সংসার নাকি সম্মান পর্ব-১৬+১৭

0
2

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৬
#অনন্যা_অসমি

সকালের রোদ গাল ছুঁয়ে গেছে, ঘরজুড়ে একটা থমথমে পরিবেশ। শর্মিলা দেবী আজ অন্যরকম। গলায় সেই চেনা তেজী সুরটা নেই, চোখেমুখে ছুটোছুটি করছে যেন একটু উত্তেজনা, একটু ভীতির আভাস আবার খানিকটা গম্ভীরর্যতা।

উজান আজ ফিরছে না। ফিরেছে তার বাবা, বেশ অনেকদিন পর ঘুরেফিরে কাল সন্ধ্যার দিকেই ফিরেছেন তিনি। কিছুদিন আগেও সময়ে অসময়ে শর্মিলা দেবীর কন্ঠ শোনা যেন। কাল থেকে তাও নেই, হঠাৎই বাড়িটা আনন্দির কাছে এক নিস্তব্ধপুরীতে পরিণত হয়েছে৷

বিকেলে খাওয়া শেষে আনন্দি একটু শুয়েছিল। মাত্রই চোখটা লেগে এসেছে তখনই বেলটা বেজে উঠল। পরপর বেশ কয়েকবার বাজল, আনন্দির চেয়েও যেন চোখটা খুলল না। কিছুসময় পর পায়ের শব্দ কানে এলো তার।

বসার ঘর থেকে বেশ কয়েকটি স্বর শোনা যাচ্ছে। না চাইলেও আনন্দির ঘুম হালকা হয়ে গেল। না, এভাবে শুয়ে থাকাটা বেমানান লাগছে তার কাছে। অনিচ্ছা স্বত্বেও উঠে বসল সে৷ পড়নের পোশাক ঠিক করে বেরিয়ে এলো।

সে ছাড়া বাড়ির সকলেই বসার ঘরে। সোফায় একজন অচেনা মধ্যবয়স্ক মহিলা বসে আছেন। আনন্দি ধীরে পায়ে এগিয়ে এলো।

” এটাই আমাদের উজানের বউ নাকি? বাড়িতে অতিথি এসেছে আর বাড়ির বউ এতো সময় পড়ে এলো।”

” মা উনি কে?” মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল আনন্দি।

” তোমার পিসি শাশুড়ি, পুষ্প।”

” শাশুড়ীর সাথে এতো কী ফিসফিস করছ বউ? শলাপরামর্শ শেষ হলে এদিকে এসো।”

আনন্দি এগিয়ে এলো। পুষ্প পিসি পা দু’খানা বাড়িয়ে দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন,

” বড়দের যে পা ধরে প্রণাম করতে হয় কেউ শেখাইনি তোমাকে?”

আনন্দি দ্রুত ওনার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

” এ কী পোশাক তোমার? শাড়ি কোথায়? মাথার ঘোমটাও তো ঠিক মতো দাওনি। এভাবে আধুনিক হয়ে সংসার হয় না বুঝেছ? সৌজন্য রাখতে হয় ঘরের বউকে। অবশ্য কাকেই বা বলছি। সংসারের কর্তী ঠিক না থাকলে ঘরের মানুষ কি আর ঠিক থাকে?”

আনন্দি একটু থমকে গেলেও মুখে কিছু বলল না। কিন্তু শর্মিলা দেবী কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন এখুনি তাকে ঝলসে দেবে। এই পুরো সময় উদয় এবং তাদের বাবা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছে।

সেই বিকেলে আর আনন্দির বিশ্রাম নেওয়া হলো না। শর্মিলা দেবীর হাতে হাতে বিভিন্ন কাজ করতে লাগল।

পুষ্পা দেবী একের পর এক আদেশসূচক কথা বলেছেই চলেছেন।

” এই কাপগুলো পাল্টাও। এই পর্দার রঙ একদম চোখে লাগছে। এই সপ্তাহেই পাল্টে ফেলবে। সোফার কভারও কিরকম, একদম রুচি নেই দেখছি তোমাদের।” ইত্যাদি ইত্যাদি৷

