শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৪৯

0
452

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৯-প্রথম অংশ]

বৃষ্টি নেমেছে প্রবল বেগে। বজ্রপাতের ধ্বনিতে গমগম করছে চারপাশ। দীর্ঘ দাবদাহের পর কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিতে ধুলো ওড়া প্রকৃতি নির্মল হয়ে উঠেছে। নির্জীবতার ক্লেশ ধুয়ে নিচ্ছে বিশুদ্ধ জলের ধারা। পিচঢালা পথের ধারে হেডলাইট জ্বালিয়ে একটি গাড়ি অকাতরে ভিজছে। গাড়ির ভেতরে দুটি প্রাণ তখন ভিজছে অভিমানসিক্ত অনুভূতির বর্ষণে। টুকটুকির পেলব হাত দুটি বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় স্থবির হয়ে আছে। নিষ্পলক দৃষ্টির অবস্থান একে অপরের অক্ষিকোটরে। লোকটির রুক্ষ দৃষ্টিতে টুকটুকি কাতরতা খুঁজে পায়। পায় ক্লান্তিকর অপেক্ষার নিদারুণ হতাশার ছাপ। নিশীথ প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় উৎকর্ণ বুঝে টুকটুকি অনুযোগ করে বলল,
“শুনেছিলাম আপনার মন যথেষ্ট শান্ত ও শীতল। তাহলে কী করে লাগে দা’বানল?”

“ভালোবাসলে হৃদয়ে ফাগুন লাগে জানতাম। ফাগুনের যে তীব্র আ’গুনও থাকে তা বুঝিনি। এখন বুঝি, ভালোবাসা যেখানে বর্ষণের অনুরূপ, দূরত্ব সেখানে দ’গ্ধতার সমান।”

নিশীথের স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে টুকটুকি বিমূঢ়। প্রবল বৃষ্টির দাপটেই কিনা কে জানে, হঠাৎ ঠান্ডা লাগতে শুরু করেছে। বিদ্যুত ঝলকানির ক্ষণিক ফুটে ওঠা আলোয় প্রিয় মানুষটার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের তারায়। কানের কাছে তীব্র নিনাদে বজ্রপাত ঘটে। বিমূঢ়, বিবশ টুকটুকি চমকে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। বন্ধনে আবদ্ধ পুরুষালি হাতদুটি তাকে ভরসা দেয়। ভালোবেসে একজন মানুষ তার প্রিয়তমের চোখে যে আকুতি দেখতে চায়, আবছায়াতে এই প্রথম টুকটুকি তা দেখতে পাচ্ছে। পরিবেশটা ক্রমেই আবেগ অভিভূত হয়ে ওঠে। টুকটুকি কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বলে,
“দূরত্ব কে তৈরি করেছে?”
“আমি।”
“ভুলটা এখানে কার?”
“একান্তই আমার। তাইতো শোধরাতে চাইছি।”

টুকটুকির কণ্ঠ সরষের মতো ঝাঝিয়ে ওঠে। মনের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলে,
“আচ্ছা! যেখানে আপনার উচিত ছিল আমার খোঁজ নেওয়া আমিই যেচে পড়ে আপনার খোঁজ নিয়েছি। ভালোমন্দ কথা চালিয়ে গেছি। সম্পর্কটাকে মসৃণ করতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি খুবই বাস্তববাদী কিনা? একটা আবেগী, খেয়ালি মেয়ের আবেগকে অহেতুক সময় দিতে বোধহয় ইচ্ছে করেনি। হয়তো বিরক্ত করছিলাম। নারী-পুরুষে যে কমন এট্রাকশন থাকে আপনার বোধহয় আমার প্রতি তাই ছিল। আমার তো মনে হয় আপনি আমায় আপনার এক্স তুবার মতো টেকেন ফর গ্রান্টেড ভেবে বসেছিলেন।”

“হুমায়রা, প্লিজ!”

“আমি প্লিজ। দোষটা আমারই। আত্মসম্মান খুইয়ে বারবার আপনার কাছে যাওয়াটা উচিত হয়নি। আসলে আপনি একটা রোবট। আপনার একজন রোবট মানবীই দরকার। যে হাসবে মেপে মেপে, কথা বলবে মেপে। কান্নাটাও মাপা হওয়া চাই। অবশ্যই তাকে আপনার মতো ক্যারিয়ার কনশাস হতে হবে। সেখানে আমি এক টিপিক্যাল বাঙালি নারী। না আছে ব্যক্তিত্ব, না সম্মানবোধ। আমাকে সময় দেওয়া মানে সময়টা টোটালি ওয়েস্ট…”

বাকি কথা শোনার ইচ্ছে হলো না নিশীথের। ঝটকায় টুকটুকিকে বুকের মাঝে ফেলল সে। রাগের সাথে থুতনিটা চেপে ধরে বলল,
“আমার সামনে আমার প্রিয় মানুষকে অপমান করার সাহস আমি কাউকে দেব না। আপনাকেও না।”

“অপমান আপনি করেননি? আপনার আচরণ এমন করে ভাবতে বাধ্য করেছে আমায়। এখন এসেছেন দরদ দেখাতে!”

