#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৫
#অনন্যা_অসমি
পরেদিন দুপুরে তারা পাহাড়ি রাস্তা ধরে হাঁটতে বের হলো। রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছিল লাল-সবুজ শাল, কাঠের কারুকাজ করা ব্রেসলেট। আনন্দি একটা ব্রেসলেট কিনে উজানকে পরিয়ে দিল।
“ আমাদের সুন্দর মুহূর্তের প্রতীক হিসেবে তোমার হাতেও এমন কিছু থাকুক, যেটা তোমাকে সবসময় এই মুহূর্তগুলো মনে করিয়ে দেবে।” মিষ্টি হেসে বলল আনন্দি।
উজান কিছু না বলেই তার কপালে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিল। একটা হ্যান্ডমেইড কাঠের মুকুট নিল সে। আনন্দির মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বলল, “ আমার রাজ্যের রানী তুমি, আর আমি তোমার প্রজা।”
চারদিকে তখনও সাদা সাদা মেঘ, যা ভেতরে সূর্য লুকোচুরি খেলে চলেছে ঠিক একরাশ চুপচাপ ভালোবাসার মতোন।
সেখান তাঁরা পায়ে হেঁটে চলে গেল গাঙচিল ভিউ পয়েন্টের দিকে। হাঁটার পথে আনন্দি মাঝে মাঝেই থেমে ছবি তুলছিল। মেঘের মধ্যে দাঁড়িয়ে উজান তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ সব ছবি তো তুমি তুলছো। আমারও একটু ছবি তুলে দাও। আমি কিন্তু তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর ভিউ হতে পারি।”
আনন্দি হেসে বলল, “ তুমি মাঝে মাঝে এমন কথা বলো, মনে হয় কোন কবি, সাহিত্যিক কথা বলেছে।”
হেঁসে উঠল দু’জনেই। আবারো হাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগল সামনের দিকে।
.
.
রাতে হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। কটেজের টিনের চালে টিপটিপ শব্দ আর বাইরের অন্ধকার যেন ওদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আনন্দি নিজের শাল গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে। উজান এসে একটা কম্বল এনে তার গায়ে জড়িয়ে দিল।
“ ঠান্ডা লাগছে?”
“ কিছুটা, এই পাহাড়ি হাওয়া আমার কাছে একেবারেই নতুন।”
উজান গলা নামিয়ে বলল, “ তোমার প্রকৃতির সব কিছুই নতুন লাগছে আর আমি নতুন আনন্দিকে চিনছি।”
আনন্দি লাজুক হাসল যেন। ছমছমে ঠান্ডা হাওয়ায় আনন্দি শীতল হাতটা উজানের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। উজান চমকে তাকাল, তারপর হেসে তার হাতটাকে নিজের হাতে চেপে ধরল।
“তোমার কি শীত করছে, নাকি শুধু সুযোগ নিচ্ছো?” চোখে চোখ রেখে বলল উজান।
আনন্দি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “দুটোই।”
উজানের মুখে সেই পুরোনো, কোমল হাসি। আনন্দির মনে হয় এই মানুষটার পাশে থাকলে যতটুকু নিঃশ্বাস লাগে বাঁচতে, ততটুকুই যথেষ্ট। আর কিছু চাই না।
এরপর দুজনেই হাত ধরে বসে থাকল। দূরের মেঘে বিজলির ঝলকানি দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের ছোট্ট কটেজে যেন আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল ভালোবাসা।
“আচ্ছা,” আনন্দি হঠাৎ বলল, “তুমি যদি একদিন হারিয়ে যাও? এই মেঘের দেশে?”
উজান চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে তুমি কি খুঁজতে আসবে?”
“ সব পাহাড় ডিঙিয়ে চলে আসব। কারণ আমি জানি, তোমার চোখের চেয়ে গভীর আর কিছু নেই।”
.
.
.