আনন্দি ধীরে ধীরে সব কাজ করতে লাগলো। একসময় ঘর থেকে সে শুনতে পেল পিসি শর্মিলা দেবীকে বলছেন, ” শোন বউ, আজকালকার মেয়েগুলোর ধৈর্য কম। একটু কিছু বললেই মুখ ভার করে। একদম সব মেনে নেবে না, ছাড় দিয়ো না। ছেলের ঘরে বউ এলে মা যেন তার জাগা না হারায়। ওদের চোখে চোখে রাখতে হয়। নইলে পরে পস্তাতে হবে। তোমার সাথে সাথে আমার ভাইটাও তখন ঘরদোর হারা হবে।”

রান্নাঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আনন্দি নিঃশব্দে সব শুনছিল। আজ তার মনে হচ্ছিল, সে বাড়ির একটা অংশ হলেও যেন আবারো সব অচেনা হয়ে যাচ্ছে। যেন কেউ একা করে দিচ্ছে তাকে, ধীরে ধীরে। তবে… আনন্দি ভেবেছিল শর্মিলা দেবীও নিজের ননদের সাথে সায় দেবেন কিন্তু উনি যেন আজ নীরব রইলেন। প্রতিউত্তরে কিছুটি বললেন না।

আজ সন্ধ্যার পূজা পুষ্প পিসিই দিলেন। শর্মিলা দেবী এবং আনন্দি ওনার পাশে বসে এটা ওটা এগিয়ে দিল।

পূজা শেষে শর্মিলা দেবী রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। আনন্দি এগিয়ে এসে বলল,

“ মা, আমি নাস্তা বানিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটু বিশ্রাম নিন।”

পেছন থেকে পুষ্প পিসির কন্ঠ ভেসে এলো,

“ না না, ওর হাতে চা দিলে আবার স্বাদ থাকবে না। এখনকার মেয়েরা তো চায়েও ইনস্টাগ্রামের ফিল্টার মেশায়।”

আনন্দি স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। শর্মিলা কিছু না বলেই পেছন ঘুরে গেলেন।

” চা, পিসি মা।” কাপ হাতে এগিয়ে দিল আনন্দি।

” তোমাকে না বলেছি আমি বউয়ের হাতের চা খাবো।”

” আমি বানাইনি পিসি মা, মা’ই বানিয়েছেন। আমি নিয়ে এলাম শুধু।”

পুষ্পা দেবী চায়ের কাপটা নিয়ে বললেন,

” তুমি এই চায়ের মতো গরমগরম আচরণ করো কিনা কে জানে! তবে কাপটা তো সুন্দর! অবশ্য আমার ভাইয়ের কেনা বলে কথা। কি জানে বাবা, বউ চা বানানো ভুলে গিয়েছে কিনা। বলা যাই না, কারো কোন বিশ্বাস নেই।”

আনন্দি আড়চোখে দেখল। বেশ আয়েশ করেই চা পান করছেন তিনি। সে যাবে না দাঁড়াবে এই ভাবনার মাঝেই পুষ্পা দেবী প্রশ্ন করলেন,

” তোমরা সাজেক গেছিলে না? কি দরকার ছিল এতো ঘোরাঘুরির? সংসারটা নতুন, আগে একটু গুছিয়ে নাও।”

আনন্দি শান্ত গলায় বলল,
“আমরা একটু সময় কাটাতে চেয়েছিলাম, উজান তো খুব কম সময় থাকে। তাই ভেবেছিলাম, একটু দূরে গিয়ে কিছু সময় নিজেরা উপভোগ করি।”

পুষ্পা দেবী হেসে বললেন,

” সেই নিজের সময়ের মধ্যেও তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি তোলা, সাজগোজ, এসব ছাড়া চলে না। সাজগোজ করে ছবি তোলা আর সংসার করা আলাদা কথা। এখনকার মেয়েরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভালবাসা খোঁজে, বাস্তবে সংসার টিকিয়ে রাখার ক্ষমতা থাকে না।”

আনন্দির মুখে সে মুহূর্তে ভাষা ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, তার ভুলটা কি ছিল শুধুই একটু ভালোবাসা চাওয়া?

” শোন মেয়ে এখন থেকেই একটু একটু টাকা জমানো শুরু করো, কম খরচ করো। ভবিষ্যতের বাচ্চার জন্য জমানো শুরু করো।”

আনন্দি আর সহ্য করতে না পেরে অযুহাত দিয়ে সেখান থেকে সরে গেল।
.
.
.

