শ্রাবণধারা পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
149

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৫
(নূর নাফিসা)
.
.
সাজবো না বধু, বাজবে না সানাই।
তবুও রইবো নাকো আর পর।
দিবাস্বপ্ন সত্যি করে,
আপনি আমার আপন প্রহর।
পরবর্তী প্রহরে নিজের নামে করে নিয়েছে তারা একে অপরকে৷ মন থেকে কতটা মানতে পেরেছে, তা জানে না সাত্তার নিজেই। তবে পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে। বাধ্য করেছে একটা জেদের সম্পর্ক স্থির করতে অনিচ্ছা সত্ত্বে! ঘরের ভেতর তামাশা তৈরি হওয়াটা বড্ড বিরক্ত করে তুলেছে এযাবৎ। এই তামাশার ইতি টানলো হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার আগে। সরাসরি চলে এসেছে কাজী অফিসে। ইফতেখারের নেতৃত্বে দিয়েছে মেয়ের দায়িত্ব বিপুর হাতে তুলে। বিপু হসপিটাল থেকে আসার পথেই বিব্রতকর অবস্থায় থেকে ভাইকে জিজ্ঞেস করে,
“ভাই, কাউকে কিছু না জানিয়ে এতোসব…”
“জানাজানি এমনি এমনি হয়ে যায়। ডেকে জানাতে হয় না কাউকে কিছু।”
“আব্বা রাগ করবেন ভীষণ।”
“তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? ঝুঁকি তো আমি নিলাম। বাড়ি ছাড়া হওয়ার ভয় তোর? রাগ আমার উপরও করেছিলেন। বাড়ি থেকে বিতারিত করেননি।”
“তোমার ব্যাপারটা অন্যরকম।”
“তুই কান্তাকে চাস কি না, তা-ই বল আমায়।”
বিপু ফ্যাকাসে মুখখানা উপর নিচে নাড়িয়ে উত্তর করে, সে চায়। কিন্তু মনে তার ভীষণ ভয়। ভাইয়ের ব্যাপারটাই পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি তার পরিবারে। সেখানে কান্তা সম্পর্কিত ব্যাপার কতটা অস্বাভাবিকতা ছড়াবে, তা নিয়েই যত ভয় চেপেছে বিপুর মনে। সে তো পরিবারকেও ভালোবাসে। কান্তাকেও চায়। কিন্তু এভাবে চায়নি। পরিবার নিয়েই তার চাওয়াটা। যা হয়তো তাদের দুই পরিবারের অবস্থানে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক এবং অবাস্তব। বিপু এর আগেও চুপ ছিলো, পরেও চুপই রইলো। যা ব্যবস্থা করার, নির্ভয়ে জেদি ইফতেখারই করলো। তাদের বাজারে রেখে সে বাড়ি গেলো। নিশ্চুপে, নিজ হাতে বিপুর কাগজপত্র নিয়ে এলো। ততক্ষণে কান্তার কাগজপত্র নিয়েও হাজির হয়েছে শিরিন। মন ভার করে রাখা পিতামাতা স্বয়ং উপস্থিত থেকে মেয়ের পছন্দের পাত্রে অর্পণ করলেন। ভাইয়ের সাহসিকতায় সাধের কান্তা আজ ধর্মীয় ও আইনী অধিকারে আতাহার বিপুর নামে লিপিবদ্ধ। দেনমোহরের পরিমাণটা ইফতেখার নিজেই প্রকাশ করলো পাঁচ লক্ষ টাকা। কেননা এখানে তার নিজের বিয়ের সময়টাকে বেশ মনে পড়েছে। একই কাজী দ্বারা একই পরিবারের দুই কাজ। শ্রাবণের সেই কথা অনুযায়ী বিপুও তো চেয়ারম্যানের ছেলে। তারও মোহর পাঁচ লাখই হওয়া উচিত বলে মনে করলো সে৷ কেউ কোনো কথা রাখেনি এ নিয়ে। বিপু শুধুই দেখছিলো, ভাই কী করে। এমন একটা পরিস্থিতিতে নিজেদের পাওয়ার ব্যাপারটা আনন্দের চেয়ে বেশি ভয়ের ছিলো পাত্রপাত্রী দুজনের নিকট। দুজনেরই ভয় পিতামাতার অনিচ্ছা এবং অপছন্দ জুড়ে। আনুষঙ্গিক ব্যাপার নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই তাদের। কাজী অফিসের কার্যক্রম শেষ হতেই একত্রে বের হয় তারা। বাজারের জমজমাট স্থান। তারা প্রবেশের সময়ও যেমন কারো কারো নজর কেড়েছে, এখন একত্রে বের হওয়ার সময় জনদৃষ্টি আকর্ষণ যেন কয়েকগুণ বেড়েছে। এসময় খালিদও উপস্থিত বাজারের ব্যাগ হাতে। কয়েক কদম এগিয়েছে মাত্র, সামনে এসে ইফতেখারকেই বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে;
“তোরা এইখানে?”
“এইতো, কাজী অফিসে।”
“তা তো দেখতাছিই! কিন্তু হঠাৎ…?”
