শ্রাবণধারা পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0
148

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৮
(নূর নাফিসা)
.
.
“ভুলে গেছেন? জানি, পারেননি। তবে আপনি এতো ভালো না হলেও পারতেন। ভালোর জন্য এই খারাপ মনেও কেমন অদ্ভুত মায়া ধরে যায়। প্রতিটি শ্রাবণমুহুর্ত যেন শুধু আপনার নামেই কেটে যায়।”
কপাল থেকে অন্য হাতটা নেমে আসে ইফতেখারের। চেক করে আরও কোনো এসএমএস আছে কি না। কিন্তু আর পাওয়া হয়ে উঠে না। এই একটাই আছে। লেখাটা আরও কয়েকবার পড়ে ইফতেখার। প্রহরটা হয়ে উঠে শ্রাবণময়। ভাবনাগুলো ভেসে যায় শ্রাবণধারায়। আবারও কি প্রণয় বুনবে সে এই মন পাড়ায়?
উঠে বসে যায় সে। মনটা আনচান করে প্রণয়িনীকে ডাকতে। আবার মনের একপাশ থেকে বাধাও আসে। মিনিট পাঁচেক কেটে যায় আকুপাকু মনের ভাবনাতেই। পরপর কল করেই বসে শ্রাবণের নম্বরে।
অনবরত অবসর দিন যাচ্ছিলো শ্রাবণের৷ মা চরম রাগ হোন, তাই ওই পরিবারের কথাটুকুও গুছিয়ে তুলতে পারে না মায়ের কাছে। তার মায়া গেঁথে আছে সেখানে। সঙ্গে আছে কিছু দুর্বিষহ ব্যথাও। তবুও মায়ায় ফিরতে চায়। মা যা চাইছে, তাতে মনের একদম সায় নেই। সম্পর্কটা সে খুব ভেবে চিন্তেই গড়েছিলো। মায়ের ইচ্ছায় এখন তা ভেঙে দিতে একদমই অনিচ্ছুক শ্রাবণ। মায়ের ক্রোধান্বিত হুকুম মানতে গেলে সবচেয়ে বড় রকমের অন্যায়টা করা হবে ইফতেখারের সাথে। ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচারের প্রেক্ষাপটে এই লোকটা একদমই নির্দোষ। তাই তাকে ঠকানোর সাধ্য শ্রাবণ রাখে না। এদিকে মাকেও বুঝাতে পারে না। কেটে যাওয়া দিনগুলোতে দুয়েকবার যা-ই কথা তুলতে গেলো, শুরুতেই ধমক দিয়ে বিচ্ছেদের হুকুম রেখে দিয়েছেন সুলতানা। মেয়েকে সেই রূপনগরের সীমানায় যেতে দিতেও ইচ্ছুক নয় তিনি৷ জীবনে নতুন মোড় নিতে বলে দেন। আর এই বিষয়টা ভাবতে গেলেই শ্রাবণের হৃদয় ভেঙে কান্না আসে। একটা অন্যায়ের ফয়সালা করতে গিয়ে আরেকটা অন্যায় সে নিজে করে আসতে পারবে না৷ ফিরে যাওয়ার, কথা রাখার অপেক্ষাতেই দিনগুলো পাড়ি দিচ্ছে। কোনো চাকরিও খুঁজছে না, বাইরেও কোথাও বের হচ্ছে না। ছোট্ট একটা রুমেই কেটে যাচ্ছে প্রহরগুলো। সঙ্গী হয়ে পাশেই বসে থাকে বিষণ্ণতা, মলিনতা। গতকালই ফোনটা ঠিক করিয়ে নিয়েছিলো শিশিরকে দিয়ে। রাতেই একটা এসএমএস করে রেখেছিলো ভালো মনের জেদি লোকটার স্মরণে। এ-ও ভাবছিলো, তিনি কল করে খুঁজেছিলেন কি না আরও? কিংবা শহরের পথে এসেই সেদিনের মতো? হয়তো হ্যাঁ, নয়তো না!
এখনো বসে বসে তা-ই ভাবছিলো শ্রাবণ। হাতে নিয়ে বসেছিলো একটা জামা। পাশের ভাড়াটিয়া মায়ের কাছে দিয়েছিলেন তৈরি করে দিতে। হাতের কাজটা শ্রাবণের হাতে তুলে দিয়েছে সুলতানা। জানালার পাশে বসে কাজ শেষ করে আর উঠেনি সে। অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে আছে দূর আকাশে। ভাবনাগুলো পাখির ডানায় ভর করে উড়ছে তার বিশালতায়। এমনি ফোনটা বেজে উঠে। তার মনোযোগ কেড়ে নেয় সাথে সাথেই। হাত বাড়িয়ে খাটের কোণ থেকে ফোনটা তুলে নিতেই বুকের ভেতরটা দুরুদুরু কেঁপে উঠে। ঠোঁটের কোণে জ্বলে উঠে কিঞ্চিৎ হাসি। চোখটাও ভিজে উঠতে চায়। ভারি নিশ্বাসে তা ঠেকিয়ে দেয় শ্রাবণ। পরপরই কল রিসিভ করে সালাম দেয়। ওপাশ থেকে মলিন, শুষ্ক কণ্ঠে ভেসে আসে ইফতেখারের জবাব।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
হৃদয়ে তোলপাড় রেখেও স্বাভাবিক মুখে হাসি স্পষ্ট রেখে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“মেসেজ দেখে কল দিলেন?”
প্রশ্নের জবাব দেয় না ইফতেখার। শ্রাবণ কিঞ্চিৎ অপেক্ষায় থেকে আবার বলে,
“গতকালই ফোনটা ঠিক করালাম। ভাবলাম, আরেকটু জ্বালাতন করি।”
ইফতেখার শুষ্ক, শান্ত স্বরেই প্রশ্ন ছুঁড়ে;
“কী ভুল করেছিলাম আমি, শ্রাবণ? কী দোষের শাস্তি আমার ঘাড়ে চেপেছে, বলবে একটু?”
মুখের হাসিটা নিমেষেই অস্পষ্ট হয়ে যায় শ্রাবণের। ইফতেখারকে যে একটা ধোকাতুল্য চাপে রেখে এসেছে, তা শুধু নিজের ভাবনা নয়। বাস্তব হয়ে ঠেকলো এই জিজ্ঞাসার পর। মুখে ধরে রাখতে চাওয়া হাসিটা আর ধরে রাখতে পারলো না তাই। এই লোকট তাকে চরম ভালোবাসে, যার প্রকৃত উপলব্ধি করতে পারে সে। তাই মুখটাও শুকিয়ে আসে যেন৷ ইফতেখার জবাবের আশায় থেকে জবাব পায় না। তাই আবারও জানতে চায়,
“বলো? অন্যায়টা আমায় চিহ্নিত করাও। আমি খুঁজে পাই না হাজারবার চেষ্টা করেও।”
মনটা ব্যথিত হয়ে পড়লেও গলাটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় থেকে শ্রাবণ প্রত্যুত্তর করে,
“ক্ষমা করবেন। না শুরুতে আর না আজ। আপনার প্রতি কখনোই কোনো ক্ষোভ, বিদ্বেষ পরায়ণতা আমার ছিলো না।”
“ওহ্! তবে কী দেখাতে চাইলে আমায়? ভুল? তোমাকে যাচাই না করে আপন করাটা ভুল ছিলো আমার? এটাই প্রদর্শন করতে চাইলে?”
