#সংসার
পর্ব ৩১
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
” হ্যালো, আমি কি ডাঃ ফারাহ নাজ নাজলীর সাথে কথা বলছি? ”
“ইয়েস। ”
” আপনার এবং আমার দেখা হওয়া দরকার খুব শিগগিরই। আমার বাসায় আসবেন নাকি আপনার বাসায় যাবো? বেটার, আপনার বাসায় যাওয়া। আপনার বাবা-মা-ভাই -বোনকেও আমার দরকার।”
“হোয়াট রাবিশ ! কে আপনি? ”
” আমার অনেক পরিচয়। আমি ডাঃ তাসমিয়া রহমান তিতির। আমি আরিয়ান, রাজেশ্বরী,লুম্বিনী, আরহামের মা। আরিয়ান,আরহাম হলো বুবুন ও তুতুন। নিশ্চয় চিনতে পেরে গেছেন আমাকে? আপনার বাসায় আমি আজ বিকালে আসছি। ঠিকানা জানি।ইন ফ্যাক্ট,সবই জানি আপনার সম্পর্কে। ”
“আমি খুব ব্যস্ত।কথা বলার সময় নেই। ”
“আপনার সব ব্যস্ততা থেমে যাবে। বিএমডিসি আমার দরখাস্ত আর প্রমাণের ভিত্তিতে আপনার রেজিষ্ট্রেশন ক্যান্সেল করবে। তারও আগে আপনার হাসপাতালের চাকরি চলে যাবে।ধরেন, কাল -পরশুর মধ্যে ই।”
“বোলচাল মেরোনা। তুমি আমার কিচ্ছু করতে পারবেনা।তোমার সাহস কতো! আমাকে হুমকি দাও। চেনো আমাকে? ”
“চিনি। আপনি বেশ নিম্নমানের মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা জুনিয়র ডাক্তার। এসএসসি , এইচএসসিতে মোটামুটি ধরণের ছাত্রী। তিনবারের বার মেডিকেলে চান্স পেয়েছেন। প্রতি প্রফে একাধিক বার সাপ্লি খাওয়ায় পাশ করে বের হতে অনেক সময় লেগেছে। আপনার বাবা একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। আপনার মা এজি অফিসের ক্লার্ক, অত্যন্ত অসাধু। আপনি আপনাদের মেডিকেলের প্রাক্তন জিএস এর সাবেক প্রেমিকা যে কিনা নিজে দুই নম্বর হলেও আপনার দুনম্বরি ধরে ফেলে এবং তার জীবন থেকে আপনাকে বিদায় করে দেয়। আপনি মেডিসিনের এক বৃদ্ধ অধ্যাপকের রক্ষিতা ছিলেন বহুদিন, পাশাপাশি মেডিসিনের আরেক মধ্য বয়সী টিচার কাম নেতার সাথে অতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ধরা পড়ে যান এবং দু’জনেই আপনাকে গলাধাক্কা দেন। ততোদিনে আপনার বহু টাকা পয়সা, গয়না, গ্যাজেট এসব হয়ে গেছে। আপনি বর্তমানে দেশের নামকরা সার্জন ডাঃ আসিফের শয্যাসঙ্গিনী। যেসব মানুষদের চরিত্র দুর্বল, তাদের আপনি জালে জড়িয়ে ফেলেন। ডাঃ আসিফকেও জড়িয়েছেন। প্রথম প্রথম দু’জনেই খুব সুখে ছিলেন, তারপরে আপনাকে ডাঃ আসিফের অসহ্য বোধ হতে থাকলো। শরীরের নেশা কয়দিন, বলেন? সে আপনার নির্লজ্জ, ভয়ংকর লোভী চেহারা আবিস্কার করলো। আপনি তার ফ্ল্যাট, টাকা, জমি ইত্যাদির হিসাব নিকাশে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন,তাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করলেন। সব প্রমাণ আছে আমার কাছে। সাক্ষী সাবুদও। প্রস্তুত হন আমাকে ফেস করার জন্য। আমি অলরেডি জিডি করেছি আপনার নামে।