সংসার পর্ব-২১+২২

0
22

#সংসার
পর্ব ২১
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

লুম্বিনী স্বপ্ন দেখছিলো।প্রায় একই ধাঁচের স্বপ্ন সে বলতে গেলে প্রতিদিনই দেখে। তারা দুই জমজ বোন খাচ্ছে, খেলছে, স্কুলের মাঠে দৌড়াচ্ছে, বাবার দু’পাশে দুই বোন বসে আছে, মা ভাত মেখে একবার রাজের মুখে,আরেকবার লুম্বিনীর মুখে দিচ্ছে , ভাইয়ার পিঠে বসে দুই বোন ঘোড়া ঘোড়া খেলছে, পুতুল খেলায় নেওয়া হচ্ছেনা বলে ছোট্ট তুতুন গলা ফাটিয়ে কাঁদছে, নানা-বুবুর বেশি প্রিয় কে, রাজ না লুম্বিনী, এই নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। বাস্তবে যা ঘটতো, সেগুলোই অমূল্য স্বপ্ন হয়ে ধরা দেয় লুম্বিনীর কাছে।

আজকের স্বপ্নটা এতো বাস্তব। স্বপ্নই মনে হচ্ছিলোনা। রাজ আর লুম্বিনী বিরাট একটা ফুল বাগানে খেলছে। দুই বোনেরই দুইটা করে ডানা, পাখির মতো কিংবা পরীর মতো। স্বপ্নেই কীযে আনন্দ লাগছিলো লুম্বিনীর। মনে হচ্ছিলো রাজ এখন থেকে তাদের সাথেই থাকবে। মাঝখানে কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলো।

ঘুম ভাঙার পরও লুম্বিনীর মনে হচ্ছিল তারা দুই বোন আজ বিকেলে একটা বড় ফুল বাগানে খেলে এসেছে। কিন্তু এখন রাজ কোথায় গেলো? বিছানায় বা বাথরুমে নেইতো। তাহলে কী বাবা-মায়ের মাঝখানে ঢুকে পড়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে ?

লুম্বিনী বাবা-মায়ের ঘরে ঢুকলো। বাবা-মা ঘুমাচ্ছে, রাজ নেই। লুম্বিনী ভাইয়ার ঘরে গেলো। তুতুনকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। ময়না খালা আর আমেনা বুবুর ঘরেও গেলো লুম্বিনী। নাহ্, নেই।

লুম্বিনী আবার গেলো বাবা -মায়ের ঘরে।

“মা, ও মা ! ”

তিতির ধড়ফড় করে উঠে বসলো। মেয়েকে কাছে টেনে বললো,”কী হয়েছে মা?”

“রাজ কোনো ঘরে নেই। সব ঘর দেখে এসেছি।”

তিতির স্তব্ধ হয়ে গেলো। রাজের নাম শুনে বোবা কষ্টে আর লুম্বিনীর জন্য উৎকন্ঠায়। অনেক চিকিৎসা, আদর যত্নের পরে সুস্থ হয়ে উঠেছে মেয়ে, আবার অসুখ ফিরে এলোনা তো?

“মা,রাজ কোথায়? রাজ কোথায়? ওহ্,রাজ তো নেই, মরে গেছে। রাজতো কবেই মরে গেছে। রাজ…….”

তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর হাহাকার শুনে সবার ঘুম ভেঙে গেছে। সবাই জড়ো হয়েছে এই ঘরে। তিতির জাপ্টে ধরেছে মেয়েকে।আসিফ লুম্বিনীকে নিজের কাছে টানার চেষ্টা করছে। সদ্য ঘুম ভাঙা ভয়ার্ত তুতুন আঁকড়ে ধরেছে বড় ভাইকে। ময়না খালা ছুটে গেছে মগ ভরে পানি আনতে। লুম্বিনীর মাথায় পানি ছিটাতে হবে।