হৃদয়টা ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। তবুও নিরুত্তর শ্রাবণ। চোখদুটো টইটম্বুর হয়ে গেছে, তবুও অশ্রু গড়াতে না দেওয়ার বৃথা চেষ্টা। আবেগ আটকে রাখার দারুণ প্রচেষ্টায় ভেতর থেকে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ যা স্পষ্ট করে তুলে উত্তরের প্রত্যাশায় থাকা ইফতেখারের কানেও। শ্রাবণ খুব বেশি সময় নেয় না। উত্তরে বলে,
“এমন কিছু চাইনি। সম্পর্কে আপনার কোনো দোষ কিংবা ভুল কোনোটাই প্রদর্শন করার সাধ্য আমার কখনোই না হোক।”
“এখন তবে কী সাধন হলো? অকারণে যে কারো দূরত্ব বেড়ে উঠে, তা তো জানতাম না আগে।”
এর বিপরীতে বলার মতো কিছুই নেই শ্রাবণের। দূরত্ব বাড়িয়ে তো বসে থাকতে চায়নি সে। পরিস্থিতি তাকে আটকে দিয়েছে দূরত্ব কাটিয়ে উঠতে। একটা বলতে গেলে আরেকটার প্রকাশ ঘটিয়ে ঘটনার ঘনঘটা করার ইচ্ছেও তার একদম নেই। আর মায়ের কথা প্রকাশ করে মায়ের বিরুদ্ধে তুলবে অভিযোগ? কখনোই না। এপাশ থেকে কোনো কথা ফুটছে না তাই বিরক্ত হয় মন। সেই সাথে হতাশার নিশ্বাসও নির্গত হয় ইফতেখারের। যা শ্রাবণের কান পর্যন্ত স্পষ্ট। পরপরই নিস্তেজ গলায় ইফতেখার পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
“আসবে না আর?”
জবাব মুখে আসতে চায় না যেন শ্রাবণের। ভেজা নির্লিপ্ত চোখদুটো নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে আকাশে। তবে অপেক্ষায় রাখে না ইফতেখারকে৷ হালকা ভেজা গলাতেই একটা উত্তর দেয়,
“আমার একটু সময়ের প্রয়োজন।”
এই উত্তরে যেন বিরক্তির রেশ আরও বেড়ে আসে ইফতেখারের। ফোনকলের লাইনটাই কেটে দেয়। কর্ণধারে তা উপলব্ধ হতেই চোখদুটো বন্ধ করে নিয়েছে শ্রাবণ। হাতের জামা ও ফোন কোলে রেখে হেলান দিয়ে আয়েশে চোখ বুজে থাকে চেয়ারে। কারো সাথে কথা বলতে শুনেই রুমের দরজায় দাঁড়িয়েছিলো সুলতানা। চেয়ারে হেলে থাকা মেয়ের ভেজা গাল দুটোও চোখ এড়ায়নি মায়ের৷ না শুনতে পেলেও আন্দাজ করতে পারেন তিনি। জিজ্ঞেস করেন,
“এতোক্ষণ লাগে এইটুকু সেলাই করতে?”
হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে দ্রুত চোখ মুছে নেয় শ্রাবণ। দৃঢ় নিশ্বাস ফেলে চেয়ার ছাড়তে ছাড়তে বলে,
“হ্যাঁ, হয়ে গেছে আরও আগেই।
ফোন রেখে জামাটা মায়ের কাছে দিতে এগিয়ে যায় সে।
“এই নাও, তোমার জামা। আর সুঁই।”
হাতে তুলে দিয়েও মায়ের হাত দুটো ধরে নেয় শ্রাবণ। অসহায়ত্ব চোখদুটো মায়ের চোখে ধাবিত করে আহ্লাদ জড়ানো গলায় বলে,
“একটা মানুষের উপর ক্ষোভ রেখে আরেকটা মানুষের প্রতি অন্যায় করা কি সাজে, মা?”
কাদের প্রসঙ্গে কথা উঠেছে, বুঝতে সময় লাগেনি সুলতানার৷ কপালের ভাজে তাই বিরক্তি ভেসে উঠেছে সাথে সাথেই। শ্রাবণ মাকে কিছু বলতে সুযোগ না দিয়ে পুনরায় বুঝাতে সুযোগটা নিয়ে নেয়,
“একটা ব্যাপারে মজে থাকলে তো জীবনের গতি ঠিক রাখা যায় না, বলো? তুমি যেই হুকুমটা আমার উপর আরোপ করেছো, তা যে কতটা কঠিন; সেটা আমার চেয়ে তুমিই ভালো জানো। এতো সহজে সাধের সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া যায়? কেমন একটা কঠিন পরিস্থিতিতে রেখে দিয়েছো আমায়, তুমিই বলো। চেয়ারম্যান পরিবারের সাথে তো তোমার তুলনা বসাতে চাই না কখনো। লক্ষ্য করে দেখো, তুমি কিন্তু বাবার বিপক্ষেই দাঁড়িয়ে গেছো। একদিকে বাবা, আর একদিকে মা যদি দাঁড়িয়ে থাকে; এমন একটা পরিস্থিতি আমার জন্য কতটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় নিশ্চয়ই অজানা নয় তোমার। আমার মা তো আমাদের কখনো কঠিন পথে ছেড়ে দেয়নি। বরং জীবনে কঠিন হয়ে দাঁড়ানো পথগুলোকে সহজ করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।”
শ্রাবণের চোখ টইটম্বুর হয়ে আসে আবারও। সুলতানা সেই চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে,
“তোর বাবা তো কখনো বলেনি তার ছেলেকেই বিয়েটা করতে! কেন গেলি তবে তুই?”
“আবারও তোমার একই কথা৷ বাবা আমায় বাধ্য করেনি ঠিক৷ হয়তো ভেবেছেন, আমাদের পছন্দে-অপছন্দে চাপ পড়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা মূলত কেন জানিয়েছে, তা কি তুমি বুঝতে পারো না? তিনি চেয়েছেন বলেই পুরনো কথাগুলো আমাদের জানিয়েছেন। তিনি যদি না চাইতেন বিয়ে হোক, তবে কখনো আমাদের জানতেই দিতেন না সেসব। বরং ব্যথা আড়াল করে রাখা বাবার অভ্যাস ছিলো। তো বাবার রেখে যাওয়া কথা আমি, আমরা কীভাবে ফেলতে পারি?”
