সংসার নাকি সম্মান পর্ব-২৪+২৫

0
2

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২৪
#অনন্যা_অসমি

বাহিরে আলোর তেজ কমে এসেছে। নার্সের পায়ে শব্দ, রোগীর আত্মীয়দের নিঃশব্দে হাঁটাচলা, আর্তনাদ সব মিলিয়ে চাপা এক পরিবেশ চারিপাশে।

বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে উজান। এখনো স্যালাইন চলছে, শরীরটা দুর্বল এখনো।

চোখ বন্ধ অবস্থায় সে অনুভব করল কেউ রুমে প্রবেশ করেছে। দ্রুত চোখ খুলল সে, সামনের মানুষটাকে দেখে থমকে গেল।

শাড়ির আঁচলটা এলোমেলো, চোখের নিচে কালি, মুখে যেন ক্লান্তি চাপ স্পষ্ট।

উজানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, তাড়াহুড়ো করে উঠে বসল সে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হাতে টান খেলে ব্যথায় আপনাআপনি মৃদু চিৎকার করে উঠল। আনন্দি দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে বসতে সাহায্য করল।

“ তুমি এসেছো?”

আনন্দি কিছু বলল না, ধীরে এসে বিছানার পাশে বসল।

উজান আবারো বলল, “ভেবেছিলাম… তুমি আসবে না।”

“ কেমন আছো?” মৃদু স্বরে জানতে চাইল আনন্দি।

” তোমাকে দেখে আগের চেয়ে হালকা অনুভব হচ্ছে।”

আনন্দি মাথা নিচু করে ফেলল।

সে আবারো বলল, ” মনে হচ্ছে কতবছর আমি তৃষ্ণার্থ ছিলাম। কাউকে দেখার অপেক্ষায় দিন গুণছিলাম। এখন বুঝি সেই পিপাসা শান্ত হলো।”

আনন্দি চুপ করে শুনে গেল শুধু।

” বাবা কেমন আছেন?”

” বাবা… বাবা সুস্থ আছেন। আজ দুপুরের দিকে বাসায় নিয়ে এসেছি।”

উজান চুপচাপ তাকিয়ে রইল তার দিকে, কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল যেন। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা মনে হয় হুহু করে উঠল।

মেয়ে মানুষ নাকি বাপের বাড়ি গিয়ে হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা ফিরে পাই, অথচ আনন্দিকে দেখে উজানের কোনোদিক দিয়েই সেই কথা সত্যি মনে হচ্ছে না। মেয়েটা যেন আরো নিভে গিয়েছে, আরো শুকিয়ে গিয়েছে।

এদিকে আনন্দি উশখুশ করতে লাগল। সামনের মানুষটা তার স্বামী অথচ তার সাথেই কথা বলতে যেন বর্তমানে তার সবচেয়ে বেশি দ্বিধা কাজ করছে। অল্প সময়ে তাদের মাঝে যেন যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।

” এতো বৃষ্টির মাঝে বেরিয়েছিলে কেন? বাবাকে পরেও দেখতে আসতে পারতে।” একটু জড়তা ছিল আনন্দির কন্ঠস্বরে।

উজান হেসে বলল, ” তাহলে তোমার দেখা পেতাম কি করে?”

আনন্দি চোখ রাঙিয়ে তাকাল। উজান হাসি আরো চওড়া করে বলল, ” আরে বাবা মহারাণী রেগে যাচ্ছে দেখি। তাহলে তো দেখি ডোরেমন থেকে টাইম মেশিন এনে অতীত পরিবর্তন করতে হবে।”

আনন্দি দাঁত কটমট করে তাকাল।

“ এভাবে হাত-পা ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকতে খুব মজা লাগছে তাই না? তোমার কিছু হলে তো সবাই আমাকেই দোষ দেবে। তুমি কি আমাকে অনুশোচনা, অপরাধবোধের মধ্যে রাখতে চাইছ?” বলতে বলতে তার চোখে যেন জল জমে গেল।

উজানের হাসি উবে গেল। সে হাত থেকে বাড়িয়ে আনন্দির হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। আনন্দি মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল। ঠোঁটে অভিমানী হাসি বজায় রেখে বলল,

“ তোমার কাছে তো আমি এখন আর ভালো মানুষ নই। তাহলে এই খারাপ মানুষটার জন্য কষ্ট পাচ্ছো কেন?”

