শ্রাবণ কিংবা ফাগুন একটুখানি বর্ষণ পর্ব-৫২ এবং শেষ পর্ব

0
845

#শ্রাবণ_কিংবা_ফাগুন_একটুখানি_বর্ষণ
প্রভা আফরিন
[৫২- সমাপ্তি পর্ব]

রহস্যময় রজনী সকল কোলাহল শুষে নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আসছে। শান্ত হচ্ছে শহরের বুক। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিশ্রামে যাচ্ছে পরিশ্রমী প্রাণেরা। অনুভব বিছানায় বসে একমনে চাকরির বই পড়ছে। বেসরকারি চাকরির সুযোগ তার অহরহ। কিন্তু অনুভব একটা সরকারি স্থায়ী চাকরির জন্য মড়িয়া। বিসিএসের প্রস্তুতিটা এবার আটঘাট বেধেই নিতে শুরু করেছে। একটানা অনেকক্ষণ পড়ে একটু ব্রেক নিয়ে সময়টা দেখল অনুভব। রাত এগারোটা বাজে। অনেকক্ষণ হলো বউয়ের দেখা নেই। নিশ্চয়ই কোনো কাজে মশগুল। চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। কিছু না কিছু করতেই থাকে সারাক্ষণ। বাইরে বেরিয়ে দেখল তার ধারণাই ঠিক। ঘর সাজানোর সরঞ্জামাদি নিয়ে খুটখাট করছেন মহারানী৷ ইদানীং তার শখ হয়েছে আসবাবহীন ফ্ল্যাটের দেয়াল সাজাবে। মুনিরা বেগমও ঘুমাননি। মেয়েকে সঙ্গ দিতেই বোধহয় রয়ে গেছেন। অনুভব মনোযোগ আকর্ষণের জন্য তার সামনে দিয়ে পানি খেতে গেল। পেট ফুলিয়ে পানি পান করেও বউয়ের কৃপাদৃষ্টিতে পড়ল না। হতাশ হয়ে মুনিরা বেগমের পাশে এসে বসল। বলল,
“আপনার মেয়ে ছোটো থেকেই পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ, তাই না? একদিনও বই নিয়ে বসতে দেখলাম না।”

“নিজে বউ নিয়ে বসে থাকলে বই ধরার সময় কোথায় মিলবে?” বলতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল প্রিয়া। শুধু শাণিত একটা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে পুনরায় কাজে মন দিল।

মুনিরা বেগম মৃদ্য হেসে বললেন,
“ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। প্রথম দ্বিতীয় না হলেও টপে থাকত। শুধু যদি কাজের চাপটা নিতে না হতো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে যেত।”

প্রিয়া চুপসে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারার গোপন আফসোস তার মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে প্রায়ই। দশম শ্রেণি থেকে স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসে চড়বে ও। তখন দুচোখ ভরা শুধু স্বপ্নই ছিল। আর এখন শুধু খাওয়া-পড়ার চিন্তা। মা-বোন সঙ্গে প্রাণপ্রিয় স্বামীর জন্যও চিন্তা। মানুষটা তাদের জন্য দিনরাত খাটছে। চোখে একফোঁটা অভিযোগ নেই। সমস্ত সুবিধা অসুবিধা খেয়াল করছে। হাসিমুখে সমস্ত আবদার মেটাতে চেষ্টা করছে। অনুভব প্রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যা গেছে তা নিয়ে আফসোস না করে যা আছে তা নিয়ে সুখে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই না, মা?”

মুনিরা বেগম প্রসন্নতার সঙ্গে হাসলেন। ছেলেটা যখন মা বলে ডাকে মনে হয় কত পুরোনো সম্পর্ক তাদের। কত চেনাজানা। কত মায়া ভর করে মনে। প্রিয়া সব কাজ রেখে বলল,
“আজ থাক। ঘুমাতে চলো মা।”

প্রিয়া মাকে শুয়িয়ে দিয়ে বাতি নিভিয়ে নিজের ঘরে এলো। অনুভব খাটের একপাশে বসে আছে। প্রিয়া অন্যপাশে বসে নিজের বইপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। অনুভব ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
“পড়া দেখানো হচ্ছে?”

