শ্রাবণধারা পর্ব-৭+৮+৯

0
141

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০৭
(নূর নাফিসা)
.
.
দুদিন যাবত দেখা কথা হয়নি বিপুর সাথে। শ্রাবণও স্বর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তাই বের হয়নি বাড়ি থেকে। রাস্তায় পিচ ঢালাইয়ের কাজ চলছে। দূর হতেই বাতাসের ধাক্কায় আলকাতরার গন্ধ এসে শ্রাবণের নাকে ধাক্কাচ্ছে। সকালে খাওয়ার আগে এই গন্ধ পেট পর্যন্ত যেতেই বদ হজম হয়। মজিদা খালাম্মা যথেষ্ট খেয়াল রাখছে। ডিসপেনসারিতে ছুটে গিয়ে ওষুধ নিয়ে এসেছে অসুখ বাঁধার শুরুর দিনই। যদিও টাকা দিয়েছে শ্রাবণই। কিন্তু ছোটাছুটিতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি নিজ দায়িত্বে। আজ দুপুরে যখন খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো মজিদার চৌকিতে মাথা পেতে। মজিদা এসে খবর দেয়,
“চেয়ারম্যানের ছোড ছ্যাড়াডায় তোরে খোঁজতাছে। কোনো কাজ ঠিক করছে মনে হয়।”
শোয়া থেকে বসে যায় শ্রাবণ। খালাম্মার দিকে তাকায় মনে মনে হেসে। খালাম্মা তো তার কাজ পাওয়ার জন্য বড্ড ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সে তো জানে, কোনো চাকরির ব্যবস্থা বিপু করেনি। নিশ্চুপ চুলগুলো খোপা করে মাথাসহ ওড়না জড়িয়ে নেয় দেহে চাদরের মতো করে। বিপুকে বাড়ির প্রবেশদ্বারের আমগাছ তলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। শ্রাবণ উঠুন ফেলে এগিয়ে যায় সেদিকে।
“কেমন আছেন?”
“বেশ ভালো। ঘুমাচ্ছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“এবার জেগে উঠুন শীঘ্রই। বিয়ে আপনি কবে করবেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?”
আকস্মিক এমন প্রশ্নে হেসেই উঠে শ্রাবণ।
“পাত্রের ঠিক নেই, পাত্রীর পছন্দের স্থির নেই, সেখনে বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করে বসি কিভাবে?”
“মনের একটা ইচ্ছে আছে না যে, এখন করবেন না। আরও অনেক পরে।”
“ওটা আসলে বলা যাবে না। আমার প্রচেষ্টা তো চলছে একটা কাজের। দেখি, আগে নিজেকে ফিট করি।”
“বিয়েই যখন করবেন, নিজে ফিট হওয়া তো জরুরী না। হাসব্যান্ড কি ঘরের হাড়ি মাজার জন্য রাখবেন?”
“আপনি দারুণ কথা বলেন তো! পাত্র যেন একেবারে রেডি?”
“রেডিই তো।”
ভাবযোগে একটু নড়েচড়ে গলা খাঁকারি দেয় বিপু। ভাজ করা একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“প্রেমের আগে বিয়েই করবেন তো? এবার প্লিজ কোনো আপত্তি আনবেন না। প্রয়োজনে কোনোরকম অভিভাবক থাকলে আপনার পরিবারের এড্রেস দিন। কথা বলে নিবো।”
“আমিই আমার একমাত্র পরিবার। কাজ কি খুঁজি সাধে? এজন্য তো বিয়েটাও করে ফেলতে পারছি না হুট করে পাত্র পছন্দ করে। নিজেকে নিজে গড়তে হবে।”
“থাক, আর গড়তে হবে না। এটা রাখুন।”
“এটা আবার কি জন্য?”
“এটা ভিন্ন কিছুর জন্য।”
হাতে কাগজ দিয়ে এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে থাকে বিপু। ভ্রুর কার্ণিশে চিন্তার রেশ টেনে কাগজের ভাজ তার সামনেই খুলে শ্রাবন। ঠোঁট কার্ণিশে বেঁধে রাখা হাসিটাও বাঁধা অবস্থাতেই আছে। হাতের লেখা সুন্দর। সুন্দর, লিখে উঠা কথাগুলোও।
❝প্রিয় বর্ষাকালের শ্রাবণ,
প্রেম যখন প্রত্যাখ্যাত, বিয়েই হোক প্রিয় সম্পর্ক। তবুও আপনি আমার। বলুন, কবুল? ❞
ওষ্ঠদ্বয়ে ট্যাপা হাসি প্রস্ফুটিত হয় শ্রাবণের। বিপুর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসব কি পাগলামো না? চেয়ারম্যানের ছেলে একটা শিকড়হীনা মেয়েকে…”
“এ-ই নিজেকে বেশ বড় করে তুলছেন ফিট করার কথা বলে। এ-ই আবার শিকড়হীনার কথা তুলে ছোট হয়ে যাচ্ছেন! চেয়ারম্যানের ছেলের যখন আপত্তি ঠেকে না, আপনার আপত্তিটা কিসে? আর কোনো অযুহাত তুলে আমায় আশাহত করবেন না প্লিজ। বারবার প্রত্যাশা নিয়ে আসি।”
দৃষ্টিদ্বয় ভাবুক বেশেই নিচে নামিয়ে রাখে শ্রাবণ। বিপু তার নত দৃষ্টিতে সম্মতি খুঁজে পায়। ঠোঁট প্রাঙ্গণে নিমেষেই হাসি জাগায়। নরম কণ্ঠে বলে,
“কি হলো? ভাবেন পরে। আগে কবুল বলেন। তবেই কাজী পর্যন্ত যেতে পারি।”
দৃষ্টি নত রেখেই লজ্জিত হেসে ঘরে ছুটে যায় শ্রাবণ। নীরব প্রতিক্রিয়াই যেখানে স্পষ্ট সম্মতির লক্ষ্মণ, সেখানে বিপুর মন অতি উল্লাসিত। সে-ও তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে বাড়ির সীমা ছেড়ে রাস্তায় উঠে ব্যবস্থা করতে। আজও খালিদের সামনে। একদম সামনে। মূলত খালিদ তাকে দেখে তার জন্যই এই বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে বিপুর দিকে। হালকা করে কেশে পাশ কাটিয়ে চলে যায় বিপু। সে যে দেখলো, বড় ভাইকে কোনোরকম ভয়ই পেলো না। তবে বিড়ালের মতো পালিয়েছে। কিছুটা দূরত্বে তাদের অবস্থানে বিয়ের কথাবার্তা হালকা করে কানে ভাসতেই শরীরের রক্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হনহন পায়ে চেয়ারম্যান বাড়ি যায় খালিদ। মামাকে পায়নি। কিন্তু বিচার দিতে কার্পণ্য করেনি। মামীর সাথে বসে বসে গুছানো নালিশটুকু দিয়ে গেছে যথাযথ। শুধু তা-ই না, সে সপ্তাহ যাবতই লোক লাগিয়েছে বিপুর পিছু। প্রতিনিয়ত খবর যাচ্ছে সে সাত্তারের বাড়ি উঁকিঝুঁকি দেয়। কোত্থেকে এক রূপসী মেয়ে এসেছে, রূপে মজে তার পিছু নেয়। পারভীন যথারীতিই চিন্তিত হয়ে উঠেছে। ইফতেখার ভাত খাচ্ছিলো তখন। চুপচাপ শোনে তাদেরকে। খালিদ বলে,
“তোরে কইছিলাম, ইট্টু বুঝাইছ। তুই বড় ভাই। দুয়েকটা ধমক টমক দিলে মানতেও তো পারে।”
ইফতেখার মুখের খাবার গিলে প্রত্যুত্তরে বলে,
“এসব ব্যাপারে আমায় জড়িয়ো না তো। তুমিও তো বড় ভাই। আমার চেয়েও বড়। দেখোই যখন, দিতে পারো না দুয়েকটা ধমক?”
