#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[২৫]
আলোকশূন্য সন্ধ্যার চাদর নিরাবরণ ধরনীর গায়ে মুড়িয়ে দিচ্ছে লজ্জার আঁধারীয়া আবরণ। বাতাসের গায়ে লেপ্টে আছে হিমগন্ধ। শিরশিরে অনুভূতি জাকিয়ে বসে শরীরে। ধূসর আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চারপাশটা টুকটুকির কাছে বিষাদঘন মনে হচ্ছে। যেন আলোর বিরহে দিনটা নেতিয়ে পড়ছে আঁধারের কোলে। রচনা করছে হৃদয় ভাঙার গান। টুকটুকি সেই গানের সুরে নিজেকে খুঁজে পায়। শুনতে পায় হাহাকারের মর্মরধ্বনি। তার মনটা আজকে একটু বেশিই খারাপ। খারাপ বলেই আলো-আঁধারির মিলনক্ষণের মতো চমৎকার সময়টাকে সে বিষাদ বলে আখ্যায়িত করছে। আলোর বিদায়কে আখ্যায়িত করেছে নি’ষ্ঠুরতম প্রস্থান হিসেবে। অথচ দিন-রাত জীবনেরই অংশ। চব্বিশ ঘন্টা সূর্যালোক যেমন নৈশপ্রাণের জন্য হু’ম’কিস্বরূপ তেমনই নিরবচ্ছিন্ন আঁধার আলোতে জীবনধারণ করা মানুষের জন্য হু’ম’কিস্বরূপ। সকল প্রাণেরা নিজের সুখের সময়টুকু দীর্ঘায়িত করতে চায়। সুখযাত্রার প্রতিটি বাকে সঞ্চিত দুঃখের ভাগ কারো চাই না। অথচ দুঃখটাই তাদের জীবনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যায়। টুকটুকি ঠোঁট চেপে মনে করছে বিকেলের সময়টা। তার বড়ো খালার ছোটো জায়ের মেজো ছেলে রাকিব আহমেদ এসেছিল বাড়িতে। তিক্তমুখে পুরোটা সময় কাটিয়েছে সে।
রাকিব আহমেদকে প্রথম দর্শনেই সুদর্শনের কাতারে ফেলা যায়। গাত্রবর্ণ গৌড়, দেহের গড়ন কিছুটা স্বাস্থ্যবান হলেও লম্বাটে উচ্চতার জন্য খারাপ দেখায় না মোটেও। পেশায় সাংবাদিক হওয়ায় তার বাচনভঙ্গি মনোমুগ্ধকর। পূর্ব পরিচিত বিধায় বেশ স্বতঃস্ফূর্ততার সাথেই মিশেছে টুকটুকির সঙ্গে। টুকটুকিও সৌজন্য দেখাতে সামান্যতম কার্পণ্য করেনি। ছাদে একান্তে কথা বলার মুহূর্তে টুকটুকি সাবলীলভাবেই বলেছিল,
“আসলে আমি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাইছি না। গ্রেজুয়েশনটা কমপ্লিট হোক।”
রাকিব স্মিত হেসে বলেছিল,
“আমার সমস্যা নেই। এতদিন যেহেতু ভাই-বোন বলে ডাকা হয়েছে তাই হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়াটা আমাদের দুজনের জন্যই অস্বস্তিকর হবে। তুমি সময় নাও। ততদিনে না হয় আমাদের সম্পর্কটা আরেকটু মসৃণ হোক। আমাকে বন্ধু ভাবতে আপত্তি আছে?”
“নেই।”
কণ্ঠ দ্বারা মানুষকে মোহিত করার গুনটা রাকিবের আছে। বলতে দ্বিধা নেই টুকটুকিও সেই কণ্ঠ ও গোছানো উপস্থাপনে মুগ্ধ। কিন্তু মুগ্ধতার দৌড় ভালো লাগা অবধিই, যেমনটা টিভিতে কোনো চার্মিং ব্যক্তিত্ব দেখলে হয়। রাকিবের সঙ্গে কাটানো পুরোটা সময় মন্দ কাটেনি। তবুও মস্তিষ্কে একটা বাক্য আলোড়ন তুলেছে ক্ষণে ক্ষণে।
তিনমাস আগে নিশীথের বাক্যবাণে পর্যদুস্ত টুকটুকি যখন বুঝল বিয়ে হওয়া মানে নিজেকে চূড়ান্ত ছোটো করা তখন পরিবারের মতের বাইরে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত শুনে নিশীথ তার সঙ্গে একবার কথা বলতে চেয়েছিল। টুকটুকি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পরদিনই নন্দিনীর কাছে গিয়ে উঠেছিল। এরপরের তিনটে মাসে নির্গত প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে স্পষ্ট হয়েছে অনুভূতির গভীরতা। যা কোমলপ্রাণ মনটাকে অসহায় করে দেয়। তবে যাই হয়ে যাক এই অনুভূতি টুকটুকি প্রকাশ করবে না। কক্ষনো না। হয়তো একেই বলে ভুল সময়ে ভুল মানুষের প্রতি দুর্বল হওয়া। প্রথম অনুভূতি বলেই বোধহয় বেদনার ভার বেশি। যা চোখের নিচে দিয়েছে কালির প্রলেপ। লোকে ভাবে পড়াশোনার চাপ, টুকটুকি জানে এ হৃদয়ের উত্তাপ। শুধু স্বীকার করার সাহস বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। ভবিষ্যতে হোক সেটাও এখন টুকটুকি মন থেকে চায় না।
কিন্তু বাড়ি ফিরে টুকটুকি আবারো এলোমেলো হয়ে গেল। আগে যা ছিল সুপ্ত এখন তাই সর্বাঙ্গে প্রকট হচ্ছে। এ মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কিন্তু নন্দিনীর মতে, দুর্বলতার কাছে থেকেই সেটাকে জয় করা উচিত। দূরে যাওয়া মানে স্পষ্টই পালিয়ে যাওয়া। যা পরোক্ষভাবে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করারই সমান। টুকটুকি কেন নিজেকে দুর্বল রাখবে। প্রিয় বন্ধুটির কথায় টুকটুকি সায় দিয়েছে। সত্যিই তো! তার কেন লুকিয়ে থাকার, এড়িয়ে যাওয়ার দায় হবে! সেই মনোভাব ও রিতা আন্টির প্রতি অম্লান ভালোবাসায় টানেই পা দিয়েছিল ও বাড়িতে। কিন্তু ওই