক্ত ঝরাতেও হাতে ব্লে*ড নিয়েছে কান্তা। আলতো আলতো করে দুইবার আঁচড় কাটলো কব্জির কাছে। আঁচড় থেকে বিন্দু বিন্দু ঘামের মতো রক্ত বেরিয়ে এসেছে। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এসে তা গাল গড়িয়ে আবার স্বচ্ছ হয়ে যায়। আবারও টইটম্বুর হয় সময়ে অসময়ে। না পারে বাবামাকে বুঝাতে, না পারে নিজ উদ্যোগে কিছু করতে। কি লাভ এই জীবন রেখে? প্রতিদিন কেঁদে উঠার কোনো মানে হয়? আম্মা তো মানবে না, আব্বাও মানবে না। হাতের শিরাগুচ্ছে আঁচড় নিতে চাইলে এই ব্লে*ড মানবে তো? অবশ্যই মানবে। দিবে নাকি তাকে মানিয়েই একটা জীবনের ইস্তফা? কিন্তু মরে গেলে কি হবে? কিছু হবে না। না সুখ পাওয়া যাবে, না আল্লাহকে পাওয়া যাবে, আর না পাওয়া যাবে তার শখের বিপুকেই! যার জন্য হয়ে যাচ্ছে এতোসব কাণ্ড! তো মরতে যাবে কোন প্রত্যাশায়? হৃদয়ের ডুকরে উঠা কান্না চাপা দিতে ঠোঁট কামড়ে রাখে। ব্লে*ডটা ছুড়ে দেয় জানালার বাইরে। হাঁটুতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদে। এইযে, একটা পাপ যে করতে যাচ্ছিল তার জন্য ভয় করে আল্লাহকে। ক্ষমা চায় মনজমিনে আর্তচিৎকার করে। সাহায্য চায় একটা সুব্যবস্থার জন্য। এই চাপময় জীবন একদম ভালো লাগছে না৷ চাপমুক্ত হতে চায় সে। নিজেকে শান্ত করে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে দরজা খুলে। এতো রাতে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে যায় সাত্তারের। মেয়েকে বেরিয়ে যেতে দেখে উঠে আসে তৎক্ষনাৎ। বারান্দায় এসে দেখে জগের পানিতে ওযু করছে মেয়ে। ওযু শেষ হতেই উঠতে দেখে এক দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে মাথা ঠান্ডা অবস্থায় চলে যায় আবার ঘুমাতে। বুঝতে পারে, মেয়ের চোখে ঘুম নামেনি আজ। তারও অনেকটা সময় নির্ঘুম কেটেছিল মেয়েকে মারার কারণে। কাঁচা ঘুম ভেঙেছে দরজার কপাট খোলার শব্দে। কান্তা আন্দাজ করতে পেরেছে বাবার উঠে আসা। পুনরায় দরজা লাগিয়ে নিজের ঘরে এসে জায়নামাজ পেতে দেয় বিছানায়। দিয়াশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বেলে ঘর আলোকিত করে। এরপর জড়ো হয় প্রার্থনায়৷ ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা ও সাহায্যের দুহাত তুলে চোখ ভিজিয়ে যায় ভোর পর্যন্ত।
শ্রাবণের কথা ও অপমান খুব গুরুত্বের সাথে ভেবে একটা কিছু করার জন্য ভাবছিল বিপু। যেদিন শ্রাবণ এতোসব বলল তাকে, সেদিন রাতে তার ঘুম হয়নি এই ভাবনার কারণে। এরপর থেকে একটা সিদ্ধান্তের দিকে ধাবিত হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আজ চারদিন হয়। আর তা একদিন যায়, দুদিন যায়, তিনদিনের মাথাতেই চলে এসেছে আফজাল হোসেনের কান পর্যন্ত। গত সন্ধ্যায়ই শুনেছে কারো মুখে যে বিপু কর্মসংস্থানের চেষ্টা করছে। অথচ তিনি বাবা হয়ে, ঘরে থেকেই জানেন না সেই খবর! সকালে যখন বারান্দায় বসে চা পান করছিলেন, বিপুকে ঘর থেকে বের হতে দেখতে পেয়ে ডাকেন।
“শুনে যা।”
বিপু এসে কাছে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করেন,
“স্কুলে নাকি দৌড়াদৌড়ি করতাছোস?”
একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে বিপু। আব্বা জানলো কি করে, কিছু ঠিক হওয়ার আগেই! আফজাল হোসেন জবাবের প্রত্যাশায় তাকিয়েই থাকেন মুখের দিকে। দৃষ্টি নত করে জবাব দেয়,
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।”
“ক্যা?”
“চাকরির জন্য।”
“চাকরি বাকরির কি এমন দরকার? আমার যেই কাজকর্ম আছে, তা-ই দেখাশোনা করলে হয় না তোর?”
“তা তো ভাই দেখছেই। আমি না দেখলেও দেখা হবে। তাছাড়া আমার নিজের কিছু করার দরকার আব্বা। অবসরই তো ঘুরাঘুরি করছি। সময় থাকতে যোগ্যতা কাজে লাগানো দরকার মনে হচ্ছে। কিছু অতিরিক্ত আয়ও হবে পরিবারে। সার্টিফিকেট অর্জন করতে যা খরচ হয়েছে, তারও সার্থকতা পাওয়া যাবে।”
“তাই বলে, শেষ পর্যন্ত কিন্ডারগার্ডেনে নামবি!”