টুকটুকি রাগ সামলাতে না পেরে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলে। নিশীথকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দুহাতে মুখ চেপে গুনগুন করে কাঁদতে থাকে। নিশীথ পুনরায় এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত রাখতেই ঝটকায় সরিয়ে দেয়৷ কান্নার দমকে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। নিশীথ অ’প’রাধীর মতো সেই কান্নার করুণ শব্দ শোনে। তার কাছে যে আচরণ স্বাভাবিক মনে হয়েছিল অন্যের কাছে তা কতটা য’ন্ত্রণার তা ঠাহর করতে পারেনি। টুকটুকি হুট করে যোগাযোগ বন্ধ না করলে বোধহয় জানাও হতো না। নিজের স্বভাবটাকে এই মুহূর্তে তার অভিশাপ বলে মনে হচ্ছে। না মাকে বুঝতে পেরেছে আর না ভালোবাসার মানুষকে। কর্মজীবনের সফলতা সব ম্লান হয়ে পড়েছে ব্যক্তিজীবনের অসফলতার কাছে। নিশীথ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বলল,

“আপনার দুর্ভাগ্য যে আপনি আমায় পছন্দ করে ফেলেছেন। তবে সেটা আমার সৌভাগ্য। আমি আপনার মতো করে ভাবতে পারি না। আমার আবেগ আপনার মতো বিগলিত হতে পারে না। তারমানে এই নয় আমার কোনো অনুভূতি নেই আপনার প্রতি। অবশ্যই আছে। শুধু আপনার মতো প্রকাশ করতে পারি না।”

“চেষ্টাও করেননি।”

“এখন করছি তো। আঁধার হাতড়ে মনের পথ চিনেছি আমি। আপনি আমার আলো হয়ে বাকিটা পথ পাড়ি দিতে সাহায্য করুন।”

বাইরে বৃষ্টির প্রকোপ কমার নাম নেই। এলোমেলো বাতাসে ডালপালা নুইয়ে পড়ছে। এমন ঝড়ো পরিবেশে হৃদয়ে ঝড় তোলা মিষ্টি আবদারে টুকটুকি অভিমান ধরে রাখতে পারে না। কিন্তু প্রকাশ না করে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। ওর অশ্রুভেজা পাপড়িগুলো ঘন দেখাচ্ছে। কাজল ছড়ে গেছে। নিশীথ গভীর চোখে ওর কান্না পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল,
“মেঘকুমারী, আপনি কী জানেন? বর্ষণ রাজাকে আসলে মনে নয়, আপনি তাকে চোখে ধারন করেন। বাইরের বৃষ্টির চেয়েও এখন আপনার চোখের বৃষ্টিকে আমার বেশি হিংসে হচ্ছে।”

টুকটুকি কথা না বলে ঠোঁট ভেঙায়। তার গালে তখন লজ্জার রঙিন আভা ফুটেছে। নিশীথ রাগ পড়েছে বুঝতে পেরে একহাতে ওর গাল টিপে দেয়। বিপরীতে টুকটুকি চোখ গরম করে। রাঙা ঠোঁটদুটি ফুলে আছে তার। নিশীথ একদৃষ্টিতে দেখছিল। টুকটুকির খেয়াল হলো রেড লিপস্টিক লাগানো আছে ঠোঁটে। লজ্জায় পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঢেকে নিল সে। নিশীথ ভ্রু কুচকে বলল,
“সমস্যা কী? সকালেও আমার দেখে মুখ ঢেকেছেন। এখনও ঢাকছেন!”

“কাউকে সিডিউস করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার, হুহ!”

“কিন্তু সিডিউস তো আপনি করে ফেলেছেন, ম্যাডাম। এবার কী হবে?”

নিশীথ ঝুকে আসে। নিশ্বাসের তীব্রতা মনের গহীন থেকে কোনো ভয়ানক বার্তা প্রেরণ করছে। মায়াবী রাতের ঘোর লেগে যায় দুই জোড়া চোখে। উন্মত্ত হাওয়ায় টালমাটাল মন। অতি নিকটে তীব্র শব্দে বজ্রপাত ঘটতেই সচকিত হয় দুজন। টুকটুকি অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চেয়ে বলল,
“কি…কিচ্ছু হবে না। গাড়ি স্টার্ট দিন বলছি।”

নিশীথ সুপ্ত বাসনাটুকু গিলে ফেলল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
“নারী ইঞ্জিনিয়ারিং-এর চেয়েও জটিল বিষয়। দূরে গেলেও বিপদ, কাছে এলেও বিপদ। একসঙ্গে থাকার ব্যবস্থাটা এবার করতেই হচ্ছে। এছাড়া নিজের অধঃপতন ঠেকানোর কোনো উপায় দেখছি না।”
___________________

ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। প্রিয়াদের ফ্ল্যাট নির্জন হয়ে উঠেছে। দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে স্থান সংকুলান না হওয়ায় প্রিয়ার মামা-মামীরা রাতেই বিদায় নিয়েছেন। মা ও দিয়ার সারাদিন ধকল গেছে বলে প্রিয়া নিজেই ওদের শুতে পাঠিয়েছে। নিজে দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজার সামনে। দক্ষিণের ঘরের দরজাটা ভিড়িয়ে রাখা। সদ্য বিয়ে করা স্বামী সেই ঘরে তার অপেক্ষায়। প্রিয়ার পায়ে যেন শেকড় গজিয়েছে৷ ওই ঘরে যাবে ভাবলেই বুকের ভেতর দুরু দুরু কাঁপন উঠছে। আধঘন্টার বেশি সময় ধরে সে এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে এতটা পেরেশানি তার হয়নি। গায়ের বেনারসি কুটকুট করছে। মেকাপ তোলা হয়নি। ক্লান্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। এদিকে মনের ভেতর অজানা ঝড় তান্ডবলীলা চালাচ্ছে৷ অনুভব অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে বাইরে উঁকি দিল। প্রিয়া লাফিয়ে উঠে গোছানো বাসনগুলো আবারো গোছাতে শুরু করল। অনুভব বিরক্ত হয়ে বলল,
“ওখানে কী?”

