শ্রাবণধারা পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
142

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৬
(নূর নাফিসা)
.
.
মায়ের পায়ের শব্দে হুশে আসে যেন শ্রাবণ। কখন যে এতোসব ভাবতে ভাবতে চোখের কার্ণিশে অশ্রুজল জমে গিয়েছিলো, খেয়ালই করেনি। মায়ের অগোচরে আলতো করে আঙুলের ডগায় অশ্রু কাটিয়ে নেয় সে চোখ থেকে। সুলতানা এসে সামনে দাঁড়িয়ে ফোনটা এগিয়ে দেয় ত্যক্ত মুখে। মুখ বলে না কিছুই। ফোন হাতে নেওয়ার আগে মায়ের মুখে তাকায় শ্রাবণ। সেই মুখ গহ্বরে চেপে থাকা ক্রোধ তার চোখে স্পষ্ট। বুঝতে পারে কেউ কল করেছে, তাই তিনি বাধ্য হয়ে ফোন এনে দিয়েছেন। শিশির ছাড়া কেই-বা আর কল করবে? নিশ্চয়ই শিশির। “স্বপ্ন নিকেতন” পাঠিয়েছিলো তাকে, অফিস যাওয়ার আগে একবার আম্মাকে দেখে যেতে। শ্রাবণ চুপচাপ ফোন নিয়ে নেয় মায়ের হাত থেকে। সুলতানা চলে যায় ফেলে আসা কাজে যোগ দিতে। টুল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসতে বসতে ফোনটা কানে তোলে শ্রাবণ।
“হ্যাঁ, বল।”
ওপাশ থেকে শিশিরে গলা ভেসে আসে,
“আপ্পি, খালাম্মার কাছে এসেছিলাম। উনার তো কোনো পরিবর্তন নেই। বরং আরও খারাপ মনে হচ্ছে।”
“এখনো অনেক জ্বর?”
“হুম।”
“শিখা আপুর সাথে দেখা হয়েছে?”
“না। আসেনি এখনো।”
“কারো সাথেই কথা হয়নি?”
“হ্যাঁ, এই ওয়ার্ডের আয়ার সাথে কথা বললাম। তিনি খাবার, ওষুধ ঠিকমতো দেওয়ার চেষ্টা করছেন। খালাম্মা খেতে চায় না। জলপটি দিলে নাকি জ্বরটা একটু কমে। কিছুক্ষণ পরই আবার তাপমাত্রা বেড়ে আসে।”
“ডাক্তার দেখে যায় না?”
“হ্যাঁ, সকাল বিকেলই নাকি দেখছে। তুমি একবার এসে দেখে যাও। কথা বলে যাও কর্তৃপক্ষের কারো সাথে। আমার মনে হচ্ছে ইমার্জেন্সিতে নেওয়া দরকার উনাকে। অবস্থা খুবই খারাপ। কথাই তো বলতে পারছেন না।”
শ্রাবণ ব্যথাতুর ও হতাশিত গলায় বলে,
“মা তো বেরই হতে দিচ্ছে না। আসতেই তো চেয়েছিলাম আমি।”
“কি করবে তবে?”
“জানি না।”
“রাখি। আমাকে অফিসে যেতে হবে।”
“তুই একটা কাজ কর। আমার ফোনটা তো বন্ধ। তুই শিখা আপুর ফোন নম্বরটা যোগাড় করে মায়ের ফোনে এসএমএস করে দে একটু। আমি কথা বলি তার সাথে।”
“ওকে, দিচ্ছি।”
কয়েক সেকেন্ড ভাবুক বেশে বসে থেকে ফোন নম্বর পাওয়ার অপেক্ষা ছেড়ে উঠে যায় শ্রাবণ। ফোনে তার মনের কাজ নেই। মন অন্যকিছু চাইছে। তাই সোজা এসে দাঁড়ায় মায়ের কাছে। মিনমিনে গলায় বলে,
“মা, আম্মার শরীরটা ভালো না। যাই না একটু? শিশির কল করলো সেজন্যই। জিজ্ঞেস করো, বিশ্বাস না হলে।”
“আমার কোনো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। তারা এসে দেখে যেতে পারে না?”
“এটা কেমন কথা বলছো তুমি? তারা আসুক বা না আসুক, সেসব দেখার সাথে তো আমার যাওয়ার সম্পর্ক না।”
“আমি এতো কিছু শুনতে চাই না। তুই কী চাইছিস, আমি জানি। আর আমি কী চাই, তা-ও তোকে জানিয়েছি। এবার কী করবি নিজেই ভেবে দ্যাখ।”
শ্রাবণ হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু নীরব থেকেই আবারও বলে,
“আমি তো গ্রামে যাচ্ছি না। আম্মাকে দেখে আসবো শুধু। একটু যাই?”
