শ্রাবণধারা পর্ব-৭৩+৭৪

0
185

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৭৩
(নূর নাফিসা)
.
.
বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করতে সেজে উঠছে চেয়ারম্যান বাড়ি। দুদিন পরই ছোটবউ উঠবে ঘরে। ফাতিহাকে তো সামান্য আয়োজনেও ঘরে তোলা সম্ভব হলো না। তাই কিছু পূর্ণতার জোয়ার উঠাতে ওই বাড়ির অন্য কিশোরীকে বিশাল আয়োজনে ঘরে তুলছে আফজাল হোসেন। সেদিন বহুবছর পর সাত্তারও এলো এবাড়ি। আগের দিন আফজাল হোসেনের সাথে মসজিদের সামনে কথা হয়েছিলো দীর্ঘ একটা সময়ের অভিমান অভিযোগ কাটিয়ে। তার পরদিনই দাওয়াত করে গেছে তার বাড়ির আয়োজনে শামিল হতে। সকল আয়োজনের দিকে যখন মনোযোগে দৃষ্টি নাড়ান আফজাল হোসেন, মাঝে মাঝে শ্রাবণের শক্ত গলার কথাগুলো কানে বাজে। শক্ত চোখের দৃষ্টি জোড়া চোখের সামনে ভাসে।
“একই বাড়ির আরেকটা মেয়ের সঙ্গে একই ভুল আবারও করবেন না যেন!”
ছেলে তার, ইজ্জত তার, সংসারও তার। ভুল করলে সেই ঘানিও টানতে হবে তাকেই। অথচ এই সংসার সুসজ্জিত করতেই ওই সুস্পষ্টভাষী মেয়েটার সে কি জেদ! যখন শক্ত চোখে কথা বলে, সমস্ত মুখে রক্তবর্ণ ঝিলমিলিয়ে উঠে! এমনি এমনি কী আর চেয়ারম্যান তাকে এতো পছন্দ করে? সে কী সৌভাগ্য তার! এমন বউ-ই বা ক’জনের ঘরে উঠে? ভাবতে গেলেই তিনি আত্মগর্বে ফোলে উঠেন। অতীতের বন্ধুকে মনে করে ধন্যবাদ জানায়। বন্ধুর জন্যই তো রূপবতী মেয়ে আজ তার ঘরে রাঙা চরণ ফেলে!
আফজাল হোসেন শ্রাবণের কাজকর্মেও নজর রাখেন। ভালোমতোই গোছগাছ করছে আয়োজনকে সামনে রেখে। বড় বউ হিসেবে দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্য পালন যথেষ্ট রাখছে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে ঘরদুয়ারের পরিবেশে পর্যন্ত নজর রাখছে৷ মূলত সমস্ত কিছু করছে শ্রাবণ মনের আনন্দে। এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য বিপু আর কান্তা। এই দুজনের প্রাপ্তির পূর্ণতার ঢেউ শ্রাবণের হৃদয়েও দোল দিচ্ছে। নিজের আনন্দের চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করে সে অন্যের আনন্দ দেখতে। যাদের ঘিরে এতো সাজসজ্জা, তারা যখন এতো আনন্দিত; তবে আর বিষাদ কীসের? তাদের পুরো পৃথিবীরই যেন এখন আনন্দময় মুহুর্ত। ইফতেখারকে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে ঘরে বাইরে উভয় দিক সামলে নিতে। তার নতুন জমজমাট ব্যবসা বন্ধ রাখার ইচ্ছে এবং উপায় কোনোটাই এখন নেই। আবার ছেলে হিসেবেও দায়িত্বটা তার বেশি। কাজেই বাড়ির আয়োজনে সময় না দিলেও চলছে না। সে যতটা সামলে নিতে জানে, বিপু ততটা জানে না। পিতা বুঝলেও সব কাজ পিতার পক্ষে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। তিনি কেবল বুঝেশুনে হুকুম জারি করতে পারেন৷ তবে ইফতেখার বাড়ির কাজ সামলে নেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাপোর্ট পাচ্ছে স্ত্রী এবং পিতার নিকট থেকে। সে যেন ব্যবসায়ের কাজে সময় দিতে পারে, সেজন্য বেশ কিছু কাজই বিশ্বাসের সাথে বিপু আর খালিদকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে আফজাল হোসেন। যেগুলোতে মনে হচ্ছে ইফতেখারই ভালো বুঝে, সেগুলোর দায় শুধুমাত্র ইফতেখারের উপর আরোপ করছে। অন্যদিকে শ্রাবণও বুঝে উঠতে পারে ইফতেখারের হিমশিম খাওয়ার ব্যাপারটা। সাধ্যমতো মানসিক সাপোর্ট সে-ও দিচ্ছে সকলের অজ্ঞাতে। নিজে ভেবে ভেবে সুবিধামত একবারে কাজ করে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে বা উপায় দেখাচ্ছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথাও বলছে যখন তখন, মজা করছে গল্পেস্বল্পে। যা মানসিক ক্লান্তি নিংড়াতে সাহায্য করে ইফতেখারকে। আজ সকালেও বের হওয়ার সময় বলে দিলো,
“বাজারের দিকেই তো যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘুরে যেয়েন। চাচীর কানে চুপিচুপি একটু নাড়া দিয়েন, আম্মা যে যাচ্ছে একটু পর। যাতে হুটহাট লজ্জায় না পড়ে নিজেও একটু মানসিক প্রস্তুত থাকতে পারেন। আপ্যায়নে লক্ষ্য রাখতে পারেন।”
“মা কেন যাবে এখন শুধুশুধু? দুদিন পর তো যাবেই।”
“আংটিটা আগে পরিয়ে দিয়ে আসতে চাইছেন। তাই যাবেন। দেখেও আসবেন। তাছাড়া, নিজেদের মধ্যে একটা আয়োজন হচ্ছে; যাওয়া প্রয়োজন না?”
