#সংসার
পর্ব ১৯
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
আদনান গলা চড়িয়ে তিতলীর নামে একের পর এক অভিযোগ করে যাচ্ছে। ছেলেটা জিনিয়াস কিন্তু পাগলা কিসিমের।
নিশাতের অসহ্য লাগছিলো সবকিছু। তিন ছেলেমেয়েকে অতি যত্নে মানুষ করেছেন তিনি। তারা যখন ছোটো ছিলো, স্বপ্ন দেখতেন কতো! নোমানের জন্য লক্ষী একটা বৌ আসবে। রূপে লক্ষীর দরকার নেই, বিদ্যায় সরস্বতী। তিতির-তিতলীর মতো সেই মেয়েও তাঁদের বুক জুড়ে থাকবে, বাবা-মা বলে দরকারে অদরকারে ছুটে আসবে, তাঁদের সাথে মন খুলে গল্প করবে, সুসময়-দুঃসময় সবসময়ে নিশাত তাকে আগলে রাখবেন। সম্পূর্ণ অচেনা একটা মেয়ে তাঁর কন্যার আসনে বসবে, বউ-শাশুড়ি সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হবেন। বউ রান্না করে তাঁদের খাওয়াবে, তাঁদের নানা ফরমাশ পালন করবে, রাতে মশারি টাঙিয়ে দিবে, কোনোদিন কল্পনাতেও আনেননি নিশাত-নাজমুল। সংসারে তমা আসার পরে তাকে মেয়ের আদর দিয়েছিলেন নিশাত-নাজমুল। আন্তরিক ভাবে। তিতির -তিতলীর থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যা কিছু কিনতেন, বৌ আর দুই মেয়ের জন্য একদম একরকম। উপহার হিসাবে টাকা দিলে তিনজনকে সমান সমান। এখন পর্যন্ত। বৌয়ের পড়াশোনা, চাকুরি, বেড়ানো কিছুতে কখনো বাধা দেননা তাঁরা।তমা প্রথম দিকে তাঁদের মনের মতো একটা বৌ ছিলো। নিশাত আর নাজমুল সাহেব তমাকে ভীষণ আদর করতেন, তার অতি সামান্য কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন, আত্মীয় -বন্ধু -প্রতিবেশীদের সামনে তমার গুণগাণ গাইতেন অনেক। সেই তমা বেশ দ্রুত পাল্টে গেলো। এমন নয় যে তাকে আলাদা সংসার করতে দেওয়া হয়নি। নিশাত বারবার নোমান -তমাকে বলেছেন, ইচ্ছা করলেই তারা আলাদা সংসার করতে পারে। সব মেয়েরই নিজস্ব সংসারের স্বপ্ন আছে। আলাদা সংসার করার ষোলো আনা ইচ্ছে থাকলেও তমা সবদিক হিসাব করে দেখেছে, শ্বশুর -শাশুড়ির সাথে থাকাটা ভালো,তার জন্য লাভজনক। দিনকে দিন ঔদ্ধত্য বেড়েছে তমার। তাকে কেউ ঘরের বৌ হিসাবে দেখেনি, দেখেছে পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে। তমা তার মর্যাদা রাখতে পারছেনা। সবচেয়ে দুঃখের কথা, তমা নোমানকে অনেক কথা বলতো যেটার মধ্যে সত্যতা থাকতোনা। উচ্চশিক্ষিত, চাকুরিজীবী মেয়ে কেমন করে অসত্য বলতে পারে? আবার সেই প্রশ্ন এসে যায়, শিক্ষা আসলে কী? সংসারের শান্তির জন্য নোমানকে কম্পোমাইজ করতে হয় অনেক। নাজমুল সাহেব -নিশাত তমার কাছ থেকে সামান্য সময়টাও আশা