“এই তো একটু…” প্রিয়া মিথ্যা বলতে পারছে না বলে চুপ করে গেল। অনুভব আর কথা না বাড়িয়ে আবারো ভেতরে চলে যায়। পাঁচ মিনিট বাদে আবার উঁকি দিয়ে দেখল প্রিয়া এক জায়গাতেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনুভব ওর সামনে এসে হাত ধরল।
“এসো।”
প্রিয়া জায়গা থেকে নড়ল না। ওর হাত ঘামছে, কাঁপছে।

“তুমি কী বাসর রাতটা এখানেই বাসি করার মতলব করছ?”
অনুভব কথাটা এত জোরে বলল যে প্রিয়ার সন্দেহ হলো মা শুনে ফেলল কিনা। লজ্জায় সে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে গেল। অনুভব মুচকি হেসে পেছনে এসে দরজা বন্ধ করে।

“নির্লজ্জতার সীমা পার করে ফেলছেন আপনি।”
প্রিয়া কটমট করে বলে উঠল। অনুভব ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমি যে ধৈর্যের সীমা পার করে ফেলছ তার বেলায়। অর্ধেক রাত তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিলে।”

প্রিয়া নিশ্চুপ। মৌ মৌ করা ফুলের গন্ধ নাসারন্ধ্র ভেদ করতেই রাগের স্ফুলিঙ্গ নেতিয়ে আবারো লজ্জার ফুলঝুরি ছুটল। অনুভব তার চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে স্মিত হাসে। আরেকটু ভড়কে দেওয়ার অভিপ্রায়ে হুট করেই কোলে তুলে নেয়। প্রিয়ার আত্মা লাফিয়ে ওঠে। খা’মচে ধরে স্বামীর কাঁধের কাছের পাঞ্জাবী। প্রথম চাহনিতে সীমাহীন বিস্ময় এবং পরবর্তীতে লজ্জা খেলে যায়। শরীর কাঁপে থরথর করে। টেনে টেনে শ্বাস নেয়। অনুভব ওকে কোলে রেখেই খাটে বসে। উদ্বিগ্ন হয়ে গালে হাত রেখে বলে,
“এই কী হলো তোমার? প্যানিক হচ্ছো কেন? পানি খাবে?”

প্রিয়া চোখ বুজে কোনোমতে মাথা নাড়ে। পানি খাবে সে। ভেবেছিল পানি আনার সুবাদে অনুভব কোল থেকে নামাবে। কিন্তু বদ লোক হাত বাড়িয়েই গ্লাস পেয়ে গেল। সব একদম পরিপাটি করেই রাখা। পানির বদলে ওর সামনে ধরল দুধের গ্লাস। প্রিয়ার পানি তেষ্টা পেয়েছিল সত্যিই। দুধ দেখে মুখ কুচকে ফেলল।
“অপছন্দ?”
“হু, আমি বাইরে থেকে খেয়ে আসি।”
প্রিয়া উঠলে চাইল। ওকে প্যাচিয়ে রাখা অনুভবের হাতটা শক্ত হয়ে পেট চেপে ধরে।
“উহু, এটাই খেয়ে নাও। মনে হচ্ছে এনার্জি আজ তোমার দরকার।”

প্রিয়া দুই ঢোক খেয়ে আর পারল না। গা গুলিয়ে উঠছে। অনুভব আর জোর না করে প্রিয়ার লিপস্টিক যেখানটায় দাগ ফেলেছে সেখানে মুখ লাগিয়ে বাকিটা খেয়ে ফেলল। ঠোঁটের ওপরে দুইকোণে দুধ লেগে গেছে। প্রিয়া তা দেখে ইশারা করতেই অনুভব ফুরফুরে গলায় বলে উঠল,
“বউয়ের আঁচল থাকতে আমি কষ্ট করতে যাব কেন? মুছে দাও।”

অনুভব মুখ বাড়িয়ে দেয়। প্রিয়া অতিষ্ট চোখে চেয়ে শাড়ির আঁচলে ঠোঁট মুছে দেয়। দুজন স্পর্শে উত্তাপ বিনিময় করছে। প্রিয়ার বিমূঢ়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিপরীতে বাড়ছে অনুভবের মুগ্ধতা। সেই প্রথম দিন তার সৌন্দর্য নিয়ে বিদ্রুপ করা মেয়েটাই এখন তার বউ! অনুভব তাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে। বুকের মধ্যে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়তে থাকে। অনুভব উদ্বেলিত আবেগে বশিভূত হয়ে প্রেয়সির ঠোঁটে একটা সিক্ত চুমু খেতে উদ্যত হয়। ঠিক তখনই ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠল,

“আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো রে ম’রার কোকিলে…”

আবেশিত সময়টুকু মুহূর্তেই খান খান হয়ে গেল। অনুভব হতভম্ব। এমন রিংটোন কস্মিনকালেও তার ফোনে ছিল না। প্রিয়া ঠোঁট চেপে হাসি আটকে কোল থেকে নেমে গেল। ফ্রেস হওয়া প্রয়োজন। অনুভব ফোন হাতে নিয়ে দেখল নন্দিনীর কল। বুঝতে বাকি নেই এমন রিংটোন কারা সেট করেছে।

“হেই মামা, হোয়াটস্ আপ?” নন্দিনীর উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে আসে।

অনুভব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“কোকিলের বাচ্চা, রাত বারোটায় ফোন করে জানতে চাইছিস হোয়াটস্ আপ? তোরে সামনে পেলে বুঝিয়ে দিতাম মেজাজ কতটা আপ।”

অনুভব ফোন কাটল। প্রিয়ার ফ্রেশ হওয়ার মাঝে আরো একবার ফোন এলো। আবারো অপছন্দের গানটা বেজে উঠেছে। এবার কল করেছে দিগন্ত। বুঝতে বাকি নেই সব প্রি-প্ল্যানড। অনুভব ফোন রিসিভ করল অত্যন্ত শান্ত মেজাজে।

“হে হে! ফোনের আউটগোয়িং সার্ভিসটা ডিস্টার্ব করছিল কয়েকদিন, বুঝলি। জাস্ট দেখতেছিলাম কল ঠিকঠাক যায় কিনা। ভেবেছিলাম ফোন বন্ধ থাকবে তোর। তুই এত রাতে জেগে আছিস দোস্ত?”