চোয়াল শক্ত রেখে মুখ ফিরিয়ে রাখেন সুলতানা। তাদের নিয়ে ভাবতেই পারেন না, মেজাজ খারাপ হয়ে আসে। মায়ের হাত আরও শক্ত চাপে ধরে শ্রাবণের আকুতি,
“মা, তুমি আমাকে নিজ পছন্দে সংসার করার স্বাধীনতা দিয়েছো না? আমার তাকে পছন্দ হয়েছে, মা। স্বামী হিসেবে সে পারফেক্ট। আমার কঠিন পথে একটু সহজ হও। তুমি সম্মতি না দিলে কীভাবে অগ্রসর হবো?”
“যাওয়ার আগে আমার সম্মতি নিয়ে গিয়েছিলি?”
“ওইযে, স্বাধীনতা দিয়েছো। তা থেকে সাহসের সঞ্চয় করেছি।”
“তোর বাবা কেন তোদের জানিয়েছে, তা তুই বেশ বুঝতে পারলি৷ তোর বাবা যে কেন হুকুম দিয়ে যাননি, তা কি তোর বুঝে এলো না একটু? তার কথা রক্ষা করা তোর জন্য আবশ্যক ছিলো না। একটা কথার উপর ভিত্তি করে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন চলতে পারে না। এইজন্য তিনি হুকুমটাও করে যাননি। এইটুকু বুঝার সুবুদ্ধি কী তোর হয়নি এখন পর্যন্ত?”
“আমি বাবার কথা রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই সেখানে গিয়েছি ঠিক। কিন্তু প্রকৃত অর্থে যার হাতটা ধরেছি, সেই ব্যক্তিটা পছন্দের মানুষ। শুধু বাবার কথা রক্ষার মোহেই না, আমি লোকটার মায়ায় পড়েছি ততদিনে। তাই ফিরতে চাইছি বেশ করে। তুমি তার কথা ভেবেই একটু পজিটিভ নাও ব্যাপারটা। তোমার মেয়ে ভালো থাকবে ওই লোকটার কাছে।”
“প্রতারককে দেওয়া কথা রক্ষা করা মানুষের কর্তব্য না। তুই গিয়েই ভুল করেছিস।”
“ভুলটাকে ফুলে পরিণত করতে দাও, প্লিজ।”
“আমি জানি না কিছু। হাত ছাড়।”
ব্যথার প্রখরতায় মায়ের মুখটাও কেমন বিষন্ন হয়ে আসে। তাই হাত ছাড়িয়ে নিতে চান বিরক্তিতে। যতই বিরক্তি আসুক, মেয়ে তো এই চেহারার বিষণ্ণতার পাতাটাও পড়তে জানে। তাই প্রচেষ্টা চলমান রাখে। হাত ছাড়লেও জড়িয়ে ধরে মাকে। তাদের নিয়তির দশাকে স্মরণে রাখতে চাইলেই হৃদয় ভেঙে কান্না আসে। শ্রাবণ ঠোঁট কামড়ে সেই কান্না চাপা দিয়ে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে থাকে। পরক্ষণে ভেজা গলায় বলে,
“তুমি না জানলে কে জানবে আর? কেউ আছে আমার? বাবা ছায়া হিসেবে একমাত্র তোমাকেই তো রেখে গেছে আমার কাছে। তোমাকে জানতে হবে, মা। বাবা তো জানার জন্য নেই এখন।”
চাপা কান্না এবার স্পষ্ট হয়ে আসে বাবাকে হারানোর ব্যথায়। মাকে জড়িয়ে কথা বলেই কেঁদে উঠে শ্রাবণ। মায়ের চোখেও সিক্ততা নামে। এযাবৎ করে আসা সংগ্রাম ও পরিনতি এই সিক্ততার কারণ। অন্য কারণ, স্বজন প্রীতি। মেয়ে দুইটা ছাড়া তারও তো কিছুই নেই আর। তাদের কান্নাও মনে সয় না।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৫৯
(নূর নাফিসা)
.
.
অফিসের ছুটির দিন। যাওয়ার কথা ছিলো শুধুমাত্র টিউশনিতে। তারপরও দেরিতে ঘরে ফিরেছে শিশির। শ্রাবণ দরজা খুলেই বলে,
“ফোন দিচ্ছিলাম। পাওয়া যাচ্ছিলো না কেন?”
জুতা খুলে একপাশে রেখে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নিতে নিতে নিশ্বাসে ক্লান্তি ছাড়ে শিশির।
“মায়ের সাথে কথা হয়েছিলো তো।”
“তার পরেই দিয়েছি আবার। দেরি হচ্ছে বলে।”
“ওই একটু ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম। থানায় যেতে হয়েছে।”
“থানায়! থানায় কেন?”
বিস্মিত হয় শ্রাবণ। শিশির ব্যাগটা রেখে পানির বোতল হাতে নিয়ে বসে টেবিলের কোণে। কিছুটা হেঁটেই গলা শুকিয়ে গেছে। বোতলের ক্যাপ খুলতে খুলতে সে বলে,
“ছিনতাই হতে যাচ্ছিলো ব্যাগটা। আল্লাহর রহমতে রিকশাওয়ালা মামার সহায়তায় আমিসহ বেঁচে গেছি।”
বারান্দায় কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো সুলতানা। মেয়ের কথা শুনে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন রুমে। শিশির দুই ঢোক পানি পান করে ঘটনার বিস্তারিত বললো।
“চলতি রিকশায় ব্যাগ টান দিয়ে দৌড় দিতে চেয়েছিলো ছিনতাইকারী। ব্যাগটা আমি ঠিকঠাকই ধরে রেখেছিলাম। তাই হুট করেই নিয়ে যেতে পারেনি। হাতে আটকে ছিলো। সাথে সাথে রিকশাওয়ালাও এক হাতে রিকশা কন্ট্রোলে রেখে অন্য হাতে ছিনতাইকারীর হাত ধরে ফেলেছে। নয়তো টানেই আমি পড়ে যেতাম রিকশা থেকে। আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি। উল্টো ছিনতাইকারীর হাতই ধরে ফেলেছি আমি এবং রিকশাওয়ালা মামা। সাথে সাথেই তিনি নেমে কলার পাঁকড়ে চড় কষালেন দু-তিনটা। আমিও ছাড়লাম না। ট্রাফিক পুলিশ ডাকলাম। আইনের কাছে অর্পণ করতে থানায় যেতে হলো। তাই একটু দেরি।”
সুলতানা পরপরই জিজ্ঞেস করেন,
“ব্যথা পাসনি তো?”
