শ্রাবণের মধ্যদুপুর পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
34

শ্রাবণের মধ্যদুপুর
১৩

তারানা তাসনুবা বৃষ্টি

সবুজের গলা হঠাৎ চড়ে যায়। নিম্মি বাসনপত্র রান্নাঘরে দিয়ে এলো। মেহমানরা বিদায় নিচ্ছে আস্তে আস্তে। মিনতির মা বাসন ধুয়ে রোদে দিচ্ছে। যদিও রোদ প্রায় মরেই গেছে। পেয়ারা গাছের নিচে চৌকি রেখেছে। ফল বাগানের মাঝের ফাকা জায়গায় মেহমানদের বসাতে চেয়েছিলেন নাজিমুদ্দিন, কিন্তু সালেহা বললো, বারান্দায় বন্দোবস্ত করে ফেলবে, কিন্তু মূল কাজের সময় সবুজ গায়েব। মিনতির মা,সালেহা আর নিম্মি মিলেই কাজ করেছে। প্রতিবেশী বৌ ঝিরা দুই একজন পরে হাতে হাত লাগিয়েছে। সালেহার কানে মোবাইলের ব্যাপারটা গেলেও সে ভাইয়ের সামনে কিছুই বলেনি। যা বলার বাড়ি গিয়ে বলবে। এক সপ্তাহ রাখার নাম করে নিয়ে আর ফিরতে দেবে না এই মেয়েকে। মায়ের গহনার সেট হাতিয়েছেন সালেহা। বিনিময়ে সনাতনী একটা চেন পরিয়ে দিয়েছে। নতুন বৌয়ের গলা খালি ভালো দেখায় না। প্রাণ ভরে বাড়ি দেখে সালেহা, এই বাড়ি,ভাইয়ের জমানো টাকা, গ্রামের জমি সব এখন তার, আয়েশ করে মুখে আরেকটা পান গুজে দেন সালেহা। ফল বিক্রির টাকা তার কাছেই আছে। ভাই চায়নি, সে দেয়নি। মিষ্টি কিনতে পাঠাবে সবুজকে। পুরো গ্রাম জানবে, সবুজের বিয়ে হয়েছে। পায়ে পায়ে ভাইয়ের ঘরে আসেন সালেহা,

• ভাইজান

• বলো

• কাইল রওনা হই আমরা?

• বেশ যাও

• কইতাছি আমার বৌমারে সাত দিন রাখুম

• ওর পরীক্ষার পর একেবারে নিয়ে যেও

• না ভাইজান গ্রামে আমাদের একটা সম্মান আছে

• বেশ নিয়ে যাও, পরীক্ষা দিতে দিও

• সবুজ যা কইবে তাই হইবো

নাজিমুদ্দিন বিছানায় এলিয়ে দিলেন শরীর। সামান্য কয়টা মেসেজ বিনিময়ের শাস্তি মেয়েটা আজীবন পাবে। চোখের কোণ ভিজে এলো তার। এই বয়সে এই ভুল কিভাবে করলেন তিনি? যেমন ভুল করেছিলেন, স্ত্রীর প্রসবকালীন সময়ে! স্ত্রীকে হারানোর বেদনা তাকে আজো কুরে কুরে খায়! এখন মেয়েটার সাথেও অন্যায় করলেন! বাবার রাগের মাথায় নেওয়া সিদ্ধান্তের বোঝা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে নিম্মির।

#

রিফাত বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যায়। বাবা বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

• বসো রিফাত, কথা আছে

• কি কথা আব্বা?

• এইটা তুমি কি করলা?

• কোনটা?

• এইযে নাজিমুদ্দিনের মেয়েটার জীবন নষ্ট করলা?

• কি বলেন আব্বা? রতনের সাথে পালায় গেলে? জীবন অনেক সুন্দর হতো?

• আমি সব মেসেজ পড়েছি,সেখানে ছড়া,কবিতা ছাড়া কিছুই ছিলো না, মেয়েটা রতনের পরিচয় জানতো না

• তাতে কি? আজকাল অনেক কিছু হচ্ছে

• হ্যাঁ হচ্ছে, সেটা আমাকে বলতে পারতে, আমি নাজিম ভাইকে ডেকে আস্তে আস্তে সবকিছু জানাতাম, মেয়েটার ফুপু একটা জালিম মহিলা, শেষ করে দিলো মেয়েটার ভবিষ্যৎ

• এত ভবিষ্যতের চিন্তা থাকলে প্রেম ভালোবাসা করতোই না

• সেটা কি আমাদের দেখার বিষয়?

