সংসার নাকি সম্মান পর্ব-১৩

0
1

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৩
#অনন্যা_অসমি

ভোররাতের নিস্তব্ধতা যেন ছুঁয়ে বসেছিল আনন্দির ভেতরের অস্থিরতাকে। রাতটা যেন অস্থিরতায় কেটেছিল আনন্দির। সে জানে, মেসেজটা তার চোখে পড়া ঠিক ছিল না, কিন্তু চোখ তো আর সে মুহূর্তে নিজের বশে ছিল না।

মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেদিন রাতেই।

” আজ তোমার হাসিটা দেখেই মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে… ইচ্ছে করছে, আবার একসাথে সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যাই। আনন্দি কি জানে, তুমি কখনও আমায় ‘না’ বলোনি?”

এই মেসেজটা চোখে পড়ার পর থেকে একরকম অস্বস্তি যেন তাকে বারবার আষ্টেপৃষ্ঠে ধরছিল। সেই অস্বস্তি নিয়েই তার দিন শুরু হলো।
.
.
সকালে চায়ের কাপ হাতে আনন্দি ধীরে ধীরে গেল ঘরে। উজান তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। আলো ঠিকঠাক পড়ছে না তার মুখে, যেন ইচ্ছা করেই নিজেকে আড়ালে রেখেছে।

” তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ?”

” না সেরকম কিছু নয়। কাল রাতে ঘুম হয়নি তো তাই।”

উজান পরবর্তীতে কিছু বলল না। আনন্দি চলে আসতে নিয়েও থেমে গেল।

” উজান, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

উজান একটু থেমে বলল, ” হ্যাঁ বলো।”

আনন্দি চোখ নামিয়ে নিল।

” কাল তোমার ফোনে একটা মেসেজ এসেছিল। সুনয়না ছিল, আর কিছু কথাও…”

উজান এবার ঘুরে তাকাল, কিন্তু মুখে যেন হাসি নেই।

” তুমি আমার ফোন দেখেছিলে?”

” না… মানে ঘুম আসছিল না, সময় দেখছিলাম। তখনই চোখে পড়ে গিয়েছিল।”

উজান শান্তকন্ঠে বলল, ” ও কিছু না। ছোট মানুষ, আবেগে হয়তো কিছু লিখেছে। তুমি তো জানোই ওকে আমরা আগে থেকেই চিনি, পুরোনো পরিচয়।”

আনন্দি যেন স্বর কঠিন করে বলল, ” আবেগ… না অভ্যেস? পুরোনো সম্পর্কগুলো এভাবে ফিরে আসে নাকি? তুমি নাকি তাকে কখনো ‘না’ বলোনি? এর অর্থ কী উজান?”

উজান হালকা হাসল, “ এই লাইনটা খুব নাটকীয় শোনায়, তাই না? হ্যাঁ এটা সত্যিই, আমি তো কিছু বলিনি ওকে কখনো। এমনকি, ওর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলও না।”

আনন্দি চুপ করে রইল। ঠিক যেন উত্তর পেয়েও কিছু একটা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে।

উজান এবার সোজা তাকাল তার চোখে। বলল,

“তুমি বিশ্বাস করো না, তাই তো?”

আনন্দি চুপ করে গেল। উত্তর দিল না, চোখ নামিয়ে চলে যেতে উদ্ধত হলো।
.
.

বিকেলে উঠোনে আবারও জমেছে আড্ডা। কয়েকজন ছেলেপুলে খেলছে, বাকিরা হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত। হঠাৎই সুনয়না একটি পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে হাজির হলো।

” এটা নাও, এটা আমি নিজে করেছি। উজান দা’র পছন্দের ছিল একসময়। এখনো ভালোবাসো তো উজান দা?”

উজান হালকা হাসল, একটু বিব্রতও দেখাল, “তুমি এখনও মনে রেখেছো?”