“উহুম। ঠিক আছি। আমার কিছু হয়নি।”
“কী অদ্ভুত! উচিত হয়েছে। এসব লোকদের ঝুলিয়ে বেঁধে ডান্ডাপেটা করা দরকার।”
দুই মেয়েই ঠোঁটের কোণ ঠেসে হেসে নিজেদের কাজে অগ্রসর হয়। শিশির চেঞ্জ হতে পোশাক হাতে নিতে নিতে বলে,
“এ যুগেরও কী অবস্থা, দেখো মা। বয়স কিন্তু একেবারে অল্প। এসময় কোথায় কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কথা। তা না করে চুরি ছিনতাইয়ে নেমে জীবন নষ্ট করছে। অন্যের ক্ষতি করায় যে নিজের সর্বনাশ স্থির, এটা একবার ভাবে না।”
সুলতানা পুনরায় বারান্দায় যেতে যেতে বলে,
“যুগ পাল্টালেই কী মানুষ পাল্টায়? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হার বাড়তে থাকলেও ব্যক্তিক শিক্ষা বাড়ে না। স্কুল কলেজ পাশ করা ব্যক্তিগুলোও চুরি ছিনতাইয়ে কম যায় না। রাস্তার ছেলেরা চুরি-ছিনতাই করে সামনে থেকে, টেনে হিঁচড়ে। সনদ প্রাপ্ত লোকগুলো করে শান্তভাবে, কাগজে কলমে। অনৈতিকতা কোথাওই কম না।”
শ্রাবণ মায়ের কথা শুনে মুচকি হাসে। কথায় গল্প মিলায় জীবনে পরিচিত হওয়া লোকগুলোর সাথে। ক’জন আর সৎ হিসেবে নজর কেড়ে নিতে পারে?
পরবর্তী দিন সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ আগে হঠাৎ ফোন আসে থানা থেকে। শিশিরকে ডাকায় গতকালের মামলা নিয়ে। এইমাত্র সে বাড়ি এলো দৈনন্দিন ব্যস্ততা কাটিয়ে। একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় হলো না। অসময়ে থানায় যেতে বিরক্ত হয় শিশির। তখনই তো কাজ শেষ করে এলো। এখন কেন আবার ডাকাবে তাকে! তবুও যেতে প্রস্তুত হয়। আইন ডেকেছে, কী আর করার! কিন্তু দুশ্চিন্তা চাপে মা বোনের মনে। থানায় কেন ডাকে আবার! এই অসময়ে যেতে দিবে না তাকে। শিশির মাকে বুঝায়,
“না গেলে তো আমি অপরাধী হবো তাদের চোখে। দুশ্চিন্তা করো না। গিয়ে দেখি, কেন ডেকেছে।”
শ্রাবণও চিন্তিত গলায় তাকে আটকে দেয়।
“দাঁড়া। আমিও যাবো সাথে।”
“যাবে? তো চলো দুজনেই যাই।”
দুজন হওয়ায় সুলতানা এবার ছেড়েছে তাদের। কিন্তু দুশ্চিন্তা ছাড়েনি তাকে। না ফেরা পর্যন্ত ছাড়বেও না। জ্যাম বিহীন রাস্তায় কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্রাবণ, শিশির থানায় পৌঁছে যায়। শিশির স্বাভাবিক জিজ্ঞাসায় গেলেও শ্রাবণ উপস্থিত ব্যক্তিদের দেখেই আটকে যায়! পরিচিত মুখগুলো এখানে কেন! তারাও শ্রাবণকে দেখে বিস্মিত। শিশিরকে ডাকা হয়েছে এই কারণে যে, ছিনতাইকারী ছেলেটার অভিভাবক এসেছে খবর পেয়ে। এখন ক্ষমা চেয়ে ছেলেকে তারা মুক্ত করতে চায়। মামলাকারী পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়। অনেক্ক্ষণ যাবত ঘুরছিলো একটু সুযোগের জন্য। ছেলে সম্পর্কে এই ব্যাপার তাদের কাছে অবিশ্বাস্য। আর তাই শিশিরকে ডাকা হয় তার যোগাযোগ নম্বর উক্ত মামলায় সংরক্ষিত থাকায়। শ্রাবণ বিস্মিত চোখেই এগিয়ে এসে সালাম দেয় তাদের। বিধ্বস্ত মনগুলো সালামের জবাবটুকুও যেন ঠিকঠাক দিতে পারছে না। ব্যথায় কাতর শিরিন মিনমিনে গলায় সালামের জবাব দেয়। পাশেই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে সাত্তার। শ্রাবণ শিরিনের উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনারা এখানে?”
শিরিন নিম্নস্বরে কান্নাজড়িত গলায় বলে,
“পোলার নামে কে জানি মামলা ঢুকায় দিছে। আমার পোলা এমন না। এমন না।”
শ্রাবণের সন্দেহ হয়, শিশিরের মামলাটাই তাদের বিপরীতে কি না। পরপর কথা বলেই জানা গেলো সাত্তারের ছেলে কাইয়ুম ছিলো সেই ছিনতাইকারী, যাকে আইনের হাতে তুলে দিয়েছে শিশির। ছেলেটাকে আজ প্রথমবারের মতোই দেখলো শ্রাবণও। তবে জানতো, কান্তার একটা ভাই আছে। বয়স অল্পই। বিপুর সমান কিংবা একটু ছোট হতে পারে। বেশভূষায়ও খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। শিশির তো আর এমনি এমনি তার নামে মামলা ঠুকেনি। পুলিশের সাথে কথা বলতেই তিনি জানিয়েছেন শিশির মামলা তুলে নিলে সে ছাড়া পাবে। এদিকে শিশিরের হাত ধরে মিনতি শুরু করেছে শিরিন।
“মা, মাগো। তুমি আমার মাইয়ার মতো। পোলাটারে ছাড়ায় দাও৷ আমার পোলায় ছিনতাইকারী না। বিশ্বাস যাও।”
মায়েদের কান্না মনে লাগে শিশিরেরও৷ তবুও তার হাতের উপর হাত রেখে বলে,
“আমি তো মিথ্যা মামলা দেইনি, আন্টি। আপনি নিজেই জিজ্ঞেস করুন, আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে চেয়েছিলো চলন্ত রিকশা থেকে। ব্যাগের টানে তো আমি নিজেও পড়ে আরেকটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হতে পারতাম৷ এরপর যদি আমার মা এসে আপনাদের কাছে কান্না করতো, আমার জীবনটা কি ফিরিয়ে দিতে পারতেন তখন?”
