#সংসার
পর্ব ৩৩
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নিশাত সারাক্ষণ নোমানের কথা ভাবেন। প্রথম সন্তানের জন্ম, তার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, তার মুখে প্রথম মা ডাক, কতো সুখস্মৃতি। মা-ছেলে কেউ কাউকে কিছুক্ষণ না দেখে থাকতে পারতেননা।স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থেকে ফিরে মায়ের সাথে নোমানের গল্প ফুরাতেই চাইতোনা। নিশাতের একটু মাথাব্যথা হলেও অস্হির হয়ে পড়তো নোমান। বাপের দিকেও খেয়াল ছিলো খুব। তিতির-তিতলীকে জ্বালিয়ে মারতো ছেলেটা। বেণী ধরে টানা, গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়া, বোনদের পচিয়ে ছড়া লেখা। সেই সাথে আলগা মাতব্বরি। কোন ছেলে বোনদের দিকে অন্য ভাবে তাকালে তার চোখ গেলে দিবে, এমন একটা ভাব।
তমার সাথে বিয়ে হওয়ার পরেও অনেকদিন ভালো চলছিলো সবকিছু। তারপরে ধীরেধীরে অশান্তি শুরু হলো।সেই অশান্তির ঝাপটা নাজমুল -নিশাতের উপরেও পড়লো। নোমান ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগলো। সদা গম্ভীর, চুপচাপ , ভুরু কুঁচকানো, অল্পেই রেগে যাওয়া। কিন্তু তাই বলে এতো পরিবর্তন? অস্ট্রেলিয়ায় সেটল করবে এটা নাজমুল নিশাতকে বললে তাঁরা বাধা দিতেন? কখনো না। তাহলে তাঁদের লুকিয়ে এমন ন্যাক্কারজনক কাজ কেন করলো নোমান? নিজের বাবা-মা’কে চেনেনা সে?
অভিমান নয়, ভীষণ অপমানবোধ হয় নিশাতের। তাই কলিজার টুকরো ছেলের সাথে হাজার চেষ্টা করেও স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেননা। তমার সাথেতো একদমই নয়। তবু তারা ফোন করলে ধরতে হয়। ইচ্ছা না থাকলেও কথা বলতে হয় একদম নিস্পৃহ ভাবে।
ইরফান -আয়মানকে নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা। এতো মাস হয়ে গেলো,ইরফান ঠিক হচ্ছে না। ভীষণ বিগড়ে গেছে। তার এক দফা এক দাবী, সে নিজের দেশে যাবে। দাদা-দাদির কাছে থাকবে। দেশে লেখাপড়া করবে। আয়মানেরও একই কথা। ছেলে দুটো বাবা-মায়ের কথা একেবারেই শোনেনা বরং যা বলা হয়, তার উল্টোটা করে। ভায়োলেন্ট হয়ে গেছে দু’জনেই বিশেষ করে বড়টা। লেখাপড়াতে একদমই ভালো করছেনা, বলা ভালো, লেখাপড়াই করছেনা।বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ। সেদিন তমা মারতে গেলে ওর হাত মুচড়ে দিয়েছে ইরফান।
এসব খবরে খুশি হতে পারেননা নাজমুল -নিশাত, তিতির -তিতলী। সবাই অনেক বুঝায় ইরফান -আয়মানকে। কাজ হয়না।