করেননা। আল্লাহ ছাড়া তাঁরা কারোর উপরে নির্ভরশীল না। তবু ছেলে-ছেলেবৌয়ের ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে। তিতির ছিলো মাটির মতো নরম একটা মেয়ে। অতি সামান্য ভালো ব্যবহার ছাড়া তার আর কোনো চাহিদা ছিলোনা। সেই মেয়ে ভয়ংকর জটিল এক শ্বশুরবাড়িতে পড়লো। দেখতে নিষ্পাপ আসিফও নেহাৎ সহজ সরল মানুষ ছিলোনা। অনেক সমস্যা তার ছিলো, এখনো কম হলেও আছে। বিয়ের পরে তিতির ক্রমাগত মানসিক আঘাতে বিষন্নতার রোগী হয়ে গেলো। একমাত্র ভাইবৌকে দারুণ ভালোবাসতো তিতির-তিতলী। তিতিরের ভালোবাসার মূল্য দেয়নি তমা। নোমানকে সে জানিয়েছে বড় ননদকে সে সহ্য করতে পারেনা। কেন পারেনা, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। আহারে তিতির! সবাইকে এতো ভালোবাসতে যাস কেন মা? তোর নম্রতা, তোর ভালোবাসাকে মানুষ দুর্বলতা মনে করে। নরম সরম পুতুল পেয়ে তোর শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদরা তোকে পায়ের তলায় রাখতে চাইলো। তোর সারল্যের অনেক সুযোগ আসিফও নিয়েছে। দিনশেষে অপরাধীর কাঠগড়ায় তোকেই দাঁড়াতে হয়। তার উপরে মেয়ে তোর বুক খালি করে চলে গেলো। নম্রতা ঝেড়ে ফেল মা, শক্ত হ। দরকারে কঠিন হ। নইলে সবাই তোকে নিংড়ে নিবে। আর তিতলী? নাজমুল -নিশাতের অতি ভালোবাসার ধন। বাড়ির ছোটো মেয়ে। তার দশ বছর বয়সেও বাবা কোলে নিয়ে বেড়িয়েছে, মা মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে, বড় ভাই আর বড় বোন পাখির মতো ডানা মেলে আগলে রেখেছে ছোটো বোনকে। সংসারের জন্য এতো স্যাক্রিফাইস করলো মেয়েটা। সন্তানদের নিয়ে শাশুড়ির নানা বাহানার কারণে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলো। পয়সাওয়ালা শিক্ষিত পরিবার, চাকুরিজীবী বৌয়ের বেতনও নিতো, গৃহকর্মীর রিপ্লেসমেন্ট হিসাবেও ব্যবহার করতো। অরণ্য -অরণীকে সামান্য সাপোর্ট দিলে মেয়েটা চাকরি করতে পারতো, আদনানের মতো সেও ফ্ল্যাট কিনতে পারতো। আদনান সংসার খরচ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হিসাবী ছিলো। হিসাবের টাকায় সংসার চালাতো তিতলী, বাচ্চা দুটোকে বলতে গেলে এক হাতে মানুষ করেছে। সেখানেও আদনানের সহায়তা পায়নি। এই তার প্রতিদান! আদনান নিজের ফ্ল্যাট কিনলো তিতলীকে ঘোর অন্ধকারে রেখে। প্রথম থেকে জানালে আদনানের মায়ের পাশাপাশি তিতলীও তার পছন্দ মতো ফ্ল্যাট সাজাতে পারতো।
দুটো ছেলেমেয়ে বিয়ে করবে, সুখে সবাইকে নিয়ে সংসার করবে, অন্তত নিজেরা সুখী হবে, কিন্তু তা হয়না কেন?
