#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৮
#অনন্যা_অসমি
রাত সাড়ে দশটা। মনটা অদ্ভুত রকম ভারী লাগছিল আনন্দির। ঘুমানোর চেষ্টা করেও ঘুম আসছিল না তার। বাইরে চাঁদের আলো, কিন্তু মনে যেন কালো মেঘেরা ঘর করেছে। একসময় উঠে জানালার পাশে বসে পড়ল সে। মায়ের নম্বর ডায়াল করল। তিনটে রিংয়ের পর ওপাশ থেকে পরিচিত, মমতাময়ী গলা ভেসে এলো।
“ আনন্দি, কেমন আছিস মা?”
” মা, ঘুমাওনি তুমি?”
” না রে মা, তোর শরীর ভালো আছে তো? এতো রাতে ফোন করলি! কণ্ঠটা এমন লাগছে কেন?”
আনন্দি ঠোঁট চেপে ধরে চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করল। কম্পন স্বরে বলল, ” ভালো আছি মা, খুব ভালো আছি। বেঁচে আছি আমি।”
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। মা বললেন,
” তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে রে। কবে আসবি?”
“ যদি এইভাবেই চলে… হয়তো খুব তাড়াতাড়িই।”
” তুই ভালো থাকলে, তোর কন্ঠ কাঁপছে কেন? মাকে মিথ্যা কথা বলিস না আনন্দি।”
আনন্দি এবার ফুঁপিয়ে উঠল, “ ভালো নেই মা। খুব একা লাগে। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, তাই… এই বাড়িতে আজকাল দম বন্ধ হয়ে আসে। কেউ কিছু বলে না, তবুও মনে হয় চারপাশে যেন অজানা আঙুল তাক করে আছে আমার দিকে।”
তিনি উদ্ধত কন্ঠে জানতে চাইলেন,
“ কেনো কিছু বললি না আগে? উজান কি কিছু বলেছে তোকে?”
“ উজান… ও যেন আজকাল ব্যস্ত হয়ে গেছে নিজেকে নিয়ে। আমার পাশে দাঁড়ানোটা যেন তার দায়িত্ব নয় আর। বারবার মনে হয় প্রতিদিন কেউ আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমি এই পরিবারের যোগ্য না।”
“ তুই আমার মেয়ে, তুই কারো কাছেই ছোট না। তোর জায়গা তুই নিজে বানাবি, বুঝলি? কিন্তু যদি মনে হয় তোর আত্মসম্মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে… তাহলে কখনোই মাথা নিচু করিস না। সম্মান ছাড়া কখনোই সংসার হয়নারে মা।”
আনন্দির অধর বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
“ মা, আমি তোমার মতো শক্ত নই। তুমি সংসার সামলেছ, আমাদের সামলেছ। আমি শুধু চেষ্টা করি… কিন্তু বারবার মনে হয় ব্যর্থ হচ্ছি।”
“ ভেঙে পড়বি না আনন্দি। তুই খুব সাহসী। এই যে তুই কাঁদছিস, তবু দাঁড়িয়ে আছিস এই তো সাহস। কিন্তু সুখ শুধু সহ্য করে পাওয়ার নয়। নিজেকে হারিয়ে ফেলে যদি সংসার চলে, সেটা সুখ নয় মা।”
” আমি এখন কী করব মা? এখনই যদি এরকম পরিস্থিতি হয় আমি কি ভবিষ্যতে আধো সুখের সংসার করতে পারব?”
“ নিজের মনকে শুন, আনন্দি। যদি তুই মনে করিস এই সম্পর্কটা একতরফা হয়ে গেছে, তাহলে আর স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাবি না। নিজের জন্য একটুখানি শান্তি খুঁজে নে। তবে হ্যাঁ ঝোঁকের বশে কখনোই কোন সিদ্ধান্ত নিবিনা। রা’গের মাথার নেওয়া সিদ্ধান্ত কখনোই সুখকর হয়না। আমি সবসময় তোর পাশে থাকব, তোর জন্য যা সুখকর তা করতে কখনোই পিছুপা হব না।”
আনন্দি আর কিছু বলল না। চোখের কোণে জমে থাকা জল মুছে নিল চুপচাপ।
আনন্দি বড় এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
“ মা, তোমার কণ্ঠটা শুনলেই কেন জানি মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে…। তোমার কথাগুলো যেন আমাকে অদৃশ্য মনোবল দিয়েছে।”
.