অ-শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ভূতের বাড়ির অসামাজিক রাজপুত্র তিনটে মাস পর তাকে কী বলল! ছকিনা পা’গ’লী! টুকটুকির সকল অনুভূতি সেখানেই হোঁ’চট খেয়ে মনের গহীনে পালিয়েছে। জেগে উঠেছে সেই ব’দরা’গী সত্ত্বাটা। লোকটার সাহস কী করে হয় তাকে এভাবে বলার? সে কি এতটাই বাজে দেখতে! উহু, সবাই বলে গোলগাল মুখশ্রীর টুকটুকিকে মিষ্টি ও আদুরে দেখায়। দেখলেই ইচ্ছে করে তুলতুলে গাল দুটো টেনে দিতে। সেখানে কিনা এলাকার মৌসুমি পা’গল ছকিনার সঙ্গে তুলনা! টুকটুকির মেজাজী ইগো জেগে উঠেছিল সঙ্গে সঙ্গে। ঘুরে পাল্টা কিছু বলার আগেই নিশীথ লম্বা লম্বা পা ফেলে তাদের বিশাল ড্রইংরুম অতিক্রম করে চলে গেছে। সেই থেকে টুকটুকির অস্থিরতা শুরু হয়েছে।
নিচ থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসছে। টুকটুকি জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। নন্দিনী একাগ্রচিত্তে বইয়ে ডুবে আছে। গায়ে ঢিলেঢালা টিশার্ট ও স্কার্ট। লম্বা চুলগুলো মাথার তালুতে খোপা করে রেখেছে। চেয়ারে দুইপা ভাজ করে বসেছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো মুনিঋষি খোলা চোখে ধ্যানমগ্ন আছে। এটাই নন্দিনীর পড়ার ধরন। মাঝে মাঝে আবার ধ্যানভঙ্গ করে আঙুলে ধরা কলমটাকে ঠোঁটের ভাজে গুজে সিগারেটের মতো টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। টুকটুকি হেসে ফেলল। নন্দিনী সাপের মতো দৃষ্টি ফেলে কলম ছুড়ে মে’রে বলল,
“কই হান্দাইছোস আমার প্যাকেট? গুইনা গুইনা ছয়খান আছিল।”
নন্দিনী যে কোন প্যাকেটের কথা বলছে বুঝতে অসুবিধা হয় না টুকটুকির। দন্তপ্রদর্শন করে বলল,
“ছয়খানই কুটি কুটি করে ডাস্টবিনে ফেলেছি। এবং এর জন্য আমি সামান্যতম অনুতপ্ত নই।”
টুকটুকি বেরিয়ে গেল। নিচতলায় যেতেই মায়ের জেরার মুখে পড়তে হলো তাকে। শারমিন বেগম দুপুরেই খেয়াল করেছেন মেয়ে রিতাদের বাড়িতে ঢুকেছে। অতিথি চলে আসায় এই বিষয়ে তিনি কথা তোলেননি। এখন বাগে পেয়ে অত্যন্ত রুষ্ট স্বরে বললেন,
“লজ্জা-শরম কি সব বিসর্জন দিয়েছিস? যে বাড়িতে বিয়ে করবি না বলে এত কান্ড আবার সেই বাড়িতেই ড্যাংড্যাং করে ঘুরে বেড়াস? ছোটোটাও হয়েছে আরেক বদ। সুযোগ পেলেই ওই বাড়ির ছেলেটার সঙ্গে কথা জুড়ে দেয়। তোরা কি একটুও শান্তি দিবি না আমাকে?”
টুকটুকি মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঠিক তখনই বাড়িতে আসেন রিতা আন্টি। বিয়ে ভাঙার পর দুবাড়ির সম্পর্ক মন্থর হয়ে পড়েছিল। একে অপরের ছায়া মাড়াতেও অস্বস্তি কাজ করত। এলাকার মানুষ তো আগে-পিছে নানান কেচ্ছা তৈরি করেছে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। তবে রিতা আন্টির নরম স্বভাবের জন্যই ঝগড়া বিবাদ ঘটেনি। টুকটুকি বিয়ে করতে নাকচ করলে শারমিন বেগম তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার কথাও তুলেছিলেন। রিতা আন্টিই নিষেধ করেছিলেন। মেয়ের জন্য শারমিন বেগম না চাইতেও মানুষটার কাছে কেমন ছোটো হয়ে গেছিলেন। আজ এতদিন বাদে তাকে এ বাড়িতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই তিনি বিব্রতবোধ করলেন। রিতা আন্টি সেসবের ধার ধারলেন না অবশ্য। হাসিমুখে বললেন,
“মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন শুনলাম। পুরোনো হিসেব বাদ। প্রতিবেশী হিসেবে তো সামিল হতেই পারি। পারি না?”
রিতা আন্টি স্বাভাবিক ভাবেই পাত্রদের খোঁজখবর নিলেন। শারমিন বেগম অনেকটা জড়তার সঙ্গেই আপ্যায়ন করলেন উনাকে। রিতা আন্টি সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“মেয়েটাকে আমার ঘরে নেব বলে সাধ করেছিলাম। তা তো আর হওয়ার নয়। হয়তো বিধাতার অন্য ইচ্ছে। যাইহোক, বিয়ে যেখানেই হোক না কেন মেয়েটা যেন সুখী হয়। আমার দোয়া সব সময় ওর সাথে আছে।”
শারমিন বেগমও অনুরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মানতে দ্বিধা নেই উনিও চেয়েছিলেন টুকটুকির বিয়েটা নিশীথের সঙ্গে হোক। এমন সুপাত্র হাতছাড়া করার মতো বোকামি একমাত্র উনার মেয়েই করতে পারে।
টুকটুকি অপ্রতিভ হয়ে রইল দুজনের আলাপের মাঝে। রিতা আন্টি মায়ের সঙ্গে আলাপ শেষ করতেই নন্দিনী নেমে এসে উনার হাত ধরে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“আরে আন্টি, আসুন। আপনার সঙ্গে তো ভালোমতো কথাই হয় না।”
নন্দিনী উনাকে টুকটুকির ঘরে নিয়ে গেল। খাটে পা মুড়ে বসে বলল,
“আপনাকে দুঃখী দুঃখী দেখায় আন্টি। আপনি কী কোনো কারণে ডিপ্রেসড?”