ছেলের সংসারে অশান্তি , মেয়েদের সংসারে অশান্তি। নাজমুল -নিশাতের কিছুই ভালো লাগেনা। একসময় এই বাসা গমগম করতো মেহমানে।এখন সবাই মহা ব্যস্ত। কেউ কেউ অসুস্থ, বাসার বাইরে বের হতে পারেননা।
নাজমুল সাহেবের বক্তব্য হলো, এইযে মানুষে মানুষে যোগাযোগ কমে গেছে, আত্মীয়তার এককালের মজবুত বন্ধন ঢিলা হয়ে যাচ্ছে , মানুষের স্বার্থপরতা,সংকীর্ণতা আর আলসেমি বাড়ছে, সব কিছুর মূলে হচ্ছে ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম এসব বাজে জিনিস। কথাটা আংশিক হলেও সত্যি, এতে সন্দেহ নেই। নিশাত মাঝেমধ্যে ফেসবুক চালান, নাজমুল সাহেব তখন গজগজ করেন।
বুবুনের গ্র্যাজুয়েশন শেষ। নোমান -তমা বারবার ওকে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যেতে বলছে। আসিফেরও ইচ্ছা এমএসসি বুবুন বাইরে থেকে করুক। এমএসসির পরে রিসার্চ, ডক্টরেট, পোস্ট ডক্টরেট বুবুন বাইরের ভালো কোনো ভার্সিটি থেকে করুক। বাংলাদেশ শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে, এতেতো সন্দেহ নেই এতোটুকু। তিতিরের বুক ফেটে যাচ্ছে , কিন্তু ছেলের উন্নত ভবিষ্যতের কথাওতো মাথায় রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষা শেষ করে বুবুন বাংলাদেশে ফিরে আসবে, হতভাগ্য দেশের হাল ধরবে। কিন্তু বুবুন নারাজ। সে বিদেশে যাবেনা। এখানেই পড়বে, এখানেই রিসার্চ করবে, দেশের মরচে ধরা সিস্টেমকে সে পাল্টে দিবে। আসিফ খুব অসন্তুষ্ট। কিন্তু বুবুন ঘাড়তেড়া। কেন যেন অনেকদিন ধরে সে বাবাকে এড়িয়ে চলে।
আসিফের খুব শখ, ছেলেমেয়েদের একজন অন্তত ডাক্তারি পড়ুক। সার্জন হোক। তখন তাকে নিয়ে আসিফ বিরাট নার্সিং হোম খুলবে। কিন্তু কে হবে? লুম্বিনী বাবাকে কথা দিয়েছে সে ডাক্তারি পড়বে।লুম্বিনী ভীষণ মেরিটোরিয়াস।সেই সাথে মনোযোগী, অধ্যবসায়ী। ও পারবে। অথচ দুই মেয়েকে নিয়ে রীতিমতো চরম দুশ্চিন্তায় থাকতো আসিফ-তিতির। লেখাপড়ায় বিশ্রী ধরণের খারাপ ছিলো দু’জনে।
আচ্ছা, রাজেশ্বরী বেঁচে থাকলে কি হতো? দুই বোন পড়াশোনায় ওইরকম ফাঁকিবাজই থাকতো? ফেল করে হাসিমুখে বাসায় ফিরে পোলাও খাওয়ার আবদার করতো? নাকি দু’জনেই শান্ত হয়ে যেতো, ফার্স্ট হওয়া নিয়ে দুই বোনের জোর প্রতিযোগিতা হতো, বিতর্কে দুই বোনই বিজয়ী হতো, দু’জনেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। লুম্বিনী হাজার ডামাডোলেও নামাজ বাদ দেয়না। তবে রাজ বেঁচে থাকলে দুই বোনই নৃত্যশিল্পী হতো, কোন সন্দেহ নেই। টিভি দেখে অবিকল নাচ কপি করতো রাজ, মিউজিক ছেড়ে তাল-লয় সব ঠিক রেখে দারুণ নাচতো, লুম্বিনীর ভুল ধরিয়ে দিতো। তিতির বড় করে শ্বাস ফেলে। কি হতো আর কি হতোনা, কে জানে!