সকালবেলা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসে রোদের ঝিলিক, চারদিকে সাদা মেঘ। যেন এক স্বপ্নপুরী। রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উজান আর আনন্দি নিরবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছিল।
হঠাৎ উজান আনন্দির কাঁধে হাত রেখে বলল,
” জানো, সাজেকটা অনেকটা তোমার মত। প্রথমে রহস্যময় লাগে, তারপর ধীরে ধীরে প্রেমে পড়ে যাই।”
আনন্দির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল, কিন্তু তার চোখে ছিল চিন্তার ছায়া।
” তুমি এখন অনেক চুপচাপ হয়ে গেছো, উজান। মনে হয় কিছু লুকাচ্ছো।”
উজান চোখ সরিয়ে বলল, “ সব সময় সব কথা বলা যায় না। কিন্তু তার মানে এই নয়, আমি ভালোবাসি না।”
সন্ধ্যায় তারা হেলিপ্যাডে বসে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখছিল। তখন হঠাৎ আনন্দি বলল, “জানো, মাঝে মাঝে খুব ভয় পাই। মনে হয় আমি তোমার ভালোবাসার যোগ্য না।”
উজান চমকে তাকাল। মেয়েটার চোখে কিছু একটা ছিল, যেন কষ্ট।
” তুমি তো আমার জীবনের সবটুকু জুড়ে আছো। কিন্তু মাঝে মাঝে অনুভব করি, আমরা হয়তো একে অন্যকে চিনে উঠিনি এখনো।”
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল আনন্দি।
“তবে একটা কথা বলি?”
“হ্যাঁ বলো।”
“যদি কখনো আমাদের মাঝে কেউ এসে দাঁড়ায়, তুমি আমায় বিশ্বাস করবে তো?”
উজান শান্ত গলায় বলল, “আমরা যদি নিজেরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে না পারি, তবে কেউ এসে আমাদের ভাঙতে সময় নেবে না।”
আনন্দির চোখে জল জমে গেল। মেয়েটা কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন বলতে পারল না।
সেই রাতে তারা হাত ধরাধরি করে ঘুরল সাজেকের রাস্তায়, বৃষ্টি ছুঁয়ে গেল ওদের আর সেই সব মুহূর্ত যেন পাহাড়ের কোলে জমে থাকল।
🍂🍂
হানিমুনের শেষ দিনটায় সাজেক ভ্যালির পাহাড়ি বাতাসে একরকম ঘোর লেগে ছিল। কাঠের কটেজের জানালার ফাঁক দিয়ে মেঘের সাদা তুলোর মতো স্তরটা ঘরে ঢুকছিল, আর সেই সঙ্গে এক অজানা নীরবতা।
সকালবেলা উজান এখনও ঘুমিয়ে। আনন্দি ধীরে উঠে এসে কাচের জানালার সামনে দাঁড়াল। দূরে পাহাড়গুলো একটার পর একটা রুপালি কুয়াশায় ঢেকে আছে। নিচের সবুজের মাঝে মাঝে লাল ছাউনি, সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। লোকজন হয়ত নাস্তার আয়োজন করছে।
এই কয়দিন সাজেকে কাটানো সময়গুলো যেন কোনো স্বপ্নের মতোই ছিল। সকালে রুইফলং পাহাড়ে হেঁটে যাওয়া, বিকেলে কংলাক পাহাড়ে মেঘে ভিজে বসে থাকা, আর রাতের আঁধারে শুধু একে অপরের চোখে চোখ রেখে বলা না বলা কিছু কথা।
একদিন হাওয়ামুড়ার চূড়ায় দাঁড়িয়ে উজান বলেছিল,
“তুমি জানো, এই মেঘগুলোর মধ্যে যদি হারিয়ে যাই… আমি চাই তুমি আমায় খুঁজতে না যাও।”
আনন্দি চমকে গিয়ে তাকিয়েছিল,
“তা কেন?”