টুকটুকি পিছু পিছু এসে আড্ডায় সামিল হয়েছে। রিতা আন্টি অসহায় মুখে বললেন,
“বুড়োরা হলো সংসারের অকেজো বস্তু। একটা সময়ের পর তাদের মতামতের মূল্য থাকে না। তাদের শখ আহ্লাদের পাত্তা দেওয়ার মতো কেউ নেই। ছেলে অফিস করে আমি একা বাড়িতে পড়ে থাকি।”
“ছেলেকে বিয়ে দিন। বউমা আসবে, বছর ঘুরতেই বাচ্চাকাচ্চায় ভরে যাবে ঘরদোর। একলা ফিল করার সুযোগই পাবেন না।”
রিতা আন্টি টুকটুকির মুখপানে চেয়ে বললেন,
“আর বিয়ে! আমাদের বেলায় ঘুম থেকে উঠে শুনতাম আজ আমার বিয়ে। অমনি টুপ করে স্বামীর ঘরে চলে যেতাম। আর আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়েকে দিন দিন জটিল করে তুলছে। কতশত ভাবনা তাদের। আমাদের সঙ্গে মতের মিলবে না। তাই আমি কনে দেখা থেকে হাত তুলে নিয়েছি। ছেলে যে মেয়ের হাত ধরে এনে বউ করতে চাইবে তাকেই ঘরে তুলব। তাতে আমার একাকিত্ব ঘুচুক বা থাকুক। কে জানে কবে ওই ছেলের মতিগতি হবে। বিয়ে করার কোনো লক্ষণই তো দেখি না।”
নন্দিনী অত্যন্ত ব্যথিত হওয়ার ভান করে আফসোস করে বলল,
“আই আন্ডারস্ট্যান্ড আন্টি। আপনার জন্য আমার কলিজায় র’ক্তক্ষরণ হইতাছে। দুঃখে কান্না পাইতাছে। মনে হইতাছে যদি কিছু করতে পারতাম। আপনার এখন কি করা উচিত জানেন?”
টুকটুকি সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। মেয়েটার হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না। রিতা আন্টি বললেন,
“কী?”
“আপনি কিন্তু দেখতে মাশাল্লাহ। হুদাই বুড়া বুড়া করেন। কত আর বয়স আপনার? পঞ্চাশ! এরবেশি হওয়ার কথা না। দেখলে কিন্তু বুঝাই যায় না দুইখান বুইড়া বুইড়া পোলাপাইন আছে। চাইলে একটা বিয়ে করে ফেলতে পারেন। একাকিত্ব ঘোচানোর স্মার্টেস্ট ওয়ে। ছেলে বিয়ে না করতে চাইলে ছেলের মা করবে।”
টুকটুকি ও রিতা আন্টি উভয়েই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। যেন ভুল কিছু শুনে ফেলেছে। নন্দিনী আবার বলল,
“আপনিই তো বললেন সকালে উঠে শুনতেন বিয়ে ঠিক। তারমানে পাত্র নিজে পছন্দ করেন নাই। পরিবারের কথায় বিয়ে করছেন। এখন নিজের পছন্দে করবেন। পশ্চিমা বিশ্বে এইসব কমন ব্যাপার। ঢাকায় নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি, বিশাল সম্পত্তি আছে জানলে কুড়ি থেকে আশি সবাই লাইন ধরবে।”
টুকটুকি একহাতে নন্দিনীর হাত চেপে ধরল। অসহায় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
“এবার থাম বইন। আমার বন্ধুত্বের সম্মানটা রাখ।”
নন্দিনী হাত ঝারা দিয়ে উচ্চস্বরেই বলল,
“কীসের আবার থামাথামি। আন্টি আপনি আমাদের বন্ধু হোন না বলেন? বন্ধুর কাছে কি রাখঢাক করে কথা বলা উচিত?”
রিতা আন্টি মাথা নাড়লেন, “একদমই উচিত না।”
টুকটুকি বি’স্ফো’রিত নয়নে তাকায়। নন্দিনী আশকারা পেয়ে আরো একটু গুছিয়ে বসে। ঝুকে এসে বলে,
“অবশ্য বিয়ের ঝামেলায় যাইতে না চাইলে আরেকটা সেইফ ওয়ে আছে। কেউ জানবেই না।”
রিতা আন্টিও ঝুকে এসে বললেন,
“সেইফ ওয়েটা কী?”
“ফেইসবুক। আপনারে একটা ঝাকানাকা একাউন্ট খুলে দেব। সুন্দর একটা প্রোফাইল পিক দেব। দরকার পড়লে হ্যান্ডসামও পোলাও সাপ্লাই দেব। একটু ম্যাসেজে হাই হ্যালো করবেন। বড়োলোকি ভাব নিবেন। দেখবেন আপনারে কেয়ার করার মানুষের অভাব নাইকা। বাবু, সোনা, ডার্লিংয়ে ভরে যাবে চারপাশ। মুখ দেখাদেখির ঝামেলা নাই। ম্যাসেজে ডেটিং হবে জাস্ট।”
“যাহ, তাই কি হয়?”
