#সংসার
পর্ব ২৭
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
লুম্বিনীর শরীরের অনেকখানি অংশ পুড়ে গেছে। পেটের উপর হতে পায়ের পাতা পর্যন্ত। দুটি হাতের কিছু অংশ। গরম তেলে।
মেয়েটার নিত্যনতুন রান্না করার বাই উঠেছিলো। রীতিমতো নেশা। বেকারি, মোঘলাই, বাঙালি, চাইনিজ। রান্নার হাতটিও চমৎকার। নেশাটা এমন তীব্র ছিলো স্কুল থেকে ফিরেই মেয়ে ঢুকতো রান্নাঘরে। সবাই নিষেধ করতো তুতুন ছাড়া। লুম্বিনীর রান্নার প্রধান ভক্ত হলো তুতুন। তুতুনের জন্য নানা রেসিপি ট্রাই করতো লুম্বিনী।
মৃগী রোগটা মাথাচাড়া দেয়নি বহুদিন। আর রান্না করলে লুম্বিনীর মন খুব ফুরফুরে থাকে। তাই তিতির প্রথম দিকে যেমন ভীষণ সতর্ক থাকতো, পরে আর অতোটা থাকতোনা। আজ গরম তেলসহ কড়াইটা পড়লো
মেয়েটার উপরে।
কি ভয়ংকর আর্তনাদ ! যন্ত্রণায় কেমন ছটফট করছে লুম্বিনী। তিতির মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে।তার মাথা কাজ করছেনা।ময়না খালা ফ্রিজ থেকে গ্যালন গ্যালন পানি ঢালছে। কাঁদতে কাঁদতে তুতুন দৌড়ালো মেরিনা আন্টির বাসায়।
এবারে হাসপাতালে তোপের মুখে পড়লো কষ্টে -ভয়ে বিবশ হয়ে যাওয়া তিতির। আসিফ রিঅ্যাক্ট করলো সাংঘাতিক। দশজনের সামনে তিতিরের গালে সপাটে চড় লাগালো একটা।
” সারাক্ষণ ঘরে বসে বসে ডিম পাড়ো।বাইরের একটা কাজে নাই, রান্নাবান্না নাই, ঘর দুয়ার গোছানো নাই, বাচ্চাদের যত্ন নাই, মেয়ে নাস্তা বানায় আর তিনি খান। তোমার বেঁচে থাকার দরকার কী? দুনিয়াতে জাষ্ট একটা বোঝা হয়ে পড়ে আছো। অসুস্থ মেয়েকে রান্নাঘরে পাঠানো ! ”
তিতিরের গায়ে কোনো কথা লাগছিলোনা।সে ঘোরের মধ্যে ছিলো। সে দেখতে পাচ্ছিলো প্রজাপতির মতো একটা মেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে, কথায় কথায় কাঁদতে বসছে, ছুটে ছুটে বাপ-মায়ের তত্ত্ব তালাশ নিচ্ছে, বোনের সাথে গুটুরগুটুর গল্প করছে,ভাইয়ের মশারি টাঙিয়ে দিচ্ছে, আত্মীয়রা আসলে আনন্দে অধীর হচ্ছে, বন্ধুদের হাসাচ্ছে, দুই মিনিটে রেডি হয়ে বেড়াতে বের হচ্ছে। তারপরে বিয়ে। আর তারপরে? হাসি থেমে গেলো,উচ্ছ্বাস পালিয়ে গেলো, বিষন্নতা ভর করলো। তবু মেয়েটা থেমে থাকেনি।হাসপাতালে কাজ করেছে, চার চারটি সন্তানের জননী হয়েছে, সাধ্যমতো সময় দিয়েছে তাদের, বুকে করে মানুষ করেছে চারজনকে, অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছে, তাদের ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। সে কোনদিন কারো মনে কষ্ট দেয়নি, কারোর ক্ষতি করেনি, তাহলে তার একটা মেয়ে মরে গেলো কেন? আরেকটিও মরে যাবে?