লুম্বিনীর এমন বিপর্যয়ের পিছনে কারণ আছে। হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া সে আর রাজ ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছে তারা দেখতে ভালোনা। সরাসরি শুনেছে, ঠারেঠুরে শুনেছে। তাদের গায়ের রং ময়লা, তারা বাইট্টা, তাদের চোখ ছোটো, তাদের নাক বোঁচা, “চেহারার কাটিং একদম ভালোনা, আহা, বাপ-ভাইরা রাজপুত্র , আর এই দুইটা খেদি-বুঁচি মায়ের মতো। অথচ মেয়ে দুটোরই বাপের মতো হওয়া দরকার ছিলো।”

এসব কথা শুনলে রাজেশ্বরী বক্তাকে আক্রমণ করে বসতো। খামচি, ধাক্কা এসব আর কী। তারপরে গলা ছেড়ে কান্না, বাবা-মায়ের কাছে নালিশ।

মা হেসে বলতো, ” মায়ের মতো হয়েছিস শুনলে তোদের কষ্ট লাগে? তোরা আমাকে ভালোবাসিসনা? আমার মেয়েরা বাবাকে বেশি ভালোবাসে, আমাকে না ” এই বলে মা মিথ্যা মিথ্যি কান্নার অভিনয় করতো।দুই বোন হেসে ফেলতো তখন।

“তোমাকেতো বাবার মতো ভালোবাসি, তুমি আমাদের জান। কিন্তু ওরা যে বলে, তোমার -আমার আর লুম্বিনীর চেহারা ভালোনা? আমরা নাকি কালো,বোঁচা, দেখতে পচা?”

“যারা বলেছে, ভুল বলেছে। আমার দুই মেয়ে পরীর চেয়েও বেশি সুন্দর। ”

“আর তুমি? ”

“আমি পরীর মা’দের মতো সুন্দর। শোনো, আমরাতো জানি,আমরা খুব সুন্দর। তাহলে অন্যরা কী বললো না বললো, তার জন্য আমরা মন খারাপ করবো কেন? আমাকে ছোটোবেলা থেকে সবাই বলেছে আমি দেখতে পচা। কিন্তু আমার মন খারাপ হতোনা। কারণ, আমিতো জানি, আমি সুন্দর। তার উপরে আমার মনে অনেক মায়া,অনেক ভালোবাসা। আমি কারো মনে কষ্ট দিইনা।আমি সবার উপকার করি। আমি মিথ্যা বলিনা। কারোর নামে পচা কথা বলিনা। এইসব গুণ যাদের থাকে,তারা দুনিয়ায় সবচেয়ে সুন্দর। আমিতো বিশ্ব সুন্দরী, সে অন্য মানুষ যাই বলুকনা কেন। ”

“কিন্তু সমস্যা মা, আমরা দু’জন তো অনেক মিথ্যা বলি। কারোর উপকার করিনা। হিংসাও করি। তাহলে তুমি সুন্দর হলেও আমরা দু’জন দেখতে আসলেই তো খারাপ।” পাকা রাজ বলতো।

“না মামনি, তোমরা আমার টিয়া পাখি, তোমরা আমার ক্ষীরের পুতুল, তোমরা আমার টুকটুকি, ফুটফুটি।”

মায়ের আদরে দুই বোনের মন শান্ত হতো।

কিন্তু এবারে লুম্বিনী চরম আঘাত পেয়েছে। তারা সব ভাইবোনই নামীদামী স্কুলে পড়ে। তাদের ক্লাসের ছেলেমেয়েরা প্রায় ওর চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করে। যেমন, একদিন সামান্হা বললো, “আজ গাড়িতে যে হ্যান্ডসাম ছেলেটা তোকে নিতে এসেছিলো আন্টির বদলে,সে তোর আপন বড় ভাই? ওয়াও! সো হ্যান্ডসাম ! প্রিন্স! আমি ক্রাশ খেয়ে গেছি। আন্টি আর তোর সাথে তোর ভাইয়ের চেহারার মিলই নেই। ”

প্যারেন্ট’স মিটিংয়ে বাবাকে দেখার পরে কতো মন্তব্য!

” মাই গড! আঙ্কেলকে দেখে আমি ফিদা। I wish I could marry him! Aunt is so lucky.”