বাড়িতে গরম গরম লুচি আর আলুর দম বানানো হচ্ছে, পুষ্প পিসি নাকি রাতে তাই খাবেন। আনন্দি রুটি বেলছিল। শর্মিলা দেবী ফিসফিস করে তাকে বললেন, ” দিদির সামনে বেশি কথা বলবে না। পুষ্পাদি যা বলে, তেমন করবে। বুঝেছো তো?”

আনন্দি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। ভিতরে ভিতরে সে অনুভব করছে, আমচকা এই বাড়িতে পুষ্পা দেবীর ছায়া যেন একটা ভারী পাথরের মতো সবকিছুকে চেপে ধরেছে।

উজানের বাবাকে দেখে আনন্দির ভালোই লাগছিল। মানুষটা হাসিখুশি, গল্পপ্রিয়, অনেকদিন পর ঘরে একটা প্রাণোচ্ছল গলা ফিরে এসেছে যেন। কিন্তু পুষ্প পিসির সামনে তিনিও যেন কেমন চুপচাপ হয়ে যান। কথার মাঝে বারবার বলেন,
” দিদি ঠিক বলেছে… ওর মত অভিজ্ঞতা কার আছে…”

পুষ্প দেবী খানিকটা সিংহাসনে বসা রাজার মতই সবার সামনে নিজের বিচার দিয়ে যাচ্ছেন।

ডাইনিং টেবিলে বসে পুষ্প দেবী মুখ কুঁচকে বললেন,

” আলুর দমে ফোঁড়ন কম পড়েছে। কে রান্না করেছে?”

শর্মিলা দেবী একটু অপ্রস্তুত, “আনন্দি করেছে…”

” হুঁ, বুঝেছি। এখনকার বউরা রান্না না, ফোন আর ফ্যাশন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রান্নার গন্ধেই বোঝা যায় কেমন বউ। তোমার গায়ে তো বউয়ের ঘরোয়া গন্ধটাই নেই। টিকবে তো সংসারে?”

আনন্দির গাল শক্ত হয়ে ওঠে। সে জবাব দেয় না, কিন্তু তার চোখে একটা চুপচাপ আগুন জ্বলে উঠেছে তবে মুখে হাসি।

খাবারের এক পর্যায়ে পুষ্পা দেবী বলেন,

” তা বউ তুমি যে ছেলের বউকে এখনো নিজের কাছে বেঁধে রেখেছ, ছেলে থাকে এক মাইল দূরে। এটা কোন সংসার? বউ তোমার ছেলের সাথে না থাকলে নাতি-নাতনির মুখ তোমার আর দেখা হবে না এইজন্মে। আমাদের তো শেষ বয়সে বংশের বাতি দিলে, ছেলেরবেলায় আবার তেমন করো না। আমরা বলেই সহ্য করেছিলাম, অন্য কেউ হলে সেই কবেই বিদেয় করে দিত।” থামলেন তিনি, আলুরদম দিয়ে লুচি ছিঁড়ে খেলেন। এই নীরবতাটা টেবিলে একটা ভারী পরিবেশ তৈরি করেছিল। আনন্দি চোখ ঘুরিয়ে বাকি সবাইকে দেখল। তার মতো সবাই বেশ অপ্রস্তুত বোঝাই যাচ্ছে। আরো একবার শশুড়ের দিকে তাকাল আনন্দি। তিনি নির্বিকারে খেয়েই চলেছেন, সম্পূর্ণ মনোযোগ তাঁর প্লেটের দিকে। যেন এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কোন কাজ নেই বর্তমানে। পুষ্প পিসি মুখের খাওয়া শেষ করে আবার বললেন,

” শোন বউ উজানকে বলবে ও যেন বাড়ির আশেপাশে চাকরি নেয়। বউয়ের সঙ্গে সংসার না হলে সম্পর্ক থাকবে কোথায়? ছেলে-বউকে একসাথে কাছে রাখবে, চোখে চোখে রাখবে। আজকালকার যুগ ভালো নেই, এই যুগের মেয়েছেলেদের বিশ্বাস করতে নেই। কি হলো বুঝেছ?”

শর্মিলা দেবী নতমুখে মাথা নাড়লেন। আনন্দির মুখ থমথমে। ওনার প্রস্তাবটা তার জন্যই ভালো, সে তো এটাই চাইছিল এতোদিন ধরে। তার এখন খুশী হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু কেন যেন সে হতে পারছে না। হয়ত পুষ্প পিসির কথার ধরণে!
.
.

