শ্রাবণধারা পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
123

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫২
(নূর নাফিসা)
.
.
শ্রাবণের আচরণের উপর চিন্তিত হয়ে বিপু টাকা ও কাগজ হাতে ঘরে এসেছে। ইফতেখারকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে যেন আরও অবাক হলো সে! কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সাথেই খবরটা দেয়,
“ভাবি এসেছিলো, ভাই!”
ক্রোধ চেপে রাখা ইফতেখার কোনো প্রত্যুত্তর না করে এক পলকের জন্য চোখ তুলে তাকায় শুধু বিপুর দিকে। পরক্ষণে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে শ্রাবণের ব্যাপারে পাত্তা না দেওয়ার জন্য। বিপু তাতেও সন্দিগ্ধ! কাছে এসে টাকা আর কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এইটা দিয়ে গেছে তোমায়।”
ইফতেখার হাতের টাকার দিকে তাকায়। ভাই ধরবে কি ধরবে না, তা নিয়েও কিছুটা সংশয় তৈরি হয় বিপুর মধ্যে। তাই পরপরই বিছানায় রেখে দেয় ইফতেখারের সামনে। বুঝতে পারছে, তার মনটা ভারি হয়ে আছে। কথা বলতে চাইছে না হয়তো। তাই অতিরিক্ত কিছু বলেওনি সে। হাতমুখ ধুয়ে নিতে চলে গেছে। নাশতা করবে। এদিকে ইফতেখারের চোখ সরে না টাকা থেকে। কীসের টাকা, তা জানে না সে। কিন্তু রাগ হচ্ছে ভীষণ শ্রাবণের উপর। রাগের প্রকোপ নিয়েই কাগজটা হাতে তুলে দেখতে৷ ভাজ খুলে পায় কিছু লেখা।
“আপনার শেষ দেওয়া টাকাটা কাজে লাগান নি আম্মা। আমি সেদিন যাওয়ার পর ফিরিয়ে দিয়েছেন। আগের দেওয়া টাকাটাও বুঝতে পেরেছেন, আমি এখান থেকেই নিয়ে দিয়েছিলাম। তাই আমাকে অনুরোধ করেছেন, সেই টাকাটাও পরিশোধ করে দিতে। বিশ্বাস করুন, আর না করুন। আমি কোনো ক্ষোভ নিয়ে বলছি না। তিনি নিজ থেকেই চান নি এই বাড়ির কোনো কিছু। আমি আরও চেয়েছিলাম, তিনি তার জায়গায় ফিরে আসুক অধিকার সমেত। তাই অপ্রকাশ্যে দুইবার টাকাগুলো নিয়ে দিলেও তিনি তা বুঝে গেছেন দ্বিতীয়বার। তার কাজে খরচ করতে দেননি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। রেখে দিন। আপনার এখন টাকার প্রয়োজন। আগামীর জন্য শুভকামনা।
আর হ্যাঁ, কিছু ব্যথা দেওয়ার বিনিময়ে কথা দিচ্ছি; আপনি ডাকার আগে ছুটে আসবে শ্রাবণ।”
শেষটুকুর জন্য যেন হঠাৎ শিলাবৃষ্টি নামলো তার মনে। রাগগুলো সব একপাশে চেপে গেলো হঠাৎ, শ্রাবণ ফিরতে চায় বলে। তবে কী একটু ডাকার প্রয়োজন মনে করে শ্রাবণ থেমে গেছে দূরে? সে ডাকেনি বলে ফিরছে না তার ঘরে? কী এক প্রত্যাশা বুকে জমা এই শ্রাবণ নিয়ে! বারবার তাকে রাগিয়ে যায়, তবুও সে মনকে নরম করতে চায়। আনচান মন নিয়ে ঝটপট বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায় ইফতেখার। কাগজটা হাতে নিয়েই বাইরে আসে। বারান্দায় আফজাল হোসেনের উপস্থিতি থাকলেও সেদিকে মনোযোগী হয়নি সে। হনহন পায়ে ছুটে গেছে গেইটের বাইরে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডানে বামে চোখ নাড়ে শ্রাবণের খোঁজে। দেখলেই বুঝি ডেকে নিতো। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে সে! পুনরায় ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে। মুঠোয় মুড়ে ফেলে হাতের কাগজটা। দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থাকে শূন্য পথে। পরক্ষণে আবারও মোড়ানো কাগজটা খুলে শেষটুকু পড়ে সে। কথার মর্মার্থ পুরোপুরি বুঝে উঠা হয়নি তার। যা পুনরায় পড়ে খুঁজে ও বুঝে নিলো। সে ডাকার অপেক্ষায় থাকেনি। ডাকার আগেই আসবে বলেছে। তবে এখন কেন এলো না? সেই অনুরাগ নিয়ে ইফতেখার বাড়িতে প্রবেশ না করে এগিয়ে গেছে কবরস্থানের গেইটে। ফাতিহার কবরে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টিতে এক ফালি অভিযোগ গড়ে। কেন এতো ঘৃণা করে শেষ ঘরে গেলেন তিনি? এই ছেলের দিকে তাকিয়েও কি কিছু সুবিধা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করতে পারলেন না? কেন এতো ঋণে ফেলে চলে গেলেন? কঠিন অভিযোগের শেষেও এসে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পায় ইফতেখার। কারণ, এই ছেলেটা একদিন তার মুখে খাবার তুলে দিতে পেরেছিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে মায়া কাড়তে পেরেছিলো। হয়তো, মানুষটাকে ফিরিয়ে আনাই শুধু সম্ভব হয়নি তার দ্বারা। সময় সুযোগ দিলো না!
আজ কান্তাকে দেখতে আসার কথা পাত্রপক্ষের। অথচ গতরাত থেকে সাত্তারের মনের অবস্থা করুণ হয়ে আছে। খাওয়া হয়নি, ঘুম হয়নি, আজ কাজেও যাওয়া হয়নি। ফাতিহার কচি মুখটা স্থির বসে আছে যেন দৃষ্টিতে। বেশিরভাগ সময়ই কাটছে বারান্দায় গালে হাত রেখে বসে বসে। এরইমধ্যে ঘটকের আগমন। পাশে এসে বসেই বলে,
“কি ভাবতাছো, মিয়া?”