থমথমে মুখে সেলাই কাজে মনোযোগ পেতে রাখেন সুলতানা। প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় থেকে শ্রাবণ আবারও বলে,
“মা? যাই না? দেখেই চলে আসবো, কথা দিচ্ছি।”
“যা। দেরি করবি না একদম।”
অনুমতি পেতেই কেমন এক কম্পিত নিশ্বাস পড়লো শ্রাবণের। ঝটপট প্রস্তুত হয়ে ছুটলো স্বপ্ন নিকেতনের নিমিত্তে। ফাতিহার পরিবার সম্পর্কে আগে তেমন কিছু জানা না থাকলেও বৃদ্ধাশ্রমে ফাতিহা নামক একজন যে শ্রাবণকে বড্ড আদর করেন, সেটা বহু আগে থেকেই জানেন সুলতানা। তাই তার দূরাবস্থায় যেতে দেওয়ার অনুমতি। আবার মন মানেও না এই কারণে যে, সে সদ্য জেনেছে এই ফাতিহা নাকি সেই আফজাল হোসেনেরই স্ত্রী! কী সাংঘাতিক অমানুষ ওই আফজাল হোসেন! তার মেয়েটা এতোসব জেনেশুনে কী করে সেই বাড়িতেই গেলো সংসার বাঁধতে, সেই দুঃখের যন্ত্রণায় বাঁচেন না তিনি। এমনটা তো আশা করেননি মেয়ের কাছে!
শ্রাবণও এসেছে, শিখাও এসেছে মাত্রই। তার সাথে কথা বলতে বলতেই ভেতরে প্রবেশ করেছে সে। প্রথমেই ফাতিহার কাছে এসেছে দুজনে। শিশির তখন চলে যাবে বললেও যায়নি। ফাতিহার কাছেই শিশিরকে পেয়েছে শ্রাবণ। ফাতিহা তখন শায়িত অবস্থায় বমি করেছে। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়ে এসেছিলো। সে, আরও দুজন এগিয়ে এসে তাকে দ্রুত বসিয়ে অবস্থা স্বাভাবিক করার বড্ড চেষ্টা করেছে এতোক্ষণ যাবত। এসবই জানাচ্ছিলো শিশির। এখন ঠিকমতো শ্বাসক্রিয়া চলছে ফাতিহার। কিন্তু চোখ দুটো নিভু নিভু করে রাখে। শ্রাবণকে দেখতেই আবারও দুধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। শ্রাবণের চোখেও পানি চলে আসে তার দুরুহ অবস্থার কথা শুনে। পাশে বসে থেকে ফাতিহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শিখাকে বলে, কর্তৃপক্ষের নিকট একটা জরুরী আবেদন পেশ করতে। যেন আজই তাকে হসপিটাল ভর্তি করা হয়। সে তো এখন এখানে কর্মরত নয়। তাই তার দ্বারা এমন আবেদন পেশ করাও সম্ভব নয়। শিখার ক্ষমতায় আছে তা। শিখা তার সাথে কথা বলেই যায় উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে। শিশির দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আপ্পি, আমি আসি তবে।”
“হুম, যা। দেরি হয়ে গেছে তোর।”
“হুম। হয়েছে একটু।”
দরজার কাছে গিয়েও কিছু ভেবে থেমে যায় শিশির। পিছু ফিরে বলে,
“আপ্পি, শুনে যাও একটু…”
“কী?”
“এসো একটু৷ কথা আছে।”
শ্রাবণ উঠে আসে তার ডাকে। শিশির বাইরের দিকে আরেকটু এগিয়ে যায় নিরিবিলিতে একাকী কিছু বলতে। শ্রাবণ পিছু পিছু এসে থামতেই সে বলে,
“ভাইয়া… মানে তোমার হাসব্যান্ড দেখতে কেমন? লম্বা?”
শ্রাবণের ভ্রু কোণের অংশ কুচকে আসে তার জিজ্ঞাসায়। হঠাৎ এই কথা? তার সম্পর্কে তো বাড়ি থাকতেও এক বিন্দু জিজ্ঞাসা সে চালায়নি! এখন, এখনে হঠাৎ তবে? শ্রাবণ জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“হঠাৎ এমন কিছু জানতে চাইছিস কেন?”
“বলো না একটু৷ চুলগুলোও কি মোটামুটি বড়সড়?”
“তুই দেখেছিস? কোথায় দেখলি? এতো সন্দেহ কেন?”
“আহ! জবাব দিতে কী সমস্যা তোমার, বুঝি না।”
“হ্যাঁ, লম্বা। চুলও কিছুটা বড়।”
শিশির মুখটা বিস্ময়কর করে তুলে আরও আগ্রহী কণ্ঠে শুধায়,
“শ্যামকালো গায়ের রঙ? মোটরসাইকেল চালায়?”
