শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-১১

0
195

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১১

সব‌কিছু সুন্দর চল‌ছিল। এতবছর পর আমার জীব‌নে যেন প্রকৃত সুখ ধরা দিলে‌া। আর যার পু‌রো কৃ‌তিত্ব ঐশীর। আমার বউ এর। মে‌য়েটা এত ভা‌লো, মি‌ষ্টি আর বুঝদার যা বলার বাই‌রে। জীব‌নের যে বয়‌সে ছে‌লেরা বাচ্চা‌দের উচ্চ‌শিক্ষার কথা ভা‌বে সে বয়‌সে এসে আমি আমার নতুন জীবন, সংসার জীবন শুরু ক‌রে‌ছি। আর শুরুটা ঝা‌মেলা দি‌য়ে হ‌য়েলেও, শুরুর পর সব‌কিছু যেন রঙীন আর সুন্দর হ‌য়ে উঠল।

এ বয়সের বি‌য়ে‌তে এত রঙ দেখ‌তে পা‌বো ভা‌বি‌নি। জীবনটা হুট ক‌রে এত রঙীন হ‌বে ভা‌বি‌নি। যেন হাজার র‌ঙের রঙ ধনু‌তে আমা‌দের জীবন র‌ঙে ঝলমল কর‌ছে। ঐশী আমা‌কে আমার বয়সটা মো‌টেও বুঝ‌তে দি‌চ্ছে না। যেন আমি সেই পঁ‌চি‌শের যুবক আর ঐশী সেই আঠা‌রোর চঞ্চল কি‌শোরী। মে‌য়েটা এত উচ্ছ্বল, চঞ্চল আর মায়াময়ী মুহূ‌র্তেই আমা‌কে ভা‌লোবাসার এক শক্ত বাঁধ‌নে বেঁ‌ধে ফে‌লে‌ছে। আমা‌কে আমার বয়স বুঝ‌তেই দি‌চ্ছে না। সবসময় এমন অনুভব করা‌চ্ছে যেন নব‌যৌব‌নে পা দেওয়া আমরা দুজন।

গতকাল রাত একটার সময় ছা‌দে নি‌য়ে গেল। চারপা‌শ তখন চাঁ‌দের আলোয় ঝলমল কর‌ছে। সেই ‌মি‌ষ্টি জোৎস্নায় ভিজলাম আমর‌া। একে অপর‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে চাঁ‌দের আলো মাখলাম। কনক‌নে শী‌তে একই চাঁদ‌রে জড়াজ‌ড়ি ক‌রে ছাদে সময় কাটালাম। শী‌তের‌ রা‌তে চাঁ‌দের আলোয় জোৎস্না স্নান করল‌াম। ও যখন আমার বু‌কে মাথা রা‌খে, আমার বু‌কে, চো‌খে চুমু খায় তখন আমার নি‌জে‌কে পৃ‌থিবীর সব‌চে‌য়ে সুখী‌দের একজন ম‌নে হয়।সৃ‌ষ্টিকর্তা এত বছর আমা‌কে যে কষ্ট দি‌য়ে‌ছেন তা সু‌দে আস‌লে ফি‌রি‌য়ে দি‌য়ে‌ছেন ঐশী‌র ম‌তো মি‌ষ্টি একটা মে‌য়ে‌কে জীবন সঙ্গী রূ‌পে দি‌য়ে। সৃ‌ষ্টিকর্তার কা‌ছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।

