শ্রাবণের মধ্যদুপুর পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
32

শ্রাবণের মধ্যদুপুর
৪৬

রেস্তোরাঁয় অপেক্ষা করছে সাধনার জন্য মাসুদ। কিন্তু এ কাকে দেখছে সে? লাল জামদানি আর গা ভর্তি গহনা, ঈষৎ স্ফিত উদর, গায়ের রঙ যেন কাঁচা সোনা। মানবী না অপ্সরী? হা করে দাঁড়িয়ে আছে,
সাধনা মিষ্টি হেসে বলে,

• বসতে বলবে না?

• হ্যাঁ প্লিজ

• কেমন আছ?

• ভালোই ছিলাম, কিন্তু তোমাকে এভাবে দেখে….

• কি হয়েছে?

• তুমি অন্তঃসত্ত্বা?

• হুম

• এই অবস্থায় আমি কিভাবে…. আমরা কিভাবে

• আমরা কি?

• নতুন জীবন শুরু…..থেমে গেল আরিফ কাছ থেকে সাধনার গহনা গুলো পরখ করছে, যে গহনা আছে তাতে সাধনাকে কোন এক জায়গায় ফেলে দিয়ে আরামসে মাস খানেক কাটানো যাবে, বোকা মেয়ে এত গহনা পরে এসেছে যেন তাকে আজই বিয়ে করবে সে, আপসোস এটাই সেদিনের মতো সাধনাকে কাছে পাওয়া হবেনা, প্ল্যান তো ছিলো কিছুদিন ভোগ করে ছেড়ে দেওয়ার…. কিন্তু সে আরেক ব্যাটার বিজ বহন করছে শরীরে! সেই শরীরের কোন আবেদন নেই আর, কিন্তু রঙ, রূপ এত খুলেছে মেয়েটার…. এক, আধবার বিছানায় যেতেই হয়! যে বাসাটা ভাড়া করেছে তা শহর থেকে বেশ দূরে, সমস্যা হলো সাথে আরো তিনজন আছে তারা তো মানতে চাইবে না, এদিকে একটা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে এভাবে গণ ধর্ষ-ণ করাটা…. অনেক বেশি রিস্ক, জানাজানি হলে মানুষ প্রতিবাদ করতে পারে, আর ঐ বাড়ির মালিকের চোখেও পড়ে যেতে পারে, ভালো বিপদ হলো

• কি ব্যাপার? এবারের প্ল্যান কি?

• মানে? মুখ শুকিয়ে গেছে মাসুদের

• কিছু না, কি খাবে বল?

• তোমার যা ভালো লাগে

• আমি এমন রেস্তোরাঁয় খুব একটা আসিনি তাই আইডিয়া নেই কি ভালো হবে

• তোমার বিলেত ফেরত জামাই তোমাকে চাইনিজ খাওয়ায়নি?

• গ্রামে এসব নেই

• হুম

• তাহলে স্যুপ অর্ডার দেই

• দাও

খাওয়া শেষ করে মাসুদ সাধনার হাত ধরার জন্য হাত বাড়ায়। সাধনা হাত দেয়না।

• কি হয়েছে?

• তুমি চলো আমি এগোচ্ছি

রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে মাসুদের ভাড়া গাড়িতে ওঠার আগেই তিনজন মুখোশধারি আড়াল থেকে বের হয়ে মাসুদকে নিয়ে চলে গেল। আড়াল থেকে হেলাল বেরিয়ে এলো। হাসিমুখে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। নিম্মিকে কল দিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে সাধনা। নিম্মি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়। মামার বাড়িতেই ফেরে সাধনা। নিম্মিকে অহেতুক অন্ধকারে রাখা ঠিক। বাসায় পৌঁছে সবকিছু খুলে বলে সাধনা আর হেলাল। নিম্মি খুবই অবাক হয়।

• এই শরীরে এইসব করতে গেলা কেন?

•না করলে ও আমারে গ্রামে থাকতে দিত না

•ভাবী ও বাসা ভাড়া করছিলো তিন চারজন গুন্ডা ভাড়া করছিলো, আমি সব জানতে পারি বাজারে আমার এক নাপিত বন্ধুর কাছ থেকে, ওরা নিজেদের খবর কাউকে বলেনা, কিন্তু এই ছেলেটার সাথে আমি এক সাথে প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম।

•কি ভয়ংকর

•প্ল্যান ছিলো রাজি নাহলে উঠায় নেওয়ার

•তারপর?

•সাধনা নাটক করে মাসুদকে ডেকে এনেছে, কিছুদিন কথা বলে বিশ্বাস অর্জন করেছে

•যারা মাসুদকে নিয়ে গেছে তারা কারা?

•আমার গ্রামের ছেলে বিশ্বস্ত

•কি করবে মাসুদের সাথে?

