#শ্রাবণ_ধারায় |অন্তিম|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
কিছুদিন যাবৎ আমার ফোনে বারবার একটি নম্বর থেকে কল আসে।অপরপাশ থেকে বলা হয় সে মানসিক হাসপাতাল থেকে বলছেন।বুঝতে পারি বারিশ আমার খোঁজ পেয়েছে।আমি জানতাম আমি দেশে ফিরে এলে বারিশ কোনো না কোনোভাবে আমাকে খুঁজে বের করবেই।তাই প্রায় দেড় মাসের মতো আমি দেশের বাহিরে থেকেছি।ধারণা অনুযায়ী দেশে আসার পর বারিশ ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করে নিজের কাছে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতে থাকে।আমার মন বারিশকে এক পলক দেখার জন্য বার বার টানলেও আমি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম।কিন্তু বারিশের সুইসাইড এটেম্পট করার কথা শুনে নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি আমি। ছুটে যাই বারিশকে এক নজর দেখার জন্য।বারিশের মলিন মুখশ্রী দেখে থমকে যাই আমি।সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ছেলেটিকে হাসপাতালের নোংরা বিছানায় দেখে আমার বুক ফেটে কান্না আসে।বারিশের সাথে কথা বলে আমার ওকে কখনো মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হয়নি।তাকে সুস্থ স্বাভাবিক ও শান্ত একটি ছেলে মনে হয়েছে।বারিশের সাথে কথা বলে জানতে পারি এসব রাণী মৃধার কারসাজি। আমি চলে আসার পর বারিশ মানসিকভাবে অনেক বেশি ভেঙে পড়ে।প্রথমে বাচ্চা হারানো তারপর আমার চলে আসার ধাক্কাটা সে সহ্য করতে পারে না।সেই সুযোগে তার অফিসের দখল নিলো ফারিশ আর তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মানসিক হাসপাতালে পাঠালো রাণী।কিছুদিন পর ইশান্ত বারিশকে আমার দেশে আসার খবর দিলে বারিশ স্বাভাবিক হতে শুরু করে।ভ্রম কাঁটার পর নিজেকে মানসিক হাসপাতালে দেখে চমকে ওঠে সে।জিদান বারিশকে মানসিক হাসপাতালে রাখার জন্য বড় অঙ্কের টাকা নিলেও বারিশের হুমকি ধামকি শোনার পর সে বারিশের কথা মতো আমাকে রোজ নিয়ম করে কল করতো।কোনো কিছুতে কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে নিজের আত্মহত্যার অভিনব কৌশল কাজে লাগালো।এবং তাতে কাজও হলো আমি অবশেষে তার সাথে দেখা করতেও গেলাম।
এই নিয়ে আমি চতুর্থ বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা।আর এবার আমি আমার বাচ্চাকে গর্ভে রাখতে সক্ষমও হয়েছি।ডেলিভারির ডেট চলে গিয়েছে আরো দুইদিন আগে এখনও পেইনের কোনো নাম গন্ধ নেই।বারিশ আমাকে বারবার অনুরোধ করছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য সিজারের মাধ্যমে ডেলিভারি করানোর জন্য। কিন্তু আমি তো নাছোড়বান্দা আমি কিছুতেই সিজার করাতে রাজি নই।আমি বারিশকে বুক ফুলিয়ে বলেছি,
– আমার বাচ্চার এখন মুড নেই বের হওয়ার ওকে জোর করে বের করার আপনি কে?আমার বাচ্চার যখন আসতে মন চায়বে তখন এমনিতেই চলে আসবে আপনাকে বলা লাগবে না।
বারিশ হতাশ কন্ঠে আক্ষেপ করে বলল,