রইলো বাকি তুতুন। দুরন্ত ফাঁকিবাজ। শুধু খেলার দিকে মন। তিতির মারধোর করতে পারেনা, এই অভ্যাসটাই ওর নেই , কিন্তু তাও মাঝেমধ্যে তুতুনকে আছাড় লাগাতে ইচ্ছা হয়। পড়া না পারলে তুতুন কোনো অজুহাত দেয়না, বকা দিলে প্রত্যুত্তর করেনা, বড় বড় নিষ্পাপ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। তখন টিচাররাও কিছু বলতে পারেননা, তিতিরও না। তবে বুবুন মাঝেমধ্যে কান মলে দেয়, ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দেয় দুই একটা। তারপরও তুতুন পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালোই করে, কারণ সর্বশক্তি দিয়ে তিতির ওর পেছনে লেগে আছে। তিতিরের এখন মনেও পড়েনা তার একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে, সে একজন ভালো ডাক্তার। বাবা-মা’কে একদিন অন্তর দেখতে যাওয়া, তাদের কি দরকার, সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করা, শেফালী খালাকে তার দায়িত্ব -কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেওয়া কারণ মহিলা দারুণ ফাঁকিবাজ, বাবা-মায়ের পছন্দের কিছু নাশতা বানানো, ডাক্তার দেখানো, দুইজন নিঃসঙ্গ ভালো মানুষকে কিছুটা সময় দেওয়া,বুবুনটা কেমন মনমরা থাকে, ওকে একটু সময় দেওয়া, লুম্বিনীর যত্ন নেওয়া, তুতুনকে মুরগী ধরার মতো করে ধরে এনে পড়ানো, অরণ্য -অরণীকে স্কুল থেকে এনে ওদের গোসল -খাবারের ব্যবস্থা করা, নিজের আর আসিফের দিকে তাকানোর সুযোগ পায়না তিতির।আসিফের দিকে অবশ্য তাকাতে ইচ্ছা করেনা, বুকে যতো ভালোবাসা থাকুক।
সন্ধ্যার পরে তিতলী আসে অফিস থেকে, কয়েক মিনিটও দাঁড়ায় না, এক কাপ চাও খেয়ে যায়না, অরণ্য -অরণীকে ধরে নিয়ে যায়। তিতির জোরাজোরি করলে অপরাধী গলায় বলে, “আপা, এদের সামলাতে তোমার কতো কষ্ট হয় সেটা আমি বুঝিনা? এখন যাই, তুমি লুম্বিনী -তুতুনকে পড়াও, নইলে রেষ্ট নাও।”
তিতলী চাকরি করতে পারছে নিশ্চিন্তে, এটা বড় একটা শান্তি তিতিরের। তিতলী তুখোড়। কাজে খুব দক্ষ । অফিসে কাজ ছাড়া সে কিছু বুঝেনা। গল্প গুজব করে সময় নষ্ট করেনা একদম। এভাবে চলতে থাকলে তিতলী অনেক অনেক উপরে উঠে যাবে, এটাই আশা তিতিরের।
তিতলী বাসায় যেয়ে তার পারিবারিক শিক্ষা অনুযায়ী শ্বশুর -শাশুড়ির সাথে দেখা করে, তাঁদের খাওয়া দাওয়া, শরীরের অবস্থার খোঁজ খবর নেয়। শাশুড়ি অপ্রাসঙ্গিক কথা শুরু করলে ভদ্র ভাবে অনুরোধ করে মূল কথায় আসতে।
“সারাদিন বাইরে থাকো, আমার নাতি নাতনিকেও এখানে রাখোনা, এতো বড় দিন কেমন করে কাটে আমার? ”
“আব্বা আছেন, আপনার অন্য দুই ছেলেমেয়ে প্রায় প্রতিদিন আসে, আপনার ভাইবোনেরা আসেন, আপনি বিভিন্ন জায়গায় যান, একটা গাড়ি আপনার জন্য বরাদ্দ থাকে, তারপরও আপনার সময় কাটেনা? স্যরি, সে ক্ষেত্রে আমার কিছু করার নেই। ”
