#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_০৫
#অনন্যা_অসমি
” মাকে তুমি কিছু বলেছ?” জানতে চাইল উজান। আনন্দি কি মনে করে নিজে থেকেই প্রথমে কিছু জানাল না।
” এই প্রশ্ন করলেন যে? মা কি আপনাকে কিছু বলেছেন?”
” না সেরকম তো কিছু বলেনি। কখন আসব তাই জানতে চেয়েছে।”
অবাক হলো আনন্দি। বাড়ি ফেরার পর থেকেই শর্মিলা দেবীর কাজকর্মে সে অবাক না হয়ে পারছে না। সকালে শাশুড়ীর আচরণ এবং ভাবভঙ্গিতে আনন্দি আন্দাজ করেছিল তিনি অবশ্যই কিছু করবেন কিন্তু সব যেন তার ভাবনার বিপরীত হচ্ছে। না তিনি তার সাথে বাড়ি ফেরার পর বাজে ব্যবহার করেছেন আর নাই বা উজানকে ফোন করে কিছু বলেছেন।
” হচ্ছেটা কি! আমি কোনভাবে মাকে ভুল ভাবছি? আশেপাশে ঘটে যাওয়া এতো এতো ঘটনা শোনার প্রভাবে কি শাশুড়ীর প্রতি আমার নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হয়েছে? তার জন্যই কি মায়ের কথা, কাজ এসব আমি স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারছিনা? আমারই কি তবে বোঝার ভুল?” মনে মনে কথাগুলো আওড়াল আনন্দি।
” কী হলো আনন্দি? কোথায় হারিয়ে গেলে?”
” হুম..? না আমি…কিছু বলেছিলেন?”
” এই বউ এখনো আপনি আপনি বলে সম্বোধন করবে? সারাজীবন আপনি বলে সম্বোধন করার চিন্তা আছে নাকি?”
মৃদু স্বরে হাসল মেয়েটা। গলার স্বর নরম করে বলল,
“আপনি সম্বোধনে সম্মান, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা সব মিশে থাকে। আপনাকে সারাদিন “আপনি” বলে সম্বোধন করতেও আমার কোন আপত্তি নেই।”
উজান যেন একটু বিরক্ত হলো।
” উফ…. দরকার নেই আমার এসবের। আমি তো চাই আমার বউ আমাকে মিষ্টি করে তুমি বলে সম্বোধন করুক। “তুমি” বলায় যে ভালোবাসাটা আছে আমি সেটা চাই।”
আনন্দি খানিকটা লজ্জা পেল। বিয়ের পর উজানকে সে অনেক কম সময়ের জন্যই কাছে পেয়েছে, এখনো বলতে গেলে তারা নতুন দম্পতি। স্বামীর সাথে এখনো সেইভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠা হয়নি বলে উজানের সামান্য কথায় মেয়েটা যেন লজ্জায় কুড়কে যায়। ফোনের অপর পাশে থাকা উজানও যেন তা অনুভব করতে পারল। তারও বেশ ভালো লাগে।
” বউ কিছু তো বলো। এভাবে চুপ করে থাকলে তো এদিকে আমি অস্বস্তিতে ম’রে যাব।”
” কবে আসবে তুমি?”
আনন্দির প্রশ্ন শুনে পূর্বের তুলনায় উজানের কন্ঠস্বরের উত্তেজনা খানিকটা যেন কমে এলো।
” এই সপ্তাহেও আমি আসব না বউ। বিয়ের পর তো মোটে এক সপ্তাহ থাকতে পেরেছি৷ এখন সবকাজ এই কয়েকদিনের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করছি যেন একেবারে সময় নিয়ে আসতে পারি।”
উজানের প্রথমদিকের কথা শুনে তার মন খারাপ হলেও পরের কথা যেন মলমের মতো কাজ করল৷
” সাবধানে থেকো। অতিরিক্ত চাপ নেওয়ার দরকার নেই। নিজের সময় নিয়ে, ধীরেসুস্থে কাজ করো। ছুটির চিন্তায় নিজে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ো না।”
” জ্বি রাণী সাহেবা। নিজের যত্নও নেব, কাজও তাড়াতাড়ি শেষ করব। আপনাকে দেখেছি কতদিন হয়ে গেল। এতো সুন্দর লাল টুকটুকে নতুন বউ রেখে কে-ই বা এতোদিন দূরে থাকতে চাই? আমি বলেই না, সহ্য ক্ষমতা অনেক তাই তো এতোগুলা দিন দূরে থেকেও ভালো আছি। দুর্বল কেউ হলে এতোদিনে দম বন্ধ হয়ে যেত।”
আবারো উজানের কথায় লজ্জায় কুড়কে উঠল আনন্দি। তার হাবভাব অনুভব করতে পেরে উজান মজা পেল। তাকে আরেকটু লজ্জা দিতেই বলল, ” কিগো বউ লজ্জা পেলে নাকি? আমি তো কিছুই বললাম তাতেই যদি তুমি লজ্জাবতী গাছের মতো কুড়তে যাও কিছু করলে তখন কী করবে?”
আনন্দির যেন এখন কান গরম হয়ে যাচ্ছে।
” উজান….”
শব্দ করে হেসে ফেলল সে।
” বউমা…. ও বউমা…. ঘুমিয়ে গেলে নাকি রুমে? কি হলো শুনতে পাচ্ছো না?”