.
পরের দিন বিকেলে পুষ্প পিসির মেয়ে তৃধা আর তার ছোট্ট মেয়ে ঈশু এসেছে বেড়াতে। সবার মুখে হাসি, ব্যস্ততা। ঈশু ঘুরে ঘুরে দেখছে সব।
সারা বাড়িতে যেন হঠাৎ একটা উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে।
তৃধা মেয়েটি নিজের থেকেই আনন্দির সাথে কথা বলতে এগিয়ে এলো। আনন্দির প্রথমে ধারণা ছিল সেও হয়ত নিজের মায়ের মতোন হবে কিন্তু না…। তৃধা হাসিখুশি, মিষ্টি একটা মেয়ে। তারা স্বামী নাকি কোন কাজে শহরের বাইরে গিয়েছে, তাই মেয়ে নিয়ে বেড়াতে চলে এসেছে। আসার সময় হাত ভর্তি জিনিস নিয়ে এসেছিল। আনন্দির জন্য একটা শাড়িও এসেছে সে। মেয়েটা খুশি মনেই জিনিসগুলো সবাইকে ভাগ করে দিচ্ছিল। অবশ্য নিজের মায়ের থেকে বেশ কয়েকবার ঝাড়িও খেয়েছে সে।
” এতো টাকা খরচ করার কী দরকার ছিল? তুই তো আর অন্যের বাসায় যাচ্ছিস না, তোর মামারই তো বাসা।”
তবে তৃধা মায়ের কথা কানে নিলো বলে আনন্দির মনে হলো না।
সেদিন সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে ভাগনী আর নাতনিকে দেখে আনন্দির শশুড় প্রমিত মল্লিক বেজায় খুশি হলেন। সেই সন্ধ্যা বেলায় ঈশুকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লেন।
আনন্দি রান্নার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে আর ফাঁকে ফাঁকে তৃধার সাথে গল্প করছে। একসময় তৃধা বলে জানতে চাইল, ” হ্যাঁরে উদয় তোর পড়াশোনা আর কতদিন? আমাদের কাজিনদের মধ্যে বিবাহযোগ্য একমাত্র তুই অবশিষ্ট। কবে তোর বিয়ের নেমন্তন্ন পাবো?”
” সময় হলে পেয়ে যাবে বোনটি আমার।” ফোন চালাতে চালাতে বসার ঘর থেকে জবাব দিল উদয়। কোথা থেকে পুষ্প পিসির আগমন ঘটল। তিনি সোফায় বসতে বসতে জবাব দিলেন,
” তোর মাকে তো বললাম এখন থেকেই মেয়ে দেখতে থাকো, বিয়ের সময় না হয় বিয়ে করল। তোর মাতো আমার কথা কানেই তুলল না। বেশী বুঝলে আসলে এই সমস্যা।”
” ঠিকই করেছে। আর তোমার পছন্দের মেয়ে আমি বিয়ে করব না।”
” কেনরে বাপু? আমি বুঝি তোর জন্য খারাপ মেয়ে পছন্দ করব?”
” না তুমি বেশি ভালো মেয়ে পছন্দ করলে তখন সমস্যা। বেশি ভালো আবার আমার সহ্য হয়না।”
ভাইপোর কথা শুনে চোখ-মুখ কুচকে গেল পুষ্প দেবীর।
.
.
আধাঘন্টা-একঘন্টা পর ফিরে এলেন প্রমিত মল্লিক এবং ঈশু। একহাতে তিনি ঈশুর হাত ধরে আছেন, অপর হাত কয়েকটা ব্যাগ। বাচ্চাটা দৌড়ে মায়ের কাছে এলো।
” মা জানো, দাদু আমাকে একটা প্রিন্সেস ড্রেস কিনে দিয়েছে। দাদু মাকে দেখাও।”
প্রমিত মল্লিক হাসিমুখে ব্যাগ থেকে ড্রেসটা বের করলেন।
“এই নাও, আমার ছোট্ট পাখি!”
