#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_০৪
#অনন্যা_অসমি
” কি হলো কথা শুনতে পাচ্ছো না? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে।” শর্মিলা দেবীর তে’জী ঝাঁ’ঝালো কণ্ঠে কেঁপে উঠল আনন্দি। শুকনো ঢোক গিলে প্রস্তুতি নিলো কথা বলার। বারবার মস্তিষ্কে কথা সাজিয়ে নিচ্ছে কিন্তু প্রতিবারেই যেন তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আনন্দি ভেবেছিল কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ধীরেসুস্থে বলবে। কিন্তু মানুষ যা চাই তা কি কখনো হয়? তাও আনন্দি চেষ্টা করলো কোনভাবে কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য।
” মা একটু বাইরে যাচ্ছিলাম। আপনাকে তো কাল রাতে জানিয়েছিলাম।”
এতো সময় দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন শর্মিলা দেবী। এবার দূরত্ব গুছিয়ে আনন্দির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। আনন্দির মাঝে এমনিতেই ভয় দানা বেঁধে ছিল এখন তা যেন আরো শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছে। হাত-পা মনে হয় তার অবশ হয়ে আসছে।
” বাইরে কোন কাজে যাচ্ছো শুনি?”
” অব…. মা আমি এসে আপনাকে বলি? সময় চলে যাচ্ছে। একটু পড়ে সূর্য মাথার উপর উঠে যাবে, দেরি হলে ফিরতে যদি দেরি হয়।” মিনমিন করে বলল সে।
” বাইরে যাওয়ার জন্য এতো অধৈর্য্য হচ্ছো কেন? কেউ অপেক্ষা করছে নাকি?” কটমট করে তাকিয়ে বললেন তিনি।
ওনার কথার ধরণে আনন্দি অবাক না হয়ে পারল না, ” মা….!”
” চিৎকার করছে কেন? সত্যি কথা বলে ফেলেছি নাকি?” চোখমুখ বিকৃত করে ফেললেন তিনি।
আনন্দি রাগ দেখাতে গিয়েও নিজের মাঝে চেপে রাখল। এই সময় রাগ দেখানো মানেই বোকামি৷ তখন হিতে বিপরীত হলে ঘটনা আরো বি’শ্রী রুপ ধারণ করবে। গোপনে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজেকে শান্ত করল। বুঝল এই মূহুর্তে না বলে সে একপাও নড়তে পারবে না।
” মা আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি।”
” ইউনিভার্সিটি? কেন?”
” কিছুদিন পরেই ফাইনাল ইয়ার শুরু হবে। মাঝে অনেক গ্যাপ পড়ে গিয়েছে কিন্তু ইউনিভার্সিটি থেকে বলছে ভর্তি হয়ে আবারো ক্লাস করতে পারব।”
” কি! তুমি এতো সব করেছ কাকে জিজ্ঞেস করে? কার থেকে অনুমতি নিয়ে করছ তুমি? টাকা পেলে কোথায়?”
আনন্দি কিছু বলবে কিন্তু তাকে সুযোগটা না দিয়ে শর্মিলা দেবী বাঁকা ভাবে বললেন,
” তুমি না জিজ্ঞেস করে আবার এই বাড়ি থেকে টাকা নাও নি তো!”
