সংসার পর্ব-১১+১২

0
44

#সংসার
পর্ব ১১
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

অনেকদিন পরে নাজমুল সাহেব -নিশাতের বাড়িতে বিশাল গেট টুগেদার। তিন ছেলে মেয়ে,তাদের শ্বশুর বাড়ির লোকজন, নাজমুল -নিশাতের ভাই বোনেরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।

নাজমুল -নিশাতের সেনাবাহিনী গত রাতেই উপস্হিত হয়েছে। সেনাবাহিনী মানে নাতি নাতনিদের দল। বুবুন তার দায়িত্বে লুম্বিনী, তুতুন, অরণ্য, অরণীকে নিয়ে গাড়িতে গত সন্ধ্যাবেলায় উপস্থিত। ফুপাতো ভাইবোনেরা রাতে থাকবে বলে ইরফান আয়মানের আনন্দ দেখে কে! ইরফান ঘোষণা দিলো, “আমরা সাত ভাই বোন ফ্লোরিং করে ঘুমাবো। আমরা আলাদা ঘুমাবোনা।”

শিশুর দল চিৎকার করে সমর্থন দিলো ইরফানকে।

নাজমুল সাহেব আর নিশাতের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো খুব। সাত ভাই বোন একসাথে ঘুমাবে, আলাদা ঘুমাবে না। লক্ষী সোনা রাজেশ্বরী, তুই কেন আলাদা থাকবি? তুই কি সব দেখতে পাস? তোকে ছাড়া এতো আনন্দ -আয়োজন, তোর কি মন খারাপ হচ্ছে ? আচ্ছা , অন্য জগতে যেয়ে তোর অনেক ক্ষমতা হয়নি? তুই পৃথিবীর মানুষের মন পড়তে পারিস? দেখতে পাস,তোর জন্য আমাদের বুকের ভিতর কি দগদগে ঘা? ”

প্রায় একই ধরণের প্রশ্ন রাজের উদ্দেশ্যে মনে মনে করলো তার মামা ও বড় ভাই।

ইরফান বড়ই সহজ সরল কিশোর। বাবা -মা তাকে বারবার বলে দিয়েছে ভাই বোনদের খুব আনন্দে রাখতে। সবাই মিলে গল্প করতে, খেলতে। তাই দুইদিন ধরে ইরফান পরিকল্পনা করেছে কি ভাবে ফুপাতো ভাইবোনগুলোকে মহা আনন্দে রাখা যায়। সেই প্ল্যানেরই একটা অংশ একত্রে রাত্রি যাপনের ঘোষণা।

প্ল্যানিং সার্থক। তুতুন ধুমধুম করে নাচছে। দুই হাত তুলে, শরীর দুলিয়ে, মুখ ব্যাদান করে হেসে উল্লাস প্রকাশ করছে আয়মান, অরণ্য,অরণী। বুবুন ভাইয়াও হাসিমুখে আছে। শুধু লুম্বিনী কুঁকড়ে বসে আছে তার নানা-নানির মধ্যেখানে।

লুম্বিনীর মৃগী রোগ হয়েছে। ঘন ঘন অ্যাটাক হয়। সারা শরীরে প্রবল খিঁচুনি উঠে। হাত পা বেঁকে যায়। নাকমুখ দিয়ে গেঁজলা বের হয় অনেক সময়। কথাবার্তা কারোর সাথে বলে না। প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয়না। স্কুলে চুপ করে বেঞ্চে বসে থাকে। ঐ বেঞ্চে লুম্বিনীর পাশে রাজেশ্বরীও বসতো।

শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে মেয়েটা। সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট সবাইকেই দেখানো হচ্ছে। সবার এক কথা, বাপ -মা ‘কে আগের ফর্মে ফিরতে হবে। তাদের হাসিখুশি, কর্মচঞ্চল থাকতে হবে যেন কিছুই হয়নি। নানা-নানি, ভাই -বোন, লুম্বিনীর আপনজন সবাইকেই আগের মতো ঝলমলে, হাসিখুশি হয়ে থাকতে হবে। ঘরের মানুষরা ঠিক না হলে কোনো থেরাপিতেই লুম্বিনী ঠিক হবে না।