নন্দিনী এক হাতের তালুতে অন্য হাত দ্বারা কি’ল দিয়ে বলল,
“অবশ্যই হয়। চাইলেই হয়।”
রিতা আন্টি ঠোঁট উলটে বললেন,
“কিন্তু আমি তো বুড়িয়ে গেছি। হাই হ্যালো দূরে থাক ছবি দেখে কেউ পছন্দই করবে না।”
“আরে আন্টি ফিল্টার আছে কি করতে? বুড়োকেও কচি বানিয়ে দিতে পারে। আপনাকে কতগুলো ফিল্টারওয়ালা কিউট ছবি তুলে দেব। আইডির নাম দেব এ্যাঞ্জেল রিতা। নিকনেইম দেব পাপা’স প্রিন্সেস। তাতেই কেল্লাফতে।”
“তাহলে এক্ষুণি একাউন্ট খুলে আমায় সবকিছু বুঝিয়ে দাও।”
রিতা আন্টি ফোন এগিয়ে দিলেন। টুকটুকি কাঁদো কাঁদো হয়ে দুজনের কথা শুনছে। তার চোখের সামনে কিনা রিতা আন্টি থেকে এ্যাঞ্জেল রিতা হয়ে যাচ্ছে! এ দিনও দেখার ছিল! নন্দিনী যেন নিজের একজন মুরিদ পেয়ে গেছে। মিটিমিটি হাসতে হাসতে একাউন্ট খুলে ফেলল। সবকিছু বুঝিয়ে রিতা আন্টির হাতে ফোন দিয়ে চোখ টিপে বলল,
“ডান। আপনার প্রথম ফ্রেন্ড আমি। টুকটুকিকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি। এক্সেপ্ট কর।”
টুকটুকি বিছানায় দেহ ছেড়ে দিয়ে বিড়বিড় করে,
“হে খোদা, আমারে তুমি উঠায় নাও।”
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[২৬]
সকাল সকাল অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নাশতার টেবিলে এসেছে নিশীথ। দিন যত বাড়ছে কাজের প্রেশারও যেন বাড়ছে। অল্প কয়েকদিনেই অফিসের সবাই তার নিষ্ঠা, কর্মঠ ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেয়েছে। বসের সুনজরে আসায় ভরসার মান রাখার অতিরিক্ত দায়িত্বটাও তার কাঁধে। সামনে একটা প্রমোশনের চান্স আছে বলে কোনোরকম হেলাফেলা নিশীথ করছে না। নাশতার টেবিলে বসে খাবার মুখে দিতেই ভ্রু কুচকে এলো ওর। অতিরিক্ত তেল-মশলার ব্যবহার। এ মায়ের রান্না নয়। কাজের মেয়েটা তরকারিতে তেল, নুন, মশলা সব উপুর করে দেয়। এদিকে নিশীথ স্বাস্থ্য নিয়ে ইদানীং বেশ সচেতন হয়েছে। অতিরিক্ত তেল-মশলা এড়িয়েই চলে। মাও সে অনুযায়ী রাঁধেন। আজ হঠাৎ স্বাদ বদল হওয়ায় নিশীথের চিন্তা হলো মা সুস্থ আছে কিনা। নিশীথ কাজের মেয়েটাকে গলা চড়িয়ে ডাকল,
“জরি, এই জরি।”
জরি ছুটে এলো। মেয়েটা একটু বেশিই চঞ্চল। এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। এক জিনিসে বেশিক্ষণ মনোযোগও দিতে পারে না। যার ফলে ওর হাতের রান্নাটা অনেকটা দায়সারা রকমের স্বাদহীন হয়। জরির গলায় একটা রুপার মালায় তাবিজ ঝুলছে। ছোটোখাটো মানুষটার দিকে নজর পড়ার আগেই সকলের নজর যায় সাইনবোর্ড সদৃশ তাবিজটার দিকে। এই বাড়িটা এমনিতেই পুরোনো ধাঁচের। জরির কেমন ভয় ভয় লাগে। রেডিওতে ভূতের গল্প শুনে শুনে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে বাড়ি পুরোনো মানেই অতৃপ্ত আত্মাদের বৈঠকখানা। ভালো বেতন ও সুযোগ সুবিধার মায়ায় চাকরিটা না ছাড়তে পারলেও ভূতের ভয় তাড়ানোর উপায় বের করেছে জরি। এই বাড়িতে ওঠার দিন কয়েক বাদের গ্রামের বাড়ি থেকে তাবিজ বানিয়ে এনেছে। নিশীথ ও তার মাকেও ভুজুংভাজুং ভূতের ভয় দেখিয়ে তাবিজ দিতে চেয়েছিল। নিশীথের কড়া চাহনির সামনে সে কথা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার সাহস পায়নি।
জরি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশীথের সামনে। এই ইঞ্জিনিয়ার বাবুকে সে অকারণেই ভয় পায়। নিশীথও তা জানে। ও বলল,
“তুই আমাকে ভয় পাস কেন জরি? তোর কী ধারণা আমার মধ্যে ভূত-প্রেত কিছু আছে।”
জরি প্রথমে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে না বোধক মাথা নাড়ল। নিশীথ গম্ভীর গলায় বলল,
“সত্যি করে বল, কেন ভয় পাস? আমাকে তোর রাগী মনে হয়?”
জরি এবার হ্যাঁ বোধক সায় দেয়।
“কিন্তু কেন? আমি কি তোকে বকেছি কখনো?”
“না। আপনে কখনো হাসেন না। মুখ আন্ধার কইরা রাখেন। আমার আবার আন্ধারে ডর বেশি।”
কথাটা নিশীথের মনোযোগ পেল। সে আসলেই কদাচিৎ হাসে। তারমানে এই নয় সে মুখ আঁধার করে রাখে। এটা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমা। মাঝে মাঝে স্বভাবের ব্যত্যয় ঘটে আশেপাশের মানুষের উল্টোপাল্টা কাজে। নিশীথ কথা না বাড়িয়ে বলল,
“মা কোথায়?”
“খালা টিভির ঘরে।”
“খেয়েছে?”
“ঘুম থেইকা উইঠ্যা লেবু আর মধু গুলাইয়া পানি খাইছে। আর কিছু খায় নাই।”
নিশীথ ভ্রু কুচকাল। পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে জরিকে বলল তার জন্য একটা ডিম ভাজতে। এরপর পাউরুটি চিবোতে চিবোতে চলে গেল টিভিরুমে। রিতা সোফায় গা এলিয়ে বসে ফোনে খুটুরমুটুর করছিলেন। নিশীথ জানতে চাইল,
“তুমি ঠিক আছো মা? শরীর ভালো?”