জানে, আব্বার চারকি পছন্দ না। তাই আগের তুলনায় গলা আরও নত করে বিপু।
“অভিজ্ঞতার দরকার আছে। তাছাড়া, হাইস্কুল পর্যায়েই জয়েন হওয়ার চেষ্টা করছি। দেখি, তারা কি ঠিক করে।”
“দৌড়াদৌড়ির কি দরকার? মাস্টারিই করবি যখন, আমারে কইলেই তো হইতো। কিন্ডারগার্ডেনে চেষ্টা না কইরা সরকারি হাইস্কুলেই ঢোকানোর জন্য দেখতাম।”
“হুট করে সেখানে গেলেই সামলে উঠতে পারি কি না কে জানে। এখান থেকেই শুরু করি। যোগ্যতায় যেই পর্যায় পাওয়া যায়। সুপারিশে গেলে তখন ঠিকঠাক সামলাতে না পারলে উল্টা কথা শুনতে হবে যে, না পেরেই জোর দেখাইছি।”
বিরক্তির হালকা নিশ্বাস ছাড়েন আফজাল হোসেন। ছোট করে যাওয়ার হুকুম দেন,
“যা।”
চুপচাপ চলে যায় বিপু। আগামীকাল প্রাকটিক্যাল পরীক্ষাস্বরূপ দুইটা ক্লাস নেওয়ার জন্য বলেছিলেন হেডমাস্টার। এরপরই হয়তো ব্যবস্থা হয়ে উঠবে একটা। ছুটিরদিন হওয়ায় একটু দেরিতেই ঘুম থেকে উঠেছে অর্পা। আলস ভঙ্গিতে বারান্দায় বসে বসে দাঁত ব্রাশ করে চলেছে নিবিড়ে। পাশ দিয়ে চলাচল করতে করতে পারভীন বকে গেলেন হালকা করে।
“একেক নবাবিরা ঘুম থেকে উঠবো দশটায়। তা-ও আবার ডেকে ডেকে খাওয়াইতে হইবো। এমন সুখই করতে পারলাম না জীবনে।”
অর্পা মুখভর্তি লালা নিয়ে জবাব দেয়,
“আমার সাথে হিংসা কেন করো? পরীকে বললেই তো হয়, আম্মু। তারপর সুখ করো। ছেলের বউও আছে তোমার হাড়ি সামলানোর জন্য।”
“ঢংয়ে ঢংয়ে কথাটাই কইতে পারবি। কাজেকর্মে তো একদমই নাই। শ্বশুর বাড়ি গেলে কিছু হইলেও তো কইরা খাওয়া লাগবো নাকি? পারোছটা কি?”
“ভাবিও তো করে না কিছুই। এমন একটা বাড়ি পেলেই হইবো।”
“হইবো নে।”
মায়ের সাথে মস্করা করে মুখ টিপে হাসে অর্পা। পুঁচ করে লালা ফেলে মাটিতে। ভুলক্রমে তার গোলাপ গাছ পর্যন্ত চলে যায়। মগের পানিতে আবার সাথে সাথেই পরিষ্কার করে নেয় সে। মনে মনে একটু ভয় করে। গতকাল ইংরেজি পরীক্ষার খাতা দিয়েছিল ক্লাসে। তিন মার্কের জন্য এসে গেছে ফেইল! মা শুনলেই না আরও ধোয়ামোছা করতো তাকে! এখন নাহয় লুকিয়ে গেল। যখন পুরো পরীক্ষার মার্কশীট দিবে, তখন কিভাবে লুকাবে? প্রাইভেট টিচার তো সবার আগে তার মার্কশীট দেখে নিবে৷ এরপর ঘরে জানাতেও বাদ রাখবে না। কি যে করবে! আব্বু শুনলেই না রাগ করে বসেন। বিপুভাই তো আছেই কানের কাছে ফেল্টুস বলে বলে ভনভন করতে!
রুটি নাশতা করে বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে পুকুরের দিকে হাঁটতে এসেছিল শ্রাবণ। পানিতে একটা জাম্বুরা ভাসতে দেখতে পায় সে। পুকুরের চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে গাছেরও সন্ধান করে। কিন্তু কোনো জাম্বুরা গাছ দেখতে পায় না। গোয়ালের কাছে বড় জাম্বুরা গাছটা আছে শুধু। এটা কি তবে কেউ ছুড়ে ফেলেছে পানিতে? গোয়ালে কর্মরত অবস্থায় দেখা যায় বকুল কাকাকে। ধীর পায়ে পুকুরের পাড় ধরে গোয়ালের দিকে এগিয়ে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“বকুল কাকা, জাম্বুরা কে ফেললো এখানে?”
“কই মা? কই?”
“এইযে, পুকুরের পানিতে ভাসছে দেখা যায়।”
“ও, গাছেত্তে পইড়া গড়ায় গেছে।”
“এতোখানি গড়ায়!”
“কি কয়! ঝড় আইলে উঠানেও যায়গা। এইডা মনে হয়, গোয়ালের চালে পড়ছে। হেরপর গড়াইছে পুকুরে।”
“হুম, তা-ই হবে হয়ত।”
শ্রাবণ এই প্রান্তের শেষ পর্যন্ত হেঁটে আবার পিছু আসে ধীর পায়ে হেঁটেই। আবারও তাকায় ভেসে থাকা জাম্বুরায়। পাকা হবে হয়ত। তাইতো পড়েছে। উঠানো যাক। আশপাশে তাকিয়ে বড় লাঠি খুঁজে। কিন্তু তেমন ডালপালা নজরে পড়ে না। বড়র মধ্যে দেখতে গেলে বাঁশ পাওয়া যায়। চিকন হলেও চলতো। মোটা, তা-ও আবার এতো বড় বাঁশ বহন করা তার পক্ষে সম্ভব না। বকুল কাকা অবসর থাকলে উনাকেই বলতো নেওয়ার জন্য। কাজে ব্যস্ত তাই বিরক্ত করলো না। উঠুনের দিকে এগিয়ে গেলেই ইফতেখারকে দেখতে পায় গেটের কাছে। মাত্রই এসেছে, যাচ্ছে দালানের দিকে মিস্ত্রিদের কাজকর্ম দেখতে।
“শুনুন…”
ইফতেখার এদিকে তাকালেই হাতের ইশারায় ডাকে শ্রাবণ। সে এসেই বলে,
“এখানে কি করছো?”
“এমনি, হাঁটছিলাম। এখান থেকে একটা বাঁশ নিন।”
“বাঁশ! কেন?”
“নিয়ে আমার মাথায় একটা বাড়ি দিন।”
মস্করা করে হাসে শ্রাবণ। পরপরই পুকুরের দিকে দেখিয়ে বলে,
“জাম্বুরাটা নিয়ে দিন।”
“জাম্বুরা এখানে গেল কীভাবে?”