“আমি নাকি ফাঁকিবাজ। তাই পড়াশোনা করি নাহয় একটু।”

“আচ্ছা পড়ো।”

প্রিয়া বইয়ে চোখ রেখে উশখুশ করতে লাগল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে পড়া হয়?”

“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?”

অনুভব গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে৷ প্রিয়া চোখ উল্টে বলল,
“নিজের রূপের প্রশংসা করেই তো ফুরসত পান না। আবার অন্যের রূপের প্রশংসা করছেন?”

“হ্যাঁ, কারণ আমার রূপের আলোয় তুমিও আলোকিত হয়ে গেছ। সুতরাং তোমার রূপের রহস্য আমার সান্নিধ্য।”

“ওহহ আচ্ছা! প্রশংসা করে ইন্ডাইরেক্টলি সেটাই মনে করাচ্ছেন?”

“কেন নয়!”
অনুভব ভাবের সঙ্গে উত্তর দিল। প্রিয়া হাসি আড়াল করতে বইটা মুখের সামনে ধরল। অনুভব বুঝল পড়া হচ্ছে না। দুষ্টু হেসে বাতি নিভিয়ে দিল বিনাবাক্যে। প্রিয়া হতভম্ব হয়ে বলল,
“এটা কী হলো? আপনার রূপের আলোয় কী এখন পড়াশোনা করব?”

অনুভব দুহাতের বাধনে বেধে গালে টপাটপ কতগুলো সিক্ত চুমু খেয়ে বলল,
“তুমি আমার প্রেমের ক্যাম্পাস। তোমাতেই আমার নিত্য বসবাস। বাকিসব আপাতত হয়ে যাক বোগাস।”

প্রিয়া মুখ ঢেকে হেসে উঠল। আবছা আঁধার চোখ সয়ে এসেছে। দক্ষিণা জানালা গলে দূরবর্তী বিল্ডিংয়ের আলোকছটা উড়ে আসে। সেই ক্ষীণ আলোতে প্রিয়া এক উন্মাদ প্রেমিককে দেখে। যার সুদর্শনতায় সে বিমোহিত, আবেগময় আবেদনে আপ্লুত, ক্লান্তিহীন দায়িত্বশীলতায় কৃতজ্ঞ জনমভর। প্রিয়া মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রবোধ দেয়, এই মানুষটা একান্তই তার! সুখের অশ্রুতে চোখদুটি তার কানায় কানায় পূর্ণ হয়। সব হারিয়ে এমন অমূল্য প্রাপ্তিই বুঝি ছিল তার কপালে!
________________

বিস্ময়করভাবে টুকটুকির আকদের তারিখটা পড়ল দিগন্তের প্লেন ছাড়ার একদিন আগে। এবং সেটা নন্দিনীর হস্তক্ষেপে। সে রিতা আন্টির কাছে অনুরোধ জানিয়েছিল বিয়েটা যেন দিগন্ত যাওয়ার আগেই অ্যারেঞ্জ করা হয়। বিয়ে না হলেও অন্তত আংটিবদলের অনুষ্ঠান হোক। রিতা আন্টি এই চার বন্ধুকে খুবই পছন্দ করেন। নন্দিনীকে মায়া করেন বিশেষ। নন্দিনীর সুই’সা’ইড এটাম্পটের পর যখন হসপিটালে র’ক্তদানের দিন তিনি দেখা করতে গিয়েছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন মনের গোপন ব্যথা, নন্দিনী দুটো বাক্য বলেছিল শুধু। এক,
“আমি তাদের ঘৃণা করি।” যেটা ছিল নিজের পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে। এবং দুই,
“আমি বর্তমানের আছি। অতীতে গিয়ে কী কাজ? আপনার ছেলের বউ তো করবেন না।”