“তোকে তোর বাবার মেয়ে মনেই হয়না।”

” আন্টি খুব ভালো। তবে আঙ্কেলের মতো এতো সুন্দর একজন মানুষ আন্টিকে বিয়ে করলো কেনো, it’s an important question. যৌতুকের ব্যাপার নাকি? ”

গতকাল টিফিন টাইমে ক্লাসের ছেলেরা একটা লিস্ট পড়ে শুনালো সবাইকে। তারা ক্লাসের মেয়েদের কয়েক ভাগে ভাগ করেছে- সেক্সিয়েস্ট, ভেরি বিউটিফুল, বিউটিফুল, লেস বিউটিফুল, অ্যাভারেজ, আগলি। লুম্বিনী, টিউলিপ এই দু’জনেই শুধু “আগলি”দের দলে।

ছেলেরা যেমন ফাজলামি করছিলো, দেখতে সুন্দর মেয়েগুলোও হাসিতামাশা করছিলো। ভীষণ অপমান আর কষ্ট লাগছিলো লুম্বিনীর। তবু স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে সে। ছুটির পরে অনেক ক্লাসমেটই তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,” হাই দ্য আগলিয়েস্ট গার্ল! কনগ্র্যাটস! ভেরি বিগ কংগ্রাচুলেশনস। সি ইওর আগলি ফেইস ভেরি স্যুন। বাই আগলি। ”
পৃথা হাসতে হাসতে বললো, “অ্যাই, আমার দেখতে পচা স্টেপ ডটারকে নিয়ে ফান করবেনা কেউ। I’m mentally deeply involved with her father. I must marry him. So let not my step daughter be insulted. In fact, I ‘m her local guardian, amn’t I? ” তারপরে হাহা,হিহি। গা গুলিয়ে উঠেছিলো লুম্বিনীর। মানসিক কষ্ট আর অস্হিরতা এক লাফে বেড়ে গিয়েছিলো দশ গুণ। একবার ভেবেছিলো,বাসার সবাইকে বা মিসকে বলে দিবে সব। তারপরে কোথা থেকে এক ভয়ংকর ক্লান্তি আর অবসাদ এসে ভর করলো। কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা কারো সাথে।

এখন ভেতরে জমে থাকা বরফ গলে গেছে। লুম্বিনীর কান্না , চোখের ভাষা, প্রলাপ সবকিছু অস্বাভাবিক লাগছিলো সবার কাছে। জমজের জন্য কান্না,কষ্টতো পাহাড় সমান আছে, কিন্তু সেই যন্ত্রণার সাথে আরও কিছু আছে।

ঘন্টা খানিক টানা কান্নার পরে শুরু হলো খিঁচুনি। মৃগীটা ফিরে এলো অনেকদিন পরে। বাসায় ওষুধ পত্র মজুদ থাকে, আসিফ – তিতির নিজেরাই মেয়ের পরিচর্যা করলো।

হাসপাতাল থেকে সহজে ছুটি নেয়না আসিফ।সেদিন নিলো। অবসন্ন গলায় তিতিরকে বললো,”চাকরি ছেড়ে দিয়ে মনে হয় ভালোই করেছো। বাচ্চাদের খুবই দরকার তোমাকে। তুমি চাকরি করলে লুম্বিনী হয়তো অনেক আগেই রাজের কাছে চলে যেতো।”

বুবুন ইউনিভার্সিটিতে গেলোনা সেদিন। তুতুন অবস্থার সুযোগ নিয়ে স্কুল মিস করতে চাইলে বুবুন কান ধরে ওকে স্কুলে রেখে এলো।

বিকালের দিকে মেয়ে নিজেই মুখ খুললো। বুক উজাড় করে বাপ-মা -ভাইদের জানালো সমস্ত কাহিনী।

তিতির স্তব্ধ। রাগে-দুঃখে বুবুনের চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি গড়াচ্ছে। বেদনাহত ও ক্রুদ্ধ আসিফ ছটফট করতে লাগলো, “কালকেই প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেইন করবো আমি। সবকটার গার্জিয়ানকে টেনে আনবো। কি শেখায় ছেলেমেয়েদের? কঠিন অ্যাকশন নিবো আমি। ”