উজানের বাবা অনেকটা গম্ভীর চেহারার হলেও, কথা বলেন সহজ স্বরে। বোনের সঙ্গে বেশ গল্প করছেন তিনি। রাতে খাওয়ার পর নিজ থেকেই জানতে চাইলেন,

” আনন্দি, শুনেছি তুমি ভার্সিটি যাও? আজ গেলে না কেন?”

সে উওর দেওয়ার আগেই পুষ্পা দেবী হইহই করে উঠলেন।

” ওসব পড়াশোনা দিয়ে সংসার চলে না। ভার্সিটি যাচ্ছো ঠিক আছে কিন্তু ঘরের দায়িত্ব আগে। বাড়ির বউ হয়েছো, শুধু নিজের শখপূরণ করলেই হবে না। বাড়ির মানুষেরও খেয়াল রাখতে হবে।”

আনন্দি এবার সরাসরি চোখে তাকাল, ” পিসি মা আমি চেষ্টা করি দুটোই সামলাতে। এখানে থাকাকালীন কখনো যদি কিছু কম মনে হয়, আপনি বলতে পারেন। কিন্তু কাজের মাপ কেবল ঘোমটা আর ফোঁড়ন দিয়ে হয় না। একটা সংসার চালানোর জন্য, বাচ্চার জন্যও একজন শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। পড়াশোনা না জানলে পড়ে আবার খোঁটা শুনতে হতে পারে।”

ঘরে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। শর্মিলা দেবী যেন ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন। পুষ্পা দেবী ঠোঁট চেপে বললেন,

” আজকালকার মেয়েরা পাল্টে গেছে… জবাব দেওয়া শিখেছে, ভালোই। দেখো আবার দেমাখ দেখাতে গিয়ে সংসারটাই না আবার উড়ে যায়।”
.
.

রাতে শোয়ার আগে উজানকে ফোন করল আনন্দি। কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল সে।

উজানই প্রথম বলল, ” আজ অনেক ব্যস্ত ছিলাম, বাড়ি এসে শরীরটা যেন আর চলে না। তোমার কণ্ঠ শুনে কেমন ক্লান্ত লাগছে। শরীর ঠিক আছে তোমার?”

আনন্দি বলল, ” তোমার পিসি এসেছেন, জানো?।”

” হ্যাঁ, মা বলেছেন। কেমন লেগেছে তোমার?”

” কেমন আর লাগবেন? ভালোই। শুধু একটু বেশি ভুলের রচনা তৈরি করেছেন। আর আমায়…”

” আমি জানি, পিসি একটু কঠোর। তুমি বেশি কিছু বলো না, নিজেকে শান্ত রেখো প্লিজ। বেশ কিছু বললে মাকে বলো, মা সব সামলে নেবে আশা করি।”

” তোমার মা কি সামলাবেন? তিনি নিজেও যেন আজ মুখে তালা মেরে রেখেন।” মনে মনে বলল সে। চোখের কোনে জল জমে উঠল। সেই রাতে, নিঃশব্দে কেবল একটা ভাবনাই তাকে গ্রাস করছিল, সে কি সত্যিই এই ঘরের বউ, নাকি শুধুই এক অতিথি? সংসারে খানিকটা ভালোবাসা, সম্মান অর্জন করতে শুরু করেছিল সে, কিন্ত তা যেন পুরোপুরি দেখা পাওয়ার আগেই পালিয়ে গেল।

চলবে……

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৭
#অনন্যা_অসমি

এ বাড়িতে শোয়ার ঘর মোটে তিনটা। একটাতে আনন্দি থাকে, অন্যটাতে তার শাশুড়ী। উদয় আসার পর বাকিঘরটা তার হয়ে গেল। পুষ্প পিসি কোথায় থাকবে সেই প্রশ্ন উঠতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তিনি নাকি উদয়ের ঘরে থাকবেন।

দরজার ঠকঠক শব্দে আনন্দি ফোন কেটে দরজা খুলে দিল।

” তোমাকে না বলেছি আমি তোমার সাথে থাকবে? তো দরজা দিলে কেন?”

” উজানের সাথে কথা বলছিলাম মা। আসুন আপনি।” সরে দাঁড়াল সে। আজ রাতটা শর্মিলা দেবী আনন্দির সাথেই থাকবেন। আর উদয় থাকবে তার বাবার সাথে ওনাদের রুমে।

বিছানায় এসে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়ল মেয়েটা। বিকেলে বিশ্রাম নিতে না পারা, সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ সব মিলিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই তার চোখ লেগে গেল।
.
.

