শ্রাবণধারা পর্ব-৭৫ এবং শেষ পর্ব

0
154

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ৭৫
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকাল হতেই শিল পাটা নিয়ে হলুদ বাটতে কোমড় বেঁধে বসে যায় পরী। এক বালতি পানিতে হলুদ আর কাঁদা গুলে হুট করেই টিনশেড ঘরের দুয়ারে বিপুর উপর আক্রমণ! গত দুতিনদিনের তিরস্কারের সব শোধ তুলে নেয় এক বালতিতে। অপ্রস্তুতভাবে এক ঝটকায় হলুদ কাঁদায় গোসল বিপুর! বালতির পানি তার দিকে ছুঁড়ে পরী আর দাঁড়িয়ে নেই! দৌড় দিয়েছে পশ্চিম প্রান্তে। বিপু আর ছাড়তে কিসে? পাটার উপরই হলুদ পেয়ে দুই মুঠ ভর্তি করে নিয়ে ছুটেছে। পরক্ষণে ফিরে এসে বালতিতেই হলুদ গুলিয়ে নিয়েছে। এবার কেউই বাদ যায়নি! বোন, ভাবি, বেয়াইন সকলের উপরই পড়েছে হলুদ পানির ঝটকা! পাশের বাড়ির দাদি এসে বসে ছিলো পারভীনের সাথে গল্প করতে। খালিদের বউ আর ভাবিও ঘন্টাখানেক আগে এসেছিলো। পরী যখন বাটতে শুরু করেছিলো, তখনই নিজ থেকে এক দলা হলুদ বাটা তুলে নিয়ে কথা বলতে বলতে গায়ে মাখছিলো তারা। তাদেরকেও পরী এসে হলুদে এবার গাদাগাদি করে দিয়ে গেলো। খালিদের বউটাও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। দৌড়ে গেছে পরীকে পাকড়াও করতে। পুকুরের পাশটা ফাঁকা বিধায় ওদিকেই সকলের হৈ-হুল্লোড়ের পর্ব চলে। সকলের অবস্থা নাস্তানাবুদ করে এক পর্যায়ে বিপু নিজেকে রক্ষার্থে পড়েছে পুকুরে ঝাপিয়ে। শ্যাওলা রঙের পানিতেই সাঁতার কেটে আধা পরিচ্ছন্ন হয়ে নিয়েছে। ইফতেখার এরমধ্যে বাইরে থেকে বাড়ি এসেছিলো। তাদের এই ছোটাছুটির হট্টগোল দেখে ঘরে কাজ থাকা সত্ত্বেও বাড়ি প্রবেশ না করে গেট থেকেই পুনরায় বেরিয়ে গেছে। বাকিদের নিয়ে টেনশন না থাকলেও সালমা ভাবির উপর বিশ্বাস নেই। যা কাদামাক্ত দেখা যাচ্ছে হাতের অবস্থা, কখন না তার দিকেই হলুদ, কাদা নিয়ে ছুটে আসে! কিন্তু তার যে এসব পছন্দ না। তাই দূর হতেই পালিয়ে যাওয়া। ফিরে বেশ কিছুক্ষণ পর। খানিক আগে শ্রাবণ গোসল সেরে অবসর বসে আছে ঘরে। ইফতেখারকে দেখেই বলে,
“ভালো হয়েছে আরেকটু আগে আসেননি। কী অবস্থা যে হচ্ছিলো হলুদ আর কাদা নিয়ে!”
“আমি দেখে গেছি। আর দেখেই আবার চলে গেছি।”
“এসেছিলেন! আগে জানলে আমিও ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতাম। হলুদ পর্যন্ত ঠিক ছিলো, এই পরীটা কাদা নিয়েই বিপত্তি ঘটিয়েছে। এদিকে সবসময় এসবই হয় বুঝি বিয়ের আয়োজনে?”
“পরীর মতো দু’চারটা গিদড় থাকলেই হয়। নয়তো না।”
“গিদড়!”
খিলখিলিয়ে হাসে শ্রাবণ। শিশির বারান্দার চেয়ারে বসেছে চুল আঁচড়ে নিতে। ইফতেখারকে বলে,
“ভাইয়া, আপনি গেলেনই যখন আমাকে নিয়েই যেতেন। আপনি জানেন না, এমন একটা পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া কত যে জরুরী ছিলো!”