“বিপুর বিয়েটা সেরে নিলাম।”
তারা চললেও খালিদ জবাব পেয়েই থেমে গেছে স্তব্ধ বেশে। ইফতেখার সেদিকে মনোযোগ না রাখলেও দ্বিতীয়বারের মতো বিপু একবার দেখে নিয়েছে খালিদ ভাইয়ের বিস্মিত মুখ। অন্যসময় হলে হয়তো এমন চেহারায় অদ্ভুত আনন্দ পেতো। আজ তার বিন্দুমাত্র হচ্ছে না। কদম যত ফেলছে, মনের ভয়ও যেন বাড়ছে। সাত্তার তাদের থেকে গতি বাড়িয়ে পা ফেলছে। তার হনহনিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়েই স্বাভাবিক গতিতে হাঁটছে ইফতেখার। গম্ভীর মুখটাও নজর এড়ায়নি এক মুহুর্তের জন্য। খুব রাগ নিয়েই যেন বিয়েটা দিতে বাধ্য হলেন। শিরিন মেয়ের সাথেই হাঁটছে আঁচলে মুখ চাপা রেখে। সাত্তার এগিয়ে যাওয়ার পর তারা তিনজন এক ধাচে, বিপু পিছু পিছু। বাজারের সীমানা ছাড়তেই ইফতেখার শিরিনের উদ্দেশ্যে বলে,
“কাকি, টেনশন করবেন না কোনো। কাকাকেও টেনশন মুক্ত রাখার চেষ্টা করবেন। এখন তো এমনিতেই মন মানসিকতা ভালো নেই কারো। ক’টা দিন যাক, কান্তাকে বাড়ি নেওয়ার ব্যবস্থা করবো।”
শিরিন ভেজা গলায় প্রত্যুত্তর করে,
“খোদা যা রাখছে কপালে, তা-ই হইবো। আর কোন দুর্দিন আছে সামনে, তা-ও খোদাই ভালা জানে।”
“সুদিনের প্রত্যাশা আর প্রচেষ্টা রাখলেই সুদিন আসবে। কিন্তু সুদিনকেও যদি দুর্দিন বলে গালি দিয়ে রাখেন, তবে তো দিন কখনোই সু হতে পারবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, আর দোয়া করুন। যেন সব সহজ হয়ে আসে।”
তারা কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে। হুট করেই পেছন থেকে কান্তার হাতটা ধরে থামিয়ে নিয়েছে বিপু। দুজনের কারোই নজর এড়ায়নি কান্তার পিছিয়ে যাওয়া। তবে সেদিকে মনোযোগ স্থির না করে কথায় এগিয়েছে ইফতেখার ও শিরিন। এদিকে কান্তার হাত ধরে একটু থেমে ছিলো বিপু, তাদের থেকে কিছুটা পেছনে থাকার জন্য। কান্তা মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বিপুর দিকে ভেজা, শক্ত চোখে তাকাচ্ছে; কেন তাকে থামালো! মুখে জিজ্ঞেস করার আগেই চোখের ভাষা স্পষ্ট বিপুর কাছে। কিন্তু তার মুখেও উপস্থিত চরম বিরক্তি। ভ্রু জোড়া হালকা কুঁচকানো রেখেই সে জিজ্ঞেস করে,
“কী করলি তুই?”
প্রশ্নের সাথে সাথেই কান্তা চোখ নামিয়ে মলিন মুখে স্পষ্ট প্রতুত্তরে জানতে চায়,
“কী করছি?”
“মরতে গেলি ক্যা?”
কান্তা ব্যথিত দৃষ্টি তুলে মায়ের যাওয়ার দিকে। বিপু ধরে রাখা হাত ঝাকিয়ে উত্তর চায়,
“জবাব দেস না ক্যা?”
চোখের জল আবারও গাল গড়ায় কান্তার। সাথে সাথেই মুছে নেয় অন্য হাতে। গলার স্বর স্পষ্ট রেখেই বলে,
“প্রতিদিন বেঁচে মরার চেয়ে তো একবারে মরে যাওয়াই ভালো।”
বিপু দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
“রাস্তায় আছিস বলে একটা চড়ও মারতে পারছি না। আমার তো ইচ্ছে করছে নিজ হাতেই তোকে মেরে ফেলি! তুই মরলে কী হতো? হুম? হতো টা কী? বেঁচে যেতি? এতো না হালাল হারাম বেছে চলিস? এতো না সাহস দেখাস? তো শেষ মেষ কী করলি? আল্লাহকে ভয় পেতে ভুলে গেলি? এইটুকু সহ্য হলো না? মরতে যেতে হলো!”
“তো কী করতাম আমি? কত যুদ্ধ করা যায় একা একা? কতদিন বসে থাকা যায় এভাবে লড়ে? আপনার তো ঘুম হচ্ছিলো, আমার একদমই হচ্ছিলো না। বাড়িতে ঘটকের ছায়া পড়লেই দমটা বন্ধ হয়ে আসে। তারউপর আপনি তো যোগাযোগই বন্ধ করে দিলেন।”
গলা নিচু রাখলেও আগের মতোই শক্ত, বিরক্ত গলায় বিপু বলে;
“যোগাযোগ বন্ধ রেখে কী আমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম? চেষ্টা করছিলাম না কিছু একটা করার? হুট করে চাইলেই কী হাত ধরে ফেলা যায়? প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তো আমাকে আগে নিজের পায়ে পোক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। কোনো একটা কূল ঠিক না করে কীভাবে তোর হাত ধরতে আসি?”
“তো এখন কীভাবে ধরলেন?”