আসিফ বা আমার পরিবারের কারো এতোটুকু ক্ষতি হলে আপনি শেষ। বিএমডিসি আপনার রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করবে, আপনার মায়ের এগেইনস্টে দূর্নীতির খুব ভয়ংকর অভিযোগ উঠেছে, বেশ কয়েকজন মামলা করেছেন। চাকরি তো থাকবেনা, জেল -জরিমানা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।খুব খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিন।”
“আমার বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন ক্যান্সেল করাবেন, নিজের স্বামীরটার করাবেন না? ”
“না। করাবোনা। কিন্তু আপনার মতো একটা নোংরা মেয়েকে থামাতে হবে।নোংরা পুরুষগুলোকেও থামাতে হবে। ”
আসিফ কথোপকথন সবই শুনতে পাচ্ছিলো।লাউড স্পিকার অন করে তিতির কথা বলছিলো।বাসায় বাচ্চারা কেউ নেই। ময়না খালা আর আমেনা ড্রইং রুমে জোরে সাউন্ড দিয়ে সিনেমা দেখছে। ধরা পড়ার পরে আসিফ বোঝানোর খুব চেষ্টা করেছে, সে সাময়িক মোহগ্রস্ত হয়েছিলো, তারপরে সে কিভাবে মেয়েটার ফাঁদে পা দেয়, মেয়েটা তাকে কত রকমের হুমকি দিচ্ছিলো, কিভাবে আসিফকে ব্ল্যাক মেইল করা হচ্ছিল, এসবের ধারাবিবরণ। তিতির গলেনি। ঠাণ্ডা গলায় বলেছে, “চরিত্রবান ও ব্যক্তিত্ববান ছেলে বা মেয়েকে কেউ ফাঁদে ফেলতে পারেনা।কারোর কূটচালে ফাঁদে পড়লেও তারা ভয় পায়না, সত্য তাদের সাহস যোগায়। ”
তিতির ব্যক্তি আসিফকে ভালোবেসেছে, আসিফের ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে পারেনি কখনো। এতো বছর এক সাথে থাকা, চার বাচ্চার বাবা-মা হওয়া, এক কন্যাকে হারানোর শোক একসাথে বয়ে বেড়ানো, সুখে-দুঃখের হাজারো স্মৃতি। মমতা,ভালোবাসা জন্মাবেই। আসিফ খেয়াল না রাখলে বিয়ের পর হতেই শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ তিতিরকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলতো। রাজের মৃত্যুর পরে নিজের শোক বুকে চেপে তিতিরকে কি দুর্দান্ত সাপোর্ট দিয়েছে আসিফ ! তাছাড়া চার ছেলেমেয়েকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে আসিফ। ছেলেমেয়েরা দূরে সরে গেলে, বাবার অন্ধকার অধ্যায় জানতে পারলে নিজের প্রতি লজ্জা,ঘৃণা ও ধিক্কারে আসিফ ভয়ংকর কিছু করে ফেলতে পারে। তিতির কোনোভাবে তা চায়না। সে সত্যি আসিফকে খুব ভালোবাসে।
সমস্যা মিটলো। নাজলী গোপনে বাসায় এসে তিতিরের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলো বারবার শপথ করলো, আর কখনো কোনো পুরুষকে শিকার করবেনা। আসিফ স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারেনা। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।বাচ্চারা অবাক হয়। বুবুন মা’কে জিজ্ঞেস করে, “বাবা কি কোনো সমস্যার মধ্যে আছে? শরীর ঠিক আছে? একবার থরো চেকআপের দরকার। অফিসে কোনো সমস্যা হয়নি তো? ”