“তা তো আছেই। সেটা আরও আগেই যাওয়া প্রয়োজন ছিলো। আচ্ছা, বলে যাবো। কাকা যে আমাদের বাড়ি দাওয়াত করতে এলো সেদিন, আপ্যায়ন ঠিকঠাক করেছিলে তো?”
“আপনার কী মনে হয়? শ্রাবণ এমনি এমনি নতুন মেহমান বিদায় করবে?”
একটু ভাবযোগে কথা বলে শ্রাবণ হেসে দেয়। ইফতেখার বলে,
“আজ বুঝি প্রথম দেখলাম, নিজের প্রশংসা করছো।”
“মাঝে মাঝে করতে হয় একটু আধটু। যান এবার, পরে বলবেন আমার জন্য দেরি হয়ে গেছে!”
“যাচ্ছি, তবে তোমার জন্য আজ সারপ্রাইজ আছে।”
“সারপ্রাইজ? কী?”
“বললেই সর্বনাশ!”
“যান, বলতে হবে না। আর শুনুন, আব্বার কাছ থেকে মশলাদির তালিকাটা নিয়ে যেয়েন। বাবুর্চি দিয়ে গেছে। আসার সময় ঠান্ডা মাথায় কেনাকাটা সেরে এলেই হবে। তবে আর দ্বিতীয়বার যেতে হবে না।”
ইফতেখার মজা করে বলে,
“তুমি এতো সহজ করে দাও কাজকে, মাঝে মাঝে মন চায় তোমাকেই সাথে নিয়ে যাই। কাজ তবে সহজে সম্পন্নও হয়ে আসবে!”
“আচ্ছা? তবে আসবো নাকি সাথে?”
“মাথা নষ্ট! কাজ করানোর মতো লোকের অভাব নেই আমার। শুধু মনে থাকলেই হলো।”
“আমি একটু পর কল করে নাহয় মনে করিয়ে দিবো।”
“দিয়ো। মায়ের সাথে তুমিও যাচ্ছো ওবাড়ি?”
“একা তো আর যাবেন না। দেখি, আমিও যেতে পারি। নাহয় পরীকে সাথে পাঠিয়ে দিবো।”
শ্রাবণকে সাথে নিয়েই কান্তাকে দেখতে যায় পারভীন। ইফতেখার দুপুরে বাড়ি আসেনি। মশলাদি কিনে বাজারের এক কিশোরকে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বিকেলে শ্রাবণ ছাদে গিয়েছিলো কাপড়চোপড় আনতে। উঠুনে প্যান্ডেলের কাজ চলছে তাই ছাদে শুকাতে হচ্ছে কাপড়চোপড়। শুরুতেই কাপড় হাতে না নিয়ে কিছুক্ষণ মন মলিন রেখে ছাদের উত্তরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে৷ একাকী সময় কাটায় ফাতিহার কবরের উপর চোখ রেখে। স্বল্প চেনা এই নারীর সাথে জড়িত তার কত স্মৃতি, কত আবেগ! কত দুঃখ বাঁধে আজও পাশাপাশি দুই পৃথিবীতে গড়া দুই বাড়িতে ঠাঁই হয়ে। সেকালেও ফাতিহা ছিলো এই চেয়ারম্যান বাড়ির পাশের বাড়ির সদস্য। আজ চেয়ারম্যান বাড়ির পরিচয় নিয়েও ঠাঁই যেন তার পাশের বাড়ির সদস্য হিসেবেই। শুধুমাত্র দক্ষিণ থেকে দিকটা উত্তরে স্থির হয়েছে। কিন্তু এবাড়ির গেটের সীমায় ঠাঁই পেলো না একটা মুহুর্তের জন্যও! আজ তারই দুইবাড়ির নতুন এক যোগসূত্রের আয়োজন চলে, অথচ তার গল্পটা কেবল গল্প হয়েই পাশের বাড়িতে সাড়ে তিন হাতের দেয়ালে খোদাই হয়ে থাকে। ভাবতে ভাবতে কখন যে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, খেয়াল করতে পারে না শ্রাবণ। তবে গাল ভিজে আছে অনুভব করতেই মুছে নেয় হাতের তালুতে। ফিরে তাকায় দাদাশ্বশুরের কবরে৷ এই মানুষটা সেদিন এতো অনিয়ম না করলেই এতোগুলো মানুষ ঠকে যেতো না এই পৃথিবীর বুকে। এই মানুষটা সরল হলেই সম্পর্কগুলোও থমকে যেতো না ধূলো জমা ধূসর স্মৃতির পাতায়। কিছু জীবনের কাছে হেরে যেতো না ‘বিশ্বাস’ শব্দটা। একাধিক জীবনের সুখ কেড়ে নিয়ে তিনি কী আজ খুব সুখী?