সব‌কিছু সুন্দর চল‌ছিল। ঐশী সব‌কিছু বেশ মা‌নি‌য়ে গু‌ছি‌য়ে চল‌ছিল। য‌দিও মা আর সা‌মিয়া প‌দে প‌দে ওর কাজ ক‌ঠিন করার চেষ্টা করত। তবুও গুণী মে‌য়েটা সব‌কিছু নিজ থে‌কে সুন্দরভা‌বে সাম‌লে নেয়। গু‌ছি‌য়ে নেয়, মা‌নি‌য়ে নেয়। আমা‌কে বু‌ঝে নেয়। কী ভাব‌ছেন অন্য স্বামীদের ম‌তো‌ আমি কেবল ওকেই মা‌নি‌য়ে নি‌তে বল‌ছি? নি‌জে মা বো‌নের কা‌ছে চুপ থা‌কি? না। অতটা মেরুদন্ডহীন পুরুষ আমি না। ওর সকল স‌ঠিক কা‌জে আমি ওকে পূর্ণ সা‌পোর্ট ক‌রি।

আজ সকা‌লে ঐশী ব্যা‌ং‌কে যাওয়ার পর মা আমা‌কে বল‌লেন,
‘সায়ন, ঘ‌রে শুধু শুধু দু‌টো কা‌জের লোক দি‌য়ে কী করব? একটা ছা‌ড়ি‌য়ে দেই।’
আ‌মি ভ্রু কুচ‌কে বললাম,
‘‌কেন? তু‌মি তো আগে বল‌তে একজন পার‌মেন্ট কা‌জের লো‌কে তোমার হয় না। সে কার‌ণে ছুটা একজন বুয়া রাখলা। এখন কেন ছাড়াবা?’
মা হে‌সে বল‌লেন,
‘আগে তো ঘ‌রে বউ ছিল না, এখন তো ঘ‌রে বউ আস‌ছে। বউ থাক‌তে আব‌ার ছুটা বুয়া কেন লাগ‌বে?’

কথাটা শু‌নে এত বে‌শি খারাপ লাগল যে রাগ উঠে গেল। তা-ও শান্ত ক‌ণ্ঠে বললাম,
‘ঘ‌রে কী বউ রূ‌পে কা‌জের মে‌য়ে আন‌ছো যে, এখন সে এসে‌ছে ব‌লে কা‌জের লোক ছা‌ড়ি‌য়ে দিবা?’
‘‌তো ঘ‌রের বউ কাজ কর‌বে না?’
‘‌কেন কর‌বে না, যতটুকু দরকার ততটুকু অবশ্যই কর‌বে, কিন্তু ঘ‌রে বউ আস‌ছে ব‌লে কা‌জের লোক ছা‌ড়ি‌য়ে তা‌র ঘা‌ড়ে সব কাজ ফে‌লে দি‌তে হ‌বে এটা কেমন কথা? সে নিশ্চয়ই এ ঘ‌রে কা‌জের লোক হ‌তে আসে‌নি।’
‘‌নি‌জের সংসা‌রের ক‌াজ কর‌বে না?’
‘‌কেন কর‌বে না, তার যতটুকু করার দরকার বা তার সা‌ধ্যে যতটুকু কুলায় ততটুকু অবশ্যই কর‌বে, কিন্তু সেটা কা‌জের লোক হ‌য়ে না। তাছাড়া ঐশী তো সারা‌দিন ব‌সে থা‌কে না? ও-ও তো ব্যাং‌কে চাকরি ক‌রে? সারা‌দিন চাক‌রি ক‌রে এসে সন্ধ্যা‌বেলা নি‌জের সাধ্যম‌তো চেষ্টা ক‌রে। সকা‌লের নাস্তা, রা‌তের খাবারও ও রান্না ক‌রে। তাছাড়া টুকটাক বহু কাজ ক‌রে। আর আমার যে কাজ ক‌রে বা ওর ব্য‌ক্তিগত যে কাজ থা‌কে তার কথা না হয় বাদই দিলাম।’