“এখন গায়ে মাখছ না তো। বড়র আগে ছোট বিয়ে কইরা আইলে হেরপর বুঝিছ নে লজ্জা কারে বলে।”
“করুক।”
খালিদ দ্বিতীয় কোনো বাক্য বলে না তার উদ্দেশ্যে। এই ছেলে হচ্ছে আরেক জাতের মানুষ। কোনো কিছু নিয়ে গভীর ভাবনাটুকু তার মধ্যে নেই। যা ইচ্ছে, করে বসবে। যা ইচ্ছেকে স্পর্শ করবে না, তার ধারেকাছেও যাবে না। দায়দায়িত্ব সব কাঁধেও নিবে না কখনো। একসাথে দুইটা কাজ দিলেও বাছাই করে একটা নিবে। অন্যটায় ফিরেও তাকাবে না আগেরটা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত। মামা যে এসব কি লালন পালন করছে, বুঝে আসে না খালিদের। যা বলার, মামীর কাছেই বলে উঠে যায় সে। মামা ফিরলে যেন ঠিকঠাক বলে। মনে মনে একটা দুঃখও তার। আজকাল সব জায়গায় মামা তাকে নিয়ে যায় না। এইযে এমপির বাড়ি গেলো মেম্বারের সাথে, পারতো না কি ভাগিনাকে সাথে নিতে? আগে তো সবার আগে তাকেই ডাকতো! মন মলিন করে উঠুনে নামতেই বকুল কাকার হুলস্থুল! গোয়াল থেকে বাছুর ছুটে গেছে। লাফিয়ে নেমে এসেছে উঠুনে। বকুল কাকা পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে খালিদের প্রতি।
“তাত্তাড়ি গেইট লাগান। তাত্তাড়ি লাগান। যাইবো গা। ধরতে পারতাম না।”
খালিদ কাদায় পা ফেলে দৌড় দেয়। এক জুতা আটকে যেতেই তা ফেলে রেখে দৌড়ায় গেইট লাগাতে। পরী বারান্দায় এসে বারান্দার গেইট লাগিয়ে দিয়েছে ঘরে ঢুকে পড়বে ভেবে। লাফিয়ে লাফিয়ে অনবরত চিৎকার করছে,
“আল্লাহ গো! আল্লাহ গো! বাছাও!”
পারভীন ও ইফতেখারও এসেছে ততক্ষণে। পরীকে চিৎকার সমেত লাফাতে দেখে ইফতেখার ঠাস করে মারে একটা মাথায়। তাতেই চেঁচানো, লাফানো শেষ তার। বকুল কাকা ছুটে বাছুর ধরতে, বাছুর ছুটেছে খালিদের দৌড় দেখে! যে-ই গেইট লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো, তুরন্ত গুঁতো দিলো উরুতে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গেছে খালিদ। পাড়াও দিয়ে বসেছে সাথে সাথে! এবার পারভীনও আৎকে উঠে,
“আয় হায়! বকুল ভাই, ধরেন ধরেন। মাইরা ফেলবো তো!”
খালিদের উপর আক্রমণ করতেই ইফতেখারও বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে। বকুল কাকা ধরতে গিয়েও পারেনি। ওপাশ থেকে সরে লাফিয়ে লাফিয়ে সারাবাড়ি দৌড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত দালানেই উঠতে যাচ্ছিলো। দালানে লণ্ডভণ্ড করার আগেই ইফতেখার বাছুরের কান টেনে ধরে ফেলে। দুই কান আঁকড়ে ধরতেই লাফালাফি থামে। রশি হাতে ঝটপট বকুল কাকা এগিয়ে এসে গলায় বেঁধে গোয়ালে নিয়ে ফিরে। খালিদ উঠে দাঁড়াতে পারছে না ঠিকমতো। একটা পায়ে কড়া আঘাত বসেছে। ইফতেখার তাকে ধরতে যায় এবার। বারান্দা পর্যন্ত এনে বসায়। দিনের মন্দার উপর খালিদ বিরক্ত হয়ে বসে বসে চাপ লাগা উরুতে মালিশ করতে থাকে অবিরত। তাতেই যদি একটু ব্যাথা কমে আসে। এমনিতে আর ক্ষতের সৃষ্টি হয়নি কোনোরকম। পরী একটু পরপর ফিক করে হেসে উঠে। তখন ভয় পেলেও এখন তার হাসি পাচ্ছে বড্ড। গরু গুতো দিয়েছে বলে কথা! পাঠা দেহের খালিদ ভাই একটা বাছুরের সঙ্গেই পেরে উঠেনি যে। পিছু ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে খালিদের উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাইজান, পাড়া দেওয়ার সময় আপনে বাছুরের ঠ্যাঙে ধইরা রাখতে পারলেন না? তাইলেই তো ব্যাথাডা পান না।”
তার ফিকফিকে হাসিতেই বড্ড রাগ হচ্ছিলো। এখন বিরূপ মন্তব্যের কারণে আরও ক্ষেপে গেলো। কটকটে চোখে তাই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় খালিদ। পরী মুখে হাত চেপে ধরে হাসতে হাসতে ঘরের ভেতরে চলে গেছে। তার মন্তব্যে যে খালিদের পাশে দাঁড়ানো ইফতেখারের মুখেও হাসি এনে দিয়েছে তাতেই আরও হাসার সাহস পেয়ে বসেছে পরী। বড় ভাইজানের হাসি চোখে মুগ্ধতা লাগার মতোই ঠেকে তার কাছে। কিন্তু এই মানুষটা হাসে কম। কাকার মতো মুখ গোমড়া করে রাখে যেন! তার আম্মাও তো কম হাসে। হাসার মধ্যে বিপু ভাইজানই এট্টু বেশি হে হে করে! আরেক তো আছেই ঢংগী আপা! যেন পৃথিবীতে বাপের একমাত্র মেয়ে সে-ই। সবাইকে নিয়ে মনে মনে ভাবতে ভাবতে আসবাব মোছামুছির কাজে হাত লাগিয়েছে পরী। গোয়ালে বাছুর বেঁধে বকুল কাকা এসেছে খালিদের পাশে। মালিশ করতে করতে ব্যাথা একটু কমেছে। সামান্য মেজাজ বকুল কাকার উপরও দেখালো। কি দায়িত্বে থাকে সে যে, গরু গোয়াল ছেড়ে পালায়! নিজের উপর দোষ চাপানো মনোভাবে নিশ্চুপ থাকেন তিনি। বকুল কাকার কাঁধে ভর করেই বাড়ি পর্যন্ত গেছে খালিদ।
মেম্বারের সাথে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন। এমপির সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছে গ্রামের রাস্তা বড় করার ব্যাপারে এবং সরকারি হাসপাতালটা আরও প্রশস্ত করার ব্যাপারে। বাড়ি এসে মেম্বারকে বিদায় দিয়ে আগে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন। খেতে খেতেই বিপুর নালিশ সম্পর্কে জানায় পারভীন। মনে মনে ক্ষিপ্ত হয় আফজাল হোসেন। ছেলেটা মান ইজ্জত নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে নাকি! এদিকে পারভীন জানায়, সেই যে দুপুরের আগে বেরিয়েছে। এখনো ফেরার নাম নেই। একটু যেন শাসন করে ছেলেটাকে। কেমন অগোছালো জীবন যাপন করে যাচ্ছে। তার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আফজাল হোসেন চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। দালানঘরের পাশে গিয়ে একটু কাজকর্মে লক্ষ্য গাঁথে। সুবিধা পেয়ে বাইরের দিকের গাঁথুনির কাজ কিছুটা ধরেছিলো মিস্ত্রি। বড় ছেলেটা পাশে থেকে থেকে ভালোই এগিয়ে নিচ্ছে সব। ছোটটার বেহাল দশাই তো তার দুশ্চিন্তার কারণ। ওটা এমন বাঁদর হলো কেন? মাগরিবের আজান পড়তেই নামাজ আদায় করতে যায়। ইফতেখারকে বলে দেয় তার সাথে কথা আছে। নামাজের পর ঘরে যেন বসে। তিনি যেতেই ইফতেখারের ভেতর হতে বিরক্তি নেমে আসে নিশ্বাসে। আজ বলতে গেলে সারাদিনই তার বাড়িতে কেটেছে। একটু বাইরের আলোবাতাস যে গায়ে লাগাবে, তার সুযোগ হয়নি এই ঘরের কাজ মিস্ত্রিদের বুঝিয়ে দিতে দিতে। এখন মিস্ত্রি গেলো, কোথায় সে একটু ছুটি নিবে। তা-ও হলো না বাবার কাজ পড়ে যায় যত তারই সাথে! পিছু হতে মা বলে দেয় নামাজ পড়তে যেতে। ইফতেখার নামাজ আদায় করে বাবার সাথেই বাড়ি এসে বসে আলাপে। প্রথমে ঘরের কাজকর্মের বিবৃতি, পরক্ষণে রাস্তার কাজের আলোচনাও। তারপর এমপির সাথে করে আসা সাক্ষাতের বিস্তারিত বর্ণনা! ক্রমে ক্রমে বিরক্তি নেমে এসেছে ঘন্টাযাবত এই আলোচনায় বসে বসে। এশার আজান পড়বে বুঝি এবার! আজকাল সকল কাজেই বড় ছেলেকে নিয়ে পরামর্শে বসেন তিনি। দায়িত্বের গুরুভার যেন পুরোটাই তার উপর অর্পণ করবেন নিজের অবনত কালে। কিন্তু গুচ্ছ গুচ্ছ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেওয়াটা পছন্দের না ইফতেখারের। যে কাজটা নেয়, তা নিখুঁতভাবে করে বলেই হয়তো বাবা ভাবে সে সব সামাল দিতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু বিরক্তি ভাবটা দেখে না কেন? বাবাকে থামাতে ইফতেখার কথার মাঝে বলে,
“হাসপাতালের কাজটা নিয়ে আপনি আপাতত একদমই ভাবতে বসবেন না, আব্বা। রাস্তার কাজ ধরেছেন, এটা আগে শেষ করুন। মেম্বারগোষ্ঠী লাফালেই শুধু চলবে না। টাকার লালসায় তারা বিরতি নিতে চাইছে না কিছুতে। একটার পর একটা লেগে থাকবে, আর তারা টাকা হাতাবে। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে আমি দেখি না। রাস্তার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বালুর মাঠে প্রজেক্ট করার কাজও ধরবেন না। খালিদ ভাই খুব পড়ে আছে এটা নিয়ে। তার চাচার সাথে জমি নিয়ে কিছু বিরোধ আছে না, সেই জন্যই এতো ব্যাকুল হয়ে উঠছে। সেখানে তার চাচারও তো জমি আছে। আপনি নিলেই তার জমির পরিমাণ কমে আসবে। এতে আপনার ভাগ্নে খুশি। কিন্তু আপনি চতুর্দিকের কাজ না করে একটা একটা সুষ্ঠুভাবে ধরেন। আর যদি সব একত্রেই ধরতে হয়, তবে আমার উপর দায়িত্ব চাপাবেন না। দশ কাজ একত্রে চালানোর দায়িত্ব আমি নিবোই না। কাকে দিবেন, তা আপনিই ভালো জানেন।”
“খালিদ তো ভুল কিছু কয় নাই। তারে আবার মন্দদিকে টানোছ ক্যা?”