ভারি নিশ্বাস ফেলে উক্ত স্থান ত্যাগ করে শ্রাবণ। কাপড়চোপড় নিতে চলে আসে অপর প্রান্তে। কাপড়গুলো হাতে গুছিয়ে নিয়েও দাঁড়িয়ে থাকে কিছুটা সময়। অপলক তাকিয়ে থাকে পূর্ব দিকের সুদূর নদীর প্রবাহিত স্রোতে। বাতাসটাও মন্দ নয়। স্বাস্থ্যের স্বস্তি যোগাতে বড্ড উপকারী মনে হচ্ছে। তবে খুব বেশিক্ষণ এই মুহুর্ত উপভোগ করা সম্ভব হয় না। মোটরসাইকেলের হর্ণের শব্দ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। ফিরেছে বুঝি মহাশয়। দুপুরে খেতেও আসেনি। বাইরে খেয়েছে কি? শ্রাবণ ছাদে থেকেই গেটের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হয় ইফতেখার এসেছে। কিন্তু শুধু নিশ্চিতই নয়, চমকে উঠে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে! মুহুর্তেই হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠে মুখমণ্ডল। দ্রুত পায়ে নেমে আসে ছাদ থেকে। মোটরসাইকেলে ইফতেখার একা নয়। শিশিরও আছে সাথে! শ্রাবণ কাপড়চোপড় অর্পার বিছানায় ফেলে বাইরে ছুটে আসে। তাকে দেখতেই শিশির এগিয়ে এসে আনন্দে জড়িয়ে ধরে। শ্রাবণ তার হাত থেকে ব্যাগ নিজ হাতে নিয়ে বিস্মিত চোখে জিজ্ঞেস করে,
“তুই কোত্থেকে?”
“ভাইয়া নিয়ে এলো।”
মোটরসাইকেল ঠিক করে রাখতে রাখতে ইফতেখারও জবাব দেয়,
“তোমার সারপ্রাইজ।”
শ্রাবণ আসলেই সারপ্রাইজড। তাই আপাতত স্বস্তির হাসিতেই কৃতজ্ঞতা জানায় ইফতেখারের প্রতি। ওদিকে পারভীনকে টিন শেড ঘরের বারান্দায় বেরিয়ে আসতে দেখে ইফতেখারই আগে পরিচয় করায়,
“মা, শ্রাবণের বোন শিশির।”
শিশির সালাম দিয়ে এগিয়ে যায় কথা বলতে। পারভীনও স্বাভাবিক জিজ্ঞাসার সাথে পরিচিত হয়। জিজ্ঞেস করে,
“তোমার মা আসবে না?”
“মা অসুস্থ তো। আসার সম্ভাবনা কম।”
এদিকে ইফতেখার বলে দেয়,
“তবুও বলেছে, যদি পারে তো শুক্রবার আসবে।”
পরী ঘর থেকে ছুটে এসে হা করে থাকে। শিশির তার প্রতিক্রিয়ায় কিছুই বুঝতে না পেরে চিন্তিত মুখে হাসে। এভাবে হা করে তাকিয়ে আছে কেন? ইফতেখার তাকে পরিচয় না করিয়ে বরং সাবধান করে দেয়,
“শিশির, এর থেকে কিন্তু দূরে থেকো। এটা ভয়ংকর প্রাণী।”
“এহ! ভাইজান জীবনেও ভালা হইতেন না।”
পরী ক্ষেপে গেলেও শিশির খিলখিলিয়ে হেসে বলে,
“এমন করে আছো কেন তুমি?”
“আপনারে দেইখ্যা গো আপা, আপনারে দেইখ্যা! আমার দেখা দুই নাম্বার সুন্দর মানুষ! আল্লাহ গো, কত্ত সুন্দর তোমার সৃষ্টি!”
হুট করেই শিশিরের হাত ধরে টেনে বের হতে হতে বলে,
“পুরান ঘরে আইছেন ক্যা? আসেন, আগে নতুন ঘর দেখাই মেহমানরে।”
“আরে, করছে কী! আমি চলে যাচ্ছি না তো এখনই। নাম কী তোমার?”
“আসেন, নাম পরিচয় সবই জানামু।”
“তুমি পরী নয়তো?”
“আরেহ! জানেনই দেখি!”
বলতে বলতে অন্য হাতে ব্যাগটাও টেনে নেয় শ্রাবণের হাত থেকে। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কীর্তি দেখে বলে,
“পাগল!”
যেতে যেতে পিছু ফিরে আবার পরী জবাব দিয়ে যায়,
“আপনাগো দেইখ্যাই পরী পাগল হইয়া গেছে, ভাবিজান। এতে আমার কোনো দোষ নাই। আগে ভালাই ছিলাম।”
ইফতেখার বারান্দায় উঠে পানি দিতে বলছে মায়ের কাছে। পারভীন পানি নিতে গেলে ইফতেখার যায় পিছু পিছু। শ্রাবণও পিছু চলতে চলতে বলে,
“ভাত খাবেন এখন?”