আজ নাজমুল সাহেব -নিশাতও মেয়ের উপরে বিরক্ত। জামাইয়ের চড়ের ঘটনা অবশ্য আগেই ঘটে গিয়েছে। ঘোরের মধ্যে থাকা মেয়েকে বিরক্ত বাবা-মা বললেন, ” শুধু বসে বসে ঝিমাতেই পারো।”
লুম্বিনীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইমারজেন্সিতে। কেবিনে তিতির, অন্য সবাই। তিতিরের কানে টুকরা টুকরা কথা আসছে, ” অপদার্থ মা।” “ঘরের কাজেও নেই, পারেনা কিছুই, আবার বাইরের কাজেও বিগ জিরো।”
“জমজদের একজনের কিছু হলে আরেকজনকে বাঁচানো মুশকিল। যেভাবে পুড়েছে,মনে হয়না টিকবে।”
কথাগুলো বলছে বুবুনের ফুপুরা। আর বুবুনের নানার বাড়ির লোকজন স্হির হয়ে বসে আছে। লুম্বিনীর জন্য দুশ্চিন্তায় মগ্ন।
একটা মানুষ প্রথম থেকেই সেঁটে আছে তিতিরের সাথে। তুতুন। আপুর কষ্ট নিজের চোখে দেখেছে তুতুন, তার ছোট্ট বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। তারপরে বাবা যখন মা’কে এতো মানুষের মধ্যে চড় মারলো, নানাভাই-বুবুসহ বাবার বোনেরা মা’কে নানাভাবে দোষ দিতে থাকলো,তখন চোখের পানি মুছে ফেললো তুতুন। আপুর জন্য টেনশন নয়, মরে যাওয়া আরেক আপুর জন্য কষ্ট নয়, অদ্ভুত একটা অনুভূতি তৈরি হলো তুতুনের মনে। কেমন যেন। তুতুন হঠাৎ বুঝতে পারলো তার ছোট্ট জীবনটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। ও যখন ছোট্ট এতোটুকুন ছিলো, তখন তার স্বাভাবিক জীবন ছিলো একটা।যদিও মা অফিস যাওয়ার সময় প্রতিদিন বিস্তর কান্নাকাটি করা ছিলো তুতুনের জন্মগত অভ্যাস। তারপরে আপু মরে গেলো, বাবা কেমন যেন হয়ে গেলো, মা যেন থেকেও নেই, অন্য জগতের বাসিন্দা, লুম্বিনী আপুর একের পর এক অসুখ, মায়ের একবার আত্মহত্যার চেষ্টা , সবকিছুই কেমন যেন। আচ্ছা, আর কারোর বাবা কী মা’কে মারে? অনেকদিন ধরে বাবা কেমন যেন ব্যবহার করে মায়ের সাথে।
বুবুন ঝড়ের বেগে কেবিনে ঢুকলো। সে গিয়েছিলো গাজীপুরে , ভার্সিটির পিকনিকে। তাকে ফোন দিয়ে মামা বলেছে, লুম্বিনীর ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, বুবুনকে দেখতে চাচ্ছে , তাই বুবুন যেন এই হাসপাতালের এই কেবিনে দ্রুত চলে আসে।
“লুম্বিনী কই মা? লুম্বিনী কোথায়? ”
নোমান ভাগ্নেকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বললো, ” তোকে বললাম না ছোট্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট? ড্রেসিং হচ্ছে লুম্বিনির। সামান্য ব্যাপার।”
“কী অ্যাকসিডেন্ট, মামা? কোথায় যাচ্ছিলো লুম্বিনী? ”
বুবুনের ছোটো ফুপু কঠিন গলায় বললো, ” মিথ্যা বলছেন কেন, নোমান ভাই? সত্যিটা আরিয়ান জানতে পারবেনা একটু পরে? শোনো আরিয়ান, এক কড়াই ফুটন্ত গরম তেল পড়েছে লুম্বিনীর গায়ে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।”
বুবুনের মাথা টলে উঠলো ভীষণ। গতরাতে সে স্বপ্নে লুম্বিনীকে মৃত অবস্থায় দেখেছে। তাহলে তার স্বপ্ন কী সত্যি হতে যাচ্ছে?
নোমান ভাগ্নেকে জড়িয়ে ধরলো। একবার ঘৃণাভরা চোখে তাকালো বুবুনের ছোটো ফুপুর দিকে। তারপরে বললো, ” ফ্যাটাল কোনো ব্যাপার না বাবা। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো।”
বুবুন তার মায়ের দিকে তাকালো। সেই ঘোরমাখা চোখ। আলুথালু বেশ। চুপচাপ বসে আছে। অশ্রুহীন চোখ।