বাসার সবাই প্রাণপণে অভিনয় করছে। নিখুঁত অভিনয় কারোর হচ্ছে না। সবচেয়ে বাজে অভিনেতা-অভিনেত্রী লুম্বিনীর বাপ -মা। নিশাত -নাজমুল প্রায় মেয়ের বাসায় চলে যান, সারাদিন কাটান প্রধানত এই লুম্বিনীর জন্য। নোমান,তমা,তিতলী প্রায়ই যায়। আসিফের ভাই বোনেরা যায়। সবার মূল লক্ষ্য থাকে লুম্বিনীকে স্বাভাবিক করা। তবে আসিফের বোনেরা ঘোরতর জটিল মানুষ। সেদিন ভাইয়ের বাসায় যেয়ে তিতিরের খাটে শুয়ে থাকা লুম্বিনীকে টেনে হিঁচড়ে নামালেন ওর সেজো ফুপু জেসমিন,

“কুইচ্চা মুরগির মতো বসে শুয়ে থাকো কেনো? মায়ের মতো আইলসা। চুল বাঁধা নাই, কোন্ কালের পুরানো রংজ্বলা জামা পরা , মায়ের যোগ্য বেটি একেবারে। সাজগোজ গেলো কই? আসো,তোমাকে সাজায়ে দিই। ”

ভাগ্য, তিতির তখন গোসলে ছিলো। নইলে এই শোকার্ত, দুর্বল অবস্থায় মা কতো না কষ্ট পেতো এই নিষ্ঠুর কথাগুলোতে। কাউকে কিছু বলতো না, শুধু আরও বিষন্ন হয়ে পড়তো।

লুম্বিনী ফুপুর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। সেজ ফুপু আর ছোটো ফুপুকে লুম্বিনীরা কোনো ভাই বোনই পছন্দ করেনা। অন্য ফুপুদের প্রতিও টান কম। বাচ্চারা ভালোবাসা আসল না নকল, সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারে। ফুপুদের যার যার সন্তান ছাড়া আর কারোর উপরে তেমন টান নেই, সেটা শিশুকালেই বুঝে গিয়েছিলো লুম্বিনীরা। ফুপুদের প্রতি বৈরাগ্য থাকার বড় কারণ হলো,ফুপুরা তাদের শান্ত,চুপচাপ, ভালোমানুষ মা’কে নিয়ে সামনে পিছনে অনেক কথা বলেন। মা নাকি অলস,অপদার্থ, কামচোরা, বাবার পাশে মা’কে নাকি মানায় না, মা ভালো মা না_ এসব কথা শুনতে শুনতে ফুপুদের প্রতি ভিতরে ভিতরে ভালোই বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছে
লুম্বিনীদের।

সেজো ফুপু লুম্বিনীকে নিয়ে ঢুকলেন জমজদের ঘরে। লুম্বিনী নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো। এই ঘর সে সহ্য করতে পারে না। রাজ চলে যাওয়ার পর হতে সে বাবা-মায়ের মাঝখানে ঘুমায়।

ময়না খালা ছুটে এসে জেসমিনকে থামায়।

“আপা, এই ঘরে লুম্বিনী সোনারে নেওয়া নিষেধ। ”

“কে নিষেধ করেছে? তুমি নিজের কাজে যাও। আমি ওর ফুপু। ওর ভালো মন্দ খুব ভালো বুঝি আমি। এই আলমীরাটা রাজের না? তালা মারা নেই ? এই যে এই ফ্রকটা আমার দেওয়া। রাজেরটা নীল,তোরটা লাল।একই ডিজাইন। তোরটা কই? পরিস না? কি সাংঘাতিক ! সোনার তৈরি নূপুর! তালা না দেওয়া আলমারিতে ! তোরটা কোথায়? এটা তোর আলমারি না? বাহ্,এখানেও সোনার নূপুর। আলমারিও তালা ছাড়া। ভাইয়ের আমার অঢেল উপার্জন, শুধু আমরা কিছু চাইলে তখন বলে টাকা নাই,টাকা নাই। বুঝলে ময়না, আমার মা -বাপ খেয়ে না খেয়ে এই ছেলেকে মানুষ করেছে। আর সেই ছেলে বিয়ের পরে বৌয়ের ভেড়া হয়ে গেছে, শেষ বয়সে আমার আব্বা -মা ভীষণ কষ্ট করেছিলেন। ”

ময়না খালা ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলো। রুষ্ট গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আপনেরা বাকি ভাই বোন তখন কি করতেছিলেন?”