আনন্দি বলার মতো যেন কিছু পেল না। রাগে বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। উজান যেন তার আচরণে বেশ মজাই পাচ্ছে।

উজান চোখ ইশারায় জানতে চাইল,

” এতোগুলা কি এনেছ?”

আনন্দি উজানের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ থেকে কয়েকটা বক্স বের করল।

” মা তোমার জন্য খিচুড়ি, ডিম ভাজি আর বেগুন ভাজি করে পাঠিয়েছে।”

” তাই নাকি! বাহ্…. এই বৃষ্টির ঠান্ডা ঠান্ডা মৌসুমে খিচুরি। মাকে আমার হয়ে একটা ধন্যবাদ দিও। না…দাঁড়াও তোমার দিতে হবে না আমিই নিজে গিয়ে দিয়ে আসব।”

আনন্দি কিছু বলল না। বাটি এবং চামচ উজানের দিকে এগিয়ে দিল। উজান হতাশ স্বরে বলল,

” আনন্দি তুমি কি বুড়িয়ে গিয়েছ?”

” বাজে কথা বন্ধ করে এবার খাবে।”

” খাব কিভাবে? আমার একটা হাত যে গলায় ঝুলে আছে সেটা কী তোমার চোখে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে? বউ… তুমি আমার আগেই বুড়িয়ে
গেলে। হতাশাজনক…..”

” থাক তোমার খেতে হবে না।”

” আরে আরে…. তুমি কি আমাকে না খেতে দিয়ে শুকিয়ে মার’তে চাইছ। বউ…. তুমি আমাকে এভাবে নতুন নিয়মে শাস্তি দেবে।”

আনন্দি চামচে খাবার নিয়ে উজানের মুখে দিল।

” চুপ একদম চুপ। চুপচাপ খাবে আর একটা কথা বললে খাবার তো বন্ধ সাথে মুখেও প্লাস্টার করে দেব।”

উজান মিটিমিটি করে হাসতে লাগল।

এরমাঝে ঘরে ঢুকলেন শর্মিলা দেবী। আনন্দিকে দেখে যেন তিনি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

“ এসেছ তাহলে।”

আনন্দি তাকালো না, শুধু হালকা মাথা নাড়াল। উজানের দিকে আরেক চামচ খাবার এগিয়ে দিল।

শর্মিলা দেবী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ।
ওনার মাঝে অপরাধবোধ নাকি রাগ বুঝল না আনন্দি।

শর্মিলা দেবী এবার বললেন,

“ যাক ভেবেছিলাম আসলেই তোমার মাঝে স্বামীপ্রীতি বলে কিছু নেই। দেরী হলেও অন্তত স্ত্রীর কর্তব্যটা ভুলে যাওনি দেখে ভালো লাগল।”

“ যাইহোক স্বামী বলে কথা, শতহলেও তাকে তো এড়িয়ে যেতে পারিনা। খাওয়া শেষ, ওষুধ খেয়ে নাও।”

প্রেসক্রিপশন দেখে উজানকে ওষুধ দিল আনন্দি। সবকিছু আবারো ব্যাগে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

উজান যেন হকচকিয়ে গেল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে তার হাত টেনে ধরল।

” চলে যাবে তুমি?”

