সংসার পর্ব-০৬

0
45

#সংসার
পর্ব ৬
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ব্যস্ত ডাক্তার হলেও তিতির ছেলেমেয়েদের পড়ায়। এই যুগে চার ছেলেমেয়ের মা হওয়ায় তাকে কম উপহাসের শিকার হতে হয়নি। মাতৃত্বকে তিতির একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে যেয়ে নিজের প্রফেশনে অনেক ছাড় দিয়েছে সে। আসিফ এগিয়ে গেছে তরতর করে। সে দেশের নামকরা সার্জন। দেশি-বিদেশি অনেক ডিগ্রি আছে আসিফের ঝুলিতে। তিতিরের আছে ডাক্তারিতে গ্র্যাজুয়েশন আর অর্ধেক পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের ডিগ্রি। তবে ডাক্তার হিসাবে তিতির খুবই দক্ষ। তাতে অবশ্য লাভ নেই। বাংলাদেশ শুধু স্পেশালিষ্ট চায়। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার সাথে সাথে সে বিশাল ডাক্তার। তখুনি তার প্রমোশন চাই, নইলে ডিপ্রেশন ভর করে। এদিকে এতোদিন ধরে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার পেশাগত দক্ষতা হয়তো কম। তিতিরের মতো ডাক্তাররা,যারা বছরের পর বছর চাকরি করেছে, নানা ধরণের অসংখ্য রোগী দেখে দেখে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে, তাদের এই অভিজ্ঞতার কোনো মূল্য নেই। প্রমোশন পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পাশাপাশি এক্সপেরিয়েন্সের উপর ভিত্তি করেও দেওয়া উচিৎ। তিতির এটা মনে করে। তার মনে করার সাথে বেশির ভাগ মানুষের মনে করা মিলে না। তাছাড়া নিজের অবস্থান নিয়ে তিতির অসন্তুষ্ট নয়। অল্পেই তুষ্ট হওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন।

তিতির পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেনি নিদারুণ পরীক্ষা ভীতির জন্য। বিশেষ করে ভাইভা। ভাইভা বোর্ডে তিতিরের বোধবুদ্ধি জড় হয়ে যায়। জন্ম থেকেই ভীরু মেয়েটা ভয়ে ভয়েই অনেক পরীক্ষা খুব ভালো ভাবেই উৎরে এসেছে, কিন্তু এখন তার সাহস তলানিতে এসে ঠেকেছে। এটা ঠিক, যে রোগী একবার তিতিরকে দেখিয়েছে, সে আর অন্য ডাক্তারকে দেখায়নি। মাঝে মধ্যে সাহস করে পরীক্ষাটা দিয়ে দিতে ওর মন চায়।

এখন অবশ্য চার সন্তানের পড়ালেখা তিতিরের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চারটা ই মারাত্মক ফাঁকিবাজ। সহজে ওদের কব্জা করা যায়না। হাতে ছাই মেখে একেকটাকে ধরতে হয়। বই পুস্তকের বিদ্যা তো লাগবেই, তবে সন্তানদের মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ মানুষ হিসেবে তৈরি করা তিতিরের কাছে অনেক জরুরি বলে মনে হয়।

মেয়ে দুটো বেশি বাঁদর। সাজগোজ, ঝগড়াঝাটি, ভাইদের পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়ার বিভিন্ন কৌশল গোপনে বাপের কানে তুলে দেওয়া, ময়না খালাদের আড্ডায় তিতিরের অনুপস্থিতিতে যোগদান এবং জ্ঞান আহরণ এগুলোই রাজেশ্বরী আর লুম্বিনীর কাজ। এবারে মেয়েদের জন্মদিনে আসিফ উপহার দিলো লকেটসহ গলার হার, দুই মেয়ের দুইটা।একেকটা হার প্রায় আড়াই ভরি করে, মানে হয়? এদেরতো আরও হার আছে। নাজমুল সাহেব এবং নিশাত নাতনিদের মুখ দেখেছিলেন দেড় ভরির একেকটা সোনার হার দিয়ে। তৃতীয় জন্মদিনে আসিফ শখ করে মেয়েদের অন্য ডিজাইনের হার কিনে দিয়েছিল। আবার এখন কেন? উত্তর হলো,মেয়েরা শখ করেছিলো। কার গলায় নাকি এই ডিজাইনের হার দেখেছিলো দুই বোন, বাপকে রিকোয়েস্ট করেছিলো ওইরকম হার ওদেরও কিনে দিতে। বর্ণনা দিয়েছিলো, “পেট পর্যন্ত লম্বা হার, একটু পরপর ছোট ছোট বল লাগানো।” হার পেয়ে বায়না ধরেছে সোনার নূপুরের। বাপও আশ্বাস দিয়েছে।এগুলো খুব বেশি অপছন্দ তিতিরের। অল্প বয়সে অঢেল পেয়ে গেলে, মুখ থেকে কথা খসামাত্র অর্ডারের মাল হাতে চলে এলে সেইসব বাচ্চারা মানুষ হয়না। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক, বিবেকবর্জিত হয়ে জীবন কাটায়।