তিতিরও গোসল সেরে নিঃশব্দে তার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলো। অনেক কথাই তার কানে গেছে। তারপরও স্বভাবসিদ্ধ স্বাভাবিক গলায় সে ননাসকে ডাকলো,” সেজো আপা, খেতে আসেন। ভাত ঠান্ডা হয়ে যাবে। লুম্বিনী সোনা, আসো আমার কোলে আসো। ময়না খালা, তুতুন ঠিকমতো খেয়ে গেছে তো মেরিনা ভাবির বাসায়? ”

সাত ভাইবোনের খেলা, হৈ হুল্লোড় জমছে না তেমন। লুম্বিনী খেলছে না,রাজ আপু নেই , তাই অরণীর পোষাচ্ছে না। বুবুনকে গোপনে চোখ মুছতে দেখার পর হতে ইরফানও ম্রিয়মাণ। তাদের দুই ভাইয়ের পর জন্মেছিলো জমজরা। একজোড়া বোন পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিলো ইরফান! জমজদের একজন নেই নয় মাস হলো, আরেক জন থেকেও নেই।

তারপরদিন বাড়ি ভরা লোকজন। নিচে বাবুর্চিরা রান্না করছে। নাজমুল -নিশাত সবাইকে খাওয়াতে খুব ভালোবাসেন। আগে শারীরিক সামর্থ্য ছিলো,প্রায়ই বাসায় আয়োজন করতেন। কয়েক বছর ধরে এসব করতে কষ্ট লাগে, তাই একসাথে সব আত্মীয়কে দাওয়াত না দিয়ে ভাগ ভাগ করে দেওয়া হতো। প্রায় পাঁচ ছয় বছর পরে সবাই আবার একসাথে। নিচের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়ারা চলে গেছেন দিন পাঁচেক হলো।উনাদের বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করে ঐ ফ্ল্যাটে মেহমান বসানোর আয়োজন করা হয়েছে। সবাইকে দেখে যদি আসিফ -তিতিরের মন কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভালো হয়। নিজেরাও একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারেন প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে। সবার বুকেই তীব্র যন্ত্রণা জমাট বেঁধে আছে।

দুপুরে খাওয়ার পরে বিস্ফোরণটা ঘটালো আসিফের ছোটো বোন তুলি। বললো,” আমার ভাইঝির মৃত্যুর জন্য তার মা দায়ী। আমি কাউকে ভয় পাই না। তাই রাজেশ্বরীর মায়ের সামনেই জোর দিয়ে বলছি, ওর মৃত্যুর জন্য ওর মা দায়ী।”

তিতির অবাক হয়ে ননদের দিকে তাকালো।

নিশাত শীতল গলায় তুলিকে জিজ্ঞেস করলেন, ” কেনো? ”

“মুসলমানের মেয়ে। নাম রাজেশ্বরী, লুম্বিনী। আমার আব্বা-মা বারবার নিষেধ করেছিলেন এই নাম রাখতে। কিন্তু আপনার মেয়ে শুনলো না। খাঁটি হিন্দুয়ানি নাম রাখলো। ফলাফলটা কি হলো? আমার বাপ-মা কষ্ট নিয়ে মারা গেলেন, তার নিজের মেয়েও মরলো।”

নোমান কি কাজে যেন এদিকে এসেছিলো। ঠান্ডা গলায় বললো,” এখানে অযথা যেন কোনো হাবিজাবি কথা না হয়। এই প্রোগ্রাম অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে মেইনলি তিতির,আসিফ ভাই আর বাচ্চাদের জন্য। এটা সবাই মনে রাখবেন,প্লিজ। ”

“আমার ভাইঝি মরলো, আমি কথা বলবো না? জানেন না, কতোবার আমার আব্বা রিকোয়েস্ট করেছিলেন ওদের নাম আসিয়া আর ফাতিমা রাখার জন্য। ”

“আসিয়া,ফাতিমা নাম রাখলে রাজ বেঁচে যেতো? ” তমা চেঁচিয়ে উঠলো। “আপনাদের বোনদের নাম নিলীমা, ন্যান্সি, জেসমিন, লিটা, তুলি। সূত্র অনুযায়ী আপনাদের তো এতোদিনে মরে যাওয়া উচিৎ। আপনাদের বাবা-মা আপনাদের নাম ফাতিমা , আসিয়া রাখেন নি কেন? ”

“আমার বাপ – মা তাঁদের সন্তানদের নাম যা খুশি রাখবেন। আপনি হাবিজাবি কথা বলছেন কেন, হ্যাঁ ? ”