গাল থেকে হাত নামায় সাত্তার। জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“খবর কী?”
“পোলায় আইবো। পোলার মায় আর বইন আইবো আসরের আগ দিয়া। পদে পদে আপ্যায়নের ব্যবস্থা কইরো।”
“গরীব মানুষ, যেটুক কুলায় হেইটুকই। সাধ্যের বাইরে যাওয়া তো আর সম্ভব না।”
“হো, তা তো আছেই। মাইয়ারেও পরিপাটি থাকতে কইয়ো। হাসিমুখ কিন্তু মানুষের মনের মায়া কাড়ে। তা, চেয়ারম্যানের বউ যে মারা গেলো হেইডা তোমার কোন বইনডা? ছোডকালে যে গুঞ্জন উঠছিলো?”
সাত্তার বসা থেকে উঠে যায় সাথে সাথে।
“জানি না।”
“বুঝি, মনের বেদন বুঝি। কিন্তু চেয়ারম্যান কাজটা ভালা করে নাই লুকায় রাইখা। মরার পরে লোক ডাইক্কা তামাশা করছে।”
“বেশি কথা কীজন্য কও? ভাত খাইলে খাইয়া যাও।”
“নাহ। খাইয়া আইছি। ভাবলাম খবরটা দিয়া যাই।”
“তো যাও। বিকালে নিয়া আইয়ো।”
বলতে বলতে ঘরে চলে যায় সাত্তার। শিরিন সেই কখন ডেকেছিলো ভাত খেতে। এখন এসে বসলো সে। শিরিন প্লেট এগিয়ে দেয় পরপরই। ভাত বেড়ে তরকারি তুলে দেয় চুপচাপ। সাত্তার ভাত স্পর্শ করে বলে,
“মাইয়ারে ভালা জামা পইরা ঠিকঠাক সামনে যাইতে কইছ। মুখ কালা কইরা যাতে না থাকে।”
শিরিন চুপই থাকে। মাথায় চাপে দুশ্চিন্তা। বললেই কি মেয়ে শুনবে? ইচ্ছা করেই যেন আরও মুখটাকে বিষন্ন করে রাখে। অন্যের কাছে নীরবে তুলে ধরে বাপ মায়ের সালিশ! তাকে জোর করে সামনে নেওয়া হয়েছে, সেটা মানুষ এমনি করে বলে দিতে পারবে। কান্তা বাইরে এক কোণে পিঁড়ি পেতে বসে হাঁড়ি মাজছিলো ছাই নিয়ে। কান পর্যন্ত এসেছে বাবার কথা। তখন ঘটকের কথাও শুনেছে এখানে থেকে। কাজগুলো তার বারবারই থেমে যাচ্ছে। হাত চলতে চেয়েও চায় না। তবুও জোরের উপর চালায়। কান্না পায়। আজ কতদিন, বাড়ির বাইরে যায় না। বিপুর দেখাও পায় না। ভুলেই বুঝি গেছে। তারও যেন হার মানার সময় চলে আসছে দিনকে দিন। কী করবে, ভেবেই পায় না কিছু। আঁচলে চোখ মুছে সে ছাইয়ে ঘঁষা পাতিল নিয়ে উঠে যায় পুকুরের দিকে। সেখান থেকে ধুয়ে নিয়ে আসবে সেগুলো। শিরিনের পা কাটার পর থেকে ঘরের অধিকাংশ কাজই সে করে যাচ্ছে। এতে করে শিরিনেরও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠা হচ্ছে। তবুও একদমই বসে থাকে না। ঘরনিরা সবসময়ই খুটিয়ে খুটিয়ে কিছু না কিছু কাজ করতেই থাকে। ‘বিশ্রাম’ শব্দটাকে খুব কমই প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাদের। হাঁড়ি হাতে পুকুরের ধারে এসে কান্তা দেখতে পায় তার জেঠিকে। মজিদা নিজের কাপড়চোপড় নিয়ে এসেছে ধুতে। এই মানুষটাকে দেখলেও তার কষ্ট হয়। একা একা থাকে। মেয়েরা মাঝে মাঝে দেখতে এলে আসে, তো আসে না। একা একা রান্না করে, নিজের কাজগুলোও ধীরেসুস্থে নিজেই করে। বয়স হয়েছে, শরীর দুর্বল। হঠাৎ কিছু একটা হয়ে গেলে কে ছুটবে তাকে নিয়ে? কান্তা হাঁড়ি রেখে পুকুরের পানিতে হাত ধুয়। তারপর মজিদার হাত থেকে কাপড় টেনে নিয়ে বলে,
“দেও, আমি ধুয়ে দেই।”
“আরে, পারমু আমি। দে দেহি। সারাজীবন কইরা আইলাম…”
“সারাজীবনের শক্তিটা তো আর শরীরে নেই। তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তা হয় জেঠি। একা একা যে এখানে আসো, হুট করে পিছলে পড়লে কে ধরবে শুনি?”
“আল্লাহ ছাড়া কেউ-ই কাউরে বাচাইতে পারে না।”
কথায় স্মিত হাতে কান্তা। কিন্তু ওদিকে কান্না জড়ো হয়ে উঠে মজিদার গলা। কাঁপানো কণ্ঠে বলে,
“কেউ কি জানতো, ফাতিহার মুখটা এমন দেখতে হইবো?”
বলেই আঁচল চেপে ধরে চোখে। কাপড় ধুয়ে দিতে দিতে কান্তা জিজ্ঞেস করে,
“কাল রাতে রাস্তায় দাঁড়ায় দাঁড়ায় ফুপুরে নিয়া যাইতে দেখছিলা, না?”
মাথা দুদিকে নাড়ে মজিদা। বলে,
“আমার মনডা মানতাছিলো না। বোরকা গায়ে দিয়া চুপচাপ গেছি গা চেয়ারম্যান বাড়ি। মুখটা এইটুক হইয়া গেছে মাইয়াটার।কি ফুলফুলে একটা রূপ আছিলো তার!”
“চেয়ারম্যান বাড়ি গেছো? আগে কি অনেক সুন্দরী ছিলেন ফুপু?”
