শ্রাবণধারা পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
200

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৭
(নূর নাফিসা)
.
.
অনুমতি নিয়ে ফাতিহার কেবিনে প্রবেশ করে ইফতেখার। পাশাপাশি বিছানার দুই বৃদ্ধা গল্প করছে বসে বসে। ফাতিহার বয়স ততটাও বৃদ্ধা পর্যায়ের না। কখনো কখনো অভাব-অনটন কিংবা অসুখবিসুখও মানুষকে স্বল্প সময়ে বয়স বাড়িয়ে ফেলে। সংখ্যায় বছর কম হলেও তারা বার্ধক্যে নত হয়ে পড়ে। ইফতেখার ধীর পায়ে নিকটবর্তী হতেই ফাতিহার নজর পড়ে তার দিকে। বিস্মিত মুখে অপলক তাকিয়ে থাকে তার পানে। ইফতেখার সালাম দিয়ে ফলের প্যাকেটটা হাত থেকে রাখে বিছানার এক কোণে। অস্পষ্ট স্বরে সালামের জবাব দিয়েছে ফাতিহা। ইফতেখার নিজ দায়িত্বে টুল টেনে পাশে বসে। জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন, আম্মা?”
আম্মা ডাকে হৃদয় জুড়িয়ে যায় ফাতিহার। চোখটা ভিজে আসে হালকা করে। দরজার দিকে তাকিয়ে খোঁজে কাউকে। জবাব দেওয়া আর হয় না। ইফতেখার তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে পিছু ফিরে দেখে দরজায়। প্রত্যাশার কেউ নেই। শূন্য ময়দান। পুনরায় তার মুখে তাকিয়ে বলে,
“শ্রাবণ আসেনি৷ আমি একাই এসেছি। আপনি কি গতকালের চেয়ে সুস্থ অনুভব করছেন?”
আঁচল টিপে চোখ মুছে ফাতিহা বলে,
“আমার আর ভালা থাকা!”
ইফতেখার পাশের র‍্যাকে ফলমূল দেখে বলে,
“ফল তো সবই আছে দেখা যায়। খাননি কিছুই। ভালো থাকবেন কী করে? মেয়ে খায়িয়ে গেলো, সেইটুকুতেই বসে থাকলে হবে?”
মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে ফাতিহা বলে,
“হো, আগের সবই তো আছে। এগুলা আনতে গেছো ক্যা, অযথা?”
“খাওয়ার জন্য এনেছি। খেতে হবে আপনাকে।”
নিজ হাতেই বাটিতে পানি ঢেলে কিছু আঙুর ধুয়ে দেয় ইফতেখার তাকে। আরও কিছু এগিয়ে দিয়ে আসে পাশের বিছানায় বসে থাকা বৃদ্ধাকেও। পুনরায় টুলে বসে ফাতিহাকে বলে,
“আমি একটু প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি, আম্মা। আমায় একটু সাহায্য করবেন?”
মুখে সৌজন্যের হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে ফাতিহা।
“আমি আবার কী করতে পারমু তোমার জন্য?”
“আমি কিছু জানতে এসেছি। আমায় হতাশ করবেন না।”
বুকের ভেতরটা একটু মোচড় দিয়ে উঠে ফাতিহার। মুখের সৌজন্যের হাসিটুকু মলিন হয়ে যায় দুশ্চিন্তায়। কী জিজ্ঞেস করতে চায় সে! আবার সেই অতীতের খোলাসা? মেয়েটা বলে দিয়েছে বুঝি কিছু! কেন বললো! কেমন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে থাকে সে ইফতেখারের দিকে। ইফতেখারও আন্দাজ করতে পারে তার মনের সন্দেহটুকু। তবুও তার জানতে হবে। সে আবারও বলে,
“আমায় হতাশ করবেন না, আম্মা। শ্রাবণ আমায় অনেক কিছুই জানিয়েছে। কিন্তু সবটা তাৎক্ষণিক বিশ্বাস আনতে পারে না আমার মাঝে। গতরাতে ঘুম হয়নি আমার। আপনি আমায় নিশ্চিত করুন, যেন আজ রাত একটু ঘুমাতে পারি। আপনি কি সত্যিই আমার বড় আম্মা?”
ফাতিহা চোখ সরিয়ে নেয় তার থেকে। উত্তর দিতে একদমই অনিচ্ছুক। কেন মেয়েটা এমন করলো। তাকে তো নিষেধ করেছিলো, এসব বলতে। নাছোড়বান্দা মেয়ে শুনলো তাকে। ইফতেখার জবাবের প্রত্যাশায় তাকিয়েই থাকে। পরক্ষণে আবার বলে,
“চুপ থেকে আমায় হতাশ করবেন না, আম্মা। আপনি আমায় সত্যিটা বলুন, যেন কিছুটা হলেও ঠিক হয়ে আসে।”
“কেউ না, আমি তোমার কেউ না।”
দুহাত, মাথা দু’দিকে নাড়াতে থাকে ব্যথাতুর কণ্ঠে অনাগ্রহ প্রকাশ করে করে। ইফতেখার হতাশ হয়। কম্পিত একটা হাত তার দুহাতের মুঠোয় ধরে।
“আমি আপনাকে আম্মা ডেকেছি না? কেন তবে ছেলেকে উপেক্ষা করবেন? শ্রাবণকে আপনি উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন? আমাকেও করবেন না। আমার জবাব গুলো দেন। আব্বা আপনাকে সত্যি করেই গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছিলো?”