“আপনার বাপ-মা নিজেদের সন্তানদের নাম রাখার অধিকার রাখেন,কিন্তু তিতির তার বাচ্চার নাম রাখার অধিকার রাখেনা, তাইতো? আপনার মেয়ের নাম লোটাস, ছেলের নাম সায়ন। আপনার বোনদের ছেলে মেয়ের নাম সায়ন্তনী, তিস্তা, পুতুল, রূপক,হীরক হলে অসুবিধা নেই। রাজেশ্বরী -লুম্বিনী নামেই সমস্যা? সারাক্ষণ গীবত গেয়ে বেড়ান, নিজের এতো ভালো ভাবিকে কষ্ট দেন, টপাটপ মিথ্যা কথা বলেন, লোকের ক্ষতি ছাড়া উপকার করেন না, আর আপনার মুখে ধর্মের কথা? ”

ভীষণ গন্ডোগোল শুরু হয়ে গেলো। তিতিরের হার্টে সমস্যা ধরা পড়েছে কয়েকদিন আগে। সে ঢলে পড়লো তিতলীর উপরে। তিতলীর কোলে বসে থাকা লুম্বিনীর মুখ আর হাত পা বাঁকা হতে শুরু করলো। নিশাত চিৎকার করে নোমানকে বললেন গাড়ি বের করতে।হাসপাতালে নিতে হবে মা-মেয়েকে। বুবুন ছাদে ছিলো। ইরফান দৌড়ে যেয়ে ভাইকে ডেকে আনলো আর এমন বিপর্যয়ের কারণটাও জানিয়ে দিলো অতি দ্রুত।
বুবুন ফুপুদের দেখিয়ে চিৎকার করে বললো,” উনাদের চলে যেতে বলো।জানো না, উনারা কি? এতোদিন মুখ খুলিনি। উনাদের ফুপু ডাকতেও আমার ইচ্ছা করে না। সারাজীবন এরা আর আমার দাদা -দাদি চরম কষ্ট দিয়েছে আমার সাতে পাঁচে না থাকা মা’কে। এতো অমানুষ যে আজকের দিনেও গায়ে পড়ে ঝামেলা করলো। রাজের জন্য দরদ উপচে পড়ছে? সবাই শোনো তোমরা, কাউকে বলি নি আমি কোনোদিন, আমার সাড়ে আট বছর বয়সে যখন রাজেশ্বরী-লুম্বিনী জন্মালো, তখন হাসপাতালে ওদের দেখে এসে এরা আমাদেরই বাসায় দাদা-দাদিকে বলছিলো, দেখে মনে হয় একজোড়া কাউয়ার ছানা। মায়ের মতো কাইল্যা, চেহারা ছবি একদম ভালোনা। মায়ের বেটি। এদের বিয়ে করবে কে? দাদা-দাদি প্রায় বলতো বুবুনের মা মহা চালাক। চালাকি করে আমার এতো সুন্দর ছেলেটাকে কবজা করে রেখেছে। কতো খারাপ ওরা! কেন দাওয়াত দিলে ওদের? আমি ওদের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখবো না। তোমরা কেউ রাখবে না।”

বুবুনের ইমোশনাল আউটবার্স্টিং হয়েছে। এই বয়সে এতো বড় শক পেয়েছে। এদিকে মা অসুস্থ, আরেক বোন অসুস্থ, ছোট্ট তুতুনের দেখাশোনা, লেখাপড়া, চাচা ফুপুদের কূটচাল ও স্বার্থপরতা….. কতো সহ্য করবে সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ এক তরুণ? ডেঙ্গুতে মরতে হলো রাজকে। তাতে সরকার,বিরোধী দল, অন্যান্য মানুষদের কি এসে গেলো? কিচ্ছু না। মাঝেমধ্যে সব ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছা করে।