শ্রাবণ তার বিস্ময়ে চিন্তিত হয়ে থেকেই ছোট করে উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ।”
শিশিরের চোখ বিস্ময় কাটিয়ে ফ্যালফ্যালে রূপ নেয়।
“আমি এখানে আসার সময় উনাকে রাস্তায় দেখেছি। তোমাকে খুঁজছে পাগলপ্রায় হয়ে। আমাকে দেখে ভুলক্রমে তোমার নাম ধরে ডেকে বসেছে৷ যখন আমি ওদিকে তাকালাম, তখনই উত্তেজিত ভাবটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেলো উনার। বুঝতে পারলেন, তিনি ভুল করেছেন। আমি শ্রাবণ না।”
বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে শ্রাবণের। কী বলবে, আর কী করবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যাক। একবার গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলুক, “আপনার শ্রাবণ হারায়নি। একটু অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।”
ভাবতেই চোখদুটো ছলছলে হয়ে উঠে। ইচ্ছেটা চার দেয়ালে আটকা পড়ে আছে তাই তার অনুভূতিকে শক্ত করে নেয়। চোখের ভেজা ভাব দূর করে শিশিরকে বলে,
“তুই অফিস যা। দেরি হয়ে গেছে।”
যে-ই ফাতিহার কাছে যেতে এক কদম বাড়িয়েছে, এমনি ম্যানেজারের কাউন্টারের দিকে ইফতেখারকে দেখতে পায় শ্রাবণ! থেমে যায় তার পথ চলা! ইফতেখার আরও কয়েক সেকেন্ড আগেই তাকে দেখে থেমে গেছে সেখানে। তাকিয়ে আছে এদিকেই। সে কী ভয়াবহ অবস্থা সেই শুকনো মুখটার! সে কী ভয়ানক ভাবে তাকিয়ে আছে ওই দৃষ্টি জোড়া! চোখাচোখিতে সে কী অনুরাগের সৃষ্টি!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সে কী ভয়াবহ অবস্থা সেই শুকনো মুখটার! সে কী ভয়ানক ভাবে তাকিয়ে আছে ওই দৃষ্টি জোড়া! চোখাচোখিতে সে কী অনুরাগের সৃষ্টি! থমথমে মুখে হনহন পায়ে এগিয়ে আসে ইফতেখার। থেমেই জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় ছিলে?”
শ্রাবণের মনের অবস্থা শোচনীয়। তাৎক্ষণিক জবাব দেওয়া হয় না তার। নিরুত্তর দৃষ্টি নত রাখে মেঝের দিকে। লোকটার অবস্থা দেখে তার আরও খারাপ লাগছে। তবুও মুখ ফুটে চাইছে না সবটা বলতে। তাকে জানতে দেওয়াটাও উচিত নয়। একটা বলতে গেলে আরেকটা জানতে উদগ্রীব হওয়ার মতোই লোক এই ইফতেখার। তাই মন কোনোরকম জবাব দিতেও ইচ্ছুক না শ্রাবণ। এদিকে ইফতেখার খিটখিটে স্বরে বলে,
“পেয়েছো টা কী তুমি? আমায় পাগল করে রাস্তায় নামাতে চাইছো? জনে জনে পাগল উপাধি পাচ্ছি আমি, এতে তোমার বেশ আনন্দ হচ্ছে? পালালে কেন এভাবে? কেউ তোমায় বেঁধে রাখতে চেয়েছিলো? নাকি আমি তোমার যত্নে নেমে ভুল করেছি? এভাবে পালিয়ে বেড়ানোর মানে কী? বাড়ি ফিরোনি কেন? যত্রতত্র রাত কাটানোর মানে কী?”
একের পর এক অবিরত বলে গেলো ইফতেখার। শেষ কথায় বিদ্ধ হয় শ্রাবণ। অথচ মুখে তার লাগাম! নিজেকে শক্ত রাখার চলে আপ্রাণ চেষ্টা। সফলও হচ্ছে তাতে। সুযোগ দেয় তাকে তার মনমতো ক্রোধ প্রকাশের। এ তার প্রাপ্য অধিকার। একদম অভিযোগ টানবে না শ্রাবণ। এদিকে তার নীরবতায় চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে ইফতেখারের। দাঁতে দাঁত চেপে ধমক দেয়,
“কথা বলছো না কেন!”