” হুম। বাবার ওষুধ কিনতে হবে, বাজারে যেতে হবে।”

” বাড়ি ফিরবে না?” বেশ উৎসুক হয়ে জানতে চাইল উজান।

” বিশ্রাম করো, আমি আসছি। সাবধানে থেকো।” নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল আনন্দি। উজানের চোখে মুখে হতাশারা আবারো ঠাঁই নিল৷

তার চলে যাওয়া দেখে শর্মিলা দেবী যেন ক্ষুদ্ধ হলেন।

” সংসারে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হয়। সেই দায়িত্বের পরীক্ষায় যদি কেউ বারবার পেছনে থাকে তবে সম্পর্ক টেকে না, নামের ভালোবাসাও ফিকে হয়ে যায়। তবে সবকিছুই শুধু দায়িত্বের খাতিরে করলে কখনোই হয়না। শুধু দায়িত্ব পালন করলেই সবকিছু সমাধান হয়না।”

তিনি আবারো বললেন,

” খুব তো তার হয়ে কথা বলেছিলে এখন সে তো শুধু দায়িত্ব পালন করেই দায়সারা হয়ে গেল? এভাবেই যদি তার কাজকর্ম চলতে থাকে তবে এর ফলাফল কখনোই সুখকর হবে না।”

উজান কোন উওর দিল না। সে এখনো দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তার নীরব থেকে মায়ের কথায় সম্মতি জানাল নাকি অভিমান করল তা বোঝা গেল না।
.
.

বাজারের ব্যাগগুলো মায়ের হাত দিয়ে সোফায় বসল আনন্দি। ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে মেয়েটা। তার মা তাকে একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন।

” বাবা কোথায়?”

” ঘুমাচ্ছে এখন। জামাইয়ের সাথে দেখা করেছিস? খাবারে কোন সমস্যা ছিল?”

” না ভালোই হয়েছে বলল।”

” তুই যে এই বাড়িতে চলে এলি কিছু বলল না?”

” হুম।”

” কি বলেছিস তুই?”:

” মা…. এখন এসব বাদ দাও না। বাবা কিছুটা সুস্থ হোক, উজানও ঠিক হোক তখন এসব নিয়ে ভাবা যাবে।” সে উঠে যেতে চাইল।

” আনন্দি….” থেমে গেল সে। মা বললেন,

” সংসারে আর যাইহোক আত্ম অহংকার, ইগো এসব থাকতে নেই৷ ইগো কখনো কারো মাঝে চেপে বসলে তার পরিণতি কখনোই সুখকর হয়না। আমি তোকে বলছিনা অন্যায় মেনে চুপচাপ সব সহ্য করতে কিন্তু মারে আর যাইহোক নিজের ইগো বজায় রাখতে গিয়ে ঠিক হতে পারা জিনিসটা নষ্ট করিস না। তা হলে পরবর্তীতে তুই নিজেই সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকবি।”

আনন্দি প্রতিউওরে বলার মতো যেন কিছু খুঁজে পেল না।

চলবে……

#সংসার_নাকি_সম্মান
#পর্ব_২৫
#অনন্যা_অসমি

দু’দিন পর,

ভরদুপুরে শহরের গলিগুলো প্রায় নির্জন। সূর্যের তাপও কমে এসেছে কিছুটা, গাছের ছায়া লেপ্টে আছে দেয়ালে।

উজানের বাসার সামনে এসে থামল আনন্দি।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করল।

” বাড়িতে আছো?”

” নীচে এসো একটু।”

কেটে দিল আনন্দি, অপেক্ষা করতে লাগল মানুষটা নামার। কিছুসময় পরেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে নেমে এলো উজান, তাকে ধরে নামাচ্ছে উদয়৷ আনন্দি উদয়ের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল।

” আমি তোমাকে নামার জন্য বলেছি। ওকে এই অবস্থায় নীচে নামিয়েছ কেন?”

” আমি কি করব? তুমি এসেছ শুনে নিজেই বেরিয়ে এলো।”

আর কথা বাড়াল না আনন্দি। হাতে থাকা ব্যাগটা বাড়িয়ে দেবে তার আগেই উজানের ইশারায় উদয় তাকে রেখেই দূরে সরে গেল।

” এই…. দাঁড়াও।”

” আরে ও দাঁড়িয়ে কি করবে? আমার ভাইটাকে কাবাবের হাড্ডি করছ কেন?”