ইফতেখার মৃদু হেসে বলে,
“এসেছো, একটু মজা না করে গেলে কেমন হয়।”
“তবে আপনি পালালেন কেন?”
“আমার এসব কখনোই পছন্দ না। তোমার আপু এক চিমটি পরিমাণ হলুদ দিয়েছে, সেটাও মুছে ফেলেছি।”
এমনি অর্পা এসে রুমের দরজায় দাঁড়ায়। হাতে নুপুর দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভাবি, এটা তোমার না?”
মুহুর্তেই বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাৎ করে উঠে শ্রাবণের। নিজের পায়ে তাকিয়ে দেখে এক পা খালি! এটা কী করলো সে! আম্মার উপহার হারিয়ে ফেললো অসাবধানতায়? এতোটা বেখেয়ালি কীভাবে হতে পারে সে? দ্রুত পায়ে এগিয়ে নুপুরটা নিয়ে নেয় হাতে।
“হ্যাঁ, আমারই তো। কোথায় পেলে?”
“আব্বু পেয়েছে উঠুনে। আমাকে ডেকে বললো, তোমার নাকি। হালকা কাদায় মাখা ছিলো। ধুয়ে নিয়ে এলাম। ভাগ্যিস, বাইরের কারো হাতে পড়েনি!”
নুপুর মুঠোয় চেপে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নেয় শ্রাবণ এক পলকে। সাথে ফেলে দীর্ঘ নিশ্বাস। পরক্ষণে নুপুরটায় চোখ বুলিয়ে দেখে হুক ছিঁড়ে গেছে। শ্রাবণ মলিন মুখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
“এটা তো ছিঁড়ে গেছে! তাইতো পড়ে গেলো।”
ইফতেখার বুঝতে পারে মুখাবয়বের মলিন হওয়ার কারণ। এগিয়ে এসে হাত থেকে নুপুরটা নিয়ে দেখে কোন পাশ ছিঁড়লো। পরক্ষণে নিজ পকেটে রেখে দিয়ে বললো,
“তুমি যে গোসল করে এলে, তবুও লক্ষ্য করোনি?”
“এতেই তো আশ্চর্য হচ্ছি! এতো বেখেয়ালি হলাম কী করে! খুব সম্ভবত গোসলের পর যখন বেরিয়েছি, তখন পড়েছে। নয়তো আমার চোখে পড়তো পা যে খালি।”
“আচ্ছা, যা-ই হোক। ওসব নিয়ে টেনশনের প্রয়োজন নেই। মন খারাপ করারও দরকার নেই। পেয়েছো যে এতেই সন্তুষ্ট থাকো। ঠিক করে এনে দিবো। ওটা খুলে সাবধানে রাখো।”
“উহুম। আজ আম্মার বাড়ি যাবো বউ উঠাতে, আর আম্মার নুপুর পরবো না তা কী করে হয়? একটাই পরনে থাকুক।”
এই কথা শুনে ইফতেখার তখনই বেরিয়ে গেছে বাজারের উদ্দেশ্যে। প্রায় আধ ঘন্টা সময় বাদ আবার হাজির হয়েছে শ্রাবণের সামনে। অর্পার ঘর থেকে শ্রাবণকে ডেকে এনে নিজ হাতেই পরিয়ে দিতে গেলে শ্রাবণ অবাক কণ্ঠে বলে,
“এতো তাড়াতাড়ি ঠিক করিয়ে আনলেন কীভাবে!”
“হুকই তো ছুটেছে। জরুরী ভিত্তিতে ঝালাই করে আনলাম। এক পায়ে নুপুর আর অন্য পা খালি, তা কেমন দেখায়?”
শ্রাবণ ফিক করে হেসে দেয় তার অদ্ভুত কাণ্ডে। পরক্ষণে বলে,
“আপনাকে একটা কিছু দেওয়ার আছে। গোসল সেরে আসুন আগে। আজান পড়ে যাবে।”
“কী দিবে?”
“বললাম না, গোসল সেরে আসুন।”
“না, এখনই দাও।”
“উহুম।”
“গোসলের পর সময় হবে না। দেখা যাবে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেছি।”
“আমি এখানেই আছি। রেডি হওয়ার সময়ই দিবো।”
“এখন দিবে না তুমি?”
