#শ্রাবণ_ধারায় |২৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
বারিশ বিছানায় চোখ বন্ধ করে মরার মতো সটান হয়ে শুয়ে আছে।পাশেই মাঝারি সাইজের মেক-আপ ব্রাশে ব্লাশঅন লাগিয়ে বারিশের দুইগালে অনবরত ঘষছে চিনি।বারিশের টমেটোর মতো লাল লাল দু’টো গাল দেখে ঠোঁট টিপে মিটিমিটি হাসে সে।বারিশ চিনির হাসি দেখে ক্ষেপে যায়।চট করে উঠে বসে চিনির হাত থেকে ব্রাশটি কেড়ে নেয় সে।আচমকা বারিশ আক্রমণ করায় চিনি প্রথমে ঘাবড়ে যায়।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে অবাক সুরে বলে,
– একি আপনি উঠে পড়লেন কেন?এখনো তো হাইলাইটার বাকি।
বারিশ চোখ মোটা মোটা করে চিনির দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– দেখি কেমন সাজালে।আয়না দেও।
চিনি ডান হাতে তর্জনির নক কামড়ে হাসে।হাসি থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে।পাশ থেকে ছোট আয়নাটি বারিশের মুখের সামনে ধরে।বারিশ দর্পনে প্রতিফলিত নিজের চেহারা দেখে তব্দা মেরে বসে থাকে।এ কি সাজানো হয়েছে তাকে?চোখের উপর সবুজ রঙের চকমকে কিছু একটা দেওয়া হয়েছে যেটাতে সাদা আলো পড়তেই চমকে উঠছে।ঠোঁটে তো আরেক ধাপ এগিয়ে রেখেছে।বেগুনি রঙের লিপস্টিক!মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির জন্য ফাউন্ডেশন ত্বকে ভালোভাবে মিশ্রিত হয়নি।দুইগালে লাল লাল ব্লাশঅন লাগিয়েছে।দেখতে একদম বিদঘুটে লাগছে!বারিশকে নিজে প্রতিবিম্বের দিকে এভাবে থম মেরে তাকিয়ে থাকতে দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল চিনি।ভ্রম কাঁটে বারিশের।রক্তচক্ষু নিয়ে চিনির দিকে তাকায় সে।ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সে।শান্ত কন্ঠে চিনিকে শাসিয়ে বলল,
– হয়েছে না সাজানো?এখন সোজা শুয়ে পড়বে।না হলে..
আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না বারিশের।তার ভারি কন্ঠে শীতল ধমক খেয়ে চিনি শুঁকনো ঢোক গিলে তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে উঠে সব মেক-আপ কিটস ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে কম্বল গায়ে জরিয়ে শুয়ে পড়লো।বারিশ চুপচাপ শান্ত দৃষ্টিতে চিনির দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ।তারপর বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সারামুখ ভালোভাবে ধুয়ে চিনির পাশে এসে শুয়ে পড়লো।চিনি বারবার এপাশ ওপাশ করছে আর খুঁত খুঁত শব্দ করছে।বারিশ একপলক চিনিকে দেখলো।বুঝতে পারলো তার ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে!কিছুদিন যাবৎই এমন হচ্ছে।বাচ্চা যত বড় হচ্ছে ততই রাতে চিনির খুঁত খুঁত বাড়ছে।বারিশ চিনির মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে দিলো। চিনির মুখে হাত দিয়ে বলল,
– কি হয়েছে?পেটে ব্যাথা করছে?
ঘুমে চিনি এতোটাই বিভোর হয়ে আছে যে বারিশের কথার জবাব দিতে পারলো না।তবে সে বারিশের কথাটি শুনতে পেরেছে।হালকা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় পেটে ব্যাথা করছে না।বারিশ মাথা নাড়াতে দেখে আবারও জিজ্ঞেস করল,
– তাহলে কোথায় কষ্ট হচ্ছে?শব্দ করছ কেন?
বিরক্ত হলো ঘুমন্ত চিনি।ঝাড়া দিয়ে বারিশের হাতটা নিজের মুখ থেকে সরিয়ে ঘুমের ঘরে এলোমেলোভাবে বলল,
– উফ্ ঘুমাতে দেন না।বক বক করছেন কেন?