” এই নাও। মা পোলাও, রোস্ট করেছিল, তোমার জন্য পাঠিয়েছে। বক্স ফেরত দিতে হবে না।”

তার দিকে ব্যাগটা এগিয়ে দিল আনন্দি। তবে উজান ব্যাগের বদলে আনন্দির হাত ধরল।

“ এতো দূর পর্যন্ত যখন এসেছ তখন ভেতরে এসো না।”

“ না, দরকার নেই। আমার তাড়া আছে।”

“ আনন্দি, তুমি কি সবসময় এভাবে পালাবে? একটু বসো, কথা বলি। আমি কোনকিছুই বুঝতে পারছিনা কি হচ্ছে।”

“ তোমার ঠিক বোঝা লাগবেও না, উজান। এখন কিছু বললেও, কেউ না কেউ আবার সেটাকে ভুল বুঝবে। কিছু বললেই ভুল, চুপ থাকলেও দোষ।”

“ তুমি কি তাহলে চিরকাল এই ভুলবুঝির মধ্যেই থাকতেই চাও?” একটু উচ্চস্বরেই বলল সে।

“ তোমার মা যেভাবে কথা বলেন, তোমার পরিবারের মানুষ যেভাবে আমাকে পর ভাবে তার পরেও কি বোঝার আছে আর? শুধু আমি-ই কেন সবসময় প্রমাণ দেবো, যে আমি অপরাধী না?”

“ তুমি কেন মাকে নিয়েই সব ভাবো? আমি কি কিছু বলিনি? আমি কি এখন তোমার পাশে দাঁড়াইনি?”

“ উজান, পাশে দাঁড়ানো মানে শুধু নীরব থাকা নয়। তোমার যখন কথা বলার প্রয়োজন ছিল তখন তুমি ছিলে না, এখন হাওয়ায় গা ভাসিয়ে, তাল মিলিয়ে কোন লাভ আছে?”

উজান এবার একপা এগিয়ে এলো।

“ আমি ভুল করেছি, আনন্দি। আমি জানি। কিন্তু তুমি যদি এভাবে নিজেকে সরিয়ে নাও তাহলে কি করে সমস্যার সমাধান হবে?”

” তুমি শুধু চুপ ছিলে না, তুমি অন্ধ ছিলে। মা’র কথায়, চারপাশের চাপে, তুমি চোখ বন্ধ করেছিলে। আজ যদি আমি আবার ভেতরে যাই, তুমি নিশ্চয় বলবে—‘সব ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু উজান, কোনকিছু ঠিক হওয়া কি এতোই সহজ?”

উজান এগিয়ে এসে বলল,

” আনন্দি… এই বাড়িটা তোমারও, তোমারও অধিকার আছে। অন্তত আজ একটা বার সুযোগ দাও। ভেতরে এসো, মা আজ দুধপুলি পিঠা বানিয়েছে। তোমার না পিঠা পছন্দ?
এসো, মা-ও খুশি হবে।”

আনন্দি ঠোঁটের কোণে এবার বিদ্রুপের হাসি দেখা গেল।

” তোমার মা খুশী হবে? উজান একটা কথা বলো তো তুমি যখন নিচে নেমে আসছিলে সে সময় তোমার মা বাড়িতে ছিলেন?”

উজান মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাল।

” তিনি কি একবারের জন্যও তোমাকে বলেছেন যেন আমি বাড়ির ভেতরে আসি?”

উজান উওর দিতে পারল না। আনন্দি আবারো হাসল।

” আমি বাড়ি ছেড়েছি সপ্তাহ পেরিয়ে, মাস হতে চলছ। তোমার মা একবারের জন্যও নিজ থেকে আমাকে বললেননি বাড়ি ফিরে আসার কথা। তিনি চাইলেন পারতেন একবার আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে ফিরে আসার কথা বলতে কিন্তু তিনি তা একবারের জন্যও চেষ্টা করেননি।”

