শ্রাবণের মধ্যদুপুর
৪৩
নিম্মি কিছু না বলে এক ছুটে বেরিয়ে গেল। কিন্তু বাড়ির দিকে গেল না। বাড়িতে তার ঘরে সাধনা, হেলাল ভাই আছেন। মাগরিবের আগে বাড়ি ফিরবে না সে। এলোমেলো হাটছিলো সে। হঠাৎ একটা রিকশা এসে থামে।
• নিম্মি কি হয়েছে? কোথায় যাও? প্রশ্ন করে রিফাত
• আপনি বাসায় যান, বাসায় অনেক কাজ
• সে যাচ্ছি, কিন্তু….
• কোন কিন্তু নাই, যান
• তুমি আসো তোমাকে নামিয়ে তারপর যাই
• কেন? কোন অধিকারে এক রিকশায় চড়বো?
• বেশ
রিফাত রিকশা থেকে নেমে, নিম্মির পাশে হাটা শুরু করে। নিম্মি কোন কথা বলেনা হেটে পার্কে যায়। সূর্য প্রায় অস্তমিত। ঠিক সেই বেঞ্চে বসে যেখানে সবুজ আর মিলির প্রথম দেখা হয়েছিল। দুজন পাশাপাশি বসে থাকে কোন কথা বলেনা। ধীরে ধীরে আলো কমে আসছে। খুব ইচ্ছে করছে রিফাতের নিম্মির হাতটা ধরে বলতে, কি হয়েছে? কিন্তু সে পারেনা। বরং বলে,
• চল তোমায় রিকশায় তুলে দেই
• আমি একা এসেছি, একাই যাব
• একাই যেও, আমি শুধু রিকশা অব্দি যাব
রিকশায় উঠে, নিম্মির মনে হয়, রিফাতের কন্ঠ কি ব্যথাতুর ছিলো? সে কি কষ্ট পেয়েছে? তার কষ্টে কি যায় আসে? নিম্মি চোয়াল শক্ত হয়। সে ঐ বাড়িতে আর কোনভাবেই যাবেনা। আন্টি না জানি তাকে কত খারাপ মেয়ে ভেবেছেন।
ভেবেছেন….. তার মতো বেহায়া মেয়ে আর জগতে নাই। নিজেকেই নিজে একটা চড় দেয়। আজ মা থাকলে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে সারারাত কাদতো! রিকশা থামে নিম্মির বাসার সামনে। সন্ধ্যা নেমেছে কেবল। দ্রুত চোখের পানি মুছে ভাড়া দেয়, তারপর খানিক দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে, চোখের লালভাব কমার অপেক্ষা করে, কিন্তু দরজাটা খুলে যায়। হেলাল ভাই দাঁড়িয়ে।
• ভাবী…. কিছু একটা বলতে গিয়েও বলেনা। বয়স একেবারে কম হয়নি তার। কিছু একটা হয়েছে, সেটা তার কাছে প্রকাশ করাটা সহজ হবেনা বুঝে চুপ করে যায়।
ভিতরে যায় নিম্মি। কলপাড়ে গিয়ে ওজু করে বাবার ঘরে নামাজ পড়ে নেয়। বাবা সম্ভবত মসজিদে। সাধনার সামনে পড়েনি, ভালো হয়েছে। মেয়েটা অহেতুক দুশ্চিন্তা করতো। তার জীবনে এখন এই কান্না নিত্যসঙ্গী। এই বিয়ে, এই মিথ্যে বিবাহিত জীবন আর সেই সাথে শ্বশুরবাড়ি নামক প্রহসন। মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে কেঁদে পুরো পৃথিবীর সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে “আমি ভালো নেই” কিংবা শুধু একজনকে ফিসফিস করে বলতে “আমি ভালো নেই” তুমি কি আমাকে একটু ভালো রাখতে পারো? কিন্তু না সেটা বলা যায় না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বাইরে বের হয়। বাবা বসে আছে ডাইনিং টেবিলে।
•আজ ও বাড়ি থেকে এত তাড়াতাড়ি ছুটি দিল?
•হ্যাঁ বাবা তেমন কাজ ছিল না
•সেই ভালো হয়েছে, একটু চা করবি মা?