হাস্যরসে বললেও রিতা আন্টি বুঝেছিলেন মেয়েটা উনাকে এড়াতে চাইছে। তাই আর ঘাটেননি। কিন্তু প্রথম বাক্যটি উনাকে নাড়িয়ে দিয়েছে অন্তর থেকে। কিছু মানুষ দগদগে ঘা বুকে নিয়ে অন্যের ঘায়ে প্রলেপ দেয়।
সবদিক বিবেচনা করে রিতা আন্টি ঠিক করেছেন এখন ছোটো করে আকদ করবেন। পরে নিশীথের চাচারা দেশে বেড়াতে এলে সব আত্মীয়স্বজন একত্র করে বড়ো করে অনুষ্ঠান করবেন। আকদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নন্দিনী দুদিন আগেই চলে এসেছে টুকটুকির বাড়ি। ইভেন্ট আয়োজনের অভিজ্ঞতা আছে বলে নিজে থেকেই সাজানোর দায়িত্বটা নিয়েছে। ঝুমঝুমি হয়েছে তার এসিস্ট্যান্ট। তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ টুকটুকিকে স্বস্তি দিল। মেয়েটা আবারো স্বাভাবিক হচ্ছে। কিন্তু তাও যেন সবকিছু পানসে। দিগন্ত গুটিয়ে রেখেছে নিজেকে। নন্দিনী ভুলেও তার প্রসঙ্গ তোলে না। কথাও বলে না। টুকটুকি বোঝাতে চাইলেও এড়িয়ে যায়। আকদ হবে আগামীকাল। দিগন্ত পরশু চলে যাবে। টুকটুকি রাতের বেলা সিক্ত কণ্ঠে অনুরোধ করল,
“হালুম তো চলেই যাবে। তুই তাকে আর মানলি না। আমি এ নিয়ে কিছুই বলব না আর। তোর জীবন, তোর সিদ্ধান্ত। কিন্তু ইকরি, অন্তত বন্ধু হিসেবে তো শেষ সময়টায় স্বাভাবিক আচরণ করতে পারিস। আমাদের বন্ধুত্বের জোর কী এতই নড়বড়ে?”

নন্দিনী কোনো জবাব দিল না। কিন্তু পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সে দিগন্তকে কল করল।

“ওই ফ’ই’ন্নি, কই তুই?”

ঘুমের আলস্য মাখা ভোরে ফোনকলে বহুদিন পর এমন একটা বাক্য শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল দিগন্ত। শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে ঘুমের রেশ কাটাতে চাইল ও। বিরক্ত গলায় বলল,
“মঙ্গল গ্রহে আছি।”

“আরে বাহ! মঙ্গলে এত ভালো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় নাকি? মঙ্গলের বাসিন্দারা তোরে ভিনগ্রহের এলিয়েন ভাইবা বাইন্ধা রাখে নাই এখনো?”

“মঙ্গল গ্রহের এলিয়েনদের প্রেসিডেন্ট আমাকে পছন্দ করেছে। তার মেয়ের জামাই করতে চায়!”

“অতি উত্তম সংবাদ। প্রেসিডেন্টের ছেলেপুলে নাই? থাকলে আমার নাম্বারটা দিয়া আসিস। নেটওয়ার্ক যেহেতু ভালো প্রেমটা হইয়া যাইব। যাইহোক, আপাতত পৃথিবীতে ল্যান্ড করে টুকটুকির বাড়ি আয়।”

“এখন কেন? অনুষ্ঠান তো বিকেলে।”

“তুই কী অতিথি যে অন টাইম আইয়া পোলাও, রোস্ট, রেজালা গিল্লা, একটা ডিনারসেট ধরাইয়া দিয়া যাবি? আর কোনো দায় দায়িত্ব নাই?”

“এত প্যাচিয়ে কথা বলিস কেন? সরাসরি বলা যায় না কী দরকার?”

“মেলা দরকার। তুই এক্ষণ আসবি। আর শোন, গাড়ি নিয়া আয়।”

“কাজের লোক এক আমাকেই পাস দুনিয়াতে? একটা দিনই তো আছি। তাতেও শান্তি দিবি না?” দিগন্তের কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ে।

নন্দিনী পাত্তা দিল না মোটেও,
“শান্তির মায় মই’রা গেছে। ভিনদেশে গিয়া সাদা চামড়ার বিলাই চোখা রূপসীগো কোলে উইঠ্যা শান্তির ফিল নিস।”