বলতে বলতে বাঁশ নিতে যায় ইফতেখার। শ্রাবণ তার জবাব দেয়,
“গাছ থেকে পড়ে গড়াগড়ি দেওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল।”
ইফতেখার বাঁশ নিয়ে এগিয়ে যায় পুকুরের কাছে। জাম্বুরা টেনে নিয়ে আসে কিনারায়। শ্রাবণ নিতে গেলে সে বলে,
“দাঁড়াও, আমি নেই। পিছলে গিয়ে আবার তুমিও হাবুডুবু খেয়ে আসবে।”
শ্রাবণ বাধা মানে না। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নেয় ইফতেখার বাঁশ রাখার আগেই। তারপর জবাব দেয়,
“পড়লেও সমস্যা নেই। সাঁতার জানা আছে।”
কিন্তু জাম্বুরায় তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। তার হাসিতে ইফতেখার বাঁশ রেখে পিছু দেখে। জাম্বুরা পচা! এই অংশ তো দেখেইনি টানার সময়! পচা অংশ নিচের দিকে ডুবে ছিল। শ্রাবণ সেটাকে বাউন্ডারির কাছাকাছি ছুড়ে ফেলে বলে,
“আপনার কষ্টটাই বৃথা।”
“তুমি বললে বিধায়ই তো টানলাম।”
“আমিই কি জানতাম নাকি!”
ইফতেখার আবার বাঁশ হাতে নিয়েছে গাছ থেকে পেরে দেওয়ার জন্য। শ্রাবণ নিষেধ করে, লাগবে না। সে শোনে না তাকে। বউয়ের খেতে ইচ্ছে হয়েছে ভেবে পেরেই দেয়। পড়েছে আবার কাদামাক্ত জায়গায়। শ্রাবণ তা নিয়ে পুকুরে ধুয়ে নেয়। ইফতেখার পিছু থেকে বলছে,
“কলের পানিতে ধুয়ে নাও।”
“নিচ্ছি। কাদা সরিয়ে নেই এখানে।”
এমনি মহিলা কণ্ঠে পিছু ডাক পড়ে ইফতেখারের নাম ধরে। শ্রাবণও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ফিরে তাকায়। একজন যুবক আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা এসেছে বাসায়। ঘরে যাচ্ছে। ডাকের সাড়ায় ইফতেখার এগিয়েছে ততক্ষণে। কিন্তু শ্রাবণ থেমে গেছে এখানেই। একটু নয়, অনেকটাই বিস্মিত হয় যুবককে দেখে! সে এখানে কি করে! এই বাড়িতে তার কি!
“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ২৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সকালে উঠুন ঝাড়ু দিতে গিয়ে যখন জানালার কাছে আসে শিরিন, জুতো ছাড়া পায়ের তলা ক্যাচ করে উঠে অজান্তেই! পুরো শরীরের লোমগুলো যেন দাঁড়িয়ে গেল রক্তশ্রোতের ধারায়! হাতের ঝাড়ু ফেলে মুখে ব্যথিত শব্দ স্পষ্ট করে মাটিতে বসে যায় তৎক্ষনাৎ। পায়ের তালুতে দেবে থাকা ব্লে*ডটা সরিয়ে নেয় এক টানে। আবারও শিউরে উঠে দেহ। পায়ের ব্যথা যেন মাথায় তান ধরেছে। ব্যথায় পা ফেলতে পারে না মাটিতে। পায়ের অর্ধাংশের ভর ফেলেই উঠে দাঁড়ায় তবুও। সকাল জেগে সূর্য মাথা বরাবর উঠতে চলেছে, তবুও নির্ঘুম চোখে ঘুম আসেনি এক প্রহরের জন্য। মায়ের মুখের শব্দ পেয়ে সাথে সাথেই শোয়া থেকে উঠে বসেছে কান্তা। জানালার কাছেই মনে হলো গলা শুনলো। বাইরে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় আধো ভর ফেলে মা এগিয়ে যাচ্ছে বারান্দার দিকে। পায়ের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে রক্ত! বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠে তার! রাতেই না নতুন ব্লে*ডটা ফেলল এদিকে! দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে বেরিয়ে আসে কান্তা। শিরিন বারান্দায় বসেছে মাত্র। কান্তা ছুটে এসে বসে যায় মায়ের পায়ের কাছে। বারান্দার রশিতে ঝুলানো গামছাটা টান দিয়ে নামিয়ে একটা অংশ ছিঁড়ে নিতে নিতে বলল,
“কাটলো ক্যামনে! দেখে হাঁটতে পারো না!”
“কপাল পোড়া থাকলে খোলা চোখও অন্ধ হইয়া যায়। জানালা দিয়া ব্লে*ড ফালাইছে কেডা?”
কান্তা মায়ের পা বেঁধে দিতে দিতে বলে,
“জানালার কাঠেই তো ব্লে*ড রাখা থাকে। পড়তে পারে না কতভাবে!”
