#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১১
#অনন্যা_অসমি
“সুনয়না!”
দরজায় তাকে দেখে কিছুসময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল আনন্দি।
লম্বা চুল, সাজানো মুখ, রঙিন পোশাক সব মিলিয়ে বেশ জ্বলমলে তার চেহারা। চোখে-মুখে স্পষ্ট আত্মবিশ্বাস আর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।
” সুনয়না তুমি? সুনন্দা আন্টি আপনিও এসেছেন। কিন্তু আমরা তো এখন বাইরে যাচ্ছি।” বলল উজান।
শর্মিলা দেবী পেছন থেকে বললেন,
” সুনন্দা আর সুনয়নাও আমাদের সাথে যাবে।”
উৎসুক নয়নে মায়ের দিকে তাকাল তিনজন।
” দাদা তো এখন বাড়িতে নেই। সুনন্দার বাপের বাড়িও তো ওখানেই, সুনন্দাও অনেকদিন ওদিকে যাবে বলে চিন্তা করছিল। তাই ভাবলাম আমরা যেহেতু যাচ্ছি ওদেরকেও নিয়ে যাই। চলো এবার গাড়ি চলে এসেছে। দেরি করে বের হলে রোদ মাথায় উঠে যাবে।”
যেহেতু শর্মিলা দেবীর সম্মতিতেই ওনারা এসেছেন তাই তিনজনের কেউ পরবর্তীতে এই বিষয় নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলল না। উজানের মামাবাড়ি যেতে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগে৷ মাঝারি ধরণের একটা মাইক্রো ভাড়া করেছিল তারা। শর্মিলা দেবী এবং সুনন্দা দেবী আগেই পেছনে উঠে বসেছে। এতোটা পথ দু’জনের পক্ষে বসে থেকে যাওয়া একটু কষ্টকর তাই যেন তারা পথিমধ্যে বিশ্রাম করতে পারে সেজন্য পেছনে বড় জায়গায় বসেছেন।
উদয় জানতে চাইল, ” দাভাই তুই কি সামনে বসবি?”
উজান তার মাথায় হালকা চাপড় মেরে বলল,
” তোর বৌদি কি তবে তোর পাশে বসবে? মাথায় কোন বুদ্ধি নেই।”
দাদার হাতে মা’র খেয়ে উদয় মুখ গম্ভীর মুখ করে ড্রাইভারের পাশে বসল। তাদের কথার মাঝে সুনয়না কখন জানি ভেতরে বসে পড়েছে। উজান ও আনন্দি বসতে গিয়ে দেখল সুনয়না একেবারে মাঝ বারবার বসেছে।
” উজান দা এসো, এখানে বস।” হাতের ইশারায় নিজের পাশে ইঙ্গিত করল সে। আনন্দি যেন অবাক না হয়ে পারল না। উজান ইতিউতি করতে লাগল। সময় নষ্ট না করে আনন্দি উঠে বসল।
” সুনয়না তুমি আরেকটু ওদিকে যাও। এতোটা পথ জানালার পাশে না বসলে অস্বস্তি লাগতে পারে। তার উপর তুমি যে ভারী জামা পড়েছ, মাঝে বসলে তোমার শরীর খারাপ করবে। তুমি বরং জানালার পাশেই বস, বোন হিসেবে না-হয় তোমার পরিবর্তে আমিই মাঝে বসলাম।”
একপ্রকার রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। কটমট করতে করতে সরে বসল সুনয়না। জায়গা পেতেই চটপট গাড়িতে উঠে বসল উজান।
সুনয়না চুপ করে থাকল। চোখ মুখে অজানা এক বিরক্তির রেখা, তবে মুখে তা প্রকাশ করল না। পরবর্তী কয়েক মিনিটে গাড়ি চলতে শুরু করল, শহর পেছনে পড়ে এগিয়ে যেতে লাগল তাদের গাড়ি।
পথে অনেকটা সময় কেটেছে। সুনয়না পাশের সিট থেকেই একের পর এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে উজানের দিকে।
“ উজান দা, মনে আছে ভার্সিটিতে তুমি কত সুন্দর গান গাইতে? কতদিন তোমার গান শুনি না, এখনো কি গান গাও?”
“ আচ্ছা, তোমার অফিসের এত কাজ থাকে, সময় পাওয়া যায় না নিশ্চয়ই। তোমার বউ কি কিছু বলে না?”
উজান মাথা নাড়ল,
“হ্যাঁ, কাজ তো থাকেই। তবে পরিবার থেকেও দূরে থাকা যায় না। সেই জন্যই তো লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছি।”
আনন্দি কিছু বলল না, চুপচাপ শুনল শুধু।
সুনয়না একটু হেসে আবার বলল,
” তোমার মা বলছিল, তোমার না নাকি ঘুম খুব হালকা, এতটুকু আওয়াজেই নাকি ঘুম ভেঙে যায়?”
