#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_০৯
#অনন্যা_অসমি
দ্রুত ঘরের যাবতীয় কাজ শেষ করতে লাগল আনন্দি। মনে মনে বেশ খানিকটাই খুশী সে। আজ বিকালে উজানকে নিয়ে বাবার বাড়ি যাবে, কতদিন পর বাবা-মাকে দেখবে। ফিরতে দেরি হবে তাই রাত পর্যন্ত যা যা কাজ আছে সব বেলা থাকতেই শেষ করে রাখছে।
সকাল দশটার একটু বেশি বাজে। শর্মিলা দেবী ডাইনিং এ বসে টিভি দেখছেন, উজান তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। সেইদিনের ঘটনার পর থেকে দু’জনের সম্পর্কে খানিকটা শীতলতা ছেঁয়ে গিয়েছিল তবে সময়ের সাথে সাথে তা আবারো ঠিক হতে শুরু করেছে।
ভাজা মাছ প্লেটে তুলে রাখছিল আনন্দি। বেলের শব্দ পেয়ে উঁকি দিল৷
” বউমা দরজাটা খুলে দাও।”
” আসছি মা।” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল সে। তিনি চাইলে উঠে কয়েক পা এগিয়েই দরজাটা খুলে দিতে পারতে। বেশী ভাবল না আর। দ্রুত হাতে মাছগুলো তুলে ছুট লাগল দরজার দিকে।
দরজা খুলতেই চেনা-অচেনা এক মুখাবয়ব দেখতে পেল আনন্দি। বেশ পরিপাটি, ফ্যাশন সচেতন এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে ওপারে। হাতে তার সুটকেস, কাঁধে ব্যাগ। ছেলেটা ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল তার দিকে। তেলমশলা লাগানো হাতে ব্যস্ত হয়ে কাপড় আরেকটু টেনেটুনে দিল আনন্দি।
” কে আপনি? কাকে চাই?”
তার প্রশ্নে ছেলেটা যেন একটু বিরক্তই হলো। চোখে থাকা কালো চশমাটা সরিয়ে গম্ভীর মুখ করে জবাব দিল,
” উদয় মল্লিক। বাড়িতে অতিথি এলে যে তাকে বাড়িতে প্রবেশ করে আলাপ আলোচনা করতে হয় সেটা জানেন না মনে হচ্ছে।”
থতমত খেয়ে গেল আনন্দি, বেশ বিব্রতবোধও করল। নিজের অজান্তেই কয়েক পা পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা করে দিল। উদয় নামের ছেলেটা চোখেমুখে বিরক্ত নিয়ে ব্যাগপত্র টেনে ভেতরে ঢুকল। আনন্দি বুঝল না কয়েক মিনিট পূর্বেই প্রথমবারের মতোন সাক্ষাৎ হওয়া মানুষটার হাবভাবে কেন তার প্রতিটা কথায় বারবার এতো অসন্তুষ্টভাব ফুটে উঠছে। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ডাইনিং এসে দাঁড়াল সে।
” এতোদিন পর বাড়ির কথা মনে পড়ল তাহলে।”
আনন্দি দেখল ছেলেটা শর্মিলা দেবীর পাশে বসেছে। শর্মিলা দেবীর কন্ঠ শান্ত তবে তাতে যেন এক মমতার আভাস মিশে আছে। আনন্দি মনে করার চেষ্টা করল ছেলেটাকে সে কোথায় দেখেছে। তার ভাবনার মাঝেই শর্মিলা দেবী তাকে বললেন,
” বউমা তুমি চুলো জ্বালিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো?”
আনন্দির মনে পড়ল সে এক চুলায় তরকারি বসিয়ে এসেছে৷ তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল, পেছন থেকে শর্মিলা দেবী নির্দেশ দিলেন,
” একেবারে একগ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়ে নিয়ে এসো৷ চিনি কম দেবে, ঠান্ডা পানি বেশি পরিমাণে দেবে।”
হাতের ট্রে টা টেবিল রাখল আনন্দি। উদয় ছেলেটা চুপচাপ পানি পান করে ব্যাগপত্র নিয়ে একটা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।
” মা উনি…..?”
” উনি মানে? এই মেয়ে তুমি এতোক্ষণেও ওকে চিনতে পারেনি?” খানিকটা অবাক হয়েই বললেন যেন তিনি।
শাশুড়ীর কথার ধাঁচে আমতা আমতা করতে লাগল আনন্দি। শর্মিলা দেবী তা দেখে হালকা ধমক দিয়ে জানালেন,
” আরে ও তোমার দেবর উদয়। আমার ছোট ছেলে। নিজের স্বামীর ভাইকেও চিনতে পারলে না কেমন বাড়ির বউ তুমি? বিয়ের সময় তো দেখালাম, স্মৃতি শক্তিকে সমস্যা আছে নাকি তোমার? না ভুলে যাওয়ার রোগ তৈরি হয়েছে?”
এতোসময় পর মনে পড়ল আনন্দির। বিয়ের কয়েকদিন পরেই শর্মিলা দেবী নিজ দায়িত্বতে সকল দূরের-কাছের আত্নীয়ের ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। কয়েকজনকে তো সামনাসামনি। সেই সময় পরিচয় করিয়ে দেখা প্রায় সকলকেই তার আবছা আবছা মনে আছে। এতো এতো লোকের মাঝে সামনাসামনি না দেখা উদয়কেও সে ভুলে গিয়েছিল। শর্মিলা দেবী আরো কথা শোনানোর আগেই ট্রে নিয়ে সরে পড়ল সে।
.
.
বিকেল হতে হতেই উজানকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ল আনন্দি। গাড়িতে বসে হরেক রকমের কথা বলছে সে। তার মুখভাব দেখে উজান অনুমান করতে পারল মেয়েটার মনের আনন্দ। মনে মনে সে যেন স্বস্তি পেল।
.
.
খাবার টেবিলে শুধু শর্মিলা দেবী এবং উদয়। দু’জনের মাঝে কোনপ্রকারের কথা নেই। কি মনে করে উদয় প্রশ্ন করল,
” শুনলাম দাভাই নাকি বাড়িতে আছে। কই একবারো তো দেখলাম না।”
” দেখবে কি করে? তুমি ফিরে যে দরজা লাগিয়ে ঘুম দিলে জাগলে তো কিছুক্ষণ আগে। তাছাড়াও উজান আর বউমা বাড়িতে নেই, বিকেলেই বউয়ের বাপের বাড়ি গিয়েছে।”
” বাহ্! আমি এলাম বলেই কি কেউ বাড়ি ছাড়ল নাকি?” ফোনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল সে৷
শর্মিলা দেবী কিছু বলতে গিয়েও যেন বললেন না।
” কতদিনের জন্য এসেছো?”
” হঠাৎ এই প্রশ্ন? আমার আসাতে তোমারও অসুবিধে হচ্ছে নাকি?”
” এই কারণেই তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না আমার। একেবারে বাপের গু’ষ্টির মুখ পেয়েছ। খাওয়া শেষে নিজের প্লেট পরিষ্কার করে রাখবে। কেউ তোমার কাজ করতে পারবে না।” বললেই থমথম করে টেবিল ছেড়ে উঠে গেল তিনি। উদয় আগের মতোনই ফোন টিপে চলেছে। যেন সে এসব কথা আগেও শুনেছে, তার এসব কথায় কোন কিছু যায় আসে না।
চলবে…..