ধমকের সাথে হাতটাও উঠে গিয়েছিলো কিছুটা। তবে ততটাও না। কিন্তু দৃষ্টি এড়ায়নি শ্রাবণ ও শিশিরের। এই বুঝি একটা কষানো থাপ্পড় পড়ে যেতো শ্রাবণের গালে। হাত শক্ত মুঠো করে নিজেকে সংযত করে নিয়েছে ইফতেখার, তাই থাপ্পড় কার্যকর হয়নি। সাথে সাথেই এক মুহুর্তের জন্য চোখের পাতা বন্ধ করে নিয়েছে শ্রাবণ। মর্মে ব্যথা লাগছে ইফতেখারের সংযত হয়ে যাওয়ার উপর। কম পরিমাণ অস্থির হয়ে এই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়নি এই লোক। অথচ তাকে কেমন অসহায় একটা মুহুর্ত পাড় করতে হচ্ছে এই সময়টাতেই! জীবনে কখনো কখনো এতো কঠিন মুহুর্ত আসে যে, একূল ওকূল উভয়ই নাগালের বাইরে থাকে। কোনো নির্দিষ্ট কূল স্পর্শ করার শক্তি মনে সঞ্চারিত হয় না। হয়তো উপায়ও আসে একটা, তবে সময় নিয়ে। সেই নিরুপায় সময়ই পাড় করছে এখন শ্রাবণ। সামনে থেকে একটা অবয়ব দূরে সরে যেতে পা বাড়িয়েছে আন্দাজ করতেই বন্ধ চোখের পাতা খুলে নেয় সে সাথে সাথে। পিছু বলে উঠে,
“আমি একটা কাজে এসেছিলাম৷ কাজটা শেষ হলেই শীঘ্রই ফিরবো।”
ইফতেখার থেমে পিছু ফিরে দাঁড়ায়। হাতদুটো জড়ো করে সামনে তুলে ধরে বলে,
“মাফ চাই। আর না। বহু আসা যাওয়া হয়েছে তোমার। আর ধোকা খেতে চাইছি না। আমি ক্লান্ত। ক্লান্ত আমি তোমার পিছু ছুটতে ছুটতে। তোমার প্রত্যাশা ওই বাড়ির কেউ আর কখনোই না করুক। থাকো তোমার কাজ নিয়ে, যত ইচ্ছে ততো।”
হনহন পায়ে প্রস্থান ঘটে ইফতেখারের। এক মুহূর্তও এখানে থাকতে অনিচ্ছুক সে। শ্রাবণ স্থির তাকিয়ে থাকে তার পিছু ফেলে যাওয়া পথে। চেয়েও পারে না থামিয়ে দিতে। পারে না দৌড়ে ছুটে গিয়ে হাতটা ধরে সাথে হাঁটতে। কিংবা পিছু ডেকে বলতে, “দাঁড়ান, আমিও যাবো সাথে।” কেবলই তাকিয়ে থাকে চাতকিনীর বেশে। শিশির এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আপ্পি, তিনি তো তোমায় ভুল বুঝলেন। বললে না কেন সত্যিটা যে, মায়ের কাছে গেছো। আর মা তোমাকে যেতে নিষেধ করেছে?”
“সে জানে আমার পরিবার নেই।”
“মানে!”
“মানের ব্যাপক ইতিহাস। তুই অফিস যাচ্ছিস না কেন? দ্রুত যা।”
শিশির চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বেরিয়ে যায় কর্মস্থলে যাওয়ার নিমিত্তে। যাওয়ার পর স্বপ্ন নিকেতনের বাইরে ইফতেখারকে দেখে যায় মোটরসাইকেলে বসা অবস্থায়। চাপা ক্রোধে ধ্যানমগ্ন হয়ে স্থির বসে আছে মোটরসাইকেলে। চলতে চেয়েও যেন চাইছে না। মনটা ভেঙে দিয়েছে শ্রাবণ। ভালোবেসে এতোটা অবহেলার পাত্র কেন হলো সে? কাজের কাছে কেন তার গুরুত্ব হেরে যায় ওই প্রাণে? কোথায়, তার মনে তো সেই প্রিয় পাত্রীর জন্য গুরুত্ব কমেনি কখনো! প্রয়োজনে কাজ ফেলেও চলে আসতে আপত্তি রাখে না। তবে কি তার প্রণয়ের ধারায় ত্রুটি আছে? আর কত উজার করা যায় মন? এভাবে তো সে নিজেই স্বকীয়তা হারিয়ে উজার হয়ে গেলো তার নিকট। তবুও পাখি নীড় ফেলে মুক্ত হতে যেন বড় ব্যস্ত! একরাশ ব্যথা নিয়েই সে এই শহুরে পথ কেটে বাড়ি ফিরে আসে। মনে মনে লজ্জিত হয় পরিবারের নিকট। চোখের সামনে বড় স্পষ্ট হয় প্রণয়জনিত ভুল। রূপের মোহে ভুলে গিয়েছিলো বুঝি আশপাশকে! এতোটা পাগল বানিয়ে ছেড়েছে শ্রাবণ তাকে। এতো যত্ন, এতো দুশ্চিন্তা, এতো প্রেম তার জন্য ওই হৃদয়ে। অথচ সে ঠাট্টা করে তার সম্পর্ক নিয়ে? একবার বলে পর্যন্ত আসাটা প্রয়োজন বোধ করেনি! আর সেদিকে সে কত ভয়ানক দুশ্চিন্তায় চেপে গিয়েছিলো। খাওয়া নাওয়া ভুলে গিয়েছিলো। তার জন্যই তো মামাবাড়িতে কী বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললো পরিবারের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে!