– পৃথিবীতে আসার আগের ঘাড় ত্যাড়ামি শুরু করে দিয়েছে। আসলে কি কি শুরু করবে কে জানে।
আমি আমার ফেঁপে ওঠা পেটে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বারিশের দিকে চোখ মোটা করে বললাম,
– একদম ঘাড় ত্যাড়া নয় আমার বাচ্চা।আপনার এতো তাড়া কিসের? ও ওর সময় মতো আসবে।আপনি আপনার কাজ করেন।
বারিশ মুখ বাঁকিয়ে ল্যাপটপ খুলতে খুলতে আমার বলা কথাটিই ব্যাঙ্গ করে বিড়বিড়ালো,”এহ্!ও ওর সময় মতো আসবে।সময় পার হয়ে গেল এখনও আসার নাম নাই।আমার বাচ্চা তোমার মতোই সময়-জ্ঞানহীন হয়েছে।”
আমি কান খাঁড়া করে তার সব কথায় শুনলাম তবে কোনো উত্তর দিলাম না।মন শেষের কথাটির উত্তর দিতে চাইলেও আমি নিজের মুখটি বন্ধ রাখলাম।এখন বারিশকে বেশি না ঘাঁটানোই ভালো।নাহলে দেখা যাবে টেনেটুনে হাসপাতালে নিয়ে সিজার করিয়ে ফেলবে।আর আমার সিজার খুব ভয় করে।পেট কেঁটে ফেলে এটা ভাবলেই আমার আত্মা কেঁপে ওঠে।তাই এটাওটা বলে আমি এখনও বারিশকে আঁটকে রেখেছি।ভাবতে ভাবতে আমি ট্রেডমিলে উঠে হাঁটা শুরু করলাম।এখন সকাল বিকেল আমার এই একটাই কাজ হাঁটা। তবে দুই মিনিটে বেশি আমি হাঁটতে পারিনা।সারা শরীর ভর ছেড়ে দেয়।দু’মিনিট হাঁটার নেমে এলাম ট্রেডমিল থেকে।তাওয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে কাউচে গিয়ে বসলাম।পাশে ছোট্ট গোল টেবিলের উপর রাখা ডালিমের জুসটি কয়েক ঢোক গিলে পাশে তাকালাম। পাশেই বইয়ের বিশাল সমাহার। অসংখ্য গল্পের বই, অর্থনীতি সংক্রান্ত বই,সাইকোলজি সংক্রান্ত বই,সাইন্স ফিকশন, ইসলামিক বইসহ বিভিন্ন ধরনের বইয়ের গাদাগাদি। আমি কিছুক্ষণের জন্য ভাবলাম একটি বই নিয়ে পড়লে কেমন হয়?তারপর চট করেই মনে পড়লো আমার তো ডায়েরি লেখা হয়নি চারপাঁচ দিন।যেমন ভাবনা তেমন কাজ বসে পড়লাম কালোরঙের ডায়েরিটি নিয়ে।এতোদিনে আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘনটা লিপিবদ্ধ করেছি আমি।
সেদিন ফারিশের শর্ত অনুযায়ী রাণী মৃধাকেও অস্ট্রেলিয়া পাঠানো হয়।ফারিশ যখন অস্ট্রেলিয়া যেতে নারাজ তখন বারিশ তার কাছে কারণ জানতে চায়লে সে শর্ত দেয় সে অস্ট্রেলিয়া যাবে তবে তার সাথে তার মাকেও যেতে দিতে হবে।এই কয়েকদিনে ফারিশ অনেক বারই বারিশকে ফোন করে খোঁজ খবর নিয়েছে।তবে রাণী মৃধা একবারের জন্যেও কল করেনি।ফারিশ কল করলেও রাণী মৃধা আমাদের সাথে কখনো কথা বলিনি।ফারিশ বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করতে হাসি দিয়ে বলেছে,
– মা আসলে এতোইটাই লজ্জিত যে তোমাদের সাথে কথা বলতে পারছে না।তোমরা মাকে ক্ষমা করে দাও।
আমরাও অতি স্বাভাবিক স্বরে কথা বলেছি তখন।কিন্তু বুঝতে বাকি ছিলনা রাণী মৃধা তার আক্রোশের জন্য আমাদের সাথে কথা বলতে চায়ছে না।ফারিশ প্রায় ফোন করে আমাদের খোঁজ খবর নেয়।
– চিনি তুমি আবার বসেছো ওখানে?তোমাকে না হাঁটতে বলেছি?একে তো হাসপাতালে যেতে চায়ছো না তার উপর না হেঁটে এভাবে বসে রয়েছ।এমন করলে বাচ্চা সারাজীবন পেটের ভিতরই থেকে যাবে,বুঝেছো?