উজান কিছু বলতে চাইল কিন্তু আনন্দি বাঁধা দিল।

” তোমাকে কখনো আমি বলিনি তোমার মা’ই একদিন আমাকে সামান্য ডিম ভাজির জন্য খোঁটা দিয়েছিল। আমার খাওয়া আর শরীর নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন। এর পরেরদিনই তিনি আমাকে ছোট মাছ এনে দিলেন, সব নাকি একসাথেই কাটতে হবে। অথচ তিনি জানতেন সেদিন আমি কোন শরীর নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু ওনার মাঝে কোন সহানুভূতি আমি দেখতে পাইনি। এরকম আরো অনেক ছোট ছোট ঘটনা সেটা সময়ের সাথে সাথে এখন বিশাল পাহাড় মনে হচ্ছে।”

আনন্দি একটু ভেবেই বলল,

” হ্যাঁ তোমরা, তুমি কেউ আমাকে শারী’রিক নির্যা’তন করোনি কিন্তু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছ। এতো অল্পসময়ে এতো কিছু হয়ে যাবে আসলেই আমি কখনো ভাবতে পারিনি। উজান অনেক সময় নীরব থাকলে হয়না। অপর মানুষটা তোমার নীরবতার অর্থ বুঝতে পারছে কিনা তা আগে স্পষ্ট হতে হয়। তোমার এই নীরবতা, এতো ব্যস্ততার কারণ আমি আজো বুঝতে পারিনি। তুমি কখনোই কোন কিছু আমাকে পরিষ্কার করে বলোনি৷ সুনয়নার ব্যপারটাও আমি দায়সারা ভাবে জবাব দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছ। যখন আমার মনের মধ্যে ভয় দানা বাঁধতে লাগল, তখন আমি অন্যকাজ করে বসলাম। সেইসময়ও তুমি আমার মনের অবস্থা বুঝলে না, এখনো বুঝতে পারছ না।”

একটু থেমে আবারো বলল,

” যেদিন তুমি তোমার অবস্থান স্পষ্ট করে বলবে, শুধুই নামের ভালোবাসার নয়, সম্মানের পক্ষেও দাঁড়াবে… যেদিন তোমার নীরবতা কারও পক্ষে নয়, যেদিন আমাকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারবে হয়তো সেদিন আমি আবার আসব। কিন্তু তার আগে নয়।”

উজান চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। আনন্দি চোখের জল মুছে চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত্য হলো।

উজান পেছন থেকে ধীরস্বরে বলল,

“ আমি হয়ত সম্পূর্ণ চেষ্টা করিনি, আমার চেষ্টায় হয়ত এখনো ক্রটি আছে৷ তবে দোষ যেহেতু আমারো আছি আমি সহজে হাল ছাড়ব না। তোমার জন্য দরজাটা সবসময় খোলা থাকবে আনন্দি।”

আনন্দি কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ ব্যাগটা উজানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নীরবে বেরিয়ে গেল। তার মুখের অভিব্যক্তি পেছনের মানুষটা বুঝল না।

তাকে যেতে দেখে উদয় এগিয়ে এলো। উজানের হাত ধরল সে।

” সবঠিক হয়ে যাবে, হাল ছেড়ো না। একটু সময় দাও।”

বাড়ি ফিরে এলো তারা। উদয় ভাইকে সোফায় বসাল। শর্মিলা দেবী দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” এলো না তো।”

” মা তুমি প্লিজ এখন আর কিছু বলো না।” উদয় বলল।

” হ্যাঁ হ্যাঁ এই বাড়িতে আমার দাম কি কখনো ছিল? আমি বললেই সব দোষ।”

” না মা দোষ তোমার না। এইখানে সবচেয়ে বেশি দোষী আমি। তুমি আমার মা, তোমার জায়গা কখনোই কেউ নিতে পারবে না। কিন্তু আমি মা’য়ের প্রতি দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে স্ত্রীকে যে নিজের অজান্তেই এড়িয়ে গিয়েছি সেটা সময় মতো বুঝতে পারিনি। মা আর স্ত্রীর স্থান আমি বজায় রাখতে পারিনি৷ তোমার কষ্টের কথা ভেবে যে আরেকজনের কষ্টের কারণ হয়ে দাড়িয়েছি তাও বুঝতে পারিনি।”