মৃদু শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আনন্দির। পিঠ পিঠ করে চোখ খুলে দেখল শর্মিলা দেবী তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

ঘুম জড়ানো কন্ঠে জানতে চাইল, ” কি হয়েছে মা? আপনার শরীর খারাপ লাগছে?”

” আমার শরীরে চিন্তা আপাতত তোমাকে করতে হবেনা। এখন ওঠো, মুখ হাত ধুয়ে রান্নাঘরে এসো।” বলেই প্রস্থান করলেন তিনি। আনন্দি ধীরেসুস্থে উঠল। ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই দেখল মাত্র সাড়ে ছয়টা। কপাল কুঁচকে গেল তার। শর্মিলা দেবী যতই কঠোর হোক কখনো তাকে এতো সকালে ডেকে তোলেননি। তার প্রয়োজনও খুব একটা হয়নি৷ মোটে তারা দু’জন ছিল, এরপর উদয় এলেও এই রুটিনে কোন পরিবর্তন হয়নি। সে নিজেই বেলা করে উঠত। এসব ভাবতে ভাবতে ব্রাশ করে ঘর থেকে বের হলো। রুম থেকে বের হতেই তার প্রশ্নের উওর পেয়ে গেল সে৷

বসার ঘরেই পুষ্প পিসি বসে আছেন, হাতে ওনার মালা।

” কি বউ? তোমার চুল শুকনা কেন? স্নান করোনি?”

” পিসি মা এতো বেলা করে স্নান করলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

” বা… বা… সাড়ে ছয়টা বাজে, এটাও তোমাদের জন্য এতো সকাল! আমাদের সময় বাড়ির বউরা পাঁচটায় উঠে স্নান করে পূজা দিত। আধুনিকতার নামে সব ভুলে যাচ্ছে আজকালকার মেয়ে গুলো।”

” ভোর পাঁচটা উঠে, কনকনে শীতেও ঠান্ডা পানি দিয়ে স্নান করে পূজা দিতাম আমি। অবশ্য বাড়ির বাকিরা তখনো কম্বলের ভেতরেই থাকতো। দেখো, এখনো ঠিকই আছি, ঠান্ডায় জমে মা’রা যাইনি৷ শুধু একটু জ্বরে কী কেউ মারা যাই?” বলল শর্মিলা দেবী। আনন্দি শান্ত চোখে শাশুড়ীর দিকে তাকাল। ওনার কন্ঠটা ছিল নিষ্প্রাণ, কথাগুলো বলার সময় যেন সেই কন্ঠে লুকায়িত বেদনা, হাহাকারের স্পর্শ ছিল৷ আনন্দি জানে না, আসলেই তার ভাবনা সঠিক কিনা। নাকি শুধুই তাকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন তিনি!

” দেখলে তো? আপনাদের পরিবার হলে এই দস্যিপনা কখনোই প্রশয় দিত না। কাল থেকে ভোরে ভোরে উঠে স্নান করে ঘরের কাজে লেগে পড়বে।”

সময়ের সাথে সাথে সকালের আলো ঠিকরে পড়ছে জানলার ফাঁক দিয়ে। কিন্তু এই আলোয় উষ্ণতা নেই। বরং যেন কেমন কড়ামাঠ ভাব। বাড়ির পরিবেশটাও তেমনই—নির্বাক, গম্ভীর আর অদৃশ্য কোনো নিয়মে বাঁধা।

রান্নাঘরের কাজ শুরু হয়ে গেছে বহুক্ষণ। আনন্দি চুপচাপ পরোটা বেলছে। পুষ্প পিসি সকালেই আদেশ দিয়ে রেখেছেন, “ আজ পরোটা করো। সাথে পনিরটা একটু ঝাল করে করবে, বুঝলে?”