ছোট্ট ঈশু জামাটা পড়ে হেলেদুলে সবাইকে দেখাতে আর খিলখিল করে হাসছে। আনন্দির খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে।
” এই নাও তৃধা মা, তোমার জন্য লিপস্টিক আর একটা মালা এনেছি, পছন্দ হয়েছে কিনা দেখ।”
” মামা এসব কেন আনতে গেলে।”
” তোমরা এতোদিন পর এলে, মামা হিসেবে আমার তো কিছু কর্তব্য থাকেই। দিদি এই নাও তোমার পছন্দের পেঁয়াজু।”
” আমার ভাইটা এখনো মনে রেখেছে আমার পছন্দ। তোর মতো ভাই যেন ঘরে ঘরে থাকুক।”
প্রমিত মল্লিক হেসে ঈশুকে আদর করলেন।
“এই তো আমার রাজকন্যা! দাদুর কাছে এসো!”
বাচ্চাটা কোলের মধ্যে একেবারে রাণীর মতোন বসল।
প্রমিত একবার চোখ তুললেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন।
“ এক কাপ চা হবে তো এবার?”
শর্মিলা দেবী একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আনন্দি ধীর পায়ে ওনার কাছে এসে বলল,
“ মা, আপনি বসুন, আমি বানিয়ে আনছি।”
শর্মিলা দেবী এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেলেন।
কিন্তু মুখে কিছু না বলে, চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
আনন্দি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সেই কোণায়।
কিছুসময় পর, শর্মিলা দেবী চা’র কাপটা টেবিলেই রেখে গেলেন নিঃশব্দে।
তখন শর্মিলা দেবী পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“তোমার জন্য এলাচ দেওয়া চা করেছি, গরম থাকতে খেয়ে নিও।”
হাসিমুখের আড়ালে আনন্দি লক্ষ করল তার চোখে একরাশ ক্লান্তি, একটা অস্পষ্ট কষ্ট জমে।
তিনি কাপ টেবিলে রেখে সরে গেলেন। নিজের জন্য এক কাপ চা এবং উদয়ের জন্য আরেকটি কাপ নিয়ে তার রুমের চলে গেলেন। আনন্দি যাবে কিনা দাঁড়াবে সেটাই ভাবছিল। প্রমিত মল্লিক তাকে ডেকে ডাকলেন।
” বৌমা, কিছু মনে করো না। আমি তোমার জন্যও আনতাম কিন্তু তুমি কী পছন্দ করো না করো তা তো আমি জানি না। এখানে কিছু ফল আছে, তুমি নিজের মতো খেয়ো আর সবাই ভাগ ঝোঁক করে দিও।”
আনন্দি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। মনে মনে ভাবল তার শশুর কত ভালো মানুষ। অপরদিকে তার শাশুড়ী অদ্ভুত রকমের কঠোর আবার কখনো গম্ভীর, নিষ্প্রাণ।
” বাবা, মায়ের জন্য কিছু……”
” আব…. ওর আর কি লাগবে? তার প্রয়োজন হলে বলবে, এনে দেব।”
” কি গো বউ তুমিও এখন ভাইয়ের দেওয়া জিনিস নিয়ে আমাদের সাথে খোঁচাখুঁচি করবে? এই সামান্য জিনিসেও তোমাদের নজর পড়ল! পেছন থেকে কেউ কান পড়া দিয়েছে নাকি?”
আনন্দি পিসির কথায় যেন থতমত খেয়ে গেল। সে কিছু বুঝবে তার আগেই পিসি আবারো বলে উঠলেন, ” শোনো মেয়ে, ভাইটা আমার। আমরা কষ্ট করে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। সে আমাদের দেবে না তো কাদের দেবে? অন্যের কথায় তাল দিতে যেও না মেয়ে। বাড়ির বউ, বাড়ির বউয়ের মতো থাকো।”
আনন্দি থমকে গেল। যে তো শশুড়কে সামান্য একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল, পিসি শাশুড়ি তা কোথা থেকে কোথায় নিয়ে গেল!
.
.