চোখের পাতা বন্ধ করে কেঁদে উঠে ফাতিহা। এদিকে জবাবের প্রত্যাশায় অস্থির হয়ে আছে ইফতেখার। চাপা হাত ঝাকিয়েই জবাব চায়,
“আম্মা, বলুন?”
উপর নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয় ফাতিহা। পরবর্তী প্রশ্নে এগিয়ে যায় ইফতেখার।
“তারপর বিয়ে করেছিলেন আপনারা। সংসার গড়েছিলেন এই শহরে?”
আবারও মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয় ফাতিহা। ইফতেখার ব্যথিত ঢোক গিলে পরপরই। যা জেনেছে, কোনোটাই মিথ্যে জানেনি তবে। সে আরও জিজ্ঞেস করে,
“তারপর আব্বা আপনাকে আপবাদ দিয়ে ফেলে চলে গেছে। আর খোঁজ নেয়নি?”
অন্যহাতে আঁচল তুলে মুখ ঢেকে নেয় ফাতিহা। কোনোরকম জবাব না দিয়ে হু হু শব্দযোগেই এবার কাঁদে সে। ইফতেখার তার হাতটা ছেড়ে দেয় নিজেকে সামলে নেওয়ার সুযোগ দিয়ে। নীরবে বসে থাকে কিছুক্ষণ মেঝেতে স্থির তাকিয়ে। মনে অবর্ণনীয় এক ব্যথা অনুভব করে। নিজ পিতার অপ্রত্যাশিত নির্মম সত্য তার এই ব্যথার কারণ। কি অদ্ভুত যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে আবারও! মেঝেতে স্থির তাকিয়েই থাকে এই যন্ত্রণা নিবারণের জন্য। ফাতিহার কান্না কমে এলেই সে আঙুরের বাটিটা এগিয়ে দেয় খাওয়ার জন্য। ফাতিহা খায় না। চুপ করে বসে থাকে। তাকায় না ইফতেখারের দিকেও। ইফতেখার টুলটা আরেকটু টেনে বিছানার সাথে ঘেঁষে বসে। হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে নিজ মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে বলে,
“কাঁদবেন না। ছেলে আপনাকে একটা আবদার করলে শুনবেন?”
ইফতেখারের মুখে না তাকিয়েই সে দুদিকে মাথা নাড়ে। কোনো আবদার সে শুনবে না। এইটুকু জবাব দিতেও একদম ইচ্ছুক ছিলো না। ইফতেখার হতাশার সাথে চোখে নামিয়ে আবার তার পানে তাকিয়ে উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করে,
“শ্রাবণ কোনো আবদার করলে শুনবেন?”
ফাতিহা এবার তার মুখের দিকে তাকায়। তারপরও মাথা নাড়ে দু’দিকে। শুনবে না সে শ্রাবণের আবদারও। ইফতেখার মুখের হাসি স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করে,
“কেন শুনবেন না? বাচ্চাদের আবদার শুনতে ইচ্ছে করে না?”
“ভয় লাগে।”
ইফতেখার বুঝতে পারে, কোন ভয় তিনি পেয়ে যাচ্ছেন। সে তো সেই ভয়ের কথাই বলতে চাইছিলো, যা তিনি আন্দাজ করে ফেলেছেন ইতিমধ্যে। তাই বুঝি শুনতে চাইছে না। তবুও বলবে ইফতেখার। তবে গুছিয়ে বলার চেষ্টা করে,
“শ্রাবণ আপনার প্রিয় মেয়ে না? তাকে সংসারী হওয়ার কত পরামর্শ দেন। তবে তার সংসারটা আপনার সামনে থেকে দেখতে ইচ্ছে করে না? একটু ভাবুন তো, কেমন হয় যদি আপনি আর শ্রাবণ একটা বাড়িতে থাকেন। একটা সংসার গন্ডিতে থাকেন। সময়ে অসময়ে ডেকে গল্প করেন। শ্রাবণ কাছ থেকে আপনার খেয়াল রাখলো। আপনি তার মতো আরও কয়েকটা বাচ্চা চোখের সামনে ঘুরাঘুরি করতে দেখেন৷ একটা জোটবদ্ধ পরিবার দেখেন। হাসিখুশি, কোলাহল সবকিছু নিয়ে প্রতিদিন বেঁচে থাকেন। সুন্দর হয় না? ইচ্ছে হয় না, একটু তেমন জীবন ধারণ করতে?”
এমন সংসারই তো জীবনে চেয়েছিলো সে। স্বামী, সন্তান, পরিবার নিয়েই বাঁচার ইচ্ছে বুনেছিলো আপন ভুবনে। সেই প্রত্যাশা নিয়েই তো আপন পরিবার ফেলে চলে এসেছিল সেদিন। কিন্তু, সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়? কিছু ইচ্ছে তো এমন অলৌকিক স্বপ্ন হয়েই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এইতো, বুকে বাঁধা স্বপ্নের শেষটায় কিছুটা পূর্ণতা আনতে স্বপ্ননিকেতন তাকে বরণ করে নিলো। পথে পড়ে মরার ভয়টুকু সে এখন পায় না। ইফতেখারও এদিকে জবাব পায় না। তাই আবারও জানতে চায়,
“ইচ্ছে হয় না?”
“না, বাবা। না। এইসব ইচ্ছা সবার করতে নাই। তোমরা এমন কিছু আমার কাছে চাইয়ো না।”
“কেন ফেরাচ্ছেন শুধু শুধু? আপনি ওই বাড়ি যাবেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাবো। আপনার সংসারের একটা অংশ অন্তত আপনাকে অধিকার প্রাপ্ত করে তুলুক। আমি আবার আসবো। আপনি আমায় ফেরাবেন না। আমি বাসায় কথা বলবো আপনাকে নিয়ে। তারপর এখানে কথা বলেও আপনাকে নিয়ে যাবো।”
“মাইয়াটারে না করছিলাম কাউরে কিছু জানাইতে। শুনলোই না!”