এর আগে সকালে কখনোই এতো ভারী খাবার খাওয়া হতো না। চা, বিস্কিট, পাউরুটি এসবই খেতো তারা। তবে পিসির আদেশ তো আর ফেলা যায় না।

শাশুড়ি চুপ করে ফ্রিজ থেকে পনির বার করে দিলেন, কিছু বললেন না। মুখে যেন একরকম অসহায়তা লুকোনো। আনন্দি বুঝতে পারল এই বাড়িতে আজকাল কথা নয়, চুপ থাকাটার প্রচলনটাই বেশি।

আনন্দি একটু দ্বিধায় বলল, “ মা, কাল রাতের পনিরটা বোধহয় একটু টক হয়ে গেছে…”

শাশুড়ি একবার চোখ তুলে তাকালেন। মুখে বলেননি কিছু, কিন্তু সেই দৃষ্টিতে একরকম সতর্ক সংকেত। আনন্দি বুঝে গেল, আজকের রান্না নিয়েও কিছু না বলাই ভালো।

পিছন থেকে পুষ্প পিসির গলা, “ তোমরা তো দেখি কিছুই জানো না! পনির টক হলে নুন-মরিচে ভেজে নাও, তাতেই ঠিক হয়ে যাবে। এত তাল-বাহানা করার কী আছে?”

আনন্দি চুপ করে গেল। মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই, কেবল হাতে লেগে থাকা পরোটা বেলার ময়দাটাই একটু বেশি শক্ত করে চেপে ধরল। তার ভেতরকার ক্লান্তি যেন সেই ময়দায় ছড়িয়ে গেল।

পরোটা বানানোর সময় হঠাৎ তাওয়া থেকে তেল ছিটকে হাতে লাগল। ব্যথায় একটু কেঁপে উঠল আনন্দি। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার
মুখে হাসি নিয়ে কাজে মন দিল। ভাবল, যাক! অন্তত মুখের হাসিটুকু এখনো নিজের মতো রাখা যায়।

শাশুড়ি ফিসফিস করে বললেন, “ একটু সাবধানে কর না, তোমার এই ছোটোখাটো জিনিসগুলো দিদিন নজরে পড়বে। এরপর তুমি কেমন সংসারী, সেটাই প্রশ্ন উঠবে।”

আনন্দি হেসে বলল, “ আমি কেমন সংসারী, সেটা তো প্রশ্ন উঠেই গেছে মা। চেষ্টা করেও হয়তো আমি ভুলটাই করছি কোথাও।”

শাশুড়ি কোনো উত্তর দিলেন না।

দুপুরবেলা খাওয়ার পর, পুষ্প দেবী শুয়ে পড়ার আগে আবারও কিছু কথা বললেন,

” শোন মেয়ে, দুপুরে একটু আমার পা টিপে দেবে। আমার পায়ের হাড়ে খুব ব্যথা। বয়সে এসে বুঝলে, হাড়ের ব্যথা সবচেয়ে অবহেলিত কষ্ট। পারো তো পা টিপতে? নাকি ওই তাও জানো না? অবশ্য আজকালকার মেয়েরা এসব করতে চায় না।”

আনন্দি কিছু না বলেই এগিয়ে গিয়ে ওনার পা টিপে দিল।

পুষ্প দেবী বলতে থাকেন, “ পড়াশোনা করো ভালো কথা। কিন্তু বল তো, গৃহিণীর আসল পরিচয় কী? সে রান্না জানে, ঘর সামলায়, শ্বশুর-শাশুড়ির যত্ন করে, স্বামীর ইচ্ছে পূরণ করে এই না? কাগজের পাতার কথায় সংসার চলে নাকি?”

আনন্দি শান্ত গলায় বলল, “ সংসার চলার জন্য তো মনেরও দরকার পিসিমা। মনটা হাঁপিয়ে গেলে লেখাপড়া তো দূর, রান্নাটিও হয় না ঠিক করে।”

পুষ্প দেবী একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ আর অত মন-টন বলো না। আমরা কি মন ছাড়া সংসার করিনি? আমরা পারলে তুমি পারবে না কেন?”

আনন্দি চুপ করে থাকল। এই প্রশ্নের উত্তর সে বহুবার নিজের মনেই খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। পা
টিপতে টিপতে ধীরে ধীরে চোখ যায় ঘড়ির কাঁটার দিকে। নিজের পড়ার সময়, বিশ্রামের সময় সব যেন কোথাও আটকে গেছে এই অবাঞ্ছিত দায়বদ্ধতার জালে।

একসময় পুষ্প পিসির চোখ লেগে এলো, আর আনন্দি ধীরে ধীরে সরে গেল।

মুঠোফোনটা হাতে নিল সে, একটা বার্তা লিখল।

“ মা, একটু কথা বলতে চাই। একা লাগছে খুব।”
কিন্তু পাঠাল না, মুছে ফেলল আবার।
.
.