রাত তখন একটু গাঢ় হয়ে এসেছে। আনন্দি বোতলে পানি নিতে এসেছে, মাথায় হাজারটা চিন্তা। তার মধ্যে অন্যতম কয়েকটা আগের ঘটনার পর সে স্পষ্টভাবে অনুমান করতে পেরেছে তার শশুড়-শাশুড়ির সম্পর্কের মধ্যে থাকা অদৃশ্য শীতলতা। এসব ভাবতে ভাবতে সেসময় তার নজরে পড়ল উজান তখন বসার ঘরে।
সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
উদয় ফোনে চাপা স্বরে কারো সাথে কথা বলছে,
” না না, আমি জানি তুমি সময় দিয়েছো… আমি বলেছি না, টাকা জোগাড় হয়ে যাবে…। আমার কাছে এতোগুলা টাকা এই মূহুর্তে নেই তাই একটু দেরি হচ্ছে। আমাকে সময় দাও… আমি কোথাও থেকে ম্যানেজ করে দিচ্ছি।”
আনন্দির কানে কথাগুলো আসতেই কান খাঁড়া করে শুনল। আবছা আবছা যা শুনেছে তাতেই বুঝতে পেরেছে টাকা বিষয়ক কোন কথা বলছে উদয়। কিন্তু এই রাত-বিরেতে কার সাথে এভাবে চাপা স্বরে কথা বলছে সে।
গলা খাঁকড়ি দিল আনন্দি। আচমকা তার আগমনে উদয় যেন ভরকে গেল। আনন্দি ফোনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না।
” তুমি বসার ঘরে কী করছ?”
” ঘুমাতে এসেছি?”
কপাল কুঁচকে এলো তার। উদয় বুঝল, তাই নিজে থেকেই জানাল, ” আমার রুমে পিসি আর দিদি থাকবে আজ। মা ঈশুকে নিয়ে তাদের ঘরে আর বাবা সেইঘরে নিচে থাকবে। আমি আজ এই সোফায় ঘুমাব।”
আনন্দি শুধু মাথা নাড়াল। বোতলে পানি নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল সে। তবে তার মাথায় না চাইতেও উদয়ের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। এতো এতো চিন্তাই মাথাটা যেন আচমকাই খালি হয়ে গেল তার।
চলবে……
#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_১৯
#অনন্যা_অসমি
ছোট বাচ্চাটা টুকটুক করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আনন্দি ছাদে কাপড় মেলে দিয়ে নেমে এলো। বালতি রাখার জন্য রুমে আসতেই নজরে এলো ঈশু তাদের রুমে বিছানার উপর উল্টোদিকে মুখ করে বসে আছে। আনন্দি ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
” কি করছ ঈশুমণি?”
” আকছিঁ। মামী দেখো পুতুলটা কত সুন্দর না?”
বলে একটা খাতা আনন্দিকে দেখাল। আনন্দি যেন থমকে গেল। মুখ শুকিয়ে গেল তার। খাতাটা তুলে দেখে সত্যিই, আঁকিবুঁকি করে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা। দ্রুত খাতাটা উল্টেপাল্টে দেখল। এসাইনমেন্ট পেপারের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বিছানায় ছড়ানো। কিছু হাতে আঁকা স্কেচও ছিঁড়ে গেছে।
” এই কী করেছো তুমি? এটা আমার এসাইনমেন্টের খাতা!” রাগে গলা কেঁপে উঠল আনন্দি।
ঈশুর কান্নার শব্দে চমকে উঠল আনন্দি। তার কান্নার শব্দে দৌড়ে এলো সবাই, তৃধা মেয়েকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“কি হয়েছে ঈশু?”
বাচ্চাটা একটু ভয় পেলেও ততক্ষণে ওর মা এসে পড়েছেন। পুষ্প দেবীও সেখানে হাজির।
” আমার খাতা ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি মারিনি ওকে। শুধু বলেছি এটা ওর খাতা ছিল না।”
“তুমি চিৎকার করেছো। ও ভয় পেয়েছে। মায়া মমতা কিছু নেই তোমার মধ্যে। বাচ্চা মানুষ, তুমি চিৎকার করেছো। ও ভয় পেয়েছে। মায়া মমতা কিছু নেই তোমার মধ্যে। কাগজ ছিঁড়েছে তো কী হয়েছে, আবার লিখে নেবে।” বলে ফেলেন পুষ্পা দেবী।
আনন্দি ধীরে বলল, “ ওটা আমার জমা দিতে হতো। অনেক সময় দিয়ে করেছিলাম। পুনরায় আবারো করা সম্ভব নয় এখন।”
পুষ্প দেবী ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “ তুমি এত ছোট ছোট বিষয়ে এত চিৎকার করো কেন? সংসারে এর চেয়ে বড় সমস্যা আসে। একটু সহ্য শেখ মেয়ে। নাহলে সুখের ভাত খেতে পারবে না?”