উজান মুচকি হেসে বলেছিল,
“কারণ আমি জানি, তুমি খুঁজলে ঠিক পেয়ে যাবে। আমি চাই, একবার যেন হারিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতাও পাই…”
আনন্দি তখন ওর হাত শক্ত করে ধরে বলেছিল,
“যতবার হারিয়ে যাবে, আমি ততবারই তোমাকে ফিরে আনব।”
কিন্তু সাজেকের সেই ঘন সবুজ আর মেঘে ভেজা নরম আলোতেও আনন্দির মনটা খচখচ করছিল। কিছু একটা ঠিক নেই। উজান আগের মতোই ভালোবাসায় মগ্ন, কিন্তু কোথায় যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে আছে। হয়তো আনন্দির মনে, হয়তো তাদের দুজনের মাঝেই। সত্যিই কি তাই? নাকি সব মেয়েটির মনের ভুল?
হানিমুনের শেষ বিকেলটা ছিল সবচেয়ে নিঃশব্দ। পাহাড়ে সূর্য ডোবার মুহূর্তে উজান বলল,
“এই সাজেকে একটা কথা রেখে যাচ্ছি…”
“কি?”
“যতদূরই যাই, যত অভিমানই হোক, এই সাজেকের স্মৃতি যেন আমাদের ঠিকানা হয়ে থাকে। যদি কোনোদিন ভুলে যাই আমরা কে ছিলাম, এই জায়গা যেন মনে করিয়ে দেয়। আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম, নিঃশর্তভাবে।”
আনন্দি চোখ বন্ধ করল। মনে হচ্ছিল, সময়টা যেন জমে থাকুক এখানে, এই মেঘের ভেতর, এই পাহাড়ি বাতাসে।
🍁🍁
সাজেক থেকে ফেরার পর প্রথম কয়েকদিন ছিল এক ধরনের বিষণ্ণতা। শহরের কোলাহল যেন পাহাড়ের নিঃশব্দ ভালোবাসাকে ঢেকে ফেলছিল।
আনন্দি ব্যস্ত হয়ে উঠল বাড়ির কাজকর্মে, নতুন করে আবারো সংসারের ছোঁয়ায়। উজানও পরশুই ফিরে যাবে, আবারো সেই পুরোনো রুটিনে।
হানিমুন থেকে ফেরার পরে সুনয়নাকে আরেক রকমভাবে চেনা শুরু করল আনন্দি। উজান ফিরে যাওয়ার আগেরদিন দুপুরবেলায় সুনয়না উপস্থিত হলো, মুখে তার বড় হাসি এবং হাতে একটা বাটি।
” আজ একটু সময় ছিল, ভাবলাম একটু রান্না করি। উজান দা’র তো কালকেই চলে যাবে। তাই তার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করলাম। ”
আনন্দি ঠোঁটে হাসির রেখা টানল, কিন্তু চোখে শীতল চাহনি।
“তুমি নিজেই বানিয়েছো?”
“হুঁ, আর কাকে বলব বলো? দেখি সরো, সরো। ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।”
বলতে বলতে তাকে ঠেলে ভেতরে ডুকে পড়ল সুনয়না।
ফিরে গেল উজান। ফেরার প্রথম এক-দু’দিন সব ভালোই চলছিল। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভব হলো আনন্দির। প্রায় সময় উজানের ফোন ব্যস্ত থাকে। রিসিভি করলেও অল্প সময় কথা বলে কেটে দেয়। প্রায়সময় তাকে অনলাইনে একটিভ দেখা যায় এমনকি মাঝরাতেও। ধীরে ধীরে তাদের মাঝে যেন আবারো একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হচ্ছিল।
প্রথমদিকে আনন্দি ভেবেছিল অফিসের চাপ। তাই আর কথা বাড়াইনি।
কিন্তু সেদিন একটা জিনিস নজরে পড়ল তার। সপ্তাহখানিক পরের ঘটনা। অনেকদিন পর উজান আবারো বাড়ি ফিরেছিল। ফিরে যাওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ পরই ফিরেছে। সেদিন হঠাৎ আনন্দির নজরে পড়ল উজানের ফোনে ভেসে উঠা একটা মেসেজে।
” সময় করে ফোন দিও। অনেক কথা এখনো বাকি।”
নামটা কি দিয়ে সেভ করা তা ভালো করে নজরে আসার আগেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। তবে তার মস্তিষ্ক কেন জানি বলছিল সেভ করা নামের প্রথম অক্ষর “S” ছিল।
আনন্দির গা শিউরে উঠল। বুকের ভেতরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেল। কীসের কথা? সাজেক থেকে ফেরার পর সুনয়না দু-তিনবার তাদের বাসায় এসেছিল, তখনও কিছুটা অস্বস্তি হয়েছিল আনন্দির। প্রতিবারই ও কথার ফাঁকে এমনভাবে উজানকে নিয়ে মন্তব্য করত, যেন সে ইচ্ছে করেই কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে।
একদিন সুনয়না বলল,
” আনন্দি, উজান কিন্তু সবসময় খুব দেরিতে রিপ্লাই দেয়। কিন্তু জানো, একদিন এমন এক রাতেও রিপ্লাই পেয়েছিলাম যখন ভেবেছিলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে!”