মামা আমাকেও তো বলতে পারেন। আমিও তো আপনার মেয়ে। বলে চায়ের ট্রে টেবিলে রাখে সাধনা। তাতে তিন কাপ চা আর বিস্কুট আছে।
• আরে তুমি করতে গেলে কেন?
•ও বাড়িতে তো সব করতে হয়, এখানে কেবল চা বানালাম
•আমার কাছে এসেছ বিশ্রামে থাকবে
•বেশ তাই হবে, চা নাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে
রিফাতের কাছে খাবার টেবিলে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়। রাইসা, রাফিয়া দুজনেই মন খারাপ করেছে মায়ের কথায়। নিম্মিকে তারাই সবসময় ডাকে, নিম্মি নিজে থেকে কখনোই আসেনা। বাবা ভর্ৎসনা করেন মা কে। মায়ের সাফ জবাব তারা যা চাইছে তা কোনভাবেই সম্ভব না। এলাকায় তাদের একটা মান মর্যাদার ব্যাপার আছে। তাছাড়া নিম্মির বিয়ে তো ভাঙেনি। অনেকেই সতীনের সংসার করে। নিম্মিও নিজের নসীব মেনে নিক। রিফাত চুপচাপ খেয়ে ভদ্রভাবে উঠে গেলো। রিয়াজ সাহেব খুশি হলেন, ছেলেটা সরাসরি মায়ের বিরোধিতা করেনি। তিনি জেসমিনকে বোঝাবেন, তার আগে নাজিমুদ্দিনের সাথে কথা বলতে হবে।
শ্রাবণের মধ্যদুপুর
৪৪
বাবার সম্মানের কথা ভেবে হয়তো মেয়েটা আজীবন টেনে বেড়াতে চাইবে এই সম্পর্ক। সেটা হতে দেওয়া যায়না। এলাকায় কথা উঠবেই কিন্তু শুরুটা কিন্তু এই পরিবার থেকেই হয়েছে তাই শেষটাও এই পরিবার থেকে হওয়া উচিত। রিয়াজ সাহেব গভীর ভাবনায় ডুবে যান। রাইসার শ্বশুর বাড়ি থেকে চাওয়া পাওয়ার বিষয়টা আসেনি। কিন্তু তাও তার কপালে ভাজ পড়ে! মেয়েটা ভালো থাকবে তো? পিঠে জেসমিন বেগমের স্পর্শে ধ্যানভঙ্গ হয়,
• কি এত ভাবেন?
•মেয়েটা সুখী হবে তো?
• বাপের বাড়ির আদর কোনদিন একটা মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে পায়না, কাজকর্ম করে খেতে হয়, বাকিদের মন যুগিয়ে চলতে হয়
•এমন হতে পারেনা, রাইসার শাশুড়ি তাকে নিজের মেয়ের মতো আদর করবেন, তুমি রিফাতের বৌকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখবে?
•হ্যাঁ কেন হয় না? আমার রাইসাকে তারা পছন্দ করে নিয়েছে, আমিও যদি কাউকে পছন্দ করে আনতে পারি, অবশ্যই আগলে রাখবো! তোমার কি মনে হয়? আমি ভাত, কাপড়ের কষ্ট দেওয়া শাশুড়ি হবো?
•না অবশ্যই না, দিন বদলেছে, পরের মেয়ের সুখ যদি আমাদের সহ্য না হয় তাহলে নিজের মেয়ের সুখ কাম্য হয় কিভাবে?
•এত ঘুরিয়ে বলার দরকার নেই, আমি বুঝতে পারছি আপনি কার কথা বলতে চাইছেন, তা হয়না, আমি বেচে থাকতে এমন অনর্থ কোনভাবেই আমি হতে দেব না
হেলাল পরদিন সকালে নাস্তা করে চলে গেল। নাজিমুদ্দিন মেয়ের হাবভাব বুঝতে পারছেন না। সবুজের সংসার যদি না করে তাহলে তো সাধনাকে রেখে তার সেবাযত্নের কোন মানে হয়না। সাধনা তার মায়ের কাছে থাক। কাল সারাদিন বাসায় ছিলো না, বাসায় ফিরে রাতের রান্না সেরে ছাদে বসে ছিলো অর্ধেক রাত। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। ওর মন হালকা করতেই এই বিয়ে বাড়ি আসা যাওয়ায় বিধিনিষেধ আরোপ করেননি কিন্তু মেয়েটা ভালো নেই। সাধনা হেলালের সুন্দর সম্পর্ক দেখে হিংসা করার মতো মেয়ে সে না। কিছু একটা হয়েছে….