তিতলী বাচ্চাদের নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। ওদের পড়তে বসায়। নিজের ঘরে বসে রাতের খাবার খেয়ে সে আয়েশ করে নিজের বানানো কফিতে চুমুক দেয়। আহ্, শান্তি।
এটা হলো একদিনের রুটিন। পরের দিনের রুটিন হলো,অফিস শেষে আপার বাসা থেকে অরণ্য -অরণীকে তুলে নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে দৌড়। রাতে বাবা-মায়ের বাসায় খাওয়া দাওয়া করে, তাদের সুবিধা অসুবিধা দেখে বাড়ি ফেরা।
একদিন আদনান রেগে আগুন। ” কি শুরু করেছো? স্বেচ্ছাচারিতার সীমা আছে। আমার ফ্যামিলির সাথে নিজে কন্ট্যাক্ট রাখোনা, খুব ভালো কথা। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদেরকে তাদের দাদা-দাদি, চাচা ফুপুর কাছে বেশিক্ষণ থাকতে দাওনা কোন সাহসে? ”
“আমার ছেলেমেয়েরাই তাদের দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুপুর কাছে থাকতে ভালোবাসেনা।”
“সারাক্ষণ ওদের কানে মন্ত্র পড়া দিলে ভালোবাসবে কেন? ”
তিতলী তার দুই ছেলেমেয়েকে ডাকলো। বেডরুমের দরজা আটকে আদনানের সামনে বাচ্চাদের নিচু গলায় বললো, ” বাবাকে বলো, দাদি,ফুপি,চাচু,চাচি কি নিয়ে বেশি কথা বলেন যার জন্য তোমাদের ভালো লাগেনা? চিৎকার করে বলবেনা, আস্তে বলো।”
” দাদি বলেন, মা একটা ফাজিল মেয়ে, বেয়াদব। মা নাকি খানকি। খানকি কি বাবা? মা ‘কে জিজ্ঞেস করেছি, বলেনি। ”
আদনান হতভম্ব। তিতলী বললো, “মা তোমাদের বলেছে এটা পচা কথা। এটার মানে জানার দরকার নেই। এটা আর কখনো উচ্চারণ করবেনা। বলো, আর কি বলেন উনারা?”
” বলেন, নানাভাই-বুবু নাকি ছেলে মেয়ে মানুষ করতে পারেনি। মামা অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে, ঠিক হয়েছে, নানাভাই -বুবুর মুখে লাথি পড়েছে। তিতির মনির চেহারা দেখলে নাকি বমি লাগে। খালুর মতো অতো সুন্দর , বড় ডাক্তার তিতিরমনিকে বিয়ে করেছে কারণ বুবু নাকি যাদুটোনা করেছিলো।বুবু নাকি তোমাকেও যাদুটোনা করেছিলো। তিতির মনি অপয়া। ডাইনি। আরও বলেছে…. ”
আদনান বললো, “থাক, থাক, আর বলতে হবেনা। চুপ করো। ”
তিতলী আদনানকে উপেক্ষা করে বললো, ” বাবাকে আরও বলো, চাচি না থাকলে ফুপু আর দাদি চাচির সম্পর্কে কি বলে? ”
“ঢলানী মাগী।”
“আর আমাদের শুকরানী বুবুকে কি বলে ডাকে? ”
” মাগী, শয়তানের বাচ্চা, কুত্তি….”
অরণ্য সব বলে যাচ্ছে। অরণী সুযোগ পাচ্ছেনা। অরণ্য দম নিতেই সে বললো, ” ফুপির শাশুড়ি নাকি পিশাচ। আর বাবা,তুমি নাকি মায়ের ভেড়া। ”
আদনান মাথা দুই হাতে চেপে ধরে বললো, ” চুপ করো। প্লিজ, চুপ করো।”
তিতলী হিমশীতল গলায় বললো, “কেন চুপ করবো? এটুকু শুনে হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে? তোমাকে সব শুনতে হবে।”
আদনান চেনে তার মা’কে। নোংরা গালাগালি করতেন ভৃত্যদের, দাদার বাড়ির গরীব আত্মীয়দের। কিন্তু ছেলের ভালোবেসে বিয়ে করা বৌকে নিয়ে কোনো মা এতো নিকৃষ্ট কথা বলতে পারে?