“মন্দ দিকে টানিনি। চাচার পরাজয়ের নিমিত্তে প্রতিহিংসা আছে তার। সেসব বাদ দেন। তাদের ব্যাপার। আমি যেটা বলছি, আপনি এতো কাজ একসাথে নিবেন না। রাস্তা বড় করছেন, বাজারটাও বড় দরকার। মানুষের সমাগম বাড়বে। বাজারের দোকানপাট ভেঙে তো এমনিতেই ছোট হয়ে গেছে। বালুর চড়ের আরও কিছু অংশ ছাড়েন বাজারের জন্য। বড় না হলে চলবেই না। প্রজেক্ট করার পরে দেখবেন সমস্যা হয়ে গেছে। রাস্তা শেষ করেই বাজারের সীমা নির্ধারণ করেন আগে। তারপর প্রজেক্টের পার্টি ডাকবেন।”
কথা মন্দ বলেনি ছেলে। যেন একটু ভাবতেই বসে গেলো আফজাল হোসেন। ইফতেখার বললো,
“আরো কিছু বলবেন? নয়তো আমি উঠতাম।”
“বিপু ফিরে নাই। না?”
“না।”
“যা। দেহিস কই কই ঘুরে। কান ধইরা বাড়িত পাঠাইস।”
ইফতেখার বসা হতে উঠতে দেরি, আঘাতপ্রাপ্ত পায়ে হালকা ভরে হাঁটতে হাঁটতে খালিদ এসে দরজায় হাজির। ছুটে এসে হাঁপিয়ে গেছে যেন। ইফতেখার দাঁড়িয়ে গেছে আর সামনে না এগিয়ে। তার অবস্থা দেখছে নিশ্চুপে। আফজাল হোসেন বলে,
“কি রে? তুই এম্নে হাঁটোছ ক্যা?”
“পায়ে গরু গুতা দিছে দুপুরে। আমার কথা বাদ রাখেন। আপনারে ফোন দিতাছি, ধরতাছেন না।”
“মসজিদে যাওয়ার সময় বন্ধ করছিলাম।”
“বিপুর পিছনে লোক লাগাইছিলাম, মামা। এইমাত্র ফোন দিলো, হেয় মেয়েটারে নিয়া ভাইজ্ঞা যাইতাছে নাকি!”
“কি কছ!”
“হো। সাত্তারগো বাড়িত এক মেয়েলোক আইছে। তারে নিয়া ভাগছে। দূরে যায় নাই। দিপু, জলদি আয়। হাতে নাতে ধরতে হইবো।”
ইফতেখারের ঠোঁটের চাপে আর নিশ্বাসে সমানতালে বিরক্তি ভাসে আবারও। একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে! তার যেন রেহাই নেই! আফজাল হোসেনের আদেশে খালিদকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে মোটরসাইকেলে। পা ভেঙে হলেও যেন এই মুহুর্তে ধরে নিয়ে আসে ক্রুদ্ধ আফজাল হোসেনের নির্দেশ। কাজের মধ্যে কোনো বিরতি না থাকায় বিরক্ত হলেও ইফতেখারের মধ্যে এতো উত্তেজনা নেই। আদেশ মোতাবেক মোটর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে মাত্র। খালিদ পিছু বসে বসে বিপুর পিছু লাগানো ছেলেটাকে ফোন করছে, তারা কোন পর্যন্ত গেছে তা ঠিকঠাক বলতে। বাজারের কাজী অফিসে যায়নি। অফিস থেকে কাজীর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে এইমাত্র হাঁটতে শুরু করেছে মেয়েটাকে সাথে নিয়ে। পিছু বসে বসে উত্তেজিত গলায় বারবার ইফতেখারকে বলছে,
“জলদি যা, জলদি যা। বেশি দূর যায় নাই। রাস্তায়ই ধরমু। আজকা খবর আছে তাগো। কত্তবড় সাহস! চেয়ারম্যানের পোলা নিয়া ভাগে ওই মেয়ে!”
ইফতেখারের বিরক্ত লাগছে তার ঘ্যানঘ্যান। তবুও সহ্য করছে বড় ভাই বিধায়। ছোট হলে বোধহয় নামিয়েই দিতো হেঁটে হেঁটে যাওয়ার জন্য। বাজার অতিক্রম করে একটু এগোতেই তাদের ধরে ফেলে দুজনে। সত্যিই পালিয়েছে বিপু শ্রাবণকে নিয়ে। হুট করে এসে মোটরসাইকেল থামতেই চমকে উঠে দুজনে! ক্রুদ্ধ খালিদ ভাই নেমেই কলার মুঠোয় ধরে বিপুর৷ শ্রাবণ বড্ড ভয় পেয়ে যায়! বিপুর চোখেমুখেও ভয়। ইফতেখারও নেমেছে মোটরসাইকেল ছেড়ে। বিপুর হাতের কাগজ টেনে নেয় সে। দুটি জন্ম সনদ কার্ড প্যাচিয়ে নেওয়া হাতে। তা খুলেই থমথমে চোখে একবার বিপুর দিকে আরেকবার শ্রাবণের দিকে তাকায় ইফতেখার। ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে ওড়নায় মুখ চেপে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রাবণ। এ কি হলো!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০৮
(নূর নাফিসা)
.
.
কলার পাকড়ে ধরা খালিদের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে বিপু।
“আরে, হচ্ছে কি! খালিদ ভাই!”
“কই যাস? মেয়েলোক নিয়া কই যাস?”
“কলার ছাড়ো। এইটা কেমন?”
“কলার? তোর ঠ্যাং ভাইঙ্গা বাড়ি নেওয়ার হুকুম পড়ছে।”
ইফতেখার ভ্রু সামান্য কুচকানো রেখে উত্তেজনাহীন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“দুপুর থেকে বাড়ি যাসনি কেন? কাজী বাড়ি নাকি যাস এখন?”
উত্তর দেয় না বিপু। দৃষ্টি নামিয়ে নেয় নিচে। পুনরায় সে বলে,
“বাড়ি যা।”
বিপু মুখ নত রেখে এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। খালিদ এক হাতে কলার পাকড়ে রেখেই অন্যহাতে বাহু ধরে টানে তাকে।
“আয়, কাজী বাড়ি যাওয়াই। পালায় বিয়ে করার শখ মামা মেটাইবো নে আজ।”
এক কদম এগিয়েও পিছু ফিরে পরক্ষণে শ্রাবণের দিকে ক্রুদ্ধ চোখে দেখে। ইফতেখারকে জিজ্ঞেস করে,
“আর এই মেয়ের কি করবি?”