বোবা হয়ে যাওয়া তিতির ভাবছিলো, এতোটুকু বাচ্চাদের মুখে এধরণের কথা! দেশসেরা স্কুলে পড়ে এই হাল? সমস্যাটা কোথায়, বাসায় না স্কুলে? বুঝেশুনে এতোটা নিষ্ঠুরতা, নোংরামি এইটুকু বয়সে মোটেই সহজাত হতে পারেনা। কোথা থেকে বাচ্চারা এমন ভয়াবহ আচরণ শিখছে? কেমন করে এই বয়সে এমন বিকৃত মানসিকতা অর্জন করছে? সমস্যার উৎসটা কোথায়? এই জেনারেশনের সবাইকে নয়, তবে অনেককেই ভ্রষ্ট পথের যাত্রী মনে হয় তিতিরের। উদ্ভট পোশাক, উদ্ভট হেয়ার স্টাইল, ইংরেজি -বাংলা-হিন্দি মিলে উদ্ভট ভাষা, উদ্ভট হাবভাব, অস্হির লাগে তিতিরের। এরা গার্জিয়ানদের সামনেই অবলীলায় বন্ধুদের বলে, “ফাক ইউ।” কিংবা “বাঞ্চোত। ” অথবা বিচ,বাস্টার্ড। অবলীলায় বলে। এইটুকু বয়সে। এরা অ্যাডাল্ট জোকস জানে এবং বুঝে। প্রযুক্তির দৌলতে এরা অনেকেই ব্লু ফিল্ম দেখে ফেলেছে। বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড না থাকাটা অসম্মানের ব্যাপার। কোথা থেকে এমন কালচারের আমদানি হলো? চৌদ্দ বছর বয়সের ছেলের হাতে বাপের দামী গাড়ির চাবি। গ্রুপ স্টাডির নাম করে কিশোর কিশোরীর একান্ত সময় কাটানো, তাও বিকৃত পন্হায়। মেয়েদের অশ্লীল ড্রেস আপ। এটা নাকী অশ্লীল নয়। আর পোশাক যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে “নো অ্যাডভাইস”, কারোর প্রাইভেসি নিয়ে ” নো নাক গলানো।” বারো -তেরো বছর বয়সী বাচ্চারা হরহামেশাই বলে, ” I’m matured enough. Who are you to interfere? “কিংবা, ” আমার লাইফ আমার। আমি যা মনে করবো, তাই করবো।”

এগুলো আগেও ছিলো। কিন্তু এখন অনেক কিছু বড় চোখে লাগে।
এরা যেন আদর্শহীন ভাবে বড় না হয়। এরা সবাই তো আমারই সন্তান। কিন্তু কীভাবে এদের আদর্শ আর নৈতিকতার গুরুত্ব বোঝানো যায়? আসলে রোল মডেলইতো নেই ওদের চোখের সামনে।

পরদিন আসিফ আর তিতির গেলো প্রিন্সিপালের কাছে। ক্ষুদে আসামীদের ডাকা হলো। তারা কিছু অস্বীকার করলোনা বরং অবাক হলো। এতো সিলি ম্যাটার নিয়ে একটা অ্যাডাল্ট মেয়ের এমন শকড হওয়া উচিৎ? লুম্বিনী ইমম্যাচিওরড। এতো ইমম্যাচিওর হলে লাইফে করবেটা কী? সামান্য ব্যাপার নিয়ে প্যারেন্টসের কাছে কথা লাগিয়েছে, প্যারেন্টস এসেছেন কমপ্লেইন নিয়ে। হাউ ফানি!