জবাব দিয়ে চোখের ধার কুঁচকে রাখে সে ব্যথিতভাবে। কত রক্ত পড়ছে! গামছার গিঁট দিয়েই আবার ছুটে ঘরে। খুঁজে খুঁজে স্যাভলনের কৌটাটা বের করে আনে। মায়ের পায়ের ক্ষতে গামছার উপরেই ঢেলে দেয় কিছুটা। কাটা ঘায়ে জ্বালা করতেই পা ঝেড়ে কাতরাতে থাকে শিরিন। কান্তা হাতের কাছে পাখা না পেয়ে আঁচল ঝেড়েই বাতাস করতে থাকে জ্বালা কমানোর জন্য। ধীরে ধীরে ব্যথার রেশ বেড়ে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন। একই অবস্থায় শিরিন বসে থাকে অনেক্ষণ। ফেলে রাখা স্থান হতে ব্লে*ডটা তুলে বাড়ির এক কোণে স্থাপিত টয়লেটের ময়লার দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আসে কান্তা। বাকি উঠুনের ঝাড়ুর কাজ শেষ করে নেয় নিজ দায়িত্বে। পরক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে রান্নাবান্নার আয়োজনে হাত লাগায়। শিরিন কতক্ষণ মাথায় হাত চেপে বসে থাকে। রক্ত দেখে যেন মাথা ঘুরছে তার। পরক্ষণে চুলোর পাশে মেয়েকে দেখে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ব্যথার তীব্রতা যেন বেড়েই চলেছে। ক্ষণিকের মধ্যেই অস্থির বানিয়ে দিয়েছে দেহ। কান্তা তাকে ঘরে যেতে দেখে বলে,
“ডাক্তারের কাছে যাও। একটা ইঞ্জেকশন নেও। ইনফেকশন হইলে কিন্তু বিরাট সমস্যায় পড়বা।”
বললেও শিরিন যায় না সাথে সাথেই। মাথার নিচে বালিশ পেতে শুয়ে পড়ে। একদিকে ভাত বসিয়ে চুলোয় লাকড়ি ঠেলছে কান্ত, অন্যদিকে সবজিও কেটে নিচ্ছে। মনে মনে অপরাধও উপলব্ধি করছে। ইশ! তার জন্যই মাকে এতোটা যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। কেন ফেলতে গেল এদিকে! রান্না সম্পন্ন করতে থাকে মলিন মনে। এরমধ্যে বাজার থেকে বাবা ফিরলেই মনে পড়ে কাল সে মাইর খেয়েছিল বাবার হাতে। অন্যথায় এতোক্ষণ মায়ের পায়ের ব্যথাতেই ব্যথিত হয়ে থাকে। অসময়ে শিরিনকে শুয়ে থাকতে দেখেই সাত্তার কারণ জিজ্ঞেস করে। বাইরে থেকে এসে ঘর এখন অন্ধকার লাগছে। তাই নজরে পড়েনি গামছা বাঁধা পা। জামিলা বলতেই জানতে পারে সে। চোখ নেই, হুশ নেই, আক্কেল নেই বলে কতক্ষণ বিড়বিড় করে সাত্তার। একটার পর একটা ঝামেলা লাগিয়েই রাখে। আব্বা কাজে যাবে, তাই কান্তা ঝটপট আব্বার নাশতাটা তৈরি করে দেয় আগে। গরম ভাতে ডিম ভাজা আর গতকালের বেঁচে যাওয়া তরকারি জ্বাল করে তুলে দিয়েছে প্লেটে। সাত্তার তা দিয়েই চুপচাপ খেয়ে নেয়। শিরিন বলে, কাজে যাওয়ার আগে একটা নাপা টেবলেট এনে দিয়ে যেতে। তার কথার পরপরই কান্তা আবারও বলে,
“অনেকটা কাটছে। একটা ইনজেকশন নাও ডাক্তার দেখাইয়া। পরে কিন্তু সমস্যা হইবো।”
মেয়ের কথা কান পর্যন্ত যেতেই সাত্তারও স্ত্রীকে বলে,
“অনেকখানি নাকি কাটছে, আয় ডাক্তারের কাছে গেলে?”
“আমি এহন হাঁটতে পারতাম না। শরীর কেমন যেন লাগতাছে। জ্বর টর না আইতে লাগছে, কে জানে!”
“এইজন্যই তো ডাক্তার দেখাবি। আয় ভ্যানে কইরা নামায় দিয়া যামু নে।”
শিরিন বোরকা পরে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় সাত্তারের সাথে। ডাক্তার দেখিয়ে ব্যান্ডেজ করে ওষুধ নিয়ে আসে। সেলাইও নাকি লেগেছে তিনটা। যথেষ্ট দেবে গেছে, বুঝতে পারে কান্তা। সাত্তার তাকে ভ্যানে করেই বাড়ি নামিয়ে দিয়ে পরে গেছে কাজে। সারাদিনের রান্নাবান্না, ধোয়ামোছার কাজকর্ম সব একা একা সামলে নিয়েছে কান্তা। মাকে ভাত খেতে দিলেও নিজে মুখে তুলতে চাইছিলো না। শিরিন চোখ মটকিয়ে জোর করে বসায়। গতকাল সারাদিন অনাহারে কাটিয়েছে। মুখটা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে মায়ের চোখে। কষ্ট তো তাদেরও হয়। কিন্তু মেয়ে যে বুঝে না, বোঝাতে পারে না সবটা!
মামী এবং মামাতো ভাই এসেছে মামাতো বোনের বিয়ের দাওয়াত নিয়ে। আপাতত ছোট আয়োজনে বিয়েটা পরিয়ে রাখবে, মাস দুয়েক পরে বড় আয়োজনের মাধ্যমে বরপক্ষ বউ ঘরে তুলবে। ইফতেখার ডাকের সাথে সাথেই এসেছে তখন ঘরে। দেখা করেছে। আফজাল হোসেন ঘরেই ছিল। তার কাছেই দাওয়াত করেছে ইফতেখারের মামী, শেফালী। উপস্থিত ছিল পারভীনও। পরী তো পরিচিত মানুষ দেখে নাচতে নাচতেই নাশতা নিয়ে হাজির হয়েছে তাদের জন্য। শেফালী একটার বেশি রুটি নিলো না। সে নাশতা করে এসেছে বাড়ি থেকে। ছেলে, অপু এক চিমটি নিয়েছে মাত্র। সে মাত্রই খেয়ে এসেছে। এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই। তা দেখে পরী মন্তব্য করে,
“এহ! অপু ভাই যেন খাইতে জানে না। খান খান। লজ্জা কইরেন না। ফুপুর বাড়িতেই যদি লজ্জা করেন, শ্বশুর বাড়ি গিয়া তো মুখে রুমাল চাপ দিয়াই বইসা থাকা লাগবো। তাইলে আবার ঠকবেন কিন্তু কইলাম!”
অপু সেই এক চিমটি মুখে রেখেই হাসে। জবাব হয়তো দিতো কিছু হলেও, ফুপা থাকায় কিছুই বললো না। তবে শেফালী হেসে বললো,
“তোর এই বকবকানি স্বভাব জীবনেও যাইতো না রে, পরী।”
“গেলেই তো এই পরীরে ভুইল্লা যাইবেন, কাকি।”
“তুই যেই কড়কড়ি, চাইলেও তোরে ভোলা যাইবো না। যাস না ক্যা এহন ওদিকে?”
“হো, যামু। ওইযে, ঘরের কাজ চলতাছে না। সবকিছু আগে পিছে নিয়া দিতে হয়। তাই ছুটি নিতাছি না।”
“আচ্ছা, যাইস। দুলাভাই, সবাইরে নিয়া যাইবেন কিন্তু। সব আত্মীয়ের আগে আপনাগো দেখতে চাই।”
“যাইবো নে তারা। আমার কখন কোন কাজের তাড়া পড়ে, বলা যায় না।”
“না, না। তা কইলে চলতো না। আপনে যাইবেন মানে, যাইবেনই।”
“আচ্ছা, দেখা যাইবো।”
“উঠি তাইলে। দেরি করতাম না। অনেক জায়গায় যাওয়া লাগবো। দিপুর বউ কই? বিয়া তো খাইলামই না। দেখতেও কি পারতাম না? লুকায় রাখছো?”