ঘরের কোণে বসে বসে পরী আর অর্পা করছে খুচুরখুচুর। তাদের খুচুরখুচুরের মুখ্য বিষয় শ্রাবণ। বিপুর কাছে শুনেছে শ্রাবণ তাদের বাড়ি গেছে। কিন্তু বাড়ি কোথায়, তা তারা জানে না। এমনকি শ্রাবণ যে একটা মিথ্যা পরিচয়ে তাদের বাড়ি এসেছিলো তাও বেশ পরিষ্কার। বাড়ি কেন গেছে, তার কারণ জানা তাদের জরুরী নয়। তাদের দৃষ্টি কটু বিষয় হচ্ছে পারভীনের গহনা৷ এতোগুলো গহনাগাঁটি নিয়ে কীভাবে উধাও হয়ে গেলো সুন্দরী রমনী! বড় ভাইজানের একদম উচিত হয়নি না জেনে, না চিনে হুটহাট একটা বউ বাড়ি তুলে আনা। ভর দুপুরে অর্পার কাছ ঘেঁষে এসে বসেছে শ্রাবণ নিয়ে আলাপ করতে।
“আপা গো, আপা। আমার তো ভাবতেই মাথাডা ফাইট্টা যাইতাছে! বাড়ির ভেতর এতো বড় পরী… থুক্কু! পরী না, জ্বিন। জ্বিন। দিনরাত চোখের সামনে একটা জ্বিন যে এইভাবে ঘুরাফেরা করতাছে, কে জানতো! কত ভালাই না মনে করছিলাম৷ শেষ পর্যন্ত কি না চোখে ধুলা দিয়া দিন দুপুরে ডাকাতি কইরা গেলো! ডাকাত ও তো কায়দা কইরা আসে। এই মহিলা তো জাদু কইরা আইছে মনে হইতাছে।”
“আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম, ভাবির যে গহনাগাঁটিতে প্রচন্ড লোভ। কীভাবে আমার চেইন চুরি করে নিয়ে গেলো, মনে নেই?”
“হো। আছে আছে। ভুলি নাই। চোর না, চোর না। এক্কেবারে আস্তা একটা ডাকাইত! মা গো মা! কী সাংঘাতিক কান্ডকারখানা!”
“গহনা গুলো দেওয়ার কথা কিন্তু তুমিই বলছিলা আম্মুর কাছে। নয়তো আম্মু দিতো না।”
কথায় দমে যায় পরী। বলার মতো কিছু পায় না। এই দুশ্চিন্তায় তারও গতরাতের অর্ধেক ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এখনো ভীষণ ভয়ে আছে যে, কখন না পারভীন এসে তার কাছে গহনা চেয়ে বসে! সে কোত্থেকে দিবে তখন? কোন দুঃখে এমন ঝামেলায় পড়তে গেলো? শাশুড়িরটা ছেলের বউ নিবে, ছেলের বউয়েরটা শাশুড়ি নিবে৷ মাঝখান দিয়ে সে কেন সুপারিশ করতে ব্যস্ত হলো। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারাটা কি খুব জরুরী ছিলো? সেই দুঃখে নিজের কপাল চাপড়ে মনে মনে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে,
“হায় কপাল! কবে শুধরাবি তুই, পরী?”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৪৮
(নূর নাফিসা)
.
.
অশান্তির ছোবলে প্রতিটি প্রহরই বিষাদে কাটছে পারভীনের। সকালেও কতক্ষণ বকবক করে গেলো চটজলদি থানায় যেতে৷ শ্রাবণের নামে মামলা দিতে। তার এতোগুলো গহনার ডাকাতি হয়েছে, এখনো এমনি এমনি বসে আছেন কেন আফজাল হোসেন? দেরি করলে কী তা ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে? তবুও আফজাল হোসেন চুপ করে গম্ভীরমুখে বসে ছিলেন। ছোট করে কেবল স্ত্রীকে বলেছিলেন,
“চুপ থাকো। যা হওয়ার হইবো নে।”
এই হওয়ার আশাতেই একেকটা প্রহর কেটে যাচ্ছে। দুপুরে যখন ইফতেখার বাড়ি আসে, তখন আফজাল হোসেন ঘরেই ছিলেন। ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কই ছিলি?”
ইফতেখার মলিন মুখে জবাব দেয়,
“এদিকেই।”
“শ্রাবণের কোনো খোঁজ পাইছোস?”
“কালকেই না বিপু জানালো, সে তাদের বাড়ি গেছে?”