তিতির ছেলেমেয়েদের আশ্বস্ত করে। কিছুই হয়নি তাদের বাবার। টেনশনের কারণ নেই।
এক ছুটির দিনে নাজমুল -নিশাত সবাইকে নিজেদের বাসায় খেতে ডাকেন।হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ। কিন্তু নোমানের মুখে অপরাধবোধ প্রকট, তমা কোনো একটা টেনশন করছে, স্পষ্ট বুঝা যায়।
বাচ্চারা খুব আননদ করছে। আসিফ অনেকদিন পরে একটু হাসিখুশি। আদনানের কথাবার্তাও অনেক সংযত। তিতির-তিতলীকে খুব হাসিখুশি দেখে নাজমুল -নিশাতও মহানন্দে আছেন। একই বাড়িতে থাকায় তিতলীর শ্বশুর -শাশুড়িকেও বলতে হয়। উনারা দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ায় বাসার সবাই মনে মনে আরও খুশি। কারণ, আদনানের মায়ের উপস্থিতি মানেই এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সম্মুখীন হওয়া।
মাগরিবের নামাজের পরে চা খেতে বসে বহু ভূমিকা, ভনিতার পরে নোমান বোম্বশেলটা ফাটালো। খুব শীঘ্রই তারা অস্ট্রেলিয়ায় সেটল করতে যাচ্ছে। ওরা চারজন। প্রসেসিং বাকি নেই। এখন শুধু যাওয়ার দিন ক্ষণ ঠিক করা। ওখানে যেয়ে ওরা বাবা-মা’কে নেওয়ার চেষ্টা করবে। আসলে দেশের যে অবস্থা ! এখানে ছেলেমেয়েদের মানুষ করা অসম্ভব ব্যাপার প্রায়।
সারাদিনের হাসি-আনন্দ মুহূর্তে উধাও। সবাই নিশ্চুপ। বাচ্চারাও।
নীরবতা ভাঙলো ইরফান। সে জলদগম্ভীর গলায় বললো, “আমি দাদা-দাদির কাছে থাকবো। আমি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, চীন, জাপান কোথাও যাবোনা। তোমরা অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেছো,এতো কিছু বলোনি।”
নিশাত বললেন, ” সব প্রসেস কমপ্লিট করে আমাদের জানানোর মানে কি? আগে বললে বাধা দিতাম? ”
তমা তড়িৎ উত্তর দিলো, ” আগে বলা আর পরে বলার মধ্যে পার্থক্য কি? ”
তিতলী স্হির চোখে তমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” বিয়ের আগে বাচ্চা হওয়া আর পরে বাচ্চা হওয়ার মধ্যে অনেক তফাত, তাইনা? খুব স্বার্থপর তোমরা। বাবা-মায়ের ঘাড়ে ভর করে আখের গুছিয়ে নিয়েছো, আখের গোছানো শেষ। এখন বাপ-মাকে ফেলে বিদেশে লেজ গুটিয়ে পলায়ন।”
“তিতলী ! ”
“চুপ! গলাবাজি করার গলা তোমাদের আর নেই। বাবা-মায়ের বাড়িতে থেকে, তাদেরটা খেয়ে, তাদের দিয়ে বাচ্চা মানুষ করিয়ে এমন সময় বিদেশে উড়াল দিচ্ছো যখন তাদের দু’জনেরই বয়স হয়েছে, দু’জনেরই অসুখ।”
“তোমার ভাই তাদের একমাত্র সন্তান, তাতো নয়, তোমরা দুই বোন আছোনা? নাকি তোমাদের দায়িত্ব নেই কোনো? ”