” এসব কি বলছেন আপনি? আর বাচ্চা মানে এই না যে ওর ভুল সব সময় মাফ করে দিতে হবে। শেখাতে না পারলে শিখবে কী করে?”
পিসির চোখ টকটকে লাল হয়ে উঠল, “তুমি শিখাবে? তুমিই এখন বাড়ির গুরুজন, কর্তী? ছোট একটা মেয়ে, ও বুঝে উঠতে পারেনি। এতোই যদি সমস্যা হয় নিজের ঘরের খাতা ঠিকমতো রাখতে পারোনি।”
আনন্দি রাগ চেপে রাখল। তৃধা পাশে দাঁড়িয়ে আস্তে বলল, “আমি বলে ছিলাম ওকে আঁকতে… আমারই ভুল। তুমি রাগ করো না,আমি নাহয় সাহায্য করে দেব।”
শর্মিলা দেবী মুখে কিছু বলেন না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ঘরে গিয়ে ছেঁড়া কাগজগুলো হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইল। কান্নাও আসছে, আবার রাগও হচ্ছে।
কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
.
.
বিকেলে উদয় ওর দরজায় এসে দাঁড়ায়।
” উহু….. যদি চাও তো আমি তোমার পেপারগুলো আবার প্রিন্ট করে দিই, ওই ছবি গুলোও ডিজিটাল কপি বানিয়ে রাখো, আমি ঠিক করে দেব।”
আনন্দি শান্ত ভাবে বলে, “তোমার এত সাহায্যের দরকার নেই, উদয়। নিজের কাজ আমি করতে পারব।”
উদয় একটু থেমে বলল, “আমি তো শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।”
“তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হলে চেয়ে নেব, দয়া দেখাতে এসো না।” আনন্দির গলায় স্পষ্ট তীক্ষ্ণতা।
উদয় চুপ করে চলে যায়, মুখটা কেমন থমথমে।
আনন্দি চুপ করে সরে গেল রান্নাঘরের দিকে। তার মনটা ভার হয়ে আছে। কেন যেন অকারণে তার সব কথাকে ভুল ব্যাখ্যা করে। সে নিজেও এই পরিবেশ থাকতে থাকতে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল সে এখানে অপ্রয়োজনীয়। কেউ ভাবে না সে ক্লান্ত হয়, কষ্ট পায়।
.
.
পিসির চিৎকার শোনা গেল, “ওরে বাবা! আমার টাকাগুলো কোথায় গেল?”
সবাই ছুটে গেল শর্মিলা দেবীর ঘরে, আওয়াজ ওখান থেকেই আসছে।
” কি হয়েছে মা? এই ভরসন্ধ্যা বেলা চিৎকার করছ কেন?”
শর্মিলা দেবী বললেন, “ বউরে আমি টাকা দিয়েছিলাম, রাখার জন্য। এতোগুলা টাকা এখানে কোথায় রাখব? বউরের আলমারিতে রাখতে দিয়েছিলাম। এখন দেখি নেই!”
“ আমি তো দিদি তোমার সামনেই আলমারির লকারে টাকা রেখেছিলাম। আজ তুমি চাইলে নিতে এলাম, যেখানে রেখেছিলাম সেখানে নেই।”
” তোমরা শান্ত হও, মনে করে দেখ অন্য কোথাও রেখেছ কিনা।”
” না তৃধা, আমার মনে আছে। দিদির টাকার সাথে আমাদের টাকার বান্ডিলেও কয়েকটা নোট কম।”
পুষ্প পিসি বললেন, “বাইরে কেউ আসেনি… তাহলে কি বাড়ির কেউ…?”
পিসির আড়চোখে তাকালেন।
” মামী তোমরা আরেকটু খুঁজে দেখ।”
” আর খুঁজেও ওই টাকা পাওয়া যাবে না। আমার তো মনে হচ্ছে ওগুলো কেউ অগোচরে সরিয়ে নিয়েছে অনেক আগেই। এখন আমাদের সামনে ভালো মানুষ সাজছে।”
” মা কিসব বলছ তুমি?”