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বিপুর মুখে তাকিয়ে থাকে কান্তা। বিপু চুপ হয়ে যায়৷ কীভাবে যে ধরলো, সে নিজেও জানে না। কিন্তু অধিকারের হাত এবং বাহুতে সংযুক্ত হাত উভয়ই যে ধরতে পেরেছে, তা বড্ড উপলব্ধি করতে পারছে। দুশ্চিন্তায় থেকেও পারছে। নিরুত্তর বিপুর রাগ অনেকটা সংযত হয়ে আসে। গলাটা কেমন ব্যথিত হয়ে আসে।
“আমার শরীর কাঁপছিলো তোর কাণ্ড জেনে। আমার কেমন লাগছিলো, যদি তোকে বুঝাতে পারতাম! এমনটা না করলেও পারতি, কান্তা। আজ তোকে ফিরে না পেলে? আমি যে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম, তুই যে সহ্য করে যাচ্ছিলি; তার শেষটা তুই এভাবেই হতাশায় ঢেলে চলে যেতে প্রস্তুত হয়ে গেলি?”
ছলছল দৃষ্টি বিপুর চোখে রেখেই কান্তা কাঁপানো গলায় প্রত্যুত্তর করে,
“আমি কিছু খাইনি।”
এমন মিথ্যায়ও যেন বিপুর রাগটা আবার বেড়ে আসে।
“খাসনি? না খেলে তোকে হসপিটাল ভর্তি কেন থাকতে হয়, বল আমায়।”
“সত্যিই খাইনি। ওষুধ পাশে রেখে শুধু ভং ধরেছিলাম। আল্লাহ মাফ করুক। বিশ্বাস করুন, প্রত্যহ আমার ভালো লাগছিলো না এইসব। তাই দেখতে চাইলাম, আব্বা আম্মা আমার উপর মন থেকে বিরক্ত কি না। একটু হলেও মূল্য দিতে চায় কি না।”
ধরে রাখা হাতটাও যেন বিস্ময়ে ছেড়ে দিয়েছে বিপু। টুপটাপ ঝরে যাওয়া অশ্রু এবার দুই হাতেই মুছে নেয় কান্তা। আরও বলে,
“ডাক্তার দুর্বলতার কারণেই বোধহয় ভর্তি করে দিয়েছে। আমি তো চোখ বন্ধ রেখে অচেতন হওয়ার ভান করছিলাম শুধু।”
মাথায় দুশ্চিন্তার চাপ না থাকলে বোধহয় বিপু হা হা করে হাসতো এই কথায়। কিন্তু তা না হওয়ায় এখন যেন রাগে ঝিমিয়ে অস্পষ্ট হাসলো ঠোঁট কার্ণিশে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে মাথার চুল হালকা মুঠোয় ধরে এধার ওধার তাকায়। তা দেখে কান্তারও কেমন হাসি হাসি পায়। চমকে দিয়েছে যে তাকে! সে-ও ঠোঁট কার্ণিশে কিঞ্চিৎ স্পষ্ট হাসি রেখে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। পরপরই বলে,
“তবে জানতাম না, বিয়েটাই যে হয়ে যাবে এভাবে।”
তার এরূপ কথায় বিপুর অস্পষ্ট হাসি যেন এবার স্পষ্ট রূপ নেয়। কান্তার দৃষ্টিনত মুখে তাকিয়ে আবার তাকায় ইফতেখার ও শিরিনের যাওয়ার দিকে। সাত্তার রাস্তায় নেই। ইফতেখার নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছে, শিরিন বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে মেয়ের জন্য। বিপুর মনটা যে ভালো হয়েছে, তা প্রকাশ না করলেও কান্তাকে বলে;
“কাকি দাঁড়িয়ে আছে।”
কান্তা সেদিকে তাকিয়ে হাঁটা ধরে।
“আসি।”
বিপু পিছু বলে,
“আমার চাকরি হয়েছে স্কুলে।”
কান্তা আবার পিছু ফিরে থামে।
“কবে?”
“এইতো, এই মাসেই। দেখা হয়নি, তাই বলতেও পারিনি।”
“ইনশাআল্লাহ, নতুন জীবন সুন্দর হোক।”
এক বাক্যে চাকরি ও বিবাহ, নতুন দুই জীবনের জন্যই শুভকামনা জানিয়ে মায়ের কাছে গেলো কান্তা। বিপুর একপাশ শান্ত হলেও অপর পাশে ভীড় জমায় দুশ্চিন্তা।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৬
(নূর নাফিসা)
.
.
বাড়ি এসে নাশতা করতে বসে গিয়েছিলো ইফতেখার। পরপরই বিপুও এসেছে। ভাত চাইলো পরীর কাছে। পরী দুই ভাইয়ের মুখেই তাকায়। কান্তা বি’ষ খেলো, আর তারা দেখে এসে ভাত খাওয়ার লাইন ধরেছে কেন? তাদের বিষাদে বিষম খেয়ে বসে থাকার কথা। বিশেষ করে বিপু। কান্তাবানুর শোকে তার মুখ শুকিয়ে যাওয়ার কথা। কান্নায় গলা ভেঙে যাওয়ার কথা। গলায় কলসি না বাঁধলেও তো পুকুরে ঝাপিয়ে পড়ার কথা। এ কী হলো কান্তা বানুর সাথে, সেই আফসোসে। কিন্তু তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদিও অতি সামান্য পরিমাণে চিন্তিত লাগছে, কিন্তু সে যতটা প্রত্যাশা করছে সেই হিসেবে কিছুই না। ভাতের থালা সামনে দিলেও কথা নাড়াতে অপেক্ষা রাখে না পরী। ঘার কাত করে বিপুর মুখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনে কান্তা গো বাড়ি গেছিলেন তো, ভাইজান? কান্তাবানু এখনো জ্যান্ত আছে?”
