#সংসার
পর্ব ৪
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
সারাদিন হাসপাতালে খেটেখুটে এসে সন্ধ্যার মুখে ঘুমিয়ে পড়েছিলো তিতির। চোখ মেলে সে ভীষণ চমকে গেলো। ক্ষুদে দুইটি ডাইনি বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরণে আলুথালু করে শাড়ি জড়ানো, ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক, দুই গালেও সযত্নে লিপস্টিক লাগানো, কপালে টিপ, দুই হাতের কনুই পর্যন্ত রং বেরঙের চুড়ি। রাজেশ্বরী আর লুম্বিনী। বয়স সাড়ে আট। সাজগোজ জীবনের একমাত্র প্যাশন। পাউডার দিয়ে সাদা ভূত হয়ে গেছে,পারফিউমের তীব্র গন্ধ। মনে হয় পুরো বোতলটাই শেষ করেছে দুই বোন।
“কয়টা বাজে?”
“সাড়ে সাতটা।”
” দুধ খেয়েছো? ”
“আরেকটু পরে খাবো।”
“এখনতো লেখাপড়ার টাইম। মিস আসেন নি? ”
“না।”
“মিস না আসলে একা পড়তে বসা যায় না? ”
ডাইনি বুড়িরা নিশ্চুপ।
” সবসময় এতো সাজুগুজু করতে নিষেধ করেছি না? ”
“আমরা বিয়ে বিয়ে খেলছি। আজ আমাদের দুজনারই বিয়ে।”
তিতির মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলো।
“জিজ্ঞেস করো মা কাদের সাথে আমাদের বিয়ে? আমার বিয়ে ভাইয়ার স্যারের সাথে আর রাজের বিয়ে হুজুরের সাথে।”
“কে বলেছে এসব কথা? ”
“ময়না খালা।”
তিতির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় ছেলের রুমে গেল। যা আশংকা করেছিল, তাই। আরিয়ান অর্থাৎ বুবুন নিবিষ্ট চিত্তে গেমস খেলছে, মোবাইলে। জরুরি অবস্থার জন্য অবশ্য একটা মোটা বই খুলে রেখেছে, একটা খাতায় কিছু লেখা এবং তার উপরে খুলে রাখা কলম। আচমকা বাপ এলে যেন চরম মনোযোগী ছাত্রের ভাব নিতে সময় না লাগে।
“কি হচ্ছে বাবু? ”
“এইমাত্র নিলাম। জাষ্ট এক মিনিটও হয়নি বোধহয়। অংক করছিলাম,এই দেখো।”
“লেখাপড়া না করে বকলম থাকো,সেটা সহ্য করতে পারবো, কিন্তু মিথ্যা কথা, চালাকি এসব আমি সহ্য করবো না। মোবাইল আমাকে দাও, আর দয়া করে পড়ো। ”
” মোবাইল লাগবে। দশ মিনিটের একটা ক্লাস শুরু হবে এখনই। খুবই ইম্পরট্যান্ট। ”
সবসময় একই ডায়ালগ।
আসিফ দামী মোবাইল উপহার দিয়েছে বড় ছেলেকে, তিতিরের অনুরোধ,রাগারাগি, অভিমান সবকিছু উপেক্ষা করে।
ছোটোটা গেলো কই? আরহাম? পাওয়া গেলো তাকে ড্রইংরুমে। টম জেরি দেখছে।
সন্ধ্যায় একটু ঘুমিয়ে পড়ার ফল। যে যার মতো চলছে। নিয়ম কানুনের বালাই নেই।
“ময়না খালা, ওদের চারজনকে নাস্তা দিয়েছেন সন্ধ্যায়? ”
“বেবাকটি কইছে এখন খাইবো না। সাধাসাধি কম করি নাই আম্মা।কথা না হুনলে কি করবার পারি? ”
আরেক সহকারী আমেনা চট করে তার টাচ মোবাইল লুকিয়ে ফেলেছে।ওইটাতেই কি যেন দেখছিল আর ফিকফিক করে হাসছিলো দু’জন।
“ময়না খালা, আপনি রাজ আর লুম্বিনীর বিয়ে নিয়ে কি বলেছেন? ”
