শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-১০

0
213

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১০

১১!!
সকাল দশটা,
আজ মা এলেন আমার অফিসে। মাকে দেখে বেশ খারাপ লাগল। বেশ ক‌য়েক দিন পর মা কে দেখলাম। এমন‌কি রাগ তার সা‌থে কথাও হয়নি ব‌লি‌নি। শ‌ফি‌কের থে‌কে মা‌য়ের খোঁজ খবর নি‌লেও, অভিমান ক‌রে তা‌কে কল করা হয়‌নি। মা এসেই কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে আমা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধর‌লেন। আমিও তা‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে একরকম কান্নাই ক‌রে দিলাম। আস‌লে মা‌য়ের থে‌কে কখ‌নো এত‌দিন দূ‌রে থা‌কি‌নি। তা‌কে কখ‌নো কষ্ট দেই‌নি। কখ‌নো তার কথার অবাধ্য হই‌নি। এবার বাধ্য হ‌য়েই অবাধ্য হলাম। আস‌লে সবার থে‌কে দূ‌রে থাক‌তে কষ্ট হ‌লেও সবার প্র‌তি একটা তীব্র অভিম‌ান জ‌মে গেছিল; যার কার‌ণে চে‌য়েও কেন জা‌নি বা‌ড়ি ফির‌তে পার‌ছিলাম না। তীব্র অভিমা‌নের দেয়ালটা চে‌য়েও ভাঙ‌তে পার‌ছিলাম না।

মা এসে অনেক কথা বল‌লেন। বা‌ড়ি যাবার জন্য বুঝা‌লেন। গতকাল সকা‌লে আসলে হয়ত মা‌কে না ক‌রে দিতাম, কিন্তু গতকাল রা‌তে ছো‌টোমামার সাথে কথা বলার পর নি‌জেই সিদ্ধান্ত নি‌য়ে‌ছিলাম বা‌ড়ি যাব। ছো‌টো মামার কথা নি‌জে‌ নি‌জেই অনুধ‌াবন করলাম আমার বা‌ড়ি যাওয়া দরকার। এ্যাট‌লিস্ট সবাই‌কে আমার গুরুত্ব বুঝাতে হ‌লেও বা‌ড়ি যাওয়া দরকার। তাছাড়া সব‌কিছু ঠিক করতে হ‌লে আমা‌কে অবশ্যই বা‌ড়ি যেতে হ‌বে। বা‌ড়ি না গি‌য়ে কিছু ঠিক করা সম্ভব না।

১১!!
শুক্রবার,
অব‌শে‌ষে চৌদ্দ বছ‌রের সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমার আর ঐশীর বি‌য়ে হ‌য়ে গেল। ঐশীর প‌রিবার সহ‌জে রাজী হ‌লেও আমার প‌রিবার রাজী হয়‌নি। ঐশীর সা‌থে সে‌দিন কথা বলার পর সরাস‌রি ওদের বা‌ড়ি গি‌য়ে ওর বাবা‌ এবং প‌রিবার‌কে বু‌ঝি‌য়ে ব‌লে‌ছিলাম,
‘ক‌াল আমার পরিবার আপনা‌দের কা‌ছে বি‌য়ের প্রস্তাব নি‌য়ে আস‌বে দয়া ক‌রে রা‌জি হ‌য়ে যা‌বে এবং বি‌য়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলবেন।’
তারা প্রথ‌মে অমত কর‌লেও আমার অনু‌রোধ রাখ‌লেন। তাছ‌াড়া ঐশী রা‌জি থাকায় বা‌কি সব‌াই তেমন অমত করে‌নি।