নিশাত বললেন, “আমাদের নিয়ে কেউ কোন কথা বলবেনা। যতোদিন গায়ে শক্তি আছে, নিজেদের কাজ তো বটেই, তোমাদের কাজও আমরা করে দিবো। আমি শুধু ভাবছি, এই সেই নোমান যে আমাদের ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারতো না? যে ভার্সিটি লাইফেও হোষ্টেলে থাকতোনা বাপ -মা আর দুই বোনের জন্য ? ”
“শোনেন মা, প্রত্যেকের জীবনে বিভিন্ন ফেজ থাকে।কিভাবে আশা করেন আপনি, নোমান এখনো আপনার আঁচল ধরে ঘুরে বেড়াবে? ওর নিজের ব্রাইট ফিউচার,সিকিওরড লাইফের কথা আপনি ভাববেননা? ওর লাইফে এখন ফার্স্ট প্রায়োরিটি ওর ছেলেরা। ওর ওয়াইফ। বাবা যখন চাকরির সুবাদে নানা জায়গায় ঘুরতেন, তখন কি উনার বাবা-মাও সবসময় সাথে থাকতেন? কাদের প্রায়োরিটি বেশি ছিলো বাবার কাছে, আপনার আর নোমানদের নাকি বাবার বাপ মা,ভাই বোনের? ”
তিতির এই কথার জবাব দিলো, ” দাদা-দাদি গ্রামে থাকতে পছন্দ করতেন।গ্রামে তাঁদের আরও ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজন ছিলো।তাঁরা একা থাকতেননা। কিন্তু বাবা,চাচা সাধ্যমতো করেছেন দাদা-দাদির জন্য। যা প্রয়োজন, তাতো করতেন-ই, ভাই বোন ভাগ্নে -ভাগ্নীদের বাড়তি চাহিদা আর আবদারও পূরণ করতেন সীমিত আয় থেকে।দাদার মৃত্যুর পরে দাদি তার ইচ্ছা অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন। নিজেদের দরকার মিটাতে আমার বাবা-মা তাঁকে ব্যবহার করেনি। দাদি আমার চাচা চাচি ও বাবা মায়ের সেবা পেয়েছেন অনেক। তুমি এসব বুঝবেনা ভাবী, সবার বোধবুদ্ধি এক হয়না। ”
ইরফান টেবিলের উপরে দুম করে এক ঘুষি দিয়ে বললো, “ওরা যাক,
আমি আর আয়মান যাবোনা। আমরা দেশে থাকবো সবার সাথে। ওদের সাথে থাকা মানে সারাক্ষণ চিৎকার আর হৈ হল্লার মধ্যে থাকা।ঝগড়া -ঝাটি, পারলে মারামারি। ”
নাজমুল সাহেব টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে ইরফানকে বললেন, ” ছি দাদা। বাপ – মা বা কারোর সম্পর্কে এভাবে কথা বলতে হয়না।”
বেড়াতে আসা মেয়ে আর নাতিদের ফেলে নিজের ঘরে মাথা নিচু করে ঝুঁকে ঝুঁকে নাজমুল সাহেবের চলে যাওয়াটা সবাইকে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিলো কি নিদারুণ আঘাত পেয়েছেন তিনি।
তিতলী টেবিলে মাথা গুঁজে ফেললো।আদনান বললো, ” বাবা-মা’কে ফেলে ভাই -ভাবি চলে যাচ্ছে, তাই তোমার মন খারাপ। আবার আমি আমার বাবা-মা’কে কাছে রাখলে তাতেও তোমার মন খারাপ। হায়রে মন! ”
তিতির ভগ্নিপতির দিকে তাকালো,” তোমার বাবা -মা আর আমার বাবা-মায়ের কাজকর্ম, নীতি, আদর্শে অনেক পার্থক্য আছে, এটা বুঝোতো আদনান? নাকি ইঞ্জিনিয়ার বলে তোমার মাথায় শুধু যন্ত্রপাতি আছে, বোধবুদ্ধি নেই? তোমার মা, ভাই,বোন এ পর্যন্ত তিতলীকে কতো ধরণের জ্বালা *যন্ত্রণা দিয়েছে, খুব ভালো জানো তুমি। তিতলী কি একেবারে কোণঠাসা হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সামান্যতম খারাপ ব্যবহার করেছে তোমার বা তোমার ফ্যামিলির সাথে? তোমাকে আলাদা হতে বলেছে? বলেনি। তুমি তোমার স্ত্রীর যুক্তিসঙ্গত সমস্যাগুলো বুঝার চেষ্টা করেছো? সমাধান দূরের কথা। কিভাবে আশা করো, তোমার ফ্যামিলিকে তিতলী মাথায় তুলে রাখবে? উনারাতো মাথায় ওঠানোর মর্যাদা জানেননা।