দিগন্ত গজগজ করে ফোন কাটলেও খেয়াল করল বিরক্ত তার লাগছে না। অপর্যাপ্ত ঘুমে মাথা ঢুলুঢুলু করলেও শরীরটা হঠাৎ ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ বিষাদের পর এই ভোর তার ভালো লাগছে। সদ্য ফোটা আলোয় চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কেটে যাচ্ছে জরাজীর্ণ মনের সকল ক্লেশ। দিগন্ত বাড়ির সবাইকে ঘুমে রেখেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
__________________

বিয়ে বাড়ির ব্যস্ত সকালে তোফায়েল হক মেয়ের ঘরের দরজায় শব্দ করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। টুকটুকি চিরুনি বুলিয়ে নিচ্ছিল লম্বা, দিঘল কেশরাশিতে। বাবাকে দেখে সে উঠতে গেল। তোফায়েল হক ইশারায় তাকে নিষেধ করলেন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তিনি আয়নায় নিজের কন্যাকে মুগ্ধ চোখে দেখলেন। বোধহয় কিছুটা আপ্লুতও হলেন। মেয়ের হাত থেকে চিরুনি নিয়ে নিজের হাতে চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বললেন,
“জন্মের পর সাত দিনের মাথায় আকিকা দেওয়ার দিন তোর চুল ন্যাড়া করে দিয়েছিলাম। এরপর আর কাউকে চুলে হাত দিতে দেইনি। গরমকালে সবাই তোর মাথা ভর্তি চুল ফেলে দেওয়ার কথা বলত। আমি দিতাম না। তোর চুলে প্রথম যেদিন ঝুটি বেধেছিলাম কি যে খুশি হয়েছিলাম। তখন এমন ক্যামেরাওয়ালা ফোন ছিল না। ছিল তারযুক্ত টেলিফোন। ফটোগ্রাফার ডাকিয়ে ছবি তুলে রেখেছিলাম সেদিনটার। আড়াই বছর বয়সে তোর চুলে প্রথম বিনুনি করেছিলাম। সেদিনের ছবিও আছে। আজ আবার তোর চুলের ছবি তুলব। আর শোন, ইঞ্জিনিয়ারকে বলে দিবি তোর চুলের যত্নে যেন হেলাফেলা না করে। নাহলে কিন্তু তার মাথার চুল আস্ত থাকবে না।”

টুকটুকি হাসে। বাবার মন যখন খুব ভালো এবং খুব খারাপ থাকে তখন বাবা ছোটোবেলার গল্প করেন। ও বলল,
“তোমার মন খুব বেশি খারাপ বাবা?”

“খুব বেশি না। অল্প অল্প। সেটা আমাদের সামাজিক বিয়ে ব্যবস্থার ওপর। কেন সব সময় মেয়েদের পরের বাড়ি পাঠাতে হবে? দুটো মেয়েকে আমি জন্ম থেকে কষ্ট করে, আদর যত্নে মানুষ করলাম তা কি অন্যকে দিয়ে দিতে?”

টুকটুকি আয়না থেকে মুখ ফিরিয়ে বাবার দিকে ফিরল। জড়িয়ে ধরে আর্দ্র কণ্ঠে বলল,
“আমি তো দূরে যাচ্ছি না, বাবা। ওই তো পাশের বাড়িতে। মনে করো এ বাড়িতেই আছি। তোমাদের ছেড়ে দূরে থাকতে পারব না।”

ঝুমঝুমি হুট করে এসে বাবা-বোনকে একসঙ্গে আলিঙ্গন করে বলল,
“আপু তো পাশের বাড়িতে স্যাটেল হয়ে যাচ্ছে। কোনো দেবর টেবরও নেই যে আমিও আশেপাশে স্যাটেল হবো। নেভার মাইন্ড, আমার বরকে ঘর জামাই রাখব। তবুও বাবাকে ছেড়ে যাব না।”

টুকটুকি কটমট করে বলল, “দেখেছ বাবা, তোমার ছোটো মেয়ে কী নি’র্লজ্জ! এখনই নিজের বিয়ের পরিকল্পনা করে ফেলেছে। আবার মুখ ফুটে বলছে!”