তিতলী ঠান্ডা গলায় বললো, ” আমি ওদের জয়েন ফ্যামিলিতে থাকবোনা। ইন ফ্যাক্ট, আমি আদনানের সাথেও থাকবোনা। অনেক হিউমিলিয়েট করেছে আমাকে, আর না। ”
রাগে অন্ধ আদনান চেঁচিয়ে বললো, ” তোকেই আমি আমার সাথে রাখবোনা। ডিভোর্স দিবো।আজকে,এক্ষুনি। ”
মুহূর্তের জন্য ঘরে পিনপতন নীরবতা। সেই নীরবতা ভাঙলেন মতিউর সাহেব। কড়া গলায় ছেলেকে বললেন,” চুপ করো। মাথার ঠিক আছেতো? ”
নিশাত ভীষণ শান্ত গলায় বললেন, ” আমার মনের কথা বলেছো আদনান।আমি চাই,তিতলী ডিভোর্স দিক তোমাকে। যে স্বামী এমন জঘন্য ভাষায় কথা বলতে পারে স্ত্রীর সাথে, তার কাছে আর মেয়ে আর নাতিদের দিবোনা।”
” আপনার মেয়েকে নিয়ে আমার হেডেক নেই , কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কথা বলার আপনি কে? ”
নোমান শক্ত গলায় বললো, ” আদনান, তুমি ভুলে যাচ্ছো, তুমি আমাদের মায়ের সাথে কথা বলছো। আমাদের সামনে আমার বোনের উপরে চোটপাট করছো। আমি মায়ের সাথে একমত, তুমি তিতলীর উপযুক্ত নও। তোমাদের ডিভোর্স হওয়াটা সবার জন্য মঙ্গলজনক। অরণ্য -অরণীকে তুমি পালন করবে কীভাবে? ওদের জন্মোর পর থেকে কী করেছো ওদের জন্য তুমি বা তোমার ফ্যামিলি? ”
“আমি আপনার মতো বৌয়ের গোলাম না যে বৌকে না জানিয়ে কিছু করতে পারবোনা। ”
নাজমুল সাহেব অবসন্ন ভাবে সোফায় এলিয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ” বুয়েট থেকে পাশ করা, বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া ইন্জিনিয়ার ছেলের মুখের এমন ভাষা ! এ রকম বডি ল্যাংগুয়েজ। ছিঃ! ”
তিতলী চিৎকার করে বাপকে বললো, “এই ছি তোমার ও মায়ের অনেক আগেই বলা উচিত ছিলো। জামাইরা তোমাদের কাছে পীর সাহেব। তিন ছেলেমেয়ের থেকে তোমরা তাদের স্পাউসদের গুরুত্ব দিয়েছো অনেক। তারা অন্যায় করলেও চুপ থেকেছো, আমাদেরকেও চুপ করিয়ে দিয়েছো। আমি আমার ডিসিশন জানিয়ে দিচ্ছি , আমি ওর সাথে সংসার করবোনা। ”
মতিউর সাহেব বললেন, ” রাগের মাথায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়না তিতলী মা। মাথা ঠান্ডা হোক, তখন সিদ্ধান্ত নিবে ডিভোর্স দিবে কী দিবেনা। তোমার শাশুড়িকে আমার ডিভোর্স দেওয়া উচিৎ ছিলো অনেক আগে। আমি ব্যক্তিত্বহীন,মেরুদণ্ডহীন মানুষ। অশান্তির ভয়ে সবসময় কাতর। তাই তোমার শাশুড়ির হুকুম মতো চলতাম। আমার বাবা-মা একদম সাদামাটা , সাতে নেই পাঁচে নেই মানুষ ছিলেন। তাঁদেরকে নিজের কাছে রাখতে পারলামনা। তোমার ডলি ফুপু কপালের দোষে বিধবা হলো, শ্বশুর বাড়ি তাকে সম্পত্তি দিলোনা, তিন তিনটা মেয়ে নিয়ে সে অভাবে হাবুডুবু খেতে লাগলো, মেয়ে তিনটা ভালো ছাত্রী ছিলো, তোমার শাশুড়ির শাসানোর চোটে বোনকে এতোটুকু সাহায্য করতে পারিনি। একটা মেয়ের পড়ার খরচ দিতে চেয়েছিলাম, তোমার শাশুড়ি বললেন তিনি গায়ে আগুন দিবেন তাহলে। আমি পরিবারের প্রথম সন্তান, সবার বড় ভাই, কারোর জন্য কিছু করতে পারিনি।