সংসারের খুঁটিনাটি পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
2

#সংসারের_খুঁটিনাটি (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমি হয়ে উঠলাম এই সংসারের চরম শত্রু। আমার স্বামী এতদিন আমার হয়ে কোন কথা বলেনি এখন বলছে কেন? আমি তাকে তাবিজ করছি। আমি কুটনি, সব কথা আমার স্বামীর কানে লাগাই। এসব কথা নিয়ে প্রতিদিন শাশুড়ী জায়ের মাঝে আলাপ হয়।

আমিও জানি না আমার স্বামী এখন আমার হয়ে কথা কেন বলছে? আগে যদি কখনো সমস্যা বলতাম তবে সে বলতো,“মানিয়ে নাও। সব কথা কানে নিতে নাই।”

এখন সে আমার হয়ে কথা বলছে। হয়তো নিজের ছোট ভাইয়ের বউয়ের কথা দ্বারা বড় আমিকে অপমানিত হতে দেখতে সে পছন্দ করছে না। তাই কথা বলছে। যাই হোক এত আলোচনা সমালোচনার মাঝে আমিও কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। সব দোষ যে তাদের তা নয়। আমারও অনেক দোষ রয়েছে। সংসারে চলতে গেলে পুরোপুরি সাবানা হয়ে তার মতো নিজেকে উজাড় করে দেওয়া যায় না। সত্যি বলতে বাস্তব জীবনে হয় না। আমিও তাই পারছি না ভালো হতে। তবে শাশুড়ীর ভাষ্যমতে আমি হিংসুটে কথাটি সঠিক নয়। আমার জাও হিংসুটে। সেও আমাকে হিংসা করছে। আমাকে নিজের শত্রু ভাবছে। এই শত্রুতা তাকে দিয়ে কি কি করাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করতে আমার সময় লেগে গেছে।

প্রায়ই শুনতাম, ধানের বস্তা থেকে ধান কমে যাচ্ছে। চাল পুকুরে পাওয়া যাচ্ছে। আমার শাশুড়ী এসব নিয়ে বকাবকি করতো। তখন আমার ছোট জা খুব কৌশলে বলে দিতো,“চাল তো আজ ভাবী ধুয়েছে। সেই নিশ্চয় ফালাইছে।”
আর ধানের কথা উঠলে খুব শান্তভাবে বলতো,“ধান তো মনে হয় ভাবী তার হাস মুরগীকে দিয়েছে।”

আমি যদিও এসব জানতাম না। আড়ালে বলতো আমার নামে। আমার শাশুড়ীও এসব বিশ্বাস করে আমার উপর রুষ্ট হতে শুরু করতেন। আগে যে শাশুড়ী আমাকে কথা শুনালেও ভাত খাবার সময় ঠিকই আমাকে ডাকতো খেতে। সে এখন আমাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছে না। একটা সময় ছিলো, যখন আমার ভুল পেলে আমার শাশুড়ী বকতো। ভুল যতই থাক বকেছে তো শাশুড়ী, তাই কষ্ট পেতাম। এটা নিয়ে কষ্ট পেয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকার পর যখন শাশুড়ী খাবার খাওয়ার সময় আমাকে আদর করে ডাকতো তখন আমার কষ্ট নিমিষেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু সেই শাশুড়ী আজ আমাকে খাবার খাওয়ার সময় ডাকে না। একেবারে ডাকে না তা নয়। ডাকে কিন্তু দ্বায়সারা ভাবে। যেই বিষয়টা আমার চোখে পড়ে।

এসব মন খারাপের মাঝেই সময় কেটে যাচ্ছে। বাচ্চা বড় হচ্ছে। আমাদের সংসারের ঝামেলাও বাড়ছে। একদিন আমি দেখলাম, আমি যেদিন ভাত রান্নার জন্য চাল ধুই সেদিন আমার ছোট জা হাতে করে এক মুঠে চাল নিয়ে খাটপাড়ে ফেলে দেয়। আমি এটা দেখে প্রথমে বুঝতে না পেরে বললাম,“মাছ তো চাল খায় না। তাদের ভাত দিতে হয়।”

তবে এই কথা বলার পরক্ষণে আমি সমস্ত বিষয়টি বুঝতে পারলাম। আমার মনে পড়লো শাশুড়ী মা খাটে চাল পেয়ে বকাবকি করে। এই ছিলো তার মনে। এসব ঘটনা আমার চোখেই পড়ে। আমার শাশুড়ী এসব দেখে না। এসব বুঝতে পেরে আমিও রেগেমেগে একদিন তারই পদ্ধতি এপ্লাই করি। সে যেদিন কাজ করে সেদিন তার কাজে খুঁত পাওয়া যায় তেমন কাজ করি। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আমার ছোট জায়ের কাজে ভুল পেলে শাশুড়ী মা বকাবকি না করে বরং সুন্দরমতো কাজটা ঠিক করে নেয়।