“আমি দেখছি।”
খালিদ টানতে টানতে হাঁটতে থাকে বিপুকে নিয়ে। যেন ভাই নয়, কোনো চোর ধরেছে পাকড়ে। বিপুও চোরের মতোই বিষাদগ্রস্ত হয়ে তার টানে টানে চলছে। সেই খবর দেওয়া ছেলেটাও তাদের থেকে খুব দূরে ছিলো না। খালিদের একা টানতে কষ্ট হচ্ছে ভেবে অন্য বাহুতে ধরে যোগ দেয়। এতোক্ষণে কলার ছেড়েছে খালিদ ভাই। কিন্তু বিপুর দুই বাহু দুদিকে বাঁধা। মুখাবয়ব ডুবে আছে দুশ্চিন্তায়। বাবার সম্মুখীন হওয়ার দুশ্চিন্তা! ইফতেখার তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড। তারা বাজার অতিক্রম করতে থাকলেই পরক্ষণে তাকায় পাশে দাঁড়ানো শ্রাবণের দিকে। শ্রাবণ এখনো মুখে ওড়না চেপে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেও ভয়ের উপস্থিতি। তাকিয়ে আছে বিপুর অবস্থার দিকেই। এমন কিছু হবে, ভাবেনি সে। ইফতেখার কাগজ দুটো পুনরায় প্যাচিয়ে নেয়। তা প্যান্টের পকেটে রেখেই নিশ্চুপ উঠে বসে মোটরসাইকেল স্টার্ট দেয়। এতোক্ষণে ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আনে শ্রাবণ। ইফতেখার তার দিকে ফিরে বলে,
“কি হলো? উঠুন।”
মুখে চাপা ওড়না ছেড়ে দেয় শ্রাবণ। চিন্তিত মুখে মোটরসাইকেলে বসে ইফতেখারের পিছু। কিন্তু একদম ছুঁয়ে দেখেনি ইফতেখারকে। মোটরসাইকেলেই শক্ত করে ধরে রেখেছে পড়ে যাওয়ার ভয়ে। ভর ছাড়া উঠে বসতেও তার সময় লেগেছে। তার কর্মকাণ্ডে খেয়াল রাখে ইফতেখার। তাই চলতে শুরু করার আগে বললো,
“ধরে বসুন। পড়ে যাবেন।”
“পড়বো না।”
“পড়লে আমার দোষ না।”
“ঠিক আছে।”
দুই হাতেই মোটরসাইকেল পাকড়ে ধরেছে শ্রাবণ। তবুও তাকে ধরে না। রাস্তার অনুকূলেই চলতে শুরু করেছে ইফতেখার। গতিও কিছুটা ধীর রেখেছে শ্রাবণের না ধরে বসার জন্য। মোটরসাইকেল এসে যথাযথ থেমেছে কাজী বাড়িতে। শ্রাবণ চুপচাপ নেমে গেছে। মুখাবয়ব হতে দুশ্চিন্তা দূরে হচ্ছে না তার। নেমেই বললো,
“তোতাপাখির জন্য ভয় হচ্ছে।”
ইফতেখারও নামতে নামতে জিজ্ঞেস করে,
“তোতাপাখি কে?”
“আপনাদের আতা গাছের বিপু।”
মোটরসাইকেল লক করে তার দিকে চোখ তুলে তাকায় ইফতেখার। নাম বলার ধরনের কারণেই এমন নিরব তাকানো। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা সত্ত্বেও এই তাকানোয় লজ্জা অনুভূত হয় শ্রাবণের। গম্ভীরমুখের শান্ত দৃষ্টি অদ্ভুত রকম সুন্দর। এই অদ্ভুত সৌন্দর্য ক্রমশই লজ্জারুণ পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ। চাবি পকেটে রেখে ইফতেখার জবাব দেয়,
“তোতাপাখির কিছু হবে না। ওটা ফুপাতো ভাই হয়। আব্বার আগেপিছে থাকে। নিশ্চিন্তে থাকুন। চলুন।”
মাথার পরে যাওয়া কাপড় পুনরায় তুলে দেয় শ্রাবণ। চলতে থাকে ইফতেখারের পিছু। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। জীবনে বহু সিদ্ধান্তই একা একা নিয়েছে। তবুও এই সিদ্ধান্তটা বড্ড সংকোচের কারণ। হয়তোবা জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায় বলেই। মাস খানেক আগেও তো ভাবেনি, এই গম্ভীর লোকটাকে পছন্দ করে বসবে! কেন ভালো লাগে তাকে? লোকটা অল্প সময়ের মায়ায় পড়ে গেছে বলে? নাকি জীবনে প্রথম প্রেম হিসেবে তাকে ডেকেছে বলে? এইতো, নিজেকে বড্ড বিশেষ বিশেষ মনে হচ্ছে। এমন বিশেষ হওয়ার সুযোগ জীবনে আরও এলেও কখনো সুযোগটুকু দেওয়া হয়ে উঠেনি কাউকে। কিন্তু এই মানুষটাকে দিয়ে দিলো। ভেবে ভেবেই দিলো। একদম জোর জবরদস্তি নয়। পছন্দসই দেওয়া হলো। নিজ বাড়ির সদস্য অনুপস্থিত থাকলেও চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলে বিয়ে করতে এসেছে জেনে কাজী বাড়ির মেহমানের অভাব হলো না। সাক্ষী ক’জন লাগবে, কাজী যেন ইচ্ছেমতোই নিতে পারে উপস্থিতদের মধ্য হতে। এইযে, আশেপাশে থাকা, পাশের ঘর হতে উঁকি দেওয়া, দুয়ার হতে উঁকি দেওয়া৷ তারউপর মৌলভী আর কাজি সাহেব তো আছেনই! সব আজকের এই বন্ধনের সাক্ষী। যদিও মূল সাক্ষী হওয়ার কথা ছিলো বিপুর। বেচারা ধরা পড়ে গেলো। ইনি কি খালিদ ভাইকে কোনোভাবে তখন ফেলে আসতে পারতেন না?
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পুরুটা সময় শতরঞ্জিত অনুভূতি ঘিরে রেখেছিলো শ্রাবণকে। ভয়, পছন্দের পূর্ণতা, কাজী বাড়ির সমাগমের আনন্দ, অসুস্থতা, লজ্জা, সংশয়, দুশ্চিন্তা! সবই দশদিক হতে ঘিরে ধরেছে তাকে। সর্বক্ষণ চুপ থাকলেও দেনমোহর ধার্যের সময় মুখ ফুটিয়ে ফেললো সে। ইফতেখার দুই লাখ বলেছিলো। শ্রাবণ মুখ খুলে বলে ফেললো,
“মাত্র দুই লাখ? বেশি করা যায় না?”
এই সমাগমে ইফতেখার নিজেই যেন একটু বিব্রত হয়ে গেলো। কিঞ্চিৎ বিস্ময় ধরে রাখা চোখে তাকিয়ে বললো,
“কত?”
“আপনি চেয়ারম্যানের বড় ছেলে। পাঁচ লাখ দিন। সমস্যা নেই, দেনা থাকবে আপনার যতদিন ইচ্ছে।”
কোলে দৃষ্টি রেখে এক হাতের আঙুলের সাথে অন্য হাতে খেলতে খেলতে মতামত ব্যক্ত করে শ্রাবণ। আশপাশের দুয়েকজন হেসেও উঠেছে মৃদুস্বরে। কিন্তু তারা দুজনের কেউই হাসেনি। ইফতেখার দ্বিতীয় কোনো কথাও বলেনি। বাবার অনুপস্থিতিতে এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে এমনিতেই মনের ভেতর নিশপিশ ভাব অনুভব করছে। তারউপর এতো মানুষের সামনে কোনো আপত্তি, আলোচনায়ও যেতে চায় না। হলে হোক পাঁচ লাখই। দেনাই তো আছে। উপার্জনে সক্ষম না হলে ধনসম্পত্তিও আছে। তাই কোনোরকম ভাবনায় যেতে চায় না ইফতেখার। পাঁচ লাখই ধার্য হয়। কাজী বাড়ি ছেড়ে পুনরায় ইফতেখারের পিছু মোটরসাইকেলে চড়েছে শ্রাবণ। এবার ইচ্ছে থাকলেও ধরে বসা হলো না মনের সংশয়ে। ইফতেখার ধীর গতিতেই বাজার ছেড়ে তাকে নিয়ে বালির চড়ে এসেছে। একপাশে দোকানগুলো, অন্যপাশে দুয়েকজন মানুষের উপস্থিতি। যারা হাওয়া খেতেই ছাইরঙা আঁধারে ঠাঁই নিয়েছে। আর নদীর কাছাকাছি মাঝামাঝিতে অবস্থানরত আছে এই নব দম্পতি। শ্রাবণ মোটরসাইকেল থেকে নেমে মোটরসাইকেলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসটা ভালো লাগছে। কিন্তু শরীর ও মনের অবস্থা ক্রমশই শোচনীয় হচ্ছে। ইফতেখারও একটু চিন্তিত। মনে মনে ভাবছে কিছু। হয়তো নিজেকে উপস্থাপন করার ব্যাপারেই। সে নেমে একটু এগিয়ে গেছে নদীর দিকে। ফোন হাতে নিয়ে সাইলেন্ট অবস্থা সরালো, কল লিস্ট দেখলো। খালিদ ভাইয়ের নম্বর হতে দুইটা কল এসেছে কয়েক মিনিট আগে। আর বিপুর নম্বর হতে অনেকগুলো কলই এসেছিলো ফোন সাইলেন্ট অবস্থায়। যখন সে বাবার সামনে আলোচনায় বসে ছিলো, তখন। এছাড়া আর কোনো নতুন তথ্য নেই। ফোন পকেটে রেখে সে আরও কিছুক্ষণ পায়চারি করে ওদিকেই। শ্রাবণ একটু দূর হতে তাকেই দেখে। তাকে বুঝতে চেষ্টা করে। নিজ মনের দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা তো আছেই! ইফতেখার এগিয়ে আসে আবার তার কাছে। জিজ্ঞেস করে,
“কি ভাবছেন?”