আবারও কান্না করে ফাতিহা। ইফতেখার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আল্লাহ সবার ভালোর জন্যই সবকিছু করেন। আপনাকেও একটা ভালো কিছু দেওয়ার জন্যই হয়তো একটা শ্রাবণ এসেছিলো আপনার কাছে, আমাদের কাছে। আপনি কাঁদবেন না। পরিবারে ফিরে গেলেও ভালো থাকবেন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি। আপনার ভালো থাকার খেয়াল আমি রাখবো। আপনি আপনার শ্রাবণের সাথে ভালো থাকবেন৷ শ্রাবণও ভালো থাকবে আপনাকে পেয়ে। আমরাও ভালো থাকবো আপনাকে ভালো থাকতে দেখে। আসি। এই ফলমূল সব খেয়ে শেষ করবেন। ওষুধের অনিয়ম করবেন না। ডাক্তার দেখে যায় প্রতিদিনই?”
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয় ফাতিহা। ইফতেখার বিদায় নিয়ে চলে আসে পরপরই। মোটরসাইকেলে চড়ে রওনা হয় বাড়ির দিকে।
বড় ছেলে বাড়ি নেই। ছোট ছেলে স্কুলে। মেয়েও স্কুলে। তারউপর পরীটাও চলে গেছে বাপের বাড়ি। অনেকদিন হয় যায় না। দুতিনদিন কাটিয়ে আসতে চেয়েছে। আজ মিস্ত্রিরাও আসেনি। মেঝের সবটা আস্তর করা হয়ে গেছে। তিন-চারদিন সময় নিবে তাতে পানি জমা রেখে। পরে রং মিস্ত্রির কাজ চলবে। দুপুরের চেয়ারম্যান বাড়ি খাঁ খাঁ করছে একরকম জনশূন্যতায়। শ্রাবণ নীরব হয়ে বসে আছে এক ঘরে প্রায় বন্দী অবস্থায়। আর এদিকে খুটিয়ে খুটিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পারভীন। তারও মুখ জুড়ে কোনো শব্দ নেই। একদম নিস্তব্ধ প্রায় পরিবেশ। আফজাল হোসেনও যে সকালে নাশতার পরপর বেরিয়েছেন, এ-ই এলেন মধ্যদুপুরে। গোসল সেরে নামাজে গেলেন। ফিরে এলে থমথমে মুখে খাবার দিলেন পারভীন। চুপচাপ খেয়ে গেলেন তিনি। পারভীন তাকে খাবার দিয়েই নামাজে দাঁড়িয়ে গেছেন। নামাজ শেষ হতে হতে এদিকে খাওয়া শেষ আফজাল হোসেনের। দাঁত খিলাতে খিলাতে চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছেন। বাইরে শূন্যদৃষ্টি রেখে ভেবে যাচ্ছেন কিছু। এরইমধ্যে পারভীন ভাবনার ছেদ ঘটায় কিছু বলতে চেয়ে। বুকে ব্যথা নিয়ে থমথমে মুখে তিনি বলেন,
“আপনার সম্পর্কে নিজ থেকে যতটুকু জানাইছেন, ততটুকুর বেশি জানার ইচ্ছা পর্যন্ত জাগাইনি কোনোদিন। আজ কিছু জিগাইতে চাই। প্রশ্ন সন্তান করছে মায়ের কাছে। কোথাও কোনো গুঞ্জন উঠছে। আমি কি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী?”
আকস্মিক রুক্ষ চোখে তাকায় আফজাল হোসেন। ময়লায় বুঝি ঘাটাঘাটি পড়েছে। তাইতো দুর্গন্ধ বাতাস ছুয়ে নিয়েছে।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৮
(নূর নাফিসা)
.
.
“আপনার সম্পর্কে নিজ থেকে যতটুকু জানাইছেন, ততটুকুর বেশি জানার ইচ্ছা পর্যন্ত জাগাইনি কোনোদিন। আজ কিছু জিগাইতে চাই। প্রশ্ন সন্তান করছে মায়ের কাছে। কোথাও কোনো গুঞ্জন উঠছে। আমি কি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী?”
আকস্মিক রুক্ষ চোখে তাকায় আফজাল হোসেন। ময়লায় বুঝি ঘাটাঘাটি পড়েছে। তাইতো দুর্গন্ধ বাতাস ছুয়ে নিয়েছে! পারভীন প্রায় ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। নিরুত্তর ওই রুক্ষ চোখে চোখ রেখেই ফোঁপানো গলায় বলে,
“আমি শুধু জানতাম, সম্পর্ক হওয়ার ছিলো। পরিবারের অমতের কারণে হয় নাই। কিন্তু, হওয়ার পরেও কী কারণে আমার সংসার হইলো এই ভিটায়? আর হইলোই যখন, এতো বছর পরে কেন অতীতের বাতাস দুয়ারে ধাক্কা খায়? কেন আমার সন্তানের লজ্জার কারণ হয় সেইসব!”