তোমার মেজো চাচা, বড় ফুপু আর ছোটো চাচা সামলেছে সব বিপদ আপদ আর সমস্যা। দোষ কাউকে দিবোনা, দোষ সম্পূর্ণ আমার। পার্সোনালিটি জিনিসটা আমার মধ্যে এক বিন্দু থাকলেও আমার তিনটা ছেলেমেয়ে অমানুষ হতোনা, আমার বাপ-মা-ভাই-বোন বঞ্চিত হতোনা। আদনান মাথামোটা, তাই তোমার শাশুড়ি তাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায় আর সে ঘুরে। আরিজ -আফরা চিকন বুদ্ধির। তারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে এক পাও নড়বেনা। আদনান ফ্ল্যাট করার আগে কিন্তু আরিজ-রায়নার ফ্ল্যাট কেনা সারা। মোটা টাকা ভাড়া আসে সেখান থেকে। থাকে আমাদের সাথে। সাহেব-বিবি এতো রোজগার করে, কিন্তু আমাদের থেকে কিন্তু ঠিকই খরচ নেয়। তোমার শাশুড়ি এখানে সুবিধা করতে পারেননি।তার ও আমার খাওয়ার, ওষুধের, চিকিৎসার খরচ আমাদেরকেই বহন করতে হয়। ভুল বললাম, আমাদের খরচের অনেকটা তোমার শাশুড়ি নিয়মিত আদনানের কাছ থেকে আদায় করে নেয়। তোমার শাশুড়ি একটা সময়ে আমাকে আর এখন বড় ছেলেকে টাকার মেশিন ছাড়া আর কিছু ভাবেনা। তার কয়েকটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। সেখানে টাকার পরিমাণ কতো জানলে হতভম্ব হয়ে যাবে। অনেক উঁচু চাকরি করতাম, মাসের প্রথম দিন সমস্ত টাকা তার হাতে তুলে দিতে হতো। সেখান থেকে হিসাব করে সে আমাকে হাতখরচ দিতো। মাসের মাঝে টাকা চাইলে এতো কৈফিয়ত দিতে হতো, টাকা চাওয়া বন্ধ করে দিলাম। আমি হলাম বৌয়ের ভেড়া। গোলামও বলতে পারো। আর আদনান হলো মায়ের ভেড়া। এতো কথা আজ বলে ফেললাম, বলিনি কখনো কাউকে, কিন্তু এতো অনাচার এই বুড়ো বয়সে আর নিতে পারছিনা। শান্তির আশায় গোলামি করেছি, কিন্তু শান্তি পেলাম কী?
চলবে।
#সংসার
পর্ব ২০
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
সুনসান , চুপচাপ বাসা। তিতলী সপ্তাহখানিক ছিলো দুই বাচ্চা নিয়ে। তিনদিন আগে ফিরে গিয়েছে নিজের সংসারে।আদনানের বিস্তর ক্ষমা চাওয়ার পর। মতিউর সাহেবের কাতর অনুরোধে। নাজমুল-নিশাত সিদ্ধান্তের ভার সম্পূর্ণ তিতলীর উপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আদনানকে ডিভোর্স দিলে তিতলী সসম্মানে সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের বাড়িতে থাকবে। সে যদি নিজের সংসারে ফিরে যায়,তাতেও কারোর আপত্তি নেই। তিতলী অ্যাডাল্ট, ইনটেলিজেন্ট। নিজের সিদ্ধান্ত নিজের নেওয়ার ক্ষমতা আছে।
তিতলীর শাশুড়ি এই ঘটনার পরে কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়েছেন। তাঁর কল্পনাতেই আসেনি কখনো স্বামী তাঁকে সবার সামনে এমন ভাবে উন্মোচিত করে দিবেন। তিতলী ডিভোর্সের ঘোষণা দিবে এটাও তিনি কল্পনা করেননি। নাইমা খুব ভালো করে জানেন, আরিজ আর আফরা নিজেদের ভালোটা সবার আগে বুঝবে। বৈষয়িক জ্ঞান তাদের টনটনে। এখন আদনান যদি পারিবারিক অশান্তির জেরে মাতৃভক্তি কমিয়ে দেয়, তাহলে সমস্যা। আদনান তিতলী আর বাচ্চাদের অসম্ভব ভালোবাসে, ভালোবাসে যেমন প্রচণ্ড ভাবে বাবা-মা’কে। ছেলের সংসার ভাঙার বেদনা তিনি সইতে পারবেননা। আদনান স্রেফ পাগল হয়ে যাবে তিতলী ডিভোর্স দিলে।