সকালে উঠে একটা ক্লাস করে এসে রান্নার জোগাড় করতে বসবে এমন সময় সাধনা ডাকে নিম্মিকে।
• কি হয়েছে?
• ভাবি আসো না, একটা সাহায্য করো
• কি?
• দেখ তো কোন শাড়িটা পরবো?
• শাড়ি কেন পরবে?
• এমনি, মন ভালো রাখতে
• বেশ এই লাল জামদানিটা পরো
• তুমি লাল পরো না কেন?
• পরি তো, পরি না কে বললো?
• তোমাকে সারাক্ষণ নীল নাহয় কালো পরতে দেখি
• ঐ যেটা সামনে পাই
• তোমার বিয়েতে ভাই কোন স্যুটকেস দেয়নি? শাড়ি, গহনা কিছুই না?
• আমার কিছু লাগবে না, দুপুরে কি খাবে বলো, বাবা নামাজে গেছে, চলে এলেই খাবার চাইবে
• তোমার যা খুশি দাও, তোমার হাতের সবই মজা লাগে
সাধনা ভালো করে শাড়ি পরে সাজে। গা ভর্তি গহনা আর লাল জামদানি পরে সে বের হয়। দুপুরের খাবার না খেয়েই চলে যায়। নিম্মি ভাবছিলো বোধহয় বাড়ির মধ্যে বা আশেপাশেই আছে, কিন্তু ও বের হয়ে গেছে। আতঙ্কে নীল হয়ে যায় নিম্মি। বাবা এখনই ফিরবে। কি বলবে বাবাকে? কোথায় যেতে পারে সাধনা? আগের প্রেমিকের কাছে? ভয়ের শীতল স্রোত নেমে যায় মেরুদণ্ড বেয়ে।
শ্রাবণের মধ্যদুপুর
৪৫
সাধনা শহরে গেছে। সুমনা পারতপক্ষে কারো সাতে পাঁচে থাকেনা। গ্রামের এক মহিলাকে সবুজ নিযুক্ত করেছে ঘরের কাজের জন্য। যা সালেহার চুড়ান্ত অপছন্দ। কিন্তু তার কিছুই করার নেই এই বয়সে পুরো বাড়ির কাজ কয়দিন করে বিছানা নিয়েছেন, ছেলের সামনে কান্নাকাটি করেছেন, ভেবেছেন এবার মিলির পা মাটিতে পড়বেই! কিন্তু মিলি বেলা করে ঘুম থেকে উঠে আয়েশ করে চা খায় আর বুচির মাকে রান্নার নির্দেশনা দিয়ে গোসলে যায়। কোনদিন মন চাইলে রুটি খায় নাহলে শুধু বিস্কুট। দুপুরে মাছ, মুরগি রান্না নাহলে সে খেতেই বসে না!
কালেভদ্রে বুচির মা এসে সালেহাকে জিজ্ঞেস করে, কি রান্না হবে! সালেহা বোঝে তার পুত্রবধূ তামাশা করার জন্য পাঠিয়েছে! শহরে আর খুব একটা যান না। নিম্মি মেয়েটা পুরোপুরি উচ্ছনে গেছে। বাবার ওষুধের টাকার জোগান দিতেই মেয়েটা দিন রাত খাটছে এটা সালেহা মানতে নারাজ! তার ভাইয়ের কি জমানো টাকা নাই? পেনশন নাই? টাকার দরকার বলে সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো! টাকার দরকার বলে সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো! মেয়েদের এই এক কুবুদ্ধি! কেন তারা সংসার করেননি? পড়া, টাকা রোজগারের নাম করে পর পুরুষ কে শরীর না দেখালে এদের পেটের ভাত হজম হয়না! নষ্ট মেয়ে মানুষ!