•বেধে রেখে কিছুদিন মারধর করে, পুলিশে দেবে

•আমি ভাত বসাই

•ভাবী আপনি চিন্তা করবেন বলে আসলাম, আমরা বাড়ি রওনা দিতে চাই, অনেক দিন আপনার কাছে থাকলাম, আমার বাড়ির কথা তো শুনেছেন

মাথা নাড়ে নিম্মি, ঘোর থেকে বের হতে পারেনা। ব্যাগ গুছিয়ে দুজন চলে যায়। যাওয়ার আগে সাধনা নিম্মিকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ। নিম্মি ওর শরীরের মা মা গন্ধটা নেয় প্রাণভরে!

শ্রাবণের মধ্যদুপুর
৪৭

হঠাৎ নিম্মি বলে,

• হেলাল ভাই একটা অনুরোধ করলে রাখবেন?

• বলেন ভাবী, আপনি হুকুম করেন!

• ভাই কটা দিন সাধনা থাকুক আমার কাছে?
দুজনকেই থাকতে বলতাম, কিন্তু বাড়তি ঘর নেই, আপনার কষ্ট হয়

• কি যে বলেন ভাবী, আপনার বোন যে কদিন রাখতে চান রাখেন, আমি আসি

• খেয়ে যান ভাই, অনেক রাত হয়েছে

হেলাল বসে পড়ে। তার থেকে নিম্মি মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও জ্ঞান, গরিমায় মেয়েটা অনেক উপরে, অন্তত তার কাছে মনে হয়। সাধনা এখানে ভালোই থাকবে।

রিয়াজুদ্দিন সাহেব সকাল সকাল নিম্মিদের বাসায় হাজির। আজ বিয়ে। অনেক কাজ। কিন্তু তিনি না নিতে এলে হয়তো নিম্মি বিয়েতে যাবেই না। নাজিমুদ্দিন রোদে বসে পেপার পড়ছিলেন, রিয়াজ সাহেব কে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন।

• আরে ভাই আপনি? আজকের দিনে?

• নিম্মি মাকে নিতে এসেছি

• বিয়ে তো দুপুরে?

• হ্যাঁ দুপুরে, তখন কাজের চাপে ডাকতে আসা হবেনা তাই সকালেই এলাম

• চাচা আসসালামু আলাইকুম, আসেন নাস্তা করবেন, নিম্মি বলে

• আজ না মা, অনেক কাজ পড়ে আছে, তুমি নাস্তা আমাদের সাথেই করতে পারতে, তোমার তো দাওয়াত ছিলো, দুপুরে কিন্তু অবশ্যই আসবে, না আসলে বুঝবো এই বুড়ো চাচার কোন সম্মান নেই তোমার কাছে

• ছি ছি কি বলেন আমি অবশ্যই যাবো, বাবাও যাবে

• ধন্যবাদ মা। আসি দুপুরের আগেই আসো, রাইসা তোমার সাথে পার্লারে যাবে

• জি আচ্ছা

রিয়াজ সাহেব চলে গেলেন। নাস্তা খেতে বসেছে বাবা, মেয়ে।

• কিছু হয়েছিলো?

• কিছু না বাবা

• তাহলে এভাবে ডাকতে আসলো কেন?

• বাবা আমি তো বেমানান একটা মানুষ, না আমি ঠিক সংসার করছি, না আমি অবিবাহিত, না আমার কোন যাওয়ার জায়গা আছে

• মানে কি? তুমি কি এই সম্পর্ক অস্বীকার করছ?

• না বাবা, শরিয়ত সম্মত সম্পর্ক আমি অস্বীকার করি কিভাবে?

• ঐ সংসারে যেতে চাও?

• না

• তাহলে কিভাবে তুমি সংসার পাবে?

• জানিনা বাবা, আমার পড়াশোনা শেষ হোক, তারপর নাহয় চলে যাব

• ততদিনে সবুজ দুই বাচ্চার বাপ হবে

• এখানে কোন প্রতিযোগিতা নেই বাবা, আমি তো আগেই হেরে গিয়েছি

• চেষ্টা না করেই হেরেছ, রিফাতের জন্য যদি মনের মধ্যে কিছু থাকে তো জানিও, অযথা একটা নামকাওয়াস্তে সম্পর্কে ঝুলে থাকার কোন মানে হয়না

বাবা নাস্তা শেষ না করেই উঠে চলে গেল। নিম্মির চোখ ভিজে এসেছে। রুটি মুখের মধ্যে গিলতে পারছে না কান্নার দমকে। খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে কান্না করা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের অনুভূতিগুলোর একটা।

সাধনা সব শুনেছে বাড়ির ভিতর বসে। নিম্মি ঘরে এসে জীবনে প্রথম বারের মতো কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। বাবার সাথে সে এত সহজভাবে মিশতে পারেনি। সাধনার শরীরের সেই মা মা গন্ধ! নিম্মির মনে হলো, তার মাকেই জড়িয়ে কাঁদছে!