মা বেশ রাগ ক‌রে বল‌লেন,
‘‌সে জন্যই চাক‌রি করা বউ আন‌তে চাই‌নি, কিন্তু তুই জিদ ধ‌রে আন‌লি। চাকরি করা বউ দি‌য়ে ঘ‌রের কো‌নো কাজ হয় না।’
‘মা, বউ তো আমার। সে চাক‌রি করা না করা আমার ব্যাপার। সে ঘ‌রের কাজ ক‌রে কি না তা-ও আমি দেখব। তে‌ামার তো দেখ‌তে হ‌বে না, মা। দরকার হ‌লে তোমা‌কে আরেকটা কা‌জের মে‌য়ে রে‌খে দি‌চ্ছি।’

মা দাঁ‌তে দাঁত চে‌পে বল‌লেন,
‘সায়ন, তুই এমন বউ এর ভেড়া হ‌য়ে গেলি? বি‌য়ে হ‌তে না হ‌তেই বউ তো‌কে আঁচ‌লে বেঁ‌ধে ফেলল? অথচ তোর বাবা মো‌টেও তোর ম‌তো ছিল না। তোর দা‌দি আমাকে কত কাজ করা‌তেন, অত্যাচার ক‌রে‌ছে তি‌নি কখনো মুখ ফু‌টে কিছু ব‌লে‌ননি।’
‘মা, দাদি গু খে‌য়ে‌ছিলেন ব‌লে তু‌মিও গু খা‌বে? বাবা মনুষ্যত্ব ছাড়া কাজ ক‌রে‌ছি‌লেন ব‌লে কী আমা‌কেও কর‌তে হ‌বে?’

মা যেন আমার কথায় নড়েচ‌ড়ে বস‌লেন। চোখ ব‌ড়ো ব‌ড়ো ক‌রে বললেন,
‘এসব কী ব‌লছিস, সায়ন?’
‘ভুল কী ব‌লে‌ছি, মা? দা‌দি তোমা‌কে কষ্ট দি‌তেন ব‌লে তু‌মিও ঐশী‌কে কষ্ট দি‌বে? দা‌দি অন্যায় ক‌রে‌ছি‌লে ব‌লে তু‌মিও অন্যায় করবে? দা‌দি তোমার প্র‌তি অন্যায় ক‌রে‌ছিল ব‌লে তু‌মি তার প্র‌তি‌শোধ ঐশীর উপর নি‌বে? তাহ‌লে দা‌দির ম‌ধ্যে আর তোমার ম‌ধ্যে পার্থক্য কোথায়? আর স‌ত্যি ক‌রে ব‌লো মা, দা‌দি যখন তোমার সা‌থে অন্যায় কর‌তেন আর বাবা সব দেখেও চুপ থাক‌তেন তখন কী তোমার কষ্ট হ‌তো না? আমি ঐশী‌কে সে কষ্টটা দি‌তে চাই না, যে কষ্টটা তু‌মি বাবার কাছ থে‌কে পে‌য়েছ।’

মা বেশ রাগ ক‌রে বল‌লেন,
‘বেশ নী‌তি জ্ঞান ঝ‌ারছিস। এসব তোর বউ তো‌কে শি‌খি‌য়ে‌ছে তাই না? বি‌য়ে হ‌তে না হ‌তে না হ‌লেও তো‌কে বশ ক‌রে আঁচ‌লে বেঁ‌ধে ফে‌লে‌ছে। এ জন্যই শি‌ক্ষিত চাক‌রি করা মে‌য়ে‌দের আমার পছন্দ না।’
আ‌মি হাসলাম। তারপর বলল‌াম,
‘ মা, স‌ত্যি কথা সবাই হজম কর‌তে পা‌রে না। সে শ‌ক্তিও সবার নেই। যখন স‌ত্যি কথা হজম কর‌তে পা‌রে না, তখন ব‌লে নী‌তিজ্ঞান ঝার‌ছিস। আর আঁচ‌লে বাঁধার কথা বল‌ছো? আঁচ‌লে তো তু‌মিও আমা‌কে বাঁধ‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লে সে কারণেই তো আমা‌কে বু‌ড়ো হওয়ার পরও বি‌য়ে করা‌তে চাও‌নি। নি‌জের হা‌তের পুতু‌লের ম‌তো চালা‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লে, কিন্তু আমি তো মানুষ। আমার মা‌ঝে রক্ত মাংস আছে। বি‌বেক, জ্ঞান, শিক্ষা‌ আছে। সে কার‌ণে নিজের ভা‌লোটা দে‌রি‌তে হ‌লেও বুঝ‌তে পে‌রে‌ছি। আর তাছাড়া তু‌মি না‌কি ঐশী‌কে ঘ‌রের বউ হিসা‌বে মা‌নো না। তো ওর ঘ‌রে কাজ করা না করায় তোমার কী আসে যায়? ওর চাক‌রি করা না করায় তোমার কী আসে যায়? তুমি নি‌জের ম‌তো থা‌কো। ঐশী‌কে ওর ম‌তো থাক‌তে দাও। য‌দি ঘ‌রে কাজ বে‌শি হয় তাহ‌লে কা‌জের লোক আরেকটা রা‌খো। টাকা আমি দিব। তারপরও য‌দি কাজ না ক‌মে তাহ‌লে আমা‌কে ব‌লো আমি কাজ ক‌রে দিব।’