বিকেলে ড্রয়িংরুমে বসে পুষ্প দেবী পুরনো অ্যালবাম খুলে বসেন। উজানের ছোটবেলার ছবিগুলো বের করে এক এক করে দেখছেন, “এই দেখ, ছেলেটার মুখে কী মিষ্টি হাসি ছিল! আর এখন? ফোন হাতে হাতে শুধু বউয়ের কথা শুনে বেড়ায়।”

আনন্দি পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কানে যাচ্ছিল সব, কিন্তু কিছু বলল না।

একসময় শশুরমশাই এসে হেসে বললেন, “হাসি তো তখনও ছিল, এখনও আছে দিদি। ছেলে খুশি থাকলেই বউ খুশি থাকে আর বউ খুশি থাকলেই ছেলেও হাসে। এটাই তো এখনকার নিয়ম।”

পুষ্প দেবী একটু থমকালেন। তারপর বললেন, “তাও তো ঠিক। তবে আজকালকার মেয়েদের বাড়ির কাজ শেখাতে হয় বেশি।”

শর্মিলা দেবী একটু শান্ত গলায় বললেন:
“দিদি, মেয়েরা আজকাল অনেক কিছুই শেখে। শুধু রান্নাঘর না, জীবনটাকেও। আনন্দিও চেষ্টা করে, প্রতিদিন রান্নাঘরে আসে, আমার সাথে সব কাজ শিখছে। সময়ের সাথে সাথে শিখে যাবে সব।”

পুষ্পা দেবী চোখ সরু করলেন, যেন বুঝতে পারছেন শর্মিলা এখন একটু অন্য সুরে কথা বলছেন।

.
.

সন্ধ্যা নামতে না নামতেই পুষ্পা দেবী আবার মন্তব্য ছুঁড়ে দিলেন, ” আধো তুমি সংসারে মন দাও? বিয়ের পর পড়াশোনা করে কী হবে? চাকরি তো আর করবে না। শুধু শুধু আমার ভাইপোর টাকাগুলো নষ্ট৷”

আনন্দি মাথা নিচু করে বলল, “ আমি চেষ্টা করি দুটোই সামলাতে। টিউশন ফি উজানকে দিতে হয়না, বাচ্চাদের পড়িয়ে আমি নিজেই তা জমা দেই। সময় দিলে সবই চলে যায়, সংসারও, স্বপ্নও।”

পুষ্পা দেবী চোখ সরু করে তাকিয়ে বললেন, “আর যদি না যায়? তখন কি শুধু সময়কেই দোষ দেবে?”

আনন্দি আর কিছু বলল না। কথার প্রতিটা চাবুক মনে হচ্ছিল যেন রক্তাক্ত করে দিচ্ছে মনটা।

তিনি আবারো চোখ কুঁচকে বললেন, “সংসার সামলে আগ্রহ থাকলে ভালো। কিন্তু দুই নৌকায় পা দিলে তো মাঝপথেই ডুবে যাবে।”

আনন্দি এবার মাথা উঁচু করে বলল, “ আমি চেষ্টা করি পা না ভেজানোর, পিসিমা। কিন্তু অনেক সময় চারপাশ এমনভাবে টেনে ধরে যে পা তো নয়, মনের ভিতরটাও ভিজে যায়।”

একটা মুহূর্তের জন্য ঘরে নিস্তব্ধতা। তারপর পুষ্প দেবী হেসে বললেন, ” বেশ ভালোই কথার প্যাঁচ জানো দেখছি।”

রাতের খাওয়ার সময় পুষ্প দেবী বলে উঠলেন, “এই মেয়ে, তুমি কদিন নিজের বাড়ি গিয়ে থাক না? তোমার মা নিশ্চয়ই তোমাকে একটু সংসারের নিয়মকানুন শেখাবে। আবার ফিরে এসে নতুন করে শুরু করো।”

আনন্দির গলায় বিস্ময়, “ আমাকে পাঠিয়ে দেবেন?”