“ভালোই তো।”
মায়ের গা ছাড়া উত্তরে নিশীথ একটু চিন্তিত। সপ্তাহখানেক ধরে মায়ের আচরণ একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। আগের মতো ছেলের চিন্তায় অস্থির হয় না। সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখে না। দরকার ছাড়া কথাও বলছেন না। অথচ মা আগে সারাক্ষণ গল্প করার মানুষ না পেয়ে আফসোস করতেন। ভালো বললেও নিশীথের মনে হচ্ছে মা সুস্থ নেই। একদিন সময় করে হসপিটালে চেকাপ করিয়ে আনতে হবে। নিশীথ জিজ্ঞেস করল,
“খাওনি কেন এখনো? চলো আমার সাথে খেয়ে নেবে।”
“উহু, আমি ডায়েটে আছি।”
নিশীথ চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল।
“ডায়েটে আছো মানে?”
“মানে ওজনটা কন্ট্রোল করা উচিত। তাই রুটিন মেইনটেইন করে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস করছি। তুই খেয়ে নে। আমি আর আধঘন্টা পরে একমুঠ বাদাম ও এক বাটি ফ্রুট সালাদ খাব।”
নিশীথের বিস্ময়ের সীমা রইল না। ভোজনরসিক মানুষটার এই বয়সে হঠাৎ ডায়েটের চিন্তা কোথা হতে উদয় হলো! রিতা তখনো ফোনে খুটুরমুটুর করছেন। নিশীথ বিরক্ত হয়ে বলল,
“ফোনে এত কী? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো।”
রিতা একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,
“কেন? তুই যখন ল্যাপটপে মুখ ঢেকে উত্তর দিস তখন?”
“আমার দরকারি কাজ থাকে মা। অকারণে ডিভাইসে সময় ব্যয় আমি করি না।”
“আমিও অকারণে সময় ব্যয় করছি না।”
“তো কী করছো? নিশ্চয়ই ফুড রিলেটেড কিছু।”
“উহু, ফলোয়ার অপশনটা খুঁজছি। বল তো কীভাবে চালু করে?”
নিশীথ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,
“তোমার ফেইসবুক একাউন্ট আছে?”
“অফকোর্স, তোর কি আমাকে ব্যাকডেটেড মনে হয় নাকি?”
“সেটা বলিনি। নেতার ঘরের মেয়ে তুমি। আপডেটেড হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি তেমন নও। এখন হঠাৎ এই ফেইসবুকপ্রীতি যে! দেখি তো আইডিটা।”
নিশীথ ফোন হাতে নিয়ে আইডির নামটা দেখতেই থ বনে গেল। তার এইটুকু জীবনে এতবড় আশ্চর্যজনক বিষয় বোধহয় দুটো দেখেনি। কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। আর কিছু দেখার আগেই রিতা ছো মে রে ফোন নিয়ে বললেন,
“নো উঁকিঝুকি। প্রাইভেসি বলে একটা ব্যাপার আছে তো। আমি বরং টুকটুকিকে ডাকি। ওই ফলোয়ার অপশন চালু করে দেবে। তুই অফিস যা। নিজের লাইফ নিয়ে বিজি থাক।”
নিশীথকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে তার মা চলে গেলেন।
গতরাতে প্রকৃতির নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে শীতের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। ছোটো ছোটো খানাখন্দ ভরে আছে কর্দমাক্ত পানিতে। তবে আকাশ এখন স্বচ্ছ। পেলব রোদের সান্নিধ্যে দেহ মন চনমনে হয়ে উঠছে। নিশীথ ল্যাপটপের ব্যাগটা নিয়ে সবে বেরিয়েছিল বাড়ি হতে। গাড়ির চাবিটা পকেট থেকে বের করতেই টুকটুকির দেখা পেল। লাইম কালার সালোয়ার কামিজে তার মাঝে সকালের স্বচ্ছ আকাশের মতোই স্নিগ্ধতা ভর করেছে। ঠোঁটে রেড লিপস্টিক, গালে হালকা টিন্টও লাগিয়েছে। নিশীথের নজর কাড়ল রঞ্জিত পুরু ঠোঁটজোড়া। টুকটুকিকে লাল রঙের লিপস্টিক কমপ্লিমেন্ট দেয়। মুখের দিকে তাকালে নিখুঁত শেইপের টকটকে ঠোঁটজোড়া অনায়াসে নজর কাড়বে। গালের পিচি টিন্ট এক্সট্রা কিউটনেস দিয়েছে মুখশ্রীতে। নিশীথ চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা নিশ্চয়ই এসব জানে বলেই নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করছে। টুকটুকি রিতা আন্টির ডাক পেয়ে একেবারে ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে বের হয়েছিল। নিশীথকে দেখে চলনে একটু জড়তা এলেও সচেতনভাবে তা লুকিয়ে ফেলল। স্পষ্ট কানে বাজতে লাগল সেদিনের কটুক্তিটা। নিশীথকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সেই পিছু ডাকল,
“মিস হুমায়রা?”
সেই গুরুগম্ভীর স্বরের ভারী ডাকটা কানে ধাক্কা দিতেই টুকটুকির পা জোড়া একলাই থেমে গেল।
“আমার সঙ্গে আপনার হঠাৎ দরকার, মি. নিশীথ?”
টুকটুকি সুক্ষ্ম তেজের সঙ্গেই উত্তর দিল। নিশীথের এক হাতে ব্যাগ। অপরহাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“আপনি যেহেতু আমার মায়ের ছোটোবন্ধু, দরকারটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসছে।”
“বলুন কী সাহায্য করতে পারি?”
“আমার সরল মায়ের মাথায় ডায়েট, ফেইসবুকিং, ফলোয়ারের ভূত কে চাপিয়েছে?”
“ভূতের হাভেলিতে থাকেন আপনারা। আমাকে চার্জ করছেন কেন?”