বিপু ভাত থেকে চোখ তুলে তাকাতে তাকাতেই দরজার বাইরে থেকে ধমক আসে পারভীনের কণ্ঠে।
“তোরে কী করতে বলছিলাম? মশারি ধুইছোস?”
পরী জবাবদিহিতা ছেড়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেছে। যেতে যেতে পারভীনের সামনে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে গেলো,
“মায়া দয়া কিচ্ছু নাই। মাইয়াডা বি’ষ খাইছে, দেখতে যাইতে তো পারলামই না। খবরটাও নিতে দেয় না একেবারে।”
পারভীন ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো কেবল তার যাওয়ার দিকে। পরক্ষণে ঘরের ভেতর দুই ছেলেকেই ভাত খেতে দেখে কেমন গম্ভীরমুখে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই আফজাল হোসেনের ডাক পড়ে। ইফতেখার তখন দালানে ছিলো মিস্ত্রির কাছে। বাবার ডাকে এই ঘরে আসে সাথে সাথেই। আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে বসে আছেন। পারভীন নিজেও ক্ষিপ্ত বেশে। ইফতেখার এসেই বলে,
“আব্বা, ডাকলেন?”
“সকালে কই গেছোস?”
ইফতেখার দুই সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে বাবামায়ের মুখে তাকিয়ে তারপর জবাব দেয়,
“হসপিটালে।”
“ক্যা?”
“কান্তা বি’ষ খেয়েছে। দেখতে গেলাম।”
বি’ষ খাওয়ার ব্যাপারটা যেন একটু ভ্রু কুচকে আনলো আফজাল হোসেনের। মনমানসিকতা ভালো না হওয়ায় বাড়ির বাইরেও যাওয়া হয় না। তার রটারটিও আসেনি কানে। তবে পরীকে কোনো বিষয়ে ভীতিকর অবস্থায় ছুটতে দেখছিলো, কিন্তু খেয়াল দেওয়া হয়নি। আফজাল হোসেন কপালের ভাজে চিন্তা ধরে রেখেই জিজ্ঞেস করে,
“কোন কান্তা?”
“সাত্তার কাকার মেয়েটা।”
কপালের ভাজ খুলে আসে পরপরই। বিরক্ত গলায় বলে,
“আমি তো অন্যকিছু শুনলাম। তুই হাসপাতাল না, কাজী অফিস গেছোস।”
“হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।”
“কীজন্য?”
“বিপুর বিয়েটা দিয়ে এলাম।”
সাথে সাথেই হুঙ্কার তুলে গলা ঝাড়েন ছেলের উপর। তিনি মূলত এই খবর জেনেই ডেকেছেন তাকে।
“মাতব্বর হইয়া গেছোস? নিজের মনমতো লুকাইয়া বিয়া কইরা আমার মানইজ্জত আধা শেষ করছোস। এখন ছোটডারে লেলিয়ে দিছোস! পাইছোস কী তোরা? এইভাবে মানইজ্জত শেষ না কইরা আমারে শেষ কইরা দিতে পারোছ না দুই ভাই?”
“আজ কেমন মায়ের ধাচের কথা বলতে শুরু করে দিছেন আপনিও। একটা মেয়ে মরতে গেছে; সেখানে আপনার মানইজ্জত বড় হয়ে গেলো, আব্বা? সে তো আপনার ছেলের জন্যই মরতে গেছে। বিপুর সাথে সম্পর্ক ছিলো, আপনি জানতেন না?”
“তারে ডাক দে। সম্পর্ক জুতা মাইরা ছুটাইতাম প্রয়োজনে। তুই বিয়ে দিয়ে সমাধান করতে গেলি ক্যা? আমার কাছে জিগাইছোস?”
“আপনি অনুমতি দিবেন না, তা আমি ভালো মতোই জানি। আর আমি আপনার সম্মান শেষ করতে নয়, বাঁচাতে গেছি। এই মেয়েটা যদি আজ মারা যেতো, চেয়ারম্যান বাড়িতে সাথে সাথেই পুলিশের ভীড় পড়তো। কারণ, বি’ষটা চেয়ারম্যানের ছেলের জন্য খেয়েছে। সেটা শুধু আপনি আর আমি না, সকাল থেকে পুরো এলাকাই জেনে গেছে।”
“তোরা কাহিনী কইরা যাবি, আর এলাকা জানবো না! বড় পাখা ওয়ালাই হইয়া গেছোস দুইটায়। আমি অন্যের ঘর ঠিক কইরা দেই সালিশ ডাইকা৷ আর আমার ঘর তোরা ভাইঙ্গা লোক হাসাইতে লাগছোস!”
উঁচু গলায়ই কিছুক্ষণ বকে যায় আফজাল হোসেন। ইফতেখার কিছুটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে শুনে বিরক্ত বেশেই চলে যায় নিজ ঘরে৷ এসে দেখে বিপু ভীতু বেশেই বসে আছে চেয়ারে। দৃষ্টি স্থির ছিলো মেঝেতে। ভাইকে দেখেই চোখ তুলে মুখে তাকায়। তার জন্য কত বকা খেয়ে এলো ভাই। এখানে বসে বসে সবই শুনে যাচ্ছিলো সে। ইফতেখার বাবার প্রতি বিরক্ত হয়ে তাকে বলে,
“তখন হুট করেই বেরিয়ে গেলি কেন? আব্বাকে সাথে নিয়ে যেতে পারলি না? দেখে আসতো, বি’ষ খেয়ে কীভাবে হসপিটাল পড়ে আছে। এতেই যদি সিদ্ধান্তটা নিজে নিতে পারতেন। বাপ না হোক, চেয়ারম্যান হিসেবেই ডেকে নিতি। সমাধান একটা করে আসতেন।”
ভাইয়ের মেজাজ খারাপের কারণ তার জানা আছে। সে কথার প্রসঙ্গে ভ্যাবলা মুখে বললো,
“কী দেখাতে নিতাম, ভাই? উনার সমাধান তো তখন অন্যদিকে মোড় নিতো নিশ্চিত। কান্তা তো বি’ষ খায়নি।”
“খায়নি মানে!”