মা হতভম্ব হ‌য়ে আমার দি‌কে তা‌কি‌য়ে রইলেন।
হয়তো তার ছে‌লের এত ব‌ড়ো প‌রিবর্তন এত সহ‌জে মে‌নে নি‌তে পার‌ছে না। সে ছে‌লে তার সব কথা বিনা বা‌ক্যে মেনে নিত, হঠাৎ সে ছে‌লের এমন আচরণ হজম কর‌তে তো সময় লাগ‌বে।

১৩!!
ঐশী ওর আঙুলগু‌লো আমার নগ্ন বু‌কে এ‌লো‌মে‌লো টানতে লাগল। আমি ওর কপা‌লে চুমু খে‌য়ে বললাম,
‘কিছু বলবে?’
‘না আস‌লে।’
‘লজ্জা পা‌চ্ছো কেন? ব‌লো?’
‘আমরা বে‌বি প্ল্যান কর‌লে কেমন হয়?’
আ‌মি হে‌সে বললাম,
‘এত দ্রুত? বি‌য়ে হ‌লো মাত্র দুই মাস হলো।’
‘তা‌তে কী? দে‌খো লম্বা প্ল্যা‌নিং ক‌রে বাচ্চা নেওয়ার বয়স তোমার কিংবা আমার কারও নেই। আমা‌দের দুজনার আর্থিক অবস্থাও বেশ ভা‌লো। বাচ্চা নেওয়ার জন্য সব‌কিছু পার‌ফেক্ট। তাছাড়া বয়স দে‌খো দুজনার। এম‌নি মে‌য়েদের ত্রি‌শের পর বাচ্চা নেওয়া রিক্স সেখা‌নে আমার ব‌ত্রিশ কম‌প্লিট হ‌লো ব‌লে। তোমারও তো কম বয়স হয়‌নি।’
‘হুম তা ঠিক বল‌ছো, কিন্তু এত বছর পর দুজন দুজ‌নকে নি‌জের ক‌রে পেলাম। দুজন দুজন‌কে কিছু মাস সময় দিব না?’
‘‌তো বাচ্চা হ‌লে কোথায় আমরা আলাদা হ‌য়ে যাব? তখনও তো একসা‌থেই থাকব। তাছাড়া বল‌লেই তো কাল‌কে বাচ্চা হ‌বে না। সময় লাগ‌বে। তত‌দিন নি‌জেরা সময় কাটালাম।’
ঐশীর কথা ভে‌বে দেখলাম স‌ত্যি বল‌ছে। বয়স তো দুজনারই কম না। ওর কপা‌লে চুমু খে‌য়ে বললাম,
‘তু‌মি যেটা ভা‌লো বু‌ঝো।’

চলবে।