তিতলী শেষ পর্যন্ত আদনানকে আরেকবার সুযোগ দিলো। অরণ্য আর অরণীর জন্য মন খুব ছটফট করছে নিশাত -নাজমুলের। জানের টুকরা দুইটা।
গত পরশু নোমান-তমারা আবার বিদেশ ভ্রমণে গেছে ছেলেদের নিয়ে। বাসায় শুধু তাঁরা দু’জন আর দুই গৃহকর্মী। তিতির আর বুবুন এসেছিলো তাঁদের নিয়ে যেতে, তাঁরা রাজি হননি।
দুনিয়া বড় অদ্ভুত। জীবনের উদ্ভট নিয়মগুলো মানুষই তৈরি করেছে। জীবনের সব সাধ আহলাদকে মাটিচাপা দিয়ে তাঁরা দু’জন ছেলেমেয়েদের বড় করেছেন। সুন্দর শাড়ি-গয়না তরুণীকালে তাঁরও পরতে ইচ্ছা করেছে মাঝেমধ্যে, কপালে জোটেনি। আশেপাশের ভাবিরা যখন কাতান-বেনারসীতে ঝলমল করতেন, গলায় নেকলেস, হাতে বালা-চূড়ি, কানে ঝুমকো পরে কোন অনুষ্ঠানে আসতেন, নিশাত সাধারণ সিল্কের শাড়ি, গলায় সবেধন নীলমনি একটা চেইন পরে, কানে ভাশুরের দেওয়া ঝুমকো পরে , ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দিয়ে হাজির হতেন। সৌন্দর্যের জন্য এতেই তাঁকে সবার মাঝে অপরূপা মনে হতো। কারো কারো শাড়ি, কারোর গয়নার ডিজাইন তাঁর খুব ভালো লেগে যেতো, কিন্তু মনের কথা তিনি মনেই রাখতেন। নাজমুল সাহেবের সাধ্য বা ইচ্ছা ছিলোনা এগুলো কেনার। তাঁকে নিজের মা-বোন-বোনের বাচ্চাকাচ্চার দায়িত্ব পালন করতে হতো, তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে তিনি খুবই সিরিয়াস ছিলেন, আর বেতনের কিছু অংশ নিয়মিত সঞ্চয় করতেন। তাহলে আর রইলো কী? সংসারের জন্য নিজের সব শখ,স্বপ্ন, ইচ্ছাকে স্বেচ্ছায় কবর দিয়েছিলেন নিশাত। বিলাসী জীবন সন্তানদের তাঁরা দিতে পারেননি, দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি, তবে তিন ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, বইখাতা,ভালো স্কুল-কলেজ, প্রাইভেট টিউটর, চিকিৎসা, ওষুধ,পুষ্টিকর খাওয়া এসব বিষয়ে তিলমাত্র কার্পণ্য করেননি নাজমুল সাহেব। নিজের সামর্থ্যের মধ্যে স্ত্রী -সন্তানকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেছেন।
ভালোবেসে এখনো সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তাঁরা।
সব বাবা -মা কিন্তু এক নন। সবাই কিন্তু সংসার-সন্তানের জন্য সব জলাঞ্জলি দিতে পারেননা। দেওয়াটা ঠিকও না। অনেক বাবা-মা আছেন যাঁরা রিটার্ন চান “তোমাকে মানুষ করার জন্য এই করেছি, ওই করেছি, এখন ফিরিয়ে দেওয়ার পালা। ” রিটার্নের কথা কখনো মাথায় আসেনি নাজমুল নিশাতের। কিন্তু কিছু জিনিস মনে আঘাত দেয়।মনের অজান্তেই মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।
ভাগ্য ভালো, নাজমুল সাহেব চাকরি জীবনের গোড়া হতে অল্প হলেও সঞ্চয় করতেন। এতে তিনি নিজেকে আর স্ত্রীকে বঞ্চিত করেছেন প্রচণ্ড ভাবে, তবে রিটায়ার করার পরে ফ্ল্যাট কিনতে পেরেছেন। নিজেদের ওষুধ,চিকিৎসার খরচ নিজেরাই চালান। উল্টে ছেলেমেয়েদেরও সাহায্য করেন। উপহারতো দেনই। আল্লাহর কাছে কোটি শুকরিয়া, অসুস্থ ও বয়স্ক হওয়ার পরে ছেলেমেয়েদের কারো উপরে নির্ভরশীল হতে হয়নি তাঁদের। আর্থিক ভাবে আত্মনির্ভরশীল না হলে কী যে হতো!