শ্রাবণ প্রশান্ত হাওয়ায় নিশ্বাস ভাসিয়ে শান্ত গলায় উত্তর দেয়,
“ভাবছেন তো আপনি।”
“বুঝতে পারছেন তবে? আপনি একটু বেশিই তাড়ায় ফেলে দিলেন আমাকে। বাড়িতে অতিরিক্ত ঘর নেই। ঘরের কাজ বহু বাকি।”
“আপনি কোথায় থাকেন তবে?”
“দুই ভাইয়ের এক ঘর। আপনি গেলে ভাইকে বাইরে ফেলে দিতে হবে।”
ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ঠাঁই দিতে চায় যেন শ্রাবণ। শান্ত স্বরেই প্রত্যুত্তর করে,
“বিয়ের প্রস্তাব তো আমি দেইনি। আপনিই দিলেন।”
“ওইযে, ছুটে যেতে চাইছিলেন।”
“চাইলে যেতেই পারতাম, এখনো।”
“আজ চাননি বলে কাল কিংবা পরশুও যে চাইবেন না, তা তো বলা যায় না।”
“আপনি ভয় পান, আমি জানতাম না।”
“নিজের জিনিস হারানোর ভয় সবারই থাকে।”
“এতো অল্পতে নিজের জিনিস চিনে উঠা যায়?”
“এক পলকেও যায়।”
“কেমন সন্দেহ লাগছে আপনাকে। আপনার উদ্দেশ্য কি, সত্যি করে বলুন তো?”
“কিসের উদ্দেশ্য?”
“এইযে, স্বল্পতায় এক শিকড়হীনাকে বেঁধে রাখার উদ্দেশ্য।”
এবার ঠোঁট কার্ণিশে স্পষ্ট মৃদু হাসি ভেসে উঠে ইফতেখারের।
“পরিবারের বাইরে মোটরসাইকেল আমার অতি প্রিয় এখন পর্যন্ত। যার আয়নায় আপনি নিজের ছবি এঁকে দিয়েছেন। তাই দিনরাত এক করে আপনাকেই দেখতে হচ্ছে। মানুষ এভাবেই বুঝি প্রেমে পড়ে যায়? আমি জানতাম না। কিন্তু মনে হলো তা-ই।”
“ছবি এঁকে দিয়েছি! কখন? কোথায়?”
আরও কাছে এগিয়ে আসে ইফতেখার। শ্রাবণের পিছু কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলের আয়নায় দুজনকেই ভাসিয়ে তোলে।
“ওইতো।”
লজ্জায় আয়নায় তাকিয়েও দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে শ্রাবণ। বিড়বিড়িয়ে বলে,
“সে তো এখনকার দৃশ্য।”
“সেদিনের দৃশ্য বাজারে ছিলো। ভুলে গেলেন?”
একই অবস্থায় থেকে শ্রাবণ বিড়বিড় করে,
“কানে ফুলটা ঠিকমতো গুজে দিতে একটু আয়নাই তো দেখছিলাম।”
“এটাই তো চরম অপরাধ করে বসেছেন। নিজের না করা পর্যন্ত কেমন হারিয়ে যাওয়ার সংশয়ে ডুবে ছিলাম।”
“এভাবে না পালালেও তো হতো।”
“হতো না।”
“কেন?”
“সম যোগ্যতাহীন আত্মীয় করার লোক আমার আব্বা না।”
“এখন জায়গা দিবে?”
“কি জানি। তাইতো বিয়ে করলাম। দেখি, কি হয়। এখানে থাকবেন আরও কিছুক্ষণ? না যাবেন?”
“আমার ইচ্ছে করছে না যেতে।”
ইফতেখার কাছ ছেড়ে পুনরায় সামনে এগোয় আরেকটু সময় অতিবাহিত হওয়ার জন্য। মৃদু বাতাসে মনের সংশয়ও যেন হালকা হচ্ছে অনুভব হয়। শ্রাবণেরও হয়তো বা। তাই চাইছে আরও কিছুক্ষণ থাকতে। একটু নিরব থেকে সে জিজ্ঞেস করে,
“মজিদা কাকি তো আপনার নিকট কোনো আত্মীয় নয়, তাই না?”
“উহুম।”
“তবে আপনি উনার পরিচয়ও উল্লেখ করবেন না। পরিচয় হীন আছেন, একদম হীনই থাকেন।”
“কেন?”
“আবারও কেন! আমি তো আপনার পরিচয় নিয়ে পড়ে নেই। আমার আব্বার মান যেন না যায় ছোটখাটো পরিচয়ে। তাই আপনি দূরের মানুষ, পরিচয়ও দূরেই থাকুক। আচ্ছা, বাদ দেন। বাড়ি চলুন আগে। দেখি কি হয়। রাত বাড়ছে। আমার ক্ষুধা লেগেছে। দোকান থেকে কিছু নিয়ে আসবো আপনার জন্য?”
“পানি দরকার এখন।”
“নদী পাশেই।”
বলেই দোকানের দিকে এগিয়ে যায় ইফতেখার। শ্রাবণ তার কথায় মৃদু হাসতে গিয়েও হাসতে পারে না। বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বিয়েটা কি হওয়ারই ছিলো? সিদ্ধান্ত ভুল নিলো না তো? ওবাড়িতে কি হবে? এতো অস্বস্তি লাগছে কেন? মোটরসাইকেলে ভর করে দাঁড়ায় শ্রাবণ। শরীর ও মনের অস্থিরতা সমতালে বেড়ে যাচ্ছে। ইফতেখার পানি নিয়ে আসতেই বলে,
“একটু হেলান দিয়ে কোথাও বসতে পারলে ভালো হতো। আমার খারাপ লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে।”
“এখানে বসবেন কোথায়? বালিতে? হেলান দেওয়ারও তো জায়গা নেই।”
জবাব দেয় না শ্রাবণ। দুহাতের ভরই মোটরসাইকেলে ফেলে। চোখেমুখে ক্লান্তি দেখতে পাচ্ছে ইফতেখার। তাই বললো,
“চলুন, বাসাতেই ফিরি।”
“হুম।”
ক্যাপ খুলে দিতেই পানির বোতলটা হাতে নেয় শ্রাবণ। এক ঢোক পানি গিলেই বোতল ফিরিয়ে দেয়। ছোট কেকের প্যাকেটটা এগিয়ে দিলে নিলো না শ্রাবণ।
“আমি কিছু খাবো না। চলুন।”
“অযথা আনলাম!”