“না।”
ইফতেখার নুপুর পরিয়ে দেওয়া পায়ে কোমলতার স্পর্শ ছোঁয়াতে গেলেই শ্রাবণ হুট করে পা টেনে দাঁড়িয়ে যায়। আলমারির দিকে যেতে যেতে বলে,
“করছেন কী! অদ্ভুত লোক তো!”
ইফতেখার হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতুত্তরে বলে,
“জেদি লোক।”
জেদের কারণে শ্রাবণ এখনই তুলে দেয় তার উপহার। এক বক্স পারফিউম এনেছে তার জন্য। ইফতেখার মুচকি হেসে ঘ্রাণ পরীক্ষা করে দেখে সবগুলোরই। জিজ্ঞেস করে,
“এখন এগুলো কোথায় পেলে?”
“এখন নয়তো। বিয়ের কেনাকাটা করতে গিয়েই কিনেছিলাম। আপনাকে দেখাইনি আগে। কেমন হয়েছে?”
“তোমার মতো মায়াবী।”
“পারফিউমেও মায়া!”
শ্রাবণ খিলখিলিয়ে হেসে পুনরায় বক্স রেখে দেয় একটা পারফিউম বাইরে রেখে। বিপুর জন্য একটা ঘড়িও কিনেছিলো আজ দিবে বলে। তা-ও দেখালো। যোহর বাদ নিজ পরিবার ও আত্মীয়দের মধ্যে কয়েকজন যুবক ও মুরুব্বি নিয়ে বরযাত্রী হিসেবে সাত্তারের বাড়ি হাজির হলো আফজাল হোসেন। মোটামুটি রকমের এক আয়োজনের মাধ্যমেই কনে বিদায় দিয়েছে সাত্তার। ঘরের রত্ন পাঠিয়ে দিয়েছে পড়শিঘরে। পুরনো দিনগুলোকে স্মরণ করে মাতাপিতার মন যেন কেমন কেমন করে। সাধের সম্পর্কে পূর্ণতার জোয়ার উঠলেও মেয়ে যেতে চায় না নাড়ীর বাঁধন ছেড়ে। কে এমন নিয়ম জোরালো এই জগৎসংসারে? অথচ দুদিন পরই তো আবার এই মেয়ে হাসিখুশিতে আসবে যাবে দুই দুয়ারে! তবে কেন এতো কান্নার শোরগোল হৃদয়ের বাঁধ ভেঙে?
শ্রাবণ ইফতেখারের কথা রেখে শাশুড়ির দেওয়া গয়না পরেই সেজেছে। মাথায় চড়িয়েছে বেনারসি ঘোমটা! এমনি এমনি যে মায়ার বিচরণ মায়াবতীর রূপে, তা যেন আরও কয়েকগুণ রশ্মি ছড়িয়েছে গহনার সোনাবরণে। ইফতেখার মুগ্ধচোখে দেখে সুযোগ হলেই। বাড়ি ফিরে তাই শ্রাবণ সুধায় একাকী পেয়ে,
“কী দেখেন এমন করে?”
মুচকি হেসে সে প্রত্যুত্তর করে,
“এক আকাশ শ্রাবণধারা।”
পরক্ষণে নিজ হাতে ঘোমটাটা আরেকটু সামনে টেনে এনে শুকনো আবদার জুড়ে বসে ফিসফিস করে,
“শ্রাবণ, তুমি নাহয় চলেই যাও আবার। চার বেয়ারা ভাড়া করে পালকি তুলেই নিয়ে আসি।”
“ইশ! বুড়ো বয়সে ভীমরতি!”
জবাব দিয়ে হাসে শ্রাবণ। ইফতেখার বিস্মিত চোখে কোণঠাসা হেসে বলে,
“বুড়ো! ক’দিন আর হলো, বিয়ে করলাম?”
“একদিন আগে হলেও তা অতীত, পুরাতন।”
“বিপুর বিয়েরও দিন গেছে বেশ কয়েক।”
“বিপুর বউ আজই এলো।”
পাশ দিয়ে যেতে যেতে পরী আংশিক শুনে মন্তব্য রেখে যায়,
“ছোট ভাইজানের বিয়ার আনন্দে হিংসা লাগতাছে বুঝি বড় ভাইজানের? জোরে জোরে কপাল চাপড়ান এইবার, চুপচাপ বিয়া করার আফসোসে। আমাগো শখও তো মাটি হইছে, তাই আমরাও এট্টু দেখি।”
শ্রাবণ মুখ চেপে হেসে সান্তনা দেয় ইফতেখারকে।
“খালিদ ভাইয়ের হাতে ধরা খেয়েও নির্ভেজাল বিয়ে সেরে আসার মজা আর ক’জনের ভাগ্যে জোটে?”