ইফতেখার থেমে পিছু ফিরে নিজের ফোনটা তুলে দেয় হাতে। জবাবে বলে,
“খেয়ে এসেছি। ফোনটা একটু চার্জে দিয়ো তো। বের হবো।”
শ্রাবণ ফোন হাতে নিতে নিতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“আপনি নতুন পোশাক পরে বের হলেই এখন থেকে সন্দেহ হবে কোথাও যাচ্ছেন। সেদিনও তা-ই করেছেন।”
জবাবে মুচকি হাসে ইফতেখার। শ্রাবণ ফোন নিয়ে চলে গেছে দালানে। শ্রাবণের রুমে বসেই বকবক করে যাচ্ছে পরী। এই মেয়েটা পারেও পরিচয় বর্ণনা করতে! একজনেরটা জানতে চাইলে পাঁচ জনেরটা বলবে সাথে। শ্রাবণ ফোন চার্জে দিয়ে চলে যায় অর্পার ঘরে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাই ঘুম থেকে ডেকে দেয় অর্পাকে। কাপড়চোপড় তুলে যার যারটা তার তার রুমে গুছিয়ে রেখে নিজেদের ঘরে আসে। পরীকে বলে খোয়ারে মুরগী দিয়ে এসে পরে যেন গল্প করে। উঠুনে লোকজন না থাকলে সে নিজেই যেতো। পরী যেতেই শিশির বলে,
“বাবাহ! কত কথা বলতে পারে তোমাদের পরী!”
“সে এমনই। হাসিঠাট্টাও করতে পারে ভীষণ। তোর ভাইয়া খেয়ে এসেছে বাসা থেকে?”
“হুম। দুপুরে হুট করেই কল দিয়ে বলে আমাদের নিতে যাচ্ছে। মা তো তাড়াহুড়ো করে রান্না বসাতে ব্যস্ত। ওমা! কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি হাজির! ভালো যে ঘরে মাছ মাংস ছিলো। তুমিও যদি সকালে একবার বলে দিতে, ধীরেসুস্থেই সব করে রাখতো।”
“শুনলি না, সারপ্রাইজ দিলো বললো যে। আমাকে জানিয়ে যায়নি কিছু। আমি কল্পনাও করিনি, আজ তুই আসবি। একটু আগেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। এরই মধ্যে আনন্দ বেড়ে গেলো।”
“আমি নিজেও কল্পনা করিনি যে আজ আসবো। ভাইয়া জোর করেই নিয়ে এলো। জামাই জেদ করছে, তাই ওদিকে শ্বাশুড়িও পাঠিয়ে দিলো। আমি পড়েছি মাঝখানে মহা বিপত্তিতে। কাল অফিস মিস হবে। আবার টিউশনে ছুটি পর্যন্ত দিতে পারিনি!”
“যাক, ভালো হয়েছে। আসবিই যখন একটু আগে আসাতেই ভালো। একটু বেশি সময় কাটানো যাবে। কল করে টিউশনির ছুটি দিয়ে দে।”
“হুম, তা-ই করতে হবে। তোমার ননদ বাসায় নেই?”
“সবাই-ই আছে। ঘুমাচ্ছিলো, ডেকে দিয়ে এলাম।”
যদিও জানতো, বিয়েতে মা না এলেও শিশিরকে পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু দুদিন আগেই যে ইফতেখার নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে সেটা ধারণায় ছিলো না শ্রাবণের। মনটা একটু বেশিই পুলকিত হয়ে আছে এখন। পরী আবার এসে শিশিরকে নিয়ে গেছে অর্পার ঘরে৷ শ্রাবণ রুমেই কাজ করে যাচ্ছিলো। একটু পর ইফতেখার ফোন নিতে এলেই এবার মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে,
“ধন্যবাদ, এতো সুন্দর সারপ্রাইজের জন্য।”
“শুকনো ধন্যবাদে কোনো কাজ হবে না।”
“আচ্ছা? তবে কী পানি পান করে গলা ভিজিয়ে আবার বলবো, ধন্যবাদ?”
“দেখো, আরও কোনো উপায় পাও কি না।”
“পুকুর পাড়ে চলেন, ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েও বলা যায় ধন্যবাদ।”
ইফতেখার দরজা চাপিয়ে এগিয়ে যায়,
“চলো তবে।”
শ্রাবণ বারান্দার দিকে ছুটে হাসতে হাসতে বলে,
“দরজা আটকে দিলে কি বারান্দার গ্রীল ভেঙে যাবো তবে?”
“এতো দুষ্টুমি শেখো কোথায়?”
“আপনার কাছে।”
“আমাকেই তো শিখতে হবে তোমার কাছে।”
বলেই হাতটা টেনে পাশাপাশি বসায় বিছানার একপাশে।
“বসো, কথা আছে।”
শ্রাবণ জরুরী ভেবে হাসির রেশ কমিয়ে এনে মনোযোগ দেয় ইফতেখারের মুখে। ইফতেখার জিজ্ঞেস করে,
“তোমার মা কী খুব অসুস্থ?”