মামির জিজ্ঞাসায় ইফতেখার সৌজন্যতার সাথে হেসে বলে,
“লুকাবো কেন! ওই একটু পশ্চিমে গেছে, পুকুরের দিকে। ডাকছি।”
ইফতেখার বেরিয়ে যায়। বিদায় নিতে থাকে শেফালী। শ্রাবণ পুকুরের সামনে থেকে সরে একটু আড়ালেই চলে এসেছিল। যেন গেটের কাছ থেকে সোজাসাপ্টা দেখা না যায়। ইফতেখার এসে তাকে জাম্বুরা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
“এখনো এটা নিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে আছো।”
শ্রাবণ একটু এগিয়ে আসে তার দিকে। উত্তর করে,
“তাল গাছের অবস্থা দেখছিলাম পেকে গেছে বুঝি অনেকটা। কালচে হয়ে গেছে।”
“এগুলো এমনই কালো জাত। পাকলে পড়তে শুরু করবে। এসো।”
“কোথায়?”
“ঘরে।”
“কে এসেছে?”
“মেজ মামী আর মামাতো ভাই এসেছে মামাতো বোনের বিয়ের দাওয়াত নিয়ে।”
“ওহ্। চলে গেছে?”
“না। তোমাকে দেখবে বললো।
“আমি যাবো না।”
শ্রাবণের আপত্তিতে ভ্রু হালকা কুঁচকে আসে তার।
“কেন?”
“এমনি।”
“এমনি মানে! একজন মেহমান এসেছে, নতুন বউকে দেখতে চেয়েছে। তুমি দেখা করতে যাবে না? উনি আমার আপন মামি হয়।”
“শুধু মামি থাকলে যেতাম। ওই লোকটা থাকায় যাবো না।”
“কেন?”
“ওই ছেলেটা রাজনীতি করে না?”
“হুম।”
“তাকে আমি চিনি।”
“তো?”
‘তো’ এরও কারণ লাগবে! কিছুটা হাতাশা ভাসে শ্রাবণের নিশ্বাসে। তবুও স্পষ্ট বলে,
“সে একটা বেয়াদব ছেলে। তাই আমি তার সামনে যেতে ইচ্ছুক না।”
একটু আশ্চর্যান্বিতই হয় ইফতেখার।
“রাজনীতি করলেই মানুষ বেয়াদব হয়ে যায়?”
“রাজনীতি না। আমি যাকে ভাবছি, সে-ই কি না নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করলাম সে রাজনীতি করে কি না। আর দোষ তার চরিত্রে।”
“কি দোষ করলো আবার তোমার সাথে?”
কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ঘটনার গভীরে যাওয়ার চেষ্টায় জানতে চায় ইফতেখার। শ্রাবণ তার চোখে তাকিয়ে সময় নেয় বলবে কি না। ইফতেখার অপেক্ষায়ই থাকে। বলে দেওয়াটাই ভালো মনে করে সে। তাই স্বাভাবিক কণ্ঠে জানায়,
“সে একজন ইভটিজার। রাস্তাঘাটে ঘুরাঘুরি করে মেয়েদের ডিস্টার্ব করতো।”
আশ্চর্যের হাসি মুখে স্পষ্ট করে ইফতেখার।
“বলছো কি! মামামামী সম্পর্কে তোমার ধারণা আছে?”
“সে কি যাত্রাবাড়ীর দিকে থাকে বা থাকতো কোনো কারণে?”
“হ্যাঁ, থাকে এখনো। কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ করে কোম্পানিতে। ভার্সিটির পড়াশোনাও ওদিকেই হয়েছে।”
শ্রাবণের ক্লু জেনে একটু চিন্তিত বেশেই জবাবটা দিলো ইফতেখার। শ্রাবণ তাচ্ছিল্যের সাথে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
“বাবা মা ভালো হলেই সন্তান ভালো হয়ে যায় না। বাবা মা খারাপ হলেও সব সন্তান খারাপ হয় না। চরিত্র গঠণ মানুষের অন্তঃস্থল থেকে হয়ে থাকে।”
“তুমি শিওর, সে ইভটিজার?”
“আমার পেছনেই ঘুরেছে আপনার ভাই। প্রায় দুইটা বছর রাস্তায় দেখলেই পিছু নিতো। কাজে যেতে ইচ্ছে হতো না তার বিরক্তির কারণে। যা তা অপমানও গায়ে লাগেনি। পিছু নিতোই। এরপর তো এদিকে চলে এলাম৷ তারও সুযোগ বন্ধ হলো। এরচেয়েও সুনিশ্চিত কোনো প্রমাণ চাই আপনার?”
ইফতেখারের মুখাবয়ব যেন অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। যদিও জানে, একটু দুষ্ট প্রকৃতির ছেলে অপু। কিন্তু এমন নোংরা কিছু বোধহয় প্রথম শুনলো তার ব্যাপারে। ইভটিজার! তাও আবার তার বউই সে কর্তৃক ইভটিজিংয়ের শিকার! ভুলেও তাই আর তাদের সামনে নেওয়ার ইচ্ছেটা দ্বিতীয় বার জাগায় না। যে কোনো পুরুষেরই হয়তো খারাপ লাগবে স্ত্রী কিংবা ঘরের কোনো সদস্যের সাথে এমন হয়েছে জানলে। তারও লাগছে। মুখের আবহই বদলে গেছে। এক প্রকার ঘৃণার জন্ম হয় মামাতো ভাইয়ের প্রতি। থমথমে মুখে একাই এগিয়েছিল দুই পা। ওদিকে মা ছেলে বেরিয়ে এসেছে চলে যাওয়ার জন্য। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দুজনকেই দেখতে পায়। এগিয়ে আসতে আসতে গলা ছাড়ে,
“নতুন বউ পলাইছে ক্যা? মামি শ্বাশুড়ির সাথে দেখা করতো না? এত লজ্জা নিয়া সংসারে আইলে চলে?”