উজান হালকা হাসল, ” মা এসবও তোমাকে বলেছে নাকি? হ্যাঁ, তবে এখন একটু সহ্য করতে শিখছি। সংসার মানে তো নতুন অভ্যেস তৈরি করা, তাই না আনন্দি?”
আনন্দি এবার একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। উজান তার চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল।
গাড়ির গতি বাড়তে থাকল৷ গাছপালা, যানবাহন পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল তারা। ক্লান্তিতে আনন্দির চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। সকাল থেকেই এত ব্যস্ততা, রাতেও ভালোমতো ঘুম হয়নি উপরন্তু এই সফর। ফলে কিছুক্ষণ বাদেই মাথা কাত করে ঘুমিয়ে পড়ল সে। উজান তার দিকে তাকিয়ে দেখল, নরম ঠোঁটে এক অচঞ্চল প্রশান্তি। চুলগুলো একটু এলোমেলো হয়ে গেছে তার, চোখে মুখে সামান্য ক্লান্তির ছাপ।
উজান আস্তে করে তার মাথাটা নিজের কাঁধে টেনে আনল। সুনয়না সেটা দেখে কী মনে করল বোঝা গেল না, কিন্তু তার মুখে কিছুটা অসন্তুষ্টতার চাপ ফুটে উঠল।
গন্তব্যে পৌঁছতে তাদের দুপুর পেরিয়ে গেল। গাড়ি বাড়ির সামনে থামতেই সকলে একে একে নামতে শুরু করল।
“ পিছন থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে এসো তোমরা।” শর্মিলা দেবী বললেন।
উজান মাথা নাড়ল, “ নিচ্ছি মা। তোমরা আগে যাও। উদয় তুই যতটা সম্ভব নিয়ে যা আমি আনন্দিকে নিয়ে আসছি।”
সবাই দ্রুত ব্যাগপত্র নিয়ে ভেতরে যেতে লাগল।
তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন আনন্দি। মাথাটা কাত করে উজানের কাঁধে রাখা। হাওয়ায় তার কপালের চুলগুলো উড়ছে। উজান গাড়ির দরজাটা লাগিয়ে দিল।
মিহিকন্ঠে আবেগের সঙ্গে বলল, “ আনন্দি… ওঠো। এসে গেছি আমরা।”
কোন সাড়া নেই মেয়েটার।
“ আনন্দি?” এবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল সে।
আনন্দির চোখ কুঁচকে উঠল, মাথাটা আরও একটু উজানের কাঁধে এলিয়ে দিল।
উজান হাত বাড়িয়ে তার কপালের চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিল। বলল,
“ ঘুমাতে তো পারো খুব। কেউ দেখলে ভাববে কত শান্ত তুমি।”
এইবার আনন্দি ধীরে চোখ মেলল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল উজানের চোখে।
“ পৌঁছে গিয়েছি?”
“ হুম। সবাই নেমে গিয়েছে, তুমিই কেবল ঘুমিয়েছিলে।”
উজান তার গালে পড়ে থাকা চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দিল।
আনন্দি লজ্জা পেয়ে সোজা হয়ে বসল,
“আমি… আমি বুঝতেই পারিনি…”
” ঘুমের মাঝে তোমাকে যে কতটা স্নিগ্ধ লাগছিল।
আমি ভাবছিলাম, তুমিই বুঝি আমার গন্তব্য। মন বলছিল এই পথ যেন শেষ না হয়। যেন তুমি আরো লম্বা সময় এভাবেই ঘুমিয়ে থাকো।”
আনন্দি হেসে ফেলল। চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল,
“ বাহ্… এতো কথাও জানো তুমি। তা কোথা থেকে শিখলে এসব?”
” কেউ একজন হুট করে জীবনে এসে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছে।” বলে আনন্দির চুলগুলো তার কানে গুঁজে দিল।
আনন্দি তার হাতটা চেপে ধরল।
“ জানো মাঝে মাঝে না খুব কষ্ট হয় তবে সুখের আশায়, ভালো কিছুর আশায় আমি সব মেনে নেই। মনে রাখিনা ওসব। তোমার এই ছোট ছোট কেয়ারগুলোর কারণেই সংসারের কাঁটাগুলোও যেন ফুল হয়ে যায় এই সময়গুলোয়।”
উজান হাত বাড়িয়ে বলল,
“চলো, এবার নামি। নয়তো সবাই ভাববে আমরা পালিয়ে গিয়েছি!”
হেসে উঠল দু’জনে। আনন্দি গাড়ি থেকে নামল, কিন্তু পা রাখার আগেই উজান তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আনন্দি হাসিমুখে তার হাতটা ধরে নামল গাড়ি থেকে। এগিয়ে যেতে যেতে মনে মনে আওড়াল,
” সবসময় এভাবেই পাশের থাকবে তো উজান? নাকি আচমকাই কোন দুঃস্বপ্নের হয়ে হারিয়ে যাবে তুমি?”
চলবে……