“না। গায়ের রঙ শ্যামলাই ছিলো তোর মতোন। কিন্তু মুখের গড়নে দুইটা খুইজ্জা পাওয়া যায় নাই এই গেরামে।”
“তিনি কোথায় ছিলেন এতোদিন?”
“আমি জানি না রে মা। শুনতাছি শহরে লুকায় রাখছিলো চেয়ারম্যান।”
“তবে এখন জানাইলো ক্যা?”
“তা-ও জানি না। হয়তো তোর আব্বার ডরে।”
“আব্বার ভয়ে? চেয়ারম্যান ভয় পায় আব্বাকে?”
“চেয়ারম্যান নিজেরে নিয়া ডরায় না। তোর ফুপুরে নিয়াই ডরাইছিলো। ভাইয়েরা মানে নাই পেমের সম্পর্ক। অন্য জায়গায় বিয়া দিয়া দিবো, এই ডরে নিয়া পলাইছে গ্রাম ছাইড়া।”
“তবে এখন যেই কাকি আছে?”
“ক্যামনে কমু তাগো এতো কথা! কীজন্য জানি বিয়া কইরা নিলো। ফাতিহারে আর আনলোই না!”
বলতে বলতে ভিজে উঠা চোখ মুছে নেয়। কান্তা আধ কথায়ই যেন অনেকটা আন্দাজ করে নেয় নিজের মতো। অল্পতেই গল্পে সাজিয়ে নেয় তার ফুপু আর চেয়ারম্যান কাকার সেই সম্পর্ক। সেই সূত্রেই কি তবে তাদের এবাড়ি ওবাড়ির যত দ্বন্দ্ব! কাপড় ধোয়া হলে হাত থেকে নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে থাকে মজিদা। পিছু ফিরে আবার চিন্তিত কান্তাকে বলে যায়,
“তোর বাপের কানে কিন্তু দেইছ না আবার, আমি যে ওইবাড়ি গেছিলাম। তইলে রাগ হইবো।”
কান্তা মাথা হেলিয়ে সায় দেয়, সে বলবে না কিছু। চিন্তামগ্ন থেকেই হাঁড়ি ডুবিয়ে দেয় পুকুরে। আনমনে কাজ করে ফিরে ঘরে।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৩
(নূর নাফিসা)
.
.
বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরে শ্রাবণ। মনের সাথে শরীরটাও যেন খারাপ লাগছে। গাড়িতে বসেই আফসোস হচ্ছিলো, কেন কান্তাদের বাড়ি একবার ঘুরে এল না? কেন খালাম্মার সাথে একটু কথা বলে এলো না। তাদের ফাতিহা যে চেয়ারম্যানের পারিবারিক কবরস্থানে আশ্রিত হয়েছে, তা কি জানে তারা? কান্তা মেয়েটার সাথেও একটু কথা বলা দরকার ছিলো। অথচ, মায়ের অগোচরে বেরিয়ে যাওয়ায় আফসোস নিয়েই দ্রুত ফিরে আসতে হলো। ঘুম থেকে উঠেই মেয়ের চেহারা দেখেননি সুলতানা। ঘরে পায়চারির একটু শব্দ পেয়েছিলো যদিও, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যাবে এমনটা ধারণা করেননি। তখন থেকেই বড্ড চিন্তিত ছিলো। পালিয়েছে কি না ভেবে রাগও হচ্ছিলো। এখন ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় গিয়েছিলি ঘুম থেকে উঠেই?”
মিনমিনে গলায় শ্রাবণ জবাব দিয়ে যায়,
“একটা কাজ ছিলো। তাই একটু বেরিয়েছিলাম।”
সুলতানা শক্ত গলায় জানতে চায়,
“কাজটা কি রূপনগরে?”
শ্রাবণ হতাশিত চোখে তাকিয়ে বলে,
“গহনাগুলো ফেরত দিতে গিয়েছিলাম, মা। আম্মার কবরটাও জিয়ারত করে এলাম।”
“আমি সেদিকে ছায়া ফেলতেও নিষেধ করেছিলাম। দোয়া ঘরে থেকেও করা যায়।”
“গহনাগুলো কি আমি ঘরে রেখে দিতাম তবে?”
আর কিছু বললো না সুলতানা। তবে চরম অপছন্দ রাখছেন ও বাড়ি যাওয়ার উপর। তিনি কাজে খেয়াল বসাতে চান। শ্রাবণ কাঁধের ব্যাগটা রাখতেই এদিক থেকে বলেন,
“ভাত খা এসে।”
শ্রাবণ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে ক্লান্ত বেশে। মনের ক্লান্তি যেন আরও নিস্তেজ করে রেখেছে তাকে। বেসিনে হাত ধুয়ে নিতে নিতে মলিন মুখে মাকে বলে,
“মানুষগুলো সব খারাপ না, মা। কোমল মনের মানুষও ওই ভিটাতে আছে। তোমার মতো একজন মা-ও আছে, যিনি শাসন স্পষ্ট রেখে বাচ্চাদের আদর করেন।”
“আমি মানুষ চিনতে চাইনি। তোদের দুজনকে শুধু মানুষ রূপে দেখতে চেয়েছি। আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত শুকরিয়া আদায় করছি এই ভেবে যে, তোরা মানুষ হয়েছিস। ন্যায় অন্যায়ের তফাতটা হয়তো বুঝতে পেরেছিস। ন্যায়কে ভালোবাসতে পেরেছিস। এখন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে যদি আমার মনটাকে বশ করতে উঠেপড়ে লেগে থাকিস, তবে তো আমায় হতাশই হতে হয়।”
মায়ের এই ব্যর্থতাপূর্ণ বাক্য আবারও নিশ্চুপ করিয়ে দেয় শ্রাবণকে। তার মনের পাড়ায় একেকটা বিষয় ক্ষণে ক্ষণে যে ঘুর্ণির সৃষ্টি করে, এই মন বুঝাবে কাকে?