“কারণ আপনার সঙ্গে মিশে মিশে আমার মা বখে যাচ্ছে। এসব এ্যাঞ্জেল ফেঞ্জেল টাইপ লেইম নাম আমার মায়ের মাথায় জীবনেও আসবে না যদি না কেউ ঢোকায়।”
টুকটুকি কড়া গলায় বলল,
“আপনার মা কি বাচ্চা যে হাঁটুর বয়সী মেয়ের সঙ্গে মিশে বখে যাবে?”
নিশীথের মেজাজ যত চড়তে লাগল কণ্ঠ তত বরফশীতল প্রস্তরে পরিণত হতে লাগল।
“জি, আমার মা বাচ্চাই। উনার মাঝে বালখিল্যতা আছে বলেই খারাপ জিনিস দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন।”
টুকটুকির কানে কথাটা বাজল খুব। খারাপ জিনিস! নিশীথ কি তাকে মিন করল শব্দটা দিয়ে? এতটাই বাজে ভাবে ওকে! টুকটুকির রাগ বাড়ল নন্দিনীর ওপর। সে কেন আন্টিকে এইসব শিখিয়ে দিয়ে গেল? যা আরেকবার অপমান করার সুযোগ করে দিল নিশীথকে। ঠোঁট চেপে কান্না লুকায় টুকটুকি। যখন তখন কেঁদে ফেলার অভ্যাসটা তার এই জনমে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। নিশীথ তা বুঝতে পেরে থমকে গেল। অনেকদিন বাদে মেয়েটার সেই আগের স্বভাবটা দেখতে পেল। কণ্ঠ একটু নরম করে বলল,
“দেখুন, আপনাদের বন্ডিং যেহেতু ভালো তাই বলছি মাকে একটু বোঝান। আজ শুনলাম ডায়েটের ভূত চেপেছে। কে জানে কবে থেকে এইসব করছে। আমারই খেয়াল রাখা উচিত ছিল। এমনিতেই অসুস্থ থাকে মানুষটা। তারওপর ওজনের কথা ভেবে যদি খাওয়া কমিয়ে দেয় তো বিপদ।”
টুকটুকি চিন্তায় পড়ে গেল। তবে এই মুহূর্তে আর এ বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রতিনিয়ত নিশীথের করা অপমান তাকে মন থেকে য’ন্ত্র’ণা দিচ্ছে। এই লোকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনেনি। সে ফোলা ঠোঁটদুটি নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল।
নিশীথ বলল,
“চলে যাচ্ছেন কেন?”
“উটকো মানুষদের মনগড়া ব্লেইম শুনে সকাল সকাল ফ্রেস মুডটাকে নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না তাই।”
‘উটকো মানুষ’শব্দটা নিশীথের কানে বিঁধল। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আচ্ছা! তা এত সেজেগুজে আছেন যে? পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে আবার? আগের বারেরটা পছন্দ করেনি?”
টুকটুকি ফুঁসে উঠে। আবারো লোকটাকে তাকে জেনেবুঝে অপমান করছে! নিশীথের মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার কী মনে হয় আমি এতটাই অসুন্দরী?”
নিশীথ উত্তর দিতে গিয়ে হোঁচট খেল। সকালের সোনালি কিরণ টুকটুকির কোমল মুখে আলতো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। ছুঁয়ে দিচ্ছে ঠোঁটের ভাজ। নাকে এসে লাগে মিষ্টি একটা মেয়েলি সুবাস। এই সৌন্দর্যকে অসুন্দর বলা ঘোরতর অ’প’রাধ। নারীমোহ এড়িয়ে নিশীথের দৃষ্টি সংযত করতে একটু কষ্ট হলো বোধহয়। দিশেহারাভাবে দু পা পিছিয়ে গলা খাকারি টেনে বলল,
“হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“আমারও একই প্রশ্ন। আপনার কেন মনে হলো পাত্রপক্ষ অপছন্দ করবে?”
“অহংকার!”
“আত্মবিশ্বাস।”
“পছন্দ করেছে তাহলে।”
“এবং বিয়েটাও ফাইনাল। আর আমি এই মুহূর্তে তার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি।”
পরের কথাটা টুকটুকি মিথ্যা বলল। সে রাকিবের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে না, ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। নিজেকে ছোটো করবে না বলেই চতুর মন বলে দিয়েছে এক লাইন বাড়িয়ে। নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। দৃষ্টি ক্ষুরধার। কি অবলীলায় নিজের বিয়ের কথা বলছে! আবার ড্যাংড্যাং করে দেখা করতে যাওয়া হচ্ছে। অথচ তিনমাসে আগেও তার আশেপাশে কত বাহানা নিয়ে ঘুরঘুর করেছে। এত তাড়াতাড়ি সব মুছে গেল? নিশীথের মনে হুট করেই বিরক্তি জমা হতে থাকে। দুজনের কেউই আর কথা বাড়ায় না। টুকটুকি পথের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে রিক্সার জন্য। নিশীথের গাড়িটা তার গা ঘেঁষে ঝড়ের গতিতে ছুটে গেল। রাস্তার ধারে জমে থাকা কাদাপানি তীব্র বেগে ছুটে এসে ভিজিয়ে দিল ওর গা। টুকটুকি বজ্রা’হ’ত হয়ে সাধের পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
চলবে…
#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[২৭]
গত রাতের হিমবৃষ্টির পরবর্তী আভাস হিসেবেই বোধহয় বেলা দশটা বাজতেই আবারো আকাশ সেজে উঠল মেঘরাজিতে। শীতল হাওয়ার ধীর প্রকোপে হাত-পা জমে আসছে। এই তীব্র শীতেও টুকটুকি পাতলা কূর্তি পরে আছে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যান্টিনের সামনে। অভিমান জমেছে বক্ষস্থলের সবচেয়ে কোমল জমিতে। ম্লান চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবদার করছে অসময়ে আবারো বৃষ্টি নামুক। তার কৈশোরের প্রথম প্রেম, ওই দূর আকাশের বর্ষণ রাজা তো মেঘের পর্দা উঁচিয়ে প্রেয়সীর দুঃখ দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে হলে তাকে পৃথিবীর বুকে নেমে আসতে হবে। তাতেই ক্ষান্ত হলে চলবে না। প্রেয়সীর অভিমান এবার একটু বেশিই গাঢ়। সেই অভিমান ভাঙাতে ঝমঝমিয়ে ঝরতে হবে। উত্তাল হাওয়ায় উড়ে এসে ছুঁয়ে দিতে হবে প্রেয়সীর চোখ, ঠোঁট, গাল, চিবুক। প্রেয়সীর অভিমান ভঙ্গ হলে খানিক রোষের গর্জন দিয়ে বলবে,
“দুঃখের বেলায় শুধু আমায় মনে পড়ে! সুখের সময় তো দিব্যি ভুলে যাও। এহেন অবিচার কেন আমার প্রতি, মেঘকুমারী?”