আনন্দি কিছু বলল না। শুধু হেসে এড়িয়ে গেল।কিন্তু ভিতরে ভিতরে সেই হাসি বিষ হয়ে জমল।
একদিন দুপুরে খাবারের সময় আনন্দি ফোন করল উজানকে। উজান বেশ তাড়াহুড়ো কন্ঠে কথার জবাব দিচ্ছে। আনন্দি আলতো কন্ঠে বলল,
” আজকাল খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে তোমাকে। সব ঠিক আছে তো?”
উজান আগের মতোই ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
“ হ্যাঁ, একটা ক্লায়েন্টের কাজ চলছে। কিছু প্রেজেন্টেশন বানাতে হচ্ছে, বুঝতেই পারছো…”
আনন্দি চুপ করেছিল, কিন্তু তার মন যেন চুপ করতে চাইছে না।
.
.
পরের কয়েকদিনে আরও কিছু কিছু ঘটনা আনন্দির সন্দেহকে পাকাপোক্ত করে তুলতে লাগল।
একদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ সুনয়না এল তাদের বাসায়। হাসিখুশি মুখে নানা গল্প করল, কিন্তু আনন্দির কানে আটকে রইল শুধু এই কথাগুলো:
” উজান দা আগের মতোই আছে, না? সেই হাসি… সেই অভ্যাস… আমি তো এখনো ভুলতে পারিনি।”
আনন্দি চেষ্টা করেছিল হাসতে, কিন্তু ভেতরে একটা খচখচে অনুভূতি জমে উঠল।
এরপর সুনয়না কয়েকবার এল, কিছুক্ষণ থেকে চলে যেত। তবে প্রতিবারই কোনো না কোনোভাবে এমন কিছু কথা বলত, যা আনন্দির মনে অদ্ভুত এক সন্দেহ জাগিয়ে তুলত।
একদিন বলল,
“ জানো আনন্দি, কিছু কিছু কথা মানুষ শুধু প্রিয় কাউকেই বলে… সব সম্পর্কের তো নাম থাকে না, তাই না?”
আনন্দি এবার আর চুপ করে থাকেনি।
” সব সম্পর্কের নাম না থাকলেও সীমা থাকা উচিত। কিছু কিছু ইঙ্গিত মানুষকে ভুল দিকেও নিয়ে যেতে পারে।”
সুনয়না হেসে বলল,
“ তোমার মতো সাহসী মেয়ের মুখে সন্দেহের সুর শুনে ভালো লাগলো। সম্পর্ক তো বোঝাপড়ার জায়গা, না?”
আনন্দির চোখে-মুখে কিছু একটা ছিল, কিছু বলতে চাইল সে কিন্তু নিজেকে সামলে নিল।
.
.
কিছুদিন পরের কথা,
পান চিবোতে চিবোতো শর্মিলা দেবী উজানকে বললেন, ” তোমাদের ফোনে মধু আছে নাকি?”
” আবার কী হলো মা? ফোন তোমাকে কিছু করেছে?”
” তোমার বউও দেখি সারাদিন ফোনের দিকে তাকিয়ে তাকে। তুমিও বাড়ি ফিরলে দেখি ওই ফোনেই কুটকুট করো। কি সমস্যা তোমাদের?”