তাঁদের সাথে নরম, ভদ্র ব্যবহারকে দুর্বলতা মনে করেন। ছেলের বৌয়ের সাথে তোমার ফ্যামিলির ব্যবহার আর ছেলের বৌয়ের সাথে আমাদের ফ্যামিলির ব্যবহার,কর্তব্যে আকাশ পাতাল তফাৎ, এটা বুঝার বুদ্ধিও নেই তোমার? ”
আদনান মাথা নিচু করে ফেললো।মনে মনে দারুণ বিস্মিত। তার শ্বশুরবাড়ি এমন একটা বাড়ি যেখানে দরকারে ছেলেমেয়েরা বকা খায়, জামাইদের আর বৌকে মাথায় তুলে রাখা হয়। আর তিতির আপা পারলে সবাইকে হুজুর হুজুর করে। সারা দুনিয়াকে। নিজের শ্বশুরবাড়ি, ভাইবোনদের শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাইকে। কেউ সাতটা চড় মারলে আপা তাকে বিনিময়ে সাতটা রসগোল্লা খেতে দেয়,এমন অবস্থা। এখন দেখা যাচ্ছে , তিতলীর মতো আপাও ফণা তুলছে। গলার স্বর স্বাভাবিক, কিন্তু কথা বলছিলো যখন, তখন তিতির আপার হিমশীতল দৃষ্টি
আর মুখ দেখে বুকে কাঁপুনি উঠে গিয়েছিলো আদনানের।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৩২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
” কি ইরফান, আমরা কি ভুল করেছি এখানে এসে? নিউট্রালি বলো। কতো সুন্দর দেশ, চমৎকার ওয়েদার, ট্রাফিক জ্যাম নাই, রাস্তাঘাটে – বাড়িঘরে পিলপিল করা লোক নাই, ভেরি ভেরি গুড এডুকেশন সিস্টেম, মেডিকেল কেয়ার। সিকিউরিটি স্ট্রং। কতো গার্ডেন, পার্ক। তোমার স্কুলটাও কতো ভালো। তুমি নিজেই দুই দেশের মধ্যে কম্পেয়ার করো, তারপরে বলো আমি ভালো করেছি কিনা।”
” শোনো আম্মু , স্যরি, আম্মু বা মা ডাকবো নাকি মাম্মি,মম,মাম্মা বলবো? যেটা শুনতে চাও। তুমি ভালো করোনি। জোর করে আমাদের দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে এসে তুমি ভালো করোনি।এখানকার কোনো কিছু আমার ভালো লাগছেনা।আমার লাইফ নিয়ে আমি ফেড আপ। যখনই মনে হয় আমার প্যারেন্টস সেলফিশ, ন্যারো মাইন্ডেড, তখন আমার এই বাড়িতে এক মুহূর্তের জন্য থাকতে ইচ্ছা হয়না।”
“ইরফান! চড়িয়ে তোর মুখ ভেঙে দিবো। স্বার্থপর আমরা না তুই,শয়তানের বাচ্চা? তোদের ভালোর জন্য প্রাণপাত করি, আর তোরাই বুকে ছোরা বসাস? ”
তমার মা বললেন, ” বাদ দে তমা, বয়ঃসন্ধির সময় এমন আচরণ স্বাভাবিক। সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে সব।”
“চার মাস কি যথেষ্ট সময় না? ঠিক হলো কই? বাঁদরের মতো মুখ করে বসে থাকে। ”