এখনকার লেখাপড়া কেমন যেন। আরিয়ান, অর্থাৎ বুবুনকে পড়াতে যেয়ে এতোটা বেগ পেতে হয়নি তিতিরকে।সুন্দর, সহজ করে সব শেখানো যায়,বুঝানো যায়। তবে বুবুন যখন ক্লাস ফাইভে,জোর একটা ধাক্কা খেয়েছিলো তিতির। ছেলে বাংলা-ইংরেজি কোনো বানান পড়তে চাচ্ছিলো না। স্কুলের টিচার বলে দিয়েছেন, “বানান ভুল হলে নম্বর কাটা হবে না।” কাজেই মনের সুখে বানান ভুল করো। তিতির ছেলেকে আদর করে বুঝালো,”নম্বর সব নয়,বাবা। তুমি যে পড়া, যে কাজ শিখবে,খাঁটি ভাবে শিখবে।এতে তুমি সত্যিকারের জ্ঞানী হবে।” পরে ছেলের অগোচরে স্কুলের টিচারের সাথে আলাপ করেছিলো তিতির। টিচার হেসে স্বীকার করেছিলেন। বোর্ডের নির্দেশ আছে। পাশের হার বাড়াতে হবে,জিপিএ ফাইভ বাড়াতে হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে কি মারাত্মক উন্নত, তা দেখাতে হবে। আর এর জন্য ছাত্র ছাত্রীদের ভুল ত্রুটিকে ভুল বলে নম্বর কাটা যাবেনা।বরঞ্চ, ভুলগুলোকে ফুল বানিয়ে দিতে হবে।

তখন হতে নিজের আর পরের সব বাচ্চা কাচ্চাকে নিয়ে খুবই সতর্ক তিতির। সবাই, এমনকি বাবা-মাও কয়েকবার বলেছেন, “এই দেশে থেকে কি করবি? বাইরে চলে যা। অন্ততঃ বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য হলেও কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় চলে যা।”

নাহ্,এই কাজটি করবে না তিতির।আরিয়ান, ইরফান,আয়মান, আরহাম, অরণ্য, রাজেশ্বরী, লুম্বিনী, অরণী সবাইকে বারবার গল্পচ্ছলে বুঝিয়েছে, নিজের দেশের কোনো বিকল্প নেই। এই দেশ তোমার। এই দেশকে তোমাদেরই দেখেশুনে রাখতে হবে। এই দেশের ময়লা আবর্জনা তোমাদেরই পরিস্কার করতে হবে। হ্যাঁ, লেখাপড়া আর রিসার্চের জন্য বিদেশে যেতে পারো,কিন্তু কাজ শেষে ফিরে আসতে হবে নিজের দেশে।

বাচ্চাগুলো ফাঁকিবাজ হলেও লম্বা লম্বা কথায় ওস্তাদ। বুবুন সেদিন বলছিলো, “ইন্টারের পরে কেমব্রিজে অ্যাপ্লাই করবো, মা? কোনটা ভালো হবে? অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ না হাভার্ড? ”

তিতির শান্তগলায় উত্তর দিয়েছিলো,”আগে এসএসসিটা পাশ করে নাও ভালোভাবে। তারপরে আমরা এটা নিয়ে আলাপ করবো,কেমন? ”

বাচ্চারা বড় হয়ে যাচ্ছে। সময় তরতর করে চলে যায়। দেখতে দেখতে একদিন বুবুনের সুদূর বিদেশে চলে যাওয়ার সময় চলে আসবে উচ্চ শিক্ষার জন্য। কিভাবে থাকবে তখন তিতির? কেন উচ্চশিক্ষা, গবেষণার জন্য বাংলাদেশ যথেষ্ট নয়? কেন এই দেশে শিক্ষাব্যবস্হা ও নৈতিকতার অধঃপতন হচ্ছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় “প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ” মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে বহু আগেই। না হারালে তো ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠানোর দরকার হতো না। স্বাধীনতার এতো বছর পরে দেশের উন্নতির চরম শিখরে থাকার কথা। কেন উন্নতি হচ্ছে না? কেন অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবার মান মুখ থুবড়ে পড়েছে? কারা দায়ী এই অধঃপতনের জন্য? মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ দিয়েছিলেন কি এমন মানহীন একটা দেশের জন্য? আফসোস!

চলবে।