শাশুড়ীর চিৎকারে ধ্যান ভাঙল আনন্দির। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। আধা ঘন্টা থেকেও বেশি সময় সে উজান সাথে কথা বলে চলেছে। কথায় কথায় কখন যেন সময় পেরিয়ে গিয়েছে সে খেয়ালই করেনি। দ্রুত ফোনে কথা শেষ করল। চা খেতে গিয়ে দেখল তা একদম জলের মতোন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে, খেতেও বিদঘুটে লাগছে। প্রথমে ভেবেছিল ফেলে দেবে কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল শর্মিলা দেবী দেখলে আরে দু’টো কথা শুনাবে। তাই সাত-পাঁচ না ভেবেই এক নিঃশ্বাস পুরোটা খেয়ে নিল।
” কোথায় মগ্ন হয়ে ছিলে এতোক্ষণ? সামান্য নাস্তা খেতেই আধাঘন্টা লাগিয়ে দিলে বাকি কাজ করবে কখন?” গম্ভীরভাবে বললেন তিনি।
” আসলে মা.. উজান ফোন করেছিল। তার সাথেই কথা বলছিলাম।”
নিজে নিজেই বিরবির করলেন যেন তিনি। এরপর হাতে থাকা মালা জপতে জপতে বললেন,
” যাও তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের কাজ শেষ করো। দেখো আবার রাত বারোটা বাজিও না। তখন উপোস করে রাত কাটাতে হবে।”
আনন্দিও আর কথা বাড়াল না। কি দরকার শুধু শুধু যেচে ঝামেলা করার।
.
.
মাঝে প্রায় ১৫/১৬ দিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। ইদানীং আনন্দি যেন একটু বেশিই খুশি খুশি থাকছে। তার খুশি হওয়ার কারণ উজান নাকি এই কয়েকদিনের মধ্যেই লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। তাই তার মধ্যে সবসময় খুশির ঝলক লেগে থাকে। এই বুঝি উজান ফোন করে বলল সে ওমুক দিক ফিরে আসছে৷ বউয়ের হঠাৎ এতো খুশি, মিটিমিটি হাসা শর্মিলা দেবীর নজরে এড়িয়ে যেতে পারল না। একদিন তো তিনি বললেই ফেলেন।
” কি বউমা, ঘটনা কী? সারাক্ষণ দেখি মিটিমিটি হাসো, আয়না দেখো। কাহিনী কী? জ্বি’ন ভু’তে আছড় কেটে নাকি? মানুষ দেখলে তো ভাববে বউয়ের মনে হয় মাথা খারাপ।”
সেই মূহুর্তে আনন্দির হাসিমুখখানা খানিকটা চুপসে গেল। তবে সে কারণ বলল না।
” তেমন কিছু না মা। কিছু কমেডি মুভি দেখছি তো তাই আপনার এরকম মনে হচ্ছে।”
বেল বাজার শব্দে আনন্দির ভাবনা বর্তমানে ফিরে এলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল বেলা বারোটা ছুঁইছুঁই। এসময় কে আসতে পারে চিন্তা করতে করতেই দরজা খুলে দিল সে।
” উজান!”
দরজার ওপারে উজানকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল আনন্দি। তাকে চমকে দিতে পেরেছে বুঝতে পেরে তার হাসি যেন আরো চওড়া হলো।
” কেমন দিলাম সারপ্রাইজ?”
” তুমি আজ আসবে কই বললে না তো।”
” বললে কি আমার মিষ্টি বউটাকে চমকে দিতে পারতাম?”
” উফ… তুমিও না। দেখি দেখি ব্যাগ কয়েকটা আমাকে দাও।” হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে একটা ব্যাগ নিলো আনন্দি। কিন্তু উজান খপ করে খালি হাতে অন্য হাতখানা ধরে ফেলল। স্বামীর আচমকা স্পর্শে মেয়েটা যেন কেঁপে উঠল। লজ্জা পেয়ে দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল।
” আরে কি করছ ছাড়ো,আশেপাশের কেউ দেখে ফেলবে।”
” দেখুন। আমি আমার বউয়ের হাত ধরছি, কার কি? তার যদি হিংসে হয় সে বরং নিজ বাড়ি গিয়ে নিজ বউয়ের হাত ধরে বসে থাকুক। অন্যের জন্য কেন আমি আমার বউকে দূরে রাখব?”
” হয়েছে হয়েছে। এবার ছাড়ো, হাতে সব মশলার ঘ্রাণ। ভালোভাবে এখনো তা যাইনি, এভাবে ধরে থাকলে তোমার হাত থেকেও বাজে ঘ্রাণ আসবে।”
” আসুক, এমনিতেও আমিও তো পরিষ্কার নেই। এতো দূর পথ পাড়ি দিয়েছি, দেখো সব ধুলোবালি। কিন্তু তুমি তো দূরে ঠেলে দাওনি তাহলে আমি দেব কেন?”
উজানের এই ছোট ছোট ভালোবাসা, সম্মানসূচক কথাগুলো শুনে আনন্দি যেন তার প্রতি প্রতিনিয়ত আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
” কি হলো বউমা দরজা খুলতে কত সময় লাগে? ওখানেই সারাজীবন কাটিয়ে দেবার চিন্তা আছে নাকি? আর কে এসেছে এই ভরদুপুরে? কার সাথে এতো ফিসফিস করছ?”
মায়ের কন্ঠে দুজনেই চমকে উঠল। উজানের মুখে যেন চিন্তা এবং ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। সকালেও তার মায়ের সাথে কথা হয়েছিল কিন্তু তখনও বলেনি সে আজ বাড়ি ফিরছে। মায়ের প্রতিক্রিয়া কী হবে ভেবেই উজানের মাথা এলোমেলো হয়ে গেল।
চলবে…..