” তোমার সব কিছু মনে আছে,” বলে এক ঝলক তাকাল আনন্দির দিকে।

আনন্দি ঠান্ডা গলায় বলল, ” তুমি স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো দেখছি।”

সুনয়না হাসল, ” যা সত্যি, তা কি কখনো ভুলে যাওয়া যায়? ওমা, তুমি বুঝি জানো না উজান’দা পায়েস পছন্দ করে? তোমাকে বলেনি বুঝি?”

উজান এবার থামিয়ে দিতে চাইল। বলল,

” সুনয়না, এসব বলে পরিবেশের ভাবটা পরিবর্তন করো না।”

রোদশী আনন্দির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,
“ দেখেছো, কীভাবে বারবার স্মৃতির নাম করে আগের জিনিস টেনে আনছে?”

আনন্দি একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “ হয়তো পূর্ব পরিচিত তাই মনে রেখেছে…”

রোদশী যেন ঠোঁট চেপে হাসল, “ হয়তো। কিন্তু তার জন্য এতটা অভিনয় দরকার পড়ে?”

সুনয়না কিন্তু থেমে থাকল না। সে শান্ত গলায় বলল,

” আমি শুধু বলছি, ভালো লাগা, অভিমান… এ সব তো সম্পর্কের মধ্যেই থাকা দরকার, এমনকি নাম না জানা সম্পর্কের মধ্যেও থাকে। তাই না আনন্দি?”

আনন্দি এবার তার চোখে চোখ রাখল, ” থাকলেও তবে একতরফা অনুভূতির নাম সম্পর্ক নয়।”
.
.

সন্ধ্যায় সবাই ঘরে ব্যস্ত। আনন্দি একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সে হঠাৎই দেখল, গাছের পাশে উদয় একা দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাচ্ছে। চোখেমুখে ক্লান্তি। অবাক হলো সে।

” উদয়? তুমি সিগা”রেট খাও?” আচমকা আনন্দির স্বর শুনে চমকে উঠল ছেলেটা।

” না… মানে… ওই আরকি মাঝে মাঝে।”

” বাড়িতে জানে?”

উশখুশ করতে লাগল সে। ইতিউতি করে জবাব দিল, ” না।”

আনন্দি মুচকি হাসল, ” আমি এখন কাউকে কিছু বলব না। তবে বৌদি নয় বোন হিসেবে পরামর্শ দেব, এসব বাজে অভ্যাস করো না। লুকিয়ে কিছু করার অভ্যেস একসময় স্বভাবে পরিণত হয়। তখন ভুল আর সোজা রাস্তার ফারাক ঘুচে যায়।”

উদয় মাথা নিচু করে রইল, কিছু বলল না। শুধু সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে চলে গেল ভেতরে।

সন্ধ্যার পর উঠোনে আলো ঝলমলে করছে। পাড়ার কয়েকজন এসে গল্প করছে। উজান হেসে গল্প করছে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। আনন্দি একটু দূরে বসে, চোখের কোণা দিয়ে উজান আর সুনয়নাকে লক্ষ করছে।

সুনয়না কথা বলছে, মাঝে মাঝে উজানের দিকে তাকাচ্ছে। চোখে এমন কিছু ভাষা যা সহজে ধরা যায় না, কিন্তু বুঝে নিতে হয়। উজান কখনো চোখ নামিয়ে নিচ্ছে, কখনো হেসে উত্তর দিচ্ছে।

রাতের খাবার শেষে সবাই ছাদে গিয়ে বসেছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। উজান হঠাৎ একপাশে গিয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুরু করল।

অনেকক্ষণ পরও যখন সে এলো না আনন্দি চুপিচুপি উঠে তার দিকে গেল। দূর থেকে শুধু এটুকু কানে ভেসে এলো,

“ না, ও কিছু জানে না। আমি… আমি সাবধান ছিলাম। কিন্তু…”

আরও কিছু কথা ছিল, কিন্তু হাওয়ার সাথে তা ভেসে গেল। আনন্দির যেন গলা শুকিয়ে গিয়েছে। এক অজানা ভয়, এক অদ্ভুত প্রশ্নে থমকে দাঁড়ায় সে।

চলবে…