বিকেলে মেহমান এলে কান্তা যেতে চায় না তাদের সামনে। জেঠির ঘরে থমথমে মুখে বসে আছে। মজিদাও ঠেলছে তৈরি হয়ে যেতে। শিরিন এই নিয়ে দুইবার চলে এলো সে তৈরি হয়েছে কি না দেখতে। এখনও এমনি বসে থাকতে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বকে যায়৷ মায়ের বকাবকিতে কান্তার চোখ দুটো ছলছল করে। বুকে জমানো কথাগুলো কারো কাছে প্রকাশ না করতে পারার ব্যথায় তিরতির করে কাঁপতে থাকে। চোখের বাঁধ ভেঙে যখন গাল ভিজে আসে, তখন মুখে শব্দ করে মিনমিনে স্বরের কিছু শব্দ,
“আমার সাথে এমন করতাছো ক্যা তোমরা? বন্ধ করো এইসব। আব্বারে নিষেধ করো বাইরের মেহমান ডাকতে। আমি তাদের সামনে যাইতে পারমু না, আম্মা।”
কথাগুলো বলেই দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে কান্তা। শিরিন রাগে, কষ্টে মেয়ের মাথায় পরপর দুইটা ঠুসি দিয়ে আবারও বকাঝকা করতে থাকে। তারই কান্না এসে যাচ্ছে এই যন্ত্রণাময় জীবন পার করতে করতে। জীবনের দুঃখগুলো না স্বামীকে বুঝাতে পারলো এযাবৎ, আর না এখন সন্তানকে বুঝাতে পারছে। কোনোদিকে তার শান্তি নেই। এই মেয়েটাকে নিয়ে যে তার কত চিন্তা, তা কেন বিন্দুমাত্র বুঝাতে পারে না তার অভিযোগ তুলে সে কাঁদছে মজিদার কাছে। মজিদা আবারও কান্তাকে ঠেলে তৈরি হয়ে নিতে। বুঝানোর চেষ্টা করে, তার বিয়েটা দিতে পারলে এই বাবামায়ের একটু নিস্তার হয়। গরীব ঘরের লোক, গরীবের সাধ সাধ্য নিয়েই বাঁচতে হয়। পাগলামি করলে এ জীবন চলবে না। বাধ্য হয়ে তৈরি হয় কান্তা। মুখটা মলিন রেখেই অবশেষে মেহমানের সামনে আসে। নিস্তব্ধ বেশে বসে থাকে। চোখ না তুলে, গলা না ভাসিয়ে জবাব দিয়ে যায় জিজ্ঞাসার। অন্যসময় হয়তো হাসি থাকতো সাত্তারের মুখে, গতকালের বিষয়টা তার মুখের জোরপূর্বক হাসিটুকুও যেন কেড়ে নিয়ে গেছে। তারউপর রাগ হচ্ছে মেয়ের ভঙ্গিমায়। হাসিমুখে দুটো জবাব কি তার মুখে আসে না? এই ভঙ্গিমা দেখতে পারছে না, তাই দরজার কাছ থেকে সরে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে অপরিচিত মধ্যবয়সী মহিলা একের পর এক জিজ্ঞাসা চালিয়ে যেন মুখের ভাব ভালোই আন্দাজ করতে পেরেছেন। জিজ্ঞাসার এক পর্যায়ে তিনি জানতে চান,
“মনটা খারাপ ক্যা তোমার? বিয়ে করতে ইচ্ছা নাই?”
কান্তা যেন ধ্যানমগ্ন থেকে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে বসলো,
“না।”
প্রশ্নকর্তা হাসলেও দরজার কাছে থাকা মা আর বারান্দায় থাকা বাবার হৃদয়ে হুঙ্কার! ঘটকও যেন বিপাকে পড়ে গেলো। মহিলাটি শিরিনের কাছে জানতে চায়,
“কি গো আপা, মেয়ে তো চায় না এখন। অযথা তাড়া নেন কীজন্য। পড়তাছে, পড়ুক।”
শিরিন জবাব কী দিবে ভেবে পায় না। ইতস্তত হয়ে বলে,
“পোলাপান মানুষ, বুঝেই কী? তারা যে বড় হয়, তারা কি তা দেখে? আজ থেকে দশ বছর পরেও যদি জিগান, একই কথা কইবো। কিন্তু, উপযুক্ততা তো দেখা লাগে বাপ মায়ের।”
“হু, তা তো আছেই। আচ্ছা, দেখেন আপনারা। বুঝেন। মা, যাও তুমি।”
হাতে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দেয় কান্তাকে। কান্তা চলে যায় আবার জেঠির ঘরে। মেয়ের হনহন পায়ে হেঁটে যাওয়া বারান্দায় থেকে তাকিয়ে দেখে সাত্তার। মহিলাটি শিরিনের সাথে কথা বলতে বলতে বাইরে আসে। পিছু পিছু আসে পাত্র ও তার বোন। ভাইবোন উঠুনে নেমে দাঁড়ালে শিরিনের সাথে তাদের মা এগিয়ে গেছে একটু বাড়ির সীমানা দেখতে। কথা বলতে বলতে ফিরে এসে বিদায় নেয় মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। কান্তা ঘরে এলেই শিরিন সম্মুখীন হয় তার।
“বিয়া করতে ইচ্ছা নাই কইলি ক্যা?”
কান্তা একবার মায়ের মুখে তাকিয়ে মনোযোগ দেয় হাতের কাপড় যথাস্থানে রাখতে। শিরিন এগিয়ে তার বাহু ধরে মুখোমুখি করে বলে,
“কথা কস না ক্যা? মানষের সামনে তামাশা না করলে ভাল্লাগে না?”
“তামাশার কী দেখলা, আম্মা? আমার কি বলার উচিত ছিলো তবে? লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলা উচিত ছিলো যে, আমি বিয়ে করতে দুই পায়ে দাঁড়াইয়া আছি?”