এসব চিন্তা মাথায় আসলে শিউরে ওঠেন নিশাতও। আজকাল অল্পেই বিরক্ত হওয়া, ভুরু কুঁচকে ফেলা, অসহিষ্ণু গলায় কথা বলা, ঠারেঠুরে মা-বোনদের নামে বিরূপ মন্তব্য করা এই নোমানকে চিনতে কষ্ট হয় নিশাতের। তমার স্বেচ্ছাচারিতা, স্বার্থপরতা, অমার্জিত কথাবার্তা সীমা ছাড়িয়ে যায় মাঝেমধ্যে , ছেলে দেখেও দেখেনা। নিশাত বা নাজমুলেরও রুচি হয়না বৌমাকে কিছু বলার। ছেলের কানে কথা তোলার কথা তাঁরা ভাবতেই পারেননা। কিন্তু এই মেয়েটা বিয়ের বছর খানেক পার হতে না হতেই নোমানকে তার বাপ-মা -বোনদের নতুন করে চেনাচ্ছে। আর নোমানও শিক্ষানবিশের মতো বৌয়ের কাছ থেকে জীবনের নানা বিষয়ে দীক্ষা গ্রহণ করছে। নোমানের তাই মনে হয়, বাপ-মা বৌমাকে আর নিজেদের মেয়েদের ভিন্ন চোখে দেখেন, বৌকে পছন্দ করেননা, বৌয়ের খুঁত ধরেন, এমন কী বৌয়ের খাওয়ার সময় নাকি ভালো আইটেম সরিয়ে রাখতেন আর মেয়ে আসলে বের করে দিতেন, ছেলে-ছেলেবৌ ঘুরেফিরে বেড়ালে বাপ-মায়ের ভালো লাগেনা, মা-বোনেরা বৌয়ের নামে কূটকাচালি করে, আরও অনেক কিছু। জন্ম থেকে যাদের দেখে আসছে নোমান, তাদের সম্পর্কে এমনসব কথা সে কীভাবে বিশ্বাস করে,এটা একটা বিষ্ময়।
বুবুন সেদিন আচমকা তিতিরকে বললো,”আমাদের ফ্যামিলি একটা থার্ড ক্লাস ফ্যামিলি।”
তিতিরের মারধোরের হাত নেই। তাই বুবুন মারটা খেলোনা।
” তোমার আর বাবার মধ্যে কয়েকদিন পরপর ঝগড়া,কথা কাটাকাটি। যদিও তোমরা বেশি চিৎকার, হৈচৈ করোনা। নানা-বুবুর মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে, মামা-মামিরতো কথাই নেই। তিতলী আম্মু আর খালুও কম যায়না। আবার তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তোমাদের সবার সাথে সবার কথা কাটাকাটি। কোনো পজিটিভ চিন্তা নেই, পজিটিভ কথা নেই, চারদিকে শুধু নেগেটিভিটি। ”
“সব পরিবারেই এমন হয় বুবুন। রাগারাগি হয়, সেটা মিটেও যায়। ভালোবাসার অভাব নেই আমাদের মধ্যে। ”
” মা, সর্বনাশটা হয় আমাদের। তোমাদের কাদা ছোড়াছুঁড়িতে আমাদের দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে রাগ আসে, হতাশা আসে, জীবনীশক্তি কমে যায়। গার্জিয়ানদের কাছ থেকে আমাদের ভালোটা শেখার কথা, সেখানে সবচেয়ে খারাপ জিনিসটাই আমরা গার্জিয়ানদের কাছ থেকে শিখি।”
“আচ্ছা, তোর বৌ আসলে দেখবো তোরা কী করিস।”
“স্যরি মা, বিয়ের বিষয়ে আমার চরম আতংক। বিয়ে মানেই জটিলতা। বিয়ে মানেই রেষারেষি। বিয়ে মানেই বাচ্চার জন্ম দিয়ে তাকে গভীর গাড্ডায় ফেলা। আমরা ভাইরা ঠিক করেছি, আমরা কেউ বিয়ে করবোনা।”
কচি ও উৎকন্ঠিত একটি গলা শোনা গেলো,” আমি বিয়ে করবো। আমি তোমাদের দলে নেই।”
তুতুন। মায়ের বেডরুমের দরজায় স্বভাববশতঃ কান লাগিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলো।
বুবুন বললো,”মা, তোমার এই গুটলিকে ঠিক করো। বড় হচ্ছে, তারপরও আড়িপাতা অভ্যাস। খুব খারাপ অভ্যাস। তুমি ঠিক না করতে পারলে আমার উপরে ছেড়ে দাও। আড়িপাতার অভ্যাস আর বিয়ে করার সাধ দুইই উবে যাবে। ”
তিতির উত্তর দিলোনা। সে তখন বুবুনের বলা কথাগুলো ভাবছিলো। কথাগুলো সত্যি, চরম সত্যি। শিশুদের মনোজগতের প্রথম ও বিশাল ক্ষতি সাধারণত বাবা-মায়েরাই করে। ইরফান,আয়মান, অরণ্য, অরণীর বিভিন্ন সময়ের মলিন মুখগুলো মনে করে তার বুক মুচড়ে উঠলো। তার আর আসিফের মনোমালিন্য বুবুনের উপরে প্রভাব ফেলেছিলো এক সময়, তুতুন-লুম্বিনী -রাজের উপরে তেমন পড়েনি।
তিতির বুবুনের হাত আঁকড়ে ধরে বললো,”ক্ষমা করে দে বাবা, আমাদের ক্ষমা করে দে।”
“বাদ দাও। নানা-বুবু ফাঁকা বাসায় আছে, তোমার টেনশন হচ্ছেনা? ”
টেনশন আবার হচ্ছে না! কতো অনুরোধ, উপরোধ, বাবা-মা এখানে আসতে রাজিই হলেননা। তাঁদের বক্তব্য , নোমানরা কয়েক মাস পরপরই সাতদিন -দশদিনের জন্য বেড়াতে যাচ্ছে, বেড়াতে যাবে, প্রতিবারই কী তাঁদেরকে নিজ বাড়ি ফেলে মেয়ের বাসায় যেতে হবে? তাঁরা কী অক্ষম?