তিতলী বাচ্চাদের বাইরে বের করে দিয়ে বলতে লাগলো, ” নিজের বিবেককে জিজ্ঞেস করো আদনান, কি পরিমাণ অবিচার, অত্যাচার আমার উপরে করছো তোমরা। তোমার মা-বোন কেমন, সব জেনেও আমাকে এই নরকে থাকতে বাধ্য করছো। আমি অনেকবার ভেবেছি , তোমাকে ডিভোর্স দিবো, এটাই তোমার পাওনা।যে মানুষ সব জেনে শুনেও নিজের ভয়ংকর চরিত্রের মা-ভাই-বোনকে বৌয়ের উপরে চাপিয়ে দেয়, তাকে আসলে মানুষ বলা যায়না। তুমি যে এতো অভদ্র পরিবারের ছেলে, এটা যদি বুয়েটে পড়া অবস্থায় এতোটুকু জানতাম৷! বাপ এতো বড় চাকরি করে, মা উচ্চ ডিগ্রি ধারী, ভাইবোনেরা সুপার ব্রিলিয়ান্ট, এসব গল্প করেছো কিন্তু তোমাদের মধ্যে এতো কুটিলতা,নোংরামি, তা বুঝতে দাওনি এতোটুকু। আমার জীবন তো বরবাদ করেছো।এখন কি বাচ্চাদের জীবনও ধ্বংস করতে চাও? বুঝতে পেরেছো যে বাচ্চাদেরকে তোমার মায়ের কাছে রাখলে ওরা উনার এবং তোমাদের মতো অমানুষদের হয়ে বেড়ে উঠবে?”
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৩৪
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তুতুন চোখ ডলতে ডলতে তিতিরের কাছে এলো। দুই গালে পানি।
“ওমা! কি হয়েছে আমার জানপাখিটার? আমার সোনা বাচ্চাটার? ”
“আমি জানপাখি না। আমি সোনাবাচ্চা না। আমি পচা বাচ্চা। পৃথিবীতে আমি একটা বার্ডেন। আমার বদলে একটা ডিম পৃথিবীতে আসলেও মানুষের উপকার হতো, ডিমটা খেয়ে একজন প্রোটিন আর ফ্যাট পেতো,ক্যালসিয়াম পেতো।কিন্তু আমি পৃথিবীর কোনো উপকার করিনি, করতেও পারবোনা। কি লাভ আমার বেঁচে থাকার? ”
তুতুন ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলো।
বাচ্চাটা পড়ালেখায় ফাঁকিবাজ, কিন্তু বাকি সব বিষয়ে দারুণ লক্ষী। আজকের কান্নাটা জেনুইন। কেউ কিছু বলেছে নিশ্চয়? কে বলেছে? কি বলেছে ছোট্ট মানুষটাকে?
“কি হয়েছে বাবাই? আমাকে বলো। তুমি কতো লক্ষী, আমার কলিজা। কে বললো পৃথিবীতে তোমার দাম নেই? পৃথিবীতে তোমার দাম অনেক, অ-নে-ক।”
তুতুন চোখ মুছে ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “কতো টাকা? ”
“এতো বেশি দাম যে পৃথিবীর সব টাকা, সব সোনা,হীরা, জহরত একসাথে করলেও তুমি তার থেকে অনেক, অনেক দামী।”
“তাহলে কেউ আমাকে কিনতে চাইলে কি করবে? ”
লুম্বিনী খিকখিক করে হেসে বললো, ” কাউকে যদি বলা হয়, ভাই, এই নেন দু’কোটি টাকা, আর এই যে আমার সব গয়না গাটি নিয়ে যান, শর্ত একটাই, এই বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে হবে, ওর খরচ আমি মাসে মাসে পাঠিয়ে দিবো, তখন সেই লোক জান নিয়ে পালাবে। বলবে, আপনাকে বরং দুই কোটি টাকা দিই, তবু তুতুনকে আমার সাথে রাখার কথা বলবেননা।”