টুকটুকি বর্ষণ রাজার বুকে মাথা এলিয়ে ভিজতে ভিজতে গুনগুনিয়ে বলবে,
“তুমি কী জানো সখা, বেদনা যতটা আঁকড়ে ধরতে জানে সুখ ততটা জানে না। সুখ হলো বন্ধনহীন প্রজাপতির মতো। মনের বাগানে ফুল ফুটলে সে এসে উড়ে উড়ে আনন্দ বিলায়। ফুল শুকিয়ে গেলে এক সময় হারিয়েও যায়। আর দুঃখ হলো ছায়ার অনুরূপ। তুমি তাকে ভুলে গেলেও, উপেক্ষা করলেও সে ছায়ার মতো সঙ্গে লেপ্টে থাকবে। সুখের প্রকাশ উচ্ছ্বাস, উল্লাস, তৃপ্তি, স্বস্তি, প্রাপ্তি কিংবা নিরব পুলক। আর দুঃখে প্রকাশ কান্না, অভিমান, বে’দনা, ব্য’থা, হাহাকার, আ’হা’জারি, বিষন্নতা। যা প্রাণ’না’শেরও কারণ হতে পারে। তাই দুঃখের সময় মানুষ পাশে কাউকে কামনা করে, সান্নিধ্য, সহানুভূতি, আদর চায়।”
“তুমি বলতে চাও সুখের সময় কেউ সান্নিধ্য খোঁজে না? শূন্যতা থাকে না সুখীদের?”
“সুখের সময় শূন্যতা দেখা দিলে তা আর সুখ থাকে না, সখা। পানসে হয়ে যায়।”
বর্ষণ রাজা বিস্ময়ে বর্ষণের তেজ হারাবে ক্ষণিকের জন্য। টুকটুকি ভ্রু নাচিয়ে বলবে,
“তাহলে বলো, দুঃখের সময় তোমাকে কামনা করা আমার অবিচার নাকি সুবিচার।”
বর্ষণ রাজা কুর্নিশের ভঙ্গিতে নুইয়ে পড়ে বলবে,
“আমার আহ্লাদী মেঘকুমারী ভাবালু কথাবার্তা বলতে শিখে গেছে। আমি তার দুঃখের সঙ্গী হতে পেরে ধন্য।”
টুকটুকি তখন খিলখিলিয়ে হাসবে। বৃষ্টির সঙ্গে খুঁনসুটিতে মাতবে।
হুট করে গায়ে জ্যাকেট উঠতেই টুকটুকি তার কল্পিত প্রেমরাজ্য থেকে প্রস্থান করে চমকে তাকায়। অনুভব পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ধমক দিয়ে বলল,
“শীতবিলাস করছিস? শীতের জামা আনিসনি কেন?”
টুকিটুকি জ্যাকেটে হাত গলিয়ে নিষ্পাপ হেসে বলল,
“তুই দিবি বলে।”
“আমি যে শীতে কাঁপছি তার বেলায়?”
“তুই নিজের রূপের আ’গুনে গরম হবি।”
অনুভব হেসে ফেলল। ওর ফরসা নাকের ডগা শীতে লাল হয়ে আছে। এই রূপের আ’গুনে অনুভব নিজে গরম না হলেও জুনিয়র মেয়েদের মুগ্ধ দৃষ্টি ঠিকই গরম হচ্ছে। ওরা দুজন ক্যান্টিনে ঢুকল। সব সময় মুক্ত আকাশের নিচে টঙয়ের দোকানে আড্ডা দিলেও এই হাড় কাঁপানো শীতে সেই সাহস ওদের হচ্ছে না। ক্যান্টিন ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় উষ্ণ থাকে বলেই আজ ক্যান্টিনে বসেছে সিনিয়র সিসিমপুর দলের আড্ডা। আজ শ্রাবণ কিংবা ফাগুন কোনো আবেশ তাদের মাঝে নেই। আছে মাঘের আঁ’চ’ড় কা’টা শৈত্যরাণীর বিস্তার।
নির্ধারিত টেবিলে গিয়ে দেখা গেল নন্দিনী টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। চুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে মাথায় কাক এসে বিলি কে’টে গেছে। টুকটুকি পাশে বসে ওর চুলে আঙুল চালিয়ে গোছাতে গোছাতে রুষ্ট গলায় বলল,
“ছিন্নমূল, হতদরিদ্রের মতো পড়ে আছিস কেন? বাসায় চিরুনি নেই। চুল আঁ’চ’ড়াতে কষ্ট হয়?”
