#সংসারের_খুঁটিনাটি (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
আমি আচারটা একদিন পর নিয়ে ফ্রীজে রেখে দিলাম। সেটা দেখে আমার ছোট জা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি এটা খাবো না। তাই আচার নিয়ে শাশুড়ীর কাছে চলে গেল বিচার দিতে। ছোট জা শাশুড়ীকে আচারের বৈয়ম দেখিয়ে বলে,“আমি কী দোষ করছি মা? আমার দেওয়া আচার ভাবী খায় নাই। সে খায় না। এটা কেন? আমার দোষ কী?”
শাশুড়ী মা এই কথা শুনে আমাকে ডাক দিলো। আমি সেখানে গেলে আমার জা চুপ হয়ে যায়। শাশুড়ী মা আমাকে জিজ্ঞেস করে,“তুমি আচার খাও নাই কেন? এটা ফ্রীজে রাখছো কেন?”
”কিভাবে খাবো? ওনি তো আমাদের নিয়ে আসা জিনিস খায় না। আমাদের খাবারে যখন এত দোষ তখন তাদের খাবার খাবো কেন?”
এই কথা শুনে ছোট জা রাগ নিয়ে বসে থাকলো। শাশুড়ী মা বললো,“সে কি খায় নাই? তুমি এসব নাটক কেন করো? এত গন্ধ তার গা দিয়ে আসে যে খাবার খাওয়া যায় না।”
“আপনি শুধু আমাদেরটা দেখলেন সে যে আমাদের কলা পঁচিয়ে ফেলে দিছে তাও খায় নাই। তা দেখলেন না।”
আমিও জবাব দিয়ে দিলাম। আমার শাশুড়ী যে এতে বিরক্ত তা আমি বুঝলাম। তাও আমার অবাধ্য মুখ কথা বলে ফেলে। এতদিন চুপ থাকলেও এখন চেয়ে কেন জানি পারছি না। আমার এই কথা শুনে শাশুড়ী ছোট জাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে,“কলা এমনি খাইনি। সবসময় কি খাওয়ার রুচি এক থাকে? কখনো ভালো লাগে, কখনো লাগে না। তাছাড়া ড্রামের উপর রাখছি মনে ছিলো না। এজন্য ওনি আচার খাবে না। এটা কোন অজুহাত হলো? সবসময় সবার রুচি এক থাকে।”
তার এসব কথা শুনে শাশুড়ী মা আমার উপর রাগ করলেন। রাগ নিয়েই বললেন,“তুমি ওনার সাথে সবসময় রেসারেসি করো কেন? এই ছিলো আমাদের ঘরে।ছোট ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ভুল করছি? এত হিংসা।”
“আপনি শুধু আমারটাই দেখেন আম্মু। তারটা দেখেন না।”
আমার এই কথায় শাশুড়ী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। তার কথা,“সে কি করে যে তারটা দেখবো? তুমি আমাকে কি দেখতে বলো? কলা রাখছিলো মনে নাই। এতে দোষ হয়ে গেছে।”
আমি কথা না বাড়িয়ে চলে আসি। শাশুড়ীর সাথে ছোট জাও তাল মিলিয়ে কথা বলে। সে বলে,“ভাইয়া সবজি নিয়ে আসে সেটা আমি খাই না। রান্না হলে তো সবজি আমিই বেশি খাই। সে তো খায় মাছ মাংশ বেশি। এখন কলাটা খাই নাই সেটা দোষ হয়ে গেল।”
এই কথা পাশের ঘর থেকে শুনে আমার যা রাগ হয়েছে। এরপরও সবাই বলবে হিংসা আমি করি। সে আমার ছোট জা। সে আমার খাওয়া নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু আমার শাশুড়ী কিছুই বলছে না। তবে এরমাঝে আমার শাশুড়ী বলে উঠলো,“চুপ করো। এটা স্বামীর বাড়ি। এখানে একটু মানাইয়া গুছাইয়া চলা লাগবে।”
শাশুড়ীর এই কথার জবাবে ছোট জা বললো,“আমার স্বামী বাড়ি তারও স্বামীর বাড়ি। সেও এটা জানো মনে রাখে।”