তোফায়েল হক হেসে দুই মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেন। পৃথিবীতে কন্যা সন্তানের পিতা-মাতা বোধহয় সবচেয়ে বড়ো আত্মত্যাগী। সারাজীবন আদরে লালন করা মহার্ঘ্য সম্পদটাকেই তারা আরেকজনের হাতে সপে দেন। কিন্তু কতজন পারে সেই মহার্ঘ্য সম্পদের কদর করতে?
_________________

বর্ষণ ও মেঘকুমারীর বৃষ্টিময় প্রেম একটি শুভ পরিণতি পেল সন্ধ্যায়। নিশীথ তার নিকটাত্মীয়দের আপ্যায়নে একটু ব্যস্ত বলে টুকটুকি বন্ধুদের সময় দিচ্ছে। সকলে ছাদে গোল করে বসে আছে৷ সম্পূর্ণ ছাদ লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করেছে নন্দিনী। নবদম্পতির জন্য একটা সুইট ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে এখানটায়। টুকটুকি সেজেছে টুকটুকে লাল বেনারসিতে। রিতা আন্টির দেওয়া পুরোনো ও ভারী গহনার ভাজে দেহ তার ন্যুব্জ। পার্লারের ভারী সাজও মুখশ্রীর মিষ্টতা ঢেকে দিতে পারেনি। তার গা ঘেঁষে বসা নন্দিনী পরেছে লাইট পিচ কালার সিল্ক কাতান। কোকড়ানো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে। সিলভার কালার গহনা জেল্লা দিচ্ছে ত্বকে। নির্মেদ মুখশ্রীতে সপ্রতিভ আভা। পাশে বসা দিগন্ত নিজের দৃষ্টি সংযত করতে ব্যর্থ ও একই সঙ্গে ব্যথিত। নন্দিনী তার সঙ্গে কথা তো বলছে কিন্তু আশানুরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। দিগন্তের হাঁসফাঁস লাগে। প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে। হাতে মাত্র একটা দিন। চব্বিশ ঘন্টা। একটা মিরাকল কি ঘটে যেতে পারে না এর মাঝে?

অনুভব বলল,
“ফাইনালি বিবাহিত সংঘের সদস্য হয়ে গেলা টুকটুকি। আমার দল ভারী করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
তারপর নন্দিনী ও দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“সিঙ্গেল সংঘের হতভাগা দুই সদস্য, বল দেখি জীবন যু’দ্ধে কারা এগিয়ে গেল?”

নন্দিনী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“উল্টা গীত গাও ক্যান মামা? বরং তোমরা বিয়া কইরা জীবনযু’দ্ধে পা দিলা। আমি শান্তি কমিটির সদস্য। তাই যু’দ্ধ নয়, শান্তি চাই।”

টুকটুকি বলল,
“তোর শান্তি কমিটিতে হালুমের জায়গা হবে না?”

নন্দিনী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল,
“একদমই না। ওরে বিদেশ গিয়া আম্রিকানগো কোলে শান্তি খুঁজতে ক।”

দিগন্ত রাগ করে। নিজেকে অসহায় প্রমাণ না করতেই জবাব দেয়,
“আমি যথেষ্ট শান্তিতে আছি। কারো কম্পানি প্রয়োজন নেই৷ তুই তো নিজেই আস্ত যু’দ্ধ।”

“কারেক্ট বেইব। আমার কাছে ঘেঁষবি না। যু’দ্ধের লেলিহান শিখায় পুড়ে যাবি।”

“আমি তো কবেই পুড়ে গেছি। শুধু পোড়া অঙ্গারের উত্তাপ টের পেলি না। পাবি কী করে? তুই তো একটা পাষাণ।”

নন্দিনী সে কথার জবাব দিল না। খোলা গলায় গান ধরল,
“পুরো পৃথিবী এক দিকে আর আমি অন্য দিক
সবাই বলে করছ ভুল আর তোরা বলিস ঠিক
তোরা ছিলি তোরা আছিস জানি তোরাই থাকবি
বন্ধু… বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে… আর কি লাগে?

কিছু কথা যা যায় না বলা কাউকে
কিছু কাজ যা যায় না করা সহজে
কিছু আচরন মানে না কেউ সামনে
কিছু জায়গা যায় না যাওয়া চাইলেই
সবই হয় যদি তোরা থাকিস সেখানে
বন্ধু… বোঝে আমাকে
বন্ধু আছে… আর কি লাগে?”