পুষ্প বললেন, “হ্যাঁ, এতে সমস্যা কোথায়? আমরা তো সবাই এমনই করেছি। একসময় আলাদা থাকলেই বোঝা যায় সংসারের মানে। মায়ের কাছ থেকে সংসারের নিয়মও শেখা হবে তোমার।”

আনন্দি এবার রূঢ় কিছু কথা বলতে চাইল। কিন্তু বয়সে বড় দেখে বলল না, পরে বেয়াদব সম্মোধন করতেও তিনি দ্বিধা করবেন না।

শর্মিলা দেবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এবার বললেন:

“দিদি, ঘর করতে হলে আলাদা পাঠানোর থেকে পাশে দাঁড়িয়ে শেখানোই ভালো। আমি চাই না আনন্দি নিজেকে পর মনে করুক। নিজের ঘরটা তার ভালোবাসার জায়গা হোক।”

পুষ্পা দেবী একটু রুক্ষ গলায় বললেন, “তোমার ছেলের ঘর, ভালোবাসা তো ওকে ছেলের দিক থেকেও পেতে হবে।”

শর্মিলা এবার একটু দৃঢ় গলায় বললেন,

“তাই তো বলছি। সম্পর্ক দু’পাশ থেকেই তৈরি হয়।সে তো শুধু বউ নয়, মানুষও। তারও অনুভূতি আছে, স্বপ্ন আছে।”

আনন্দির চোখে জল জমে। সে কিছু বলে না। কিন্তু ভিতরে যেন একটু ভরসা জন্মায়।

রাত গভীর। আনন্দি জানলার পাশে দাঁড়িয়ে। বাইরে ছড়িয়ে আছে হালকা জ্যোৎস্না। সেই আলোয় নিজের মুখটা আয়নায় দেখে মনে হলো, অনেকগুলো প্রশ্ন জমে গেছে চোখের কোণে।

সে ফোনটা তুলে উজানকে কল করল। ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলা, “ আনন্দি, আজ খুব ক্লান্ত আমি। অফিসে অনেক চাপ। তুমি কেমন আছো বলো তো?”

আনন্দি ধীরে ধীরে বলল, “তোমার পিসি আজ বললেন আমাকে মায়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। নাকি আমি সংসারের বিষয়ে ভালো করে জানি না। তুমি কী বলবে?”

উজান একটু থেমে বলল, “আনন্দি, এখন এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি ফিরলে কথা বলি?”

আনন্দির গলায় কষ্ট, “তুমি ফিরবে, তার মানে কবে? আর ফিরলে সত্যিই কথা বলবে তো? নাকি আবার মায়েদের, পিসিদের সামনে আমিই দোষী হয়ে থাকব?”

উজান বলল, “তুমি আবার শুরু করো না তো। একটু সময় দাও। আমি ফিরলে সব সামলে নেব।”

আনন্দির গলায় এবার একটু কাঁপুনি, “ তুমি সামলাবে? তুমি কি কখনো পাশে ছিলে, উজান? আমি শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই—তুমি আদৌ আমাকে নিজের স্ত্রী বলে ভাবো তো? নাকি এই বাড়ির অতিথি ভাবো?”

সে আবারো ঠাণ্ডা গলায় বলল, “সময়ের মধ্যে আমি হারিয়ে যাচ্ছি, উজান। তুমি হয়তো বুঝছ না। এই দূরত্ব না জানি এতোটা বেড়ে যায় যে একসময় আমাদের সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যায়। তখন ছেয়েও আর তা জোড়া লাগালো সম্ভব হবে না।”

ফোনের ওপাশে দীর্ঘ নীরবতা। উজান চুপ।

তারপর আনন্দি নিজেই বলল, “ থাক, উত্তর দিও না। আমি বুঝে গেছি।”

আনন্দি ফোনটা কেটে দিল। ধীরে ধীরে ফোনটা বিছানায় রেখে দিল। ঘরে নিস্তব্ধতা ফিরে এল। কিন্তু মনের মধ্যে ঝড় থামল না। গাল বেয়ে নীরবভাবে নেমে এল দু’ফোঁটা জল।

রাতের ঘরটা নিঃসাড়। বাইরের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে একটু একটু করে। আলো-ছায়ার খেলায় আনন্দি নিজেকে খুঁজে পায় না।

আসে পাশে এত লোক, এত কথা। তবুও মনে হয়, এই ঘরের দেয়ালগুলো ছাড়া কেউ ওকে সত্যিই শুনছে না। সম্মানের জন্য লড়াইটা বড্ড একার।

চলবে……