কেন যে আজ এতো রাগ হলো বুবুনের তার মায়ের উপরে।এতোটুকু মায়া হলোনা। এই মহিলা সারাক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকেন। আর কোনো কাজ নেই। অসুস্থ মেয়ে রান্নাঘরে ঢুকে, তাঁর কোনো টেনশন হয়না। বুবুনের ঐ মুহূর্তে মনে পড়লোনা, মা এখনো তাদের তিন ভাইবোনের খাওয়া দাওয়া, লেখাপড়া,চিকিৎসা সবদিকে তীক্ষ্ণ খেয়াল রাখেন। ভেজা চোখে তিন ভাইবোনকে বুক দিয়ে আগলে রাখেন, তাদের সব গল্প শোনেন, আদর-মমতা দিয়ে তাদের সব শূন্যতা পূরণ করেন। তারা তিনবেলা কি খাবে, সন্ধ্যার নাশতা কী হবে, প্রতিদিন প্রত্যেকের পছন্দমতো মেন্যু ঠিক করেন মা। মা পড়া বোঝালে তা পানির মতো সহজ লাগে। অসুস্থ লুম্বিনীকে দিনরাত এক করে সেবা দিয়ে সুস্থ করেছেন মা। নানাভাই-বুবুর সমস্যা হলে সেখানে কার ডাক পড়বে? মায়ের। মামা-খালার সমস্যাতেও মা। আগে হাজার অপমানের পরেও চাচা-ফুপুদের সমস্যা সমাধানে মা পাশে থাকতেন,এখন থাকেননা। ডাক্তারি করে মা আগে মোটা অংকের বেতন পেতেন, এখন বিনা পয়সায় দিনে কমপক্ষে দশজন রোগির সেবা দিতে হয়।আত্মীয় স্বজন,বন্ধু, কাজের খালারা, দারোয়ান চাচারা।
বুবুন মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো, ” তুমি এখানে বসে আছো কেন? বাসায় যাও। এসি ছেড়ে আরাম করে কফি খাও জায়নামাজে বসে। দোয়াদরুদ পড়ো। তারপরে জায়নামাজে শুয়ে ঘুমাও। তোমার কাজইতো ঐ। দায়িত্ব নিতে পারোনা, চার চারটা বাচ্চার জন্ম দিলে কেন? লুম্বিনীর এতো বড় অ্যাকসিডেন্ট কেন হলো তুমি থাকতে? ”
লুম্বিনীর মাথায় যখন রান্নার ভুত চেপেছিলো, তখন সবচেয়ে বাধা দিয়েছিলো তিতির। সবাই বাধা দিয়েছিলো। তারপরে লুম্বিনীর ক্রমাগত আব্দার, অনুরোধের কাছে হার মেনে আসিফ, বুবুন এরাই বলেছিলো,” যাক।এতে যদি খুশি হয় হোক। একটু খেয়াল রাখলেই হলো। কাজকর্ম করতে দেওয়াই ভালো,এতে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবে। ভবিষ্যতে হোষ্টেলে থাকবে,নাকি বিদেশ যাবে, রান্না জেনে রাখা ভালো।”
তবু অনুমতি দেয়নি তিতির। তারপরে অনুমতি দিতে বাধ্য হলো। মেয়ের পিছনে সে ঘন্টার পর ঘন্টা এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো যে মেয়েই কান্নাকাটি শুরু করতো, এই আসিফ-বুবুন-ময়না খালাই বলতো, ” মেয়েকে বড় আর স্বাধীন হতে দিবেনা? ”
আজ সব দোষ তিতিরের। কোনো অসুবিধা নেই। কোনো অপমান গায়ে লাগছেনা। দুঃখ,কষ্ট হচ্ছে না। তিতির নিঃশব্দে একমনে বলে যাচ্ছে , “আল্লাহ, আমার লুম্বিনীকে বাঁচিয়ে দাও। আমার প্রাণের বিনিময়ে আমার মেয়েকে সুস্থ করে দাও।আর আমি চলে যাওয়ার পরে আমার বাচ্চা তিনটাকে নিরাপদে, সুস্থ রেখো আল্লাহ।”
ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে লুম্বিনীর। যদি বেঁচে যায় আল্লাহর রহমতে, প্লাস্টিক সার্জারি লাগবে দুই তিন দফা।
সাতদিন পরে লুম্বিনী আশংকামুক্ত হলো। আপাততঃ। তারপরেতো প্রতি সার্জারির সময় আশংকা।
এই সাতদিন বড় অদ্ভুত ভাবে কাটলো। কারোর সাথে কারোর কথা নেই। সবাই যেন রোবট। মেরিনা শুধু তুতুনের পুরো ভারটা নিলেন।স্কুলে আনা নেওয়া, খাওয়ানো, রাতেও নিজের কাছে রাখা।