তিতির নরম গলায় বললো, ” লুম্বিনীতো একটু অসুস্থ, জানো তোমরা। কারণও জানো কেন অসুস্থ। কেউ কাউকে হার্ট করে কথা বোলোনা। তোমরা আমাদের কতো লক্ষী বাচ্চা। তোমাদের নিয়ে আমাদের অনেক আশা। চেহারা নিয়ে কথা বলতে হয়না। চেহারা আল্লাহ তৈরি করে দিয়েছেন। সেটা নিয়ে আমাদের কথা বলা উচিৎ ? আর তোমরা সবাই অনেক সুন্দর, লুম্বিনীও খুব সুন্দর। তবে কেউ যদি মিথ্যা বলে, অন্যের মনে জেনে-বুঝে কষ্ট দেয়, ঝগড়া করে, অন্যকে বুলিং করে, তাহলে কিন্তু সে সুন্দর না। ”

তিতির বুঝতে পারছিলো, ওর লেকচারে কোনো কাজ হবেনা। কোনটা ভালো,কোনটা মন্দ , কোনটা বেয়াদবি , কোনটা বেহায়াপনা, কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় – সেই জ্ঞানটাই তাদের নেই। তারা তো ছোটো মানুষ , বড়দের মধ্যেও অনেকে জানেনা উচিত -অনুচিতের ভেদাভেদ।

চলবে।

#সংসার
পর্ব ২২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

” লুম্বিনী মা, অংক কেমন লাগে তোমার? ”

“খুব ভালো মা।”

“বলো কী ! অংকতো সবাই ভয় পায়। অংক কঠিন লাগেনা তোমার? ”

“না মা। অংক আমি খুব ভালো বুঝতে পারি। তুমি আর ভাইয়া কী সুন্দর করে বুঝিয়ে দাও! ম্যাথ মিসও ভীষণ ভালো। এবারে আমি ম্যাথে নাইনটি এইট পেলাম না? ”

“সেই তো ! বিজ্ঞান ভালো লাগে? ”

“খুব ভালো লাগে মা। আমি সায়েন্টিস্ট হতে চাই। ভাইয়া যা মজার মজার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখায় আমাকে আর তুতুনকে। তুমি বিগ ব্যাং এর নাম শুনেছো? জানো কিছু বিগ ব্যাং নিয়ে? ”

“খুব অল্প জানি।এই এতোটুকু। ”

“আমি অনেক কিছু জানি। সায়েন্স ইজ মাই মোষ্ট ফেভারিট সাবজেক্ট।”

” যে স্টুডেন্ট ম্যাথ আর সায়েন্স খুব ভালো বুঝে, সে কী ইনটেলিজেন্ট? ”

“অফকোর্স, মা।”

“তুইতো ইংরেজিও বলিস ভারি মিষ্টি করে। মেম সাহেবদের মতো।”

“সেতো স্কুলে সবাই বলে ।”

“তুই খুব ইনটেলিজেন্ট। ঠিক বলেছি? ”

“জ্বী, মা।”

“রাস্তায় যে বাবুরা ভিক্ষা করে, ফুল বিক্রি করে সিগন্যালে, তাদের জন্য তোর এতো মায়া কেনরে ? ”

” ওরা কতো সুন্দর, ওদের কতো কষ্ট! ওদের খিদে লাগে, খাবার পায়না।শীতকালে ওদের গায়ে সোয়েটার থাকেনা। ওদের বাবা-মায়েরা গাড়িভরা রাস্তায় ওদের ছেড়ে দেয়। ওরা ফুটপাতে ঘুমায়। কেউ ওদের সাথে আদর করে কথা বলেনা। ওদের আমি অনেক ভালোবাসি।তুমিওতো ওদের ভালোবাসো, মা।”

“অবশ্যই বাসি। কিন্তু ওদের জন্য কেক, বিস্কিট, স্যান্ডউইচ, জ্যুস এগুলো সবসময় গাড়িতে মজুদ রাখার কথা আমি কখনো ভাবিনি।তোর কাছ থেকে শিখেছি। তোর অনেক মায়া। সবার জন্য। খুব কম মানুষই অন্য মানুষকে, পশু,পাখিকে এতো ভালোবাসতে পারে। তুই যদি চাস, তাহলে তোর ক্লাসমেটদের কঠিন শাস্তি দিবেন প্রিন্সিপাল। ”