জবাব নেই শিরিনের৷ তার কেবল ছেলেকে ছাড়া পাওয়া চাই৷ আর তাই তৎক্ষনাৎ শ্রাবণের হাত ধরে আবার আকুতি করে,
“চাচী না ডাকছো? এট্টু দয়া করো, মা। মামলা টা তুইলা দিতে কও। একটামাত্র পোলাই আমার। সারাজীবন ভয় পাইছি কেস-কাসারি নিয়া। হেই ভয়েই আমারে ধরছে। আমি তো পোলারে আয় রোজগারের জন্য শহরে পাঠাইছি। মামলা খাওয়ার জন্য না।”
আরও কত আকুতি! বাবা মা সুদূর হতে বুনে স্বপ্ন, সন্তান করে সেই বুনা স্বপ্নের অপদস্ত! ভেবেই ভারি নিশ্বাস নির্গত হয় শ্রাবণের ভেতর থেকে। সাত্তার কিছুই বলে না। জীবন যুদ্ধে ব্যর্থ, মর্মাহতভাবে দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপ। ছেলে কিংবা মেয়ে, কারো দিক থেকেই সুখী নয় সে। সুখ হীনতার ছাপ মুখভাবেই স্পষ্ট। সেই সাথে দারিদ্রতা তো আছেই! ক্ষণে ক্ষণে তাদের দুই বোনের দিকেই তাকায় তারা সহায়তা করে কি না দেখতে। মুখ ফুটিয়ে বলে না কিছুই। শ্রাবণ শিশিরকে ইশারা করে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। শিশির মামলা তুলে নিতে এগিয়ে যায় ব্যবস্থাপকের কাছে। ক্ষিপ্ত চোখে একবার তাকায় কাইয়ুমের দিকে। মাথা নত করে অপরাধী বেশেই দাঁড়িয়ে আছে। ডায়েরিতে সাক্ষর করতে করতে মনে মনে ফুসে সে,
“মা এসে হাত ধরে কান্নাকাটি করলেই কী! এর তো চেহারাতেই ফুটে চোরাভাব! দরদে মামলা উঠানো কেন? থাপড়ে কান লাল করে ফেলা উচিত এদের।”
অপদার্থ ছেলে নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন পিতা মাতা চলেছে গ্রামের উদ্দেশ্যে। দুই বোন ফিরছে নিজেদের মায়ের কাছে। তবে বাড়ির কাছে এসেও বাড়ি প্রবেশ করেনি। একটু আগেই নেমে গেছে রিকশা থেকে। ভেলপুরি খাবে বললো শিশির। শ্রাবণও অমত করলো না। খেতে খেতেই শিশির জিজ্ঞেস করে,
“তাদেরকে তুমি চেনো, আপ্পি?”
“হুম।”
“বাসা কোথায়?”
“শ্বশুর বাড়ির লোক।”
জবাব দিয়ে মুচকি হাসে শ্রাবণ। শিশিরও হাসে বোনের হাসিতে। মুখের খাবার শেষ করে শ্রাবণ বলে,
“ফাতিহা আম্মাকে তো চিনিস৷ আম্মার ভাই ভাবি উনারা।”
“ও… আচ্ছা! আম্মা তো বেশ ভালো মানুষ ছিলেন। ছেলেটা তো চোর!”
“সব মানুষ কি আর এক হয়! তার বাবামাও যথেষ্ট ভালো বলেই জানি। দূরে থেকে স্বভাবে দোষ জড়িয়ে ফেলেছে সম্ভবত। কাজের জন্য শহরে থাকতো।”
“চুরি ছিনতাই-ই তার কাজ? জানো, এর উপর এমন রাগ উঠেছিলো গতকাল। পুলিশ না পেলে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিতাম একটা হলেও।”
“চড় দিলেই দাঁত পরে যায়?”
নিচু স্বরে খিলখিলিয়ে হেসে শিশির জবাব দেয়,
“চেষ্টা তো করতাম অন্তত।”
“থাক। সংঘর্ষে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ওসব এড়িয়ে চলাই ভালো।”
“টক টা বেশ মজাই লাগছে। ভাইয়ার সাথে তোমার কখনো বেড়াতে যাওয়া হয়নি? কিংবা কোনো স্ট্রিট ফুড তোমাদের টানেনি?”
“হুম। কয়েকবার।”
“তাই! কোথায় কোথায় গেলে?”
“দূরে কোথাও না। গ্রামেই। গ্রামের সরু রাস্তায় কখনো মোটরসাইকেলে চড়া, কখনো নদীর তীরে বালুর মাঠে হাঁটাচলা, কখনো শাপলা বিলে নৌকায় চড়া।”
“আহ! কী প্রেমময় মুহুর্ত!”
বড় বোনের সাথে মজা করে হেসে উঠে শিশির নিজেই। পরক্ষণে আগ্রহের সাথে বলে,
“শাপলা তুলেছো?”
“প্রথমবার উনাকে ছাড়া গিয়েছিলাম দেবর ননদের সাথে। তখন খুব তুলেছি। নৌকাটা পুরো ভরে ফেলেছে তারা শাপলা তুলে।”
“ইশ! কী আনন্দ! সবসময়ই শাপলা পাওয়া যায় ওদিকে?”
“কেন, তুই যাবি?”
“তোমারই যাওয়া হচ্ছে না, আমি কার কাছে যাবো! তুমি থাকতে, তোমার কাছে ছুটে যেতাম। ঘুরে আসতাম।”
“হুম। সবসময় শাপলা পাওয়াও যায় না। বর্ষার পানিতে বেড়ে উঠে বিল ভরে যায়।”
“বুঝলাম। আচ্ছা, ভাইয়া দেখি তোমার সাথে কোনো যোগাযোগই করলো না আর? অথচ সেদিন দেখলাম কেমন পাগলের মতো খুঁজছিলো! উনিও কি ফ্যামিলির চাপে আছেন? নাকি রেগে?”
ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে শ্রাবণ তার জবাব দেয়,
“আমি চাপে। আর তিনি অভিমানে। তবে কথা হয়েছে গতকাল।”
আনন্দ প্রকাশে একটু বিস্মিত হয়ে উঠে শিশির।
“সিরিয়াসলি! এসেছিলো?”
“না। ফোনকলে।”
“ওহ্।”
“যাওয়ার কথা বলেনি কিছু?”
“বলেছে।”
“আরে, মায়ের কাছে আরেকটু ঘুটুরমুটুর করে দেখো। ভাইয়াকেও নাহয় সামনে হাজির করো। দেখলেই মন গলতে পারে। মেনে যাবে।”
হতাশার নিশ্বাস ফেলে শ্রাবণ।
“ভাইয়াকে আনবো সামনে? ভাইয়াও রেগে আছে আমি চলে আসাতে৷ মা-ও ভীষণ চড়া তাদের বিপরীতে। অপমানজনক পরিবেশের সৃষ্টি করতে আমি চাইছি না আপাতত। তবে যেতে দেওয়ার জন্য মা মেনেছে। ইনশাআল্লাহ, কাল পরশুই যাচ্ছি।”
এবার হতাশায় মলিন হয়ে আসে শিশিরের মুখটাই।
“তাই! মেনে গেছে? তুমি চলে গেলে আবারও আমি একা হয়ে যাবো!”
মুচকি হেসে নিজের হাতের ভেলপুরি শিশিরের মুখে তুলে দিয়ে শ্রাবণ বলে,
“মা আছে তো সাথে। তাছাড়া, আমরা দূরে থেকেও কাছাকাছিই থাকি। পথের দূরত্বকে দূরে ভাবতে নেই।”
মুচকি হাসে শিশিরও। ফোনটা বেজে উঠে শ্রাবণের৷ মা কল করেছে। রিসিভ করতেই সুলতানা বলেন,
“কি রে, কোথায় তোরা? সেই কখন বললি ফিরছিস!”
“আছি বাসার কাছেই। তোমার মেয়ে ভেলপুরি খেতে নেমে গেছে। তুমি কোনটা খাবে? ভেলপুরি না ফুচকা?”