নাজমুল -নিশাত তিতিরের বাসাতে থাকলেননা এবার। বুবুন অনুরোধ করেছিলো। তাঁরা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তাঁদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি আর অবশিষ্ট নেই। নিজেদের বাসায় থেকেই তাঁরা যা করার করবেন। বুবুন যেন নিজের যত্ন নেয়। ময়না খালা থাকতে চিন্তা নেই।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ২৮
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নিশাতের লিভারে হাইডাটিড সিস্টের অপারেশন হয়েছে। কিছু জটিলতা থাকায় নিশাতকে চৌদ্দ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। তিতির দুই সপ্তাহ মায়ের সাথেই কাটিয়েছে। মায়ের প্রতিটা শ্বাসের দিকে নজর রেখেছে। আসিফ সার্জন।তার হাসপাতালে অপারেশনটা হওয়া স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু তিতিরের দৃঢ়তায় আসিফের হাসপাতালে নিশাতের অপারেশন হয়নি। সবাই অবাক। সবার মনে জিজ্ঞাসা। কিন্তু তিতির স্হির।
মায়ের অপারেশন, অপারেশন পরবর্তী বিভিন্ন চিকিৎসা দেখতে দেখতে তিতিরের মনে তার নিজের চিকিৎসক জীবনের স্মৃতি ভেসে উঠে। কেমন এক নেশা। সার্জনের সাথে আলাপ করে সে নিজেই মায়ের ড্রেসিং করে দেয়। এমনকি একটা ওষুধের ডোজের বিষয়ে চীফ সার্জনের সাথে তার মতবিরোধও হয়। পরে বই ঘেঁটে সার্জন নিজেই তিতিরকে স্যরি বলেন।
“আপনার মতো ডাক্তারের প্রতিদিন কিছুটা সময় রোগীকে নিয়ম করে দেওয়া উচিত। আপনি খুব স্কীলড ডক্টর। আপনার পেশেন্ট ডিলিং,কাউন্সেলিং আমি দেখেছি। মনে মনে অনেক প্রেইজ করেছি। ”
চীফ সার্জন প্রফেসর আবদুস সামাদ বলেছিলেন তিতিরকে।শুধু উনি নন, অনেক মানুষ অনেকবার তিতিরকে এই কথাগুলো বলেছে। তার কাছ থেকে চিকিৎসা পাওয়া রোগীরা কেমন কেমন করে যেন তার ফোন নম্বর যোগাড় করে ফেলে, চেম্বার করতে অনুনয় করে।
নিশাতের আশেপাশের কেবিনের কয়েকজন রোগীর লোকজনের সাথে আলাপ হয়েছিলো তিতিরের। এখন এমন অবস্থা , তারা এসে চুপিচুপি তিতিরকে প্রশ্ন করে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ ঠিক আছে কিনা। ম্যাডাম হ্যাঁ বললে তারা নিশ্চিন্ত। অস্বস্তিকর অবস্থা। অন্য হাসপাতালে মাতব্বরি করা অনৈতিক। তারপরও একদিন এক রোগির ফাইলে এতো বড় ভুল ধরা পড়লো, তিতির চুপ থাকতে পারলোনা।সে নার্সকে দিয়ে ডিউটি ডক্টরকে ডাকলো। বেশির ভাগ বড় বড় হাসপাতাল সদ্য পাশ করা বা অনভিজ্ঞ ডাক্তারকে ডিউটি ডক্টর বা মেডিকেল অফিসার হিসাবে রেখে দেয়। এমন কিছু নামকরা হাসপাতালও আছে যেখানে অনভিজ্ঞ ডাক্তারের হিস্ট্রির উপরে নির্ভর করে কনসালট্যান্টরা চিকিৎসা করেন।রোগীর অনেক বড় বড় সমস্যা তাঁদের অগোচরে থেকে যায়। এতো বড় ভুল দেখে তিতির চুপ থাকতে পারলোনা।ডিউটি ডাক্তারকে স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করলো,” অর্ডার আপনি লিখেছেন? ”
“না। আপনি রোগীর লোক?”
“হ্যাঁ। আপনি এই রোগীর সব হিস্ট্রি জানেন? ”
ডাক্তার বিরক্ত গলায় বললো, ” কি দরকার, কাইন্ডলি সেটা বলেন। আপনিতো ৩০৫ নম্বর কেবিনের লোক।ওখানে দেখি আপনাকে। ৩০৭ এর ফাইল দিয়ে কি দরকার আপনার?”
” আমি একজন ডক্টর। এবারে বলেন, আপনি জানেন ৩০৭ এর রোগির কি সমস্যা ? আর এই ওষুধটা, যেটার অর্ডার দেওয়া আছে, সেটা দিলে কি সমস্যা হতে পারে?”