“হ্যাঁ, হাডুডু খেলছি। খেলবি?”

“আমার কী সেই কপাল আছে? বিয়ের বয়স হয়েছে, এদিকে বাপ-মা জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। হায়! এই মধ্যরাতে এসে মনে হচ্ছে, হাডুডু খেলার জন্য হলেও যে একটা মনের মানুষ চাই। হ্যালো! শিকু তুই শুনতে পাচ্ছিস? আই অ্যাম সো ডিপ্রেসড ইয়ার।”

অনুভব ফোন কেটে সরাসরি সুইচ অফ করে দিল। প্রিয়া ততক্ষণে তাতের শাড়ি পরে বেরিয়েছে। প্রসাধনহীন স্নিগ্ধ মুখটা ক্ষণেই অনুভবের থিতিয়ে থাকা অনুভূতিটাকে সতেজ করে দিল। বৃষ্টিঝরা প্রকৃতিও তখন সতেজ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিতেই একরাশ হাওয়া এসে ভরিয়ে দেয় ঘরের অলিগলি। স্বামীর নিষ্পলক দৃষ্টির সামনে প্রিয়া কী করবে ভেবে পায় না। কখনো হাত মোচড়ায়, কখনো চুল ঠিক করে। অনুভব মুচকি হেসে তা উপভোগ করে। দুচোখে ঘোর লেগে যায়। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে,
“এসো।”

প্রিয়া জড় পদার্থের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। অনুভব ওর কোমল হাতটা মুঠোয় পুরে জানালার কাছে টেনে এনে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। ঘাড়ে থুতনি ছুঁইয়ে বলে,
“আমার সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। তুমি এখন থেকে আমার ব্যক্তিগত মানুষ, আমার বউ। সবচেয়ে সুন্দর পুরুষটাকে তুমি পেয়ে গেছো, হাসু। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।”

প্রিয়া ভ্রু কুচকায়, “আপনাকে পেয়েছি বলে আপনি আমার ওপর প্রাউড ফিল করছেন?”

অনুভব গদগদ হয়ে বলল,
“হ্যাঁ। তোমারও করা উচিত।”

“আপনি নিজের সৌন্দর্যকে খুবই ভালোবাসেন তাই না?”

“তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি এই মেয়েটির রাগী মুখটা। একেবারে বুকে গিয়ে লাগে।”

প্রিয়া লজ্জাবনত হয়ে মুচকি হাসে। অনুভব ওর কানে ঠোঁট রেখে আকুল কণ্ঠে ফিসফিস করে,
“আই লাভ চকলেট, অ্যান্ড ইয়্যুর স্মাইল লুক লাইক মেল্টিং হট চকলেট। আই কান্ট রেসিস্ট মাইসেল্ফ।”

শিরশিরে অনুভূতিতে আক্রান্ত প্রিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকায়। যেমনটা চাঁদ লুকিয়েছে মেঘের আড়ালে। আ’গ্রা’সী অনুভব ততক্ষণে প্রিয়তমার ওপর অনুরাগের আ’ক্র’মণ চালিয়েছে। দক্ষিণা জানালা একরাশ সুখানুভব নিয়ে একটি নতুন অধ্যায়ের রচনা করতে লাগল।

চলবে…

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৪৯-দ্বিতীয় অংশ]

বাড়িওয়ালা সফেদ মোল্লা মানুষটা দেখতে রুক্ষ-শুষ্ক হলেও মনটা নামের মতোই পরিষ্কার। তাই বিয়ের পরদিনই অনুভব প্রিয়াকে দুপুরের দাওয়াত দিয়ে বসেছেন। এই সময় নব দম্পতি বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি, আত্মীয়দের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে কূল পায় না। কিন্তু অনুভব-প্রিয়ার যা বাপের বাড়ি তাই শ্বশুরবাড়ি। যেহেতু ওদের বিয়েটা ঘরোয়াভাবে হয়েছে, আত্মীয়-স্বজনও তেমন নেই, তাই বউ ভাতের নামে দুপুরে ওদের খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করেছেন সফেদ মোল্লা। কিন্তু দাওয়াত দেওয়ার সময় স্বয়ং নন্দিনী উপস্থিত ছিল বলে সফেদ মোল্লা চেয়েও এড়াতে পারেননি ওদের। ভেবেছিলেন সৌজন্যতা দেখিয়ে দাওয়াত করলে নন্দিনীও সৌজন্যতা দেখিয়ে মানা করে দেবে। কিন্তু মেয়েটি মোটেও সেটা করল না। গদগদ হয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করল। সেই সুবাদে পরদিন হইহই করে বন্ধুরা হাজির হলো সাদার রাজ্যে। সাদা মহলের সম্মান রক্ষার্থেই আজ নন্দিনী সাদা ফতুয়া ও ফিসকাট প্যান্ট পরে এসেছে। ঈষৎ কোকড়ানো চুলগুলো টুইস্ট করে বাধা। লাইট মেকাপ করেছে মুখশ্রীতে। দিগন্ত পরেছে সাদা পাঞ্জাবি, গা থেকে মৃদুলয়ে বেরোচ্ছে ভারসাচির পুদিনা, লেবু ও কাঁচা আপেলের মাইল্ড ফ্লেভারের মাইন্ড রিফ্রেস করা সুবাস। টুকটুকিও একই রঙের সালোয়ার-কামিজ পরেছে। লাল লিপস্টিকটা আজ আর তার ঠোঁটে নেই। তার স্থানে আছে লাইট পিচি পিংক কালার। তিনজন যেন কোমল স্নিগ্ধতা জড়িয়ে রেখেছে চারপাশে। দেখলেই মনটা ফুরফুরে হয়ে আসে। ওরা এখন অনুভবের ফ্ল্যাটে। জোহরের পর বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটে যাবে। চারবন্ধু নিজেদের স্টাইলে পোশাক পরলেও রঙ মিলিয়ে পরা হয়েছে অনেকবার। আজ অনেকদিন বাদে আবারো রঙ মিলিয়ে পরে টুকটুকি ও নন্দিনী আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত। দিগন্ত খুশি হতে গিয়েও পারছে না। কারণ সেজেগুজে আসা মাত্রই অনুভব দাঁত কেলিয়ে বলেছে,
“তিন ভাইবোনকে খুব সুন্দর লাগছে।”