সাধনা বলে,
• তোমার বিয়ে হয়েছে খুবই অদ্ভুত সময়ে, মামা রাগের মাথায় মায়ের চাপিয়ে দেওয়া সম্পর্কে জড়িয়ে দিয়েছে তোমাকে তাও যদি এমন হতো ভাই তোমার যত্ন নেয়, খেয়াল রাখে তাও হতো, ভাই তার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে আনলো,বাড়িতে যা কোনদিন আসেনি তা ধার দেনা করে কেনা শুরু করলো। নতুন অংশ বাড়িয়ে অনেকটা আলাদা থাকা শুরু করলো, আমি জানি মায়ের এই অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে ভাই আরো নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে, আর তোমার সাথে তার তো কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এভাবে হয়না।

শ্রাবণের মধ্যদুপুর
৪৮

নিম্মি আর সাধনা আলাপ করছে, নিম্মি রাইসার বিয়েতে যাবে,

• কি করা উচিত আমার?

• নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর, আমার স্বামী আমার যত্ন নেয় আর ভালোবাসার মানুষ একটা লম্পট, তোমার ক্ষেত্রে সেটা নাও হতে পারে, মানুষটাকে একটা সুযোগ দিতে পার

• তার আগে কি তোমার ভাইকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত না?

• ভাই কি সুযোগ চেয়েছে?

• না

• তাহলে?

• আমি যদি তার কাছে যেতে চাই রাস্তা এত সহজ না

• কোন রাস্তাই সহজ না নিম্মি, আমাকে হেলাল পছন্দ করে বিয়ে করেছে, কিন্তু বাড়িতে গিয়েই শুনি তার বিদেশ থেকে পাঠানো অধিকাংশ টাকা তার বাবা,ভাইয়ের নামে জমি কেনা৷ সে ব্যবসার জন্য জমি বিক্রি করতে পারছে না, তারা বলছে এটা তাদের ভবিষ্যত, হেলাল যেন আবার বিদেশ গিয়ে কামলা দিয়ে টাকা কামিয়ে নিজের নামে বা আমার নামে জমি,বাড়ি কেনে, কি পরিমাণ স্বার্থপর দেখেছ?

• তুমি কি বললে?

• আমি বলেছি আমার জমি, বাড়ি লাগবে না, সে যেন আমার কাছে থাকে, তাতে যা কামাই হবে আমরা মিলেমিশে চালিয়ে নিবো

• বাহ! তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ

• অল্প দিনেই অনেক ঝড় বয়ে গেছে, তাই অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে

• ফুপু কি বলেন?

• মাকে কিছু জানাইনি, মা জানে আমি অনেক সুখী, বাদ দাও শিগগির শাড়ি বের করো

• আমার তেমন ভালো শাড়ি নেই

• তাহলে আমার লাল জামদানি পরো, আমি সাজাবো তোমায়

• না না থাক

• আরে পাগল আমি আর আগের মতো সাজিনা, সুন্দর করে সাজাতে পারি

• লাল পরবো?

• হুম পরবে

সাধনার জোরাজুরিতে শাড়ি পরে নিম্মি কিন্তু কোন চুড়ি,গহনা পরাতে পারেনা সাধনা। সাজগোজের জিনিসপত্রের ঝাপি খুলে বসলেও নিম্মি শুধু কাজল পরেছে আর ঠোঁটে না দেখতে পাওয়ার মতো হালকা লিপস্টিক। মনে পড়ে তার, বিয়ের প্রথম দিনে মেজেন্টা শাড়ি পরেছিলো কোন প্রসাধনী ছাড়া, লিপস্টিক নিয়ে কটুকথা শুনিয়েছিলো সাধনা, আজ সেই সাধনা তার বন্ধু হয়েছে।

• তুমি যাবেনা?

• না, এই অবস্থায় আর না যাই

• ঠিক আছে, তোমার খাবারের ব্যবস্থা করেই বের হবো আমি

• উহু, আমি নিজেই একজন গিন্নী! এটুকু পারবো না? আমার ডালের প্রসংশা আমার শাশুড়ি অব্দি করে, আজ মামাকে মুগ্ধ করে ছাড়বো

• বেশ আমি তাহলে আসি

•তোমায় আজ বেশ লাগছে

•প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ

•একটা অনুরোধ

•মানুষ চিনতে ভুল করো না, সে আমার ভাই হোক আর তোমার প্রিয় মানুষ

•মানুষ চেনাই সবচেয়ে কঠিন কাজ এই পৃথিবীতে, এত এত ডিগ্রি! মানুষ চেনার কোন ডিগ্রি নাই

•মানুষ চিনতে হয় অভিজ্ঞতা দিয়ে ডিগ্রি দিয়ে না, যাও এবার, তার চোখ হয়তো তৃষিত নয়নে চেয়ে আছে

এবার লজ্জা পায় নিম্মি দৌড়ে বের হয় বাসা থেকে। সাধনা হেসে ফেলে।

চলবে।