“তবে তুই গেলি না ক্যা? কথা বলার দরকার ছিলো না?”
“বলেছি। তার আশা বাদ দেন, আব্বা। এই বাড়িতে তার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“এইটা কেমন কথা! এইদিকে এতো কিছু যে হইলো, এইসব মীমাংসা হইবো না?”
“হওয়ার দরকার নাই তো। আম্মার গহনাগাঁটিই তো? আমি গড়ে দিবো নাহয় কোনোদিন।”
ক্রোধ চাপা গলায় কথা বলে ইফতেখার চলে যেতে পা বাড়ায়। আফজাল হোসেন পিছু বলেন,
“গহনা বড় কথা না। তার তো আসা দরকার। কী কারণে এমন করলো, তার একটা খোলাসার দরকার। তোর সাথে কী আসতে চায় নাই?”
“না।”
“তার ঠিকানা দে, আমি কথা বলি।”
“বাদ দেন তো, আব্বা। তার পেছনে কোনো সময় নষ্ট করার মানেই হয় না। একদম ভুলেই যান কোনো শ্রাবণ ছিলো! আর তার কোনো ঠিকানাও আমার জানা নেই। রাস্তা থেকে এনেছিলাম তো, রাস্তায়ই দেখা হয়েছে বারবার।”
চোয়াল শক্ত রেখে শেষটুকু বিড়বিড়িয়ে বলতে বলতে বারান্দা অতিক্রম করে হনহন পায়ে নিজ ঘরে চলে যায় ইফতেখার। রাগে, কষ্টে নিজের উপরই আঘাত হানতে চাইছে যেন সে। ঘরে এসেই পা টা সজোরে মারে খাটের পায়ায়। শিরায় শিরায় ঝিমঝিম করছে শ্রাবণময় অনুভূতিরা৷ কী করে মাথা থেকে তাকে ঝেড়ে ফেলা যায়, তারও উপায় পাচ্ছে না খুঁজে। চারিদিকে কেবল অসহ্যকর যন্ত্রণা! ওদিকে ছেলের উপর চরম রাগান্বিত হয় পারভীন। খুব বড় হয়ে গেছে বুঝি তার এই ছেলে? খুব কামাইরোজী হয়েছে বুঝি তার যে, এমন খামখেয়ালি মেজাজে কথা বলে যাবে সে? মায়ের গয়না গড়ে দিবে, আর বউ যে নিয়ে পালালো সেদিকে কোনো তোয়াক্কাই নেই৷ পরিশ্রমে মরিয়া হবে, তবুও শাস্তি দিতে তাদের বাপ ছেলের যেন অন্তর জ্বলে যাচ্ছে! এমন একটা পরিস্থিতিতে কীভাবে তারা চুপ করে আছে! ছেলেটার মাথা নাহয় ওই মেয়েটা শেষ করে দিয়ে গেছে। কিন্তু তার স্বামী কেন এখনো শান্ত হয়ে বসে আছে, সেই যন্ত্রণায় আরও জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে সে! গয়না ফিরে পাক বা না-ই পাক৷ কোনো একটা পদক্ষেপ তো নিবে অপরাধীর বিরুদ্ধে।
এদিকে আফজাল হোসেন ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছিলেন ভাবুক ভঙ্গিতে। সবকিছু নিয়েই তিনি ভাবছেন। হুট করেই শ্রাবণকে ডাকাত বলতে পারেন না। গহনা নেওয়া শ্রাবণের উদ্দেশ্য, তাতে প্রত্যক্ষ সন্দেহ তিনি আনতে পারেন না। মেয়েটাকে শুরু থেকেই কেমন রহস্যময় লাগছিলো তার। হলোও তো তা-ই। ফাতিহা পর্যন্ত কী এমনি এমনি পৌঁছেছে সে? আর এখন হুট করে তার এভাবে চলে যাওয়াটাও কেমন সন্দেহের হয়ে ঠেকে আছে। তাই হুট করেই তিনি তার তালাশ করতে থানায় ছুটতে পারছেন না। অপেক্ষায় ছিলেন ছেলের মতামত আর মন্তব্যের। এখন ইফতেখারের সাথে কথা বলে, তার ভাবভঙ্গি দেখে সন্দেহের রঙ অন্যরকম হলো। ছেলে তো বুঝি বিরক্ত শ্রাবণের প্রতি। তবে কি কোনোরকম ঝগড়াই হলো নাকি তাদের মাঝে, যার জন্য শ্রাবণ চলে গেলো কাউকে কিছু না বলে? বেড়াতে যাওয়ার সময় তো আবার তেমন কিছু দেখলেনও না। সবাই-ই যথেষ্ট হাসিখুশি ছিলো। তবে এইটুকুতে কী এমন হয়ে গেলো! আবার ছেলেটাও গিয়ে কেমন অপুর গলাই চেপে ধরলো! এসবই ঘুরছে তার মাথায়৷ তিনি সেদিকেই ভাবতে বসে আছেন গম্ভীর বেশে। শ্রাবণের সাথে তারই কথা বলা দরকার। আর সেজন্য দরকার শ্রাবণের সন্ধান পাওয়াটা।