বাকি দুইজন না বুঝলেও দিগন্ত জানে এ স্পষ্ট টিপ্পনী। সত্যিটা ধরে ফেলার পর থেকেই অনুভব হাত ধুয়ে ওর পিছনে লেগেছে। সেও পাল্টা চি’মটি কা’টতে ভুলল না।
“বারবার হাই তুলছিস যে! রাতে বুঝি খুব ধকল গেছে? একটুও ঘুম হয়নি?”

অনুভব আরেকবার হাই তুলে জবাব দেয়,
“উহু, বললাম না হাডুডু খেলেছি।”

“কয় রাউন্ড হলো, দোস্ত? কোনো সমস্যা নেই তো? থাকলে কিন্তু চিন্তা করবি না। ভালো হার্বালিস্টের কাছে নিয়ে যাব। এক কোর্সই যথেষ্ট।”

অনুভব দিগন্তের ঘাড়ে থাবা বসিয়ে কপাল কুচকে বলে উঠল,
“আন্টি জানে, যেই ছেলেকে তিনি কচি খোকা করে রাখতে চেয়েছেন সেই ছেলে পেকে ঝুনা হয়ে যাচ্ছে?”

দিগন্ত ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চিপে বলে,
“তোদের মতো ফরমালিনযুক্ত বন্ধু থাকলে পাকার জন্য মৌসুম লাগে নাকি?”

ওরা কথা বলছিল নিচু গলায়। দিগন্তকে মুখ বিগড়ে ঘাড় ডলতে দেখে টুকটুকি বলে উঠল,
“তোদের আবার কী হলো?”

“কিছু না। গিয়ে দেখ তো হাসু রেডি কিনা।” অনুভব তাড়া দিয়ে প্রসঙ্গ বদলায়। সকাল থেকে প্রিয়া তাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলছে। ভুলক্রমে সামনে পড়ে গেলেও মুখ লুকিয়ে সরে যাচ্ছে। দরকারে ডাকলে পাঠাচ্ছে দিয়াকে। শুরুতে উপভোগ করলেও এখন অনুভবের মন উতলা দেখা পেতে। দেখা পাওয়া গেল আরো বিশ মিনিট বাদে। নন্দিনী প্রিয়াকে ঘরোয়াভাবেই মিষ্টি করে সাজিয়ে দিয়েছে। নতুন বউ ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে পরিয়েছে লাল শাড়ি। শাড়িটা প্রিয়ার মায়ের। এক সময় বেশ শৌখিন পোশাক পরতেন তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রেই হোক বা নতুন শাড়ি কিনে দেওয়ার অপারগতায়, মুনিরা বেগম সেগুলো মেয়েকে দিয়েছেন। ন্যাপথলিনের গন্ধযুক্ত শাড়িতে মা মা ঘ্রাণ ও অতীতের সুখস্মৃতি বিজড়িত বলেই বোধহয় প্রিয়ার কাছে শাড়িগুলো সেরা উপহার।

অনুভবের সামনে পড়ে প্রিয়া গুটিয়ে গেল। এক পলক তাকিয়ে মাথা নত করে রাখে। ঠোঁটের কোণে খুবই সুক্ষ্ম এক লাজুক হাসি ধরে রাখা। এদিকে অনুভব হা করে তাকিয়ে আছে। বউ হয়ে গেলে মেয়েরা হুট করে এত সুন্দর হয় নাকি! ঘড়ির কাটায় দেড়টা বাজে। দেরি হচ্ছে বলে ইতিমধ্যে দোতলা থেকে রিমাইন্ডার এসে গেছে। অনুভব ইচ্ছে করেই প্রিয়াকে আটকে দিয়ে বাকিদের বলল,
“তোরা যা। আমরা আসছি।”
রুমে যেতে যেতে প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমার হাতঘড়িটা খুঁজে দাও তো, হাসু। সকাল থেকে পাচ্ছি না।”

বন্ধুরা তার অভিপ্রায় বুঝে ইচ্ছাকৃত গলা খাকারি টেনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। প্রিয়া অসীম লজ্জায় ডুবে রুমে ঢুকেই কড়া চাহনি দিল। বলল,
“নির্লজ্জ হতে পারেন, আমি তো নই। কেন সবার সামনে এভাবে অস্বস্তিতে ফেলেন?”

অনুভব দুই হাতের বাধনে স্ত্রীকে বেধে ফেলে গালে নাক ঘষে।
“সকাল থেকে দূরে আছো কেন? এটা তার ছোট্টো একটা শাস্তি। আমাকে ইগনোর করার চেষ্টা করলে এরপর থেকে আরো ভয়ানক শাস্তি দেব।”

প্রিয়া কপাল চাপড়ে মুখ লুকায়। এখন কি শান্তিতে লজ্জাটাও পেতে দেবে না!
_________________

মেঘলা দুপুরে রোদেরা হাতছানি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। দরজা খুলে তিনটে সাদা পায়রা দেখে সফেদ মোল্লা হতভম্ব। নন্দিনী সহাস্যে বলে উঠল,
“আসসালামু আলাইকুম, হোয়াইট চাচা। ভালো আছেন?”