পুষ্প দেবী কড়া গলায় বললেন, “ভুল কি বললাম? আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু করতে পারে। পেছনে অভাব থাকলে মনের ভিতরটাও কেমন বদলে যেতে সময় লাগে না।”
” কি বলতে চাইছেন দিদি?”
সেই মুহূর্তে পুষ্প দেবীর মেয়ে বললেন, “আমি শুনেছি আনন্দির বাবা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি, না? অনেক খরচ নিশ্চয়ই। ও হয়ত…আমার শুধু মনে হলো…”
ঘরে নীরবতা ছেঁয়ে গেল। আনন্দির চোখ কপালের দিকে উঠল,
” কি বলতে চাইছেন আপনি? মায়ের আলমারি থেকে টাকা আমি নিয়েছি!”
” তোমাকেই তো আমি ঘর গোছাতে ওই ঘরে যেতে দেখলাম। তুমি তো জানোই চাবি কোনটা।”
আনন্দি অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে।
“ পিসিমা! আপনি কী বলছেন? আমি এমন করব ভাবলেন কীভাবে?”
” তাহলে বলো তো টাকা গেল কোথায়? তোমার তো টাকার প্রয়োজন ছিল তাই না?”
” আপনার আমার প্রতি এতো কিসের রাগ? কিছু হলেই আমাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলেন।”
” রাগ থাকবে কেন? আর চিৎকার করছ কেন? চিৎকার করে সত্যিটা আড়াল করার চেষ্টা করছ নাকি?”
আনন্দির চোখে জল এসে যায়। সে বলছে কিছু বলছে না আর, নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। তার গলা বুজে আসে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এমন অপমান তো তার প্রাপ্য ছিল ন!
শর্মিলা দেবী আনন্দির দিকে তাকিয়ে বললেন,
” কিছু বলবে তুমি?”
আনন্দি স্তব্ধ। গলায় কোনো জোর নেই, “ আমি কিছু নিইনি। আমি কখনো এমন করতেই পারব না।”
পুষ্প পিসি মুখ বাঁকা করে বললেন, ” বুঝি বুঝি যখন দোষ করে ধরা পড়ে যায় তখনই এরকম কুমিরের কান্না করে মানুষ। আজকালকার ছেলেমেয়ে ন’ষ্ট হচ্ছে বাবা-মায়ের শিক্ষার কারণে। তারা ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারে না বলে তাদের বাচ্চাগুলো চু’রি, ডা’কাতি, মিথ্যা কথা বলতে শিখে….। ছিঃ….”
” পিসি আমাকে দোষ দিয়েছেন আমি মুখ বুজে মনে নিয়েছি কিন্তু আমার বাবা-মাকে এর মধ্যে টানবেন না।” জোড় গলায় বলল আনন্দি।
” বাহ্… বাহ্…. চো’রের মাইয়ের বড় গলা দেখছি।”
” মা….। তুমি বারবার চো’র চো’র বলছ কেন? সামান্য কয়টা টাকাই তো। আনন্দি না জিজ্ঞেস করে নিলেও হয়ত তার বেশি প্রয়োজন ছিল….!”
” চো’র বলব না তো কী বলব? আজ চোখে পড়েছে বলে না নজরে এসেছে। না জানি আরো কত কিছু লুকিয়ে চুরিয়ে এ বাড়ির বাইরে নিয়ে গিয়েছে।”
” আনন্দি তুমি নিলে এখনই বলে দাও।” শর্মিলা দেবী বললেন।
” কি আর বলবে? তোমার বউয়ের মুখ আছে বলার? তোমার ছেলের বউয়ের যে হাত নাড়ানোর স্বভাব আছে জানলে কখনোই আসতাম না। আমার মেয়ে হলে হতো চ’ড় মেরে সব দাঁত ফেলে দিতাম।”
” আমাকেই কেন দো:ষ দিচ্ছেন? আপনার নিজের মেয়েও তো নিতে পারে। আর মা আপনার ছোট ছেলেও তো এই বাড়িতেই থাকে। নাকি ওরা সবাই আপনাদের চোখে অদৃশ্য।”
” আনন্দি!”