গলা তার কিছুটা উঁচু হয়ে এসেছে বিরক্তিতে। শিরিন কটমটে চোখে তাকিয়ে বলে,
“কথা লাইন কইরা কইতে পারোছ না? মুখের উপর যে না কইরা দিলি, ওইডায় লজ্জা লাগে নাই? জবাব নাই, তো চুপ কইরা থাকবি। মুখে কথা ফুটে না, ফুটে না। আবার চ্যাটাং চ্যাটাং জবাব উঠে ক্যামনে? কথারও তো একটা নম্রতা আছে, সৌন্দর্য আছে।”
“এতো সৌন্দর্য লাগাইতে পারতাম না।”
কর্কশ জবাবের বিপরীতে ঠাস করে এক চড় মেরে বসে শিরিন।
“পারতি না ক্যা? পারতি না ক্যা? বাপ মার মুখে জুতা মারার আচরণের জন্যে জন্ম দিছিলাম?”
বাইরে থেকেও সাত্তার শুনে যাচ্ছিলো মেয়ের উৎকন্ঠা। রাগে কিড়মিড় করে যেন তার দেহ। মনটা ভালো না থাকায় একটা ধমকও দিতে পারছে না। কষ্ট যাপন করেও যেন সহ্য করে যাচ্ছে সব। সন্ধ্যায় ঘটকের সাথে দেখা হলেই তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। ঘটক জানিয়েছে, বিয়েতে মেয়ের সম্মতি নেই বলে ধরে নিয়েছে পাত্রপক্ষ। চেহারা দেখেই নাকি বুঝতে পেরেছে তাকে জোর করে ধরে এনে বসানো হয়েছে তাদের সামনে। এমন জোরাজুরিতে সম্পর্ক গড়ে কোনোরকম ঝামেলায় পড়ার ইচ্ছে তাদের নেই। তাই নিষেধ করে দিয়েছে তারা। এই মেয়ে নিবে না। তাতেই সাত্তারের মাথা উত্তপ্ত। তারা দিনরাত দুশ্চিন্তায় মরে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে, আর মেয়ে তৈরি করে রাখে তামাশা! তখনই বাড়ি ফিরে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে মেয়ের সামনে। শক্ত গলায় জানতে চায়,
“রংঢং শুরু করছোস ক্যা? বিয়েশাদি করতি না?”
বাবার মুখে প্রত্যক্ষ জিজ্ঞাসায় উত্তর আসে না কান্তার। চুপ করে থাকতেই ধমক দেয় সাত্তার। কান্তাও এবার কান্নার সাথে উঁচু গলায় একই আচরণ করে বাবার সাথেও। তার এক কথা,
“বিয়ে দেওয়ার হইলে তার সাথেই দিয়ো, আব্বা। এমন জোরাজুরি কইরা আমারে অন্য কারো ঘরে দিতে পারবা না তোমরা।”
সাত্তারও এবার হাত উঠায় মেয়ের গায়ে। মুখমন্ডল ও মাথায় এলোপাথাড়ি থাপড়ে যায়। শিরিন ধরতে গিয়েও ধরে না। মেয়ের এমন পাগলামি আচরণে চরম হতাশ হয়ে আছে সে। পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে মজিদা৷ থামায় সাত্তারকে। শিরিন কাঁদে আর বলে,
“ধইরেন না, বু। এর মতো মাইয়া আমার দরকার নাই। মাইরা ফালাক। যেই সন্তান বাপ মায়ের বেদন বুঝে না, সেই সন্তান দিয়া কি করমু?”
মজিদা সাত্তারকে ঘরের বাইরে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়ে তার প্রত্যুত্তরে বলে,
“এইসব কইস না। এই সন্তান না থাকলেও কান্না করতি।”
“থাকার পরেও তো করতাছি। আপনের মাইয়ারা সংসার করতাছে না? এরুম পাগলামি করছে? আমরা বেডিরা সংসার করতাছি না? এরুম পাগলামি কইরাই আইছি?”
“পোলাপান মানুষ। বুঝবো নে বয়স হইলে।”
“আর কবে? এর চেয়ে কত ছোট থাকতে বিয়া হয় নাই আমগো? এর চেয়ে ছোট পোলাপান এখনো বিয়া হইতাছে না আশপাশে? সবই কপাল আমার! কপাল! মন চায়, সব ছাইড়া দিয়া কোনোদিগে চলে যাই। আর সহ্য হয় না তাগো নিয়া।”
কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে পাশের রুমে চলে যায় শিরিন। মজিদা যথাসম্ভব বুঝ ঢালে আবারও কান্তার উদ্দেশ্যে। থমথমে মুখে বিছানায় বসে আছে কান্তা। কথার কিছুই কানে নেয়নি। বাবা মেরেছে, একটা শব্দও করেনি। কান্নাগুলো সব নীরব বেশেই ঝরে পড়ছে। বুকের কষ্টগুলো উথাল-পাথাল ভাবে হৃদয় ভাঙছে। মনটাকে ভারি করে রেখেছে তীব্র। এই রাতও আজ তাদের নিকট স্তব্ধ!
ভোরে নামাজ আদায় করে দুই ভাই ই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এখন ইফতেখারের ঘুম ভাঙতেই ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে বিপুকে ডেকে জিজ্ঞেস করে,
“স্কুলে যাবি না?”
বিপু সময় দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে যায়। তার তো যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, অথচ ঘুম তাকে বশ করে রেখেছে! ঝটপট যায় হাতমুখ ধুয়ে নিতে। পরীকে ময়লা ফেলে ঘরের দিকে আসতে দেখে মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতেই বাথরুম থেকে বলে নাশতা রেডি করতে। পরী তার দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘরে যায়। কিছু বলতে চেয়েও যেন বলে না। রান্নাঘরে এসে ভাত নেয় প্লেটে। তরকারির বাটি আর প্লেট নিয়ে তাদের রুমে আসে। ইফতেখার তার আগে সজাগ হলেও শোয়া থেকে উঠেছে মাত্র। কাঁথা, বালিশ আর মশারিটা গুটিয়ে রাখছে একপাশে। বিপু ততক্ষণে শার্ট পরে তৈরি। মাথা আচড়াতে চিরুনীটা হাতে নিয়েছে সবে। চিন্তিত মুখে পরী খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে বলে,
“ছোট ভাইজান, একটা দুঃসংবাদ পাইছি।”
বিপু আয়নায় মনোযোগী থেকে মাথায় চিরুনী চালাতে চালাতেই বলে,
“তুই সুসংবাদ কবে দেস? তোর সংবাদ শোনার টাইম নাই। আরও আগে ডেকে দিলি না, স্কুলের সময় হয়ে গেলো!”