মুহুর্তেই একরকম ভয় কাজ করে শ্রাবণের মনে। পাল্টা প্রশ্ন করে,
“কেন, কী হয়েছে?”
“ভয় পাচ্ছো কেন? আমি জিজ্ঞেস করছি মাত্র। উনাকে আসার জন্য অনেক জোর করলাম৷ এলেন না। শিশিরকে পাঠালেন আমার সাথে। বললেন, উনি অসুস্থ। আসা সম্ভব না। পরে যদি কখনো সুস্থতা অনুভব করেন, তবে এসে ঘুরে যাবেন।”
“ওহ্। হ্যাঁ, এমনিতে তো অনেকদিন যাবতই অসুস্থ।”
“চিকিৎসা করাচ্ছো না কেন তবে?”
“হচ্ছে তো। ডাক্তার দেখাচ্ছে, ওষুধ খাচ্ছে।”
“বড় কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হলে করাও। রোগ নিয়ে বসে থাকা ভালো না। সমস্যা থাকলে তুমি একান্তভাবেই আমাকে বলো। আমি চেষ্টা করবো ব্যবস্থা করার।”
“না, তেমন কোনো সমস্যা নেই। ওষুধের উপরই থাকতে হবে। এ-ই। হাড় ক্ষয় হওয়াতে হাঁটাচলায় অসুবিধা হয়ে যায়। কোথাও যেতে চায় না তাই।”
“দেখো, আমি নিজ থেকেই কিন্তু জানতে চাইছি, সমস্যা আছে কি না। তারপরও যদি না বলো!”
শ্রাবণ মৃদু হাসি এলিয়ে বলে,
“আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস কম, তা আমি জানি।”
“না, তেমন কিছু বলছি না।”
“আপনি যেমনটা ভাবছেন, তেমন সমস্যা নেই। বড় চিকিৎসা করানোর নির্দেশনা এলে করিয়ে ফেলতাম। টাকা যেভাবেই হোক না কেন, আগেই যোগাড় করে নিতাম। আর এখনও আপনি বলার পর আপনাকে অবশ্যই বলতাম।”
“ওকে, আমি চাই-ই কোনো কিছু তুমি আমার কাছে লুকানো থেকে বিরত থাকো।”
“ঠিক আছে।”
শ্রাবণ এক মুহুর্তের জন্য তার এক হাতের বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে আবার বলে,
“আমাকে ভালো, ভরসাপূর্ণ একটা মন দেওয়ার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ।”
ইফতেখার মুচকি হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলে,
“এবার ঠিক আছে।”
শ্রাবণ কাঁধ থেকে মাথা তুলে চাঞ্চল্যকর গলায় বলে,
“কিন্তু আপনি যে শ্বশুর বাড়ি গিয়েও জেদ করতে পারেন, অবিশ্বাস্য ছিলো! তাইতো বলি, মা কাজের কথা চিন্তা না করে এমনি এমনি শিশিরকে পাঠিয়ে দিলো!”
ইফতেখার মুচকি হেসে উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে যায়,
“আমার জেদই যখন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে আছে, তখন আর কী করার?”

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৭৪
(নূর নাফিসা)
.
.
একে একে প্রত্যেকের সাথেই পরিচিত হয় শিশির। আফজাল হোসেন যেন একটু বেশিই আনন্দ প্রকাশ করলেন সে আসাতে। তার মা এলে হয়তো আরও বেশি খুশি হতেন। শ্রাবণ তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল দেখে গেছে তার প্রতিক্রিয়া। পরবর্তী সকালে যখন বোনের সাথে বাড়ির পশ্চিম প্রান্তে ঘুরেফিরে দেখছিলো শিশির, পুরনো ঘরের বারান্দায় বসে তাকিয়ে ছিলেন আফজাল হোসেন। পরী ময়লার ঝুড়ি কাঁখে তুলে ফেলতে যেতে যেতে লক্ষ্য করে যায় তার পলকহীন দৃষ্টি। একটু আগেও দেখেছিলো কেমন স্থির তাকিয়ে ছিলেন শিশিরের দিকে। তাতেই ভেংচি কেটে কথা বলে যায় সে মনে মনে,
“এহ! কাকায় চাইয়া যে রইছে আপার দিকে! কালকে থাইকা খালি চাইয়া থাকতেই দেখি। কী ভাবেন, খোদা জানেন! এই রূপের কারণেই ভাবিরে সহজে মাইন্না নিছে। তা জানি না নাকি? এইজন্য ভাবির চ্যাটাং চ্যাটাং কথাও মিষ্টি মনে কইরা হাসে। এহন আবার কী ভাবতাছে, কেডা জানে! এই আপায় ছোড পোলার বউ হইলেই ভালা মানাইতো, তা-ই নাকি? বাবাগো বাবা! বড় লোকেগো এই এক বিরাট সমস্যা! খালি ট্যাকাপয়সা আর সুন্দরী খোঁজে৷ এইজন্যই খোদায় কালা বউরেই সুন্দর বানায় দিছে ছোড ভাইজানের চোক্ষে। উচিত করছে।”
মনে মনে কথা বলে একবার সামনে তাকিয়ে, আরেকবার পিছু তাকাতে তাকাতেই হনহনিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পুকুরের পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে অজান্তে চলে গেছে পুকুরে ঝাপ দিতে। ঠিক ঝাপানো নয়, ঢালুতে পা পড়ে ঝুড়িসহ সে পিছলে গেছে পানিতে। গল্পে মগ্ন শ্রাবণ শিশির দুজনেই পিছু ফিরে বিস্মিত হয়ে আছে। পানিতে পড়া পরী নিজেও বিস্মিত, সকাল সকাল কী থেকে কী হয়ে গেলো এটা তার সাথে! বিস্মিত পরিবেশ অট্টহাসিতে মাতিয়ে দিতে হুট করে বিপুর উদয়ন ঘটে! মূলত গোয়ালের কোণে দাঁড়িয়ে ঘাসের ব্যাপারে বকুল কাকার সাথে আলাপ করছিলো সে মুখে ব্রাশ নিয়ে। পানিতে ঝাপানোর শব্দ পেয়েই দৌড়ে আসে পুকুর পাড়ে। ইচ্ছাকৃত হাহাহোহো করে হেসে বলে,
“শয়তান শয়তানি হালেই মরে।”
পরী রাগে ফেঁপে উঠে।
“দাঁত কেলাইবেন না কইলাম! এক্কেবারে দাঁত ভাইঙ্গা ফালামু সামনের গুলা। ভাঙা দাত নিয়া কাল বিয়া করতে যাইয়েন হের পরে!”