সফেদ মোল্লা নন্দিনীকে মাথা পাগল মেয়ে হিসেবেই জানেন। সে জন্য তার উদ্ভট আচরণেও নরম থাকার চেষ্টা করেন৷ এই যেমন নন্দিনী এখন উনার নামটা ঠিক উচ্চারণ করল না। তাতে অসন্তুষ্ট হলেও তিনি নিরুত্তাপ। বাকিদের দিকে চেয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে ভেতরে আনলেন। ড্রইং রুমের সাদা রঙের সোফায় কালো টিশার্ট পরা উজ্জ্বল বর্ণের একটি ছেলে ফোনে ডুবে ছিল। অতিথি দেখে ভদ্রতা বশত ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়। সর্বপ্রথম দৃষ্টি বিনিময় হয় নন্দিনীর সঙ্গেই। একঝাঁক অচেনা মানুষ দেখে সে অপ্রস্তুত। পরিচয় দেওয়ার নিমিত্তেই সফেদ মোল্লা বললেন,

“আমার ছেলে নির্মল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ছে। আজই বাড়ি এসেছে।”

“হোয়াইটের ছেলে ক্লিন! তাহলে মেয়ে থাকলে কী নাম হতো?” নন্দিনী বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল। দিগন্ত চিমটি কেটে চুপ থাকতে বলে। নন্দিনী তাকে পাত্তা দিল না যদিও।

“হ্যালো মি. ক্লিন! আমি নন্দিনী।” পরিচয় করতে সর্বপ্রথম নন্দিনীই এগিয়ে গেল। টুকটুকি ও দিগন্ত একে অপরের মুখ চেয়ে পুনরায় নন্দিনীর দিকে চায়। যেন ওর মনোভাব অর্ধেকটা ধরে ফেলেছে। নির্মল নামের ছেলেটা নিজের নাম শুনে প্রথমে ভ্রু কুচকাল। পরে হেসে ফেলল। হাসল নন্দিনীও। সেই হাসি আরেকজনের চোখে ঈর্ষার আগুন জ্বা’লিয়ে দিল খুব সন্তর্পণে।

অনুভব ও প্রিয়া এলো কিছুক্ষণ বাদে। সফেদ মোল্লা সবাইকে খেতে বসিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে নির্মলের সঙ্গে নন্দিনীর আলাপচারিতা এগিয়েছে। তাদের আলাপের বিষয় অনুভব-প্রিয়ার বিবাহ। এরেঞ্জ ম্যারেজ ভালো নাকি লাভ ম্যারেজ সে নিয়ে নিজেদের দর্শন জাহির করা হচ্ছে। দিগন্ত তীক্ষ্ণ চোখে দুজনকে দেখছিল। পোলাও, রোস্ট তার গলা দিয়ে নামছে না। ভাবখানা এমন যে রোস্ট রেখে নন্দিনীর মাথাটা চিবিয়ে খেতে পারলে শান্তি হয়। আস্ত একটা ব’জ্জা’ত মেয়ে। কী দরকার আরেক লোকের সঙ্গে হাহা হিহি করার? অনুভব কানের কাছে ঠোঁট এনে নিচু গলায় গুনগুন করতে লাগল,
“বন্ধু যখন অন্যপুরুষ লইয়া
আমার চোখের সামনে দিয়া
রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়
ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়।”

দিগন্ত শীতল দৃষ্টি ফেরায় অনুভবের দিকে। অনুভব মিচকে হাসি দিয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলল,
“গতরাতে মমতাজের ‘ঘুম ভাঙাইয়া গেলো রে ম’রার কোকিলে’ শোনার পর থেকে কেন জানি সারাদিন তার গানই ঠোঁটের আগায় ঘুরঘুর করছে। পরিস্থিতির সঙ্গে দারুণ মানানসই, তাই না?”

দিগন্ত দাঁতে দাঁত চেপে প্রত্যুত্তর করে,
“হ্যাঁ খুব। আমার তো নাচতে মনে চাইছে।”

“যাকে মনে ঠাঁই দিয়েছো সে তোমাকে নাচিয়েই ছাড়বে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বন্ধু আমাদের লাখে একটা কিনা!”

দিগন্ত কোনো উত্তর দিল না। ভোজনরসিক ছেলেটির ওজন কিছুটা বেড়েছে ইদানীং। হ্যাংলা পাতলা ভাবটা মুছে গিয়ে ভরাট ভাব এসেছে দেহে। ট্রিম করা দাড়িতে তার ফরসা মুখটা বেশ সুদর্শন দেখায়। অনুভব ওকে পরখ করে নিচু গলায় বলল,
“শুনেছি বিয়ে হলে মানুষ সুন্দর হয়। তুই দেখি প্রেমের বাতাস লাগতেই সুন্দর হয়ে গেছিস। কী ব্যাপার, হু? এ কার মহিমা? বিদেশি ঘোলা চোখের বিড়ালের নাকি বাংলাদেশী বাঘিনীর?”