” আ… মা… ওসব কিছুই না। আমি একটু কাজে ব্যস্ত আছি। আর আনন্দিকে তো আমি ফোন চালাতে তেমন দেখলাম না। সারাদিনই তো এটা ওটা কাজ করে, না হয় পড়াশোনা করে।”
” তুমি দেখবে কী করে? তোমার নিজের চোখই তো ফোনে আটকানো থাকে।” উজান শুনল কিনা বোঝা গেল না। কোন পরিবর্তনই দেখা গেল না তার মাঝে।
.
.
.
স্থানীয় অনুষ্ঠানে সবাই জড়ো হয়েছে। ছোটোখাটো উৎসব, কিছু সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, গল্পগুজব। আনন্দি উজানের সাথে এসেছে। শর্মিলা দেবী নিজের পরিচিতদের সাথে গল্পে মশগুল। সুনয়নাও এসেছে। মেরুন রঙের শাড়ি, ঠোঁটে গাঢ়ো লিপস্টিক, চোখে কাজল। মিথ্যা নয়, সত্যি আজ তাকে বেশ সুন্দর লাগছিল।
সুনয়না মঞ্চ থেকে নেমে এলো। বসল উজানের সামনে থাকা চেয়ারটাতে, একেবারে মুখোমুখি।
” আমার পারফরমেন্স কেমন লেগেছে উজান দা?”
” বরাবরের মতোনই তোমার গানের গলা খুবই সুন্দর।”
” আমি জানতাম তোমার ভালো লাগবে। আমার শাড়িটা সুন্দর না? তোমার পছন্দের রং পড়েছি।” বলতে বলতে শাড়িটা ঘুরিয়ে পেচিয়ে দেখাতে লাগল।
উজান হেসে বলল,
” শাড়িটা বেশ সুন্দর। কিন্তু আমার পছন্দের রং তো মেরুন নয় বেগুনি।”
” কিন্তু তুমিই তো…” কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল সে।
” তোমাদের সাজেক ট্রিপের ছবিগুলো অনেক সুন্দর ছিল। কটেজের বারান্দা থেকে বাইরের দৃশ্যটা তো একেবারেই চোখ আঁটকে যাওয়ার মতোন।”
পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠল, ” হ্যাঁ আমিও উজানের প্রোফাইলে সাজেকের ছবি দেখলাম। কিন্তু সুনয়না তুমি এ ছবি কোথায় দেখলে? উজানের প্রোফাইলে তো দেখলাম না।”
সুনয়না লম্বা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ” দেখেছি কোনভাবে। কেউ আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দেখিয়েছে।” বলে হেসে উঠল সে। যেন অনেক মজার কোন কথা বলেছে৷
একটা গল্পের মাঝে হঠাৎই সুনয়না বলে উঠল,
” জানো আনন্দি উজান দা মাঝেমাঝে এতো মজার কথা বলে না, তার কিছু মেসেজ দেখে তো আমি অবাক না হয়ে পারি না। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হলে মনে হয় তার মধ্যে কোন অনুভূতিই নেই। একদম পুরো রস-কস বিহীন।”
আনন্দির গায়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। সে মুখ তুলে তাকায় উজানের দিকে।
উজান যেন থতমত খেয়ে গেল। আশে-পাশে বসে থাকা কয়েকজন কিছুই বুঝতে না পেরে উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইল। উজান হালকা গলায় বলে,
“সুনয়না, কোন আইডির কথা বলছ তুমি? আমি তো কখনোই তোমার সাথে ব্যক্তিতগত ভাবে কোন কথা বলিনি।”
এক মুহূর্তের জন্য যেন থমকে গেল চারপাশ। ফিসফিস শব্দ শোনা গেল চারিপাশ থেকে।
” উজান দা, তুমিই তো বলেছিলে, আমি যাই বলি না কেন, তুমি কোনোদিন ‘না’ বলবে না। তাই না?”