তুতুন গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো। তিতিরের খুব খারাপ লাগলো। তুতুনের কান্নার মধ্যে হাহাকার,বেদনা,লজ্জা,অপমান মিলেমিশে আছে। কারোর কথায় ভীষণ আঘাত পেয়েছে বাচ্চাটা। লুম্বিনী বুদ্ধিমতী এবং বিবেচক মেয়ে। কি দরকার ছিলো তার ফোঁড়ন কাটার? চার বাচ্চার মধ্যে যত্ন,মনোযোগ সবচেয়ে কম পায় তুতুন।
তিতির লুম্বিনীর দিকে তাকিয়ে বললো, ” তুমি খুব লক্ষী,বুঝদার একটা মেয়ে।তোমার কাছ থেকে এই সময়টায় এমন মন্তব্য আশা করিনি। আমি ভাবতাম, তোমরা ভাইবোনেরা একে অন্যের সেন্টিমেন্টের জায়গা বুঝো।”
লুম্বিনী লজ্জিত গলায় বললো, “স্যরি, মা। ”
তিতির তুতুনকে কোলে জড়িয়ে বসে রইলো, অনেক আদরের কথা বললো, তুতুনের শিশুকালের অনেক গল্প করলো ওকে হাসানোর জন্য, তুতুন যে কতো ভালো, কতো যে তার গুণ, সেগুলো বলতে লাগলো আন্তরিক ভাবে।
লুম্বিনী জিজ্ঞেস করলো, ” দুঃখ শেষ হয়েছে? কি খাবি দুঃখী রাজপুত্র , বল্! চিজ চিকেন স্যান্ডউইচ নাকি পিৎজা? কোনটা বানাবো বল্। ”
তুতুন গম্ভীর মুখে বললো, ” আজ থেকে তোমার তৈরি কোনো খাবার আরহাম খাবেনা।”
লুম্বিনী তুতুনের গাল টিপে বললো, “আমার সোনা ভাইয়া, সো স্যরি। আপুরা ভাইদের সাথে ফান করে। ফানটা বুঝতে হয়। তোর জন্য আজ বরং চিজ স্যান্ডউইচ, নুডলস উইথ চিকেন -প্রণ -ভেজিটেবলস করি। সবার শেষে হট চকোলেট ড্রিংক। চলবে ভাইয়া মনি, সোনামনি, চাঁদের খনি? ”
তুতুনের মুখ আলো হয়ে গেলো।
লুম্বিনী ভাইকে বললো, “চল্ আমার সাথে। আমাকে হেল্প করবি।”
তিতির বুবুনের ঘরে ঢুকলো। দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বুবুন।
” বুবুন, কি হয়েছে? এই অবেলায় শুয়ে আছিস কেন? ”
বুবুন উত্তর দিলোনা, তবে তার চোয়াল শক্ত হলো।
” কতোদিন হয়ে গেলো মনমরা। খাওয়া দাওয়া নেই ঠিকমতো, উষ্কখুষ্ক। কি হয়েছে, কিছু বলবিতো? কোনো সমস্যায় পড়লে শেয়ার কর। তুতুনকে কি তুই কিছু বলেছিস? ”
” ঘর থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি।”
“কেন? ”
“কানের কাছে কটর কটর করে যাচ্ছিলো। বাচাল একটা। ”
তিতির কঠিন গলায় বললো,” বুবুন, শোয়া থেকে উঠে বসো। এখন শোয়ার সময় না। আমি জানতে চাই, কি হয়েছে তোমার? সমস্যা লুকিয়ে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এমন জোম্বির মতো থাকার কি মরতবা? সমস্যা লুকিয়ে রাখার জিনিস না।”
“তুমি সমস্যা লুকিয়ে রাখোনা?”