রক্ত পানি করা উত্তর দিলো ইরফান, হিমশীতল গলায়, ” ইউ পুওর লেডি,লিসেন, আই মাস্ট টিচ ইউ এ গুড লেসন। আরেকবার যদি আমাকে, আয়মানকে, আমার দাদা দাদি, ফুপু ফুপা, ভাইবোনদের নিয়ে একটা, জাস্ট একটা খারাপ কথা বলো, হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। মানুষ করার জন্য ভিন দেশে নিয়ে আসছো । মানুষের পেট থেকে মানুষ হয়, তুমি আর তোমার হাসব্যান্ড মানুষ না। তুমি একটা উইচ, তোমার হাসব্যান্ড একটা ভেড়া।”
নোমান -তমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কে এ? ইরফান? সেই ছোট্ট মিষ্টি ক্ষীরেভরা পুতুলটা? সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখ লাল, মুখের মাংসপেশি শক্ত, তার ঠোঁটের কোণে কষ, সে কাঁপছে থরথর করে,রাগে।
ইরফানের নানি বললেন, ” শেম ইরফান। এতোদিন এই শিক্ষা পেয়েছো? ছি, ছি।”
“চুপ। বললামনা আমার সাথে কেউ একটা খারাপ কথা বলবে না? মাসের পর মাস নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে অস্ট্রেলিয়ায় ঘাঁটি গেঁড়েছো।লর্ড ক্লাইভ, মীর জাফর, ঘষেটি বেগমের মতো। তোমার মেয়ে তার বাবা-মা, স্বামী, দুই ছেলেকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে সফল হয়েছে। এরপরে আনবে ভাইকে। কিন্তু আমার দাদা-দাদিকে কিছু আগে কেন বলা হলোনা? আমাদের মতামত নেওয়া হলোনা কেন? ”
“তোমার দাদা-দাদি দেশ ছেড়ে আসতেননা। একেক মানুষের একেক প্যাটার্ন না? তার উপরে তোমার বাবার চাইতে তোমার ফুপুদের উপরে উনাদের বেশি টান। মেয়েদের ছাড়া উনারা আসতেননা। ”
” ওহ্ নানিজান, তাই আমার দাদা-দাদিকে কিছু বলার দরকারই মনে হয়নি তোমাদের, ইভেন তাদের ছেলের। আমার বাপ তার বাপ-মায়ের কথা না ভেবে প্যারেন্টস ইন ল’র কথা ভেবেছে। গ্রেট। ”
তমা চেঁচিয়ে বললো, ” একজন পুরুষ তার বাবা-মা নিয়ে থাকবে, একটা মেয়ে তার প্যারেন্টস নিয়ে থাকতে পারবেনা? আমার কাছে আমার বাপ-মা দামী, তোমার দাদা দাদি নয়।”
ইরফান শুধালো তার বাপকে, ” আর তোমার কাছে? ”
নোমান মাথা নিচু করে রইলো।
ইরফান তার মা’কে বললো, ” তোমার কাছে তোমার বাপ -মা বেশি মূল্যবান। এতে কোন অন্যায় নেই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি আমার দাদা-দাদির কাছ থেকে তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এলে কেন? ”
“তোমার বাবা ছোটো মানুষ? আমি তাকে কোলে করে নিয়ে আসছি? আর তোমার ফুপুরা মরে গেছে নাকি? তারা তাদের বাপ -মাকে দেখেশুনে রাখতে পারেনা? ”
” বিয়ের পর থেকে আমার দাদা-দাদির বাড়িতে থাকতে কেন? দাদা-দাদির সুবিধার জন্য? মোটেওনা। বাড়িভাড়া বাঁচানোর জন্য , আমাদের দুই ভাইয়ের নিরাপত্তার জন্য। আমরা দাদির রান্না খেয়ে বড় হয়েছি, দাদার সাথে স্কুলে গিয়েছি। দাদা-দাদির থেকে সব সুবিধা তোমরা নিয়েছো।আর এখন ওদের একা করে চলে এসেছো।আমাদের মানুষ করার জন্য এনেছো তো? দেখো, কেমন মানুষ হই। ”