নিম্মির সংসার থেকে তো মন কবেই উঠে গেছে! বাড়িতেও একটা বাড়তি ঘর রাখেনি, কখন কে থাকতে চায়! সব দোষ নিম্মির ঘাড়ে দিয়েও শান্তি পাচ্ছেন না। নিম্মি তো এসেছিল, সংসারের হাল কাধে তুলেছিলো তারপর মিলি এসেই সব উলটে পালটে দিলো। বুচির মা ছুটে এসে জানালো সুমনার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।
বিচলিত সালেহা ছুটে যায় মেয়ের কাছে। বুচির মাকে পাঠায় বরফ আনতে, মিলি গোসলে গেছে ঘরের দরজা আটকে দিয়ে, নতুন ফ্রিজ সেটাও তাদের ঘরেই। এভাবে দরজা বন্ধ করত না মিলি। সালেহা মাঝে মাঝেই তাদের অগোচরে ঘরে যেতেন, জিনিসপত্র দেখতেন। একদিন মনের ভুলে বুচির মাকে মিলির রাতের সংক্ষিপ্ত পোশাক নিয়ে বুচির মাকে বলেছিলেন, কি অসভ্য মেয়ে! এসব করেই ছেলেকে মায়াজালে ফাঁসিয়েছে! বিয়াত্তা, এক বাচ্চার মা, কত ছলা কলাই না জানে! বুচির মা সুন্দর করে কথা লাগিয়েছে মিলিকে! একদম আগুনে ঘি পড়েছে। সালেহা মেয়ের নাকে তুলো গুজে খুশি হয়। আসুক আজ সবুজ। এত বড় বিপদে বৌ দরজা আটকে রাখে, বরফ দেয়না….
সবুজ বাড়ি ফিরে এলো রাত করে। সে শহরে গিয়েছিল। হাতমুখ ধুয়ে কেবল বসেছে বিছানায়। কিন্তু মন ফেলে এসেছে শহরে! নিম্মিদের বাড়িতে গিয়ে নিম্মিকে সাধনার চিকিৎসা, খাওয়া খরচ আর নিম্মির জন্য কিছু হাত খরচ দিয়ে এসেছে, ভেবেছিলো নিম্মি হয়তো নিতে চাইবে না। কিন্তু সে সহজ ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে টাকা নিলো। ইচ্ছে করেই দুপুরে গিয়েছে, যাতে ভাত খেতে সাধে। সাধনার জন্যই বোধহয় আয়োজন ছিলো মোটামুটি। নিম্মি যত্ন করে বেড়ে খাওয়ালো। কিন্তু কোন কথা না বলে, তারা চারজন খেতে বসেছে। মামা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে গেলেও নিম্মি যেন মৌনব্রত পালন করছে! অথচ সেই ছেলেটার সামনে মিলির চোখমুখ কথা বলে ওঠে!ছেলেটা নাকি ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে। তাহলে যেকোন দিন সবুজ নিম্মির তালাকের নোটিশ পাবে। তার কি খারাপ লাগছে?
মিলির স্বেচ্ছাচারী আচরণ তার ভালো না লাগলেও বিবাহিত জীবনের আসল স্বাদ তাকে মিলিই দিয়েছে। নিম্মির সাথে কাটানো ঐ এক রাত তার জন্য এখন বিব্রতবোধের কারণ। শুধুমাত্র মিলিকে রাগাতে সে ঐ কাজ করেছিলো। যার জন্য নিম্মি তাকে কিছুই বলেনি, আবার স্ত্রী সুলভ কোন আচরণ নিম্মি করেনা। মিলি যেমন বাসি মুখে চট করে চুম্বন দেয়। বাইরে থেকে এলে জড়িয়ে ধরে, রাতের ভালোবাসাবাসি ছাড়াও সারাদিন মেয়েটা কোন না কোন অজুহাতে ছুয়ে দেয়, কাছে আসে। কিন্তু নিম্মি কখনো তা করেনি। অবশ্য বিয়ের এক মাসের মধ্যেই তো মিলির ব্যাপারটা জানাজানি হলো, নিম্মির মতো কিভাবে তার কাছে আসবে? বিভিন্ন উছিলায় কেন ছুয়ে দেবে? কেনই বা এক, আধটা নির্দোষ চুম্বন দেবে?
তাহলে কি নিম্মি ঐ ছেলের সাথে এমন করবে? মিলির মতো করে? রিফাত না কি যেন নাম! তাকে কি নিম্মি অযথাই ছুয়ে দেবে? আরেকটু ভাত নিতে বলবে? কাঁচামরিচ লেবু আনতে বলবে? ভুলে গেলে বকবে? একটা সংসার হবে নিম্মির? ভালোবাসার?
চলবে।