এক প্যাকেট ছিঁড়ে একটা কেক সে খেয়ে নেয় গপাগপ। শ্রাবণ ক্লান্ত চোখেও তাকিয়ে দেখে তার গলদ করণের ব্যস্ততা। খাওয়ার বেগ দেখে মনে হচ্ছে, পালিয়ে বিয়ে করেও কোনো দুশ্চিন্তা নেই তার মুখে। কি মানুষ! ভেবেছে দুটোই খেয়ে নিবে। তবে তা করেনি। একটা শ্রাবণের কাঁধের ব্যাগটা টেনে রেখে দেয়। পকেট থেকে তার এবং শ্রাবণের জন্ম সনদও ব্যাগে রাখে। মোটরসাইকেলে চড়ে বসে পরক্ষণে। মোটরসাইকেলে উঠে বসতেও দুর্বলতা অনুভব করছে শ্রাবণ। তখনকার অর্ধেক শক্তিও যেন নেই দেহে। এবার ইফতেখারের কাঁধে ভর করেই উঠে বসে। মোটরসাইকেল চলতে শুরু করলেও কাঁধ থেকে হাত সরায়নি। আর তখন সংশয়ে স্পর্শই করছিলো না তাকে। কিন্তু ইফতেখার বালির মাঠ ছাড়ার আগেই পুনরায় থেমে যায়। তার কাঁধটা পুরো গরম হয়ে গেছে এইটুকু আসতেই। শার্টের উপরে তাপমাত্রাটা সাথে সাথেই বুঝে উঠতে পারেনি তখন। এখন উপলব্ধি করতেই থেমে শ্রাবণের হাতের উপর হাত রেখে মুখাবয়বে বিস্ময়ের ঠাঁই দেয়। পিছু ফিরে কপাল ছুঁয়ে বলে,
“আপনার তো খুব জ্বর! বলেননি কেন এতোক্ষণ? ডাক্তার দেখাবেন?”
মাথাটা ভারি লাগছে, তাই সে মাথার ভারও হেলিয়ে দেয় ইফতেখারের পিঠে।
“আমার জ্বর আজ দুদিন ধরেই। আপনি বাসায় চলুন আগে।”
ইফতেখার বাড়ির উদ্দেশ্যে পথ কাটে। শ্রাবণ এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে পিঠেই মাথা পেতে রেখেছে। ইনিই বিপুকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠানোর লোক। ইনিই সেদিনের বৃষ্টিতে দূর হতে বৃষ্টিবিলাসীকে ভিজতে দেখে মাথা হতে ছাতা ফেলে দেওয়ার লোক। শ্রাবণ আড়ালে তাকে দেখতে পেয়েছিলো তাই বিপুকে ফেরত পাঠিয়েছে। বিপু সেই পাঠানো সামগ্রী ফেরত এনে টাকার কথা প্রকাশ করলে কোনোরকম না বলেই ইফতেখার পকেট থেকে টাকা বের করে চাপিয়ে দেয় বিপুর হাতে। ভাইয়ের হঠাৎ বদলে যাওয়া নবরূপ দেখে আনন্দ চিত্তে নিজের মাথার ছাতাও ফেলে দেয় বিপু। সে তো ভাবতেই পারেনি, ভাইও কারো প্রেমে পড়ে যাবে এভাবে! দুয়ের মধ্যস্থ বাহক হওয়াটা যেন দায়িত্বস্বরূপ নিয়ে নিয়েছে কাঁধে। তার বিশ্বাস ছিলো, কান্তা আর তার ব্যাপারটা পরিবারে একমাত্র ভাইই পাকাপাকি করতে পারবে। তাই ভাইয়ের চিঠির ডাকবাহক হওয়াটাও চরম সৌভাগ্যের মনে করে ছুটে যেতো কিঞ্চিৎ আহ্বান পড়তেই। ভাই ভাবির পুরো যোগাযোগটাই যেন তার মাধ্যমে পৌঁছায়। আর বারবারই বেকুব খালিদ ভাইয়ের কড়া নজরে শুধু সে-ই ফাঁসে!
চলন্ত মোটরসাইকেলে ঠান্ডা বাতাসটা ভালোই লাগছিলো উত্তপ্ত দেহে। যেন বাতাসের বেগে উত্তপ্ততা অনেকটা ছুটে গেছে এতোক্ষণে। যদিও তা নয়। মোটরসাইকেল চেয়ারম্যান বাড়ির গেইটে প্রবেশ করতেই মাথা তুলে নেয় শ্রাবণ। ইফতেখার ঘরের সামনে এসেই থামে। শ্রাবণ নেমে যায়। ঘরের ভেতরের সদস্যদের চোখ পড়ে এদিকে! মেয়েটাকে পিছু বসিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে ইফতেখার! এতোক্ষণ যাবত বিপুর উপরই ধাওয়া যাচ্ছিলো। ভাইয়ের বিয়েটা যেন সম্পন্ন হয়ে উঠে, সেজন্য চুপ ছিলো। মায়ের থাপ্পড়, বাবার বকাঝকা সব সহ্য করছিলো নিশ্চুপে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থেকে। প্রকাশ করলেই বিয়ে ভাঙার ভয়! খালিদ ভাই তাকে বাড়ি আসার জন্য ফোন করার সময় মনটা বলছিলো ভাই যেন ফোন রিসিভ না করে। যদি বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে বলেই দেয় সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তবে না তখনই আবার খালিদ ভাই ছুটে যায় ভাইকেও আটকে দিতে! এখন দুজনকে একত্রে ফিরতে দেখে কিছুটা শান্তি লাগছে। বাকিটা অশান্তির স্রোতে ভাসছে। কি যেন হয়! কি যেন হয়!

“শ্রাবণধারা”
পর্ব- ০৯
(নূর নাফিসা)
.
.
দৃষ্টি নত রেখে ইফতেখারের পিছু পিছু ঘরে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণ। ইফতেখার সকলের মুখে তাকিয়েই ভাবভঙ্গি দেখে। এতোটা সময় পর সে এই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তা সকলের চোখেই বিস্ময়ের কারণ। খালিদ মামার উদ্দেশ্যে বলে,
“মামা, এইটাই সেই মেয়ে।”
আফজাল হোসেন তাকিয়ে দেখে শ্রাবণের দিকে। বলেন না কিছুই। পারভীনের আনচান মন জিজ্ঞেস করে,
“কে সে?”
ইফতেখার স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেয়,
“শ্রাবণ। আমরা বিয়ে করে ফেলছি, মা।”
“কিহ!”
পরী দরজার কাছে থেকে জ্বিভ অর্ধেক বের করে দিয়ে মাথায় হাত তুলেছে। এইটা কি শুনলো সে! ঘরে এতোক্ষণ কি চলছিলো আর এখন কিসের উদয়ন ঘটলো! কাহিনী মূল চরিত্র তো ছোটভাইজান না। খলনায়কের মতো ঝাপিয়ে পড়লো যেন তার বড় ভাইজান! ওদিকে পারভীনের বিলাপ শুরু!
“আল্লাহ! আর কি দেখা বাকি আমার? আর কি দেখা বাকি? সব একবারে দেখায় দেও। ছোট পোলা নিয়া কয়দিন যাবত তামাশা, আর বড় পোলা নিয়া নতুন জ্বালা! কি অপরাধ করছিলাম রে, বাপ? কি অপরাধ করছিলাম যে বাপ মা ভুইলা বিয়া কইরা সারছোস? কো আমারে, কো। প্রায়শ্চিত্ত কইরা যাই কিছু মরার আগে।”
কিছুই বলে না ইফতেখার। খালিদ তো স্তব্ধীভূতই হয়ে আছে! এমন দেখাই যে ইফতেখার দেখবে, তা তো কল্পনাও করেনি তখন বিপুকে নিয়ে আসার সময়। যাকে গুরু মনে করে নিয়ে গেলো, সে-ই ঘটনার কেন্দ্রীয় আসামী হয়ে গেলো! আফজাল হোসেন গম্ভীরমুখে বলেন,
“বাপের ইজ্জত নিয়া ভালোই টানাটানি লাগছোস দুই ভাই। সন্ধ্যায় খবর আসে ছোটজন পালাইছে। রাতে খবর হয় বড়জন সেই মাইয়া বউ কইরা নিয়া আসছে। সকালে এলাকা জুইড়া মুখেমুখে খবর হইবো চেয়ারম্যানের। বাহ! খুব ভালা।”
“আপনি রাজি হইবেন না, তাই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হইছে আব্বা।”
“তো এহন সামনে দাঁড়াইছোস কোন মুখে?”
ধমক দেন আফজাল হোসেন। নিশ্চুপ দৃষ্টি নত করে রাখে ইফতেখার। পারভীন উত্তেজিত হয়ে উঠে।
“বের হো ঘর থেকে। যা, বের হো। কোনো পোলা গোলা লাগবো না আমার। যার যার রাস্তা সে দেইখ্যা নে। যা।”
পারভীনের ধাক্কায় হালকা নড়ে উঠে ইফতেখার। বিপরীত কোনো প্রতিক্রিয়া রাখে না। উচ্চস্বরে শ্রাবণকে ধমক দেয় পারভীন,
“এই বেহায়া মাইয়া, দাঁড়ায় রইছো কোন সাহসে? বের হও!”
আসলেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না শ্রাবণ। একটু বসতে বললেও বড় উপকার হতো তার। এমন পরিস্থিতিতে বসার সুযোগও পাচ্ছে না। তার পাশে কোনো বসার জায়গা থাকলেও বোধহয় অনুমতি ছাড়াই বসে যেতো। ক্রমশই ক্রোধের মাত্রায় চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে আফজাল হোসেনের। শ্রাবণের দিকেই তাকিয়ে আছে ক্রোধপরায়ণ দৃষ্টি। লালাভ বর্ণের রূপবতী। মুখমণ্ডল এখনো লালচে হয়ে আছে শ্রাবণের। এই রূপেই বুঝি মজে গেছে তার ছেলে। তিনি শ্রাবণকেই জিজ্ঞেস করেন,
“বাড়ি কই তোমার? বাপের নাম কি?”
কোনোরকম জবাব দেয় না শ্রাবণ। তাকায় না পর্যন্ত কারো দিকে। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে গলার স্বর ক্রুদ্ধ হয় আফজাল হোসেনের।
“কথা কও না ক্যা? সাত্তার তোমার কি হয়?”
নিরুত্তর শ্রাবণ ক্লান্তশ্রান্ত চোখদুটোও বন্ধ করে নিয়েছে এবার। দেহের অস্থিরতা লুটিয়ে দিয়েছে মেঝেতে। সবার আগে চিৎকার করে উঠে পরী! বাকিদের কেউ কেউ বিস্মিত। ইফতেখার সাথে সাথেই বসে পড়েছে। মাথার শব্দটা তার বুকে হেনেছে বড়সড় আঘাত! একটুও যদি আন্দাজ করতে পারতো শ্রাবণ হেলে দুলে যাচ্ছে, তবেই ধরে ফেলতে পারতো। হেলেদুলে যাওয়া দেখে বিপু বলে উঠেছিলো,
“ভাই!”
সে চোখ তুলে বিপুর মুখে তাকিয়ে এদিকে ফিরতে ফিরতে ততক্ষণে পড়েই গেছে শ্রাবণ। পাশে থেকেও ধরতে পারলো না ইফতেখার! এখন মাথা হাতের তালুতে রেখে ঝাকিয়ে ডাকছে তাকে। কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না শ্রাবণের। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। জ্ঞান হারিয়েছে বুঝি! পরী ছুটে এসেছে পানির জগ নিয়ে। হালকা পানি ছিটালেও চোখ খুলে না শ্রাবণ। ওদিকে পারভীনের বুক কেমন ধড়ফড় করতে থাকে। কি হলো হঠাৎ! এগিয়ে এসে সে-ও অবস্থা বুঝতে স্পর্শ করতেই চোখ বড় করে ফেলে।
“এর তো ইচ্ছেমতো জ্বর! শরীর পুড়ে যায়!”
বিপু এগিয়ে বলে,
“ডাক্তার ডাকবো?”
“ডাক জলদি। মরার আপদ, সব আসে আমার ঘরে!”
বিপু বেরিয়ে যায় দৌড়ে। ইফতেখার শ্রাবণকে তুলে নিয়ে যায় অর্পার বিছানায়। পরী পানির বালতি নিয়ে দৌড়ায়। অর্পা চিন্তত মুখেই দাঁড়িয়ে থাকে পাশে। নড়ে না কেন? মরে টরে গেলো নাকি! চুল খুলে দিয়ে মাথার নিচে পলিথিন দেয় পরী। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে পানি ঢালতে থাকে অনবরত। পারভীন পায়ের তালু ঘঁষেছে কতক্ষণ। জ্ঞান ফিরছে না তাই অস্থির হয়ে উঠেছে। যদি এখন মরেই যায় তার ঘরে! কি করবে! ইফতেখার থার্মোমিটার খুঁজতে ব্যস্ত। ওদিকে মুহুর্তেই আফজাল হোসেনের ঘর ফাঁকা হয়ে গেছে। স্থির দাঁড়িয়ে আছে কেবল মামা ভাগ্নে। মামা সম্মান চিন্তায়, ভাগ্নে মামাকে বুঝতে। সকলের ছোটাছুটির কাজ থাকলেও এই দুজনের কিছু করার মতো নেই। খালিদ তো পুরোই বোকা হয়ে রইলো ঘটনায়! ইফতেখারকে নিয়ে সে এমন কিছু বিন্দু মাত্র কল্পনাও করেনি। মামার আস্থার কতটা ক্ষুন্ন হলো, তা ভেবেই নিরাশ হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
“মামা, আমি বাড়ি যাই তবে।”
কিছুই বলেন না আফজাল হোসেন। চুপচাপ বেরিয়ে যায় খালিদ। বিপু কিছুক্ষণের মধ্যে মোটরসাইকেলে বসিয়ে ডিসপেনসারি হতে কম্পাউন্ডারকে নিয়ে এসেছে। জ্বর মেপে তিনি স্যালাইন দেয়ে গেছেন। আবার বিপুকে সাথে নিয়ে গেছেন কিছু ওষুধ দেওয়ার জন্য। প্রায় আধঘন্টা যাবত টানা পানি ঢেলে গেলো পরী। অর্পার কাঁথা বালিশ সব চেপে দিয়েছে তার উপর। অর্পা নিরব দর্শক হয়ে দেখছে। ভাবি তার দেখতে ভীষণ সুন্দরী। কিন্তু এই যে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে ভাইটাকে নিয়ে পালিয়ে গেলো, এটাই ভারি অপছন্দের হলো। তারউপর তার বিছানার দখলদারি হওয়ায় আরও অপছন্দের হলো! একশো চার ডিগ্রি জ্বর ছুঁয়ে বসেছে শ্রাবণকে। অসুস্থতার প্রতি যেন পারভীনের মায়া হয়। পরী পানি ঢালতে থাকলে কিছুক্ষণ পাশে বসেছিলো সে। তাকিয়ে ছিলো শ্রাবণের মুখে। মেয়েতো ভারি সুন্দরী। ছেলের নজর কেড়ে নিয়েছে বুঝি এই রূপের ঝলকে? পালিয়ে এতো বড় অপরাধ করলো কেন? সুন্দরী মেয়ে ওই ভ্যানওয়ালা বাড়ির আত্মীয় হলো কেন? বড় ঘরে এদের জন্ম হতে পারে না? পরক্ষণে চোখ তুলে শক্ত দৃষ্টিতে তাকায় ইফতেখারের দিকে। হতচ্ছাড়া মেয়ে নিয়ে ভাগলো কেন!
ইফতেখার নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলো চিন্তিত বেশে। মাকে কটাক্ষ দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে সে প্রস্থান করেছে সঙ্গে সঙ্গে। নিজের ঘরে গিয়ে অযথাই একটু পায়চারি করলো। পরক্ষণে হাতমুখ ধুয়ে রান্না ঘরে এগিয়ে গেলো। পরী ব্যস্ত, তাই পরীকে ডাকে না। মা রেগে আছেন, তাই মাকেও ডাকে না। পেটে প্রচুর ক্ষুধা। হাড়ির ঢাকনা খুলে খুলে নিজেই প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে বসে যায়। বিপু ওষুধ নিয়ে ফিরে এসে তাকে রান্নাঘরে খেতে দেখলেই মাথা চুলকাতে চুলকাতে আবার চলে আসে। ভাই বিয়ে করে বড় ফ্রি মুডে আছে। তার মাথায় এতো টেনশন ভর করে আছে কেন? নিজে কবে এমন শান্তিযোগে ভাত খেতে বসবে?
গত কয়েকদিন ধরে ঘুমাতে এসে শ্রাবণের ব্যাপারে কথা বলতে থাকতো, দুদিন যাবত বিয়ের পরিকল্পনা করছিলো। আর আজ জ্বরে আক্রান্ত বউয়ের ভার মায়ের আর পরীর উপর ছেড়ে দিয়ে এসে মশারী টানিয়ে নিজের ঘরে ঘুমাতে ব্যস্ত ভাই তার! পেট শান্তি তো দুনিয়া শান্তি অবস্থা! বিপু ঘরে এসে তার অবস্থা দেখে কোমড়ে হাত তুলে দাঁড়ায় একটা মুহুর্ত। কিন্তু কে দেখে তাকে? পরক্ষণে নিজের ঘুমের ব্যবস্থাও করতে থাকে। অর্পার চোখেও ভীড়েছে প্রচুর ঘুম। অথচ বিছানার মাঝখানে পড়ে আছে শ্রাবণ। অনেক্ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হয়ে বলে,
“আমি ঘুমাবো কোথায়?”
পারভীন চোখ তুলে তাকায়। মেয়ের বিরক্তি বুঝতে পারে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে যায়,
“পরী, থাম এইবার। আর দিতে হইবো না পানি। রাতের বেলা এতো পানি দিলে ঠান্ডা আরও বাড়বো।”
“আম্মা, শরীর আগের চেয়ে অনেকটা ঠান্ডা হইছে না?”
