#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_০৬
#অনন্যা_অসমি
” উজান! তুমি যে আজ ফিরবে কই একটাবারও তো জানাওনি। নাকি এখন থেকে আর জানানোর প্রয়োজনবোধ করছ না?” আড়চোখে আনন্দির দিকে তাকালেন শর্মিলা দেবী। আনন্দি কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। পরিস্থিতি অন্যদিকে চলে যাবে এই আশংকায় উজান দ্রুত মায়ের পাশে বসে পড়ল।
” মা…। কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। অনেক চাপে ছিলাম তো তাই কাউকেই বলা হয়নি। সাথে আমি চাইছিলাম তোমাদের চমকে দিতে।”
” হয়েছে আর সাফাই গাইতে হবে না। যাও চটজলদি স্নান সেড়ে এসো। আর বউমা উজান ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে তুমি মাছ ভাজা, ঝাল ঝাল করে মাংস আর ডিম ভুনা করে। যাও যাও তাড়াতাড়ি রান্না বসাও।”
খানিকের জন্য থম মেরে গেলে আনন্দি। ইতোমধ্যে তার রান্না শেষ। বাড়িতে যেহেতু সে এবং শাশুড়ী থাকে, তাই ওনার কথা মতোই প্রতিবেলায় রান্না হলো৷ সকালে তিনি শুটকি, শাক, ভাজি, এসব করতে বলেছিলেন। সে সময় নিয়ে ওনার স্বাদ অনুযায়ী রান্না করেছিল। এখন এই গরমে, এতো কম সময়ে আবার এতগুলো রান্না করতে হবে ভেবেই ক্লান্তি যেন তাকে আরো ঘিরে ধরল। পরক্ষণেই সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। ভাবল, ” আরে উজান তো তারও স্বামী। মায়ের চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বেচারা এতোদিন কী না কী খেয়ে দিন পার করেছে। নিজের বাড়িতে এসে যদি ভালোমন্দ না খায় তবে খাবে কখন?”
এই ভেবে সে রান্নাঘরে উদ্দেশ্য এগোবে তখন উজান তাকে থামিয়ে দিল৷
” মা এই গরমে এতোটা পথ জার্নি করে ভারী খাবার মোটেও খেতে হচ্ছে করছে না। এসব বরং পরে খাব।” মাঝে কথা থাকি উজান মাকে একবার পরখ করে নিল। বুঝল তার কথায় উনি মোটেও সন্তুষ্ট হননি।
” আনন্দি তুমি বরং বেশি করে পেঁয়াজ, মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল ডিম ভাজি করো। অনেকদিন ধরে ঝাল ঝাল ডিম খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু এতো ব্যস্ত সময় যাচ্ছিল ডিম কেনারও সময় হয়নি।”
” আরে আমার বাপ, তুই আমাকে আগে বলবি না। তুই তাড়াতাড়ি কাপড় চোপড় ছেড়ে আয়, আমি তোকে তোর পছন্দ তো ডিম রান্না করে দিচ্ছি।” উজান হাসল, তার মা যখন খুব আবেগী হয়ে পড়ে কিংবা ওনার অনুভূতিগুলো অতিরিক্ত হয়ে যায় তখনই তাকে “তুই” বলে সম্বোধন করে৷
” এইযে বউমা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে এসো। জীবনে কি মানুষ দেখোনি?”
স্বামীর দিকে ক্লান্তমাখা মুখে মিষ্টি করে হেসে শর্মিলা দেবীর পেছন পেছন রান্নাঘরে গেল আনন্দি।
.
.
” নাও বাবা খাও, আরেকটু ভাত নাও। ইশ… কয়েকদিনেই আমার ছেলেটা কতটা শুকিয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে পুরো। হাড়বজ্জাত লোকগুলো আমার ছেলেটাকে খাটিয়ে মারল।”
কি মনে করে আনন্দির মুখ ফসকে বলে ফেলল,
” তারজন্যই তো বলেছিলাম মা আমাকেও ওনার সাথে যেতে দিন। তাহলে ওনার যত্নের কোন সমস্যা হতো না।”
শর্মিলা দেবী থেঁতে গেলেন। কর্কশ কন্ঠে বললেন,
” তো আমি এইখানে একা থাকব? আমি রাত বিরতে ম*রে পড়ে থাকলে খবর পাবে? বুড়ো বয়সে একা ম*রে পড়ে থাকার জন্যই সারাজীবন সন্তানদের জন্য খেটেছি?”