” ঘুরিয়ে পেঁছিয়ে বলছিস কেন? একেবারেই বলে দে দোষটা আমার। আমিই খারাপ।”

” না মা, মায়েরা কখনই খারাপ হয়না। কিন্তু শাশুড়ী হিসেবে তুমি চাইলেই পারতে আনন্দির সাথে আরেকটু কোমল হতে, তাকে এই পরিবারের একজন হয়ে উঠতে সহযোগীতা করতে পারতে। নাকি তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে দূরে দিতে৷”
.
.
.

” আনন্দি, এই আনন্দি। কবে থেকে তোর ফোন বেজে চলেছে। শুনতে পাচ্ছিস না তুই?”

বলতে বলতে তার মা তার রুমে এলো। তিনি দেখলেন মেয়ে ফোনের সামনেই বসে আছেন।

” কিরে তুই তো ফোনের কাছেই আছিস। ধরছিস না কেন?”

আনন্দি উওর দিল না। মা এগিয়ে এসে তাকে আলতো করে ধাক্কা দিল।

” কি হলো?”

” উজান ফোন করছে।”

” সে তো ভালো কথা। ছেলেটা এতোবার ফোন করছে, ধর।”

আনন্দি ধরল না, পুনরায় কল কেটে গেল। তার মা যেন মেয়ের আচরণে হতাশ হলেন। তিনি বিছানায় বসলেন।

” তুই কী চাইছিস বল তো? ছেলেটা তো চেষ্টা করছে সব ঠিক করার, নিজের ভুলটাও স্বীকার করছে। তাহলে তুই কেন বারবার পিছিয়ে আসছিস?”

” কিন্তু বিয়ের পর থেকেই এতোদিন যা যা করল তার কী হবে? আমাকে মানিয়ে বুঝিয়ে নিয়ে যাবে তারপর ও বাড়ি একা রেখে আবারো চলে যাবে। তারপর তার ব্যস্ততার বাহানা। আমিও বাকি পাঁচটা মেয়ের মন সংসার করতে চেয়েছিলাম মা, সেই আশায় তার সাথে ওবাড়ি পা রেখেছিলাম। কিন্তু সে কি করল? আমাকে একা রেখে চলে গেল। এরকম সংসার তো আমি চাইনি মা।”

” আনন্দি, আমি তোকে সেইদিনও বলেছি ইগো থাকলে কোনকিছুই কখনোই সমাধান হবে না। উজানের ভুল ছিল কিন্তু সেও তো এখন সব ঠিক করার চেষ্টা করছে৷ তুই যদি এভাবে এড়িয়ে চলিস তাহলে এভাবেই চলবে আর এভাবে তো সংসার হয় না মা। একটা সম্পর্কে ” কমিউনিকেশন” অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করে। কমিউনিকেশন গ্যাপের কারণে না চাইতেও অনেক ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়। সুন্দর হতে পারা সংসারটাও ভেঙে যায়। এভাবে তো হয় না, তোদের দু’জনের এবার মুখোমুখি বসে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। ওর সাথে কথা বল, দেখ কি বলে।”

উজান আবারো ফোন দিল। এবার আনন্দি আর অপেক্ষা করল না।

” আনন্দি তুমি একবার এই বাড়িতে এসো।”

” উজান, আমি তো বলেছি। যেই বাড়িতে আমার কোন সম্মান নেই, আমার বাবা-মায়ের সম্মান নেই। যেখানে বিনা অপরাধে আমাকে চুরির অপবাদ দেওয়া হয় সেখানে আমি কখনোই ফিরে যাব না। তাহলে কেন তুমি আবারো সেই কথা বলার জন্য ফোন করেছ?”

” ধরো এটাই শেষবার, দয়া করে একবার এসো।”

আনন্দি আবারো বারণ করতে যাবে কিন্তু উজানের কথা শুনে থমকে গেল।

” হারিয়ে যাওয়া টাকাগুলোর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।”

চলবে………