এবার আনন্দি আর যেন সহ্য করতে পারল না।
” দেখুন মা আপনি কি ইঙ্গিত করছেন তা আমি স্পষ্টই বুঝতে পারছি। আমি বড়োলোক পরিবারের মেয়ে না হলেও অভাব কখনো চোখে দেখিনি। সামান্য কয়েকটা টাকা চুরি করার আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমি উজানকে বলেছি, তিনিই সব করে গিয়েছেন। আমি শুধু আজ গিয়ে কাজ জমা দিয়ে সাইন করে আসব। চিন্তা করবেন না টাকা উজানকে দিতে হয়নি। আমি নিজের উপার্জনের টাকায় সব করেছি৷”
শর্মিলা দেবী মোটেও দমে গেলেন না।
” বিয়ের পরও যে তুমি পড়াশোনা করবে এমন তো কোন কথা ছিল না। বিবাহিত মেয়ের আবার কিসের পড়াশোনা? আশেপাশে মানুষ কী বলবেন? সবাই বাঁকা চোখে তাকাবে, আমাদের বাড়ি নিয়ে আলোচনা করবে।”
” কেন মা? কোথাও কি লেখা আছে বিবাহিত মেয়ের পড়াশোনা করতে নেই? এতোবছর আমি কষ্ট করেছি, আমার বাবা-মা কষ্ট করেছেন আমার পড়াশোনার জন্য। রাত জেগে পড়াশোনা করেছি। এখন শুধু বিবাহিত বলেই কি আমার সব কষ্ট, স্বপ্ন বৃথা হয়ে গেল? আশাপাশের মানুষ দিয়ে কী হবে? দিনশেষে আমরা আমাদের জন্যই, পরিবারই বিপদের সময় পাশে থাকে। বিপদে পড়লে আশেপাশের মানুষ তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। আমরা শুধু তাদের আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিপদে কেউ এগিয়ে আসবে না। আমি তো দেখতে যাওয়ার দিনই উজানকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলাম আমি পড়াশোনা শেষ করব। আমার পরিবারও আপনাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। তাহলে এখন এতো অবাক হচ্ছেন কেন মা?”
আর কিছু বলতে পারলেন না শর্মিলা দেবী। আনন্দি বুঝল এটাই সুযোগ, এখন বের হতে না পারলে আর কোনদিনও পারবে না।
” আমি আসছি মা। ফিরে এসে বাকি কথা শুনব। সাবধানে থাকবেন।”
বলে একমুহূর্ত দাঁড়াল না সে। জুতো জোড়া পায়ে ঢুকিয়ে দ্রুত পায়ে নেমে গেল।
.
.
দ্রুত কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরল আনন্দি। ভয়ে তার বুক ধুকধুক করছে। কাঁপাকাঁপা হাতে বেল দিল সে। দাঁত দিয়ে ঠোঁটের কোণা এতো জোড়ে চেপে ধরেছে আরেকটু হলেই রক্ত বেরিয়ে যাবে।
আনন্দি পুরোটা সময় ভেবেছিল আজ বাড়িতে ফিরলেই তা’ন্ডব শুরু হবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শর্মিলা দেবী স্বাভাবিকভাবেই দরজা খুলে দিলেন। এমনকি একটা শব্দও তিনি উচ্চারণ করলে না। আনন্দি দ্রুত রুমে গিয়ে স্নান করে রান্নাঘরে খাবার গরম করতে গেল।
” মা খাবার খেতে আসুন।” দরজার বাইরে থেকেই ডাকল সে। শর্মিলা দেবী চুপচাপ এসে খাবার বেড়ে খেতে শুরু করলেন। আনন্দিও কথা বাড়ল না। সে ভেবেছিল হয়ত অনেক বড় ঝামেলা হবে, কথা শুনতে হবে অনেক। সেইভাবে নিজেকে পুরো রাস্তা মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু বর্তমানের বাড়ির পরিবেশ একদম তার ভাবনার বিপরীত। একদম নীরব, বাড়িতে যে দু’টো মানুষ সামনাসামনি বসে আছে বাইরে থেকে কেউ ধারণাও করতে পারবে কিনা সন্দেহ। এতোটাই নীরব আনন্দির মনে হচ্ছে একটা পিন পড়লেও তার শব্দ বুঝি অনেক ভারী শোনাবে। ঝগড়া-ঝামেলা হবে বলে সে যতটা ভয় পাচ্ছিল নীরবতা যেন তা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই নীরবতাই যেন ঝড় আশার পূর্বাভাস।
.
.
দুপুরে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকালেই রাতের রান্নার জন্য সব গুছিয়ে রাখল আনন্দি। সন্ধ্যার পূজা আজ শর্মিলা দেবী নিজেই দিয়ে নিলেন। পূজার সময়টা সে শাশুড়ীর পাশেই বসে রইল।
শাশুড়ীর নাস্তা ওনার ঘরে দিয়ে এসে নিজেরটা নিয়ে বসল আনন্দি। হাতে ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। দ্বিধাদ্বন্দের ছাপ তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। কী করা উচিত, কী বলবে তা ভাবতে ভাবতেই ফোনের আলো জ্বলে উঠল। স্ক্রিনে ঝলঝল করছে “উজান” নামখানা। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে ধীরস্থির করল সে। মনে মনে কয়েকটা কথা শোনার জন্যও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিল।
চলবে….