এরপরও মানুষ বলবে, সংসারে ঝামেলা হয় কেন? ঠিকমতো খাবার পাও, জামা-কাপড় পাও। কিন্তু মানুষ এটা বুঝতে পারে না, সংসারে শুধু এসব পাওয়ার আশায় একজন মেয়ে বউ হয়ে আসে না। দিনশেষে তার মানসিক শান্তিও দরকার হয়। এভাবেই দিনের পর দিন ছোট জা আমাকে কেস খাওয়াচ্ছিলো। একটা সময় শ্বশুড়ও আমাকে খারাপ ভাবতে শুরু করে। সে একদিন খাবার সময় বলে,“তোমরা চাও কি? আমি ঘরটা জ্বালিয়ে দিয়ে বের হয়ে যাই। তোমরা সেই শুরু থেকে জায়ে জায়ে ঝামেলা করেই যাচ্ছো।”

এই কথার জবাবে ছোট জা সুন্দরমতো বলে,“আমি তো কোন ঝামেলা করিনি। আমাকে ভাবী সহ্য করতে পারছে না। এটা কী আমার দোষ?”
এভাবে সেদিন আমার নামে আবার বিচার হলো। এবার শ্বশুড়ও সরাসরি আমাকে দোষ দেয়। কোনরকম খাবার খেয়ে উঠে যাই। আসলে মুখ দিয়ে খাবার নামছিলো না। বহু কষ্টে গিলেছি। ঘরে এসে স্বামীকে সব বলে। বললাম,”অল্প ঝামেলা থাকতেই আমরা আলাদা হয়ে যাই। এরপর দেখা যাবে মারামারি বাধবে। তারচেয়ে এত ঝামেলা না নিয়ে নুন ভাত যা জুটে সেটা দিয়ে আলাদা হয়ে যাই।”

আমার স্বামীও রাজি হলো। সে আমাকে পরবর্তী দিন বাবার বাড়ি যেতে পরলো। একসাথে যে বাসা ভাড়া পেলে নিয়ে আসবে। এই ঘরে এত ঝামেলায় মূলত আর রাখতে চাচ্ছে না। পরবর্তী দিন সকালে আমি আমার শাশুড়ীকে জানালাম,“আম্মু আমি আজ বিকালে বাবার বাড়ি যাবো। তারপর এসে আমরা আলাদা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিছি।”
এই কথা শুনে শাশুড়ী মা খুশি হলেন না। যতই মুখে আলাদা হতে বলুক আমার স্বামী তো তারই সন্তান। তাছাড়া আমার ছেলেকে শাশুড়ী, শ্বশুড় খুব ভালোবাসে। আমি এজন্যই এতদিন আলাদা হতে চাইনি।দূরে গেলে আমার ছেলেটা তাদের আদর পাবে না। কিন্তু এত ঝামেলায় মানসিক শান্তি পাচ্ছি না মোটেই। তাই আমাদের চলে যাওয়াই ঠিক। এই কথা শুনে আমার শাশুড়ী মনের দুঃখে হোক বা রাগে সে বলে,“যাও যাও। আমার ছেলেটাকে তো কেড়েই নিছো। তার কানে বিঁষ ঢালছো। এখন তো যাবাই। গেলে যাও। আজ থেকে নাতি জানো আমাদের ঘরে না আয়। যাবাই তো তাহলে নাতি পুতির এত মায়া করে কি হবে?”
এভাবে বিলাপ বকতে শুরু করে দিলো। হয়তো আমার শাশুড়ী এবার আমার চোখমুখ দেখে বুঝতে পেরেছে আমরা সত্যি এবার আলাদা হবো। আর এটা মুখের কথা নয়। তবে যেহেতু আলাদাই হবো তাই শাশুড়ীকে কিছু কথা বললাম,“আমরা তো চলে যাচ্ছি আপনারা ভালো থাকবেন। আপনার ভালো বউ কত ভালো সেটাও দেইখেন। সেই সময় তো আর আমাকে দোষ দিতে পাবেন না। তাই আজ বলে গেলাম।”

এভাবে শুরু করে শাশুড়ীর কিছু ভুল তাকে ধরিয়ে দিলাম। শাশুড়ী মা এসব মানতে নারাজ। উল্টো রাগ নিয়ে বলে,“আমি দুইচোখে দেখি? যাবা যাবা। তাই বলে আমারে দোষ দিয়ে যাবা কেন? আমি কী করছি?”