“আমি বিয়ে করে ফেলছি। দাঁত আস্ত রাখলেই কী আর ভাঙা থাকলেই কী!”
আবারও হাসে, পরীর আরও রাগ হয়। ফোঁপাতে ফোপাঁতে পাড়ে উঠে বসে। শ্রাবণ এগিয়ে বলে,
“তুমি এতো জায়গা থাকতে পুকুরের ওপর হাঁটতে গেলে কেন?”
“আল্লাহ জানে, চোখ কোন চান্দে উইড়া গেছিলো এদিক আইসা মরতাম!”
“অন্ধ মানুষের চোখ তো চান্দেই থাকে। হাহাহোহো…!”
বিপুর হাহাহোহো হাসি থামে না ওদিকে। পরী রেগেমেগে হাতের ঝুড়ি দিয়েই ঢিল ছুঁড়ে বলে,
“যান এন্তে কইছি!”
বিপু ফুটবলের মতো লাথিতে ঝুড়ি আবার ফেরত পাঠায় পরীর কাছে।
“দ্যাখ, দ্যাখ। তোর লাফে ব্যাঙ সব পানি ছাইড়া উপরে উঠে গেছে।”
আবারও অট্টহাসিতে ফাটে! শ্রাবণ মুখ চেপে হাসলেও শিশির খিলখিলিয়ে হাসে। কারণ, সত্যিই ব্যাঙ উপরে বসে আছে। পরীর কান্না পায় রাগে। কী বলবে ভেবে না পেয়ে বলে,
“বাড়িত বউ আইতাছে বলেই এতো হেহে করতাছেন, না? যাইতাম না কাল আপনের বউ আনতে।”
“তুই যাইস না আনতে। আমার বউয়ের পা আছে। নিজে হেঁটেই আসতে পারবো। বাড়ি কাছেই।”
“ভাবি, কিছু কইবেন!”
শিশির খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে যেন লুটিয়ে যাচ্ছে। পরীকে পুকুরে পড়তে দেখাই যেন তার সর্বোচ্চ বিনোদন ছিলো। বিপুর কথা আরও হাসি থামতে দিচ্ছে না। সে মন্তব্য করে,
“কাছেই যখন, বিপু ভাই কোলে তুলেও আনতে পারবেন।”
“পাক্কা! বেয়াইনের কথা আরও ঠিক। আসলে এটাই বলতে চাইছিলাম।”
শ্রাবণ তাকে থামাবে কী, নিজেই হাসি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। তবুও বলে,
“কোলে তুলেই আনাবো কাল। মাথায় রেখেন। এবার যান এখান থেকে। নাহয় আপনাকেও পুকুরেই নিক্ষেপ করা হবে।”
পরী এমনি কাদা তুলে ছুঁড়ে মারে। বিপু সরে গিয়ে তাকে সাবধান করতে করতে চলে যায়। বকুল কাকাও গোয়ালে থেকে হাসে। শ্রাবণ পরীকে ভেজা পোশাক পাল্টাতে পাঠিয়ে দেয় দ্রুত। ঝুড়ি নিয়ে যায় নিজ হাতে করে।
গ্রামের রেওয়াজ মোতাবেক রাতে হলুদের ডালা কুলো নিয়ে কান্তাদের বাড়ি যায় শ্রাবণ, শিশির, অর্পা, পরী এবং ইফতেখার। বিপু নিজেই সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলো, সদস্য নাকি কম হয়েছে। মূলত আত্মীয়দের দু-তিনদিন আগে ডেকে এমন আয়োজনের কোনো ইচ্ছে জাগেনি চেয়ারম্যানের। তার মূল আয়োজন মূলত বৌভাত। গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও আত্মীয়বর্গ নিয়ে বিশাল আয়োজন হবে শুক্রবার। আর আগের যত আয়োজন, মূলত ঘরোয়া পর্যায়ের। যদিও বউ তুলে আনতে বরযাত্রী হিসেবে যাবে আত্মীয়দের মধ্যে গুটিকয়েক মুরুব্বি। পারভীন নিজেও চাইছিলেন না এসব আয়োজন নিয়ে ভাবতে। কান্তা, শিরিন যেমন অনেকটা ধার্মিক রীতিরেওয়াজে প্রাধান্য দিয়ে চলে; পারভীনের মনমানসিকতাও অনেকটা তেমনই। তবে সাজগোজের ব্যাপারে বেশ আহ্লাদ। ঘরোয়া আয়োজনে পুত্রবধূ ঘরে তুললেও বেনারসি আর