“আমি সমস্যা নিয়ে বসে থাকিনা বুবুন, সমাধানের চেষ্টা করি।”
” ডাক্তার নাজলীকে চেনো মা? ”
তিতির ভয়ংকর চমকে উঠলো।
“কি ব্যাপার মা? কারেন্টের শক খেলে নাকি? ”
ঘটনার আকষ্মিকতায় তিতির কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা।
“ডাঃ নাজলী, তোমার সতীন, তোমার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী। ”
“বুবুন, যতোই রাগ হোক, কষ্ট হোক, ভাষা আর বডি ল্যাংগুয়েজ সংযত করো।”
” আমার পক্ষে এতো ভদ্রতা , এতো সংযম সম্ভব না। তুমি মহিয়ষী, তোমার পক্ষে যা সম্ভব, সাধারণের পক্ষে কি তা সম্ভব ? আমি খুন করবো ঐ মহিলাকে। শুট করবো। পিস্তল যোগাড় করতে না পারলে ছুরি নইলে লোহার রড….”
“বুবুন ! শান্ত হও, বাবা। এটা তোমার বাবার একটা বড় অন্যায়। কিন্তু অন্যায় মানুষই করে।গরু-ছাগল করেনা।তোমার বাবা খুব বড় একটা অন্যায় করেছে, ক্ষমা চেয়েছে বারবার। মেয়েটার ব্যাপারেও আমি যা স্টেপ নেওয়ার নিয়েছি। এটা এখন পাস্ট।এটা নিয়ে আর ভাববেনা।”
“তুমি নিজেকে খুব ইনটেলিজেন্ট ভাবো। প্রেমিক যুগলকে তুমি শাসন করেছো আর ওরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভালো মানুষ হয়ে গেছে, তাইনা? এই নাজলী আর তোমার হাসব্যান্ডের ঘটনা আমি অনেক আগে থেকেই জানি। তুমি যখন জানো, বলতে গেলে তখন থেকেই। তুমি শাসন ব্যসন করে নিশ্চিন্ত কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত থাকিনি। তত্ত্ব তালাশ নিয়েছি। তাদের মধ্যে এখনও মাখামাখি। কয়েকদিন আগে মেয়েটাকে আমি শাসালাম রাস্তায়। গত সপ্তাহে দ্যাট বিচ আমার সাথে দেখা করতে চাইলো। তোমার হাসব্যান্ডের সাথে তার খুব ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি দেখালো। জানালো, তারা বিয়ে করেছে এবং সে দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। আমি ঘেন্না করি ওদেরকে,আমি তোমাকেও ঘেন্না করি, তুমি সুবিধাবাদী। এই বাড়ি, গাড়ি,ব্যাংক ব্যালান্স, আভিজাত্য, সো কলড মর্যাদা থেকে তুমি বের হতে চাওনা। একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মহিলা সম্পূর্ণ খালি হাতে বাচ্চাদের হাত ধরে চরিত্রহীন স্বামী -সংসারের মুখে লাথি মেরে চলে আসে, দিনরাত খেটে বাচ্চাদের মানুষ করে। কিন্তু তুমি তোমার কমফোর্ট জোন হারাতে চাওনা। ”
“বুবুন সোনা, তুমি এক তরফা কথা শুনেছো ডাঃ নাজলীর কাছ থেকে। তোমার বাবা কিংবা আমার কাছ থেকে শুনোনি কিছু। এটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হলো? তুমি প্রথম থেকেই এসব কথা আমার সাথে শেয়ার করতে পারতে। তুমি কেন মেয়েটাকে শাসাতে গেছো? তোমার কাছ থেকে উল্টোপাল্টা কথা শুনে সে রিভেঞ্জ নিয়েছে। হাবিজাবি বলে, পুরানো ছবি দেখিয়ে তোর মনের শান্তি নষ্ট করেছে। তাদের বাজে সম্পর্ক ছিলো সত্য, এখন নেই। ”
বুবুন তড়াক করে লাফিয়ে উঠে লাথি দিয়ে চেয়ার ফেলে দিলো। টেবিলে রাখা চায়ের কাপ পিরিচ আছড়ে ভাঙলো। সেই সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার, জান্তব চিৎকার। তার চোখ জবা ফুলের মতো লাল, ঠোঁটের কোণায় ফেনা।
বাড়ির যে যেখানে ছিলো, হুড়মুড় করে ছুটে এসেছে। তিতির বুবুনকে জড়িয়ে ধরলো এবং মুহূর্তেই ছেলের ধাক্কায় দেওয়ালে সজোরে ছিটকে পড়লো। তিতির চোখে অন্ধকার দেখলো। তার জ্ঞান ফিরলো ঘন্টা চারেক পরে। ঝাপসা চোখে সে অনেকগুলো মুখ আবছা ভাবে দেখতে পেলো। অলরেডি তার ব্রেইনের সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। তিতির একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো, ” আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া,ইন্ট্রা ক্রেনিয়াল হেমোরেজ হয়নি।” তিতিরের আস্তে আস্তে সব মনে পড়লো। বুবুন? বুবুন কোথায়? কেমন আছে? জ্ঞান হারিয়ে পড়ে নেইতো? কিংবা নিজের বড় কোন ক্ষতি?