“কিছু কই নাই তো আম্মা? ওরা আমার নাম কইছে? মাইয়া দুইডা খুব মিছা কথা কয়।”
“কে মিথ্যা বলে নিজেকেই প্রশ্ন করেন। আর আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এধরণের কথা দ্বিতীয় বার বলবেন না। আমার হেল্পিং হ্যান্ডের খুবই দরকার আছে, কিন্তু উল্টাপাল্টা করলে যতো কষ্টই হোক,তাকে আমি সরিয়ে দিবো।”
চার ছেলেমেয়েকে সামনে বসিয়ে সন্ধ্যার নাশতা খাওয়ালো তিতির। রাজেশ্বরী আর লুম্বিনীর ধরাচূড়া বুঝিয়ে শুনিয়ে খুলে দিয়ে হাতমুখ ডলে ডলে ধুইয়ে দিলো।
মনে একটা গুপ্ত ইচ্ছা আছে তিতিরের। রাজ আর লুম্বিনীকে কখনো বিয়ে দেবেনা ও। ছেলেদুটো রাজপুত্রের মতো সুন্দর হলেও মেয়েদুটো তা হয়নি। তিতিরের শাশুড়ি প্রায় বলতেন,” মেয়ে দুটার চেহারা ছবি ভালো হয় নাই। মায়ের মতো, ভোঁতা ভোঁতা। মায়ের মতোই মাথায় চুল নাই। ছেলেগুলো সুন্দর। মেয়ে দুটারই বাপের মতো হওয়া দরকার ছিলো।”
মেয়েরা একদিন অন্যের মুখে উঠতে বসতে এধরণের কথা শুনবে,ভাবতেও পারে না তিতির। সভ্যতা -ভব্যতা -সুন্দর মন-সুন্দর আচরণ -মেধা থাকার পরও চেহারার জন্য রাজ আর লুম্বিনী খোঁটা শুনবে,তিতির এটা কল্পনাতেও আনতে পারে না। অথচ মেয়ে দুটো হয়েছে সাজুনি বুড়ি। বাপের কাছে আবদার করেছে বড় মেকআপ বক্সের। একটা হলে হবে না,দুইজনের দুইটা লাগবে। আসিফকে কঠিন ভাবে নিষেধ করে দিয়েছে তিতির।
কিছু মানুষ এমন কেন যে হয়! অপরের বিয়ের সময় এমন বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করে যে ঐ দম্পতির মধ্যে একটা অদৃশ্য দেওয়াল থেকে যায়।
বিয়ের কিছুদিন পরে তিতির একদিন শাশুড়ির ঘরের মশারি টাঙাচ্ছিলো। দূর সম্পর্কের এক খালা শাশুড়ি চেঁচিয়ে উঠে বললেন,”তিতির,ফ্যানের সাথে বাড়ি খাবে।সাবধান।” শাশুড়ি বলে উঠলেন,”কিছুই হবে না। ও তো বাঁইট্টা। ” তবে এসব কথা উনি ছেলের আড়ালে বলতেন। বড় বৌকে সহ্য করতে পারতেন না।মেজ বৌ তিতিরকে ভালোবাসতেন বটে,তবে আঘাত খুব একটা কম দিতেন না।
অরণী দেখতে ভারি সুন্দর। তিতলী ওকে সবসময় সাজিয়ে গুজিয়ে রাখে। রাজ আর লুম্বিনীকে পেলে ওদেরও সাজিয়ে দেয়। চুল বেঁধে দেয়, লিপস্টিক, টিপ,গালে একটু রুজ,মালা,চুড়ি। অরণীর জন্য জামা বানালে প্রায় ই রাজ আর লুম্বিনীর জন্য একই রকম জামা বানায় তিতলী। তিতির তিতলীকে নিষেধ করে,” অরণীকে অতো সাজাগোজা শিখাস না, তিতলী। পরে এই সাজগোজ নিয়েই পড়ে থাকবে, পরীক্ষায় গোল্লা পাবে।দুই সেকেন্ড পরপর আয়নায় চেহারা দেখবে। পরিস্কার পরিপাটি রাখবি কিন্তু স্টাইলিশ বানাস না ছোট বয়সে।”