আফজাল হোসেন বুঝতে দেরি করেন না, ইফতেখারই পারভীনকে করেছে তবে এই প্রশ্ন! এদিকে পারভীনের প্রায় কাঁদো কাঁদো ভাব। ওদিকে ক্রোধের ভারে নেমে আসে আফজাল হোসেনের রুক্ষ চোখ। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার সোজাসুজি এনে রাখে। পারভীন তাকে চুপ থাকতে দেখে আরও ব্যথিত হোন। বলেন,
“আমি তো খুব যত্নে লালন করছিলাম এই সংসারটা। সুখের একটা নাটাই ধরে রাখছিলাম এতো বছর যাবত। কেন অসুখের আগুন পড়লো আমার নাটাইয়ে? কী পাপ করছিলাম আমি? কীসের প্রতিদান পাইতাছি তবে?”
আফজাল হোসেন গম্ভীর মুখে বলেন,
“পোলা ভালা না, তাই তোমার নাটাইয়ে অসুখ লাগছে।”
“দোষ যদি পোলা খুঁজে পায়, তবে ভালো থাকবেই ক্যামনে? এতো বড় হইয়া এইসব শুনে, তাদের গায়ে লাগে না? এতোবছর ধইরা বিশ্বাস গেঁড়ে রাখছি, তারপরও যদি আজ অবিশ্বাসের ফুলকি এসে আঘাত কইরা যায় আমার গায়ে লাগে না?”
“ঘ্যানঘ্যান কইরো না, যাও। এমন না যে, সব লুকায় রাখছি; গোপনে গোপনে সংসার সামলায় যাইতাছি। শুরুতেই জানাইছিলাম তোমারে।”
“আপনি আমারে কোনোদিন বলেন নাই, বিয়ে করছিলেন।”
“সম্পর্ক ছিলো, তা তো জানো। বিয়ে করি আর না করি, তাতে কী? জানলে থাকতা না এতো বছর?”
এই প্রশ্নের জবাব নেই পারভীনের কাছে। থাকতো কি না সেটা তখন জানলে, সিদ্ধান্তটাও তখনকার পরিস্থিতির ভিত্তিতেই নিতে পারতো। এখন কী যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে? খুঁজবেই আর কীজন্য? সবই তো তার এখানে! বুকে জমা এক রাশ ব্যথা নিয়ে পারভীন চলে যায় তার কাছ থেকে। হাউমাউ করে কাঁদতে পারে না কোনো সুস্পষ্ট যৌক্তিক কারণ নিজের সামনেই দাঁড় করাতে না পেরে। তবে কাঁদে, মনে মনে কাঁদে। বিশ্বাসের অমর্যাদা হওয়ায় কাঁদে। সন্তানের গায়ে লজ্জার আঁচড় পড়বে, তাই কাঁদে। বাচ্চারা বড় হয়েছে, এখন হুটহাট পিতামাতার সম্পর্কে লজ্জাকর কিছু জানলে তাদের গা জ্বালা করবে। মাথা নত হয়ে আসবে। লোকমুখে দুই কথা শুনলে লোকচক্ষু হতে দৃষ্টি সরে আসবে লজ্জায়। কেন করলেন তিনি এমন? খোলাসা হয়ে যা লজ্জা দিবে তাদের, তা কেন তিনি গোপনে গেঁথে রাখলেন? এতো বছর পরে এসব উঠেই আসছে কেন? কার কী উদ্দেশ্য হাসিল হবে তাতে? ওই নারীর তো কোনো খোঁজই নেই আশপাশে। তবে কেন ঘাটাঘাটি পড়েছে সেদিকে?
ব্যথা বুকে চাপিয়ে রাখতে নিশ্বাসে কম্পন উঠে পারভীনের। হনহন পায়ে পরপরই আসে অর্পার ঘরে। শ্রাবণকে বসে থাকতে দেখে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে,
“কী ক্ষতি করছিলাম তোমার? কী কারণে আমারে জ্বালাইতে আইছো? অন্যায়টা কী আমার? সুখের সংসারে কেন আগুন লাগাইতে আইছো?”
শ্রাবণ তার দিকে তাকিয়ে মুখোমুখি প্রত্যুত্তর করে,
“এসব কী বলছেন, আম্মা? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। আপনার সংসারে আগুন লাগাতেও আসিনি। আর না আপনাকে কোনো অপরাধের দোষী হিসেবে চিহ্নিত করেছি।”
“আগুন লাগাইতাছো না তো কী করছো বইসা বইসা? তুমি আসার পর থেকে শান্তি নাই আমার দুয়ারে। সংসারটা কী আমার এমন লণ্ডভণ্ড ছিলো?”
তাচ্ছিল্যের সাথে নিশ্বাসে মৃদু হাসি ঝাড়ে শ্রাবণ। বলে,
“এইটুকু শান্তি আপনার সংসারে সয় না, আম্মা? ওদিকে যে একটা নারীর পুরো জীবনটাই অশান্ত হয়ে রইলো, তার ব্যথাটুকু তো একটু অনুভব করেন একটা নারী হওয়া সত্ত্বেই। যার সংসার জুড়েই আপনারা বসে আছেন এতোটা সময়।”
“কী বলতে চাও তুমি? হ্যাঁ? তার সংসার আমি ভাইঙ্গা দিছি?”