অনুভব কনুই দিয়ে খোঁ’চা দিতেই দিগন্ত অপ্রস্তুত হলো। আঁড়চোখে চাইল নন্দিনীর দিকে। সেই মেয়ে নতুন মুরগী পেয়ে মহা আনন্দে আছে। বুক চিড়ে প্রলম্বিত শ্বাস বেরোয় অজান্তেই। প্রেম কাকে বলে, প্রেমের রূপ কেমন, স্বাদ কিংবা অনুভূতিই বা কেমন তার কিছুই দিগন্ত জানে না। আলাদাভাবে বুঝতেও চায়নি কখনো। তবে ভালোবাসার টান দিগন্ত বোঝে। মায়ার মহিমা উপলব্ধি করতে পারে। বন্ধুদের দিগন্ত মন থেকেই ভালোবেসেছে। সেই ভালোবাসা সূর্যের মতো দৃশ্যমান, বাতাসের মতোই অনুভূতিময়। কলুষতা, হিং’সা, সন্দেহ, লোভ কিংবা ক্রোধ কোনোটারই স্থান নেই সেখানে। এই ভালোবাসায় আছে ভরসা, আস্থা, যত্ন, নির্ভাবনা। শত চড়াই-উতরাই পেরিয়েও তাদের বন্ধুত্বটা টিকে আছে একমাত্র শুদ্ধতা ও সম্মানের কারণে। পিতা-মাতার স্নেহঘন সান্নিধ্য চাওয়া তৃষ্ণার্ত হৃদয় তার বন্ধুদের সান্নিধ্যে শান্তি পায়।

নন্দিনীর সঙ্গে দিগন্তের ঝগড়াঝাটি হলেও তারা মন থেকে কেউ কারো অনিষ্ট চায়নি। ভাবতেও পারে না। দিগন্ত নন্দিনীকে আগলে রাখতে শুরু করেছে ফার্স্ট ইয়ারে যখন ওকে প্রথম সু’ই’সাইড এটা’ম্পট করতে দেখে। তার আগে পর্যন্ত দিগন্তের নিয়ম মেনে চলা রুদ্ধ জীবন একটি মুক্ত বিহঙ্গের অবাধ স্বাধীনতা, জটিলতাহীন একলা জীবন দেখে প্রথম প্রথম হিং’সাই করত বটে। লাগামহীন স্বভাবে নাস্তানাবুদও কম হতে হতো না। কিন্তু সুই’সা’ইড এটা’ম্পট করে নন্দিনী যখন ডিপ্রেসিভ দিনগুলো অতিবাহিত করছিল, সবাই বুঝে গেছিল মেয়েটা চরম নিঃসঙ্গ। জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই, পিছুটান নেই, সমাজের নিয়ম মানার দায়ও নেই। একটা মেয়েকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে, তার নিঃসঙ্গতা কাটাতে গিয়েই বন্ধুমহলের বন্ধন জোড়াল হতে শুরু করেছিল।

দিগন্তের আনকোরা, অনাঘ্রাত মন কবে এই দুর্বার মেয়েটির প্রতি বন্ধুত্বের সীমারেখা লঙ্ঘন করে আলাদা কিছু অনুভব করতে শুরু করেছে সে জানে না। দুর্বলতা ফুলে ফেঁপে বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে শেষবার নন্দিনীর হাত কা’টার পর। তখন থেকে অল্পতেই বুকে কাঁপন ধরে। তাকাতে ভয় হয়। দৃষ্টির বদল নন্দিনী বুঝে ফেলছে না তো! বুঝলেও কী হবে এর পরিনতি?

দিগন্তের ভয় ছিল অনুভব ও টুকটুকি জানলে ওকে কটাক্ষ করবে, বন্ধুত্বের মাঝে অযাচিত অনুভূতি টেনে আনাটা ওরা কেউই সহজভাবে নেবে না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সবাই এখন ভবিষ্যত নিয়ে ভাবছে। আগামী দিনগুলোর প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। এখন সবচেয়ে অরক্ষিত জীবন একমাত্র নন্দিনীর। ওর পাশে কোনো কাছের মানুষ নেই। জীবন নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু জীবন তো এভাবে চলতে পারে না৷ বেপরোয়া স্বভাব ততক্ষণ নিরাপদ যখন সে উ’গ্র, ছন্নছাড়া জীবনের পাশাপাশি নিজের সুরক্ষার কথাটাও চিন্তা করে। নন্দিনী নিজেই নিজের কাছে অনিরাপদ। কখন নিজের ক্ষতি করে বসে তা কেউ জানে না। এমতাবস্থায় বন্ধুরা ওর ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। মেয়েটাকে কেউ একজন আগলে রাখার মতো প্রয়োজন। দিনশেষে একটা নিজের মানুষ দরকার। সেটা দিগন্ত হলে আপত্তি নেই অনুভবের। বাইরের কেউ হলেই বরং চিন্তা থেকে যাবে। টুকটুকি যদিও এখনো কিছু জানে না। অনুভব জেনে দিগন্তকে সাপোর্ট করছে। কিন্তু যাকে নিয়ে এত চিন্তা, জল্পনাকল্পনা, সেই নন্দিনী আদৌ তাকে মেনে নেবে?

পায়েসের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে সফেদ মোল্লা চার বন্ধুকে জহুরির চোখে দেখেন। সরাসরি বলেন,
“ছেলেতে মেয়েতে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। আমার অভিজ্ঞতাও তাই বলে। তাহলে তোমাদের বন্ধুত্ব ঠিক রইল কী করে?”

“আপনার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল, হোয়াইট আংকেল?” নন্দিনী প্রশ্ন করল।

সফেদ মোল্লা ভ্রু কুচকালেন,
“এই প্রশ্ন কেন?”