• আপনি এত তরফদারী করেন কেন? নাজিম আংকেল কিভাবে আপনাকে অপমান করেছিলো ভুলে গেলেন?

• সেই বছর পাঁচেক আগের কথা, মনে রেখে প্রতিশোধ নিলে? পরে কিন্তু নাজিম আমার পেনশন যখন বন্ধ ছিলো, তখন সাহায্য করেছিল, আর ঐ টাকাটা আমিই সরাইছিলাম

• কি বলেন?

• হ্যাঁ, পশ্চিমপাড়ার যে জমি কিনেছি রাইসার জন্য ঐ জমির বায়নার টাকা দিতে নিয়েছিলাম, পরে আবার সেই টাকা ফেরত দিয়েছি, না বুঝে কাজটা যে করলা বাবা…..

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রিয়াজ সাহেব।

রিফাত রুমে ফিরে ব্যাগ নিয়ে সোজা বাসে উঠে পড়ে। তার মনে হচ্ছিলো ঐ মুহূর্তে তার দম আটকে সে মরেই যাবে। ভেবেছিল নাজিম আংকেলকে একটা সবক দিলে বাবা খুব খুশি হবে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত হয়ে গেল। ক্যাম্পাসে এসেই সে ফাহিমাকে কল দেয়। ফাহিমার সাথে টুকটাক আলাপ হয় ফোন মেসেজে। প্রেম না, আবার ঠিক বন্ধুত্বও না! ক্যাম্পাসে একমাত্র ফাহিমাই পারবে তাকে এই আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি দিতে!

• কি ব্যাপার এত জরুরী তলব? জিজ্ঞেস করে ফাহিমা

• আমি একটা ভুল করে ফেলেছি

• কি বাড়ি থেকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে?

• আরে না

• তাহলে?

পুরো ঘটনা রিফাত বুঝিয়ে বলে ফাহিমাকে। ফাহিমা বলে,

• আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি মেয়েটাকে পছন্দ করো, যখন দেখেছো মেয়েটা রতনের সাথে কথাবার্তা বলে তখন রাগে তোমার মাথা ঠিক ছিল না

• কি যা তা বলছো?

• আমার যা মনে হয়েছে তাই বললাম

• আমি আসলে বাবার হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম

• এটা কেমন প্রতিশোধ? মেয়েটার তো কোন দোষ নাই

• আমার কাছে মনে হয়েছে আঙ্কেল এর সম্মান নষ্ট করা যাবে

• এখানে আমাদের সমাজের সমস্যা, আমরা ভুল মানুষকে সবসময় টার্গেট করি, কিংবা কারো দুর্বল জায়গাতে আঘাত করি

• আমিও হয়তো তাই করেছি

• সে কারণটা যাই হোক, এখন কি করবে?

• বিয়ে তো হয়েই গেছে

• তোমার একবারও মনে হলো না বিয়ে ঠিক হওয়া একটা মেয়ে জেনে বুঝে রতনের সাথে প্রেম করবে না

• আমি আসলে কিছু ভাবতে পারছি না

• আর এভাবে দৌড়ে বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে কেন ফিরলে

• মনে হল তোমাকে বললে আমি সব সমাধান খুজে পাব

ফাহিমা অনেক ঠান্ডা স্বভাবের, পরিণত একজন মানুষ। সবসময় যেকোনো পরিস্থিতিতে, নিজেকে শান্ত রাখতে পারে। যেমন এই মুহূর্তে রাগে ফেটে গেলেও সে স্বাভাবিক আচরণ করছে রিফাতের সাথে। রিফাত কে সে অনেক আগে থেকে পছন্দ করে। কিন্তু সেই পরীক্ষার হলে পাশাপাশি সিট পড়ার পর থেকেই রিফাত ফাহিমার সাথে আলাপ করে। তারপর হঠাৎ করেই ফোন নম্বর আদান প্রদান হয়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট মেসেজ লেখে রিফাত তাকে। এর বেশিদূর ফাহিমা নিজেও আগাতে চায়নি। কিন্তু হঠাৎ করে কি থেকে কি হয়ে গেল! রিফাতেরই ভুল ওকে জীবনের কোন মোড়ে নিয়ে যাবে? রিফাতের এই আত্মগ্লানি কি ভালোবাসায় রূপান্তরিত হবে?