গহনাগাঁটিতে জড়িয়ে তোলার সাধ এবং সাধ্য উভয়ই উপস্থিত তার মাঝে। কিন্তু অন্যদিকে চেয়ারম্যান খেতাবেও তো বড় ব্যাপারস্যাপার জড়িয়ে আছে। তাই মূলত আত্মীয়স্বজন আর সুপরিচিত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে আয়োজনেও কোনো আপত্তি ঠেকেনি তার। সামাজিক রীতিরেওয়াজের প্রতি ছেলেমেয়ের আহ্লাদেও কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেননি। তবে বিশেষভাবে জড়াতে দেননি আত্মীয়দের। শুধুমাত্র ঘরের মেয়েগুলোকেই পাঠালেন। দুষ্টুমি করে বিপুও পিছু নেয়। সবাই চলে যাচ্ছে কান্তাকে হলুদ মাখাতে, তাকে নিচ্ছে না কেন? একা একা বাড়ি বসে কী করবে সে? কান্তার বাড়ির রাস্তা পর্যন্ত চলে গেছে তাদের পিছু নিয়ে। শ্রাবণ চোখ রাঙিয়ে তাকে বাড়ির বাইরে রেখে গেছে। কেননা কোনো পুরুষমানুষকে তারা এই ছোট্ট আয়োজনের গণনায় ধরেনি। হোক সে কান্তার বর, তবুও না। আর ইফতেখার তাদের সাথে গেলেও সে আয়োজনে শামিল হতে যায়নি। গিয়েছে কাকার আগামীকালের বন্দোবস্ত কেমন, তা দেখতে ও জানতে। কাকার সাথে সাক্ষাৎ করতে।
কাইয়ুম ছেলেটা এতোদিন শ্রাবণকে দেখেই কেমন গা ঢাকা দিয়ে চলার চেষ্টা করেছে। আজ শিশিরকে দেখে যেন তৎক্ষনাৎ পালানোর তাড়া! আলো ছেড়ে আঁধারে ঠাঁই নিয়েছে হুটহাট। শিশির নিজেও বিস্মিত। এই ছেলের বাড়ি এটা! বিস্মিত হলেও নিশ্চুপেই পরিচয় ও পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছে। আলাদাভাবে কোনো জিজ্ঞাসা চালায়নি শ্রাবণের সাথেও। কান্তার সাথে বসে তাদের আলাপ আলোচনা বেশ ভালোই জমলো। সেই সাথে মুহুর্ত জমজমাট করতে পরী তো আছেই! দুইহাতে হলুদ বাটা লেপে কান্তা ও কান্তার চাচাতো বোনদের মেখে গেলো। নিজেও হলদে ভুত হয়ে গেলো বেয়াইনদের হাতে। কান্তার বিয়েকে কেন্দ্র করে মজিদা কাকির ঘরও আজ ভরো ভরো। যা বেশ ভালো লাগলো শ্রাবণের কাছে। কেননা সে এই বাড়িতে যখনই আসে, ওই ঘরটায় একটুকরো নিশ্বাস ব্যতিত আর কিছু দেখতে পায় না যেন। অথচ আজ বাচ্চাকাচ্চাদের হৈহোল্লোড়ের সাথে বড়দের জীবন্ত উপস্থিতির কী সুন্দর বিচরণ চলছে! কী খুশি দেখাচ্ছে একাকী এই মানুষটাকে। ইফতেখার নিজ দায়িত্বে তাদের সাথে নিয়ে ফেরার জন্যই অপেক্ষায় বসে ছিলো। যাওয়ার প্রয়োজন মনে হলে কান্তাদের বারান্দায় থেকে শ্রাবণকে ডাকে। সাড়া দিয়ে শ্রাবণ বেরিয়ে এলেই গালে তিন আঙুল পরিমাণ হলুদের ছাপ দেখতে পায় ইফতেখার। মৃদু আলোতেই যেন সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ফর্সা গালে হলুদাভ ভারি সুন্দর ফুটেছে। ইফতেখার মন্তব্য করে,
“ভালোই তো দেখাচ্ছে।”
দুষ্টু হাসি গালে চেপে লুকানো হাত সামনে এনে এক আঙুলে তুলে আনা হলুদ বাটা ছুঁয়ে দেয় ইফতেখারের গালে। প্রত্যুত্তরে বলে,
“আপনাকেও ভালো দেখাচ্ছে।”
অন্য গালেও দিতে গেলে হাত ধরে ফেলে ইফতেখার।
“দিয়ো না!”