“ভং নাকি ধরেছিলো। আসার সময় বললো।”
ইফতেখারের মেজাজ আরও খারাপ হয়। সে চোয়াল শক্ত করে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। এবার যেন বাবার বকাঝকা গুলো কড়াকড়িই গায়ে লাগলো। কারণ, প্রকৃত অর্থেই সে অযথা মাতব্বরিটা করে এলো। কারণহীনা ঘটনা ঘটিয়ে এলো! তাই ধমক দেয়, চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যেতে। বিপুর হাসি পেয়ে যায়। ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া দেখে মুখ টিপে অস্পষ্ট হাসতে হাসতেই বেরিয়ে যায়। ইফতেখারের মেজাজ শান্ত হয় না। বাবার ধমকানো এখনো চলছে পাশের ঘরে। দুই ভাইকেই বকছে। তবে ইফতেখারের স্পর্ধা নিয়েই তিনি বেশি ক্ষেপেছেন। আর এই ক্ষেপার কারণেই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে জেদি ছেলের। চলে যায় গোসল করতে। পরপরই শার্ট পরে প্রস্তুত হয় বেরিয়ে যেতে। ফোন এসেছে। তার লোক এসেছে বালুর মাঠে। মালামাল এনে রাখতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। চিরুনিটা হাতে তুলে একটু মাথাটাও আচড়ে নেয় দেহে সরিষার তেল ঘষে। হঠাৎ চোখে পড়ে হাত ঘড়িটা। এই ঘড়ি উপহার দাতা তার সবচে বড় যন্ত্রণা। মর্মের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা! সে যখন আশেপাশে থাকতো, কারণে অকারণে মাথাটাও এতো গরম হতো না। বিগড়ানো মেজাজও অল্প সময়েই শান্ত হয়ে যেতো তার ক্ষুদ্র এক পলক দর্শনে। এখন সে নেই, তার শান্ত মনটাও যেন আঁচল ধরে পিছু পালিয়েছে সেই সাথে। ঘড়িটা হাতে তুলেও ইফতেখার মর্মব্যথার তাড়নায় রেখে দেয় যথাস্থানে। পরার রুচি আর হয়ে উঠে না। মেজাজ বিগড়ানোর সাথে সাথে বিষন্ন করে তুললো যেন তার এই প্রেমময় মনটাকেই!
বাইরে এসে কাজে মনোযোগ দেওয়ার পর ঘরে জন্মানো বিষন্নতা ও রাগ কেটে গেছে। বিকেল পর্যন্ত বালুর মাঠেই তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। পরক্ষণে এসে একটু বসেছে ক্লাবে। সঙ্গীরাও এসে আড্ডায় বসে পড়েছে কিছু সময়ের ব্যবধানে। এক পর্যায়ে ক্যারাম খেলায় মেতে গেলেও ইফতেখার যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। চেয়ারে হেলান দিয়ে তাদের খেলা দেখে এবং নিজের জগৎ নিয়ে ভাবে। দুপুরের পর থেকে বিপুর বিয়ে নিয়ে আশপাশে রটারটিও যথেষ্ট হচ্ছে। তাতে তার কিছু আসে যায় না। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অন্যায় কিছু তো হয়নি। পবিত্র একটা সম্পর্ক গড়েছে আইন ও ধর্মীয় নীতি অনুসারে। সুতরাং, তার কাছে এটা গায়ে মাখার কোনো ব্যাপারই না। অবশ্যই পাত্র পাত্রীর অধিকার আছে, নিজেদের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কেননা, জীবনটা তাদের। সংসারটাও তারা গুছাবে তাদেরই মতো করে। এখানে অন্যদের পছন্দ জোর করে চাপিয়ে দেওয়া, মনোমালিন্যতা, রাগারাগি, হানাহানি একদমই অহেতুক অর্থ বহন করে। অথচ কিছু বাবামায়ের অতিরঞ্জিত স্বভাবটুকু বড্ড বিরক্তিকর তার কাছে। এই যেমন তার বাবা-মা এবং কান্তার বাবা-মা। প্রেমে আবদ্ধ হয়ে ভুল নাহয় একটা করেছেই, ভুলটাকে তারা গাঢ় কেন করে ফেলে? সহজভাবে ভুলকে পবিত্রতায় বেঁধে দিলেই কী পারে না? অতীত টেনে কেন এমন ক্ষোভ নিয়ে বসে থাকবে। এসব নিয়ে ভাবতে গেলেই বিরক্ত হয় ইফতেখার। ইশার আজানের ধ্বনি কানে আসতেই উঠে যায় অবিলম্বে। বন্ধুদের খেলা ডিসমিস করে দেয় মাঝামাঝি অবস্থায়। ক্লাব তালাবদ্ধ করে চলে যাবে। খেলা পরে হবে একসময়। আপাতত ছুটি নিতে বাধ্য করে। নামাজ থেকে বেরিয়েই খালিদ ভাইয়ের সাথে দেখা ইফতেখারের। আব্বার কানে যে খবরটা কে পৌঁছে দিতে পারে, তা আন্দাজ করা শুরু করলেই খালিদ ভাই থাকবে সন্দেহের শীর্ষে। তার মনটাও এখন ভালো আছে বিধায় শান্ত স্বরে ফুরফুরে মেজাজে জিজ্ঞেস করে,
“বাড়ি যাচ্ছেন?”