শ্রাবণের মধ্যদুপুর
১৪

শশুর বাড়িতে নিম্মির আজ প্রথম দিন। সালেহা নতুন শাড়ি পরতে দিয়েছে তাকে। নিম্মি ভেবেছিল অনেক কথা শোনাবেন ফুপু। মোবাইলে প্রেম বিষয়ক। কিন্তু তিনি একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি। এজন্য অনেক কৃতজ্ঞ বোধ করছে সে।

সালেহা সাধনা কে বললেন,
• তোর ভাবীরে সাজাই গুজাই দে, বাড়ির নতুন বউ, হাতে কানে সোনা পরবা, আজ আশেপাশে ঘুরে দেখো, কাল তুমি পায়েস রানবা

• তোমার সাজনের জিনিস কই? জিজ্ঞেস করা সাধনা

• কিছুই কেনা হয়নি, শুধু একটা কাজল আর ক্রিম আছে

• লিপিস্টিক?

• না তেমন মাখি না

• ও খালি প্রেম করতে পারো, সাজা ছাড়াই যদি ছেলেরা মজে তাইলে সমস্যা কি?

কোন উত্তর দেয় না নিম্মি। স্বপন তাকে নিষেধ করে গেছে।

• আরে একটু মশকরা করলাম

• ঠিক আছে

• লিপিস্টিক দিবা?

• না যা আছে তাই চলুক

• তুমি নয়া বউ

• কোন সমস্যা নেই

• পাশের বাড়ির চাচী দেখা করতে কইছেন

• বিকালে গেলে হবে

• অহন কি করবা

• একটু পড়তে বসি

• এত পইড়া কি হইব? আম্মায় তো পরীক্ষা দিতে দিব না

নিম্মি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। সবুজ তাকে কথা দিয়েছে তার পড়াশোনায় সবসময় সহযোগিতা করবে। কিন্তু ফুপুর রাগ, জেদ সম্পর্কে সে জানে, বাবাও আর তাকে পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করবেনা। হতাশ লাগে নিম্মির। কি হতে কি হয়ে গেল? ঘরে একটা বিছানা, পড়ার টেবিল আর আলমারি ছাড়া কোন আসবাব নেই। পড়ার টেবিলে সবুজের কিছু বই। গল্প,উপন্যাস নেই। জীবনে ঘাত, প্রতিঘাত সয়ে বড় হওয়া মানুষের আসলে এসব শখ থাকেনা। নিম্মি ভাবে মানুষটার সাথে তাকে সারা জীবন কাটাতে হবে, অথচ দুজনের কোন মিল নেই, নেই মনের টান। বাংলা সিনেমার মতো হুট করেই একদিন অমর প্রেম হবে তাদের? ভাত খেতে ডাকে সাধনা। সাধনা খুব সেজেগুজে থাকে। ফরসা গায়ের রঙ, তাতে লাল লিপস্টিক! লাল কালো বাটিকের সালওয়ার কামিজ, গলায় সরু চেন চিকচিক করছে, পান পাতার উপর লেখা এল, এই এল হলো নিম্মির মায়ের নাম! লতিফা বেগম লতা। কোন প্রতিক্রিয়া নেই নিম্মির। ফুপুর হাতেই বাবা মায়ের সব গহনা তুলে দিয়েছে। না দিয়েই বা কি করার ছিলো? সুমনা বসে, ফ্যাকাসে রুগ্ন মুখটা হাসিহাসি, এই একটা মানুষ নিম্মিকে মেনে নিয়েছে সহজভাবে, কোন কষ্টদায়ক কথা বলেনি, সবসময় মা, বোনের কথার হুল থেকে তাকে বাঁচাতে না পারলেও স্বান্তনার বাণী শুনিয়েছে।

বিকেলে চাচীরা এলেন বৌ দেখতে, নিম্মির যেতে হলো না। সোনালি পাড়ে মেজেন্টা সুতি শাড়িতে কেমন বৌ বৌ লাগছে,হাতে সিটি গোল্ডের বালা, অনেক খুঁজে এনেছে সালেহা। বোঝার উপায় নেই যে এটা স্বর্ণ না। এই ধাতু মেয়েদের আজীবন বিমুগ্ধ করে রাখে, মেয়েদের দিয়ে কি করায় আর কি না করায়! সকাল থেকে বাড়ির বাইরে সবুজ। তার খোঁজ কেউ নেয়নি। সেও তার কাজ সেরে শহরে চলে গেছে। স্কুল ছুটি হলেই মিলির সঙ্গে বের হবে। কিন্তু মেয়েটা কি আজো রাগ করে থাকবে? মিলিকে দূর থেকে স্কুল থেকে বের হয়ে অটোতে উঠতে দেখে, সবুজ চুপচাপ একটা রিকশায় চড়ে বসে, ইশারা করে রিকশাওয়ালাকে পিছু নিতে। মিলির বাসা কাছেই, একটা টাওয়ার বিল্ডিংয়ে। আজ সাথে মিষ্টি নেই। মিষ্টি কি তাহলে অসুস্থ? ফোন করলে তো রিসিভ করেনা। কিন্তু নম্বর ব্লক করেনি, এটা একটা সুখের কথা!