“খবর পাইয়া তব্দা খাইয়া রইছি। ডাকার খেয়াল নাই। কান্তা আপায় নাকি বি’ষ খাইছে!”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৪
(নূর নাফিসা)
.
.
“খবর পাইয়া তব্দা খাইয়া রইছি। ডাকার খেয়াল নাই। কান্তা আপায় নাকি বি’ষ খাইছে!”
বিপুর হাত থেকে হঠাৎ চিরুনি পড়ে যায়! ইফতেখার বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়েও থেমে যায়। দুজনের থমকানো চোখই তার দিকে স্থির। পরীর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। দুজন স্থির চোখে তাকানোর সাথে সাথেই সে বলে উঠে,
“আমি নিজে জানি না সত্য, নাকি মিথ্যা। বকুল কাকার মুখে শুইন্যা আইলাম মাত্র। কালকা নাকি এক সমন্ধও আইলো। আবার কাকী মারধরও করলো। তার জন্যই নাকি মরতে গেছে, বকুল কাকা শুনছে সকাল সকাল। আমার শরীর কাঁপতাছে শুইন্যা।”
পরীর মুখ থামতে না থামতেই বিপু বেহুশে ছুটে যায় বাইরে। গতি খুব বেশি না হলেও বলা যায় দৌড়াচ্ছে। কারণ তার হাঁটার গতি স্বাভাবিক নেই। মাথা ঘামতে শুরু করেছে। কোথায় পা ফেলছে, তা অনুভবে নিতে পারছে না। অনুভূতি জুড়ে শুধুই একটা অস্বাভাবিক প্রশ্ন, “কী করলি তুই?!”
বিস্মিত ইফতেখার কপাল কুচকে রেখে তাকিয়ে আছে বিপুর যাওয়ার দিকে। পরী কাঁপা হাতেই যেন চিরুনিটা মেঝে থেকে তুলে যথাস্থানে রাখে। ইফতেখার তার দিকে দৃষ্টি এনে জিজ্ঞেস করে,
“বকুল কাকা দেখেছে?”
“জানি না, ভাইজান।”
ইফতেখার ভ্রু মাঝে দুশ্চিন্তার ছাপ রেখেই উঠে যায়। টেবিল থেকে পানির জগটা নিয়ে বারান্দায় এসে মুখে পানি ছিটায়। কোনোমতে মুখটা মুছে শার্ট পরতে পরতেই বেরিয়ে যায়। কী করলো! সত্যি শুনলো? এমন পাগলামো করতে আছে? এসব বাচ্চামোপনা না! এখন কী অবস্থা! মন্দ কিছু যেন ওবাড়ি গিয়ে না শুনে তার জন্য মনে মনে প্রার্থনা চলছে ইফতেখারের। পরীরও মন চাইছে ছুটে যাক। আম্মা কাজের ফরমায়েশ দিয়ে রেখেছেন, তাই ছুটতে পারছে না। তবে আম্মার কানে খবরটা পৌঁছে দিতে ভাতের প্লেট নিয়ে ফিরে গেছে পরপরই। কেননা, সে জানে। বিষয়টা যদি সত্য হয়ে থাকে, ভাইজানের আর ভাত খাওয়া হবে না এখন। কিন্তু, কান্তা বানু কি মরে গেলো; না বেঁচে আছে? এই শঙ্কাটাই তো তার হৃদয়কে শান্ত করতে পারছে না। মনে ভয় হচ্ছে, এই বুঝি মসজিদের মাইকে ওবাড়ির আরেকটা ঘোষণা প্রকাশ হয়!
কান্তাদের বাড়ি এসে বিপুর মাথা ঠিক নেই যেন। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ, তা দেখেও ধাক্কা দেয়। খোলা জানালায় উঁকি দেয়। মানুষজন কোথায় সব? কাকে ডাকবে সে? কার কাছ থেকে একটু খবর নিবে, ভেবে পায় না। মজিদার ঘরের দরজা খোলা আছে। দু-চার জন মহিলাও আছে, গলা শোনা যাচ্ছে। সেদিকেই ছুটবে নাকি? ভাবতেই মাথায় হাত উঠে যায়। ফ্যাকাসে মুখে চুলে হালকা মুঠো চাপে। ইফতেখারকে দেখতে পায় এমনি। দ্রুত পায়েই এবাড়ি প্রবেশ করেছে সে। বিপুর দুরাবস্থাও তার নজরে পড়েছে। এদিকে ঘরে থেকে বিপুকে দেখে মজিদা দুয়ারে দাঁড়িয়েছে। তাই ইফতেখার বিপুর দিকে হাঁটার বাঁক নিয়ে মজিদার দিকেই এগিয়েছে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“চাচি, কান্তা কোথায়? কি শুনলাম এইসব?”