“আমি কিছু খাবো না। জলদি খেয়ে বাসায় আয়।”
“আরে বলো একটা।”
“কিছু আনতে হবে না।”
“আচ্ছা, তবে ভেলপুরি নিয়ে আসি।”
টুট করেই কলটা কেটে দিলো সুলতানা। মা যে তাদের এমনসব জেদে বিরক্ত হোন, তা তাদের বেশ ভালো লাগে। কোনো জিনিসে মন পড়লে নিষেধ করলেও মায়ের জন্য নিবেই। নেওয়ার পর একটু বকাঝকা করে হলেও তা গ্রহণ করেন। কেননা, ভালোবাসা ফেলতে নেই।

দিন দুই বাদ,
স্কুল থেকে ফেরার পথে ভাবলো, কান্তার সাথে দেখা করে যাবে। বিয়ের পর এ পর্যন্ত দুইবার গিয়েছিলো দেখা করতে, স্বল্প সময়ের জন্য। শিরিন যা-ই কথাবার্তা কিংবা টুকটাক আপ্যায়নে এগিয়ে আসে। সাত্তারকে সালাম দিলেও যেন মুখ ফুটে কথা আসে না। তবে সম্পর্কের দিকটা কিছুটা যখন এগিয়েছে, বাকিটাও এগোতে থাকবে বলে বিশ্বাস বিপুর। আপ্যায়ন হলো কি না হলো, তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সাধের কান্তা পেয়েছে, এ-ই ঢের৷ যদিও এক বিন্দুও পাওয়া হয়নি তার পরিবারের দিক থেকে! এখনো ভয়ে ভয়েই থাকে বাবার সম্মুখ হতে দূরে। কান্তার বাড়িতে আসতেও একটু সংশয় অনুভূত হয়। আগে হতো, প্রণয় লুকোচুরির সংশয়। এখন হয় আকস্মিক বিয়ের গীত গেয়ে এবাড়ির জামাই হয়ে উঠে। তবুও, মনে চাইলেই দেখা করতে পারে; এ-ই প্রাণের শান্তি। দেখা করবে যখন কিছু ছোলা কিনে নিয়েছে দোকান থেকে। যখন শ্বশুর শ্বাশুড়ি দাওয়াত করে নিবে, তখন নাহয় মিষ্টি নেওয়া যাবে। তাই আপাতত তেমন কিছু নিলো না, যা লোকের নজর কাড়ে। বউয়ের জন্য পকেটে গুজেই ছোলা নেওয়া যাবে। পরপরই মালাই আইসক্রিম দেখে মনে হলো, একটা আইসক্রিমই নেওয়া যাক। এই গরমে ভালো উপভোগ করবে। পকেটে ছোলা, হাতে আইসক্রিম নিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই তার প্রত্যাশার পানপাত্রে ঘোলা জল! আব্বাজান মাতব্বরের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কান্তাদের বাড়ির কাছাকাছি। যোহরের নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার সময় উনার। এই মাতব্বর কাকা বুঝি আটকে দিয়েছে পথে জরুরী ডাকে। এবার তার দেখা সাক্ষাৎ কী করে হবে! আব্বার সামনে দিয়ে যাবে কান্তাদের বাড়ি? অসম্ভব! চিন্তামগ্ন থেকে দু-তিন পা এগিয়ে ভাবলো ফিরে যাওয়া যাক বাজারের দিকে। আরেকটু পরে নাহয় আসা যাবে আব্বাজান এদিক থেকে চলে গেলে। কিন্তু তাতেও সফল হলো না। কথার মাঝে ব্যস্ত থেকেই এদিকে তাকিয়ে তাকে দেখে ফেলেছেন আফজাল হোসেন। এখন যদি ফিরে যেতে দেখেন, চোর তো ধরা পরবেই। তাই আর যাওয়া হলো না। এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকেই। বাবাকে অতিক্রম করে যেতেই এদিকে আফজাল হোসেনের কথাও শেষ হয়ে এসেছে। বিপু একটু আগে, তিনি পেছনে। দু-চার কদম ফেলেই বিপুকে পিছু ডাকেন হাঁটতে হাঁটতে। বিপু ডাকের সাড়া দিতে একটু থেমে সমপথিক হয় বাবার। আফজাল হোসেন তার সাথে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করেন,
“সকালে যাওয়ার সময় গরুর ভুষির কথা বলছিলি মাহফুজরে?”
“বলছিলাম তো, দুই বস্তা দিতে। পাঠায় নাই?”
“দেখলাম না তো। টাকা দিছোস?”
“হুম। বিশ টাকা করে আরও বেশি রাখলো। দাম নাকি বাড়ছে।”
“পাঠাইছে হয়তো তবে। জিগাই নাই বকুল রে।”
“আচ্ছা, জিজ্ঞেস করবো নে আমি।”
“হাতে আইসক্রিম গলাইতাছোস ক্যা?”
হাতের আইসক্রিমে তাকিয়ে একটু ইতস্তত হয়ে যায় বিপু। পরক্ষণে জবাব দেয়,
“অর্পার জন্য নিলাম। তাপে গলে যাচ্ছে।”
“অর্পা স্কুলে না?”
“হু। ফ্রিজে রেখে দিলেই বাড়ি ফিরে খাবে।”
এদিকে বাড়ি প্রবেশ করতেই ঝাড়ু হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরী। দিন দুই আগে এই ঘরের আসবাব অধিকাংশ নড়চড় হয়েছে নতুন ঘরে। তাই পুরাতন ঘরের ঝাড়ামোছার কাজটা করে নিচ্ছে সে সারাদিন ব্যাপী। কাজ করে হাঁপিয়ে হাওয়া খাচ্ছিলো বারান্দায় হেলে দাঁড়িয়ে। মুখে পুরে চিবাচ্ছে ভাজা তেঁতুল বীজ। বিপুর হাতে আইসক্রিম দেখেই ঝাড়ু হাতে ছুটে দালানের দিকে।
“ওই ভাইজান, খাড়ান। খাড়ান।”
তার পিছু চেঁচানোতে বাবা ছেলে দুজনেই ফিরে তাকিয়েছে। আফজাল হোসেন ঘরে এগিয়ে গেলেও বিপু থেমে গেছে ঝাড়ুদারের কথা শুনতে। পরী এসেই ক্লান্ত মুখখানায় সুস্পষ্ট টানা দিয়ে হাসি এলিয়ে বলে,
“কাজ করতে করতে গলাটা শুকাইয়া গেছে। মাথা দিয়া ধোয়া বাইর হইতাছে এক্কেবারে। আইসক্রীমটা দিয়া যান। খাইয়া ঠান্ডা হই।”
বিপু হাতের আইসক্রিমে তাকিয়ে হতাশার নিশ্বাস ফেলে তা দিয়ে দেয় তার হাতে। এরপর হাত খালি রেখে প্রবেশ করে দালানে। আইসক্রিম পেয়ে খুশি হয়ে পুরাতন ঘরে ফিরে পরী। মাঝখানে রোদে পুড়তে থাকে বিপুর উদ্দেশ্য এবং হতাশাটুকু। কিনলো একজনের জন্য, নাম প্রকাশ করলো আরেকজনের। অবশেষে খেয়ে নিলো অন্যজন! রিজিক কোত্থেকে ঘুরে আসে কার তরে! বউয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ হারিয়ে বিপু নিজ ঘরে এসে ছোলা পুরে মুখে।

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৬০
(নূর নাফিসা)
.