ব্লাড প্রেশার দু’জনেরই খুব ফ্ল্যাকচুয়েট করে, করলে করুক, তবু দরকারে একলা থাকবেন তারা।
ছেলেমেয়েরা বড় স্বার্থপর। তিতির বাপের বাড়ি যেয়ে থাকতে পারছেনা লুম্বিনী আর তুতুনের স্কুলের কথা ভেবে, আসিফের শরীর ইদানিং প্রায় খারাপ যাচ্ছে এটাও একটা কারণ। বুবুন যেয়ে থাকতে পারতো। কিন্তু তার ভার্সিটি খোলা। পরীক্ষা হচ্ছে।তিতলীরও একই সমস্যা।
আচ্ছা, বাসায় যদি অসুস্থ, দুর্বল দু’জন মানুষ থাকেন যাঁরা তাঁদের সর্বস্ব দিয়েছেন পরিবারের কল্যাণে, সে ক্ষেত্রে ঘন ঘন লম্বা সময়ের জন্য বেড়াতে যাওয়া কতোটা যুক্তিযুক্ত? উত্তর বিভিন্ন রকম হবে। কারণ সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। কেউ কেউ বলবে, এটাইতো স্বাভাবিক। যার যার জীবন তার তার। বাপ-মায়ের জন্য বেড়ানো বন্ধ রাখতে হবে নাকি? হোক সেটা ঘন ঘন। ছেলে-বৌ-নাতিরা বাসায় থাকলেও সময় দেয়না, এটাও দোষের নয়। ব্যস্ত জীবন , ব্যস্ত সময়। খুব হেকটিক শিডিউল। অফিসে দীর্ঘ সময় ধরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, রিফ্রেশমেন্টের জন্য রেস্টুরেন্ট, শপিং, বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সামাজিক কারণে সব দাওয়াত রক্ষা করা, ফিউচার প্ল্যানিং নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা, এতোকিছুর মধ্যে দু”জন মানুষকে কতোটা সময় দেওয়া সম্ভব? আর এতো ব্যস্ত জীবনে সময় পেলে অবশ্যই বেড়াতে যাওয়া উচিৎ। বাপ-মায়ের জন্য সব আটকে থাকবে নাকী?
কি এক অদ্ভুত সংস্কার,স্নেহ নিম্নগামী। বাপ-মায়ের থেকে সন্তানের প্রতি বেশি যত্নশীল হও, সন্তান আর স্বামী বা স্ত্রী সবার আগে। তারপরে না বাবা-মা।
সাইকোলজির এক অধ্যাপক একবার তিতিরকে বলেছিলেন, বাবা-মা নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের ইচ্ছায় সন্তানকে পৃথিবীতে আনেন।কাজেই সন্তানদের দেখাশোনা তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক। ছেলেমেয়েরাতো স্বেচ্ছায় দুনিয়ায় আসেনি।কাজেই তাদের দায় নেই বাবা-মা’কে দেখাশোনা করার।
কী অদ্ভুত কথা! মানুষের চিন্তা ভাবনা, মূল্যবোধের কী আজব অবস্থা!
চলবে।