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় কি নিয়ে যেনো বাপের উপরে রাগ করে ক্রিষ্টালের একটা পেপারওয়েট আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলো বুবুন, অবশ্যই বাবার অনুপস্থিতিতে। মা ভীষণ বকা দিয়েছিলো বুবুনকে। ভাই ও মায়ের রণমুর্তি দেখে ছুটে পালিয়েছিলো তুতুন, লুম্বিনী, রাজেশ্বরী। টম জেরি দেখা বাদ দিয়ে গভীর মনোযোগের সাথে পশুপাখির বাংলা আর ইংরেজি নাম আত্মস্থ করছিলো আরহাম ওরফে তুতুন। লুম্বিনী আর রাজেশ্বরী তড়িঘড়ি করে মুখের রং ধুয়ে,ধরাচূড়া খুলে ফেলে ” My mother ” প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করছিলো। তিন ভাইবোনের লেখাপড়া শেষ হতেই চাচ্ছিলো না। বুবুন তার মায়ের কাছে মাফ চাইতে এসেছিলো। মায়ের কোলে মাথা রেখে নিজের ভুল স্বীকার করেছিলো। বড় ছেলেকে আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি গলায় যখন ভালো মন্দ বুঝাচ্ছিলো তিতির, তখন ছোটো তিনটার ধড়ে প্রাণ এসেছিলো। কিছুক্ষণ পরে তুতুন এসে জানালো,প্রয়োজনের তুলনায় খুব বেশি পড়ে ফেলেছে আজ। এখন মা অনুমতি দিলে সে টম জেরি দেখতে পারে। রাজ-লুম্বিনী এলো গুটি গুটি পায়। ওরা কি এখন পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠতে পারে? “মাই মাদার ” প্যারাগ্রাফ মুখস্থ করেছে, আস্ত এক চ্যাপ্টার অংক করেছে। স্কুলের পড়াও নাকি খুব ভালো করে শেষ। ওদের অংক চেক করতে যেয়ে তিতির দেখলো, মিথ্যা বলেনি মেয়েরা, আস্ত এক চ্যাপ্টার অংক করেছে দুই মেয়ে।সমস্যা হলো, চ্যাপ্টারটিতে মোট তিনটা অংক।

ছোট তিনটাকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছিলো তিতির, বাবার উপরে রাগ করে বুবুনের পেপার ওয়েট ভাঙার গল্প কোনো অবস্থায় যেন না করা হয়। কথা দিয়েছিলো বাচ্চা তিনটা।

বাবার খাওয়ার পরে দুই পাশে বসলো দুই আদরিনী। যথারীতি লাল টুকটুক ঠোঁট, দুই গালে লাল ছোপ, কপালে লাল টিপ, ময়না খালার করে দেওয়া স্টাইলিশ খোঁপা, তার চার পাশে ফুলের মালা, হাতে পায়ের বিশ আঙ্গুলে টকটকে লাল নেইল পলিশ, পায়ে নূপুর, হাতে লাল টুকটুক চুড়ি।

“মামনিরা, কাঁচের চূড়ি ভেঙে গেলে হাতে ফুটে রক্ত বের হয়ে যাবেতো।”

রাজ বড় শ্বাস ছেড়ে বললো, ” কি আর করা বাবা।আমাদের তো কাঁচের ছাড়া আর চূড়ি নাই। ”

“চূড়ি না পরলেই হয়।”

“কি বলো বাবা! চূড়ি না পরলে হয়? ” দুই মেয়েই চমকে উঠলো।

“বিয়ের সময় আমাদের সোনার চূড়ি বানিয়ে দিবে না বাবা? ” উৎকন্ঠিত লুম্বিনীর প্রশ্ন।

“দিবো না মানে? অবশ্যই দিবো। এত্তো গুলো দিবো। সামনের মাসে বেতন পাই, আপাতত দু’জনকে দুইটা করে বানিয়ে দিবো,কেমন? ”

“তাই দিও বাবা,তাই দিও।” রাজ বলেছিলো। ” কাঁচ ফুটলে ভীষণ ব্যথা। রক্তও পড়ে খুব। ”

” তুমি কি করে জানলে মা? তোমার গায়ে কাঁচ ফুটেছে কোনোদিন? ”

“আজকে পায়ে ফুটেছে বাবা।”

“সে কি! কি করে? ”

“ঘরে একটা ছোট্ট কাঁচের টুকরো পড়েছিলো। খুব ছোট্ট, দেখতে পাইনি। কিৎকিৎ খেলার সময় পায়ে বিঁধে গেলো। সে কি রক্ত! নারে লুম্বিনী ? মা দেখলে বকবে,তাই লুকিয়ে বাথরুমে পা ধুয়েছি।এখনো অনেক ব্যথা।”

আসিফ মেয়ের পা কোলে নিয়ে বললো,”কোথায় ফুটেছে মামনি? ”

“এইতো বাবা,যেখানে তুমি হাত দিয়ে আছো।দাগ দেখতে পাচ্ছো না?”