নোমান মাথা নিচু করে বসে রইলো চুপচাপ। ছেলে বেয়াদবের মতো কথা বললেও যা বলেছে ঠিক বলেছে। কাজটা আসলেও ঠিক হয়নি। তার নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগে। ছেলেবেলার কথা মনে হয় খুব। বাবা-মা-তিতির-তিতলী। কতো আত্মীয়, কতো বন্ধু। হোক গরীব, দূর্নীতিগ্রস্ত, অরাজকতায় ভরা দেশ। দেশে থেকে না হয় দেশ মেরামতের কাজ করতো।আর মানুষ বাংলাদেশে বাস করেনা? নোমানের কান্না আসে।বাবা-মায়ের জন্য। বোনদের জন্য। ভাগ্নে-ভাগ্নীগুলোর জন্য। ফেলে আসা দিনগুলোর জন্য। ভুল হয়ে গেছে, মস্ত ভুল।
ভিডিও কল দিনের মধ্যে দুই তিনবার হয়। নোমান এক দুইবার করে, রাতে তমা করে, গলায় মধু ঢেলে কথা বলে, কিন্তু নোমান বুঝতে পারে নিশাত ছেলে এবং বৌয়ের সাথে একেবারে আবেগশূন্য হয়ে কথা বলেন। শান্ত গলায়, ঠান্ডা চোখে। কুশল জিজ্ঞেস করলে সবসময় উত্তর দেন, ” ভালো,আলহামদুলিল্লাহ। ” নাজমুল সাহেবের কথাবার্তায় তাও হালকা প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায়। কিন্তু ছেলে ও বৌ সম্পর্কে একদম নিরাসক্ত এই মা’কে চেনেনা নোমান-তমা। তাই কেমন অস্বস্তি লাগে, কথা জড়িয়ে যায়।
তবে ইরফান, আয়মান একটু পরপর ফোন করে দাদা-দাদী, ফুপু, ফুপাতো ভাইবোনদের, ওরাও করে, তখন অনেক হাসাহাসি, গল্প, কলকলানির শব্দ পাওয়া যায়।
নোমান মায়ের মোবাইলে ভিডিও কল দেয়, ” মা? কেমন আছো? ”
” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
“বাবা ভালো আছেন? ”
“আছেন। ”
“বাবা সেদিন বলছিলেন কি কি নাকি টেস্ট করানো হয়েছে তোমার আর বাবার? কেন? টেষ্টের রিপোর্ট কি? ”
“ভালো। কোনো সমস্যা নেই। ইরফান আয়মান কেমন আছে? ”
“ওরা ভালো নেই। আমিও ভালো নেই , মা। ”
” ইরফান,আয়মান কোথায়? ”
“ওদের ঘরে।জানতে চাইলেনা তো আমি ভালো নেই কেন? ”
” তুমি যথেষ্ট অ্যাডাল্ট। তুমি কেন ভালো নেই, কি করলে ভালো থাকতে পারবে, তা বোঝার বুদ্ধি তোমার আছে। যখন বুদ্ধি ছিলোনা, তখন সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতি মুহূর্তে আমরা ছিলাম। এখন নিজের সব সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারবে, আশা করি।”
” বাবা কোথায় মা? আর কিসের একটা শব্দ পাচ্ছি প্রথম থেকেই। ”
“মিলাদের শব্দ পাচ্ছো। রাজের মৃত্যু বার্ষিকী আজ। ইরফান গত দুই দিন ধরেই ফোনে কান্নাকাটি করছিলো।আজ ভোররাতে ফোন করে ইরফান -আয়মান কথা বলেছে আমার আর ওর দাদার সাথে। ”
“তোমরা তিতিরের বাসায় মা? ”
“হ্যাঁ। ”
“তিতলীরা এসেছে? ”
“কেন আসবেনা? ”
“তিতির,তিতলীর শরীর কেমন? বুবুন, তুতুন, অরণ্য, অরণী? লুম্বিনী কেমন আছে মা? আসিফ -আদনান? ”
“ভালো।”
” রাজের কবর জিয়ারত করতে কে কে গিয়েছিলো?”