“এই অর্ডার আমি লিখিনি। যে লিখেছে, তার সাথে কথা বলেন।”
তিতির সিনিয়র একজন ডাক্তার, কিন্তু আনাড়ি, অনভিজ্ঞ ডিউটি ডাক্তারের কোন হোলদোল নেই। বরং হালকা অবজ্ঞা তার হাবভাবে।
তিতির কঠিন গলায় বললো, “কি নাম তোমার? ডিউটিতে এখন তুমি আছো? এই রোগীর কনসালট্যান্টকে ফোন করে অর্ডার কারেক্ট করার রেসপন্সিবিলিটি কার? তোমার না? আর আদৌ তুমি বুঝতে পারছো অর্ডারে কি সমস্যা? কেন এই ওষুধটা পেশেন্টের জন্য ডেঞ্জারাস? ”
কাজ হলো। ডিউটি ডক্টর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, “না ম্যাম।আসলে এই পেশেন্ট আমি ডিল করিনিতো, তাই ফাইল ওইভাবে স্টাডি করিনি। যে অর্ডার লিখেছে, ও আছে এখনও, আমি ডাকছি।”
যে আসলো,সেও চোখমুখ কুঁচকে রেখেছিলো।তিতির যখন দুইজনকে এর ভয়াবহতা বুঝিয়ে বললো, তখন দু’জনের মুখে ও কথায় আমূল পরিবর্তন।
“ম্যাডাম, তাহলে কি করবো? ট্রিটমেন্ট প্ল্যান আপনি বলে দিন,ম্যাম।”
“আমি যদি অথোরিটি হতাম, তাহলে এই ওষুধগুলো এই কারণগুলোর জন্য দিতাম।” তিতির ওষুধের নাম এবং সেগুলোর ইন্ডিকেশন বুঝিয়ে বললো।
“কিন্তু আমি তোমাদের অথোরিটি নই। রোগীর হিষ্ট্রি আবার ভালো করে নাও, তাঁকে এক্সামিন করো, রিপোর্টগুলো দেখো, তারপরে কনসালট্যান্টকে ফোন দিয়ে পেশেন্টের অবস্থা জানিয়ে আমার বলা ট্রিটমেন্ট প্রটোকল জানাও।দেখো, তিনি কি বলেন। ”
ঐ চৌদ্দ দিনে তিতির মায়ের অক্লান্ত সেবাতো করেছেই, সেই সাথে তাকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। রাতে দফায় দফায় ডিউটি ডক্টররা নানাজনের ফাইল নিয়ে এসেছে, ” ম্যাডাম, কোথাও ভুল আছে কিনা একটু দেখে দিবেন, প্লিজ? ”
নার্সরা এসেছে যখন তখন, ” ম্যাডাম, রোগীর ব্লাড স্যুগার এখন এতো।অ্যাকট্রাপিড কতো দিবো? ” আরও নানা প্রশ্ন।
নার্স আর আয়ারা এসে নিজেদের নানা চিকিৎসা করিয়ে গেছে। তিনজন ডিউটি ডক্টর তাদের পরিবারের সদস্যদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে গেছে।
“ম্যাডাম, প্লিজ কোথাও বসেন, রোগীদের কথা ভেবে বসেন কোথাও।”
“ম্যাডাম, কোনো মেডিকেল কলেজে জয়েন করেন, প্লিজ। আপনি এতো সুন্দর করে সব বুঝিয়ে বলেন, আপনি একটা কোচিং সেন্টার খুলেন।”
মা’কে আল্লাহর অশেষ রহমতে সুস্থ করে বাসায় নিয়ে এলো যখন তিতির, তখন তার আত্মবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে অনোকখানি। আত্মসম্মানবোধও। এই দুইটার বিষয়ে আর কম্প্রোমাইজ করতে রাজি না তিতির। সারাজীবন অল্পে ভয় পেয়েছে তিতির,টেনশনে আধমরা হয়েছে, ন্যায্য কথা বললে ঝগড়া লেগে যায় যদি, যদি সম্পর্ক নষ্ট হয় সেই ভয়ে শত অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেছে, তার কথায় যেন কারো প্রাণে এতোটুকু আঘাত না লাগে তাই অনেককেই অনেক কথা বলা হয়নি । যাক, অতীত চলে যাক।কিন্তু নিজে আর পোকা হয়ে থাকতে চায়না তিতির। ঐ সেদিন থেকে, যেদিন লুম্বিনী পুড়ে গেলো,আসিফ চড় মারলো, বুবুন রাগে ভয়ে অন্ধ হয়ে মা’কে অনেক কথা শোনালো, কথা শোনালেন স্বয়ং বাপ-মা, ননদ-দেবরদেরতো কথাই নেই, সেদিন থেকে, আজ থেকে ঠিক সাত মাস আগে থেকে আমূল পরিবর্তন হলো তিতিরের।
চোখের পানি এতোটুকু না ফেলে লুম্বিনীর সেবা করে গেছে তিতির।এতোটুকু ফাঁকি না দিয়ে। ড্রেসিং এর সময় অমানবিক চিৎকার করতো লুম্বিনী, কানে তুলো গুঁজে মেয়েকে সামলাতো তিতির। ড্রেসিং রুম থেকে হিমশীতল চোখে আর গলায় আসিফকে বের করে দিয়েছিলো তিতির। স্পষ্ট গলায় সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলো, ড্রেসিং রুমে বা কেবিনে তিতির ছাড়া আর কোনো ফ্যামিলি মেম্বারের দরকার নেই। লুম্বিনী আহত হওয়ায়, লুম্বিনীর ছোট্ট শরীর পুড়ে যাওয়ায় তিতিরের থেকে বেশি কষ্ট আর কে পেতে পারে? অথচ সে তখন পরিবারের সামনে দাগী আসামী। পরম ভালোবাসায়, মমতায়, স্নেহে, যত্নে লুম্বিনীকে সুস্থ করে তুললো তিতির। অসুরের শক্তি ভর করেছিলো ওর উপরে। দিন রাত এক করে খাটাখাটনি। তিন মাস পরে এক গভীর রাতে হাসপাতালের বেডে শোয়া লুম্বিনী তিতিরকে খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছিলো, ” বাবা তোমাকে চড় মেরেছিলো মা, আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তোমার কোনো দোষ ছিলোনা। দোষ থাকলেও বাবার কি রাইট আছে তোমাকে মারার? I hate baba.”