” এখন কেন এরকম প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন? আমার তো মনে হচ্ছে আপনার ছোট ছেলেই চু’রি করেছে। দেখুন গিয়ে জু’য়ার নেশা আছে নাকি। মাসের চার-পাঁচ দিন তো তাকে বাড়িতেই দেখা যাই না।” তেজী কন্ঠে বলল সে।
” আনন্দি! মুখ সামলে কথা বলো।” তেড়ে এলেন শর্মিলা দেবী।
আনন্দি বিদ্রুপ করে হাসল, ” আপনার ছেলের ব্যপারে বলেছি বলে আপনার গায়ে লেগেছে। আর আমাকে যখন মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছিল তখন আপনি ঠিকই চুপ করে ছিলেন। এমনকি আমার বাবা-মাকে বাইরের লোক আজেবাজে কথা বলছিল তখনও চুপ করে ছিলেন। শাশুড়ী মা আপনি আসলেই হিপোক্রেটিক।”
” এই মেয়ে কি ইংরেজি ঝাড়ছ? কাকে বাইরের লোক বলছ শুনি? শোন এই বাড়িতে থাকি না বলে ভেবোনা যা খুশি তাই বলবে। এখনো আমার কথায় বাড়ির সবাই উঠে বসে।”
” তুমি কোন সাহসে আমার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে?”
” আমি নিজের কানে শুনেছি আপনার ছেলে কারো সাথে টাকার কথা বলছিল। কি হলো চুপ করে আছো কেন? বলো সত্যিটা?”
উদয় আমতা আমতা করতে লাগল। শর্মিলা দেবী এগিয়ে এসেছে উদয়কে চেপে ধরলেন।
” উদয় সত্যি করে বল তুই নিয়েছিস টাকা।”
” হ্যাঁ আমার টাকার প্রয়োজন ছিল…. কিন্তু আমি নেইনি। সত্যি বলছি মা।”
” আমার দিব্বি দিয়ে বল।” করুণ দৃষ্টিতে তাকলেন তিনি ছেলের দিকে।
” তোমার দিব্বি মা, আমি নেইনি টাকা।”
শর্মিলা দেবী যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। বুক থেকে যেন ওনার পাথর নেমে গিয়েছে কিন্তু তিনি বুঝলেন না অন্যকারো বুক ভারী হয়ে এসেছে।
পিসি যেন এবার আরো সুযোগ পেলে।
” আমি জানতাম, আমি জানতাম উদয় এরকম করতেই পারে না। আমাদের বংশের ছেলে বলে কথা। এই মেয়ে মনগড়া কাহিনি বলে আমাদের ঘুরাচ্ছে। বউ তুমি এখুনি প্রমিতমকে ফোন করব আর এই মেয়ের বাপ-মাকেও ফোন করে আসতে বলো। আমিও একটু মেয়ের গুণি বাপ-মাকে দেখি। চু’রি করেছে তার উপর আবার মি’থ্যা কথা। ছিঃ….. না জানি আর কোন গুণ আছে।”
আনন্দি র আর নিজেকে সহ্য করতে পারল না। দু’হাতে চোখের জল মুছে নিল সে।
” অনেক সহ্য করেছি আর নয়। যে বাড়িতে প্রতিদিন সম্মান হারাতে হয়, বারবার খোঁটা শুনতে হয়,নিজের বাবা-মা যে বাড়িতে ছোট হয় সেখানে আর কতদিন? সে বাড়ির ভাত আমার গলা দিয়ে এই জন্মে আর নামবে না।”
” কি বলতে চাইছ কী তুমি?” বলল পুষ্প পিসি
তৃধা বলল, “আনন্দি… একটু শান্ত হও। আনন্দি!”
ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করে দেয় আনন্দি। আবারো অবাধ্য চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিল, কারো নম্বর ডায়লগ করল। পরপর দু’বার কল করেও যখন কেউ রিভিউ করল না তখন যেন সে আশাহত হলো। কি-বোর্ডে কাঁপা কাঁপা হাতে কিছু টাইপ করে সেন্ড করল সে। ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল, আলমারি থেকে কাপড় ব্যাগ রাখল। খাটের নিচ থেকে একটা ছোট বাক্সে রাখা টিউশন ফি’র টাকাগুলো বের করে দেখল, হাত কাঁপছে তার। এটাই তার একমাত্র সঞ্চয়। বাবা’র জন্য কেনা নতুন ওষুধ, হাসপাতালের রিপোর্ট এগুলো তার কাছে ছিল, সব কিছু একত্র করে ব্যাগে রাখে। ফোনটা তুলে নিল, সেখানে ভেসে উঠেছে একটি লেখা।
” উজান, যে সংসারে আমার কোন সম্মান নেই, আমার বাবা-মায়ের কোন সম্মান নেই। সেখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। চলে যাচ্ছি আমি। তোমার মতোন ব্যস্ত মানুষের যদি সময় হয় ডির্ভোস পেপারে সাইন করে দিও। এই সংসার করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।”
শেষবারের মতোন আবারো উজানকে ফোন করল আনন্দি। কিন্তু না! এবারো মনঃক্ষুণ্ন হলো সে। হতাশাভরা নিঃশ্বাস নিল। দরজা খুলে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলো সে।
তাকে এতোবড় ব্যাগ নিয়ে বেরতে দেখে সবার চোখ কুচকে গেল।
” এতো বড় ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো তুমি?” শর্মিলা দেবী বললেন।
” দেখো কোন কিছু লুকিয়ে রেখেছে নাকি।” মুখ বাঁকিয়ে বললেন পুষ্প পিসি।
” আমি চলে যাচ্ছি মা।”
” চলে যাচ্ছি মানে? কোথায় যাচ্ছো তুমি?” শর্মিলা দেবী অবাক নয়নে জানতে চাইলেন।
” আপনারা তো চাইছিলেন আমি যেন আমার বাবার বাসায় চলে যাই, সেখানেই যাচ্ছি।”
” কি একটু বলেছি তিনি তো মুখ ভার করে, চোখ মুখ উল্টে ফেলেছেন৷ ব্যাগপত্র নিয়ে একেবারে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। আজকালকার মেয়েদের কত তামাশা।” কিছুক্ষণ থেকে আবারো বললেন, ” এতো ঢং করো নাতো বাপু। ঠিকই তো দু’দিন পরে তোমার বাপ-মা আমাদের বাড়িতেই ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দেবে, কাকুতিমিনতি করবে। চু’রি করেছ, মেনে নাও। এতো তেজ কোথা থেকে আসে তোমার মেয়ে।”
” মা! দয়া করে চুপ করো। আনন্দি তুমি বোন একটু শান্ত হও। রাগের মাথায় কিছু করো না।”
” আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে বাড়িতে আমাকে চো’র বলে সম্বোধন করা হয়, চু’রির অপবাদ দেওয়া হয়, আমার বাবা-মায়ের শিক্ষার উপর আঙুল তোলা হয় সেখানে মাথা নিচু করে পড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার বিবেকে বাঁধছে, আমি এখনো চুপ করে মেনে নিলে সত্যিকার অর্থে আমার মনে হবে আমার শিক্ষায় দুর্বলতা আছে। তাই তো অন্যায় হচ্ছে জেনেও, নিজের সম্মান, আত্মাসম্মান সব বির্সজন দিয়ে এই বাড়িতে পড়ে থাকব। আমার বাবা-মায়ের এই সামর্থ্যটা এখনো আছে তাদের মেয়েকে দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ানোর। এই বাড়ির খাবার, মানুষ, বাতাস সব আমার কাছে এখন বিষ সমতুল্য।” চোখের জল মুছল আনন্দি। সরাসরি সবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ” মেয়েরা নাকি লাল শাড়িতে শশুড়বাড়ি আসে আর সাদা শাড়িতে এই বাড়ি ছেড়ে যায়। আমি আনন্দি, লাল শাড়িতে এই বাড়িতে এসেছি আর লাল শাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি। আমার মধ্যে একটুও যদি আত্মাসম্মান, লজ্জা, বিবেকবোধ থাকে আমি কখনোই আর এই বাড়িতে পা রাখব না। আর কখনো আমি এই বাড়িতে ফিরে এলে লাল শাড়িতে নয়, সাদা শাড়িতে ফিরে আসব।”
চলবে……