অনুভব বলল,
“এবার লাগছে আসল ফ’ইন্নি। এই লুকে তোরে গুলিস্তানের মোড়ে ছেড়ে দিয়ে আসলে কিন্তু ভালো ইনকাম হবে মামা।”
নন্দিনী টেবিলে থা’প্প’ড় দিয়ে বলল,
“চুপ শা’লারা, শীতের বরফচণ্ডী রূপে কাহিল হইয়া পেটের জ্বা’লায় ম’র’তাছি আর বিশেষজ্ঞরা একজন করে রূপের চিন্তা আরেকজন ট্যাকার। আরেক বিশেষজ্ঞ খাওন আনতে গিয়া মনে হয় ওইখানেই খাড়াইয়া-ই খাওয়া শুরু করছে।”
খানিক বাদেই দিগন্ত ব্যস্ত দুইহাতে চা-নাশতা নিয়ে এলো। শব্দ করে টেবিলে রেখে অতিষ্ট স্বরে বলল,
“আমাকে কি চাকর পাইছিস তোরা? অর্ডার দেও, চা টেনে আনো, খাবার টেনে আনো৷ আর নবাবের দল বসে বসে গিলবে।”
টুকটুকি নিষ্পাপ মুখে বলল,
“দুইজন ছেলে থাকতে মেয়েদের দিয়ে খাবার বহন করানোটা কি ঠিক দেখায়, হালুম? মানুষ তোদের নিন্দা করবে না? আমরা তোকে নিন্দা থেকে বাঁচাচ্ছি।”
অনুভব কৈফিয়ত দিয়ে বলল,
“ক্যাম্পাসের ক্রাশ হাতে করে চা, নাশতা নিয়ে ছোটাছুটি করছে বিষয়টা রমনীদের চোখে লাগবে, আহ’ত করবে, ইউ নো। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না?”
দিগন্ত দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল,
“প্রেস্টিজ তোর পেছন দিয়ে…”
বাকি কথা গিলে ফেলল দিগন্ত। নিজের ভাষার ব্যবহারে নিজেই বোকা বনে গেছে। ধপ করে বসে জ্যাকেটের চেইন খুলে ফেলল। নিজের ভাষা শুনে তারই গরম ধরে গেছে৷ নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে বক্র সুরে বলল,
“আমি নিষ্পাপ, সবই সঙ্গদোষের প্রভাব।”
নন্দিনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে ততক্ষণে। গতকাল সন্ধ্যার পর আর কিছু খায়নি বলে খিদেয় সে এমনিতেই কা’তর হয়ে আছে। দিগন্তের কথায় পাত্তা না দিয়ে সমুচায় কা’মড় বসিয়ে বলল,
“খাওয়ার সময় রা’গ করতে নাই। তাই কবি এখন নিশ্চুপ হইয়া আহার ভক্ষণ করিবে।”
দিগন্ত বিস্ময়ে বলল,
“হাঁসের মতোন ভকভক করে গিলছিস কেন? জীবনে খাসনি?”
নন্দিনী পাল্টা সুরে বলল,
“আমি পাতি হাঁস। রাজহাঁসের লগে বইয়া আছি। যদি সব খাইয়া ফেলে!”
টেবিলে হাসির রোল উঠল। বৈঠকের আসল পেটুক দিগন্ত নিজেই। তাই খোঁচাটা হজম করতে হলো। পরমুহূর্তেই নন্দিনীকে ধমকে বলল,
“শীতের পোশাক কই? স্বভাবতো নিঃসন্দেহে সাপের মতো। শরীরও কি সাপের মতো শীতল র’ক্তের হয়ে গেছে? তোরা মেয়েরা শৈত্যপ্রবাহেও স্টাইল কীভাবে ধরে রাখিস বুঝি না।”
উত্তরটা অনুভব দিল,
“রূপের আ’গুন বুঝলি, সবই রূপের আ’গুনের তেজ। তুই বুঝবি না।”
“বুঝতে হবে না। আমার ব্রেইনের আ’গুন আছে। যা দিয়ে পড়াশোনাটা ভালোমতো উৎরে যায়। তোদের এক্সট্রা রূপের আগু’ন জ্বেলে পড়েও হয় না কেন?”
নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল,
“টপারের বাচ্চা, চাইর কোনাইচ্চা… একটু বেশি পারোছ দেইখ্যা ভাব লস আমাগো লগে?”
দিগন্ত গর্বিত ঠোঁটে চায়ে চুমুক বসায়। কাঁধ নাচিয়ে বলে,
“টপার বলেই নিজের এসাইনমেন্ট আমাকে দিয়ে করিয়ে প্রতিবছর উৎরে গেছিস। তোর উচিত আমার পা ধোয়া পানি খাওয়া।”
অনুভব বলল,
“ওহহ! তাহলে তুই ই সেই ছাত্র যাকে আশেপাশের প্রতিবেশী সব মায়েরা রোল মডেল বানিয়ে দেখিয়ে নাদান ব্যাকবেঞ্চার বাচ্চাদের জিনা হারাম করত। আর বলত অমুকের পা ধোয়া পানি খা। কিন্তু আমরা তো খাব তোর মাথা।”
সকলের মন ধীরে ধীরে এলোমেলো গল্পের গহ্বরে ডুবে গেল। এক সময় টুকটুকি জিজ্ঞেস করল,
“শেয়াল পন্ডিত শিকু, পায়েলের সঙ্গে কতদূর এগোলো?”
অনুভব মাথা নেড়ে হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে,
“টানছে না। এমনিতে ওর সবই ভালো কিন্তু বন্ডিং তৈরি হচ্ছে না। তাছাড়া নন্দিনীর অতীতে বিয়ের আসর থেকে পালানোর ঘটনাটা নিয়ে একটা তাচ্ছিল্য আছে ওর চোখে। আমার সেটা পছন্দ নয়।”
সকলে একযোগে লম্বা নিশ্বাসের লহর ছোটায়। শুধু নির্বিকার থাকে নন্দিনী। টুকটুকি গালে হাত দিয়ে বলল,
“তোর মনের আয়নায় কি ইহজীবনে কারো মুখ ভাসবে না?”
অনুভব চোখ বুজে একটু ভাবল। কেন কে জানে, হুট করেই তার প্রিয়ার খোঁজ নিতে ইচ্ছে করছে। কয়েকদিন বাদেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে মেয়েটার। কী করে যে ছোটো কাঁধে এতকিছু সামলায়! মনের অলিন্দে কখন যে প্রিয়ার গম্ভীর মুখটা ভেসে উঠেছে অনুভব টের পায়নি। যখন টের পেল, চমকে চোখ মেলে তাকায়। কি আশ্চর্য! মেয়েটাকে নিয়ে এমন ভাবনা কস্মিনকালেও তার মনে আসেনি। রূপের আগু’ন নয়, ভাবনার দা’বা’নলেই অনুভবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে।
চলবে…