তারপর বা‌ড়ি ফি‌রে মা আর ছো‌টো মামা‌কে বলেছিলাম,
‘কাল আপনারা ঐশী‌দের বা‌ড়ি গি‌য়ে বি‌য়ের পাকা কথা দি‌য়ে আস‌বে। আগামী শুক্রবার বি‌য়ে হ‌বে সে কথা বল‌বেন।’
মা আর সা‌মিয়া তখনও বেশ ঝা‌মেলা পাকা‌তে চাই‌লে, আ‌মি সা‌মিয়া‌কে এক ধমক দি‌য়ে ব‌লে‌ছিলাম,
‘‌ছো‌টো বোন ছো‌টো‌বো‌নের ম‌তো থা‌কবি। তোর মতামত নি‌য়ে আমি নিশ্চয়ই আমার জীব‌নের সিদ্ধান্ত নিব না? আমার জীব‌নের বিষ‌য়ে কথা বলার তুই কেউ না। তো‌কে ব‌ড়ো‌দের কথায় থাক‌তে দি‌য়ে‌ছি সেটাই অনেক বে‌শি। এখা‌নে থাক‌তে যখন দি‌য়ে‌ছি তখন চুপচাপ কথা শুন‌বি। ব‌ড়ো‌দের কথার মা‌ঝে খবরদার একটা কথা বল‌বি না। সা‌মিহা তো তোর ম‌তো না, তুই এমন খ‌বিশ হ‌লি কেন? এত খচ্চর হ‌লে জীব‌নে চলা যায়? কোর ঝগড়া‌টে স্বভা‌বের জন্য তোর শ্বশুর বা‌ড়ির লোক পর্যন্ত তো‌কে পছন্দ করে না। নি‌জের রাগ‌কে কমা। আর আমার বিষ‌য়ে খবরদার নাক গলা‌বি না।’

‌ছো‌টো মামাও আমার কথায় সহমত প্রকাশ ক‌রে সা‌মিয়া‌কে বকাঝকা কর‌লেন। সা‌মিয়া চুপ ক‌রে গেল। শ‌ফিকও আর কো‌নো কথা বলল না। ত‌বে মা বল‌লেন,
‘ওরা না হয় ছো‌টো কথা বল‌তে পার‌বে না, কিন্তু আমি তো ব‌ড়ো। তাছ‌াড়া তোর মা হিসা‌বে তোর বি‌য়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সব‌চে‌য়ে বে‌শি আমার। সে অধিকার থে‌কে বল‌ছি তুই ঐশী‌কে বি‌য়ে কর‌তে পার‌বি না।’

আ‌মি শান্ত ক‌ণ্ঠে বললাম,
‘ভুল বল‌লে মা। বি‌য়ে যে‌হেতু আমার, সিদ্ধান্তও আমার। তে‌ামা‌দের হ্য‌াঁ বা না তো শুন‌তে চাই‌নি। ব‌লে‌ছি কাল গি‌য়ে বি‌য়ের কথা বলবে। আগামী শুক্রবার বি‌য়ের সকল আয়োজন করা কথা বল‌বে। তু‌মি গে‌লে যা‌বে না হয় ছো‌টো মামা যাবে। মা, বি‌য়ে তো আমি ঐশী‌কেই করব, সে পুু‌রো পৃ‌থিবী রা‌জি না থাক‌লেও। তোমরা য‌দি খু‌শি খু‌শি যাও তো ভা‌লো। নয়‌তো বি‌য়ে আমি একাও কর‌তে পা‌রি। আর একা বি‌য়ে কর‌লে আমি আর এ বা‌ড়ির দি‌কে ফি‌রেও তাকাব না। তু‌মি থে‌কো তোমার বা‌কি ছে‌লে মে‌য়েদের নি‌য়ে। আল্লাহর কসম কে‌টে বল‌ছি মা, কাল যদি তু‌মি না যাও আর আমার বি‌য়ে‌তে মত না দেও আমি আর এ বা‌ড়ি‌তে পা দিব‌ না।’

মা দীর্ঘশ্ব‌াস ছে‌ড়ে রা‌জি হ‌লেন। ত‌বে আমার মনে হালকা স‌ন্দেহ জাগ‌ছিল। সে কার‌ণে আ‌গেই শক্ত ক‌ণ্ঠে ব‌লে দি‌য়ে‌ছিলাম,
‘ঐশীদের বা‌ড়ি গি‌য়ে হা‌সি মু‌খে বি‌য়ের দিন ঠিক কর‌তে হ‌বে। তা‌দের কো‌নো রকম বা‌জে কথা বলা চল‌বে না। আর মা আর ছো‌টো মামা আর সা‌মিহা যা‌বে কেবল। শ‌ফিক কিংবা সা‌মিয়া যে‌তে পার‌বে না।’

কারণ জা‌নি তো আমার হাজার বারণ করার পরও ঝা‌মেলা যা করার ওরা দুজনই কর‌ব। মা আমার শর্ত মান‌লেন। আস‌লে বাধ্য হ‌য়ে মান‌লেন। সংসারটা এখনও আমার টাকায় চ‌লে। এই যে ঘ‌রের সবাই রাজার হা‌লে থাক‌ছে তার পু‌রোটাই আমার আয়ে। শ‌ফিক তো কিছুই দেয় ন‌া। সব‌াই হয়তো ভাব‌ছে যে হাঁসটা সোনার ডিম দেয়, তার রাগ সহ্য করা উচিত। সে মে‌শিনটা টাকা ছাপায় তার গড়গড় বির‌ক্তিকর শব্দও মধুর লা‌গে।