ভ্রু কুঁচকে ফেলে বারিশ।ঠোঁট বাকিয়ে শুয়ে পড়লো চিনির পাশে।কিছুক্ষণ নিষ্পলক অকারণেই চিনির দিকে তাকিয়ে রইলো সে।মুখগুলো ফুলে গিয়েছে।সেই মুখের দিকে তাকিয়েই দীর্ঘ সময় পাড় করে ফেলে বারিশ।চিনি নাক মুখ কুঁচকে আবারও বিরক্তির শব্দ করতেই বারিশ চিনির পেটের দিকে তাকালো।কিছু একটা ভেবে একটি ছোট কুশন চিনির সামান্য পেটের নিচে দিয়ে দিলো।এবার বুঝি সুবিধা হলো চিনির।মুখে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠলো।সে হাসি দেখে মুচকি হেসে চিনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিচু স্বরে নিজে নিজে বলল,
– পাঁচ মাস হয়ে গেল!আরকিছু মাস পরই আমাদের টোনাটুনির সংসারে ছোট্ট একটা পুতুল আসবে।আমি তো সারাদিন পুতুলটার সাথে খেলবো।জানো,আমি ছোটবেলা কখনো পুতুল খেলিনি। আমি তো ছেলে তাই আমি প্লেন নিয়ে খেলতাম আর বলতাম আমি একদিন সত্যি সত্যি প্লেন চালাবো।কিন্তু এবার আমার মেয়ে পুতুলের সাথে আমি অনেক খেলবো।
বারিশ নিজের তর্জনি দিয়ে চিনির সারা মুখ ছুঁয়ে দিলো।সারা মুখের আদলে তর্জনি বিচরণ করতে করতে চোখের সামনে মেলে গেল চিনির সাথে তার বিয়ের দিনগুলোর কথা।
রাণী বারিশের দাদির কথায় বারিশের জন্য ভালো মেয়ে দেখে বারিশকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।সে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রতিদিন ফোন করে জানতে চায় পাত্রী চেয়েছে কিনা!প্রথম প্রথম তেমন গায়েন মাখেনি রাণী।ভেবেছে বয়স্ক মানুষ কিছু দিন পর এমনিতেই ভুলে যাবে তাই ভেবে শুনেও না শোনার ভান করে কাটিয়ে দিয়েছে কিছু দিন।কিন্তু তার ধারণা যে ভুল তা যতদিন গেল ততো স্পষ্ট হলো।বারিশের দাদি বিষয়টি ভুলবার বদলে বিষয়টি নিয়ে আরো বেশি সিরিয়াস হয়ে যায়।রাণীকে প্রতিনিয়ত তাড়া দিতে থাকে বারিশের জন্য মেয়ে দেখার জন্য।অবশেষে বাধ্য হয়ে সবার মন রাখতে রাণী বারিশের জন্য মেয়ে দেখে শুরু করে।অনেক মেয়ে দেখার পর চিনির সন্ধান পায় তারা।বারিশকে চিনির ছবি দেখানো হলে কিছুসময়ের জন্য থমকে যায় বারিশ।বাকরুদ্ধ হয়ে চিনির হাসোজ্জল ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে।মৃদু স্বরে বলে,”চিনি?”
সহসা তার মুখ থেকে বিস্ময় কেটে গিয়ে মুখে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে।সে হাসির কারণ বুঝি সে নিজেও জানে না।মনে মনে ভাবে,”এতোদিন কোনো মেয়ে পছন্দ হয়নি বুঝি একারণেই!শ্রাবণ ধারার মতো আবেগে ভিজিয়ে দিয়ে গেল এ হৃদয়!আরেকটু নাহয় ভেজা যাক!”
রাণী ভেবেছিল এবারও বুঝি পাত্রীকে পছন্দ হবে না বারিশের এবং তার শাশুড়িকে এবারও বারিশের দোহাই দিয়ে বিয়েটা আঁটকে দেওয়া যাবে।তবে এবারও তার ভুল ধারণা ভেঙে বারিশ তার সামনে থাকা কাঁচের টি-টেবিলের উপর চিনির ছবিটি রেখে রাণীর সামনে দাঁড়ায়। রাণী মাত্রই চায়ে চুমুক দিয়ে শ্বাস ছেড়েছে।বারিশকে এভাবে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে মাথা তুলে বারিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কিছু বলবি?