“আমি শুরুতেও আপনাকে দোষারোপ করিনি, এখনো করতে চাইছি না। কিন্তু নিজের ঘাড়ে দোষ টেনে নিতে আপনি বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছেন। তার সংসারে আপনার কোনো প্রভাব আছে কি না, তা আপনিই ভালো জানেন। আমি শুধু এইটুকু জানি, এই সংসার উনার প্রাপ্য।”
“কার প্রাপ্য? কার সংসারে আইসা তুমি কার প্রাপ্যতা দেখাও? মাতব্বরি কম করো। আসার পর থেকেই শান্তি খাইতে শুরু করছো। সবটা কথার মধ্যে মাতব্বরি চালান দাও। তোমারে কে ডাকছিলো আমার সংসারে? দূর থেকেই পোলার ঘাড়ে বইসা মাথা নষ্ট করছো। এহন ঘরে আইসা দিনরাত তারে সংসারা ছাড়া করতাছো।”
“উল্টাপাল্টা বলবেন না আম্মা। এসব কথা হয়তো আমার চেয়েও বেশি খারাপভাবে চাপতে পারে আপনার ছেলের উপর। স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো আপনি বরাবরই অস্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করেন। সঠিক জায়গায় হাল চাষ করতে পারেন না।”
“চ্যাটাং চ্যাটাং কথা চালাইয়ো না। কোন হাল কোন জমিতে চাষ করা লাগে, সেইসব তোমার শেখাইতে হইবো না। নম্র স্বভাবের হইয়া থাকতে পারলে এই বাড়ি থাকো। আর নাহয় দূর হও। কোনো অশান্তির ছায়া আমি বাড়ির সীমানায় রাখবো না।”
ঠোঁট কার্ণিশে তাচ্ছিল্যের হাসি জাগায় শ্রাবণ।
“কেন জানি এখন আপনাকেও দোষারোপ করতে ইচ্ছে হয় আপনার স্বার্থপরতা মনোভাবের কারণে। কিন্তু করবো না। হয়তো বা অতি কষ্টের চাপেই স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন। একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুন। আর হ্যাঁ, আমি আপনার ইচ্ছায় এই বাড়িতে আসিনি। তো আপনার ইচ্ছায় যাওয়ারও প্রশ্নই আসে না!”
কথা বলেই বসা থেকে কাথা টেনে শুয়ে পড়ে শ্রাবণ। পারভীন ক্ষিপ্ত হয়। আরও কান্না পায় মনের ক্ষিপ্ততায়। থমথমে মুখে হনহনিয়ে চলে যায় রান্নাঘরে। মাথায় হাত চেপে টেবিলে কনুই ভর করে টুলে বসে থাকে আনমনে দুঃখের চাদর বুনতে। স্বামী, ছেলে, ছেলের বউ সবদিক থেকেই নিজেকে বড় অসুখী মনে হচ্ছে তার। শ্রাবণ শুয়ে পড়লেও চোখে ঘুম নেই। মাথাভর্তি দুশ্চিন্তা। এবাড়িরও দুশ্চিন্তা, বাড়ির বাইরেরও দুশ্চিন্তা! কোনদিক রেখে কোনদিকের ব্যবস্থা আগে করা দরকার, ভেবে পাচ্ছে না।
প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে, ইফতেখার ফিরেছে বাড়িতে। মোটরসাইকেলের শব্দে শ্রাবণ বাইরে ফিরে তাকিয়েছে। মাত্রই শোয়া থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে এসেছিলো বাইরে থেকে। হাতে গামছা নিয়েই দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ইফতেখার তার দৃষ্টির সামনে দিয়েই পাশের রুমে গেলো। পোশাকাদি নিয়ে আবারও দৃষ্টির সামনেই দিয়েই বেরিয়ে গেলো বাইরের বাথরুমের উদ্দেশ্যে। আসা যাওয়ায় একবারও তাকালো না এই ঘরে। অথচ এতোটা সময়ে শ্রাবণ সেদিকেই চোখ রেখে বসেছিলো। সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা ব্যস্ত। আর বসে থাকা শ্রাবণ চিন্তিত।
ইফতেখার গোসল সেরে আবার ঘরে যাওয়ার সময় তাকিয়েছে অর্পার ঘরে। শ্রাবণকে দেখে গেছে, বলেনি কিছুই। তবে ঘরে গিয়ে একটু পরেই ডাকলো। এই ঘর থেকে শুনে শ্রাবণ উঠে গেছে তার কাছে।
“ডেকেছিলেন?”
“খাবার দাও।”
শ্রাবণ চুপচাপ চলে যায় রান্নাঘরে। পারভীন একইভাবে এখানে বসা। দৃষ্টি গাঁথা জানালার বাইরে। শ্রাবণের উপস্থিতি টের পেলেও তাকায়নি সেদিকে। শ্রাবণ চুপচাপ ইফতেখারের খাবার নিয়ে চলে গেলো। খেতে বসতে গিয়ে ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“মন খারাপ নাকি?”
“না। কোথায় ছিলেন? সকালের নাশতাও তো করলেন না। বাইরে খেয়েছেন?”
“খাইনি। ভুলেই গিয়েছিলাম, নাশতা করা হয়নি।”
“ভালোই তো।”
ইফতেখার আবার তার মুখে তাকিয়ে শঙ্কিত হয়,
“তোমার শরীর খারাপ?”
“না, আমি ঠিক আছি।”
“বেঠিক লাগছে। মনই খারাপ।”
তার কথা শুনে মৃদু হাসির চেষ্টা করে শ্রাবণ। ইফতেখার বলে,
“মন খারাপ করো না। স্বপ্ন নিকেতনে গিয়েছিলাম আজ। আম্মাকে নিয়ে আসবো শীঘ্রই বাড়িতে।”
শ্রাবণ একটু বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে থাকে তার মুখে। কাল গিয়ে আবার আজই চলে গেলো! মনে মনে আন্দাজ করে, খুবই গভীরতার সাথে দায়িত্ব নিতে চাইছে লোকটা। নেতিবাচক প্রভাবের কিছু দেখছে না তার মনোভাবে। যতটা সহজ মনে করছেন, ততটা সহজে সফল হবেন তো এই লড়াইয়ে? উনার নিজ আম্মাই তো বিপরীত আচরণ করে গেলো একটু আগে। ইফতেখার তার দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। তাই জিজ্ঞেস করে,
“কী?”