মজিদা বলবে কি বলবে না, দ্বিধায় পড়ে গেছে। ইফতেখার আবারও জানতে চায়। তিনি এবার জানিয়ে দেন। গত রাতেই নাকি ঘটনা ঘটে। তখনই শিরিনের কান্নাকাটি শুনে সে তাদের ঘরে গিয়ে দেখে সাত্তার হন্নে হয়ে ভ্যান নিয়ে ছুটছে রাতের আঁধারে। আরও জানায় পাত্রপক্ষের দেখতে আসা এবং তার অমতে মারধরের ব্যাপারটাও। ভীষণ চিন্তিত ও ভীত হয়ে আছে মজিদা নিজেও। আঁধার ঘনিয়ে আলো ফুটে গেলো সেই কখন, এখনো ঠিক জানেন না কী অবস্থায় আছে। কোনো খবর আসেনি বাড়িতে। কে আছে তার, খবর এনে দেওয়ার জন্য? কোথায় নিয়ে গেছে, তা-ও বলতে পারে না মজিদা। ইফতেখার স্থানীয় সরকারি হাসপাতালকে ধারণা করেই ছুটে তখন। সাথে চলে অস্থির বিপু। মনের অবস্থাটা নাজেহাল করে রেখেছে তার কান্তা।
হাসপাতালে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আছে শিরিন। আঁচলে মুখ চেপে নীরবেই কেঁদে যাচ্ছে থেমে থেমে। ভাবতে গেলেই বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ যন্ত্রণায় ফেঁপে উঠছে। সন্ধ্যার পরপর যখন একটা শাসন পর্ব চললো, তারপর থেকেই ঘরটা একরকম নীরবতায় ছেয়ে ছিলো। অনেকটা সময় পর যখন মনে মালিন্যতা পুষে খাওয়ার জন্য ডাকতেই মেয়ের ঘরে উঁকি দিলো, কীটনাশক আর মেয়েকে অগোছালো অবস্থায় বিছানায় স্থির পড়ে থাকতে দেখলো। বুকের ভেতরটা তাৎক্ষণিক চেপে গেলো তার। দ্রুত পায়ে এগিয়েই মেয়ের নিথর অবস্থা দেখে চিৎকার করে উঠলো। সাত্তার বাইরে থেকে ছুটে যায় ঘরে। মাথা এলোমেলো হয়ে আসে তাজ্জব কান্ডে! এ কী হলো! এ কী হলো! সাথে সাথেই নিজ ভ্যানে চড়ে মধ্যরাতে হসপিটালে এসে ভীড়লো। ডাক্তার দেখালো। তিনি পরীক্ষা করে শঙ্কামুক্ত করেছেন বেশ কিছুক্ষণ পর। বিষক্রিয়ার ছড়াছড়ি নেই। মেয়ে ঠিক আছে। কিন্তু শরীর দুর্বল। সেলাইন দেওয়া হয়েছে তাই। সেই থেকে মেয়ে কেবিনের বিছানায় আর বাবা-মা নিস্তব্ধতার সাথে বসে আছে কেবিনের বাইরে বেঞ্চের উপর৷ নির্ঘুম একটা রাত কেটে গেলো তাদের। কিছুক্ষণ আগে শিরিন গিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করে এলো,
“কী করলি তুই? কী করলি!”
কান্তা কোনো জবাব দেয়নি। চুপ করে শুয়ে ছিলো অন্যত্র দৃষ্টি রেখে চিন্তিত বেশে। এদিকে বাবামায়ের প্রহরও কাটে না। সাত্তারকে শিরিন বললো ডাক্তারের কাছে আবার যেতে। তখন তো ডাক্তার বললো, বিষক্রিয়ার বিস্তার ঘটেনি। এতোক্ষণে যদি আবার শরীরে ছড়িয়ে যায়! আরেকবার চেকাপ করে তাদের নিশ্চিত করতো যদি, মনটা বোধহয় একটু সস্তি পেতো! কিন্তু বলার পরও মিনিট পাঁচেক হয়ে গেছে। সাত্তার নড়ে না। কী যেনো চিন্তায় মজে আছে লোকটা। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে দৃষ্টি সম্মুখে মেঝের দিকে। হঠাৎ পাশ থেকে গলা ভাসে ইফতেখারের।
“কাকা, কদিন দৌড়াবেন এভাবে হসপিটাল? প্রতিদিন বেঁচে যাবে মেয়ে?”
ব্যথায় নুয়ে থাকা সাত্তার দৃষ্টি তোলে সেদিকে। তাদের দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকানোর বৃথা চেষ্টা করে যায়। তবে মুখখানা থমথমে রয়ে যায় যথাযথ। ইফতেখার এগিয়ে তার নিকটে থামে। তাদের থমথমে অবস্থা দেখেই বুঝে নিয়েছে কান্তার সাথে ভয়ানক কিছু ঘটেনি। সে কেবিনের দিকে একবার তাকায়। পরক্ষণে আবারও সাত্তারের উদ্দেশ্যে বলে,
“অযথা ঝামেলাটা না পাকালেই কী হয় না আপনাদের? সহজ একটা জীবনকে কেন কঠিনতর পর্যায়ে নিয়ে যান?”
থমথমে গলায় সাত্তার বলে,
“কী কইতে চাস তুই?”
“আমার বলা হয়তো কান্তা আরও আগেই বলে দিয়েছে। আমাকেও তা-ই বলতে হবে, বলতে গেলে। নিজের ক্ষোভ না দেখে সন্তানের দিকে একটু চোখ রাখুন। জোড়াজুড়িতে সবসময় সবকিছু সম্ভবপর হয় না। দেখছেনই তো অবস্থা। বিয়েটা দিয়ে দিচ্ছেন না কেন? সেই তো পরের ঘরেই দিবেন।”
মলিন দৃষ্টি পুনরায় সম্মুখে মেঝেতে নামিয়ে নেয় সাত্তার। থমথমে গলায় উত্তর করে,
“কক্ষনো না!”
“সবসময় না-এর দিকে স্থির না থেকে কি হ্যাঁ-এর প্রতি সদয় হতে পারেন না? মরে যেতে দিতেন তবে। অযথা হসপিটাল নিয়ে এলেন কেন? দুদিন পর সেই তো আবারও মরতে যাবেই।”
প্রত্যুত্তর করে না সাত্তার। বিপরীতে বলার মতো কথাই যেন নেই তার কাছে। সে দ্বিগুণ শোকার্ত। ইফতেখার আবার বলে,
“মরতে দিতেও চান না, আবার বাঁচিয়েও রাখতে পারেন না। আসলে সমস্যা কি আপনার, কাকা? বোনকে হারিয়েও আপনার শিক্ষা হয়নি?”
ক্রুদ্ধ চোখে আবার তাকায় সাত্তার। ইফতেখার থেমে থাকে না তার এই চোখের প্রতিক্রিয়ায়। বরং গলা আরও উঁচু করে তোলে যেন। কেননা, কর্মকাণ্ড জেনেই সে চরম বিরক্ত ছিলো, এখন তার কথা শুনেও। কিছু বাবা-মা এমন কিছু সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে চায় সন্তানের জীবনের বিপরীতে, যেখানে সন্তানকে মরতেও দেখতে পারে না আবার বাঁচতেও দেয় না। এমন ভাবান্তরের কারণে বিরক্তিকর কণ্ঠেই জবাবদিহিতা চায় তার কাছে,
“বোনের মতো মেয়েকেও হারাতে চাইছেন? একই ভুল আবার করতে চাইছেন? কি নিয়ে বাঁচতে চান আপনি?”