.
বিকেলেই শ্রাবণের ছায়া পড়ে চেয়ারম্যান বাড়ির আঙিনায়। বাড়িতে প্রবেশের আগেই মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে ছিলো পারিবারিক কবরস্থানের সামনে। দোয়া করলো কবরবাসীর জন্য, স্মরণ করলো তীক্ষ্ণ অতীতকে৷ চোখ দুটো সিক্ত হয়ে আসে অতীতের আঘাত বর্তমানের বুকে এসে৷ সেসব নিয়ে বেশি গভীরে ভাবতে গেলে বদদোয়া উঠে আসতে চায় মনের গহীন থেকে। কিন্তু কবরবাসীর প্রতি বদদোয়ার উত্তোলন সে হতে দিবে না। তাই স্বল্প সময়ই অবস্থান করে প্রবেশ করে বাড়ির দ্বারে। সারাদিন কাজকর্মে ব্যস্ত থেকে এই পড়ন্ত বিকেলে গোসল সেরে বেরিয়েছে পরী। উঠুনেই মেলে দিচ্ছে কাপড়চোপড়। এসময় হঠাৎ শ্রাবণের আগমণে যেন তব্দা খেয়ে গেছে। তার ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হেসে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো, পরী?”
“ভাবি! আপনারে দেখার পর আমি নিজেই বুঝতাছি না, কেমন যে আছি!”
“পাগলী মেয়ে। এসময় গোসল কেন?”
“ঘরের মালামাল নড়চড় হইলো যে, কাজ করতে করতে দিন পাড় হইয়া গেছে।”
“ও আচ্ছা৷ সবাই ওঘরে উঠে গেছে?”
“জ্বি, হ্যাঁ।”
“বড় ভাইজানের রুম কোনটা?”
“সোজা উঠলেই ডানে চেয়ারম্যান কাকার, বামে বড় ভাইজানের। আরেকটু ভিতরে যাইবেন, ডানে আপায়। বামে ছোট ভাইজান। বড় ভাইজান ঘরেই আছে, যান।”
“বুঝলাম। কিন্তু তুমি কোথায় আছো এখন? এই ঘরে?”
“ইন্না-লিল্লাহ! একলা মানুষ এই ঘরে থাকমু! রাইতের বেলা ভুতপ্রেত আমারে দিয়া চড়ুইভাতি খেলতো! আমি আমার আপার লগেই আছি।”
“তাই? জেনে খুশি হলাম। যাই দেখা করে আসি তোমার ভাইজানের সাথে।”
পরিবেশ বেশ নীরবই লাগছে। মুচকি হেসে ইফতেখারের ঘর খুঁজতে দালানের গেট অতিক্রম করে শ্রাবণ। ডানের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ৷ ঘরে কেউ নেই। বামেরটা অর্ধেক খোলা। হাকলা করে উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হয়ে ভেতরে যায় শ্রাবণ। পা ঝুলানো রেখে দুই হাতের ভাজে মাথা রেখে বালিশ ছাড়া চিত হয়ে শুয়ে আছে ইফতেখার। দৃষ্টি স্থির ছাদের সিলিংফ্যানে। কেউ যে ঘরে এলো, তাতেও খেয়াল দেয়নি। হালকাভাবে গলা খাঁকারি দিয়েই তাকে সুনিশ্চিত করেছে শ্রাবণ, ঘরে কেউ এসেছে। সাথে সাথেই প্রশ্নও জুড়ে,
“আমাকে নিয়ে ভাবা হচ্ছে?”
হুট করেই ভাবনায় মোর নেয় ইফতেখার। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে বসে আকস্মিক। বিস্মিত হয়েছে স্পষ্ট! তা দেখে মুখের হাসি প্রশস্ত করে শ্রাবণ বলে,
“আমার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট। রেজাল্ট নিয়েই ফিরলাম একেবারে। এবার চাইলেই কর্মসংস্থান নিয়ে ভাবা যায়। অভিনন্দন জানান।”
কথা বলে না ইফতেখার। বিস্ময়টা যেন মলিনতার সাথে কেটেছে। মুখটা শুকনো। এক সমুদ্র অভিমান এসে ভীড়ে মনের পাড়ায়। অবিরত থৈথৈ করতে থাকে বিনা অনুমতিতে। শ্রাবণ অভিনন্দন জানার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়নি খুব একটা। সে জানে, পড়াশোনার খবরে আগ্রহী শুরুতেও ছিলো না ইফতেখার। এখনো নেই। রুমের চারদেয়ালে চোখ বুলায় শ্রাবণ। বিছানা ব্যতিত আর কিছু রাখা হয়নি এখন পর্যন্ত। দরজা ঠেলে ফাঁকা বারান্দায়ও উঁকি দিয়েছে একটু। বারান্দার দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে দিলো বারান্দা ভেদ করে ঘরে আরেকটু বেশি আলো প্রবেশের জন্য। বড় ছেলেকেই অগ্রাধিকার দিয়ে সামনে রাখলেন তবে শ্বশুর আব্বা! তা ভেবে অস্পষ্ট এক গাল হাসে সে। পরীকে দেখা গেলো পুরাতন ঘরে যাচ্ছে মাথায় গামছা প্যাচাতে প্যাচাতে। শ্রাবণ আবার রুমের দিকে মনযোগী হয়। ইফতেখার একই স্থানে বসে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাগ, অভিমান, বিরক্তি সবই যেন একত্রে জমা হয়েছে সেই চোখে৷ তার থমথমে চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রাবণ আবারও ঠোঁট টানা দেয়।
“এটা আমাদের ঘর? ভালোই হলো ফাঁকা হওয়ায়। নিজের পছন্দানুযায়ী গোছাতে পারবো সব। আপনার কোনো প্ল্যান আছে?”