গ্রামের সবাই জড়ো হয়ে বৌ দেখছে। সবুজের দাদী এসেছেন মেয়ের বাড়ি থেকে, আরো কিছু বৃদ্ধা এসে বসলেন নিম্মির পাশে।

• কেমন বৌ আনছি আম্মা কন? সালেহা জিজ্ঞেস করে আহ্লাদী স্বরে

• বৌ মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর হইছে,তয় আমার নাতী কই

• শহরে গেছে

• আজকাল ভাইরে শহরেই বেশি দেখি, ভাবীর ভয়ে পলায় নাকি টিপ্পনী কাটে মৌরি, সবুজের ফুপাতো বোন

• তর মুখ খারাপ দেইখা আমি নিম্মিরে আনছি ঘরে, কামেই যায় আমার পোলা

• মৌরি অনেক বার দেইখাই কতাডা কইছে, এমনেই কয় নাই, সবুজের ফুপু বলেন

• তুই পড়তে যাস না? মানুষ গুনতে যাস? সালেহা সরে পড়ে

সাধনা রান্নাঘরে সেমাই রান্না করছিলো, তার খুব ইচ্ছা ছিলো আসরে সেও বসবে, কিন্তু মা জোর করে পাঠালো, সবার সামনে নিম্মির অনেক আদর দেখাতে হবে। সেমাই আর পেয়ারা কেটে ট্রেতে সাজিয়ে আনে সালেহা। সবুজ কিছু কিনে রাখেনি, সালেহা রাখাল পাঠিয়ে ব্যবস্থা করেছে, মৌরির বলা কথা তারও মনে কাটা হয়ে আছে। সবুজের আচার ব্যবহার অনেক বদলে গেছে, তাকে কোন কিছু প্রশ্ন করলে, সুন্দর করে আর জবাব দেয় না। সালেহা জানে বিয়েটা তার পছন্দ মত হয়নি। কিন্তু তাই বলে এভাবে ঘরের বাইরে থাকা তো ঠিক না। আর শহরে ভাইয়ের নজরে পড়লেও মুশকিল। ছোট একটা শহর, দুকান পাঁচ কান হতে কতক্ষণ? কথা ছড়ালে বিপদ।

• কি বৌমা? মা মরা মাইয়াটার সব গয়না তুইলা রাখছ? সাধনার জন্য?

• কি কন আম্মা?

• ঠিকই কই, আইজই অর জিনিস অরে বুঝাই দিবা

• সেমাই খান আম্মা

• আমি অজু কইরা, আসর পইড়া আসি, বৌ আসো নামাজ পইড়া নাও, নাতবৌয়ের হাত ধরে কল পাড় যান দাদী

সবুজ মাত্র ফিরেছে, তাকে কোন প্রশ্ন করার সাহস পায়নি সালেহা, কিন্তু নাটক করার লোভ সামলাতে পারলো না! সবুজ ঘরে বসতেই গহনার পুটলি নিয়ে হাজির,

• এই নাও বৌমা তোমার আমানত, গ্রাম দ্যাশে এইগুলান কাছে রাখা নিরাপদ না, তাই আমি আইনা রাখছি, তুমি এতগুলা মাইনষের সামনে আমারে ছোট করলা

নিম্মি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে পুটলিটা নেয়। এতে তার মায়ের গহনা, তার মায়ের শাড়ির টুকরোতে পেঁচানো,

• আমি কাউরে কিছু লাগাইনি ফুপু, উনারা যা বলেছেন দেখেই বলেছেন, নতুন বৌয়ের গা খালি,এমন বললেন

• সবুজ বাপ আমার কাদো কাদো স্বরে কথা শুরু করার আগেই সবুজ বলে ওঠে

• মা খাওয়ার কিছু থাকলে দাও, সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি

যদিও ভুল কথা, মিলির স্কুলের সামনের দোকান থেকে আট, দশ কাপ চা তো খেয়েছেই!