উজান আচমকাই উঠে দাঁড়াল। শান্ত তবে গম্ভীর কন্ঠে আদেশের সুরে সুনয়নাকে বলল,
” তুমি আমার সাথে এদিকে এসো।”
দু’জন কোলাহল থেকে দূরে নির্জন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল।
” তুমি আনন্দির সামনে সত্যিটা বলতে ভয় পাচ্ছিলে না?” বলে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল মেয়েটি। উজান আগের মতোনই গম্ভীর কন্ঠে বলল, ” সুনয়না আমি সামনাসামনিই কখনো তোমার সাথে বেশি কথা বলিনি তাহলে মেসেজে কি করে এতো রিপ্লাই দেব?”
” মানে? তুমি না? তাহলে কে?”
অন্ধকারের মাঝে তাকাল উজান। বেরিয়ে এলো আনন্দি, চোখে-মুখে অদ্ভুত এক চাপ। গুটিগুটি পায়ে উজানের সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখে কপাল কুঁচকে এলো সুনয়নার।
” সত্যিটা বলবে এবার?”
আনন্দি আমতো আমতো করে বলতে লাগল,
“আমি। ওই আইডিটা আমি খুলেছিলাম, উজানের নাম দিয়ে।”
সুনয়নার মুখ যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। উজান আগের মতোনই চুপচাপ দাড়িয়ে রইল।
” তুমি যাকে উজান ভেবে মেসেজ করছিলে, সেই প্রোফাইলটা আসলে আমি খুলেছিলাম। তোমার সব কথার উত্তর আমি দিয়েছিলাম।”
উজান খানিকটা বিষ্ময় নিয়ে বলল, “ তুমি… এখনো চালিয়ে যাচ্ছো কথোপকথন?”
আনন্দি মাথা নিচু করে বলল, “ তুমি আগেই জেনে গেছো, তাই না?”
উজান বলল, “ আমি শুধু জানতাম তুমি একসময় খুলেছিলে। কিন্তু এখনো কথা বলছো সেটা জানতাম না। কিন্তু সুনয়নার কথা শুনে আমার মনে সন্দেহ জাগল।”
আনন্দির কণ্ঠে কষ্ট ছিল, কিন্তু চোখে সাহস, ” হ্যাঁ, আমি চালিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতে চেয়েছিলাম, তুমি সত্যিই কি আজও কাউকে বিশেষ জায়গায় রাখেছ কিনা। আর সুনয়না তোমার ইঙ্গিত, তোমার উপস্থিতি, সবকিছু এতটাই ঘনীভূত করে তুলেছিল পরিস্থিতিকে, যে আমার মনে সন্দেহ জাগতে বাধ্য হয়েছিল।”
সুনয়না হালকা হেসে বলল,
“ বাহ, একে বলে নাটক! আমি তো ভেবেছিলাম, তুমি আমায় ভালোবাসতে শুরু করেছ উজান দা। এখন দেখি, তোমারই স্ত্রী তুমি হয়ে আমার সাথে অভিনয় করচ্ছিল! এমনকি তোমাকের একান্ত ট্রিপের দিনও আমার মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছিল।”
আনন্দির গলা কেঁপে উঠল,
“ তোমার ভালোবাসা বলে কিছু ছিল না। শুধু নিজের ইগো মেটানোর খেলা ছিল। আর আমি চেয়েছিলাম তোমার সেই ইগো টাকে ভাঙতে।”
উজান এবার শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ সন্দেহের ভিতর ভালোবাসা বাঁচে না আনন্দি। তুমি আমার কাছে আসতে পারতে, জিজ্ঞেস করতে পারতে। আমি না হয় তোমাকে একটু কম সময় দিতে পারছিলাম, কিন্তু আমি কখনো তোমার প্রতি অবিশ্বস্ত ছিলাম না। ”
আনন্দি এবার চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু চোখে জল জমে উঠেছে। সুনয়না এবার মুখ ঘুরিয়ে নিল।
” তোমার এই সাহসের জন্য সাধুবাদ জানাই।
তুমি নিজের স্বামীর নামে ফেইক আইডি খুলে, আমায় প্রতারিত করেছো? তাহলে তুমি আর আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আনন্দি, সত্যটা লুকিয়ে রাখতে পারো, কিন্তু মনের ভয় কখনও ঢাকতে পারো না। সম্পর্ক যখন বিশ্বাসে ভর করে না তখন তা টুনকো হয়ে যায়। কি অদ্ভুত খেলাটাই তুমি শুরু করেছিলে।”
এই কথাগুলো যেন ছিল নীল বি’ষের মতন ছিল আনন্দির জন্য। সে কখনোই ভাবতে পারেনি এভাবে সত্যিটা সামনে চলে আসবে।
ঘরে ফেরার সময় দু’জনেই চুপচাপ। গাড়ির মধ্যে শুধু সীটবেল্টের ক্লিক শব্দটা স্পষ্ট ছিল।
সেই রাতে উজান আর আনন্দির মধ্যে অদৃশ্য তীব্র ঝড় বয়ে যায়। উজান বলল,
” তুমি কেন আমায় কিছু বললে না? কেন এত বড় একটা খেলা খেললে?”