“বললেন যে অভিজ্ঞতা আছে। নিজের অভিজ্ঞতা থাকলেই তো শতভাগ জোর দিয়ে বলা যায়।”

সফেদ মোল্লা পরিবারের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। মাথা পা’গল হলেও এই মেয়ে অন্য পা’গলদের মতো ভিত্তিহীন আচরণ করে না! খুবই বিপদজনক পা’গল। অনুভব বলল,
“আপনার কথায় যুক্তি আছে, আংকেল। কিন্তু আমরা বন্ধু হিসেবে খুব চুজি, মানুষ হিসেবেও তাই৷ একেকজন যেমন লাভ অ্যান্ড লাইফ পার্টনার এক্সপেক্ট করি, আমরা মোটেও তেমন নই। তারমানে এই নয় আমার বন্ধুরা যোগ্য মানুষ নয়। বরং প্রিয় মানুষের তালিকায় ওরাই এগিয়ে থাকবে। রিলেশনশিপ বিষয়টায় চাওয়া-পাওয়ার স্থান আছে, পার্টনারের প্রতি এক্সপেকটেশন তৈরি হয়৷ পছন্দ, অপছন্দ মানিয়ে চলতে হয়। বন্ধুত্বের বেলায় তা বাধনহারা। ফ্যামিলির সামনে যা বলা যায় না, করা যায় না বন্ধুদের সামনে তা নিঃসংকোচে করা যায়। অন্যদের কাছে যা অন্যায়, বন্ধুত্বে তাই ন্যায়। হ্যাঁ, ফ্রেন্ডশিপে ক্রাইমও হয় তবে আমাদের সম্পর্ক তেমন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে না। উই আর ভেরি মাচ কেয়ারিং এবাউট আওয়ারসেলভ্স্। সবচেয়ে বড়ো কথা নন্দিনী ও টুকটুকি দুজনকেই আমি প্রথমত বন্ধু বলি দ্বিতীয়ত বোন। আমি ওদের মাথায় হাত রাখি, যত্ন করি স্নেহে। সেখানে কামনা-বাসনা কল্পনাতেও ঠাঁই পায় না। দিগন্ত আমার দোস্ত কাম ভাই। ওরাও আমাকে তেমনই দেখে। কাজেই এখানে আপনার অভিজ্ঞতা আংশিক অকার্যকর।”

অনুভবের কথা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। কিন্তু শেষ বাক্যে এসে থমকে গেল। সফেদ মোল্লা প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“আংশিক কেন?”

অনুভব চোরা চোখে দিগন্তকে এক পলক দেখে। ছেলেটা লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অ’প’রাধবোধে মাথা নুইয়ে আছে। এমন নিষ্কলুষ একটা বন্ধুত্বের মাঝে কেন তার অযাচিত অনুভূতি জন্ম নিল? দোষী একমাত্র সেই। অনুভব একটু চুপ থেকে বলতে লাগল,
“আংশিক বলছি কারণ বন্ধুত্ব থেকে অন্য কোনো সম্পর্ক হলে সেটা দোষের কিছু নয় বরং বেস্ট ওয়ে টু চুজ রাইট পারসোন ফর রেস্ট অফ দ্য লাইফ। সম্পূর্ণ অচেনা কিংবা চেনা একটা মানুষের সঙ্গে রিলেশনশিপে গেলে বা বিয়ে করলে তাকে আমরা ধীরে ধীরে জানব। এমন অনেক স্বভাব আছে যা আমাদের পছন্দ হবে না। ভালোবাসার জন্য আমরা মানিয়ে নেব। সম্পর্কে মানিয়ে নেওয়াটা মোস্ট ইমপোর্টেন্ট। না পারলেই অশান্তি। সেক্ষেত্রে দুটো বন্ধু অনেক বছর ধরে নিজেদের সম্পর্কে অবগত। একে অপরের সুখ, দুঃখ, বেদনায় পাশে আছে। ভালোদিক, মন্দদিক সব জানা। এমতাবস্থায় তারা যদি বন্ধুত্বকে আরেকটা রূপ দিতে চায় সেটা দোষের কিছু নয়, তাই না? লাইফ পার্টনার যদি প্রিয় বন্ধুটা হয় তাহলে সম্পর্কটা আরো সুন্দর হবে আমার বিশ্বাস।”

সবাই এবারও চুপচাপ। দিগন্ত কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে চায় অনুভবের দিকে। অনুভব অল্প হেসে চোখের পলক ফেলে ভরসা দেয়৷ ওদের চোখাচোখি নন্দিনীর চোখ এড়াতে পারে না।

সফেদ মোল্লা বললেন,
“তোমাদের আমি যতটা বুদ্ধিমান ভেবেছি তোমরা তারচেয়েও বুদ্ধিমান। বন্ধুত্ব ধরে রাখো সারাজীবন। পৃথিবীটা ধীরে ধীরে যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। আগে মানুষ যাত্রাপথে একসঙ্গে ভ্রমণ করলে একজন আরেকজনের সঙ্গে পরিচিত হতো। কর্মস্থলেও সবাই সবার খোঁজ খবর রাখত। সৌজন্যতা থেকে কতশত সম্পর্ক তৈরি হতো। ধর্মের ভাই, মিতা, পাতানো বাবা-মা, ভাই-বোন, ইয়ার-দোস্ত কত কী! একজনের খাবার দশজনে ভাগ করে খেতো। এখন একসঙ্গে বসলেও কেউ কারো দিকে ঘুরে তাকায় না। হাতে একটা ফোন আর ইন্টারনেট থাকলে আর দুনিয়া চেনে না। মানুষ এখন আধুনিক হতে গিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে৷ তোমাদের বন্ধুত্বটা ভালো লেগেছে। সময়ের প্রয়োজনে বদলাবে, কিন্তু মনটাকে যান্ত্রিক হতে দেবে না।”

টুকটুকি আবেগঘন মন নিয়ে পাশে বসা নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
“আমি যান্ত্রিক হতে চাই না। তোদের সঙ্গে বুড়ো হতে চাই। চুল পাকাতে চাই। বৃদ্ধ বয়সে ক্ষীণ দৃষ্টিময় চোখে চশমা পরে কার কয়টা দাঁত পড়েছে গুণে দেখতে চাই। শিকু আর হালুমের চুল পড়ে টাক হওয়া মাথায় তবলা বাজাতে চাই।”

সকলে হেসে উঠল। দিগন্ত বলল,
“তোর তবলা বাজানোর ইচ্ছে পূরণ করার জন্য হলেও একটা চান্দিছোলা টাক চাই।”

চলবে…