“একা একা লড়তে যাবেন না।”
“মানে!”
“আব্বা আম্মা না চাইলে উনাকে আনতে যাবেন না।”
“আমি আব্বার সাথে কথা বলবো।”
“আম্মার সাথেও সহজ হয়ে নিতে হবে। আপনি উনাকে নিয়ে এলেন, আর উনি এসে আপত্তিকর পরিস্থিতি দেখলে বিভ্রান্ত হবেন। মানসিক অশান্তিতে ভুগবেন। আর মানসিক অস্থিরতা মানুষের দৈহিক ক্ষতিও সাধিত করে ফেলে। এমন কিছু যেন নাহয়, তবেই আনতে যাবেন। নয়তো সেখানেই তিনি ভালো আছেন, ভালো থাকবেন।”
“বাড়ি এলেই ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“হবে না। আপনি যতটা সহজ ভাবছেন, ততটা সহজও না। বাড়ি পর্যন্ত তো উনাকে মানিয়ে নিয়ে আসতে পারবেন, কিন্তু সুখের ভরসাটুকু আপনি একা হতে পারবেন না। এখানে মুখ্য ভুমিকা থাকতে হবে আপনার আব্বার। তিনি না আনলে, কাউকেই আনতে হবে না। এ বাড়ির সাথে উনার সম্পর্কই আব্বাকে ঘিরে। আর আপনি আব্বাকে জোর করতেও যাবেন না। এমন যেন নাহয়, আপনার চাপে তিনি বাধ্য হোন। মানুষ বাধ্য হয়ে কখনো দুটি কথাও হাসিমুখে বলতে পারে না, জানেন তো? আম্মা এমনিতেই একজন অসুস্থ মানুষ। উনার দরকার সাপোর্ট। উল্টো যেন অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি নাহয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।”
ইফতেখার চুপচাপ খেতে থাকে। একটু দুশ্চিন্তাও মাথায় চেপে যায়। সে যে গেলো, তিনি তো কাঁদলেন। আবার না কান্নার কারণেই অসুস্থতা বেড়ে আসে! নাকি একটু সাপোর্ট মনে করে শান্তি পাবেন? ভাবতে থাকে সে।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৩৯
(নূর নাফিসা)
.
.
বাবার সাথে কথা বলতে গিয়েছিলো ইফতেখার। যাওয়ার সময় শান্ত মেজাজে গেলেও বেরিয়েছে গলা উঁচিয়ে কতক্ষণ মেজাজ দেখিয়ে। বলেছিলো, ফাতিহাকে নিয়ে আসবে সে। আফজাল হোসেন তাকে নিয়ে আসার স্বীকৃতি দিলেন না। তিনি এমন অন্যায় কেন করলেন, ছেলের কাছে তার জবাবদিহিতাও করলেন না। তার মাকে ঠকিয়েছে, তাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, সেজন্য কতক্ষণ চেঁচামেচি করে গেলো। আফজাল হোসেন ধমক দিলেই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো। সাথে এ-ও বলে গেলো, সে আনবেই ফাতিহাকে এই বাড়ি। শ্রাবণ পাশের ঘর হতে সবই শুনছিলো। তাদের সম্মুখে আসেনি। ইফতেখার মেজাজী লোক, সে জানে তা। তাই আগেই সন্দেহ করছিলো, বাবার সাথে রাগ দেখাতেও দেরি করবে না সে। হলোও তা-ই। আর তাই আরও একধাপ হতাশা পুষে বসে রইলো। এতো জেদ কেন উনার! ইফতেখার সেই যে সন্ধ্যার আগে বেরিয়েছে, বাড়ি ফিরেছে একদম ঘুমানোর সময়। পারভীনের মন মলিন, তাই রান্নাটাও নিজ দায়িত্বে নিজ হাতে করে নিয়েছে শ্রাবণ একা একা। আজ এই ঘরের বাচ্চাদেরও মন মলিন। মলিন মন বিপুর, মলিন অর্পারও। যার ইচ্ছে হয়েছে, খাবার খেয়েছে। যার হয়নি, খায়নি। আফজাল হোসেনের খাবারটা ঘরে দিয়ে গেছে শ্রাবণ নিজেই। আফজাল হোসেন তাকে দেখেও কিছু বলেননি। চুপচাপ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন। মুখগহ্বরে দেবে ছিলো রাগ। হয়তো স্ত্রীর প্রতি, নাহয় পুত্রের প্রতি কিন্তু পুত্রবধূর প্রতিই উনার এই রাগ। ইফতেখার বাড়ি এলে শ্রাবণ বেরিয়ে এসেছে অর্পার ঘর থেকে। বিপু মশারী টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তাই বললো,
“রান্নাঘরে আসুন, সেখানে খাবার দিচ্ছি।”
একবার দরজার দিকে তাকিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত থেকে ইফতেখার বললো,
“খাবো না।”
“খাবারগুলো নষ্ট হবে।”
“ঘুমাও গিয়ে।”
“আপনার জন্যই জেগে ছিলাম। আসুন তাড়াতাড়ি।”
“আমি খাবো না। গিয়ে ঘুমিয়ে থাকো।”
“আমি খাইনি কিন্তু।”
বারবার বলায় বিরক্তি ও হতাশিত চোখে তাকায় সে। শ্রাবণ তার চোখকে উপেক্ষা করে বলে যায়,
“দুই মিনিট অপেক্ষা করবো।”
বিরক্তিকর একটা নিশ্বাস ফেলে সে-ও হনহন পায়ে রান্নাঘরে যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। দুজনেরই খাওয়া হয় চুপচাপ। মন মলিন থাকলেও একের পর এক ঘরের সবাই-ই খেলো, মুখে খাবার তুললো না শুধু পারভীন। শ্রাবণ একাধিকবার ডেকেছিলো। অর্পাকে দিয়ে খাবারও পাঠিয়েছিলো। উল্টো ধমক দিয়ে তাড়িয়েছেন। পরবর্তী সকাল হতে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন। রান্নাটাও নিজেই বসিয়েছেন। টানা দুদিন যাবত এমন থমথমে রয়ে গেলো পরিবেশ। এসময় পরী ফিরে এসেই যেন শোকাবহ পেলো। আন্দাজে সময় নেয় না, কিছু হয়েছে। অর্পাকেই খোঁচা মেরে জেনে নেয় চেয়ারম্যান কাকার গুপ্ত কাহিনী। নাক ছিটকায় মনে মনে। মায়া হয় বাকিদের মুখে তাকালে৷ পরবর্তী দিন শ্রাবণের কাছও ঘেঁষে গেছে এই ব্যাপার নিয়ে। ফাতিহা নিয়ে জানার আগ্রহ তার মনে বেড়েই চলেছে প্রচুর। শ্রাবণ তখন বই হাতে আনমনে তাকিয়েছিলো জানালার বাইরে। পরী এসে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি, চা খাইবেন?”