আচমকা কথা বলায় কেঁপে উঠলো চিনি।কলম থেমে গেল তার।ভুত দেখার মতো বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো বারিশের দিকে।সে লেখায় এতোই মনোযোগী হয়ে ছিল যে আশেপাশে কি হয়ে যাচ্ছে কোনো খেয়াল ছিলনা তার।বারিশ হঠাৎ কথা বলায় চমকে ওঠে সে।চিনিকে ভয় পেতে দেখে বারিশও ভেবাচেকা খেয়ে গেল।দ্রুত পায়ে চিনির কাছে এসে চিনির কাঁধে হাত রাখলো।চিনির কপালে অধরের ছোঁয়া দিয়ে নিচু স্বরে বলল,
– সরি আমি বুঝতে পারিনি তুমি ভয় পাবে।
বারিশ চিনির কাঁধে দু’টি মৃদু চাপড় দিলো।কপাল থেকে বুক অবধি ফুঁ দিলো।চিনি এখনও চোখ বেরিয়ে তাকিয়ে আছে।পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছে সে।বারিশের কপাল সংকুচিত হয়ে এলো।মৃদুস্বরে চিনিকে ডাক দিলো,
– চিনি?
চিনি আরো কিছুক ওভাবেই থমকে থাকলো।অতঃপর কিছু সময় অতিবাহিত হতেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো সে।ঘাবড়ে গেল বরিশ চিনির কাঁধে মৃদু আঘাত করতে করতে বলল,
– কি হয়েছে চিনি?এমন করছ কেন?কি হয়েছে?
মুহুর্তেই চিনি ঘামতে শুরু করলো।সারা শরীর ঘামে ভিজে গেল।শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে চলেছে।সে ছাড়া ছাড়া কিছু শব্দ উচ্চারণ করলো,
– বা..রিশ!হাস..হাস!
আর কিছু বলতে হলো না তাকে।বারিশ বুঝতে পারলো চিনির এমন করার কারণ।সে তৎক্ষনাৎ চিনিকে কোলে তুলে নিলো।বারিশ গৃহকর্মী মিতুকে তাদের সঙ্গে হাসপাতালে আসার জন্য বলল।ইশান্ত গাড়ি বের করে বাড়ির সামনে রাখলো বারিশ সোজা গিয়ে চিনিকে গাড়িতে তুললো।গাড়ি চলতে শুরু করলো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের উদ্দেশে।গাড়ির মধ্যেই আচমকা বারিশের চুল টেনে ধরলো চিনি।ব্যাথা দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
– তোর জন্য সব হয়েছে।তোর জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে আমার।তুই সব নষ্টের মূল।
বারিশ বোকা চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো চিনির দিকে। শুঁকনো ঢোক গিলে পাশে বসা গৃহকর্মী মিতুর দিকে তাকাতেই দেখলো মিতু ঠোঁট টিপে হাসছে।ড্রাইভারের সিটে বসা ইশান্তের দিকে তাকিয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়লো বারিশের।বারিশ থমথমে মুখে চিনির দিকে চেয়ে বলল,
– এমন করে না চিনি এই তো হসপিটালে চলে এসেছি।একটু শান্ত হয়ে বসো।
চিনি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চিৎকার করছে।বারিশের কথায় যেন তার রাগ আরো মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো।বারিশ চুলে আবারও একটি টান দিয়ে কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,
– আমার জায়গায় থাকলে দেখতাম কেমন শান্ত হয়ে বসে থাকতি তুই।
বারিশ আর কোনো কথা বললো না।আড় চোখে মিতু আর ইশান্তকে দেখলো তারা আবার ঠোঁট চেপে হাসছে।তা দেখে বারিশ মুখ ঘুয়ে জালনার বাহিরে দৃষ্টি রাখলো।লক্ষ করলো তাদের গাড়ি যত সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সকল গাছ দোকানপাট সবকিছু ততোই পিছনে সরে সরে যাচ্ছে।ভাবলো সময়ের সাথে সাথে মানুষও এভাবে সরে সরে যায়।আজ ভাগ্যে ঠিক কি লেখা আছে সে জানে না।তবে সে চায় না তার জীবন থেকে আর কেউ সরে যাক!