“না,না মা। ওরা খারাপ না। ওরা ফান করছিলো।আমি বুঝতে পারিনি। এমনিতেই ওরা অনেক বকা খেয়েছে টিচার্স আর পেরেন্টসের কাছে। ওদের জন্য আমারই কষ্ট লাগছে মা। জানো মা, সামান্হাদের ব্রোকেন ফ্যামিলি। ওর স্টেপমম চাননা সামান্হা বাবার কাছে থাকুক, স্টেপ ফাদার চাননা ও নিজের মায়ের কাছে থাকুক। ও থাকে নানুর বাড়িতে।স্কুলের খরচ ওর বাবা দেন। আর আমার ঐ বন্ধুটা আছেনা, সৌম্য। ওর মা মারা গেছেন। ওর বাবা খুব মেন্টাল টর্চার করতেন।তাই আন্টি সুইসাইড করেন। আন্টি সুইসাইড করার তিন মাস পরে ওর বাবা তাঁর লাভারকে বিয়ে করেন। সৌম্যকে নাকি দুনিয়ায় কেউ ভালোবাসেনা। আর আমার বাবাকে বিয়ে করতে চায় যে, ওর বাবা-মা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন দুই বছর আগে। চাচার বাড়িতে থাকে। ওকে নিয়ে চাচা-চাচির মধ্যে সবসময় ঝগড়া হয়। এদিকে জয়ের আম্মু অন্য একটা জায়গায় বিয়ে করেছেন, সাথে ওর ছোটো বোনকে নিয়ে গেছেন, জয়কে নেননি। ওর দাদি আর ফুপিরা খুব শিগগিরই জয়ের বাবার ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন। মেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। জয় বলে বেড়ায়, ও পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসেনা ওর ছোটো বোনটা ছাড়া।ওর নাকি স্কুলেই থাকতে ভালো লাগে, বাসায় যেতে ইচ্ছা করেনা। ওদের সবার কতো কষ্ট। আমি সব জানি তাও কেমন বিচ্ছিরি রি-অ্যাক্ট করলাম।আমার খুব গিল্টি ফিলিংস হয়েছে। আজ ক্লাসে আমি সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছি ডায়াসে উঠে, দুই হাত জোড় করে, এই যে এমন ভাবে। ওরা আমাকে মাফ করে দিয়েছে। আমরা সবাই এখন গুড ফ্রেন্ডস। ”

“ওদের এতো দুঃখ কষ্টের কথা আগে বলিসনিতো? ”

“কী হবে বলে? আর ওদের প্রাইভেসি নষ্ট হবেনা? ”

ঐ শিশুগুলোর জন্য কষ্টে তিতিরের মন ভার হয়ে গেলো। আহারে বাচ্চারা! পারিবারিক দুর্যোগের অসহায় বলী ওরা। কতো কষ্টে, অবহেলায়, লজ্জায়, অপমানে, নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটে ওদের ! তিতির ঠিক করলো, সে গোপনে এদের খোঁজ খবর রাখবে, এদের অনেক আদর করবে, এদের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশবে। আর প্রিন্সিপালকে জানাবে এদের বেদনাভরা ইতিহাস। টিচাররা যদি আরো ফ্রেন্ডলি হন, ফাদার বা মাদার ফিগার হন, তাহলে খুব ভালো হয়। তিতির প্রিন্সিপালকে আরও একটা বিষয়ে অনুরোধ করবে। প্রতি মাসে অন্ততঃ একবার সব শিশুর মেন্টাল হেলথ চেক করতে হবে খুব দক্ষ কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে। এছাড়া স্কুলে প্রফেশনাল কাউন্সিলর থাকা দরকার।