হাসিমুখে কথা বলতে বলতে এগিয়েছে শেফালী। অপু মায়ের সাথে সমানতালে না এগিয়ে এলেও মায়ের কথার প্রেক্ষিতে মুখে হাসি স্পষ্ট করে তাকিয়েছিল এদিকে। দূর থেকে অবয়ব দেখেই যেন একটু সন্দিহান হয়ে পড়ে। মুখের সেইটুকু হাসির বিলুপ্তি ঘটে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আরও চার পাঁচেক কদম। নিশ্চিত হতেই বিস্মিত সে। শ্রাবণ এগিয়ে গেলেও খুব একটা যায়নি। পায়ের গতি এতোটা ধীর রেখেছিল যে মামিই যেন তার কাছে এগিয়ে আসে। সে মাথার আঁচল আরেকটু টেনে সালাম দিয়ে কথা বলে সৌজন্য মুখে। শেফালী সৌন্দর্যের প্রশংসা করে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। ইফতেখার এইটুকু সময়ের অধিকাংশ জুড়ে তাকিয়ে ছিল অপুর দিকেই। শ্রাবণ একদম মিথ্যে বলেনি। সন্দিগ্ধ ওই চোখে বিস্ময় ফুটতে দেখেছে ইফতেখার। শেফালীকে বিদায় দিয়ে শ্রাবণ আরেকবার তাকায় অপুর দিকে। নিকটে না এলেও দূরত্বের প্রায় অর্ধেকটা এগিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। এতোক্ষণ যাবত তো বিস্ময়েই ডুবে ছিল তাকে এই বাড়ির বউ হিসেবে দেখে, এখন শ্রাবণ তাকাতেই সেই বিস্মিত চেহারা রূপ পাল্টে ঠোঁটের কোণে সামান্য স্পষ্টতার সাথে দুষ্টু হাসির জন্ম দেয়। এই হাসির ফলাফল শ্রাবণের মুখের সৌজন্যতার হাসিটুকুও কেড়ে নেয়, যা সে শেফালীর জন্য ফুটিয়েছিল। চোখের গহ্বরে জন্ম নেয় ঘৃণিত ক্রোধ।
“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩০
(নূর নাফিসা)
.
.
শনিবার স্কুলে ক্লাস নিয়ে দুপুরে বাড়ি ফিরে বিপু। শ্রাবণকে উঠুনে দেখেই উৎফুল্ল গলায় বলে,
“ভাবি, চাকরি হয়ে গেছে আমার। প্রাইমারি লেভেল না, সেকেন্ডারির ক্লাসগুলোই করবো।”
“ভালোই তো! কাল জানলাম ট্রাই করছেন আর আজই কনফার্ম!”
“কিসের কাল! প্রায় এক সপ্তাহ যাবত চেষ্টা করছিলাম।”
“অভিনন্দন, নতুন জীবন নতুন কর্মসংস্থানের জন্য।”
মিষ্টি হেসে অভিনন্দন জানায় শ্রাবণ। বিপু ঘরে এসে মায়ের কাছেও বলে। পারভীন কিন্ডারগার্ডেনের কাজের প্রতি ততটা খুশি না হলেও ছেলের খুশিতে খুশি ব্যক্ত করে। পরী তো উল্লাসে গলা ফাটাতেই ব্যস্ত পিছু পিছু কিছু আদায়ে।
“বিপু ভাইজান, মিষ্টি খাওয়াইতেন না?”
“কিসের মিষ্টি! আমি টাকার বস্তা নিয়া ঘরে ঢুকছি নাকি!”
“মাস শেষে তো পাইবেনই।”
“গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল! দূর হো!”
“দূর হইতাম কেল্লাই? টাকা টোকা বুঝি না। খুশির খবর আনছেন তো মিষ্টি খাওয়াইবেন। ব্যাস।”
“বোয়ামে চিনি থাকলে খাইয়া নে।”
“মাস্টার হোন আর মুচি হোন ছোটলোকি জীবনেও দূর হইতো না। খাচ্চোর ব্যাডা! এইসব ব্যাডার ঘরে বউ টিকে না দুইদিনও। বুইজ্জা রাইখেন।”
যেতে যেতে তার কথায় হেসে গেলেও বিপুর মনটা ছুটে গেছে কান্তার কাছে। তাকে তো খবরটা দেওয়া হলো না! দিনকাল কেমন কাটছে, জানতে পারে না। কোনোরকম যোগাযোগই হচ্ছে না। দেখা করার উপায়ও পাচ্ছে না!
বিকেলে শিক্ষক ছুটি দিয়ে গেলেই নিজের ঘরে আসে অর্পা। শ্রাবণকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় চেইন ঠিক করতে দেখে। সোনার চেইনটা গলায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখছে শ্রাবণ। আকস্মিক নিজের গলায় হাত উঠায় অর্পা। তার গলা খালি! তার চেইনটাও তো এমন মোটা ছিল! ভাবির গলায় তো চেইন ছিল না! আর তার গলারটাই খুলে গেলো কিভাবে! তার তো খেয়ালই ছিল না গলার দিকে! বই টেবিলে ছেড়ে দিয়ে আরেকটু এগোয় অর্পা। এ তো তারই চেইন! শ্রাবণ তাকে আয়নায় দেখে পেছনে ঘুরেছে ততক্ষণে।
“পড়া শেষ?”
“হ্যাঁ। ভাবি, এইটা আমার চেইন না?”
নিজের গলায় চেইনে একবার তাকায় শ্রাবণ। পরক্ষণে মিষ্টি হাসির সাথে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ।”
“তোমার গলায় গেলো কি করে?”
“আমি খুলে নিয়ে গেছিলাম রাতে। তাই।”
“খুলে নিয়ে গেছো মানে!”
“সুন্দর লাগছিলো তোমার গলায় দেখে। তাই পরতে ইচ্ছে হলো।”
“অদ্ভুত! তাই বলে তুমি আমার গলা থেকে চেইন খুলে নিয়ে যাবে!”