– এসকিউজ মি.স্যার ইউ কান্ট টেক ইট উইথ ইউ।
শ্বেত বর্ণে পাতলা সোনালি চুলের মেয়েটি ফারিশের হাতের দিকে ইশারা করে কথাটি বলতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল ফারিশ।কালো প্যান্ট শার্ট পরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বলল,
– ইট’স জাস্ট আ সফ্ট ড্রিংকস। নাথিং এল্স!
মেয়েটি কঠোরভাবে প্রতিত্তোর করলো,
– সরি স্যার।ইউ কান্ট টেক ইট উইথ ইউ।ইফ ইউ নিড সফট ড্রিংকস অর এলকোহল দে উইল বি গিভেন টু ইউ ওন দ্য প্লেইন। বাট ইউ কান্ট ব্রিং সফট ড্রিংকস ফ্রম আউট সাইড ইনটু দ্য প্লেইন।প্লিজ পুট ইট ইন দ্য ডাস্টবিন।
ফারিশ ছোট্ট একটি শ্বাস ফেললো।জুসটিতে দেওয়া স্ট্রতে মুখ দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলল শ্বেত বর্ণের মেয়েটির দিকে।ধবধবে ফর্সা শরীরে কালো জিন্স আর শার্ট পরেছে।কাঁধ অবধি সোনালী চুলগুলোর সকলে সমান সাইজে কাঁধে ছড়িয়ে আছে।কপাল জুড়ে সোনালী চুল।ফারিশ মুখ থেকে স্ট্র সরিয়ে বলল,
– হোয়ার আর ইউ ফ্রম?
মেয়ে ফারিশের পিছনে তাকিয়ে দেখলো তার পিছনে বেশ বড় লম্বা সারি।সবাই চেকিং এর জন্য অপেক্ষা করছে।সে ফারিশের করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
– প্লিজ ইউ স্টান্ড ব্যাক আ লিটিল। অল আদারস আর ওয়েটিং ফর চেকিং।
ফারিশ তড়িঘড়ি সরে একপাশে দাঁড়ালো। হাতে থাকা জুসের কাপটি ডাস্টবিনে ফেলে মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।সকলের চেকিং শেষ হতেই ফারিশ বিনয়ের স্বরে আবারও জিজ্ঞেস করল সে কোথা থেকে এসেছে।মেয়ে ইংরেজিতে উত্তর দিলো,
– আ’ম ফ্রম জার্মানি।হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?
– বাংলাদেশ।
– আই সি!
ফারিশ মেয়েটিকে বলল,
– ক্যান উই কানেক্ট ওন উইচ্যাট?
– ইয়া অফকোর্স।
মুচকি হাসে ফারিশ।ফোন বের করে উইচ্যাটে স্ক্যান করে সে।মেয়েটির সাথে আরো কিছুক্ষণ ভালো মন্দ আলাপ করে বেরিয়ে পড়ে ফ্লাইটের উদ্দেশ্যে।প্লেনে উঠতেই বারিশের কল আসে।ফারিশ ফোন রিভিস করতেই অপর পাশ থেকে বারিশ বলল,
– কিরে তুই কি প্লেটে উঠেছিস?