গান থামিয়ে নন্দিনী দেখল বন্ধুবান্ধব সব চুপচাপ হয়ে আছে। আবেগে আচ্ছাদিত তাদের চোখের মণি। দিগন্তের দিকে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি মেলে নন্দিনী আবার গেয়ে উঠল,
“অতীতের কথাগুলো, পুরনো স্মৃতিগুলো মনে মনে রাইখো
আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাইকো…”

দিগন্ত ফুঁসে উঠল। গানটার অন্তর্নিহিত অর্থ তার গায়ে জ্বালা ধরায় জেনেই নন্দিনী ইচ্ছে করেই ওকে শুনিয়ে শুনিয়ে আনন্দ নেয়। দিগন্ত বসা থেকে উঠে গেল। এরপর আড্ডাটাও জমল না। দুর্বোধ্য নন্দিনীকে আবিষ্কার করার অক্ষমতায়ই বোধহয় সময়টা তাল কেটে যাওয়া সুরের মতো ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে হতে লাগল ক্রমশ। আঁধারের বুকে আলো জ্বেলে বসা বন্ধুদের মুখে খই ফুটল না। উঠে যাওয়ার আগে টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে নন্দিনী বলল,

“জগতে সুখের বড্ড অভাব। এত এত দুঃখী, কমপ্লিকেটেড মানুষের মাঝে কিছু সরল, আপাদমস্তক সুখী মানুষের খুবই প্রয়োজন। তোর মাঝে কখনো বাস্তবতার রূঢ় ছোঁয়া না লাগুক। খুব সুখী হ, টুকি সোনা।”
___________________

স্বল্পালোকিত ছাদে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে বসেছে নবদম্পতি। দুটি চেয়ারযুক্ত গোল টেবিলের দুই প্রান্তে নিশীথ ও টুকটুকি। মাঝে কারুকার্য শোভিত পিতলের মোমদানিতে মিটমিট করে জ্বলছে তিনটি রঙিন অ্যারোম্যাটিক ক্যান্ডেল। মাথার ওপর চন্দ্রালোকিত আকাশ। তারকাগুচ্ছ যেন অভিবাদন জানাচ্ছে তাদের। বাতাসের বহমানতা অতি ধীর বলেই মোমের শিখাগুলো টিকে আছে সদর্পে। আগুনের কমলাটে আলোয় টুকিটুকির মুখখানা প্রজ্জ্বলিত। নজরবিদ্ধ নিশীথ অপলক চেয়ে আছে। খেয়াল করছে সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্ম মুখভঙ্গি। লাজুক টুকটুকি সেই গভীর চোখের সামনে পড়ে খাবি খাওয়া মাছের মতো হয়ে যায়। হাতভর্তি চুড়ির টুংটাং শব্দ তুলে বলে,

“এভাবে কী দেখছ?”

“মেঘবতীকে।”

“মেঘবতী?”

“হু, তোমার আসমানি রাজাকে বলে দিয়ো, মেঘকুমারী বিয়ের পর মেঘবতী হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত মেঘবতী।”

“বলে দেব। আর তুমি কী হলে?”

“তোমার ব্যক্তিগত ইঞ্জিনিয়ার। কোথাও গোলমাল দেখা দিলেই সারিয়ে দেওয়া এখন আমার নৈতিক দায়িত্ব।”

টুকটুকি হেসে ফেলল। ক্ষীণ স্বরের মিষ্টি, লাজুক হাসি। বলে,
“আমাকে কেমন লাগছে বললে না তো?”

নিশীথের নজর থমকায় লাল টকটকে পুরু অধরপল্লবে। আকাশটা ধীরে ধীরে মেঘের আড়ালে নির্বাসিত হতে শুরু করেছে। স্বামীর সান্নিধ্যে বসে, তার শান্ত, শীতল অথচ ধারালো দৃষ্টির কবলে পড়ে টুকটুকির বুকের ভেতর শিরশিরে অনুভূতি ছড়ায়। নিশীথ চেয়ার টেনে কাছাকাছি বসে টুকটুকির হাত ধরল। আঙুল নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,
“রেড চেরিকে আজ রেড ওয়াইন লাগছে। নেশা না চড়ে যায়!”