সালেহা দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে যায়। ভেবেছিল নিম্মি বলবে, না আপনার কাছেই থাক, কিন্তু চালাক মেয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো!

• গহনা নিয়ে ভালো করছ, মেয়েদের শক্তি হলো এই গয়না, আম্মা সারাজীবন তার গয়না আগলে রাখছে, না খাইয়া থাকছে তাও গয়নায় হাত দেয়নি, আর এখন সাধনার জন্য তোমার গয়না হাতাইছে, কি আর বলবো বিরক্ত স্বরে বলে সবুজ, আমি কি কম করেছি এদের জন্য? সাধনার জন্য কি আমি গয়না গড়ে দেব না? সুমনার চিকিৎসার দিকে কিন্তু মায়ের মন নাই…..

শ্রাবণের মধ্যদুপুর
১৫

সবুজের মুখে এমন অকপট কথা শুনে অবাক হয় নিম্মি। সে রান্নাঘরে এগিয়ে যায়। ফুপু আর সাধনার কথা-কাটাকাটি কানে আসে, সাধনা খুব রেগে গেছে গহনা নিম্মিকে দেওয়াতে, তার গলার চেইন কোনভাবেই সে খুলে দেবেনা!
নিম্মি না শোনার ভান করে, সেমাই ফল আর পানি ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে যায় সবুজের জন্য।

• চা খাবেন?

• না সারাদিন অনেক কাপ খাইছি, রাতে ঘুমই আসবেনা

• খারাপ কি? জাগবেন আমার সাথে

• তুমি জাগবা কেন?

• পড়তে হবে, সারাদিন পড়তে বসতে পারিনি

• কেন?

• দাদী, মৌরি আর প্রতিবেশীরা এসেছিলো, মৌরির বলা কথাটা মুখ ফসকে বলতে গিয়েও চেপে গেল নিম্মি, সবুজকে তার পক্ষে চাই

নাজিমুদ্দিন সাহেবের কিছুই ভালো লাগছে না। একমাস হতে চলল নিম্মি গ্রামে গেছে, ওর ফোন রেখে গেছে। সরাসরি কথা হয়না। সবুজ ফোন রিসিভ করেনা। কালেভদ্রে রিসিভ করে, সালেহাকে ফোন ধরিয়ে দেয়। নিম্মির জীবনটা এভাবে নষ্ট না করলেও চলত। সেদিন মেয়েটার কথা শুনত, তাহলেই আর এই ভুল হয়না। রিফাতের মাথায় কি ভূত চাপলো আর তিনিই বা কেন এত মাথা গরম করলেন…..সালেহা ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক কথা বলে কিন্তু নিম্মিকে পাঠাতে রাজি হয়না। আজ একবার গেলে কেমন হয়? হাতে করে বেশি করে মিষ্টি নিয়ে যেতে হবে। মিনতির মাকে ডেকে পাঞ্জাবি ইস্ত্রি করে দিতে বলেন নাজিমুদ্দিন। গত তিনটা শুক্রবার পুরো দিন বুক ভার হয়ে ছিলো, মিনতির মায়ের সাথে আর কি কথা বলা যায়, তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, এই একাকিত্ব নিম্মিকে ঠেলে দিয়েছিল সম্পুর্ন অচেনা মানুষের সাথে মোবাইলে মেসেজ আদান-প্রদানে। মাঝে মাঝে কি তার মনে হয় না? খালি বিছানার ওপাশে কেউ বসুক। তার চুলের সুবাসে ঘুম ভাঙুক। অফিস থেকে ফেরার পথে তার জন্য এটাসেটা আনার ফর্দ করুক। রাতে ঘুমের মাঝে শরীরে হাত পড়ুক! নিম্মির জন্য তিনি সবকিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে শেষমেষ মেয়েটাকে এমন এক সাগরে ফেলে দিলেন? মেয়েটা তো আর সাতরে উঠতে পারবে না! খুব অসহায় অনুভব করছেন নাজিমুদ্দিন।

• ভোরে উইঠা বাসে যাওন লাগত, অহন যাইয়া কিসে ফিরবেন? এই লন পাঞ্জাবি, আগে কইলে পিঠা বানায় দিতাম