– হ্যাঁ এই মাত্র বসলাম।
– আচ্ছা নামার আগে আমাকে ইনফর্ম করিস।
– আচ্ছা।
ফোন রেখে বাইরে দৃষ্টি ফেলল বারিশ।আজ দু’দিন ধরে অনবরত বৃষ্টি হয়ে চলেছে।এই মুহুর্তে বারিশের কাছে আকাশটিকে সিস কাঁদুনে মনে হচ্ছে। থামার নামই নিচ্ছে না!হঠাৎই সে ভাবলো আচ্ছা এমন বৃষ্টিতে ফ্লাইট যদি আঁটকে যায় তাহলে ফারিশের তো আসতে আরো দেরি হবে।এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে তা তো মনে হয় ফারিশ জানে না।বারিশও বলতে ভুলে গিয়েছে।এখন ফ্লাইট যদি এই পর্যন্ত না আসে তখন?ভাবতে ভাবতেই বারিশ ফোনটি বের করে ফারিশকে আবার কল করল।ফোন বন্ধ পাওয়া গেল।বারিশ বুঝতে পারলো ফারিশ প্লেনে উঠে গিয়েছে।অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে হাতে থাকা কফির কাপটাই ছোট ছোট চুমুক দিলো।কেন যেন তার বৃষ্টি দেখতে খুব শান্তি লাগে।বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছিটে যখন চোখ মুখ স্পর্শ করে তখন মনে হয় তার প্রিয়তমা কোমল ছোঁয়ায় তার হৃদয় শীতল করে যাচ্ছে।এই বর্ষার এক বিকেলেই তো তার প্রিয়তমার সাথে তার দেখা হয়েছিল।তাই আজও বৃষ্টি হলে সে উৎসুক দৃষ্টিতে আকাশ পানে চেয়ে থাকে।কিছু একটা যেন তাকে অকারণেই চেয়ে থাকতে বাধ্য করে।সেদিকে তাকিয়েই দীর্ঘ এক তপ্ত শ্বাস ফেলল বারিশ।বৃষ্টি এখন বেশ অনেকটাই কমে এসেছে।টেবিলের উপর থেকে গাড়ির চাবিটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সে।যাত্রাপথেই ফোন এলো ফারিশের জানালো আকাশ বেশি খারাপ হওয়ায় প্লেইন দেরিতে ফ্লাই করবে এবং মুম্বাই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে তাই তার আসতে দেরি হবে।বারিশ তাকে মুম্বাইয়ে তার থাকার ব্যবস্থা করে রাখবে বলে আশ্বস্ত করল।
ছোট্ট ছেলেটির হাত থেকে বলটি গড়িয়ে চলে গেল মাঝ রাস্তায়।বলটি অনুসরণ করে ছেলেটি পা বাড়াবে বলে ধাতস্থ হলে তার কাঁধে চাপ পড়লো।ছেলেটি ঘাড় তুলে দৃষ্টি উপর করতেই দেখতে পেল তার মা তার দিকে চোখ মোটা করে তাকিয়ে আছে।তাকে তাকাতে দেখেই সে মাথা নেড়ে যাওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা জানালো।ছেলেটি নিচের ঠোঁট বেরিয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো।অপেক্ষা করল কখন বৃষ্টি থামবে এবং সে বলটি তুলবে।চাতক দৃষ্টিতে বলটির দিকে চেয়ে রইলো ছেলেটি।একের পর এক গাড়ি এসে বলটির অবস্থান পরিবর্তন করে দিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে একটি গাড়ির আঘাতে বলটি সোজা বিশাল বড় ড্রেনে গিয়ে পড়লো।ছেলেটি নিজেকে আর আঁটকে রাখতে সক্ষম হলো না।সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ থাকা মায়ের হাতটিকে উপেক্ষা করে দৌড়ে এলো বলটি অনুসরণ করে।ব্যস্ত রাস্তার দিকে ছেলেকে দৌড়ে যেতে দেখে বুক কেঁপে উঠলো হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিহিত যুবতীর।সেও ছেলেকে অনুসরণ করে ছুট লাগালো।পিছন থেকে চিৎকার করে বলল,
– শালীন দাঁড়াও।ছুটে না পড়ে যাবে।
কে শোনে কার কথা ছেলেটি দৌড়ে যাচ্ছে প্রাণপনে।যুবতী পায়ের গতি বাড়িয়ে ছেলেটি হাত টেনে ধরলো। ধমকের সুরে বলল,
– বলেছিনা বাইরে নামবে না।তাও দৌড় দিলে কেন?একটা কথা শোনার প্রয়োজন মনে করো না তাইনা?নিজে ভিজলে আমাকেও ভেজালে।চলো..
