#শ্রাবণের_সে_অপেক্ষা
লেখক: শারমিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১২
‘চলো ছাদে যাই।’
ঐশী বলল। আমি হেসে বললাম,
‘রাত বারোটার বেশি বাজে। এখন ছাদে যাবে?’
‘এই ঝলমলে জ্যোৎস্না রাতে ছাদে না গেলে ভালো লাগবে না। চলো না প্লিজ।’
‘তোমার এই অভ্যাসটাকে ভালো বলব না কি খারাপ বুঝতে পারছি না। জ্যোৎস্না দেখলেই তুমি ছাদে যেতে চাও।’
‘তো এটা কী খারাপ অভ্যাস?’
‘না তা না। তবে এত রাতে ছাদে না যাওয়াই বেটার।’
‘কেন? তুমি কী ভূতে ভয় পাও?’
‘না না মোটেও না। তবে জ্বিন বলতে যে কিছু আছে সেটা মানো?’
‘হুম মানি। তো?’
‘তাহলে মেয়েদের যখন তখন বা রাতে বেশি ছাদে যেতে হয় না সেটা জানো? বদ জ্বিনের নজরে পড়ে সেটা জানো?’
‘বদ নজর শুধু মেয়েদের দিকে পড়ে? ছেলেদের দিকে পড়ে না?’
‘হুম পড়ে। তবে মেয়ে আর বাবুদের দিকে বেশি পড়ে। পুরুষরা তো নিজেরাই বাদর। এদের দিকে আর জ্বিনে কী নজর দিবে। কখনো শুনছো বাদরকে জ্বিনে ধরছে?’
ঐশী হেসে বলল,
‘ বুঝলাম বাদর সাহেব। তা মেয়েদের আব বাবুদের দিকে কেন?’
‘বাবুরা নিঃষ্পাপ, কোমল, তাদের শরীরে সুন্দর ঘ্রাণ থাকে তাই তাদের দিকে সহজে বদনজর দেয়। আর মেয়েদের শরীরেও মন মাতানো মিষ্টি একটা ঘ্রাণ থাকে। সে ঘ্রাণেই জ্বিন বেশি আর্কষিত হয়।’
‘তুমি তো জ্বিন নও। তাহলে তুমি কেন বলো তোমার শরীরের ঘ্রাণটা মিষ্টি। তুমি নাকি আমার ঘ্রাণে আকর্ষিত হও। তুমি কীভাবে আমার শরীরের ঘ্রাণ পাও?’
আমি হেসে বললাম,
‘আমি তোমার স্বামী। আর তোমার শরীরের ঘ্রাণ নয়, তোমার পুরোটাই আমাকে পাগলের মতো টানে।’
ঐশী ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ও হো। তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। আর তুমি নিজেকে আয়নায় ঠিকমতো দেখছো? কোনো পরীর চেয়ে কম না তুমি। আর পরীকে দেখলে তো জ্বিন আসবেই।’
ঐশী হেসে বলল,
‘বুঝলাম। তাছাড়া যে সব কথা তুমি বললা, তা আমি আগে থেকেই জানি।’
‘তাহলে কেন বারবার যেতে চাও?’
ঐশী আমার কাঁধে মাথা রেখে বলল,
‘আসলে জ্যোৎস্না আমার খুব প্রিয়। ছোটো বেলা থেকেই চাঁদের আলো আমাকে ভীষণ টানে। ছোটোবেলায়, কিশোরী বয়সে মা ছাদে উঠতে দিতেন না বা রাতে খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরেও বের হতে দিতেন না। বলতেন বিয়ের পর বরের সাথে এসব জ্যোৎস্না ফোৎস্না দেখিস। এখন হবে না।
তারপর যখন তোমার সাথে বিয়ে ঠিক হলো, তখন থেকে স্বপ্ন দেখতাম তোমার সাথে জ্যোৎস্না বিলাশ করার। তারপর এতগুলো বছর কেবল স্বপ্নই দেখে গেলাম। একটা ছোটো সংসারের, একটা ভালোবাসার মানুষের, যার কাঁধে মাথা রেখে জ্যোৎস্না বিলাশ করা যায়। আমার সে স্বপ্ন পূরণ হতে বহু বছর লেগে গেল।
এত বড়ো হওয়ার পরও রাতে মা একা ছাদে উঠতে দিতেন না। এত বছর যাবত জীবনটা কেবল রুটিন মেনে চলত। একটা বাঁধাধরা নিয়মে চলতো। প্রথমে ভার্সিটি শেষ করলাম, তারপর ব্যাংকে জব হলো। রোজ সকালে উঠে নাস্তা করে ব্যাংকে যেতাম সন্ধ্যায় ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরতাম। যেদিন ব্যাংকে কাজের চাপ বেশি থাকত, রাত বেশি হতো সেদিন বের হওয়ার আগেই দেখতাম বাবা কিংবা মাহদী ব্যাংকের বসার স্থানে বসা।
একই নিয়মে এতগুলো বছর চলেছে। কোথাও ঘুরতে যাইনি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেইনি। ভার্সিটিতে পড়াকালীন বাবা মা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিত না। তারা কড়া শাসনে রাখত। তাছাড়া তোমার সাথে বিয়ে ভাঙার পর আমারও মনটা কেমন যেন মরে গেছিল। চেয়েও বন্ধুদের সাথে মিশতে পারতাম না। ছেলেদের সাথে তো একদমই মিশতে পারতাম না। কেমন যেন অস্বস্তি হতো।