“ছিঃ মা । তোমার বাবার মাথার ঠিক ছিলোনা তখন। ঐ অবস্থায় মানুষ কি করে না করে, তা মনেও থাকেনা।”
” তোমারতো আরও শকড কন্ডিশন ছিলো।”
“সব মানুষের ধৈর্য্য, মানসিক গঠন এক রকম হয়না মা।”
“বাবা স্যরি বলেছে তোমাকে? ”
তিতির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ” স্যরি যে বলতেই হবে এমন কথা নেই। অন্য কথাবার্তা , আচার-আচরণের মাধ্যমেও অপরাধবোধটা বোঝানো যায়।”
অপরাধবোধ বুঝিয়েছিলো বটে বুবুন। পাঁচ -ছয়দিন পরে মায়ের পা ধরে উন্মাদের মতো মাফ যাওয়া, দেওয়ালে মাথা ঠোকা। শান্ত তিতির স্হির গলায় ছেলেকে বলেছিলো,”শান্ত হও বুবুন। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমাকে নিয়ে আমার মনে কোন কষ্ট নেই। কিন্তু এখন থেকে এভরি মোমেন্টে ট্রাই করো, নিজেকে ম্যাচিওর করার, শক্ত করার, বিপদে দিশেহারা না হওয়ার। ”
নিজের অজান্তেই কত বড় অপরাধ, অন্যায় মায়ের সাথে করেছে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছিলো বুবুন। এখনও মায়ের পা ধরে বসে থাকে, মায়ের সুবিধা অসুবিধার দিকে আরও বেশি খেয়াল রাখে। ছেলের উপরে অভিমান বা নেতিবাচক ভাবনা দূরের কথা, নিজের বাপ-মা,ভাইবোন,স্বামী কারোর প্রতি বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই তিতিরের। দেবর ননদদের কর্দমাক্ত কথাকে সে তো এখন ধর্তব্য মনে করেনা।
ঘটনার তিন চারদিন পরে নাজমুল সাহেব-নিশাত এসে উপস্হিত। মেয়ের সাথে কাটা কাটা ভাব, বুবুন-তুতুন আর আসিফের দিকে লক্ষ্য রাখা, তাদের খাওয়া-দাওয়া, দৈনন্দিন সাংসারিক কাজে যেন সমস্যা না হয় তাই তারা এসেছেন। অপদার্থ তিতিরকে তাঁরা কোনোদিক দিয়ে ভরসা করেননা। তিতিরও বাপ-মায়ের সামনে আবেগ -উচ্ছ্বাস কিছুই দেখালোনা, রাগতো নয়ই। খুব স্বাভাবিক থাকলো।তুতুনকে স্কুলে নেওয়ার জন্য যখন নাজমুল সাহেব রেডি হচ্ছিলেন, তখন তিতির শান্ত গলায় বললো, “বাবা,আমি তুতুনকে স্কুলে ড্রপ করবো।ওখান থেকে হাসপাতাল। ছুটির সময় তুতুনকে আমি নিয়ে আসবো। তুতুনকে খাইয়ে আবার হাসপাতালে চলে যাবো।পরদিন ওর স্কুল টাইমের আগে প্রেজেন্ট হবো।”
নাজমুল সাহেব উত্তর না দিয়ে রেডি হতে লাগলেন যেন কিছুই শুনতে পাননি। তিতির তুতুনের ব্যাগ চেক করে, টিফিন বক্স আর পানির ফ্লাস্ক দিয়ে বললো, ” আসো তুতুন সোনা। বাবা-মা, আমি আসি। ময়না খালা, যে ভাবে বললাম, আমেনা আর আপনি ওই ভাবে রান্নাবান্না করবেন, সময়মতো সবাইকে খাবার দিবেন। আসি।”
নিশাত ফোঁস করে বললেন, “আসি মানে? আমরা কি এখানে সিনেমা দেখতে এসেছি? তোমার বাবা নিয়ে যাবে,নিয়ে আসবে তুতুনকে।”
তিতির শান্ত গলায় বললো, “তোমরা এসেছো, আমার ভালো লাগছে।আমার বাসায় তোমাদের উপস্থিতি সবসময় আমার খুব ভালো লাগে।তবে আমার সংসার আমি চালাবো। আমার সংসার চালানোর জন্য , আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য তোমাদের ভাবতে হবেনা। ”
“কে ভাববে? তোমার ননদরা? মেরিনা প্রতিবেশী মাত্র, তার কাছ থেকে আর কতো সাহায্য নেবে?আমিতো দেখি, নিজের সংসারের থেকে তোমার সংসারই ওকে বেশি সামলাতে হয়।”
তিতির স্হির ভাবে নিশাতের দিকে তাকিয়ে বললো, ” এটা আমার আর ভাবির ব্যাপার। এখানে তোমার টেনশনের কিছু নেই। ”
“শখ করে আমাদের টেনশন হয়না। তুমি ডিমপাড়া মুরগির মতো সারাদিন ঝিমাও, এখন এই বিপদে বুবুন,তুতুন, আসিফের আমাদের দরকার।বিশেষ করে বাচ্চা দুটার।তুমি একটার পর একটা ঘটনা ঘটাবে, সামালতো দিতেই হবে আমাদের। ”