বারিশ টি-টেবিলের উপর রাখা চিনির ছবিটির দিকে দুই ভ্রু ইশারা করে বলল,
– এই মেয়েটির বাবার সাথে কথা বলো।
রাণী চমকে উঠলো।বিমূঢ় মুর্তির মতো কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে নিষ্পলক চেয়ে রইলো টেবিলে থাকা চিনির হাসোজ্জল ছবিটির দিকে। সবকিছু কেমন যেন গোলকধাঁধার মতো পেঁচিয়ে গেল।বারিশ ভ্রু কুঁচকে রাণীর কাঁধ স্পর্শ করে ভারি স্বরে বলল,
– মা?
ঘোর কাটলো রাণীর।ঠোঁটের উপরে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম ডান হাতের তালুতে মুছে নিলো।মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বারিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
– সত্যি? আমি খুব খুশি হয়েছি।অবশেষে তোর কাউকে পছন্দ হলো।মাকে এখনই কল করে বলছি।
বলেই সোফা থেকে উঠে গটগট করে হেঁটে চলে গেল রাণী।রাণীর আচারণে বেশ অবাকই হলো বারিশ। তবে মস্তিষ্ক গভীরের কিছু ধরতে না পেরে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো।বারিশ রাণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে নিজের কাজে অর্থাৎ কোম্পানির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
এরপর আস্তে আস্তে কথা এগিয়ে গেল।চিনি ও বারিশের বিয়ে ঠিক হলো।মনের ভিতর এক অদ্ভুত শান্তি এসে বসবাস শুরু করলো বারিশের।সর্বোক্ষণ মুখে মুচকি হাসি লেগেই রয়েছে।যা কারো মন আরো বিষিয়ে দিলো।
সাদা গাউনে পুতুলের দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীর দিকে টলমল চোখে এগিয়ে এলো বারিশ। হাতে থাকা একগুচ্ছ সাদা গোলাপ এগিয়ে দিলো যুবতীর দিকে।যুবতীও আবেগি দৃষ্টিতে তার চোখে চোখ রেখে ফুলের গুচ্ছটি হাতে নিলো।হাত বাড়িয়ে দিলো বারিশের দিকে।সে কোমল শুভ্র হাতের দিকে তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলল বারিশ। হৃৎপিণ্ডের ওঠানামার গতি এখানে প্রবেশ করার আগেই দ্বিগুণ হয়েছে।এখন চিন্তা একটাই লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে হাতে চলে না আসলেই হলো।বারিশকে হাত দিতে না দেখে চিনি হার হাতের আঙুল নাড়িয়ে ইশারা করে হাতে হাত রাখতে।বারিশ তার রূপার আংটি পরা হাতটি চিনির হাতে রাখল।ধীর পায়ে স্টেজ উঠে চিনির পাশে দাঁড়িয়ে চিনির সকল আত্মীয় স্বজনের সাথে পরিচিত হলো।তারা একে একে এসে তাদের গিফট দিলো এবং বারিশ ও চিনির সাথে কুশল বিনিময় করলো।চিনি সবার সাথে বারিশকে পরিচয় করিয়ে দিলো।বারিশের হাত ধরে ঘরে প্রবেশ করে চিনি।ঘরে কোনো অতিরিক্ত সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ নেই।না আছে কোথাও ফুল!বাসরঘরে ফুল থাকবে সারাঘর ফুলের সুবাসে মোঁ মোঁ করে আর সেই সুবাসে দু’টো হৃদয় শরৎ এর সাদা মেঘের মতো নীল আকাশে ভেসে বেড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই না?কিন্তু কোথাও কোনো ফুলের ছিটেফোঁটাও নেই।তবে পরদিন সকালে চোখ খুলতেই ধাক্কা খায় চিনি।সারাঘর ফুলের গাদাগাদি। সবাই যেন নিজেরে সৌন্দর্য পরিদর্শনে ব্যস্ত। এতো সুন্দর সাজানো ঘরে অগোছালো শুধু সে!বড় বড় চোখে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে সে।পাশ থেকে কেউ তার ভরাট কন্ঠে বলে,
– জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম সকালে তোমাকে স্বাগতম!
চলবে…