আনন্দি বলল, ” খেলা করিনি। ভাঙা মন নিয়ে একটা প্রতিরক্ষার দেয়াল তুলেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি…..”
” ভেবেছিলে আমি মিথ্যা বলছি? বিশ্বাসটা এতটাই দুর্বল ছিল তোমার? যে তুমি নিজেই ভুল পথে হাঁটছিলে?।”
” আমি ভুল করেছিলাম। আমার সন্দেহ, আমার আবেগ আমাকে ওখানে টেনেছে। তার থেকেও বেশি ছিল তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়। যখন তুমি আমাকে সময় দিতে না আমার মনে ভয় ঝেঁকে বসত, মনে হয়ত তুমি বুঝি ওর সাথে আছো। তাই আমি ওকে ব্যস্ত রাখতাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি ভালোবাসি বলেই…”
উজানের চোখেও তখন জল, তবে কণ্ঠে ক্লান্তি।
“ আমরা সাজেকে কথা দিয়েছিলাম যে মেঘের মাঝে হারিয়ে যাব, কিন্তু একে অপরকে হারাব না। কিন্তু আজ… আমি তো তোমার চোখে খুঁজেই পাচ্ছি না আমার সেই মানুষটাকে। তুমি আমাকে কখনোই বিশ্বাস করোনি।”
” বিশ্বাস কোনো জন্মগত বিষয় না উজান। সেটা তৈরি হয়, ভাঙেও আবার। তুমি কি সত্যিই বলতে পারো, তুমি কোনো ইঙ্গিত দাওনি তাকে? কখনো কি আমার সন্দেহ না হওয়ার মতোন পরিষ্কার উওর দিয়েছ?”
উজান কিছু বলল না। আনন্দি নীচু গলায় বলল, “ তুমি আমায় একটুখানি সময় দাও… হয়ত আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাবো… আমাদের খুঁজে পাবো।”
চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দু’জন।
উজান বলল, ” তবে কথা দাও, ভবিষ্যতে সন্দেহ তুমি কোনো কিছুর নিজের ভেতর লুকিয়ে না রেখে আমায় জানাবে। সন্দেহ আমাদের মাঝে নিজের জায়গা করে নেওয়ার আগেই তুমি আমাকে বলবে। আমরা দুজনেই মানুষ। ভুল হবেই। কিন্তু যদি ঠিকঠাক কথা বলি, তাহলে হয়তো সেই ভুলে বিভ্রান্তি আসবে না।”
আনন্দি তার হাত ধরে কাঁধে মাথা রাখল। একটা দীর্ঘ নীরবতা। তারপর শুধু বাতাসের শব্দ।
সাজেকের সেই সকালের মতো ঠান্ডা হাওয়াটা আবার কেমন যেন বুকের ভেতর দিয়ে চলে গেল…
আনন্দি জানে, সম্পর্ক মানেই নিখুঁত হওয়া নয়—বরং সে হয়তো একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে এক গভীর সত্য, এক অনিঃশেষ টান। একটা অসম্পূর্ণ বিশ্বাস, কিছু ভুল শব্দ আর একটা ভাঙা মুহূর্ত নিয়ে রাতটা শেষ হলো।
চলবে…..