হাত টেনে নিজের সাথে নিয়ে যেতে চায়লো যুবতী।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটিও তার হাত টেনে ধরলো করুণ স্বরে বলল,
– আম্মু আমার বল!
– বল আরেকটি কিনে দেওয়া যাবে চলো এখন তুমি।স্কুল ড্রেসটার কি অবস্থা করেছ দেখ তো একবার।
ছেলেটি নিজের গায়ে থাকা সাদা আর নীল রঙের স্কুল ড্রেসটির দিকে তাকালো।নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস শব্দ করলো।সাদা শার্টটির উপর কাঁদা নকশা চোখে পড়ার মতো।যুবতীর সিল্ক শাড়িটিও পানি আর কাঁদায় জুবুথুবু। সে ছেলেকে টানতে টানতে স্কুলের বাইরে করা ছাউনির দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।ছেলেটি পিছন ফিরে করুণ চোখে ড্রেনের দিকে চেয়ে রইলো।সহসা কেউ তার মোটা স্বরে বলল,
– কি হয়েছে?আমার ছেলে ঠোঁট ফুলিয়ে আছে কেন?
পা থামিয়ে দিলো যুবতী।পিছন ফিরে চোখ তুলতেই দেখতে পেল সাদা কালো সুট কোর্টে কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার স্বামী।স্বামীকে দেখে সে মুখ গোমড়া করে ড্রেনের দিকে ইশারা করে বলল,
– বারিশ দেখুন না ওর বলটা ড্রেনে পড়ে গিয়েছে।ওর আমাকেও ভিজতে হলো।এতো বেশি জেদি হয়েছে।বললাম নিচে নেমো না কিন্তু শুনলো না।
বারিশ চিনির ইশারায় ড্রেনের দিকে একপলক দেখলো।ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মুখ ফুলিয়ে মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে।বারিশ ছেলের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো ছেলের নাকে স্পর্শ করে আদুরে স্বরে বলল,
– আইসক্রিম খাবে?
চট করে উত্তর দিলো ছেলে,
– আম্মুকে দিবো না।
ভ্রু উঁচিয়ে চিনির দিকে তাকায় বারিশ।ঠোঁটে মৃদু হাসি।চিনি চোখ বড় বড় করে বলল,
– কিহ্?আচ্ছা?নয় মাস পেটে রাখলাম আমি আর বের হলো আপনার কার্বন কপি এখন আবার আমাকে শত্রুপক্ষ ঘোষণা করা হচ্ছে?দাঁড়াও বাড়িতে চলো দু’জনেই খবর আছে।
বারিশ হাসলো চিনির কথায়।ছেলেকে কাঁধে ওঠার জন্য ইশারা করলো।সঙ্গে সঙ্গে কালবিলম্ব না করে বাবার কাঁধে ভর ছেড়ে দিলো শালীন।বারিশ ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে রইলো সামনে দিকে।বাবার পিঠে ছেলেকে দুষ্টুমি করতে দেখে স্মৃতির খাতা খুলে গেল চিনির।সেও একসময় এমনভাবে বারিশের পিঠে চড়ে বারিশের সাথে অনেক দুষ্টুমি করেছে।মুচকি হাসলো চিনি মনে মনে ভাবলো,”নাহ্ ছেলেটি একেবারে তার বাবার মতো হয়নি।কিছু কিছু মিল তার সাথেও আছে।”ভাবতেই হাসি প্রশস্ত হলো তার।বারিশ এক হাতে ছেলেকে আগলে অন্য হাত বাড়িয়ে দিলো নিজের অর্ধাঙ্গিনীর দিকে।সে হাতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি জল এসে ভিড় জমলো।তাদেরকে পিষে দিয়ে সে হাতে হাত রাখলো চিনি।শাড়ি আঁচল দিয়ে ছেলের মাথা ঢাকতে চেষ্টা করলো বারংবার তবে ছেলে তা মাথায় স্থানী হতে দিলো না।মুখ দিয়ে বিরক্তির শব্দ উচ্চারণ করে আঁচল সরিয়ে দিতে থাকলো।বারিশ স্নিগ্ধ স্বরে বলল,
– থাক না।একটু ভিজি!
~সমাপ্ত