দুই সেকেন্ডের মতো সময় নিলো উত্তর পাওয়ার। কিন্তু ইফতেখার নিরুত্তর। এতো বাহানা নিয়ে কেন জীবনে এলো? এসেছিলোই যখন, কেন চলে গেলো? আজ কেন তবে আবার? আসবেই যখন, এতোগুলো দিন কেন শূন্যতায় রাখলো? বহু ‘কেন’ সমন্বিত অভিমান গড়া তার হৃদয় কুঁড়ের দেয়ালে দেয়ালে। সে তো কেবল এক মায়ার সংসার চেয়েছিলো এই মায়াবিনীকে নিয়ে। তার অন্তস্থলের রহস্য তো চায়নি এই সংসারে। সাধারণভাবেই কাটাতে চেয়েছিলো বাকিটা পথ। ভেজালটুকু একদমই প্রত্যাশায় রাখেনি। শ্রাবণ সেকেন্ড দুয়ের বেশি সময় একদম নষ্ট করেনি তার মুখ থেকে উত্তর পাওয়ার জন্য। নিজের মতো বলেই যাচ্ছে অবিরত।
“এই কর্ণারে একটা কর্ণার ট্রলি রাখবো। এক গুচ্ছ কৃত্রিম ফুল আর মাঝে মাঝে মৌসুমী ফুল এনে রাখবো তাতে। এই দেয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি রাখবো। দুজনের একটাতেই হবে। তাই না? আর কি, আর কি… আর, পাশেই একটা বুকশেলফ থাকবে। এই জানালার কাছে একটা টেবিল রাখবো। আপনি তো আর পড়বেন না, তাই একটা চেয়ার আমার জন্য। আর একটা টেবিল ল্যাম্পও থাকবে। ব্যাস। দেয়ালে দুয়েকটা পেইন্টেড ক্যানভাস লাগিয়ে দিলেই ঘরের সাজসজ্জা শেষ। আর বারান্দায় বেশি কিছু না। কর্ণারে একটা টবে মাধবীলতা লাগিয়ে দিবো। বারান্দার ওপাশে তো আপনার এনে দেওয়া শুভ্র বেলী আছেই সারাবাড়ি ঘ্রাণে মাতিয়ে রাখতে। মাঝামাঝিতে ছোট্ট একটা রাউন্ড টেবিল আর দুপাশে দুইটা বেতের চেয়ার রাখবো। দুজন মুখোমুখি বসে গল্প করবো। চা, কফি কিংবা টুকটাক কিছু খেতে খেতে বিকেল সন্ধ্যা জমিয়ে তুলবো। ভালো হবে না?”
ইফতেখার এবারও নিরুত্তর। তবে বসে নেই পূর্বাবস্থায়। অভিমানের তীব্র অভিযোগে উঠেই গেছে বসা হতে। হনহন পায়ে বেরিয়ে গেছে একদম ঘর ছেড়ে। অতঃপর বাড়ি ছেড়েও। সে কি তেজ! বাব্বাহ! শ্রাবণ মুখ টিপে হেসে বিছানায় বসে। ব্যাগটা রাখে পাশেই। দীর্ঘ নিশ্বাসের পতন ঘটে সময়টায়। সেও বালিশ ছাড়াই দেহ এলিয়ে দেয় পা ঝুলানো রেখে। স্থির তাকিয়ে থাকে সিলিংয়ে। তিনপাখার সিলিংফ্যানটি ঘুরছে না। কিন্তু অক্ষিগোলকের মণিকোঠায় বহু পাখাই ঘুরে বেড়াচ্ছে অবিরত। কিছুসময় এই ঘূর্ণায়মান ভুবনেই পড়ে থাকে সে। চোখের কার্ণিশে সিক্ততা অনুভব হতেই উঠে বসে পুনরায়। চোখের কোটরে কনিষ্ঠা আঙুল চেপে সিক্ততা সরিয়ে নিতে চায়। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে পরী। তার নজরে পড়তেই জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি কাঁদছেন নাকি গো!”
মুচকি হাসে শ্রাবণ।
“কান্না নয় গো, পরী। সুখ।”
“আমি আসলেই ভাবতাম, আপনে সুখী। দুখী তো আছিলো আমার মা চাচীরা! এট্টু টেরবেটের হইলেই বাপ চাচা উত্তমমধ্যম কেলানি দিতে দৌড়ায় যাইতো। ভাতের হাড়ি উল্টায় দিতো। টানা পোড়েন সংসার। বালুমাখা ভাত যে কত দিন খাইতে হইছে! তারপরও তারা সংসার করে। আমি বুঝি না, তারা পইড়া পইড়া মাইর খাইতো ক্যা? আমি হইলে তো এক থাপ্পড় খাইয়া আরেক থাপ্পড় ফিরায় দিতাম। এমন বেডার সংসার তো দূর!”
শ্রাবণ নিঃশ্বব্দে হেসে উঠে।
“বলা আর করা, এতো সহজ নয় গো বোন। যখন সংসারী হবে, তখন তুমিও তোমার মা চাচীর মতোই হয়ে পড়বে। সংসারের অন্যতম অর্থ মায়া। নারী এই মায়াতেই আটকে যায়। তাই সহজেই ছাড়তে পারে না।”
“কী জানি! জুলুমের পিঠে আবার কোন মায়া জন্মায় কইতাছেন! যাকগে, বড় ভাইজান আপনারে বকাঝকা কইরা গেলো নাকি? কেমন রেগেমেগে বাইর হইয়া গেলো!”
“নাহ। বকেনি।”
“আমিও, জানি৷ বড় ভাইজান আপনারে বকতে পারেই না! কিন্তু তারপরও কান্নাকাটি করেন কীজন্য, বুঝলাম না।”
“কী নাছোড়বান্দা রে! বকেনি বলেই কাঁদছি। হয়েছে এবার?”
“কী আজব! না বকলে কানবেন ক্যা শুধুশুধু!”
“আসলেই আজব। যার বর্ননা আমার কাছেও নেই তোমাকে দেওয়ার জন্য। বাড়ির বাকিরা কোথায়? কোথাও বেড়াতে গেছে?”
“জ্বি নাহ! নবাবী আপায় ঘুমায়। আম্মায় রান্না বসাইছে। ছোট ভাইজান স্কুল থেকে আসার পর কই জানি টইটই করতে গেছে, কেডা জানে! কান্তা বানু তো বিষ খাইছিলো, শুনছিলেন?”
শ্রাবণের হাসিমাখা মুখ সাথে সাথেই থমকে উঠে।
“মানে!”
“হো। কত যে কাহিনী তা নিয়া।”
“কবে?”
“এই কয়দিন আগে। আপনি যাওয়ার পরেই। আর এখন আসার আগে।”
“তারপর?”
ওদিকে পারভীনের ডাক পড়ে যায়। তাকে বলেছিলো অর্পাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য একটা ডাক দিয়ে যেন দ্রুত চলে যায় গরম মশলা গুঁড়ো করে দিতে। তা রেখে আলাপে জমে গেছে শ্রাবণের সাথে! কাহিনী আর বলে উঠা হয় না বিস্তারিত। বেরিয়ে যেতে যেতে বলে যায়,
“আমিও আপনার মতো ভাবছিলাম মইরাই গেছে। কিন্তু মরে নাই। তারপর বিয়া হইয়া গেছে। অথচ বিয়া না হওয়ার লাইগাই বিষ খাইছিলো ছ্যামড়ি! পরে জানামু নে এই ইতিহাস। মশলা না জানি পুইড়া ছাই!”
তার কথা শেষ হয়েছে উঠুনে নেমে। শ্রাবণ দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে এইটুকু পর্যন্ত শুনতে। চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়েই আছে। কী হয়ে গেলো এসব! মন তো কেমন করছে তার। কান্তাকে নিয়ে তো এমনটা কখনো ভাবেনি! এতো ধৈর্য্যহীন মেয়ে সে!