আসিফ যা বোঝার বুঝলো। তারপরে বললো, ” কাঁচ কোত্থেকে আসবে? ”

তুতুন রাজেশ্বরীর পায়ের কাছে শুয়েছিলো এতোক্ষণ, দেবী দূর্গার পায়ের কাছে যেমন অসুর পড়ে থাকে। দুই বোনের কথার তোড়ে সে সিরিয়াল পাচ্ছিলোনা। পেটটা ফুলে যাচ্ছিলো বাচ্চাটার। এখন গড়গড় করে ভাইয়ার ইতিহাস সে সবিস্তারে বাবার কাছে এক নিঃশ্বাসে বর্ণনা করলো। রাজেশ্বরী আনন্দিত মুখে ছোট ভাইকে ধমক দিলো, “তুতুন, ভাইয়া আর মা বারবার আমাদের বলেছিলো এসব কথা আমরা যেন বাবার কানে না তুলি।তুই তুললি কেন?”

চলবে।

#সংসার
পর্ব ১২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

অসুখে মরে যাওয়া আমাদের দেশে খুব সাধারণ ব্যাপার। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল। কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। আর রাজনীতিবিদরা? এই দল ওই দলকে দুষে,ওই দল এদেরকে। সব ব্যাপারেই। তামাশা দেখতে দেখতে সবার চোখ পচে গেছে। কর্তৃপক্ষের কাছে মানুষ এখন কিছু আশাও করে না।

তুতুনের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু অর্পণ ডেঙ্গুতে মারা গেলে নতুন করে শোক উথলে উঠলো তিতিরদের। নার্সারি থেকে তুতুন আর অর্পণ এক সাথে পড়াশোনা করেছে। একই বেঞ্চে বসতো সবসময়। তুতুনের টিফিন প্রীতির কথা জানতেন রুবা ভাবি। ছেলের বক্সে অতিরিক্ত খাবার দিয়ে দিতেন তুতুনের জন্য। রাজের মৃত্যুর পরে আপন বোনের মতো সময় ও ভালোবাসা দিয়েছেন তিতিরকে। বিয়ের দশ বছর পরে অর্পণের জন্ম। ঐ একটিই সন্তান। সেই অর্পণকে আল্লাহ তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন! রুবা ভাবিকে জড়িয়ে ধরে তিতির হাহাকার করে কাঁদলো। অর্পণের জন্য। রাজেশ্বরীর জন্য। বেঁচে থাকা সন্তানদের ভয়াবহ ভবিষ্যতের আশংকায়। তুতুন হতবিহ্বল। সবার মনের অবস্থা শোচনীয়। অর্পণ তুতুনদের পরিবারের খুব প্রিয় পরিচিত একটা মুখ।

অর্পণের মৃত্যুর ঠিক পাঁচ দিন পরে মারা গেলো তিতিরের ছোট ননদের মেয়ে লোটাস। নয় বছর বয়স। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিচ্ছিলো আসিফ। ওদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো মেয়েটাকে। প্রাণপণ চেষ্টাতেও বাঁচানো গেলো না।

লোটাসের মৃত্যুর পরে শোকে উন্মাদিনী তুলি ঝাঁপিয়ে পড়লো তিতিরের উপরে, ” ডাইনি,পিশাচ, নিজের মেয়েকে খেয়ে নোলা ভরেনি, আমার মেয়েকে খেলি? রাক্ষসীর নজর ছিলো আমার ছেলে মেয়ের দিকে। খুব আনন্দ হচ্ছে এখন? ”

স্তব্ধ তিতির কোনো কথা বললো না। অর্পণ আর লোটাস অসুস্থ হওয়ার পরে দুই পরিবারকে সমানে সাপোর্ট দিয়েছে তিতির আর আসিফ। বাবা-মায়েদের কাউন্সেল করে, তাদের জোর করে কিছু খাইয়ে, তাদের বাসায় রান্না করা খাবার পাঠিয়ে , সবচেয়ে বড় কথা, আল্লাহর কাছে কেঁদে কেটে বাচ্চাদের সুস্হতার জন্য দোয়া করে রুবি ভাবি আর তুলিদের পাশে থেকেছে ওরা। তার এমন প্রতিদান! অর্পণের মায়ের হিস্টিরিয়া মতো হয়ে গিয়েছিলো। আসিফকে বলেছিলেন, ” আপনি আরেকটু চেষ্টা করলে কি আমার ছেলেটা বাঁচতো না ভাই ? আপনার তো আরও তিনটা বাচ্চা আছে,আমার কে আছে বলেনতো? নিজের মেয়ের জন্য যা করেছিলেন, আমার অর্পণের জন্য তা করেন নি আপনি। কেন বলেছিলেন এখনই আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে না? অন্যদেরকেও সন্তানহারা দেখতে চান আপনি। বুঝে গেছি আমি, সব বুঝে গেছি। ” অর্পণের বাবা বলেছিলেন,”ওর মাথার ঠিক নেই। কিছু মনে করবেন না ভাই। তবে আমারও মনে হয় আমার ছেলেটাকে আপনারা সঠিক সময়ে আইসিইউতে নেন নি।”