“হু। পানি ফালায় দিয়া খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
গামছা নিয়ে মাথা মুছে দিতে থাকে পারভীন নিজেই। বালতি নিয়ে বেরিয়ে যায় পরী। ঘরে ছিটিয়ে পড়া পানিটুকু মুছে দিয়ে পারভীনের সাহায্যে শ্রাবণকে একপাশে টেনে ঠিক করে শুয়িয়ে দেয়। অন্যপাশটা অর্পার জন্য ফাঁকা হয়েছে এবার। মেয়েকে ভাত খেতে ডেকে চলে যায় পারভীন। আফজাল আহমেদ গম্ভীরমুখেই খেতে বসেছে। অর্পার ঘরেই সবসময় মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমায় পরী। আজ রাত গভীর হয়ে এলেও পরী ঘুমাতে পারে না। ডাক্তারটা বলে গেছে স্যালাইন শেষ হয়ে গেলে ক্যানোলা খুলে ফেলতে। তাই একটু পরপরই মাথা তুলে দেখে শেষ হলো কি না? কিছুক্ষণ আগে পারভীন এসেও দেখে গেছে। এখন শেষ হতেই ঝটপট উঠে যায় পরী। সে তো পারবে না। কিন্তু ডাকবে কাকে? কাকা ঘরে থাকায় ওই ঘরে কড়া নাড়তেও দ্বিধা। অর্পাকেই ডাকে তাই ফিসফিস করে।
“আপা, এই আপা।”
“হু?”
ঘুম জড়ানো গলায় সাড়া দেয় অর্পা।
“আরে এই আপা, উঠেন। ভাবির স্যালাইন শেষ তো। ওইডা বন্ধ করেন।”
অর্পার আগে শ্রাবণেরই চোখ খুলে যায় পরীর ফিসফিসে। হাত বাড়িয়ে নিজেই বন্ধ করে ক্যানোলা খুলে নেয় হাত থেকে। কাঁথা সরিয়ে উঠে বসে শ্রাবণ। এলো চুল খোপা করে নেয়।
“ভাবি, আপনার জ্ঞান ফিরছে! এহন শরীরটা ভাল্লাগতাসে?”
পরীর জিজ্ঞাসার জবাবে স্মিত হেসে পলক ফেলে শ্রাবণ।
“নাম কি তোমার?”
“আমি? পরী।”
“বাহ! মাঝ রাতে পরীর দেখা!”
পরীরও কেমন অদ্ভুত ভালো লাগলো এতো রাতে কারো সাথে পরিচিত হতে পেরে। বিছানা ছেড়ে নামে শ্রাবণ।
“আরে, আরে। যান কই?”
“বাথরুমটা দেখাও।”
পরী এগিয়ে ধরতে যায় তাকে। শ্রাবণ বাঁধা দিয়ে বলে,
“আমি হাঁটতে পারবো। তোমার কষ্ট করতে হবে না।”
ভোর হতে না হতেই পাড়া জুড়ে কানাঘুঁষা উঠেছে, চেয়ারম্যানের বড় ছেলে বিয়ে করেছে। কিন্তু বড়লোকের বাড়িতে চাইলেই হুড়হুড় করে ছুটে আসতে পারে না জনসাধারণ। বউ দেখার ইচ্ছেটা ওই দূর হতেই পুষে রাখে মনে। নিকট আত্মীয় এসেছে দুয়েকজন। এসেছে খালিদের বউ, এসেছে খালিদের বড় ভাইয়ের বউ। আর আশপাশের দুয়েকজন। পালিয়ে বেড়ানোটা কানাঘুঁষার হলেও ইফতেখার সুন্দরী বউ এনেছে৷ এই ব্যাওয়ারটা ভারি প্রশংসাযোগে প্রকাশ করছে তারা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে শ্রাবণ। মুখ কেমন লালচে হয়ে আছে। চোখের ধার কিছুটা কালচে লাগছে। জ্বরের প্রকোপ কেমন অসুস্থ একটা ভাব এনে দিয়েছে চেহারায়। নিজেরই ভালো লাগছে না। অথচ সকাল সকাল পরী মেয়েটা মন্তব্য করে,
“ভাবি, আপনে কি যে সুন্দরী! আম্মায় তো ফ্যালফ্যালাইয়া খালি আপনারেই দেখতাছিল রাতে।”
অথচ এই ফ্যালফ্যাল করে দেখার মতো রূপ সে খুজে পাচ্ছে না লালাভ চেহারায়। নিজেই নিজেকে পরীক্ষা করে নেয় থার্মোমিটারে। একশো চার ডিগ্রির জ্বর একশো দুয়ে নেমে এসেছে। এসময় ইফতেখার এসেছে এই ঘরে। ঘুম থেকেই উঠে এসেছে মাত্র। কাছে এসে থার্মোমিটারের চোখ রাখে। কপাল ছুঁয়েও দেখে।
“ভালো লাগছে এখন?”
“আপনাকে তো ভালোই লাগছে। এতোটা সময় ঘুমিয়ে এখন এসেছেন খবর নিতে।”
“আপনি বেহুশ হয়ে গেছেন, সেই চিন্তায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
নিঃশ্বাস কাঁপিয়ে শব্দহীন হেসে উঠে শ্রাবণ।
“মানুষ চিন্তায় পড়লে ঘুম হারায়। আর আপনি ঘুমিয়ে পড়েন?”
“পরীকে তো পাশেই রেখেছিলাম আপনার খেয়াল রাখতে।”
“হ্যাঁ আর বলতে হবে না। কে কি করেছে, আমি জানি সবই।”
“আপনি তো বে…”
ইফতখারকে থামিয়ে ফিসফিস করে শ্রাবণ।
“আমি জ্ঞান হারাইনি। তবে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকু ঠিক হারিয়ে ফেলেছিলাম। তারউপর আপনাকে এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতেই পড়ে গেছি।”
ইফতেখারের চোখে ও মুখে যেন বিস্ময়ের হাসি ফুটতে চায় তার কথায়।
“আপনি মাথায় ব্যাথা পাননি?”
“পেয়েছি। কিন্তু মাথার ব্যাথার চেয়েও বেশি কষ্টকর ছিলো দাঁড়িয়ে থাকা। যাইহোক, আপনি কিন্তু আমায় সালামি দেননি। নতুন বউদের ঘরে এলেই সালামি পাওয়ার কথা। বাকিদের তো বাদ, আপনার থেকে কিন্তু নূন্যতম আশাটা করেছিলাম।”
ইফতেখার চোখ ডানে বামে নাড়ায় ভাবুক ভঙ্গিতে। আসলেই বোধহয় সালামি দেওয়া জরুরি ছিলো। তাই পকেটেও হাত রেখে দেখে টাকা আছে কি না। তিন-চারশোর মতো খুচরা ছিলো। শ্রাবণের মুঠোয় চেপে দিয়ে দেয় পুরোটা।
“নাশতা করে ওষুধ খান। জ্বর বাড়তে দিয়েন না।”
মুখে চাপা হাসি ধরে রাখে শ্রাবণ। শেষ কথা শুনতে পেয়ে দরজার পাশ থেকে মুখ চেপে ধরে হেসে উঠে পরী।
“আয় হায়! ভাইজান দেখি ভাবিরে আপনে আপনে কইরা ডাকে!”
সেই প্রেক্ষিতে কিছু বলে না ইফতেখার। বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
“নাশতা করতে দে, পরী। তোর ভাবির দিকে খেয়াল রাখিস।”
“হো, হইছে। আর কইতে হইবো না। এই ঘরে কেউ অসুস্থ হইলে এই পরীর চেয়ে ভালা খেয়াল কেউ রাখে না। পরী দায়িত্বে থাকতে আপনের বউও কেউ নিতো না। দুইদিক থেকেই নিশ্চিন্তে থাকেন।”
শ্রাবণ ব্যাগে টাকা রাখতে রাখতে স্মিত হাসে তার কথায়। পরক্ষণে বলে,
“তুমি তো ভারি দুষ্ট!”
“হো। দুষ্টামিডাও আমি বেশি করি। তাই সবার থেকে গালমন্দডাও বেশি বেশি করে খাই।”
তার কাঁধে হাত রেখে বাইরে যেতে যেতে শ্রাবণ বলে,
“আমার তো দুষ্টুই বেশি পছন্দের।”
“তবে আপনে গম্ভীর ভাইজানরে পছন্দ কইরা সারলেন ক্যামনে?”
“কারণ, তোমার গম্ভীর ভাইজানের ভালোবাসাটা একটু অন্যরকম সুন্দর।”