পারভীন সকাল হতে চুপ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। নীরব থেকে থেকে দেখলেন, কে কী ব্যবস্থা করলো। এ পর্যন্ত কোনোরকম তথ্যই তার কানে আসেনি। আফজাল হোসেন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন আসরের সময়। এখন ফিরেছেন মাগরিবের পর। নামাজ পড়েই সোজা বাড়ি এসেছেন বুঝা যাচ্ছে। মসজিদ থেকে বেরিয়ে একদমই সময় নষ্ট করেননি বাইরে। মুখটাও কেমন থমথমে, গম্ভীর হয়ে আছে। মাগরিবের আজান হয় সময়ই এই গম্ভীরতা তিনি ধারণ করেছেন মুখাবয়বে। মনের ভেতরও চলছিলো অবর্ণনীয় হাহাকার সমুদ্রের ঢেউ! ঘরে এসে দেখেন পারভীন নামাজ পড়ছে। তিনি চুপচাপ বসে আছেন এক কোণে। একদম নড়ছেন না। পারভীন নামাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করে,
“চা খাইবেন?”
ধ্যানভঙ্গ হয় আফজাল হোসেনের। ফোনটা হাতে নিতে ব্যস্ত হয়ে উত্তর দেয়,
“না।”
ইফতেখারের নম্বরে ডায়াল করেন পরপরই। পারভীন এদিকে জিজ্ঞেস করে,
“থানায় গেছিলেন?”
এসময় এমন জিজ্ঞাসায় রাগ হয় আফজাল হোসেন। সকাল বিকেল এক কথা তার মধ্যে চরম অপছন্দ আনলো যেন! তাই ধমক দিয়ে বসেন,
“ঘন্টা পরে পরে কী শুরু করছো এইসব! কব্বরে নিয়া যাইবা গয়না?”
ধমক আঘাত হানে পারভীনের বুকে। সারাদিনে মাত্র দুইবার বললো, আর এতেই তিনি এতো বিরক্ত? সংসারটা তার এ কী হলো? মানুষগুলোও কেমন হঠাৎ করেই বদলে গেলো! টাকাকড়ি, ধন সম্পদ কেউ কবরে নিয়ে যেতে পারে? যাওয়ার সময় কিছুই যাবে না সাথে, তা জেনেও তো দুনিয়ায় এক টুকরো শখ আহ্লাদ বুনতে থাকে। অথচ এই শখের গুরুত্ব দিতে জানে না লোকে। সে কথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। আর একবারও জিজ্ঞেস করবে না এসব কিছু। শখের কুরবান হয়েছে, যন্ত্রণা কেবল তারই হোক। সম্পদ তো উনারই ছিলো। আর এই সুখসম্পদে শখটা কেবল নিজের মতো সাজিয়েছে পারভীন। এতো বছর যাবত যত্নে সাজিয়ে রাখা সংসার আজ বিধ্বস্তপ্রায়। প্রতিটি দিনক্ষণই যেন তাকে অবিরত কাঁদিয়ে চলেছে। শেষকালে বুঝি মানুষ গুরুত্ব হারিয়ে বড় অযত্নের হয়?
এদিকে ইফতেখারকে কল করে এক্ষুণি বাড়ি ফিরতে বলেন আফজাল হোসেন। অত:পর গুণতে থাকেন তার ফেরার প্রহর, বুনতে থাকেন স্মৃতিবিজড়িত নাটাই! সেদিনের রূপসী শ্যামাঙ্গিনী নাকি আজ ধরণী থেকেই ছাটাই!
রাত প্রায় ন’টা। শিশির এসেছে বাড়ি। হুড়মুড়িয়ে ঘরে এসেই শ্রাবণকে খুঁজছিলো। মেয়ের চেহারা দেখেই সুলতানা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী রে? কী হয়েছে?”
“আপি কোথায়, মা? তোমার ফোন বন্ধ কেন? এক ঘন্টা যাবত ট্রাই করছি।”
“ফোনে চার্জ নেই। বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো, খেয়াল করিনি। কিন্তু কী হয়েছে?”
“আপ্পি কোথায়?”