কোনো জবাবই নেই সাত্তারের মুখে। সে ইফতেখারের প্রতি রাগান্বিত ও পরিস্থিতির কারণে ব্যথিত চোখজোড়া আবারও নামিয়ে নেয় অন্যত্র। সে কী চায়, তার জবাব যেন তার কাছেই নেই। শুধু এইটুকু জানে, চেয়ারম্যান পরিবার তার অপছন্দ। চরম পর্যায়ের অপছন্দ। সেই সাথে এই ধরনের প্রেমপ্রীতিও। ইফতেখার রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে কিছুক্ষণ স্থির তাকিয়ে থাকে সাত্তারের ফিরিয়ে নেওয়া দৃষ্টির দিকে। পরক্ষণে শক্ত গলায়ই জানতে চায়,
“আপনি আমার কিছু পরিষ্কার উত্তর দিন। মেয়েকে মরতে দেখতে যে পারবেন না, তা আমি ভালো করেই জানি। কখনো কখনো মান সম্মানের আগে জীবন দেখা জরুরী হয়। আপনি বিয়েটা বিপুর সাথে দিবেন কি না, সেটা বলুন আমাকে। মেয়েকে বাঁচতে দেখতে চান কি না, সেটা বলুন।”
সাত্তার না তাকিয়েই থমথমে গলায় বলে,
“আমি চেয়ারম্যান বাড়ি কখনোই যাইতাম না আত্মীয় করতে। কখনোই যাইতাম না তোর আব্বারে বেয়াই ডাকতে। তোর আব্বাও আইবো না আমার মাইয়া নিতে।”
“আপনাকে চেয়ারম্যান বাড়িতে যেতে হবে না। চেয়ারম্যানকেও আপনার বাড়ি আসতে হবে না। ওই বাড়িতে আপনার মেয়ের জায়গা না হলে আপনার বাড়ি রাখবেন। আপনার বাড়িতে তো জায়গা আছে রাখার মতো। প্রয়োজনে জামাই ঘরজামাই থাকবে। নিজের ইনকামে চলবে, স্ত্রীর দায়িত্বও নিবে। আপনার এতেও সমস্যা?”
সাত্তার আবার নিশ্চুপ। সে এমন একটা পরিস্থিতিতে আছে যে, কোনোরকম সিদ্ধান্ত নিতেও তার বড্ড ভয়! ইফতেখার উত্তর চাইতে বলে,
“চুপ থাকবেন না, কাকা। আমি এখানে ঠাট্টা করতেও আসিনি। আপনাদের পরিবারের উপর মাতব্বরি করতেও আসিনি। একটা সমাধান চাইতে এসেছি মাত্র। আপনার মেয়েকে আপনার চেয়ে ভালো বাইরের মানুষ বুঝবে না। আমার পরিবারকেও আমার চেয়ে ভালো বাইরের কেউ বুঝবে না৷ আর বাইরের কারো উপহাস আমাদের কারোরই বুঝে উঠার প্রয়োজন নেই। এই যে একটা ঘটনা কান্তা ঘটিয়েছে, দৌড়ে এলে তার ভালোর প্রত্যাশায় আপনারাই এসেছেন। বাইরের কেউ কিন্তু ছুটে আসেনি তাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে। আর তাই তার জীবনের লক্ষ্যটাও আপনাদেরই সুনিশ্চিত করা দরকার। সময় সুযোগ সবসময় সবার জন্য ভালোটা নিয়ে আসে না। একটু সহজ হোন। একটু ছাড় দিয়ে চলেন। জীবন এমনি সুন্দর, সহজ হয়ে আসবে। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষতির চেয়ে লাভটা বেশি কখনোই হবে না। তারা ভালো হলেও তামাশা বসাবে, খারাপ হলেও তা-ই বসাবে। আপনার ভালোটা আপনার নিজেকেই দেখতে হবে। বিপুর তরফ হতে দায়িত্ব সমেত আমি আপনার কাছে প্রস্তাব রাখছি, বিয়েটা দিয়ে দেওয়ার জন্য।”
ইফতেখার এতোক্ষণে পাশে থাকা শিরিনের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলো শিরিন কেমন নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইফতেখার তাকাতেই যেন দৃষ্টি গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত হলো। শিরিনকে তাই জিজ্ঞেস করলো,
“কান্তা এখন কেমন আছে, কাকি?”
চোখ নামিয়েই হালকা করে মাথা নেড়ে মলিন কণ্ঠে শিরিন জবাব দেয়,
“ডাক্তার জানাইছে ভয়ের কিছু নাই।”
“বাড়ি যেতে বলছে?”
“এখনো বলে নাই।”
ইফতেখার আবার তাকায় সাত্তারের দিকে। মতামত না নিয়ে যেন সে নড়বে না এখান থেকে। একটা জরুরী সমাধান চায় এর। তাই পুনরায় বলে,
“কাকা, বলেন না কেন কিছু? আপনার একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্তেই কিন্তু পরিস্থিতিটা বদলে যেতে পারে।”
সাত্তার একই অবস্থায় থেকে জিজ্ঞেস করে,
“আমি বদলাইলে সব বদলাইবো?”
“সব হয়তো না। কিন্তু অর্ধেকটাই সুনিশ্চিত বদলে যাবে। যার জন্য পুরোটা বদলে যাওয়ার প্রত্যাশাও রাখা যায়।”
“যা। তবে তোর আব্বারে কো দেখি, আসে কি না।”
“আব্বা এখন আসবে না। আব্বা এলে পুরোটাই বদলাতো। আপনি আপনার দিকটা ঠিক করেন। বললাম ই তো, প্রয়োজনে সে ঘরজামাই থাকবে। আপনি মেনে রাখতে পারলেই হলো।”
“এরপর এইজন্য কিছু হইলে তার দায়ভার তুই নিবি?”
“ঠিক আছে। চেয়ারম্যান পরিবারের দিক থেকে কিছু হলে তার দায়ভার আমার।”

চলবে।