কানের কাছে ফিসফিস করে বলা শব্দগুলো মস্তিষ্কে প্রভাব বিস্তার করতেই টুকটুকি কেঁপে ওঠে। চোখে চোখ রাখতেই টের পায় মনের আর্জি। সঙ্গে সঙ্গে থুতনি নিচু করে ফেলল ও। নিশীথ তার থুতনি তুলে নেয় আজলায়। অনেকটা সময় নিয়ে একটা লম্বা, সিক্ত চুমু ছোঁয়ায় মেঘবতীর ঠোঁটে। যেন মিটিয়ে নিতে চায় সুদীর্ঘ সময় ধরে পুষে রাখা তীব্র পিপাসা। তপ্ত নিশ্বাসের মিছিল বয়ে যায়। নিশীথ বলে,

“তোমার লাল রঙ ভীষণ উ’ত্য’ক্ত করেছে আমায়। শাস্তিস্বরূপ এখন থেকে শুধু লাল রঙই পরবে তুমি।”

দুজন চমকে উঠল বৃষ্টির ফোঁটার স্পর্শ পেয়ে৷ একটু আগেই যে আকাশ ছিল চন্দ্র তারকাখচিত, এখন সেখানেই বাউণ্ডুলে মেঘেদের বিস্তার। নিশীথ আকাশের দিকে মুখ করে ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলে উঠল,
“চলে এসেছে, আমার সতিন।”

স্বামীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ টুকটুকি খিলখিল করে হেসে ওঠে।
__________________

নন্দিনী আজ টুকটুকির বাড়িতে রাত্রিযাপন করবে। অনুভব ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে গেছে। দিগন্ত গাড়ি নিয়ে বেরোতে গিয়েও থমকে গেল। আকাশ রঙ বদলেছে। শীতল বাতাস জানান দেয় মুষলধারে বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা আছে। এমন সময় একাকি নন্দিনী ঘন আঁধারে হেঁটে চলেছে। দিগন্ত গাড়ি থেকে নেমে গেল। কাছে গিয়ে খেয়াল করল মেয়েটির হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দিগন্ত হুট করে ওর হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিল। আকস্মিক কান্ডে নন্দিনী চমকে পেছন ফিরে তাকায়৷ ওকে আরেকদফা অবাক করে দিয়ে দিগন্ত সিগারেটে টান দিল। খুকখুক করে কেশে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে অবিশ্রান্ত কাশতেই লাগল। একপর্যায়ে চোখে পানিও চলে এলো। নন্দিনী বুকে হাত গুজে নির্দয়ের মতো সবটা দেখল। নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“যা সহ্য হয় না তা করতে যাস কোন দুঃখে?”

দিগন্তের কাশি থেমেছে। চোখ দুটি লাল হয়ে এসেছে। বলল,
“তোর সব সহ্য হয় তাই না?”

“না তো। এই মুহূর্তে তোরে সহ্য হইতাছে না।”

দিগন্ত ক্ষীপ্ত পায়ে নিকটে এসে বলল,
“খুব অসহ্য মানুষ হয়ে গেছি?”
“খুব খুব।”
“আমি কী এতই খারাপ?”
“একটু বেশিই ভালো।”
“তোকে অবহেলা করি?”
“একটু বেশিই যত্ন করিস।”
“তাহলে তোকে চাওয়া আমার অপরাধ ছিল?”
“ভুল ছিল।”
“আমি সেই ভুল বারবার করব।”
“আমি তোর বন্ধু, শুধরে দেব।”

দিগন্ত বাধভাঙা জোয়ারের মতো আছড়ে পড়ে নন্দিনীর গায়ে। দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সময় বয়ে যায়। কারো মুখে কথা ফোটে না, কেউ নড়ে না।দিগন্ত আবেগাচ্ছন্ন কণ্ঠে বলে,
“তুই চাইলে আমি যাব না কোথাও। একবার শুধু বল। আমি থেকে যাব।”

“বোকার মতো কথা বলিস না। এখনই সময় নিজেকে গড়ে নেওয়ার। আবেগের ফাঁদে পা দিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলিস না। পরে সারাজীবন আফসোস করতে হবে।”

“চলে গেলে আফসোস থাকবে না বলছিস?”