“বাথরুমে।”
এদিকে মায়ের কাছে জবাব পেতে পেতে ওদিকে শ্রাবণ বেরিয়ে এসেছে। তৎক্ষনাৎ দুজনকেই সে দেয় ফাতিহার মৃত্যু সংবাদ! শ্রাবণ স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন খবরটা পেয়ে। এ কী শুনলো সে! এ কী হলো! ঘন্টাখানেক আগেই শিশির টিউশনিতে থেকে খবরটা পেয়েছে শিখার ফোনকল হতে৷ শ্রাবণকে পায়নি তাই শিশিরকে জানিয়েছে শিখা। শিশির মায়ের কাছে কল করেও পাচ্ছিলো না তাদের। একটু আগেভাগেই টিউশনি শেষ করে সে রওনা হয়। জ্যামে পড়ে হয় আরও দেরি। অবশেষে খবর পৌঁছেও শান্ত নয় সে। আবার ছুটছে শ্রাবণের সাথে স্বপ্ন নিকেতনে। সুলতানা একদম নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি। বরং ব্যথিত হলেন শোক সংবাদে। মেয়েরা বেরিয়ে গেলো চট জলদি করে। পিছু থেকে তিনি বলে দিলেন, সাবধানে যেতে। বেহুশ যেন না হয়। অথচ শ্রাবণের পুরোটা পথই যেন ছিলো একটা ভিন্ন শহর, ভিন্ন গলি! এতো দূরত্বের মনে হচ্ছিলো এই পথ! বুকের ভেতর ধড়ফড় করছিলো অনবরত। আত্মার আত্মীয় দূরে সরে গেছে কিছু কাজ অপূর্ণ রেখে, সে ঠিক থাকেই বা কী করে? কী করে সামলাবে আর নিজেকেই? পথ তো সামলে নিয়ে এলো শিশির। কিন্তু মনের সামালে একমাত্র রব ব্যতীত আর কার সাধ্য কার্যকর? তবুও শেষ সীমান্তে এসে ভেঙে পড়েনি শ্রাবণ। ফাতিহার নিথর মুখটা দেখতেই জলে টইটম্বুর হয়ে গেছে দুই চোখ। বুকের ভেতর হাহাকার! মুখে নেই কোনো শব্দ। একটানা কেবল তাকিয়েই রইলো ভেজা চোখের হাজারটা প্রশ্ন সামনে রেখে। আজ সকালেও এই মুখটা জীবন্ত দেখে গেলো। জীবন্ত হাতটা ছুঁয়ে গেলো। মুখে খাবার তুলে গেলো। ওষুধ তুলে গেলো। মাথায় হাত বুলিয়ে কত কথা বলে গেলো। ফাতিহা কাঁদলেন, কতটা সময় জুড়ে তাকিয়ে ছিলেন তার দিকে। শ্রাবণ যাওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের সাথেও কথা বলে গেছে। এখানে ডাক্তার দ্বারা তার চিকিৎসা তো চলছিলোই। তারপরও অপরিবর্তিত অবস্থার কারণে শিখার আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। দুপুরেই তাকে হসপিটাল ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু ফাতিহার কোনো উন্নতির সুযোগ হলো না। হসপিটাল থেকে ফেরা হলো না আর সুস্থতা নিয়ে। মাগরিবের আগ মুহুর্তে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। পরপরই ম্যানেজমেন্ট বিভাগ থেকে তার পরিবার বলে দাবি করা আফজাল হোসেনের তথ্যপত্র ঘেটে খবর পৌঁছে দেয় ফোনকলে। তার কিছুক্ষণ পর খবর পায় শিখা। সে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার পর বাড়ি চলে গিয়েছিলো বিকেলে। খবর পেয়ে পুনরায় আশ্রমে এসে নিশ্চিত বিস্তারিত জেনে শ্রাবণের সাথে যোগাযোগের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। শিশিরের সাথে যোগাযোগ করে পরক্ষণে।
কিছুক্ষণ আগেই ফাতিহাকে হসপিটাল থেকে এখানে আনা হয়েছে। আশ্রমের সমস্ত বৃদ্ধাদের ভীড় পড়েছে তার আশপাশে। কেউ বা কাঁদছে। পাশের বেডের মহিলাটা একটু বেশিই কাঁদছে। সাথী চলে গেলো যে! তাকেও যেতে হবে বুঝি এমনই করে! মিনিট দশেক আগে এলেও শ্রাবণ মাত্রই খেয়াল করলো এখানে ইফতেখার ও আফজাল হোসেনকে! তারা আরও বেশ কিছুক্ষণ আগে এসেছে এখানে। ভীড় থেকে একটু পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে ইফতেখার। নিশ্চুপ নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলো এতোক্ষণ শ্রাবণের দিকে। কেমন থমথমে, স্তব্ধতা নিয়ে শ্রাবণ ফাতিহাকে দেখছিলো যে; তা-ই মনোযোগে দেখছিলো সে। শ্রাবণের ছলছলে চোখ জোড়া সেদিকে স্থির হতেই যেন তার মলিন শান্ত চোখের পলক পড়লো এইমাত্র।

চলবে।