আমি কথা বাড়ালাম না। আমি বিশ্বাস করি, আজ নাহলেও কাল বা কোন একদিন ঠিকই আমার শাশুড়ী আমাদের মর্ম বুঝবে। যাই হোক সেদিন বিকালে বাবার বাড়ি চলে আসলাম। তার সাতদিন পর বাড়ি এসে আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে পাশেই একজনের বিল্ডিং এ এক রুম ভাড়া নিয়েছে তাতে উঠছি। সবাইকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলাম। শাশুড়ীর কাছে যখন বিদায় জানাতে যাই। তখন সে বলে,“হইছে ঢঙ করা লাগবে না। আমার ছেলেকে নিয়ে তো যাচ্ছোই। আমাদের কথা ভাবছো জীবনে? এখন ঢঙ করে যাওয়ার জন্য অনুমতি নেওয়া লাগবে না।”

এই কথা বলে শাশুড়ী মা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। আমি সেদিন শাশুড়ীকে কথা দিয়েছিলাম, জীবনে যাই হয়ে যাক তাদের আমরা দেখবো। কিন্তু শাশুড়ী এসব কথার জবাব দেয় না। অতঃপর শুরু হলো ভাড়া বাসায় আমাদের ছোট্ট সংসার। মাস শেষে একটা টাকা শ্বশুড়, শাশুড়ীকে জামাই পাঠাতো। কিন্তু তারা নিতে চাইতো না। জোর করেই সে দিয়ে আসতো। তার বাবা, মা তার টাকার উপর অধিকার আছে। কিন্তু শাশুড়ী মা রাগ করে আমাদের টাকা নিতে চান না। তার মতে আমি তার ছেলেকে কেড়ে নিছি, আমিই তার ইনকাম খাই একা।

এভাবেই চলছিলো। তবে শ্বশুড়, শাশুড়ী মুখে ভালোবাসি না বললেও বিকালে আমাদের দেখতে ঠিকই আসতো। আমাদের বললে ভুল হবে আমার ছেলেকে। আগেই বললাম না, তারা নাতিকে খুব ভালোবাসি। ঘরে যা ভালো জিনিসই রান্না হোক না কেন সেটা নাতির জন্য নিয়ে আসতো। এই নিয়ে অবশ্য ছোট জায়ের সাথে বাজতো। আমার শাশুড়ী ছোট জাকে বকে পার পেতো না। ছোট জাও মুখে মুখে অনেক কথা বলতো। যেহেতু পাশাপাশি থাকতাম, তাই সব খবর কানে আসতো।

আমার শাশুড়ীর সাথে ছোট জায়ের এখন প্রায়ই ঝগড়া হয়। এসব নিতে না পেরে আমার শ্বশুড়, শাশুড়ী দেবরকে ফোন দিয়ে তার কাছে ঢাকা নিয়ে যেতে বলে বউ। দেবর নিতে না চাইলেও একটা সময় শাশুড়ী জোর করে ঢাকা পাঠিয়ে দেয় বউ। এমনটাই যে ছোট জা মনেমনে চাইছিলো তা বুঝি আমি। আসলে আমি চলে আসছি, তার প্রতিদ্বন্দ্বী নাই। একা কাজ করে কাটাতে হচ্ছে। স্বামীও নেই বাড়ি। তাই সে এই প্লান করেছে। আমি সবই বুঝি। এভাবেই আমাদের একটি যৌথ পরিবার ভেঙে তিনটি সংসার হয়েছে। এই আলাদা সংসার গুলোই মনে হয় ভালো। যে যার মতো ভালো তো আছি। আমার শ্বশুড় শাশুড়ীও এখন প্রায় সময় আমাদের এখানে এসে নাতির সাথে সময় কাটিয়ে যায়। আমাদের বাড়িতে ছোট করে ঘর উঠানোর পরামর্শ দেয়।

পরিশেষে, এরকম পরিস্থিতিতে পরে সবাই হয়তো আলাদা হয়ে যায়। যারা আলাদা হয়ে যায় তারাই ভালো থাকে। কিন্তু যারা একসাথে থাকে তাদের সারাজীবন এরকম সংসারে খুঁটিনাটি সমস্যা লেগেই থাকে। আসলে একসাথে সবাই ভালো থাকতে পারে না। চাইলেও পারে না। এক স্থানে দশজন মানুষ থাকলে সেই দশজনের চিন্তা, ভাবনা চেতনা এক হবে না। তাদের মত বিনিময় হবে। কারো ভালো কারো সহ্য হবে না। এমনটা হবেই। পারিবারিক ক্ষেত্রে এগুলো বেশি হয়। এখানে কম বেশি সবারই দোষ থাকে। কারো বা বেশি, কারো বা কম। তবে দিনশেষে দেখা যায় যেই মানুষকে অবহেলা, অপমান করে অন্য একজনকে বড় বানিয়ে তাকে ভালো বউয়ের তকমা দিয়ে তার সাথে কাটিয়েছেন, শেষ সময়ে পাশে সেই অবহেলা করা মানুষটিকেই পান। কিন্তু সেরা ভালো বউয়ের তকমা দেওয়া মানুষটি দূরাবস্থা থেকে নাক ছিটকায়। এটাই হয়তো সংসার জীবনে। এখানে আমি কারো দোষ দিচ্ছি হয় না। মানুষ হিসাবে দুজন মানুষকে আমাদের সমান চোখে দেখা সম্ভব নয়। সত্যি সম্ভব নয়। আমি অনেক পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। তবে আমাদের সবার উচিত নিজেদের ভুলগুলো বুঝে তা শুধরে নেওয়া।

(সমাপ্ত)