“বুবুন, আমার বুবুন কোথায়? বুবুন কোথায়? ”
আসিফ তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো, ” বুবুন বাসায় আছে। ওর কোনো কারণে নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছে। ওর কাছে তিতলী,আদনান সবাই আছে।বাবা-মায়েরও পৌঁছে যাওয়ার কথা এতোক্ষণে। ”
“লুম্বিনী, তুতুন? ”
“ওরাও বাসায় আছে। তুমি টেনশন করোনা। ”
আসিফ ঘটনার কতোটুকু জানে?
তিতির ক্ষীণ গলায় বললো, “কি হয়েছে আমার? আমি কোথায়? ”
” তুমি নিজের দিকে এতোটুকু লক্ষ্য রাখোনা তিতির।খাওনা ঠিকমতো, এদিকে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি, পরিশ্রম। তুমি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলে।”
” তুমি জানলে কিভাবে? ”
“ময়না খালা বললেন। উনার ফোন পেয়ে সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওনা হই। উনি তিতলীকেও ফোন দিয়েছিলেন। আমি আর তিতলী প্রায় একই সাথে পৌঁছেছি। আদনানও আমাদের পরপরই পৌঁছে গেছে। যেয়ে দেখলাম তোমার ভয়ংকর অবস্থা, তাও ওরা মাথায় ঠান্ডা পানি ঢেলেছে, বরফ চেপে চেপে ধরেছে।”
“বুবুন? আমার বুবুন, তুতুন, লুম্বিনী? ”
“তুতুন, লুম্বিনী তোমার পাশে বসে কাঁদছিলো। আমেনা সামলাচ্ছিলো, ময়না খালা বুবুনের ঘরে ছিলেন।আমাকে বললেন তোমাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে, তিতলীকে বললেন বুবুনকে সামলাতে।”
“তুমি দেখোনি বুবুনকে? ”
“এক ঝলক। শুয়েছিলো।”
হায় আল্লাহ! বুবুন পাগল হয়ে গেছে। ময়না খালা ঘটনা বুঝে গেছে এটা তার কাজকর্মে পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে। বুবুনকে নিয়ে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আবার এই ভয় মাথায় কাজ করছে, ছেলে তার নানা-নানি, খালা-খালু,ভাইবোন, আমেনা সবার সামনে আসিফ-নাজলীর কেলেঙ্কারির কাহিনী বর্ণনা করেছে কিনা।সবাই প্রচণ্ড আঘাত পাবে। বাবা-মা’কে এমন দুঃখ দিতে চায়না তিতির। আদনান দুঃখ পাবে আবার তিতলীকেকথায় কথায় অপদস্হ করার সুযোগও পাবে। আর আসিফ যখন জানবে, তার কাহিনী ছেলেমেয়েসহ সবাই জানে, লজ্জায় নিজেকে শেষ করে ফেলতে পারে।
আর চিন্তা করতে পারছেনা তিতির।মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। মানুষ সেধে পড়ে এতো যন্ত্রণা আমদানি করে কেন?
চলবে।