“হু। মাঠে কাজ করাইলি?”
“হ্যাঁ, করালাম।”
“মালামাল তুলবি এদিকেই?”
“কাল পরশুই ইনশাআল্লাহ। আব্বার কানে খবরটা আপনিই প্রথম পৌঁছে দিছেন, তাই না?”
“জানাশোনায় এমন একটা কাজ ক্যামনে করতে পারলি তুই, ভাবতে অবাক লাগে। মামার দিকটা একবার ভাবলি না? তুই তো বুঝদার, বড় পোলা ছিলি।”
“ভাগ্যের লেখক তো আর আমি না। যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই ঘর নির্ধারণ করেছেন। ঘরে উঠার সময়টাও। তবে আপনাকে বিশেষ বিশেষ ধন্যবাদ না দিলেই নয়, খালিদ ভাই। আপনি না থাকলে যে কত আপডেট মিস করতো চেয়ারম্যান পরিবার! ভালো। চালিয়ে যান। বড় ভাইয়ের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে হয়তো এসব। নজর না রাখলে ছোটরা বিধ্বস্ত হয়।”
ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ঠেসে দিয়ে চলে যায় ইফতেখার। যদিও সে তার ফুপাতো ভাইয়ের স্বভাবটা মজাদার ভেবেই বলে গেছে, কিন্তু খালিদের বেশ অপমানে লাগলো।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৭
(নূর নাফিসা)
.
.
সপ্তাহ দু-তিন মনোমালিন্যতায়ই গেলো তাদের। ঘরটা কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। একজন বউ হয়ে এলো, তবুও রইলো না খুব বেশি সময়। কেমন একটা অভাব ধরে রাখলো ঘরের মধ্যে। আরেকজনের আসার কথা ছিলো, বন্দোবস্ত হওয়ার আগেই দূরত্ব বাড়িয়ে চিরতরে চলে গেলো। অবস্থান নিলো দ্বিতীয় সীমানার ঘরে। প্রায় তিন সপ্তাহ যাবত বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে এখন আরেক নতুন সদস্যের বার্তা। কিন্তু তাকেও ঘরে আনার কোনোরকমই বন্দোবস্ত হচ্ছে না। পুরাতন মানুষগুলোই রয়ে গেছে পুরনো জায়গায়। কিন্তু পুরাতন সুখটা যেন নীড়হারা হয়ে আছে। আগের মতো হৈহোল্লোড়ে একদম মাতে না ঘরদুয়ার। মনে মনে কেবল ঠাঁই নিয়েছে বিষাদ! বাবার সম্মুখীন হতেই ভয় পায় বিপু। ছায়া দেখলেই কেমন কেটে পড়ার তাগিদ তার। আফজাল হোসেনও রেগে আছেন। ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছে, কী আর করবেন তিনিই? রেগে থাকার বেশি আর কিছুই যেন করতে পারছে না। ইফতেখারকে বকাঝকা করার পরপরই বিপুর উপর ধমকে ছিলেন একবার৷ এরপর ডাকেনও না, ছেলেরাও আসে না। কে আসবে পুনরায় ধমক খেতে! যত ছোটাছুটি শুধু পরীর। নীরব নীরব ঘরটাকে সে-ও প্রাণোচ্ছল করে তুলতে পারছে না। একা একা কি আর চিৎকার করা যায়? পারভীন তো আছেই কপাল চাপড়ানোর তাড়ায়। ছেলে দুইটাই তাকে বড্ড কষ্ট দিলো। স্বামীর দেওয়া আঘাত আর না-ই বা উল্লেখ করুক। মেয়ের কাছ থেকেও যেন প্রত্যাশা ছেড়ে দিয়েছে ছেলেদের প্রতিদানের কারণে। রবের কাছে একা একা কান্না করা আর অভিযোগ করাই যেন আজকালের প্রধান কাজ হয়ে উঠেছে তার। কী এমন পাপ করেছিলো, যার ফলাফল এতো বিষাদ আনে তার মনে?
রাস্তার কাজ শেষ হওয়ার পর আরও কয়েকটা কাজ হাতে নিবেন পরিকল্পনা করে রাখলেও নেওয়া হয়ে উঠছে না। মনমানসিকতা ভালো যাচ্ছে না, তাই আলাপ আলোচনায়ও বসছে না ঘরে কিংবা বাইরে। বাইরে গেলেই তো অসম্মানজনক কথাবার্তা উঠে আসবে। বড় ছেলের বউ নিয়ে তেমন গুঞ্জন না উঠলেও এবং ঘরমুখে প্রশংসা প্রাপ্ত হলেও ছোটো ছেলের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে রইলো। ঘরের কাছে ঘর, একই এলাকার দ্বিমুখীতা যাদের জীবন ধারা জানে লোকে; তাদের নিয়ে গুঞ্জন করাটাই অতি স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটা দুইটা পরিবারেই অস্বাভাবিক আপত্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পারছে ফেলতে, আর না পারছে মানতে! মাঝখানে ঝামেলা পাকিয়ে ঠান্ডা হয়ে রইলো ইফতেখার ছেলেটা!