“সবাই। রাজের বাবা,নানা, খালু, চাচারা,ফুপারা। বুবুন,তুতুন, অরণ্যতো আছেই। ইরফান, আয়মানকে ভিডিও কলে জিয়ারত করিয়েছে বুবুন।
আমরাও ছিলাম, আমি-তিতির-তিতলী-আপা।”
নোমান কিছুক্ষণ কষ্টে কথা বলতে পারলোনা। রাজের মৃত্যুবার্ষিকী সে কেমন করে ভুলে গেলো? সবার সাথে সবার আগের মতো হৃদ্যতা, রাজের মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য ফোন করে কাঁদাকাটি করেছে ইরফান,আয়মান। এই দুই ভাইকে ভিডিও কল করেছে অন্য ভাইরা, বোনের কবর দেখাতে।এতো কিছু হয়, হচ্ছে, সবই নোমানের অগোচরে। সবার থেকে, সবকিছু থেকে নোমান বিচ্ছিন্ন।
“মা? ”
“বলো।”
“আসিফের ভাইবোনেরা আবার আসা যাওয়া শুরু করেছে? তিতিরকে জ্বালায়না তো? ”
“না। তারা আসিফের ভাইবোন। তিতির-তিতলী এটাই শিখেছে, যতো যাই হয়ে যাক, যে যেমন হোক, তাদের বাসায়, তাদের ছেলেমেয়েদের কোনো
অকেশনে তাদের বাপ-মা,ভাই-বোনকে যেমন মর্যাদা দিতে হবে, তেমন গুরুত্ব দিতে হবে জামাইদের পরিবারকেও।”
“মা,আমি ভালো নেই। ”
“ভালো থাকার চেষ্টা করো নোমান। রাখি। কাজ আছে কিছু। ”
কি বিশাল শূন্যতা! মায়ের শরীর মোটেও ভালো মনে হলোনা নোমানের। অনেক শুকিয়ে গেছে, কেমন ক্ষয়াটে, ফ্যাকাসে। কথাগুলো আর মুখের ভাব কি বরফশীতল। নোমান কেঁপে উঠলো।
রাতে বাবাকে ভিডিও কল দিলো নোমান, “বাবা, এখন কেমন আছো তুমি?”
“ভালোই আছি।আল্লাহ যেমন রেখেছেন। তুই ভালো? ”
নোমান হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, ” বাবা,আমি ভালো নেই। তোমাদের ছাড়া একদম ভালো নেই। ”
“তা বললে হবে কেন? ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে গেছো, এখন এটা বললে হবে নাকি? কাজকর্ম মন দিয়ে করো, একটু ঘুরাফেরা করো, আস্তে আস্তে ভালো লাগবে।আমাদের নিয়ে চিন্তা করিসনা, আমরা ভালো আছি, তিতির-তিতলী, বুবুন, জামাইরা সবাই খুবই খেয়াল রাখে, যত্ন করে।”
“তোমরা ফাঁকা বাসায় না থেকে ওদের কারোর বাসায় থাকোনা বাবা? তাহলে শান্তি পাই।”
“এখনো অশান্তির কিছু নাই বাবা। মতির মা যথেষ্ট খেয়াল রাখে।তিতির -তিতলী পালা করে প্রতিদিন আসে।সারা সপ্তাহের বাজার দুই মেয়ে করে দিয়ে যায়। তারপর, এইযে ধরো, কাল তিতিরের বাসায় এসেছি, বুবুন যেয়ে নিয়ে এসেছে, সপ্তাহখানেক থাকবো। তোমার খালা,মামা,চাচারাও প্রায় আসেন।আমাদের নিয়ে টেনশন করিসনা। ”
“বাবা,আমি চরম অন্যায় করেছি তোমাদের সাথে। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
নাজমুল সাহেব একটু চুপ থেকে বললেন, “ভাবিয়া করিও কাজ,করিয়া ভাবিওনা। সামনে পুরো ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, এই প্রবাদটা মনে রেখো।”
চলবে।।