“কেন? নিজের বিয়েতে তো দেননি-ই, ভাইয়ের বিয়েতেই নাহয় একটু…”
ইফতেখার সেই হাত শ্রাবণের গালের কাছেই নিয়ে আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
“তুমি দিয়েছো না, তাতেই হবে।”
পরক্ষণে শ্রাবণের আঁচল তুলে নিজের গাল মুছে নিয়ে বলে,
“অনেক্ক্ষণ তো হলো, এবার বাসায় চলো?”
“হুম, আসছি।”
তাদের সাথে নিয়েই বাড়ি ফিরে ইফতেখার। নিজ বাড়িতে এসে কড়া আলোতে স্পষ্ট দেখে প্রত্যেকের চেহারা। সকলে ঠিক থাকলেও পরীর হয়েছে গাদাগাদি অবস্থা! বেশি চঞ্চলতার কারণে বেশি দেবেছে সকলের হাতে। বিপু দেখেই শুরু করেছে তিরস্কার! বাকিদেরও চেহারা, পরীরও চেহারা!
তারা ঘরে এলেই ইফতেখারকে পাশের রুম হতে ডাকে পারভীন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে গয়নার বাক্স হাতে। অর্পার ঘরে হাসাহাসি শুনে সেখানে খুঁজে আসে শ্রাবণকে। নেই জেনে নিজে রুমে এসেই পায়। মাত্রই মুখ ধুয়ে হলুদ সরিয়ে নিয়েছে শ্রাবণ। তবুও হলুদ আভা ছড়িয়ে আছে মুখমন্ডলে। ইফতেখারকে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই চোখে পড়ে গহনার বাক্স। আম্মা কী গহনা দেওয়ার জন্যই তাকে ডাকলো তখন? ইফতেখার যেন মুখাবয়বেই তার ভাবনা পড়ে দিয়েছে। তাই মুখে মুচকি হাসির রেশ রেখে এগিয়ে এসে বলে,
“বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা ভালো না। মাকে সেদিন নিষেধ করলে, তাই আমাকে ডেকেই পাঠালেন এগুলো। কাল যেন পরতে পারো।”
“আপনাকে কে বললো, আমি রাগ করে আছি?”
“রাগ না করলে তো খুশিতেই নিয়ে নিতে।”
“সব ব্যাপারে সবার খুশি জাগে না। আপনি না আনলেও পারতেন। আমার ইচ্ছে নেই, এগুলো পরার।”
ইফতেখার তার হাতের তালু উঁচিয়ে বাক্স তুলে দিয়ে বলে,
“কিন্তু খুশির ব্যাপারগুলোতে বাঁধা এলে অভিমান ঠিকই জাগে।”
মূলত, শ্রাবণের অভিমান ধরতে পারাটাই তার মুখের এই হাসির কারণ। তার বোন অর্পার মতো মেয়েদেরকে অভিমান করলে গাল ফুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু এই অনন্যার অভিমান হাসিমাখাতেই যেন অনন্য হয়ে আছে। বড্ড স্বাভাবিকতার মাধ্যমেই সে অভিমান ঢেকে রাখতে চাইছে। ইফতেখার কথার পরপরই অভিমানিনীর কপালে আলতো স্পর্শ এঁকে আবার বললো,
“শখের জিনিসই তো। পরে নিয়ো।”
শখের পুরুষ যে তার লুকায়িত অভিমানটুকুও ধরে নিতে পেরেছে, শুধুমাত্র সেই কারণেই তার আদুরে আবদার গ্রহণ করতে দ্বিতীয় কোনো কথা বললো না শ্রাবণ। বাক্স খুলে দেখে ইফতেখারের সামনেই। মনে হয় নতুন গড়া হার, দুল ও বালার সেটটাই তাকে দিয়েছে। এদিকে, বাক্স খুলে দেখতে দেখে ইফতেখার বলে;
“কান্তার জন্যও সমান সমানই দেখলাম বুঝি আরেক বক্সে।”
শ্রাবণ বুঝতে পেরেছে তার আগ বাড়িয়ে সমান পরিমাণ প্রকাশের কারণ। সে বাক্স বন্ধ করে ইফতেখারের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
“পুরো সমানই তো?”
“হ্যাঁ, তাইতো দেখলাম। বউদের সমান অধিকার। কারো কম বেশি নেই বললো মা।”
“তবে এটা বদলে, সেটাই নিয়ে আসুন।”
“কেন, এটায় কী হলো আবার?”
“এটা নতুন বানানো হয়েছে। নতুন বউয়ের জন্যই থাক। আপনি বরং এগুলো বদলে আগের গুলো নিয়ে আসুন।”
ইফতেখার বদলে নিতে চলে গেলো। সে তো ভেবে নিয়েছিলো পরিমাণই বুঝি দেখছে শ্রাবণ! ইতিবাচক ভঙ্গিমা তার মুখে হাসি এনে দেয়। বদলে নিয়ে আসে গহনাগাঁটি।

চলবে।