“বা রে! তুমি আমার ননদ। নিতেই পারি।”
“না, পারো না। আমার চেইন দাও।”
“দেওয়ার জন্য তো নেইনি, ননদিনী।”
“আম্মু…”
অর্পা রাগান্বিত হয়ে বেরিয়ে যায় মাকে ডাকতে। এই বুঝি কান্নাই করে দিবে, তার চেইন নিয়ে গেছে! পারভীন শুনে অতি আশ্চর্য হয়। চেইনটা বোধহয় তার গলায় দেখেছিল একবার। তবে ততটা খেয়াল করে দেখেনি। এ কেমন কথা! আরেকজনের চেইন সে কেন খুলে নিবে! থমথমে মুখে অর্পার ঘরে এসে হাজির হয় পারভীন।
“অর্পার চেইন নিছো ক্যা?”
“পরতে মন চাইলো, আম্মা।”
“তাই বলে লুকায়া নিয়া যাইবা!”
“লুকিয়ে রাখলাম কোথায়? আমি তো পরেই আছি। আপনিই বলুন, ভালো লাগছে না নাকি আমার গলায়?”
“ভালা মন্দ বুঝি না। চেইন দাও।”
“দুঃখিত। আমার ইচ্ছায় নিয়েছি, আমার ইচ্ছে হলেই দিবো।”
“তোমার ইচ্ছা মানে! আরেকজনের জিনিস টাইনা নিজের ইচ্ছা দেখাইলে চলবো!”
ঝাঁজালো গলায় শাসায় পারভীন। শ্রাবণ স্বাভাবিক স্বরেই জবাব দেয়,
“আপনারও তো এটা বুঝা উচিত যে, ঘরে বউ আছে আজ কতদিন। অথচ এক টুকরো গহনা আপনি তার গায়ে জড়াননি। এই যেমন, কাল আপনার ভাবিই বলছিল চেয়ারম্যান বাড়ির বউয়ের কান গলা খালি থাকবে কেন? আমিও কথাটা কয়েকবার ভাবলাম। আসলে তিনি ভুল বলেননি। এই দেখুন, কী সুন্দর লাগছে এখন। গলাটা ভরা ভরা।”
“আমার মাইয়ার চেইন নিয়া নিজের গলা ভরা দরকার নাই। তারটা তারে ফিরায় দেও। আর কে কোনটার উপযুক্ত, কারে আমি কি দিমু না দিমু সেইটাও তোমার চেয়ে ভালো আমার মাথায় আছে।”
“কি আছে আম্মা, আপনার মাথায়? একজোড়া সিটিগোল্ডের চুড়িতেই আপনার বড় পুত্রবধূর বরণ হয়ে গেল!”
“আগে জানতাম না তো, কেমন যে তুমি। ভাবছিলাম অনেক কিছুই। এখন মনে হয় সিটি গোল্ডেরও যোগ্য না।”
“আমিও তা-ই বলি। সিটি গোল্ডের যোগ্য আমি একদমই না। রিয়েল গোল্ডের যোগ্যই আমি।”
“মুখে মুখে তর্ক কইরো না। চেইন দিতে কইছি, চেইন দাও।”
“দুঃখিত, আম্মা। যতটুকু জেনেছেন, খুব অল্পই জেনেছেন হয়তো। আপনার জানার এখনো অনেক বাকি আছে। আরও জানতে থাকুন। আমি এই চেইন দিবো না।”
বিছানায় বসে কাঁথা জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে শ্রাবণ। পারভীন খুবই রাগ হোন তার আচরণের উপর। কতটা স্পর্ধা হলে সে তার মেয়ের গলা থেকে চেইন খুলে নিয়ে যায়! কতটা স্পর্ধা হলে আবার তার সাথেই এভাবে তর্ক করে তাকে এড়িয়ে যায়! কথা শোনাতে না পেরে সুনিশ্চিত করে, তার বিহিত আফজাল হোসেনকে দিয়েই করবেন। গলা থেকে চেইন টেনে খুলে আনার মানসিকতা তার নেই। ক্ষিপ্ত পারভীন অর্পার হাত ধরে বেরিয়ে আসেন।
“তোর আব্বা আসুক, উনিই এর ব্যবস্থা করবেন। আয়।”
ব্যবস্থার কথা কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই বন্ধ চোখের মেলানো ঠোঁটে হাসি ভাসে শ্রাবণের। অবেলা শুয়ে থাকে চোখের বিশ্রামের জন্য। আফজাল হোসেন আসরের সময় বেরিয়েছিলেন। ফিরেছেন মাগরিবের নামাজ পড়ে তার পর। ইফতেখার আজ বাড়ি নেই। দুপুরের দিকে বেরিয়েছিল কাজে। ঘরের কাজ প্রায় শেষের দিকে। পছন্দের রঙ ও তার দামদর নিয়ে কথা বলতেই গেছে এক পরিচিত জায়গায়। তাই তার ফেরার অপেক্ষায়ও আছেন পারভীন। কি বেয়াদব বউ যে এনে দিয়েছে ছেলে, তা দেখাবে এবং কৈফিয়ত চাইবে। এদিকে আফজাল হোসেন ফিরতেই অর্পা দৌড়ে আসে। বাবার চেহারা দেখতেই যেন তার চোখের ধারা বইতে ব্যস্ত হয়েছে। গলায় সে কি আহ্লাদ জড়ানো ব্যথা! দরজার কাছে এসেই ডাক দেয়,
“আব্বু…”
আফজাল হোসেন টুপিটা আলনায় রেখেছিলেন। পিছু ফিরে মেয়ের চেহারা দেখেই জানতে চান,
“কি হইছে, আম্মা? কান্না কেন করো?”
অর্পা কান্নার বেগে ঠোঁট ভেঙিয়ে এগিয়ে আসে,
“ভাবি আমার চেইন নিয়ে গেছে। কিছু বলো।”
“কিসের চেইন নিছে?”
“আমার গলার চেইন নিয়ে গেছে গত রাতে। নিজে পরে বসে আছে। চাওয়ার পরও দিচ্ছে না। উল্টো দেবে না বলে জেদ ধরেছে।”
“নিছে ক্যা?”
“আমি কি জানি? ডেকে জিজ্ঞেস করো। কেন নিবে সে আমার চেইন!”
“ডাকো দেখি।”
“আমি পারবো না। তুমিই ডাকো।”
কান্নারত অভিমানিনী বিছানায় বসে যায়। ফোঁপাতে থাকে। আফজাল হোসেন পরীকে ডাকেন। পরী রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে।
“কি, কাকা?”
“শ্রাবণ নাকি অর্পার চেইন নিয়া গেছে?”