নাজমুল -নিশাত এমনই।ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসেন যেমন, বিরূপ পরিস্থিতিতে তাদের এবং পরস্পরের প্রতি সেই পরিমাণ বিষ ওগড়ান।
তিতির দৃঢ় কিন্তু খুব নিচু গলায় বললো, ” ভাষা সংযত করো।আমার ছেলেমেয়েদের সাথে আমি এমন ভাষায় কথা বলিনা। আমার ঝিমানোর জন্য রাজের ডেঙ্গু হয়েছিলো? আমি ঝিমাচ্ছিলাম বলে লুম্বিনীর গায়ে তেল পড়লো? আমার ঝিমানোর জন্য বাসায় এক বেলা কোনো কাজ বন্ধ থেকেছে? দুইদিন পরপর আমার সংসার দেখাশোনা করতে তোমাদের আসতে হয়? তোমার জন্ডিসের সময় নিজের হাসপাতাল সামলে, নিজের বাচ্চা-ভাইয়ের বাচ্চা সামলে , বাড়ির সবার রান্না, তোমার পথ্য, তোমার গোসল একমাসের উপরে কে করেছিলো, তমা না তিতলি? নাকি তোমাদের ছেলে বা জামাইরা? তোমার নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, কোভিড, বাবার কোভিড এইসব সময়ে তোমাদের সংসার কে সামলাতো, মনে পড়ে? তমার দুর্ব্যবহারে বাসা থেকে দুদিন পরপর কাজের লোক চলে যায়। তখন ময়না খালা বা আমেনাকে কে পাঠায়? নতুন আরেকজনকে যোগাড় করে দেয় কে? শুনতে নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে? বলতে আমার শতগুণ খারাপ লাগছে।এসব কথা বলা কতোটা কুৎসিত, নিজের প্রতি চরম ঘৃণা হয়।কিন্তু তোমরা অবলীলায় বলতে পারো। নিজেদের সংশোধন করো, প্লিজ। তুতুন, তুতুন তুমি কোন রুমে, এসো।”
বাবা-মা’কে এভাবে বলে ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছিলো তিতিরের। বাবা-মা নিশ্চয় চলে যাবে নিজেদের বাসায়।তারপরে কি আর কখনও আসবে? তিতিরের সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে এ জীবনে? তিতিরের বুক ঠেলে কান্না আসছিলো। কিন্তু সে এটাও বুঝতে পারছিলো, এই কথাগুলো বলার দরকার ছিলো। শুধু বাবা-মা নন, সবার অন্যায় কথাকে থামিয়ে দিতে হবে।যে কারোর উল্টোপাল্টা কথার সঠিক সময়োপযোগী উত্তর দিতে হবে। আর সব সম্পর্কে একটা অদৃশ্য দেওয়াল রাখতে হবে, ঐ দেওয়ালকে ক্রস করে কাউকে আসতে দেওয়া যাবেনা। তিতির নিজে কারো সাথে দুর্ব্যবহার করেনা, করতে চায়ওনা। তাহলে একটা উপায়। নিজের চারদিকে বলয় তৈরি করা।
বুকে তীব্র আলোড়ন, কিন্তু গাড়িতে তিতির তুতুনের সাথে খুব হাসাহাসি করলো, গল্পের ছলে জীবনের শিক্ষা দিলো কিছুটা, আদর করলো অনেক। হাসলো,প্রচুর হাসলো।নিজের অভিনয় প্রতিভায় নিজেই অবাক হয়ে গেলো তিতির। কিন্তু তার হাসিমাখা সুখী মুখ তিন বাচ্চার জন্য খুব দরকার।
স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময়ও খুবই উৎফুল্ল থাকলো তিতির। বললো,লুম্বিনী অনেক সুস্থ হয়ে গেছে। তুতুনের নাম করছে। তুতুনের কাছে তিতির জানতে চাইলো, কি ক্লাস হলো, ক্লাসে কি মজা হলো, কি পড়াশোনা হলো আজকে ।
বেমক্কা তুতুন বলে উঠলো, “মা, বাবা তোমাকে ওদিন কেন মারলো? তোমার কষ্ট হয়নি? আমার খুব কষ্ট হয়েছে। ”
ড্রাইভার সাহেব চমকে উঠলেন।তিনি “ম্যাডামের” খুব ভক্ত। ম্যাডাম প্রথম দিনই বলে দিয়েছিলেন, “ম্যাডাম নয়, আপা ডাকবেন।” এ পর্যন্ত একদিনও আপা রাগ করে কথা বলেনি। দুই ড্রাইভার, ময়না খালা,আমেনা – এদের খাওয়া আপা নিজে দেখাশোনা করে। কোনো বাসায় যে কর্মচারীদের পালাক্রমে মুরগির রান, রুই বা কাতলের মুড়ো, বাড়ির লোকের জন্য যা রান্না হয়, তার সব দেওয়া হয়, এটা এ বাড়িতে না আসলে জানা হতোনা ড্রাইভার সাহেবের। এতো ভালো আপাকে স্যার চড় মারলো? ছোটো বাচ্চার সামনে? মনে হয়, লুম্বিনীর গায়ে তেল পড়ার জন্য। সে যাই হোক, শিক্ষিত মানুষ কোনো অবস্থায় স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারে?
লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো তিতির ড্রাইভার সাহেবের সামনে। তুতুন এমন একটা প্রশ্ন করে ফেলবে, তার মাথায় আসেনি। পরক্ষণেই মনে হলো, সে অন্যায় করেনি, কাজেই লজ্জাটা তার লাগার কথা নয়। সে তুতুনের গাল টিপে দিয়ে বললো, “বড়রাও ভুল করে। তোমার বাবা টেনশনে ভুল করে ফেলেছেন। এটা ভুলে যাও সোনা। আর নিজে এখন থেকেই খুব ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো, মিথ্যা বলবেনা একদম। কাউকে অসম্মান করে কথা বলবেনা। ”
নাজমুল -নিশাত চলে যাননি। মুখে শান্তিচুক্তির ভাব। নাজমুল সাহেব নাতিকে দেখে হৈহৈ করে উঠলেন সানন্দে। নিশাত আদুরে গলায় বললেন, “তুতুন ভাইয়া আজ বুবুর কাছে গল্প শুনতে শুনতে খাবে।”
তুতুন হাতমুখ ধুতে গেলো। তিতির নাজমুল -নিশাত-বুবুনকে বললো,”তোমরা খেয়েছো? ”
“হুঁ। লুম্বিনী কেমন আছে? ”
” রিস্ক ফ্রী না এখনো।”
শুনে বুবুন ডুকরে কেঁদে উঠলো। নাজমুল -নিশাতের চোখেও পানি।
তিতির বললো,” ইনফেকশন না হলে ভয়ের কিছু নেই। ইনফেকশন হবেনা আশা করছি।”
নিশাত বললেন, ” আমি তুতুনকে খাওয়াবো।তুমি নিজে খেয়ে নাও।”
তিতির উত্তর না দিয়ে তুতুনের ভাতের প্লেট নিজের কাছে টেনে নিলো। তুতুন একাই খেতে পারে। কিন্তু রাজের মৃত্যুর পরে ও নিজেই বহুদিন খেতে পারেনি, তারপরে একটু একটু খেতো কিন্তু ময়না খালা ছাড়া ওর খাওয়ার সময় বেশিরভাগ সময় কেউ থাকতোনা। সেই অবহেলাকে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
ভাত, বড় এক টুকরো ইলিশ ভাজা, মুরগির মাংসের বড় একটা টুকরো, লাল শাক, আর পাঁচ মেশালি তরকারি দিয়ে তিতির ছেলেকে ভাত খাওয়াতে বসলো। গল্প বললো, রাতে ভাইয়ার কাছে ঘুমাতে বললো, টিচারের কাছে পড়াশোনা করতে বললো, কাল সকালে আবার চলে আসবে সেটা বললো, নানাভাই-বুবুর সাথে গল্পগুজব করতে বললো। আচরণ এতো স্বাভাবিক যে সবাই একটু ভড়কে গেলেন।
নাজমুল সাহেব মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, “দুপুরে হাসপাতালে খেয়েছিস?”
“না।”
“কোথায় খেলি? ”
“খাইনি।”
বেশি গলে যাওয়া এতো তাড়াতাড়ি ঠিক হবেনা। নিশাত তাই খড়খড়ে গলায় বললেন, ” খেয়ে যাও। তুমি ছাড়াও লুম্বিনীকে দেখার জন্য লোক আছে। খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে জ্বালা আর বাড়িওনা।”
তিতির তুতুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”আসি।”
ময়না খালা দুইটা বাক্স দিয়ে দিলেন। ভাঙা গলায় বললেন, ” আমার কসম আম্মা, গাড়ির মধ্যে গরম গরম খাইয়া নিবেন।”
চলবে।