গ্রাজুয়েশন শেষ হতে হতে অধিকাংশ বান্ধীদের বিয়ে হয়ে গেছিল। তারপর অধিকাংশদের সাথে যোগাযোগ কমে গেল। মাস্টার্স শেষ হতে হতে প্রায় সবার বিয়ে হয়ে গেল। সবাই যার যার সংসারে ব্যস্ত হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ফোনে টুকটাক কথা হতো। দেখা হতো না বললেই চলে। তারপর জব হওয়ার পর, ব্যস্ততায় অধিকাংশের সাথে যোগাযোগই বন্ধ হয়ে গেল। এখন কেবল দু তিন জনার সাথে ফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়। দেখা সাক্ষাৎ কারও সাথে হয় না।
বাঁধা নিয়মে জীবন চলছিল আমার। অনেক বছর যাবত একই নিয়মে চলেছে। তারপর আবার নতুন করে তুমি এলে। আমার একঘেয়ামি জীবনে নতুন রঙ নিয়ে এলে। অবশেষে এত বছর পর আমার স্বপ্ন সত্যি হলো। আমার ছোটো একটা সংসার হলো। আমার নিজের একটা মানুষ হলো। যে আমার অনেক সাধনার মানুষ। যার সাথে আমি আমার ছোটো ছোটো অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে পারি। যার সাথে হারিয়ে যেতেও আমার কারও অনুমতি লাগবে না। যে আমার কেবলই আমার। আর আমি কেবল তার।’
কথাগুলো বলতে বলতে ঐশীর গলা কাঁপছিল। ওর চোখ দুটো পানিতে টলমল করছিল। আমারও খুব খারাপ লাগছিল। বুঝতে পারছিলাম এতগুলো বছর কষ্ট কেবল আমি একা করিনি। তারচেয়ে বেশি ঐশী কষ্ট করেছে, কষ্ট পেয়েছে। আমি তো এতগুলো বছর যাবত কেবল গাধার মতো শারিরীক কষ্ট করেছি। আর ও তো মানসিক কষ্ট করেছে। প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করেছে। অনেকটা সময় ওকে বুকের মাঝে আকড়ে ধরে রাখলাম। তারপর বললাম,
‘চলো ছাদে।’
‘তুমিই তো বললে জ্বিনের আঁচড় লাগবে।’
আমি হেসে ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস বললাম,
‘আমি সাথে থাকলে লাগবে না।’
ও হেসে বলল,
‘তুমি আর কখনো এভাবে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলবে না।’
‘কেন?’
‘দেখো আমার সারা শরীরে কাটা দিয়েছে।’
আমি হো হো করে হেসে ওর কানে চুমু এঁকে ফিসফিস করেই বললাম,
‘তাহলে এটা বেশি বেশি করতে হবে।’
ও আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তারপর ছাদে গিয়ে অনেকক্ষণ দুজন গল্প করলাম। আমি শুধু ওর কথাই শুনলাম। ও যে এত কথা বলতে পারে আমি জানতাম না। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর যখন ফোনে কথা বলতাম তখন আমিই বেশি বলতাম, ও শুনতো। আর এখন একটানা অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। অথচ ওর পরিবারের কিংবা পরিচিত সবাই ওকে স্বল্পভাষী জানে। আমার সাথে যে ও এত কথা বলে, তা অন্য কাউকে বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না। কোথাও শুনেছিলাম মেয়েরা তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষের সাথে সবচেয়ে বেশি কথা বলে। যারা সাথে তারা সবচেয়ে বেশি সেইফ মনে করে, স্বতঃস্ফূর্ত মনে করে তার কাছে নিজের সকল কথা বলে। কথাটা যে সত্যি তার প্রমাণ ঐশী।
ঐশী অর্নগল কথা বললেও আমি বারবার চারপাশে তাকাচ্ছিলাম। রাত দুটো বাজে। গা কেমন ছমছম করছে। ইয়ে মানে হাসবেন না, আমার একটু ভূতে ভয় আছে, কিন্তু সে কথা তো ঐশীকে বলতে পারি না। নির্ঘাত সেটা নিয়ে খুব মজা নিবে। তাছাড়া পুরুষ মানুষের ভয়ের কথা কাউকে বলতে হয় না। নিজের স্ত্রীকে তো একদমই না। স্ত্রী যে আপনার কঠিন থেকে কঠিনতম বিপদে পাশে থাকবে, কিন্তু সে-ই আপনার ভয় পাবার বিষয় নিয়ে আপনাকে খোঁচাবে।
অনেকক্ষণ গল্প করার পর ঐশী হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘চলো ঘুমাব।’
আমি তো অনেকক্ষণ যাবতই হাই তুলছিলাম। বললাম,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।’
বিছানায় শোয়ার পর ঐশী যখন বুকে মাথা রাখল, কেন জানি পরম শান্তিতে আমার চোখে গভীর ঘুম নেমে এলো। শান্তির ঘুম।
১৪!!
আজ ঐশী বেতন পেয়েছে। বেতনের তিনভাগের একভাগ টাকা ওদের বাড়ি পাঠাল। একভাগ নিজের জন্য রাখল আরেকভাগ আমার মায়ের হাতে দিলো, কিন্তু মা সেটা নিয়ে যে কান্ড করলেন তাতে লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যাবার উপক্রম হলো।
চলবে…