নতুন ব্যবসায়ে মনোযোগী হয়েছে বেশ। বালু, পাথর নিয়েই এগিয়েছে শুরুতে। অগ্রগতির দিকেই আছে ইফতেখার। চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগও বাড়িয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। স্থানীয় এলাকায় ব্যবসায়ের ধরনটা একটু ব্যতিক্রম হওয়ায় সুবিধাজনকই মনে হচ্ছে শুরুটায়। প্রায় প্রতিযোগীশূণ্য একটা পথে চলেছে সে। রিজিকে কতদূর যাওয়ার সুযোগ আছে, তা-ই দেখার বিষয়। আজকাল ভারি ব্যস্ততায় দিন পাড় হচ্ছে। এদিকে ঘরের কাজও শেষ হয়ে এসেছে। এবার গুছিয়ে নেওয়া দরকার। বাবা গম্ভীরতায় না ডাকলেও ইফতেখার নিজ থেকেই এসে আজ সামনে দাঁড়ালো কিছু বিশেষ আলোচনায়।
“আব্বা, কিছু কথা ছিলো।”
দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে হিসাবের খাতা নিয়ে বসেছিলেন আফজাল হোসেন। পুরো ঘরের কোন কোন খাতে কত খরচ হলো, তা-ই মিলিয়ে নিচ্ছিলেন। ছেলের উপস্থিতিতে মনোযোগ ছেড়ে জবাব দেন,
“হুম, বল।”
“ট্যাক্স তো আমাকে দিয়েই পাঠাতে পারতেন। খালিদ ভাইকে পাঠানোর কী দরকার ছিলো শুধু শুধু!”
“তুই ব্যস্ত মানুষ। দরকার কী আর ভেজালের?”
বাবার অব্যক্ত অভিমানটা যেন ধরতে পারে ইফতেখার। প্রত্যুত্তরে বলে,
“ব্যবসায় করছি বলেই যে আপনার কাজ ছেড়ে দিয়েছি, এমনটা তো না। যে কাজগুলো আপনি আমাকে দিয়ে করাতেন, আমি সবটাই করতে প্রস্তুত এখনো। আপনার কাজ করার পরেই অবসরতাটা আমার ব্যবসায়ে দেওয়ার জন্য ভেবেছি। যখনই প্রয়োজন, বলবেন শুধু। সময় ঠিক করে নিবো।”
“কোনো কাজ হাতে নেওয়ার পরে তা মনোযোগের সাথে না করলে কাজের অমর্যাদা হয়। ফলাফলও ভালো আসে না। করতাছোস, মন দিয়ে কর। খালিদ দূরের কেউ না। তারে আমার কর্মচারী হিসেবেই রাখছি।”
“আমি সেটা বলছি না। আপনি তো এসব বিষয়ে আমায় ডাকতেন আগে। আমি আমার অবস্থানটা ধরে রাখতে চাইছি। আপনার কাজকে হেলা করতে চাইনি একদম।”
“বুঝছি। দরকার হইলে ডাকবো। মালামাল আসে যায় কেমন?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই যাচ্ছে। টাকা আরও কিছু ঢালতে হবে। অল্পস্বল্পে হবে না মনে হয় সামনে।”
“লাগলে উঠায় নিস।”
“যা বলতে আসছিলাম, ঘরের ব্যবস্থা তো আগে করা দরকার আব্বা। কিছু আসবাব নতুন আনা দরকার। আম্মার জন্যও দোয়া করানো দরকার এর আগে।”
“মসজিদে হইবো দোয়া। শুক্রবারেই মিলাদ করা, তবারকের ব্যবস্থা কইরা।”
“আচ্ছা।”
এমনি পারভীন আসে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে। আফজাল হোসেন কাপ নিতে নিতে পারভীনের উদ্দেশ্যে বলে,
“ঘরে উঠতে কী কী লাগবো আসবাবপত্র, জানায় দেও ইফতিরে।”
পারভীন খাটের কোণে বসে গম্ভীরমুখে বলেন,
“দুইটা খাট হলেই হইবো আপাতত। অর্পার খাটটা ঘুণে ধরছে। আরেকটা অতিরিক্ত লাগবো অতিরিক্ত রুমের জন্য। বাকিসব পুরাতন নিয়েই উঠা যাবে।”
আফজাল হোসেন চায়ে চুমুক দিয়ে ইফতেখারের উদ্দেশ্যে বলে,
“সেগুনের দুইটা খাট দেখিস বাজারে।”
“আচ্ছা, দেখবো নে। মিলাদের টাকাটা দিয়েন। খালিদ ভাইকে ডেকে ব্যবস্থা করে নিবো।”
“কাল নিয়ে যাইস।”
“ঠিক আছে।”
ইফতেখার চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই আফজাল হোসেন ডাকেন তাকে।
“আর শোন।”
“হুম?”
ইফতেখার পিছু ফিরে তাকাতেই জিজ্ঞেস করেন,
“শ্রাবণ ফিরবো না?”