শ্রাবণের ধ্যানভঙ্গ হলে সে ফিরে তাকিয়ে বলে,
“না। তোমার ভাইজান ঘুম থেকে উঠেছে?”
“উঠে নাই। এতো রাত করে বাড়ি আইলো ক্যা ভাইজান? আপনে আসার পর তো একদিনও দেখলাম না দেরি করতে।”
শ্রাবণ মুখে সৌজন্যের হাসি এলিয়ে বলে,
“ফিরেছিলো তো একদিন। কোথায় যেন ঘুরতে গেলো সেদিন, ফিরতে রাত হলো।”
“ওইটা হালকার উপ্রে ঝাপসা।”
শ্রাবণ বইয়ের পাতা অযথা উল্টাতে উল্টাতে বললো,
“গাড়ির ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলো মালামাল আনয়নের জন্য। তাই দেরি হয়েছে নাকি।”
“ওহ্। ভাত খাইবেন? নিয়া আসি?”
“না, একটু পরে খাই।”
“রুটি আনি তবে?”
শ্রাবণ তার মুখে মনোযোগ সহিত তাকিয়ে বলে,
“আমি খাওয়ার হলে নিজেই নিয়ে খাবো। আম্মার কোনো প্রয়োজন হতে পারে, আম্মাকে সহযোগিতা করো। অন্যদের দিকে খেয়াল দাও।”
পরী এসে পাশে বসে যায়।
“তা তো রাখমুই। আপনিও তো এই বাড়ির সদস্য। আপনের খেয়াল রাখতে হইবো না তবে! তাছাড়া ভাইজান কত কয়, ভাবির খেয়াল রাখিস। সেইজন্যও তো আলাদা একটা দায়িত্বে থাকতে হইবো। পরী আছেই, সবার খেয়াল রাখতে। দরকার হলে খালি কইবেন একবার।”
“আচ্ছা। যখন দরকার হবে, ডাকবো।”
“ভাবি, একটা কথা বলেন তো দেখি।”
“কী?”
পরী ফিসফিসে গলায় বলে,
“কাকায় যে আরেকটা বিয়া করছে, এইটা তো সত্যি। তাই না? তা-ও নাকি আবার সাত্তার কাকার বইন হেই কাকি! তো বেডি শহরে গেলো ক্যামনে? তাগো কি আত্মীয় আছে শহরে?”
শ্রাবণ এতোক্ষণে পরিষ্কার হয় তার কাছ ঘেঁষার উদ্দেশ্য নিয়ে। বইটা বন্ধ করে বলে,
“এই ছিলো আপনার মনে?”
মুখ টিপে হাসে পরী। বলে,
“আমার খুব ইচ্ছা করতাছে তারে দেখতে।”
“উনার তকদীরে যদি সংসার অধিকার লেখা থাকে, তবে তিনি আসবেন আপনার ইচ্ছে পূরণ করতে।”
“আল্লাহ! দুই সতীন ক্যামনে সংসার করবো এক বাড়িত!”
“সম্ভব হলে কতভাবেই করা যায়।”
“উনার পোলাপান কয়জন? সব বড় বড়ই?”
“তিনি নিঃসন্তান।”
“ও, এইজন্যেই তবে কাকায় আরেক বিয়া কইরা লইছে।”
“তোমার কথা কেন মানুষ গুরুত্ব কম দেয়, জানো? এই অতিরিক্ত কথার জন্যই।”
পরী যেন দমে যায় কিছুটা। তবে শ্রাবণ কারণ জানায় তাকে উল্টাপাল্টা না ভাবার জন্য।
“নব দাম্পত্য জীবনে ঝগড়া করেই তোমার কাকা উনাকে শহরে রেখে চলে এসেছে। আর উনাকে শহরে নিয়েও গিয়েছিলেন তিনিই। এরপর আর খোঁজ নেননি কোনো। বুঝতে পেরেছো ব্যাপারটা? বাইরে গিয়ে, এসব কূটমন্তব্য করো না। এক কথায় মানুষ হাজার কথাও বানিয়ে যায়, জটলা পাকায়।”
“না, না। এই বাড়ির কোনো কথা আমি বাইরে গিয়া কই না। তবে বাইরের অনেক কথাই এই বাড়ি কইয়া দেই। বিশেষ কইরা আম্মার কাছে।”
মৃদু হাসির সাথে শ্রাবণ বলে,
“এটাও বাজে অভ্যাস। এভাবেই তো রটারটি হয়।”
“তবে কামডা কাকায় ভালা করে নাই। বেডিরে ফালাইয়া যহন আইবো, নিলোই ক্যা? ঝগড়াঝাটির লাইগা ছাইড়া দেওয়া লাগে!”