এবার ইফতেখারও শব্দযোগে হেসে উঠে। আসলেই দিনটাকে ঘিরে একটা মজার স্মরণীয় ঘটনা সৃষ্টি করে রেখেছে খালিদ ভাই। এটা সে নিজেও প্রায়ই মনে করে। বিশেষ করে খালিদ ভাই সামনে পড়লেই মনে হাস্যকর স্মৃতি নেড়ে উঠে।
কান্তার পরিবার সাথে নিয়ে পরবর্তী আয়োজন জাঁকজমকপূর্ণভাবেই সেরে উঠে। ইফতেখার ফোনে যোগাযোগ করলেও সুলতানা আসতে পারেননি। অন্যথায় আত্মীয়স্বজন সহ আফজাল হোসেনের পরিচিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও হাজির হয়েছে দূরদুরান্ত থেকে। সেদিনের পর ইফতেখার কোনো কাজে মামাবাড়িতে না গেলেও অপু এই আয়োজনে ঠিকই হাজির হয়েছে পরিবারের সাথে। তবে ইফতেখারকে এড়িয়েই চলেছে নিজের মতো করে। অথচ ইফতেখার ভেবেছিলো, সে আসবেই না। এখন এসেই যেন মনে অসন্তোষ মনোভাবের সৃষ্টি করলো! শ্রাবণ বেশি ব্যস্ত ছিলো কান্তাকে নিয়ে। এ বাড়ির সাথে তাদের পূর্ব সম্পর্কের একটা সংশয় তো রয়েই গেছে, তারউপর বড় মাপের মেহমান ও এতো আত্মীয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার ব্যাপার তাকে আরও বেশি বিব্রত করে ফেলছে। একমাত্র শ্রাবণই যেন এখানে তার অতি আপন। এবং সেই শ্রাবণই হাসিমুখে সকলের সাথে সাক্ষাৎ করে সামলে নিচ্ছে পরিচয়পর্ব। পাশাপাশি সামলে নিচ্ছে ঘরের বাকি সদস্যদের প্রয়োজন। কিছুক্ষণ পরপর আফজাল হোসেন লোক নিয়ে সামনে আসছেন, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন পুত্রবধূদের। পারভীনও প্রয়োজনে ঘরে ডেকে নিচ্ছেন শ্রাবণকে। সর্বোপরি ব্যস্ত মুহুর্ত কেটে যাচ্ছে তার। অপু কখন এসেছে খেয়াল করেনি। তবে অপু ঠিকই খেয়ালে রেখেছে তাদেরকে। শিশিরকে এখানে দেখে যেন মন অপ্রস্তুতভাবেই সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। মিটিমিটি হাসি জ্বলছেই রাশি রাশি। কান্তার কাছেই কান্তা ও অর্পার সাথে বসে কথা বলছিলো শিশির। শ্রাবণ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অপুর সামনে পড়ে যায়। অপুও হঠাৎ থেমে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন, ভাবিজান?”