তিতির এইটুকু তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে, মেয়েদের আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। শুধু পড়ালেখা না, রান্না, সেলাই, সাধ্যমতো বেশি বেশি কাজে দক্ষ হতে হবে, খুব পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমতী হতে হবে, তুখোড় ব্যক্তিত্ব থাকতে হবে। ব্যক্তিত্বের অভাব থাকার জন্যেই তো বিয়ের পরে তিতিরকে এতো উল্টাপাল্টা করার সাহস পেয়েছে শ্বশুরবাড়ি।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তিতির তার বৌভাতের একটা উপহারও চোখে দেখেনি। তিতিরকে দেওয়া উপহার,সে সামান্য হোক বা অসামান্য, তিতিরকে একবার দেখানোর কথা কেউ মাথায় আনেনি।নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। ভদ্র পরিবার এমন করে কি করে,জানা নেই তিতিরের।
গল্প-উপন্যাসে কতো কিছু লেখা থাকে। নব দম্পতিকে নিয়ে কতো আনন্দ, অনুষ্ঠান। সব নষ্ট করে দিয়েছিলো আসিফের ছোট ভাই আর বোনদের কেউ কেউ ।
বিয়ের সময় যে উপহার পেয়েছিলো তিতির, তার থেকে সোনার একজোড়া করে দুল দিয়েছিলো আসিফের বোনদের। কয়েকদিনের মধ্যে তিতির জানতে পারলো,দু’জনের দুল নাকি ভেঙে গেছে। পলকা জিনিস। ছোট ননদ অনার্স পাশ করার পরে খুব খুশি হয়ে মজবুত একখানা সোনার আংটি উপহার দিলো তিতির। কিছুদিন পরে শাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে তিতিরকে বললেন,” কোথা থেকে কি হাবিজাবি জিনিস দাও তুমি? তুলির আংটিটাও ভেঙে গেছে। তুলি বলেছে,মা, তোমার বৌকে বোলো,সোনার জিনিস দিতে হলে যেনো ভালো জুয়েলারি থেকে কিনে দেয়।”
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তিতির। ঐদিন প্রথম মুখ খুলেছিলো সে।শাশুড়িকে বলেছিলো,”তুলিকে তো আর উপহার দেওয়া যাবে না। সোনার জিনিস তো নয়ই। সোনা ওর গায়ে সয়না।তাই যা দেওয়া হয়, ভেঙে যায়। ”
পুত্রবধূর শীতল গলায় বুদ্ধিমতী শাশুড়ি ভাব ও ভাষা মুহূর্তে পাল্টে ফেলেছিলেন। এর আগে যখন যা মনে হতো, বলে দিতেন। এখন সন্তর্পণে বললেন,” তুলি ছোটো মানুষ তো! সিরিয়াস ভাবে বলেনি। মজা করে বলেছে। আমি আর তোমার আব্বা বলেছি, তিতির বাচ্চা মানুষ, যা পেরেছে দিয়েছে।”
তারপরে যথারীতি সেই কথা,”আসিফকে কিছু বোলো না। স্বামীকে সব কথা বলতে নেই। ”
সময়ের সাথে সাথে শ্বশুরকুলের আচরণের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিতিরকে সবাই ভালোবেসেছে বা ভালোবাসার অভিনয় করেছে। তিতিরও অনেক পরিণত হয়েছে এতো বছরে। এখন চট করে কথা গায়ে লাগেনা।
আচ্ছা, তিতির কেমন শাশুড়ি হবে? রাজ আর লুম্বিনীর বিয়ে দিবেনা, তবে বুবুন আর আরহামের দিবে। রাজ ও লুম্বিনীকে যেমন ভালোবাসে,বৌমাদেরও তেমন ভালোবাসবে। বৌমারা যদি বেচাল করে, নিশাতের মতো সেটা মেনে নিবে না তিতির। বুঝাবে, না বুঝলে ভদ্র ভাবে সদর দরজা দেখিয়ে দিবে। ছেলে যদি বৌয়ের সাথে যায়,যাবে। কলিজা ব্যথায় টনটন করলেও কিছু করার নেই। মানুষ জীবনকে অকারণে এতো জটিল করে কেন?
চলবে।