“হুম, এটাই জীবন থেকে পাওয়া শিক্ষা। মাথায় রেখো ভবিষ্যতের জন্য। তুমিও তো কখনো উঠবে কোনো সংসারে।”
“ধুর!”
“কেন, সংসার করার ইচ্ছা নেই?”
লাজুক হেসে পরী জবাব দেয়,
“হেইডা পরেরটা পরে দেহা যাইবো। আমগো তোতাপাখির কী খবর? কান্তাবানু আর আইবো বুঝি জিন্দেগীতে? তার ফুপুর লগেই ভারি ঝঞ্জাট!”
“আবারও বেশি কথা! তোমার খবর তুমি দেখো। যাও!”
“হু, যাইতাছি।”
পরী উঠে চলে যায়। দরজার বাইরে থেকে আবার ফিরে এসে ফিসফিস করে,
“ভাবি, ওই বেডিরে আপনে দেখছেন?”
“কাকে?”
“আরে, কাকায় যে বিয়া করছে।”
“তোমার কী হয় তিনি? বেডি বেডি বলে যাচ্ছো, এগুলো কেমন শুনায়? সম্বোধন করতে কী সমস্যা?”
“আচ্ছা৷ স্যরি, স্যরি। ওই কাকিরে আপনে দেখছেন?”
“উনাকেও আম্মা-ই বলবে। দেখেছি আমি উনাকে।”
“অনেক সুন্দর?”
“ব্যথিত, আঘাতপ্রাপ্ত মানুষদের কখনোই সুন্দর দেখায় না। এইযে, তুমি আমাকে সুন্দর সুন্দর বলে বেড়াও। যখন চারদিকের আঘাত আমার উপর চাপ সৃষ্টি করবে, তখন এই আমাকেও আর সুন্দর বলে প্রশংসা করতে পারবে না।”
“হো, তা তো আছে৷ উনি কি বুড়া, না জোয়ান?”
তার আগ্রহের কমতি দেখছে না শ্রাবণ। তাই আবারও মৃদু হেসে ফেলে। বলে,
“তিনি অসুস্থ, তাই দেখতে বৃদ্ধপ্রায়। কিন্তু বয়স কম৷ তোমার এই আম্মার মতোই বয়সী।”
“ও, আচ্ছা।”
চলে যায় পরী। শ্রাবণ নিজের ফোনটা চার্জার কানেক্ট করে। এটা আবার কাস্টমার কেয়ারে নিতে হবে। কথা বুঝাই যায় না। টুকিটাকির সমস্যাও মিটছে না যেন। ফোনের ওপারের সমস্যা তো আরও ব্যাপক ভেজালপূর্ণ হয়ে গেলো। তাকে আবার শহরে যেতে হবে।
বসে থাকতে থাকতে পা দুটো অবস হয়ে আসে যেন ফাতিহার। শরীরে জোর পায় না যে নিজে নিজে একটু হাঁটাচলা করবে। শিখা এসে সকাল বিকেল হাঁটাচলা করিয়ে যায় ধরে ধরে। আজ সকালে হাঁটার পরও আবার বসতেই পা ঝিমঝিম করছে। দুপুরে গোসল করানো হলেই আবারও একটু হাঁটতে চায়। ভবনের ছাউনির ভেতরই কিছুক্ষণ হাঁটিয়ে এই মাত্র বসিয়ে দিয়ে গেলো শিখা। এমনি দরজায় ছায়া পরে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই অবয়বের! দেখতেই চোখদুটো বিশালাকৃতি ধারণ করেছে। বুকের ভেতর শুরু হয়েছে দুরুদুরু কম্পন! নিশ্বাস কাঁপে, চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে আসে আফজাল হোসেনের প্রবেশ গতির পালাক্রমে। ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতেই তিনি তার আসন পর্যন্ত পৌঁছান। বহু বছর পর দেখা বহু পরিবর্তনের সাথে। বহু সময়ের ব্যবধানে মুখোমুখি হওয়া তাদের। ফাতিহার গাল গড়িয়ে অশ্রু যাচ্ছে নিঃশব্দে, অনবরত। আফজাল হোসেন বামে তাকিয়ে দেখেন পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখেন। বাইরেও দেখতে দেখতেই এসেছেন। এমন কত মানুষেরই আশ্রয় এই ছাদের নিচে। ফাতিহার হাত পায়েও যেন কম্পন ধরে যাচ্ছে। নিজের অস্বাভাবিক অবস্থা স্পষ্ট নিজের কাছেই। এতো অস্থিরতার ভার নিতে পারছে না যেন। দুরত্ব কমিয়ে কাছাকাছি এসে দাঁড়ায় আফজাল হোসেন। ফাতিহা কিছু বলার মতো সামর্থ্য রাখে না। একটা সালামও উচ্চারিত হচ্ছে না তার মুখে। থমথমে মুখে আফজাল হোসেনই জিজ্ঞেস করেন,
“কেমন আছো?”