এই একই কথা আমি বললে হতাম ‘বেয়াদব’। অথচ যা জা বলায় কিছুই হলো না। এই সংসারে এতদিন থেকে আমি এতটুকু বুঝেছি আমি যে হিংসা করি সেটা নয়। আমার ছোট জা আমাকে আরও বেশি হিংসা করে। আমি নাহয় শাশুড়ী এই দুইজনের উপর ভিন্নরকম ব্যবহারে হিংসা করছি। তো সে কেন করছে? এখানে কার অপরাধ বেশি? সেদিন সেই তুলকালাম সেখানেই থামেনি। আমার ছোট জা শ্বশুড়মশাই আসতে তাকেও এই ঘটনা জানালো। এটা শুনে শ্বশুড়মশাই আমাকে ডেকে বললো,“আমার ঘরে থাকলে এভাবে একজনের জিনিস অন্যজন খাবে না। এভাবে চলবে না। দুইজনে মিলেমিশে থাকতে পারলা থাকবা নয়তো যে যার পথ দেখো।”
আমার শ্বশুড়মশাইয়ের কথায় বোধহয় ছোট জা সন্তুষ্ট হতে পারলো না। সে চট করে বলে উঠলো,“আমি কী করছি? আমার দোষ কোথায় বাবা? সবসময় সবার মন রুচি এক থাকে। আমি কী সংসারে কোন ঝামেলা করি। তাহলে আপনি দুইজনকে বলেন কেন? আমি তো তার সাথে মিলেমিশেই থাকতে চাই।”
“তোমরা দুইজনেই বউ। আমি যা বলবো দুইজনকেই বলবো। একজন তো একা একা মিলতে পারবে না।”
এই ঘটনা এভাবেই শ্বশুড়ের কথার মাধ্যমে শেষ হলো। তবে এসবে যে আমাদের মাঝের ঝামেলা শেষ হয়ে গেছে এমনটা নয়। আমাদের ঝামেলা শেষ হয়নি বরং আরও বেড়ে গেছে। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম, এরপর থেকে আমি সকালে আলু ভর্তা বানালে আমার জা খায় না। আমি কাঠাল ভাঙলে সেদিন খায় না৷ তবে এসব সবসময় কেন জানি না শাশুড়ীর আড়ালেই হয়। আর আমার চোখটা বড্ড খারাপ। এসব আমার চোখেই পড়ে। শুধু তাই, কানটা আরও বেশি খারাপ। সবসময় দোষের কথাগুলো শুনে।
যাই হোক, সে আমার হাতের কোন জিনিস খাচ্ছে না। সে আমার ছোট জা। এসব দেখার পর রাগ, কষ্ট, হিংসা কার না হবে? আমিও তার হাতের খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তার করা আলু ভর্তা আমি খাচ্ছি না সেটা গিয়ে শাশুড়ীর চোখের সামনেই পড়লো। শুরু হলো আরও ঝামেলা। শাশুড়ীর কথা,“বিয়ের আগে দেখি বলছিলা দুই জা বোনের মতো থাকবা। এখন এত গন্ধ আসে। আসলে তুমি এসব যে কেন করছো?”
“আপনি শুধু আমারটাই দেখেন।”
আমার এই কথার জবাবে শাশুড়ী মা রেগেমেগে বলেন,“আমি শুধু তোমারটা কি দেখি? সে কি করে যে দেখবো? কথায় কথায় একটা কথা পাইছো? আমি তো তারে কখনো তোমার হাতের খাবার না খাইতে দেখিনি। কিন্তু তুমি তো করতাছো এসব ঢঙ। আমার ঘরে থাকতে হলে এসব ঢঙ করা যাবে না।”
“হয় সব ঢঙ আমি করি। বাকি সবাই তো শুধু দেখে। সেও তো আমার হাতের জিনিস খায় না। এটা আপনার চোখে পড়ে না।”
আমিও মুখে মুখে জবাব দিয়ে দিলাম। শাশুড়ী মা জবাবে বললো,“না। কই আমি তো দেখি না তারে না খাইতে। সব নাটক তো তোমারই দেখি। সেই সাথে বেশি বাড়ছো। ছোট ছেলের বিয়ে করাতে পারলাম না এর মাঝে তোমার রূপ বের হতে শুরু করেছে। নতুন নতুন রূপ।”
আমার শাশুড়ী মা এসব বলে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো। শ্বশুড়মশাই সেদিন বাড়িতেই ছিলো। সে এসে জিজ্ঞেস করে,“কী হয়েছে?”