আইসিইউ তে নিতে কিছু ক্রাইটেরিয়া লাগে। অর্পণ আর লোটাসের তেমন কোনো সমস্যা ছিলো না। আসিফ সার্জন। তার অনুরোধে হাসপাতালের নামকরা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের আন্ডারে ভর্তি করা হয়েছিলো বাচ্চা দুটোকে। খুবই এক্সপার্ট মেডিসিন স্পেশালিষ্টও রেগুলার দেখতেন অর্পণ আর লোটাসকে। রাজেশ্বরীর জন্য যে তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে পারে নি আসিফ-তিতির , অর্পণ আর লোটাসের জন্য তা নিয়েছিলো। কিন্তু এতো ব্যাখ্যা দিতে ইচ্ছা করলো না।

শোকাতুর তুলিকে কষে চড় মারলো আসিফ। মনে মনে পরিবার নিয়ে বড় কষ্ট আছে আসিফের। তার ভাই বোনেরা সংকীর্ণতা থেকে বের হতে পারছেনা। কেন পারছে না, কে জানে?

ভাইয়ের হাতে শক্ত চড় খেয়ে এবারে আসিফের উপরে চড়াও হলো তুলি,” কোন্ সাহসে আমার গায়ে হাত তুললে তুমি? আমি তোমার নামে মামলা করবো। তুমি আর তোমার বৌ আমার লোটাসকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছো। নির্লজ্জ, বৌয়ের ভেড়া। শ্বশুরবাড়ির চাকর। আমার মেয়েকে মেরে ফেললো। আমার বাপ -মা’কে দেখেনি, কতো অবহেলায় মরলো আমার বাপ মা, ভাইবোন ভাগ্নে ভাগ্নি কারোর খোঁজ নেয়না, শুধু বৌয়ের গোলামি করে… ”

আসিফ আবার চড় মারার আগেই কলিগরা ধরে ফেললেন। জঘন্য নাটক হাসপাতালের মধ্যে। এরমধ্যে আসিফের মেজো বোন ফোঁড়ন কাটলেন, ” তুলির কোনো কথা মিথ্যা না। আর একটু আগে যে মায়ের মেয়ে মরেছে, সে উল্টাপাল্টা বলতেই পারে, শোকে পাগল হয়ে যেতে পারে, তাও তুই ওকে চড় মারলি? বৌয়ের তাঁবেদারি করলি? ”

মেডিসিন স্পেশালিষ্ট প্রফেসর বরুণ কান্তি বললেন, ” আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ডঃ আসিফ এবং ভাবির জন্য। এতো ভালো দুইজন মানুষের কপালে এমন ক্রিমিনাল ফ্যামিলি ? মেয়ের মৃত্যুও ভেতরের আবর্জনাকে কমাতে পারে নি। স্যরি আসিফ, আমি নাক গলাচ্ছি আপনার ফ্যামিলির বিষয়ে। যেহেতু ব্যাপারটা এখন আর পার্সোনাল বা ফ্যামিলিয়াল পর্যায়ে নেই। আমার খুবই ইচ্ছে হচ্ছে পুলিশ ডাকতে। আপনার -আমার কপাল খারাপ, কৃতঘ্ন ফ্যামিলির মেম্বার আমরা। ”

বুবুন রাগে ঘৃণায় কাঁপছিলো। মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে আসিফকে বললো, “বাবা, চলো।”

” তোরা যা। আমি পরে আসছি।”

“বাবা, ওদের সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। ওরা তোমার জীবনের অভিশাপ। তুমি চলে এসো। ”

প্রফেসর বরুণ বললেন, “বাবা,তুমি মা’কে নিযে বাসায় যাও। যতো যাই হোক,তোমার বাবার ভাগ্নি মারা গেছে। মামা হিসাবে তাঁর কিছু দায় থেকে যায়। আমি বহু বছর ধরে তাঁর সাথে কাজ করছি তো, তোমার বাবা দায়িত্ব এড়ানো শিখেন নি। তুমি মা’কে নিয়ে বাসায় যাও। তোমার বাবার সাথে যেনো ওরা এতোটুকু মিসবিহেভ করতে না পারে, সেটা আমি দেখছি। ”