“আমিও তো জানি না, কাকা। মামার বাড়ি গেছিলাম একটু দুপুরে। সন্ধ্যায় ফিরা হুনি এই পালা! আম্মায় বকরবকর করতাছে।”
“ডাক তো দেখি শ্রাবণকে।”
“নামাজ পড়তাছে দেখছিলাম। শেষ হইছে কি না, কে জানে!”
বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে অর্পার ঘরে আসে পরী। শ্রাবণ মাত্রই নামাজ আদায় করে জায়নামাজ ভাজ করে রাখছিল। পরী পেছন থেকে বলে,
“ভাবি, আপনারে কাকায় ডাকছে।”
“কেন?”
“ক্যা আবার! আপার চেইন নিয়া গেছেন যে। তাত্তাড়ি আসেন।”
“আসছি।”
“আপনার সাহস দেখলে অবাক না হইয়া পারি না।”
“এমন অবাকের কারণ ক’জন হতে পারে বলো?”
মুচকি হেসে সামনে দিয়ে বেরিয়ে আসে শ্রাবণ। বোকার মতো তাকিয়ে থেকে পিছু পিছু হাঁটে পরীও। একদিকে শ্রাবণ হাজির হয়েছে, অন্যদিকে চা নিয়ে হাজির হয়েছে পারভীন। আফজাল হোসেন তার দিকে তাকাতেই শ্রাবণ বলে,
“আব্বা, ডেকেছেন?”
“অর্পার গলার চেইন নাকি খুলে নিছো? কারণ কি?”
“তেমন কিছু না। একটু পরে থাকতে চেয়েছি।”
আফজাল হোসেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“একটু পরতেই তো চাইছে, আম্মা। এতো কান্নাকাটি করার কি দরকার আছে?”
“শুধু পরতে নেয়নি। চুরি করে নিছে আমার গলা থেকে। ফেরত চাওয়ার পরও দিবে না বলছে।”
“মা, অর্পা কান্না করতাছে। দিয়া দেও তারটা তারে।”
“দুঃখিত, আব্বা। আমার পরে থাকার ইচ্ছে না শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি এটা ফেরত দিবো না।”
শ্রাবণের এমন অদ্ভুত কথার উপর একটু বিস্মিতই হয়ে উঠেন যেন আফজাল হোসেন। এতো সুন্দর করে দিয়ে দিতে বললো, তবুও শুনলো না দেখে পারভীনও এবার নালিশ করতে প্রস্তুত।
“স্পর্ধাটা দেখছেন খালি? দেখছেন অবস্থা? মুখের উপর ক্যামনে না কইরা দিলো যে? বিকালে আমি চাইতে গেছি পরেও আমার সঙ্গে বেয়াদবি করছে। আরেকজনের জিনিস সে নিবোই ক্যা? এগুলা কোন ধরনের কীর্তি?”
শ্রাবণ পারভীনের প্রত্যুত্তর করে উপস্থিত সকলের মুখোমুখি থেকেই,
“কি আজব কাণ্ডকারখানা তুলে রেখেছেন, আম্মা! এইটুকু একটা বিষয়ে এতো রিয়েক্ট করার কি আছে?”
“মাইয়ার প্রায় এক ভরির চেইন নিয়া গেছো, এইটুকু বিষয় কও তুমি আবার?”
“আশ্চর্য! ভরি এক হোক আর দুই হোক, একটা চেইনই তো নিয়েছি। কারো জীবন ছিনিয়ে তো নেইনি। কারো বেঁচে থাকার অধিকার তো ছিনিয়ে নেইনি আপনাদের মতো।”
“আমাদের মতো মানে? কার কি ছিনিয়ে নিছি আমরা?”
আরও ক্ষেপে যান পারভীন। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি স্পষ্ট করে শ্রাবণ বলে,
“বললেই চিনবেন নাকি!”
পারভীনের রাগ হয় তার তাচ্ছিল্যকর অভিব্যক্তির উপর। আরও ধমকে উঠে তাকে সাবধান করে,
“কথাবার্তা সাবধানে কইয়ো। কার সাথে কোন ধাঁচের কথা কইতে হয়, সেই কায়দা শেখা হয় নাই পরিবার থেকে।”
“পরিবার থেকে সব রকম কায়দাই শেখা হয়েছে, আম্মা৷ আর খুব ভালোভাবেই শেখা হয়েছে। শিক্ষায় ত্রুটি থাকলে, এই শ্রাবণ থাকতে নয়তো আপনাদের স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বাঁচতেও ত্রুটি হয়ে যেতো। আরও আগেই কিছুটা ঝড় এসে আপনার সাজানো সংসার লণ্ডভণ্ড করে যেতো। এই মনে করুন, আমার পরিবারের শেখানো কায়দার কারণেই তা হয়নি। চিন্তা নিয়েন না। স্বস্তিতে এমনিতেও বাঁধা আসবে আপনাদের। শীঘ্রই আসবে। শ্রাবণের তান্ডবলীলা ছাড়াই আসবে। অপেক্ষা করেন। আর হ্যাঁ, কাহিনী যখন এতোটাই রটিয়েছেন তো এই চেইন আমি আর দিবোই না।”
ঠমক নেড়ে কথা বলে চলে যায় শ্রাবণ। শুরু হয় আবারও পারভীনের ফুসলানো! বরাবরের স্পর্ধা যে কতটা জঘন্যরকম দেখিয়ে যাচ্ছে, কতটা দুর্ব্যবহার করে যাচ্ছে তার সাথে প্রতিনিয়ত, সবটাই ফুসলে যাচ্ছেন আফজাল হোসেনের সামনে। পরী হা হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রাবণের যাওয়ার পানে। আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে শক্ত দৃষ্টি ফেলে রেখেছেন দরজার দিকে। কানে কথা সবই যাচ্ছে, তবে তিনি শ্রাবণের স্পর্ধাটুকু মেপে গেলেন। কি ধরনের কথা বলে গেলো তাকে মুখের উপর অপমান করে! কি চাইছে সে? এসব করে তার কি লাভ? সংসারে অশান্তি টানার চেষ্টা কেন করছে? তার কোনো ক্ষতি তো সে করেনি। তবে কিসের এতো ঝাঁজ দেখাচ্ছে এখানে এসে?
চলবে।