শ্রাবণ ঠোঁটের কোণে বিরক্তিঠাসা হাসি ধারণ করে সুস্পষ্ট গলায় উত্তর দেয়,
“বেশ ভালো।”
“আপনাদের বাড়ি এলাম, অথচ আপ্যায়ন ছেড়ে যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।”
“পালাবো কেন? আপনাদের আপ্যায়নের জন্যই তো এতো আয়োজন করা। বসুন, খাওয়াদাওয়া করুন, আশপাশে কত আত্মীয়স্বজন আছে গল্পে গল্পে সময় কাটানোর।”
“হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া সারলাম। আত্মীয়স্বজনও ভালোই আছে দেখছি। আপনার বোনটাও আছে দেখলাম। ভাবলাম, বেয়াইনের সাথেই গল্পসল্প করবো; খাওয়া দাওয়া করবো। কিন্তু বেয়াইন যে সেখানে বসেছে, আর নড়চড়ের নাম নেই।”
কথা বলতে বলতে শিশিরের দিকে তাকায় দুষ্ট চোখে। শ্রাবণ অস্পষ্ট দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। অপু পুনরায় তার দিকে ফিরে বলে,
“আপনার সেদিনের কথা বেশ ভাবলাম৷ ভেবে ভেবে দেখলাম, মা তো মা-ই; বোন তো বোনই। প্রয়োজন এখন বউ। বোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বোনের ভাবি দরকার। মাকেও দেখলাম। বুঝলাম, মায়ের পুত্রবধূ দরকার। আমারও তো বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি? নিজেকে নিয়েও ভাবা দরকার। তাই বউ খুঁজতেই নেমেছি, মেয়েদের দিকে দেখছি। আপনার বোনটাও বেমানান না।”
শ্রাবণ মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি স্পষ্ট করে বলে,
“তাই? কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হলো, আপনি আমার বোনের যোগ্য না। ধন্যবাদ।”
তিরস্কৃত ধন্যবাদ জানিয়ে শ্রাবণ নিজ কাজে চলে গেলো। আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলো, বেলা ফুরালে মেহমানও ধীরে ধীরে সীমানা ছাড়লো। ডেকোরেটের লোকজন গুছিয়ে নিচ্ছে সব। ঘরের লোকজনও গোছগাছ করে নিচ্ছে ঘরের ভেতরের পরিবেশ। ইফতেখার ফ্রেশ হয়ে বিশ্রামে বসেছে সারাদিনের ক্লান্তি নাশ করতে। বসে বসে শ্রাবণকে বলছে,
“রাখো তো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। একটা দিন ঘর নোংরা থাকলে আহামরি ক্ষতি হবে না। বিশ্রাম নিয়ে আগে সুস্থ থাকো। কাল থেকে ধীরে ধীরে করে নিয়ো।”
“হয়েই গেছে। কাল তো শিশির চলে যাবে। আপনি দিয়ে আসবেন? নাকি একাই যাবে?”
“যাবে কেন? আরও দু-চারদিন থাকুক না।”
“হুম, থাকতে বসে আছে সে! অফিস আছে না? তারউপর মা একা বাসায়। আজই চলে যেতে চাইছিলো বিকেলের দিকে। আমি আটকে রেখেছি।”
“ঠিক আছে। দিয়ে আসবো নে।”
একটু থেমেই জিজ্ঞেস করে,
“অপুর সাথে তোমার দেখা হয়েছে?”
শ্রাবণ কাজের ফাঁকে চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। মুখে সন্দেহজনক হাসির রেশ রেখে পুনরায় কাজে মনোযোগ দিয়ে বলে,
“হলো তো।”
“কিছু বলেছে বুঝি?”
“হুম। কেমন আছি, জানতে চাইলো।”
“আর?”
“আর কী? বললাম, বেশ ভালোই আছি।”
“তারপর?”
“আমি ফালতু লোকের পিছু সময় কম নষ্ট করি।”
বেশি কথা হয়নি বুঝতে পেরে ইফতেখার চুপ রইলো। শ্রাবণ আন্দাজ করতে পারে, সারাদিন হয়তো তার মাথায় এটাই ঘুরপাক খাচ্ছিলো যে অপু আসে কি না; শ্রাবণকে আজও কিছু বলে কি না!
সমাজিক রীতিমতো নতুন বউকে বউভাতে বাপের বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি তাই গাল ফুলিয়ে বসে আছে কান্তা। এতো কাছাকাছি বাড়ি হওয়াতে দুই পরিবারই যেন হালকাভাবে এড়িয়ে গেলো বিষয়টা। অথচ কাকে বুঝাবে, তার মন যে বড্ড চাইছিলো মায়ের সাথে ওবাড়ি চলে যাক এক্ষুণি। অথচ একবার তার কাছে জানতেও চাইলো না, যেতে ইচ্ছে করছে নাকি! এই ফোলা গাল কাউকে দেখানোর সাধ্যও হয়নি তার। বরং বিপুর সামনে ধারণ করেছে মনের মালিন্যতা৷ বিপু মুখ টিপে দুষ্টু হেসে গাল ফোলানিকে দেখে মন্তব্য করে, পরেরবার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তেলের পিঠা খাবে শাশুড়ির হাতে। তার গাল দেখে নাকি মনে পড়লো তেলের পিঠার কথা! কান্তা চোখ মটকে তাকায় এমন তিরস্কারে। তাতেই বিপু এবার বলে,
“সেদিনই না কান্না করছিলা, শ্বশুর বাড়ি আসার জন্য? আর কাল এসে আজই বাপের বাড়ি যাওয়ার তাড়া?”