নন্দিনী একটু নরম হলো। বলল,
“তুই আমার বন্ধু হালুম। সবচেয়ে ভালো মন তোর। আমি তোর ভালো চাই। ভালো চাই বলেই বলছি এই বাজে মেয়েটাকে চাস না। দিনশেষে শুধু কষ্টই পাবি। আমি যে আমার বন্ধুকে কষ্টে দেখতে চাই না। আমি চাই তুই সুখী হ। সব সুখ তোর হোক।”

“তুই আমার হয়ে যা। আমার চেয়ে সুখী আর কেউ হবে না।”

“তা হয় নারে। বন্ধন আমাকে টানে না। মনের ওপর জোর তো খাটে না। বাস্তবতার ওপরেও না। মিথ্যা আশায় জড়িয়ে তোকে শুধু শুধু কষ্ট দিতে চাই না। তুই এগিয়ে যা হালুম।”

“আর তুই?”

“ইকরি-মিকরি অলওয়েজ বিন্দাস বেইব।”

“সত্যিই গ্রহণ করলি না আমায়! তুই আমার সুখ চাইতে গিয়ে সবচেয়ে বড়ো দুঃখটা দিলি, ইকরি। এমন বিদায় তো চাইনি।”

নন্দিনী দিগন্তের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“এরচেয়ে সুন্দর বিদায় হতে পারে না বন্ধু আমার।”

রাত গভীর হয়, আঁধার ঘন হয়। ওরা মিশে থাকে একে অপরের সঙ্গে। দিগন্ত জ্বালা ধরা টলমলে চোখদুটি প্রিয় ইকরির কাঁধে লুকায়। আর নন্দিনী, তার দৃষ্টি প্রস্তরখন্ডের মতো অন্ধকারে থমকে থাকে। বিদায়ের আগে সেই ছিল তাদের শেষ দেখা।

এরপর! এরপর সিনিয়র সিসিমপুরের চার বন্ধুর আড্ডা আর জমেনি। জাহাঙ্গীরনগরের গাছপালা, পথঘাট, লেকের পাড়, চায়ের স্টল হতে চারজন প্রাণোচ্ছল অতিথি পাখি উড়ে গেল। অনুভব চাকরির পেছনে ছুটে জুতোর তলা ক্ষয় করে দিল, দিগন্ত ভঙ্গুর মন নিয়ে ভিনদেশে পাড়ি জমাল, টুকটুকি ব্যস্ত হয়ে গেল নতুন সংসারে এবং নন্দিনী ট্রাভেল এজেন্সিতে জব নিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেল। তাদের আড্ডামুখর ম্যাসেঞ্জার গ্রুপটা শব্দের অভাবে গুমরে ওঠে, পড়ে থাকে শূন্য। সেখানে অনুভূতির বর্ষণ নামে না। দূরত্বের তীব্র খরার দাপট শুষে নেয় বর্ষণসিক্ত জল। ঝংকার তোলে বিচ্ছেদ বেদনা। তবুও… তবুও কারো কারো মনে একাকি সময়ে হানা দেয় অতীতের সুখস্মৃতি। বোকা, আবেগী টুকটুকি তার বন্ধুদের জন্য কাঁদে। ম্যাসেঞ্জার গ্রুপটাতে স্মৃতিরোমন্থন করে৷ অনুভূতি নিংড়ে লেখে,

“ভালোবাসা ছিল, খুঁনসুটি ছিল,
ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব
তারুণ্য ছোঁয়া প্রাণে জাগেনি
দূরত্বের ভারী শব্দ

বন্ধু বিনা কাটত না প্রহর
এমনই মনের টান
সময়ের স্রোতে আজ তাদের মনে
শুধুই ব্যবধান।”

________________________________
নন্দিনী চরিত্রটাকে কিছুটা ধোয়াশার মাঝে রেখেই শেষ করলাম। যদি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ লিখি তখন তার অতীত জীবনটা তুলে আনব। আর যারা চাইছিলেন নন্দিনী দিগন্তকে সহজেই গ্রহণ করে নেবে তারা ৫১- ক পর্বটা আবারো পড়ে বিবেচনা করবেন। লম্বা একটা উপন্যাস, কোথাও অসঙ্গতি রয়ে গেলে কমেন্টে জানিয়ে দেবেন। ধন্যবাদ।