“আমার ঘরে এই ছিলো। সংসারে এত অশান্তি। একজনের ছায়া আর একজন দেখতে পারে না।”
এই কথা বলে শাশুড়ী মা একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলে,“ছোট বউ আলু ভর্তা বানাইছে এখন সে খাবে না। সে শুধু মরিচ দিয়ে ভাত খাচ্ছে। জা জা ছায়াও দেখতে পারে না। এতই রেসারেসি।”
“তোমরা এগুলো কি শুরু করছো? ঘরের মধ্যে এত অশান্তি করো কেন? একসাথে থাকতে গেলে অনেক মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। এভাবে এত জেদ, হিংসা ভালো না।”
শ্বশুড়মশাই এই কথা বললে আমিও জবাবে দুইটা ঘটনা বললাম। যেখানে আমাকে আমার ছোট জা অপমান করে কথা বলছে। সেইখানে আমার শাশুড়ী থাকায় আমি চুপ ছিলাম। কিন্তু শাশুড়ী কোন জবাব দেয় নাই। এই কথা শুনে শ্বশুড় বলে,“কথা যে দুইটা বলছো দুইটাই ছোট বউ রং বলছে। কিন্তু তুমি তো বড়। তো তুমি এটা ঐসময় বুঝিয়ে বলবে না যে সে এতবড় কথা কিভাবে বলে? তোমার তো উচিত ছিলো বলার। বড় তুমি।সে ভুল করলে বলার সম্পূর্ণ অধিকার ছিলো।”
“আমি কেন বলবো, সেখানে তো আম্মু ছিলো।”
এই কথা শুনে শাশুড়ী মা বলে,“এই বড় বউ শুধু আমারে দোষ দেয়। আমি কী করবো? পড়ছি মহাঝামেলায়। সে নতুন বউ তারে আমি বছর না ঘুরতে কী বলবো? তাছাড়া রেসারেসি তো তুমিই বেশি করো। এমন করলে তোমার কান্ড দেখে সে শিখবে না? সে তো একই কান্ড করবে।”
“ওহ আমি কান্ড করি?”
আমাদের এসব কথার মাঝে আমার স্বামীও চলে আসে। তার কাছে আমি সবসময় সব ঘটনাই বলি। সে এতদিন চুপ থাকলেও আজ থাকে না। সে এবার আমার হয়ে কথা বলে। এসবের মাঝে সবার মধ্যে ঝামেলা বেধে যায়। বিশেষ করে আমার স্বামী সব কথা আমার শাশুড়ীকে বলছিলো। সে এখানে একটি শব্দও ছোট জায়ের জন্য ব্যবহার করেনি। বড় ভাই হিসাবে উচিতও নয়। তবে এখানে তার কথা বলা ঠিক হলো না। এখানেও আমাদের মস্তবড় দোষ হয়ে যাবে। এসবের মাঝে শ্বশুড় ঝামেলা শেষ করতে বলে,“যার যার পথ সে সে দেখো। আমার ঘরে কোন অশান্তি হবে না। অশান্তি করতে মন চাইলে তা এই ঘর থেকে বের হয়ে। ঘরে চাল আছে ডাল আছে। এসব নিয়ে আলাদা হয়ে যাও। এসব পথ দেখো। এভাবে এক ঘরে থেকে, এর হাতের জিনিস ও খাবে না। ওর হাতের জিনিস ও খাবে না। এসব চলবে না।”
আমার স্বামীও রাগের মাথায় বলে,“হ্যাঁ যাবো। থাকেন ছোট ছেলে এবং বউ নিয়ে।”
এই কথার জবাবে শ্বশুড় বলেন,“কাউকে ঘরে রাখবো না। যার যার পথ সে সে দেখবে। আমার দুই স্বামী, স্ত্রী আমাদেরটা বুঝে নিবো। যখন এতই ঝামেলা তখন কারো এক ঘরে থাকা হবে না। সবাই আলাদা আলাদা থাকুক।”
এভাবেই ছোট ছোট ঝামেলা দীর্ঘ হয়ে যায়। আমার শ্বশুড় শাশুড়ীর কাছে আমরা অপ্রিয় হয়ে যাই। আসলে বাচ্চার জন্য শাশুড়ীর সাথে গল্প করতে পারি না। কিন্তু ছোট জা সেটা করে। শুধু তাই নয় সে শাশুড়ীর অতীতের সংসারের কষ্টের গল্প শুনে তাল মেলায়। এভাবেই সে শাশুড়ী মায়ের দুঃখ বোঝার নামে তার মন জয় করে নেয়। এখানে অবশ্য আমারও দোষ আছে। আমিই পারিনি এই জায়গাটা তৈরি করতে। তাই তো শাশুড়ী তার কোন দোষ খুঁজে পায় না। আর যে শাশুড়ীর কাছে ভালো হবে সে অটোমেটিক শ্বশুড়ের কাছে ভালো হবে। তাছাড়া ছোট জায়ের ভাষ্যমতে, সে আমার হাতের জিনিস খায় না। কারণ আমি খুব নোংরা। আমি বাবুদের পটি পরিস্কার করি হাত দিয়ে। এই সেই নানা কারণ দেখিয়ে সে সবসময় তার দোষটা কাটিয়ে নেয়। যেটা আমি পারি না। এখানেই এই সংসারের শত্রু হয়ে উঠলাম আমি।
’
’
চলবে,