কান্তা বিড়বিড় করে নিজের ভাগ্যকে দোষে।
“এজন্যই এতো কাছে বিয়ে হওয়া ভালো না। কেউ পাত্তাই দিলো না ঠিকঠাক আয়োজনে!”
“বিয়ে কি তবে পাশের গ্রামে হওয়া দরকার ছিলো?”
“চুপ করুন। আপনার জন্যই সব হয়েছে।”
“এখান থেকে ডাকলে সেখান থেকে সাড়া দেওয়া যায়, সকাল বিকেল গিয়ে ঘুরে এলেই তো হলো। এতো মন খারাপের কী আছে?”
“কাছে তো কী হইছে? আমার কী মন চায় না বাপের বাড়ি যাই?”
“আর সংসার? সংসার করতে কার মন চাইতো এতোদিন?”
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ধীর গলায় সুধায় বিপু। লাজুকবেশে দৃষ্টি নত করে নেয় কান্তা। ইশ! এই সংসার, এই মানুষ তো তার সাধের অর্ধাংশ ছিলো। আজ সাধের বড় পূর্ণতা। সুখের দুয়ারে ফুটে আছে সাধের মাধবীলতা। বিপু বাহুডোরের শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে রাখে তাকে। কান্তা পরম আবেশে মিশে থাকে নির্ভয়চিত্তে। প্রাপ্তির উত্তেজনায় কাঁপানো গলায় বলে,
“আমার ভয় কেটে গেছে গত সন্ধ্যাতে। আমি আর ভয় পাই না আপনাকে হারানোর, পাই না ভয় ভালোবাসতে।”
বিপুর মুখে প্রশান্তির ছাপ ভেসে উঠে নিমেষে। হাতের বাঁধন কিছুটা হালকা করে চোখ বুজে প্রাপ্তিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে অনুভব করে রাশি রাশিতে। তারও তো ভয় ছিলো সেই সময়টাতে, যখন দুশ্চিন্তায় জব্দ থাকতো দিবা কিংবা নিশিতে।
সপ্তাহ দুয়েক যেতেই কাগজপত্র প্রস্তুত করে শরীফ আহমেদের প্রাপ্য তুলে দেয় শ্রাবণের হাতে। যদিও আফজাল হোসেন মোটেও চাননি কবরস্থানের জমিটুকুর কাগজ তৈরি করতে, তবুও শ্রাবণ যখন শর্তের ভিত্তিতে রাজি হয়েছে ইফতেখার এই জমি দেওয়ার জন্যই পিতার প্রতি জেদ প্রদর্শন করলো। কেননা, তার প্রত্যাশা পিতাকে দায়মুক্ত করা। জমির অংশ যেদিক থেকেই হোক না কেন, প্রাপ্যটুকু ফিরিয়ে দেওয়াই ছিলো তার লক্ষ্য। অবশেষে লক্ষ্য পূর্ণ হলো। আফজাল হোসেন পৃথক করে রাখা অংশটুকুই শরীফ আহমেদের পরিবারকে দিয়ে দিলেন। ইফতেখারকে দিয়ে একটা সাইনবোর্ডও তৈরি করিয়ে নিলো শ্রাবণ। আজ সকালে একা একা কবর জিয়ারত করতে এসে পূর্বের সাইনবোর্ডটি বদলে দিলো শ্রাবণ নিজ হাতে। প্রবেশদ্বারে ‘পারিবারিক কবরস্থান’ এর জায়গায় ‘সামাজিক কবরস্থান’ লিপিবদ্ধ হলো। একটা পরিবার নয়, বরং একটা সমাজের সমাধি তথা শেষ আশ্রয়ের দুয়ার খুলে দিলো। মনের একটা কোণে যে কিঞ্চিৎ অপরাধপ্রবণতা আটকে ছিলো জমি গ্রহণ নিয়ে, এই রূপান্তর কাজের পর একটা কম্পিত নিশ্বাসের সাথে তার পুরোটাই যেন স্বস্তি হয়ে বেরিয়ে এলো। এবার মন শক্ত গলায় আর্তনাদ তুলতে প্রস্তুত, বাবার এই পাওনা নিয়ে সে ভুল করেনি। বরং বাবার মর্যাদা বাড়িয়েছে৷ আত্মগর্বে দুচোখের অশ্রু নেমে গাল দুটোও ভিজে উঠেছে৷ শ্রাবণ আঁচলের কোণে চোখ মুছে বাড়ি ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, পিছু দাঁড়িয়ে আছে আফজাল হোসেন। তাকিয়ে আছে সদ্য পরিবর্তন করে দেওয়া সাইনবোর্ডের দিকে। ভোরে নামাজ পড়তে বেরিয়ে এখন ফিরেছে। নিরিবিলি প্রথে শ্রাবণকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই এগিয়েছে। এমনিতেও প্রতিনিয়ত কবর জিয়ারতের অভ্যাস তার আছে। শ্রাবণ তাকাতেই সে সাইনবোর্ড হতে দৃষ্টি ফেরায়। ঠোঁটের ধারে অতি সামান্য হাসি ধরে মন্তব্য করে,
“ভালো উদ্যোগ।”
শ্রাবণ প্রত্যুত্তরে বলে না কিছুই। আফজাল হোসেন পরপরই বলেন,
“তবে ভালো সুযোগ হাতছাড়া করছো। বাজারের দিকে এক টুকরো জমি তোমায় আমি দিতে চাইছিলাম।”
“ধন্যবাদ, আব্বা। এতো ভালো সুযোগের প্রত্যাশা আমি করিনি।”
“তা না-ই করতে পারো। তবে তোমার পরিবারের জন্যই ভালো হইতো। যাকগে, আমার বাড়িতেও কম জায়গা নাই। তোমার মা যখন অসুস্থ, চাইলে এইখানে এনেই রাখতে পারো। এমন দুয়েকজন সদস্য আমার বাড়ি নিয়মিত খাইলেও ভাতের টান পড়বো না।”
“তা না-ই পড়তে পারে, আব্বা। আপনার যথেষ্ট আছে৷ আল্লাহ কাউকে দিয়ে পরীক্ষা করে, আবার কারোটা নিয়ে। কিন্তু যারটা নিয়ে নেয়, তার জন্যও বাঁচার পথ ঠিকই খোলা রাখে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি উপার্জন করে আমার মায়ের ভরনপোষণ করবো৷ আলাদা বাসায় রাখবো, চিকিৎসা করাবো, সাধ্যমতো প্রয়োজন মেটাবো। কিন্তু কোনো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি উঠতে দিবো না। আপনার করুনায় তো না-ই। আল্লাহ করুক তো, শিশিরের বিয়ের পর তার শ্বশুর বাড়িতেও না।”
“তা ঠিক আছে। তোমাদের ব্যাপার, তোমরা যেইটা ভালা মনে করো। তবে এতো অহংকার ভালা না, মা। যাকগে। আমি খুব খুশি হইছি শেষ পর্যন্ত জমিটা তোমাদের কাছে তুলে দিতে পেরে। আজ প্রকৃত অর্থেই দায়মুক্ত। বলি যে, তুমি রাগটাও শুধু শুধুই করো মা। বুঝছো? কিন্তু সব রাগের জয় তো আর হয় না। তাই বুঝে শুনে রাগ করতে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে যাক, বয়স হইলে ধীরে ধীরে এমনি বুঝতে পারবা।”
কথা বলে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। জয়ের হাসি! মানুষের স্বভাব, চরিত্র যে আমৃত্যু পরিবর্তন হয় না তার জ্বলন্ত প্রমাণ আফজাল হোসেন। অপু যেমন তার চরিত্র বদলাতে পারে না, আফজাল হোসেন বদলাতে পারে না স্বার্থপরতা। দুষ্টু মনের দুষ্টু চরকা ঘুরতেই থাকবে জীবনভর। কিন্তু তিনি কি ভেবেছেন, তার এই রূপটাকে শ্রাবণ ভুলে গিয়ে উপরের ভালো মানুষী খোলসটার মায়ায় পড়েছে? সে কী ধরতে বাকি রেখেছে যে আফজাল হোসেন হারজিতের খেলা খেলতে চেয়েছেন তার সাথে? এই তো, তিনি নিজেই প্রকাশ করে ফেললেন জিতে উঠার অহংভাব থেকে। কিন্তু তিনি ঠিক শ্রাবণকে কতটা চিনে উঠতে পারলেন এযাবৎ? ইফতেখারের প্রণয় তাকে আকৃষ্ট করে রাখতে