বুবুন মা’কে খুব যত্ন করে বাসায় নিয়ে এলো। গাড়িতে মা’কে একহাতে জড়িয়ে ধরে রইলো। বাবা-মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বুবুনের। যারা সবার জন্য করে, তাদেরই কষ্ট পেতে হয় বেশি। লোটাসের জন্য খুব খারাপ লাগছে, তবে কোনো চাচা-ফুপুর জন্য না।

ভাগ্য, বাসায় তিতলী আম্মু আছে অরণ্য -অরণীকে নিয়ে চার পাঁচ দিন ধরে। তুতুন-লুম্বিনী আর বুবুনের দেখাশোনা করার জন্য। তিতির লোটাসদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তাই।

বাসায় এসে বুবুন দেখে, নানাভাই,বুবু,মামা,মামি,খালু আরও কয়েকজন নিকটাত্মীয় এসেছেন। লোটাস মারা যাওয়ার সাথে সাথে তিতলীকে জানিয়ে দিয়েছিলো বুবুন। তিতলী আম্মু আবার আত্মীয় স্বজনকে জানিয়ে দিয়েছে।

“আহা রে, ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা এই সেদিনও বেড়াতে এলো, লক্ষী একটা বাচ্চা, সে এখন দুনিয়ায় নাই। খুব কষ্ট হচ্ছে লোটাসের জন্য। তুলি সুস্থ আছে তো? কি ভয়ংকর অবস্থা আমাদের দেশের। আল্লাহ, রক্ষা করো। ”

সবাই শোকার্ত। নোমান বললো,” কি রে তিতির,বুবুন,তোরা চলে এলি কেনো? তুলির পাশে এইসময় তোর বেশি থাকা দরকার ছিলো। শরীর খারাপ লাগছে নাকি,তিতির? জানাজা আজ রাতেই হবে নাকি কাল? আমরা ওখানে যাই চলো। ”

বুবুন বললো,”ওখানে যেতে হবে না। ওরা মানুষ না। ”

“ছি! কি বলিস এসব । ছোট মানুষ, ছোটো মানুষের মতো থাকবি। কি হয়েছে রে তিতির? তোকে এরকম লাগছে কেনো? ”

“আমি একটু বেডরুমে যাই। ”

“যা,যা। দাঁড়া, আমিও আসছি। ফ্রেশ হয়ে শো, মাথা টিপে দিই। ময়না,ওদের দু’জনের জন্য ঠান্ডা শরবত বানাও।” নিশাত উদ্বিগ্ন গলায় বললেন।

“লাগবে না মা। আমি ঠিক আছি।”

তিতির বেডরুমে ঢুকে দরজা লক করে দিলো।

নোমান বাবাকে বললো,”বাবা, তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আমি আর আদনান যাই তুলির বাসায়। মা,তুমি আর তমাও চলো। তিতলী,তুই থাক বাবা,তিতির আর বাচ্চাদের ম্যানেজ করার জন্য। কাল যাস। বুবুন, তুই এখনও ফোঁস ফোঁস করছিস, কি ব্যাপার? কি হয়েছে? ”

রাগে আরিয়ান কাঁপতে থাকলো। তারপরে লাথি দিয়ে একটা টুল উল্টে ফেললো, কাঁচের জগ ছুঁড়ে ফেললো দূরে।ঝনঝন করে ভাঙলো ওটা।

নিশ্চয় কোনো খারাপ,অপমানজনক ঘটনা ঘটেছে। নইলে বুবুন এমন করতো না। রাজের মৃত্যুর পর থেকে এই ঘোড়া রোগ হয়েছে ছেলেটার।

আধাঘন্টা পরে সবার হুঁশ হলো, এখনো দরজা খুলেনি তিতির। প্রথমে দরজায় ধাক্কাধাক্কি, তিতিরের উদ্দেশ্যে সবার আর্তচিৎকার, পাগলের মতো চাবি খোঁজাখুঁজি। দরজা ভাঙার চেষ্টা চলছে যখন,তখন চাবি পাওয়া গেলো। পার হয়ে গেছে আরও পনেরো মিনিট। ডেটলের তীব্র গন্ধে ভয়ে হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে সবার।

তিতির পড়ে আছে মেঝেতে। নিথর। পাশে প্রায় খালি হয়ে যাওয়া ডেটলের বোতল।

চলবে।