‌তো অব‌শে‌ষে কো‌নো রকম ঝা‌মেলা ছাড়া আমার আর ঐশীর বিবাহ সম্পান্ন হ‌লো। আস‌লে ঝা‌মেলা ছাড়া ন‌া, বহু ঝা‌মেলার পর। চৌদ্দ বছর সাত মা‌সের এত এত ঝা‌মেলার পর দুজন দুজন‌কে পেলাম। ধুমধাম ক‌রে আশেপা‌শের ক‌য়েক এলাকা জা‌নি‌য়ে আমা‌দের বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে। আলোকসজ্জা, মানু‌ষের ভীর আর জ‌মি‌য়ে খাওয়াদাওয়া‌র মতো জমকা‌লো অনুষ্ঠান হ‌য়ে‌ছে। অব‌শে‌ষে সে আমার হ‌লো। আমরা দুজনার হলাম।

রাত বা‌রোটা
‌পৌষ মাস চল‌ছে, তবুও আজ অসীজ‌নে মুষলধা‌রে বৃ‌ষ্টি হ‌চ্ছে। আমার রুমটার ফু‌লে সাজা‌নো বিছানায় ঐশী গু‌টিসুটি মে‌রে ব‌সে আছে। বৃ‌ষ্টির কার‌ণে শীতটাও প্রচণ্ড অনুভূত হ‌চ্ছে। প্রচণ্ড শী‌তে নববধূ সা‌জে গা‌য়ে চাদর মু‌ড়ি‌য়েও কাঁপ‌ছে ‌মে‌য়েটা। রা‌তে আমা‌দের বা‌ড়ি‌তে আসল ও। য‌দিও মা আর সা‌মিয়া খু্ব রাগ ক‌রে আছে। ওর সা‌থে ঠিকভা‌বে কথাও ব‌লেনি। ওর আপ্যায়নও ক‌রে‌নি। সব‌কিছু আমার প‌রের বোন সা‌মিহা একাই ক‌রেছে। তারা কিছু ক‌রে‌নি তা‌তে কী?
অনেক তো ভাবলাম তা‌দের জন্য এবার নাহয় নি‌জের জন্য একটু ভাবলাম। ভাবল‌াম সেই মে‌য়েটার জন্য যে কো‌নো রকম স্বার্থ ছাড়া শুধু আমা‌কে ভালো‌বে‌সে‌ছে। অপেক্ষা ক‌রে‌ছে আমার জন্য। ঐশীর পা‌শে ব‌সে বললাম,
‘আমা‌দের জীব‌নে শ্রাবণ মাসটা বোধ হয় পৌষ মা‌সে এলো।’
ঐশী মৃদু হে‌সে বলল,
‘পৌষ মাস? মা‌নে কারো পৌষ মাস তো কা‌রো সর্বনাশ।”
খুব হাসলাম দুজ‌নে।

অব‌শে‌ষে আমা‌দের শ্রাব‌ণের অপেক্ষার অবসান তো হ‌লো ত‌বে তা পৌষ মা‌সে।

১২!!
বি‌য়ের পর সব‌কিছু এত সুন্দরভা‌বে যা‌চ্ছিল যে, সব‌কিছু স্বপ্ন ম‌নে হ‌চ্ছিল। ঐশী একজন পার‌ফেক্ট জীবনসঙ্গী। এত ম্যা‌চিওর, অর বুঝদার যে আমা‌কে কিছু বু‌ঝি‌য়ে দি‌তে হয়‌নি। সব‌কিছু নি‌জেই খুব অল্প সম‌য়ের ম‌ধ্যে সা‌জি‌য়ে গু‌ছি‌য়ে নি‌য়ে‌ছে। যেন কত বছর যাবত সংসার কর‌ছে। দুজন মি‌লে ক‌দিন বেশ অনেক জায়গায় ঘু‌রে আসলাম। চট্টগ্রাম, রাঙামা‌টি, বান্দরবান, খাগড়াছ‌ড়ি, নীল‌গি‌রি, সি‌লেট। বেশ চলছিল সব‌কিছু, কিন্তু ঘু‌রে বা‌ড়ি ফেরার পর সা‌মিয়া আর শ‌ফিক জায়গা জ‌মি‌তে যার যার ভাগ বু‌ঝে চাইল।

চলবে…