• না ফিরতে পারলে নাহয় থেকেই যাব, ওটা শুধু আমার জামাই বাড়ি না, বোনের বাড়ি

মিনতির মা আর কথা বলেনা। দুপুরের রান্নার জোগাড় শুরু করেনি সে। সবকিছু ফ্রিজে গুছিয়ে রেখে, ছাদ থেকে কাপড় নামিয়ে, সব দরজা, জানালা বন্ধ করে চলে গেল। নাজিমুদ্দিন বাজারে গেলেন। সবচেয়ে ভালো মিষ্টি কিনবেন ভাবলেন, কিন্তু মিষ্টি বেশি নেই। দুই দিন আগে জানালে তারা টাটকা বানিয়ে দিয়ে যায়। হুট করে সিদ্ধান্ত নিলে এমন হবেই, গ্রাম থেকে আরো মিষ্টি কিনতে হবে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তিনি অবাক, বাস থেকে নামছে সবুজ। শুক্রবার কি কাজ থাকতে পারে? অবশ্য ওর তো চাকরি না, ব্যবসা। ব্যবসার কাজে এসেছে হয়তো। তিনি এগিয়ে যাওয়ার আগেই রিকশায় উঠে পড়ে সবুজ। অগত্যা বাসে উঠে পড়েন নাজিমুদ্দিন। জুমুআর নামাজ ধরতে হবে। পারবেন কিনা আল্লাহ জানেন! এই বাস এত বার থেমে থেমে যায়, এক ঘন্টার রাস্তা এরা দুই আড়াই ঘন্টা লাগিয়ে দেয়। ভোরবেলা আরামে আসা যায়, খুব বেশি থামেনা।

ভর দুপুরে ভাইকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন সালেহা। ফোন না করে সরাসরি মিষ্টি হাতে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরিহিত দুখী চেহারার মানুষটাকে সালেহার কেমন যেন মায়া লাগে। আবার ভয় হচ্ছে, নিম্মিকে যদি নিয়ে যেতে চায়?

• কেমন আছিস?

• আলহামদুলিল্লাহ আল্লায় রাখছেন

• আলহামদুলিল্লাহ

• ভিতরে আসেন

• এগুলা রাখ

• এগুলোর কি দরকার ছিল ভাইজান?

• এখন তো এটা খালি বোনের বাড়ি না! মেয়ের শ্বশুর বাড়ি

• মেয়ের বাড়ি বলেন শ্বশুর বাড়ি কেন হবে?

• আচ্ছা না হয় তাই বলবো, মেয়েটাকে ডেকে দে

সালেহা মিষ্টিগুলো নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। শুক্রবার দিনটাও সবুজ বাড়িতে নেই। নিম্মি রান্নাঘরে কাজ করছিল, একটু থমকে যায় সালেহা, এই শরীরে ভাইয়ের সামনে যাবে? ঘর্মাক্ত ক্লান্ত চেহারা নিয়ে? নাকি বলবে গোসল করে যেতে, হ্যাঁ সেই ভালো!

• বউ তুমি গোসলে যাও

• কাজ তো পড়ে আছে ফুপু

• থাউক, নয়া বউ, এমন ঘেমে চুপসে আছো, মাইনষে কি বলবে, এমন তো না সংসারের সব কাজ তুমি করো

• কিছু হবে না আমি কাজটা সেরেই যাই

• যা বলতাছি করো পিছনের পুকুরে যাবা

• আচ্ছা

সবুজদের বাড়ির তিন পাশেই পুকুর, সামনের উঠান পেরিয়ে রাস্তা, সব পুকুরে মাছ ছাড়া আছে। কলের পানিতেই এ বাড়ির মেয়েরা গোসল করে। কিন্তু চুল নষ্ট হয়ে যাবে সেই দোহাই দিয়ে নিম্মিকে পুকুরে পাঠায়। বাশের মাচান করে দেওয়া আছে, সেখানে কাপড় ধোয়ার ব্যবস্থা আছে, গামছা সাবান কাপড় সবকিছু গুছিয়ে বের হয় নিম্মি। এই ব্যাপারটার একটা ফয়সালা দরকার। একদিন পিছলে পড়ে গেলে তো বিপদ হবে। অবশ্য সে সাঁতার পারে। তারপরও চারিদিকে গাছের ছাউনি দেওয়া, স্যাতসেতে পুকুর তার পছন্দ না। কিন্তু সবুজকে এসব বলা হয়নি। দ্রুত গোসল সেরে ঘরে উঠে কাপড় বদলে নেয় নিম্মি। সাধনা এসেছে,

• ভাবি বৈঠক খানায় যাও

• কেন কি হইছে

• গেলেই বুঝবা

• ঠিক আছে

চলবে