মুখটা মলিন হয়ে আসে যেন ইফতেখারের। সবটা না জানলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন তিনি। তাকে অপমান করলেও শ্রাবণকে ভুলে যাননি আফজাল হোসেন। বরং অপমানের পরেও যেন এই সুস্পষ্টবাদী শ্রাবণ তার পছন্দ! ইফতেখার কাটিয়ে পড়তে ছোট করে জবাব টানে,
“জানি না।”
“রাগারাগি গাঢ়তর করা ভালো না। চোখের সামনেই তো পরিণতি দেখা যায়। অযথা অশান্তি বাড়ানোর দরকার নেই।”
বুকের ভেতর নিঃশ্বাস আটকে রেখে যেন বাবার মুখে তাকিয়ে থাকে ইফতেখার। ঠিক এই কথাটাই যদি বেশ কয়েকবছর আগে তিনি নিজে বুঝতেন, কেউ ঠকে যেতো না হয়তো তার দ্বারা। এখনোই বা বুঝছেন কোথায়? কান্তাকেও তো মানছেন না! সাত্তার কাকার সাথে রাগারাগিটা ধরে রেখেছেন নয়কি? অন্যকে বুঝানোটা বোধহয় খুব সহজ। বুঝে নেওয়াটা সহজ নয়। তবুও তা নিয়ে কিছু বলতে উদ্যত হয় না সে। বাবা হয়ে বুঝানো দরকার মনে করেছেন, তিনি বলেছেন। সুতরাং সে চুপই থাকে। আফজাল হোসেন পরপরই বলেন,
“শ্রাবণরে বাড়ি নিয়ে আয়।”
“তার সাথে আমার যোগাযোগ নেই।”
“যোগাযোগ থাকবো না ক্যা? দুই দিন যাবত বিয়া কইরাই যোগাযোগ বন্ধ কইরা দেস, এইসব রঙতামাশা পাইছোস?”
গলার স্বর কিছুটা উঁচুই হয়ে আসে আফজাল হোসেনের। ইফতেখার প্রত্যুত্তর না করলেও পারভীন বলে,
“আপনি তারে চাপ দিতাছেন ক্যা? যে গেছে, তার ফেরার দরকার নেই। দুনিয়াতে মেয়ের অভাব পড়বো না। বিয়ে আরেকটা করায় নিবো। ওইরকম মেয়েলোক আল্লাহ কারো ঘরেই না ফালাক। ঘরের শান্তি শেষ।”
“তুমি চুপ থাকো একদম।”
পারভীনকে থামিয়ে ইফতেখারকে আবার বলেন, শ্রাবণের সাথে যোগাযোগ করে তাকে বাড়ি নিয়ে আসতে। শ্রাবণের প্রতি মায়ের অনিহাটাও লক্ষ্য করে ইফতেখার। বাবার কথায় কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না করেই চলে যায় চুপচাপ। সে নাহয় ভালোবেসেছে, তাই মন পাজরে শ্রাবণ বিরহ অবিরত চলছে। ঘরে ফিরলেই শূন্যতা ছুঁয়ে যাচ্ছে অনুভূতিতে। কিন্তু যে শ্রাবণ বাবাকে প্রত্যক্ষ অপমান করে গেলো, তার জন্য বাবার এতো দরদ কেন?
অবসর দুপুরটায় একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে এসে শুয়ে পড়েছে ইফতেখার। কপালের উপর হাতের পিঠ রেখে ভাবছে আপনজনদের নিয়েই। শ্রাবণের শূন্যতা ক্ষণে ক্ষণে বেশিই যন্ত্রণা দেয় তাকে। এইযে, বাবা বললো শ্রাবণ আনতে। আর মন যেন এক্ষুণি ছুটতে চাইছে শ্রাবণের কাছে। অথচ আজ কতদিন, ওদিকে যাওয়াই হয় না। শ্রাবণের খোঁজও নেওয়া হয় না, দেখাও পাওয়া হয় না কোনোভাবে! ফোনটা হাতে নিয়ে কন্টাক্ট লিস্টে শ্রাবণের নম্বরটা বের করে। ডায়াল করতে গিয়েও করে না। ব্যথা লাগে। অভিমানের ব্যথা। যে কাছে এসে ফাঁকি দিয়ে দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়, তার প্রতি অভিমান জন্মাবেই না কেন! অভিমানের সেই বুদবুদে আবার বেরিয়ে আসে কন্টাক্ট লিস্ট থেকে। দিবে না কল। ডাকবে না একদম! পরপরই মেসেজ লিস্ট খুলে সিম কোম্পানির অফারগুলো হটাতে। শ্রাবণের ফোন থেকে আসা মেসেজে চোখ আটকে যেতেই মনটা কেমন ধুক করে উঠে! গত রাতেই একটা এসএমএস এসেছে। সচরাচর চেক করা হয়না বলে চোখে পড়েনি। এসএমএসটা খুলতেই যেন তা হৃদয় স্পর্শ করে নেয় আক্ষেপ কাটিয়ে।
“ভুলে গেছেন? জানি, পারেননি। তবে আপনি এতো ভালো না হলেও পারতেন। ভালোর জন্য এই খারাপ মনেও কেমন অদ্ভুত মায়া ধরে যায়। প্রতিটি শ্রাবণমুহুর্ত যেন শুধু আপনার নামেই কেটে যায়।”
কপাল থেকে অন্য হাতটা নেমে আসে ইফতেখারের। চেক করে আরও কোনো এসএমএস আছে কি না। কিন্তু আর পাওয়া হয়ে উঠে না। এই একটাই আছে। লেখাটা আরও কয়েকবার পড়ে ইফতেখার। প্রহরটা হয়ে উঠে শ্রাবণময়। ভাবনাগুলো ভেসে যায় শ্রাবণধারায়। আবারও কি প্রণয় বুনবে সে এই মন পাড়ায়?

চলবে।