পারে ঠিক, কিন্তু অন্ধ করেনি। সে ভালো মানুষটার প্রেমে পড়েছে ঠিক, তাই বলে খোলস ধারণ করা মানুষের মুখে জবাব দিতে ভুলে যায়নি। শ্রাবণ হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাই জবাব দিতে প্রস্তুত হয়ে চোখের পলক ফেলে। আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে ঠোঁটের ধারে তাচ্ছিল্যকর হাসির জন্ম দিয়ে প্রত্যুত্তর করে,
“হ্যাঁ, আব্বা৷ আপনি সত্যিই জিতে গেছেন। নিবো না বলেও জমিটা আমি নিয়েই নিলাম অবশেষে। তবে শ্রাবণ কিন্তু একদমই হেরে যায়নি। বয়সের দোহাইয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও ভুল করেনি। আমি জমিটা নিয়েছি, এই জমিতে আপনার দাফন করানোর জন্য।”
মুহুর্তেই মুখের হাসি উড়ে গেলো আফজাল হোসেনের। খেলাটা তবে তার মতো করে হারজিত হিসেবে গ্রহণ করলো শ্রাবণও! আর অন্যদিকে জমি নেওয়ার অমতে গিয়ে এইটুকুই নিতে রাজি হয়ে তবে এভাবেই তার পরাজয়ের হিসেব মিলিয়ে নিলো? শ্রাবণ ভারি আনন্দ পায় চেয়ারম্যানের মুখগহ্বরে উদিত হওয়া বিস্মিতভাব দেখে। রগরগে হচ্ছে চোখের শিরা! পরপরই সে আরও বলে,
“আল্লাহর হুকুমে যদি আমার মৃত্যুটাই আগে এসে যায়, তাতেও আমার কোনোরকম আফসোস থাকবে না৷ এমনকি, আপনি যদি আপনার স্বজনদের কাছে এমন আবদারও করে যান; এখানে দাফন না করানোর জন্য। তবুও আমার আফসোস থাকবে না৷ কেন জানেন তো? আপনার খাটাশ বাপজানও কিন্তু এখানেই ঠাঁই নিয়েছেন। তাতেই আমার বাবার সম্পদ হারানো বড় সার্থক। মানুষ বেঈমান হলেই কী, আল্লাহ তায়ালা তো উত্তম পরিকল্পনাকারী এবং সুবিচারক। এই দেখুন, যে সম্পদের কারণে আমার বাবার জীবনটাই অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলো; সেই সম্পদেই আপনার বাপজানের দাফন সম্পন্ন। এরচেয়ে বড় সুখবর আর হয়ই না আজ আমাদের কাছে। মানুষ পেয়ে গর্বিত হয়। আমরা হারিয়ে গর্বিত হয়েছি। আপনার প্রতি অশেষ ধন্যবাদ, জায়গাটাকে কবরস্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য৷ আপনার কারণেই আজ আমার প্রিয় এবং অপ্রিয় মানুষগুলোর শেষ আশ্রয় আমার বাবার সম্পদ। আলহামদুলিল্লাহ। আপনার আশ্রয়ও এখানেই হোক, খুব আশাবাদী।”
পূব আকাশ যেমন এসময় সূর্যের লালিমা স্পষ্ট করতে ব্যস্ত, মুখে মুচকি হাসির আভা সুস্পষ্ট রেখে এই যুবতী ঘরের তরে পা ফেলতে ব্যস্ত। পিছু দাঁড়ানো আফজাল হোসেনের মধ্যেই শুধু নেই কোনো ব্যস্ততার চাপ। পরাজয়ের হিংস্রতা থমকে রেখেছে তাকে। যতদূর পা ফেলে গেছে নারী, স্নিগ্ধ প্রভাত ধূসর করে গেছে দৃষ্টি সম্মুখে। প্রজ্জ্বলিত প্রাঙ্গণে তার অসময়ে শ্রাবণধারা বইছে কালবৈশাখী ঝড়ের বেগে!

(সমাপ্ত)

[শিশিরকে নিয়ে বেশি কিছু লিখলাম না। লিখতে গেলে আলাদা গল্প হয়ে যাবে। শ্রাবণময় ভুবনে শ্রাবণধারাই বইতে থাকুক। হ্যাপি রিডিং… 🌺]