তিতির মেয়েকে বললো,” তাহলে লুম্বিনী, দেখা যাচ্ছে, তোমার মধ্যে সবার জন্য অনেক ভালোবাসা। তোমার মধ্যে অনেক দায়িত্ববোধ। তুমি খুবই ইনটেলিজেন্ট। তুমি খুব ভালো স্টুডেন্ট। আউট নলেজ তোমার অনেক বেশি। যার এতোগুলো মহৎ গুণ আছে, সে অসুন্দর হয় কী করে? সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। আল্লাহর কাছে সে সবচেয়ে বেশি সুন্দর। তুমি আমার বুদ্ধিমতী মেয়ে। তোমাকে মনের দিক থেকে আরও স্ট্রং হতে হবে। কেউ খারাপ কথা বললে ওটা নিয়ে তোমার ভাবারই দরকার নেই। কারণ, তোমার হাতে অনেক কাজ। তোমাকে বিজ্ঞানী হতে হবে, গরীব দুঃখীদের কষ্ট দূর করার জন্য তোমাকে অনেক সময় আর শ্রম দিতে হবে। কাজেই, কারোর কথায় মন খারাপ করে সময় নষ্ট করবেনা। তোমার মা কী সত্যবাদী ? মা’কে মিথ্যা বলতে শুনেছো কখনো?”

“আমার মা হান্ড্রেড পার্সেন্ট ট্রুথফুল। আমার মা মিথ্যা বলেনা।”

” তাহলে শোনো, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরদের একজন। তোমার মা বলেছে এটা।আর জানোইতো, মা মিথ্যা বলেনা।”

“কিন্তু মা, আমি যে শর্ট! আমার ক্লাসের সবাই আমার চেয়ে লম্বা। আমার গায়ের রং সবার থেকে কালো। আমার চোখ ছোটো ছোটো। সবাই বলে হাতির মতো কুৎকুতে চোখ। আমার নাক থ্যাবড়া।”

“তাতে কী? গায়ের রং, চোখ, চুল এগুলো সৌন্দর্যের প্যারামিটার না, মা। এন্ডলেস বিউটির প্যারামিটারগুলো হলো সুন্দর চিন্তা, সুন্দর কাজ,সুন্দর ব্যবহার। এর সবগুলি তোমার আছে, মানুষ যে যাই বলুক। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তোমার মন সারাজীবন যেন এমনই সুন্দর থাকে।”

রাতে আসিফ তিতিরকে বললো,” লুম্বিনীর স্কুল চেঞ্জ করবো ভাবছি।”

“কেন? ”

“কেন সেটা মা হয়ে বোঝোনা? আমার মেয়ের মনে কী পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে স্টুপিডগুলো।”

“ওরা বাচ্চা।ওদের নিয়ে এভাবে বলতে নেই।”

“বাচ্চা? বদ ছেলেমেয়ে। নিজের মেয়েকে নিয়ে চিন্তা নেই , তাকে যারা এতো অপমান করলো, তাদের জন্য তোমার দরদ উথলে উঠছে?”

” ওরা যে কথাগুলো লুম্বিনীকে বলেছে, তুমি, তোমার বাবা-মা, তোমার ভাইবোনেরা, তোমার জ্ঞাতিগুষ্টি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আমাকে এসব কথা বলেছো। তখন অন্যায় মনে হয়নি? ”

” মা বটে তুমি। মনে হচ্ছে, লুম্বিনীর ঘটনায় আমার কষ্ট তাড়িয়ে তাড়িয়ে এনজয় করছো। খুব মজা পাচ্ছো। একটা শিশুর সাথে তুমি, এক বয়স্ক মহিলা, নিজের তুলনা করছো। ”

“লুম্বিনীকে জীবনে এমন কথা আরও অনেক শুনতে হতে পারে।তাই তার শক্ত থাকা দরকার। পৃথিবীতে আসিফ, আসিফের ভাইবোন, বাপ-মায়ের মতো মানুষের অভাব নেই তো।”

“এইতো পছন্দের সাবজেক্ট পেয়ে গেছো। শ্বশুরবাড়ির নিন্দা করতে পারলে আর কী চাই? তুমি এমন মহিলা, পারলে আমার বাপ-মাকে কবর থেকে তুলে কথা শোনাও।”

তিতিরের কথা বলতে রুচিতে বাধছিলো। সে উত্তর না দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ঘুমটা তার আশ্রয়। ঘুম ভাঙার পরে পৃথিবীটাকে বড় শূন্য শূন্য লাগে। গলার কাছটা টনটন করে ব্যথায়। আর দেখা হবেনা। আর কোনোদিন দেখা হবেনা তার সাথে,ভাবা যায়?

চলবে।