আর কিছু বলার সাহস পেল না আনন্দি। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল সে, কি-ই বা বলার আছে তার। উজানের বাবা মাসের বেশীরভাগ দিনই এখানে ওখানে ট্রিপে চলে যান, ভিষণ ভ্রমণপ্রেমী মানুষ তিনি। তবে তা একা নাহয় বন্ধুদের সাথে। ছোট এক ভাই আছে তার, কোথায় জানি গিয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে। তাদের বিয়েতেও আসেনি সে। বর্তমানে এই পরিবারে মোটে মানুষ পাঁচজন। আনন্দি বুঝল তার শাশুড়ীর আংশকা, ওনার নিরাপত্ততাহীনতা অনুভব করার কারণটাও সে বুঝল৷ কিন্তু তাকে বুঝবে কে? ওনার অন্তত আরেক ছেলে আছে। কিন্তু তার? নতুন বিয়ে হয়েছে তার। স্বামী সে ক’দিন বা কাছে পেয়েছে? মেয়ে হিসেবে, নতুন বউ হিসেবে তার-ও তো কিছু শখ, আহ্লাদ আছে। তারও তো ইচ্ছে জাগে স্বামীর সাথে সময় কাটানোর। উনি কি পারতেন না অনন্ত শুরুর কয়েকটা মাস তাদের একসাথে থাকতে দিতে?
.
.
উজানের বাহুতো মাথা রেখে শুয়ে আছে আনন্দি। উজান মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর কথা বলছে। একসময় তার চোখ লেগে এলো। একসময় ঘুমের মাঝে অনুভব করল দরজায় কেউ ঠোকা দিচ্ছে৷ কিন্তু তার চোখ যেন মোটেও খুলছে না। অগত্য উজানকেই উঠতে হলো৷ যত্ন সহকারে আনন্দিকে শুয়ে দরজা খুলে দিল সে। শাশুড়ীর কন্ঠস্বর কানে এলো তার, কিন্তু কী কথা হলো তা আর তার শোনা হলো না।
.
.
মায়ের সামনাসামনি চেয়ারে বসল উজান। শর্মিলা দেবী বিছানায় বসে কাঁথা সেলাই করছেন।
” ঔষধ খেয়েছ মা?”
” হুম।”
” আব… ঘুমাবে না?”
” বাড়ির সবাই যদি ঘুমাই ঘরে চুরি হয়ে গেলেও তো কেউ টের পাবে না। বাড়ির জিনিসগুলো তো আমার স্বাদের জিনিস, তাই অগত্যা আমাকেই জেগে থাকতে হবে।”
উজান কিছু বলার মতো পেল না। সে সঠিক না বুঝলেও আন্দাজ করতে পারছে মা তাকে কেন ডেকে এই সময়। তার আন্দাজ মূহুর্তেই সত্যি প্রমাণিত হলো৷
” কতদিনের জন্য এসেছো?”
” পনেরো-বিশের ছুটি নিয়ে এসেছি। বিয়ের পর তো থাকতেই পারলমনা বেশি দিন। তাই হাতে সময় নিয়ে এসেছি।”
” হুম।”
আবারো নীরবতা ছেয়ে গেল। সুঁচে নতুন সুতা ঢুকাতে ঢুকাতে শর্মিলা দেবী বললেন,
” আগেরবার তুমি যাওয়ার আগে বউকে ভার্সিটিতে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে গিয়েছ। কই আমাকে তো একবারো জিজ্ঞেস করলে না।”
মায়ের কথায় উসকোখুসকো করল উজান৷ ছেলের অবস্থা দেখে তিনি বিদ্রুপ কন্ঠে বললেন,
” নাকি আমার মতামত জানার প্রয়োজন মনে হয়নি।”
” সেরকম কিছু নয় মা। বিয়ের আগেই তো কথা হয়েছিল এই বিষয়ে। তাই নতুন করে আর কি জানাব। ক্লাস শুরু হলে তখন তো এমনিতেই জানতে তাই আরকি…..” ইতস্ততবোধ করল উজান।
” বুঝলাম ছেলের কাছে এখন এই অভাগীনি মায়ের কোন মূল্য নেই৷ অবশ্য থাকবেই বা কেন তার জীবনে তো নতুন একজন এসেছে। আমার তো এখন আর কোন গুরুত্ব নেই। আমাদের মতামতের গুরুত্ব কারো কাছে নেই। না ছেলের কাছে আর না তার বউয়ের কাছে। আমি তো এখন বলতে গেলে এক উটকো ঝামেলা।”
” মা……” অসহায় কন্ঠ শোনা গেলে উজানের। শর্মিলা দেবী হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিলেন।
” আর কিছু বলো না তুমি। চলে যাও এখন, তোমার বউ এসে দেখলে ভাববে আমি তোমাকে কান পড়া দিচ্ছি। আমাকে কাজ করতে দাও।”
” মা তুমি একবার….”
” আমি তোমাকে যেতে বলেছি। আমার কথার যখন কোন মূল্য তোমার কাছে নেই তখন তোমার কোন কথায় আমি শুনতে চাইনা।”
হতাশ হয়ে বেরিয়ে এলো উজান। হঠাৎ করে তার জীবনে কী যে হচ্ছে তার সমীকরণ সে এখনো মেলাতে পারছেনা৷ গণিতের মতোন জটিল সংসার জীবনের নতুন ধাপে সে এখনো মা এবং বউয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে পারছেনা। তার মনে আংশকা জন্মাতে শুরু করল। একটা ভুল পদক্ষেপ না সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। সে বুঝে ওঠাে আগেই কাউকে না হারিয়ে ফেলে সে।
চলবে……