#সংসার
পর্ব ৩৫
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তিতিরের মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে তীব্র যন্ত্রণায়। সেই যন্ত্রণাকে ছাপিয়ে গেছে ভয়ংকর দুশ্চিন্তা। বুবুন সুস্থ আছে তো? কোন ভয়ংকর দুর্ঘটনা না ঘটায়।বাড়ির আর সবাই আসিফের অপকীর্তি জেনে গেছে? কি হবে তাহলে? লজ্জায় আসিফ যদি নিজেকে শেষ করে দেয়?
তিতির আসিফের মোবাইল থেকে সন্তর্পণে ময়না খালাকে ফোন করলো। ময়না খালা ফোন নিয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে যা বললো, তার সারমর্ম হলো, তিতির আর বুবুনের কথোপকথন ময়না খালা শুনে ফেলেছিলো। এছাড়া সে আগে থেকেই ঘটনা আঁচ করেছে, আসিফকে কয়েকবার সে ফোনে কথা বলতে শুনেছে যা সন্দেহজনক ছিলো। বুবুন মা’কে ধাক্কা মারার পরপরই ময়না খালা আসিফ আর তিতলীকে ফোন করে জরুরি ভাবে আসতে বলে। লুম্বিনী আর তুতুনকে অন্য ঘরে নিয়ে এসে তাদেরকে বুঝায়, বুবুনের মাথার অসুখটা বেড়েছে,তাই মা’কে ধাক্কা দিয়েছে। ওরা যেন কাউকে কোনদিন না বলে যে বুবুন মা’কে আঘাত করেছিলো। তাহলে বুবুনের অসুখ বেড়ে যাবে। যে কেউ প্রশ্ন করলে ওরা যেন বলে, মা মুখ থুবড়ে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। আমেনার হাওলাতে ওদেরকে রেখে ময়না খালা বুবুনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়।তাকে বলে, “লক্ষী বুবুন আব্বা, তোমার বাবার ঘটনা, মা’রে তুমি ধাক্কা দিছো, এমন ঘটনা কাকপক্ষীরেও এখন কইবানা বাপধন। তোমার নানা-বুবু,খালারেও কইবানা।” তিতলী আসলে তাকে বুবুনের ঘরে ঢুকিয়ে দেয় ময়না খালা। তিতলী বুবুনের ডাক্তারকে ফোন করে।তিনি ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন বুবুনকে।ময়না খালা নাজমুল -নিশাত-তিতলী সবাইকে বলেছে, হঠাৎ করে বুবুনের মাথার ব্যামো খুব বেড়ে গেছে। সে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারে। তাকে চোখে চোখে রাখা আর ভালো ডাক্তার দেখানো একান্ত দরকার। আসিফের কুকীর্তির কথা কেউ জানেনা।
তিতির বাড়ি ফেরার জন্য অস্হির হয়ে গেলো। ডাক্তাররা বললেন, “ম্যাম, আপনার চার পাঁচ ঘন্টা জ্ঞান ছিলোনা। এটা শুধু মাথায় আঘাত পাওয়ার জন্য না, আপনি ডাক্তার হয়ে ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছেন। আপনার হিমোগ্লোবিন মাত্র সাত। আপনার কাছ থেকে এটা আশা করা যায়না। আপনি দুইটা দিন হাসপাতালে থাকেন, আপনার টোটাল প্রোটিন, অ্যালবুমিন, অন্যান্য টেস্ট করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিই, তারপরে বাড়ি যান। বাচ্চাদের জন্য বাড়ি যেতে চাচ্ছেন, সেই বাচ্চাদের ভালো রাখতে হলেতো আপনাকে আগে ভালো থাকতে হবে ম্যাডাম।”
তিতির কারো কথা শুনলোনা। দুশ্চিন্তায় সে অস্হির। আসিফের অসন্তুষ্টি উপেক্ষা করে সে বাড়ি ফিরে আসলো।
চোখ দুটো অতি ভয়ংকর। কোটরে ঢোকা, পাতাগুলো কালো হয়ে যাওয়া, কপাল জুড়ে কালচে বেগুনি কালসিটে। তিতিরকে দেখে নিশাত, নাজমুল সাহেব, লুম্বিনী , তুতুন, হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তিতির সরাসরি গেলো বুবুনের ঘরে।ছেলেটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিতলী আছে পাহারায়। বোনপোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অরণ্য -অরণী তুতুনের পাশে বসে কাঁদছিলো। তিতির মনি তাদের স্কুল থেকে নিয়ে এলো, নিজের হাতে খাইয়ে দিলো,তারপরে খেলাধূলা না করে দুই ভাইবোন গেলো ঘুমাতে। গতরাতে ওদের নিজেদের বাসায় বাবা-মায়ের বুয়েটের বন্ধুদের গেট টুগেদার ছিলো। প্রাণের বন্ধুরা একসাথে হয়ে আড্ডায়, গল্পে, গানে, খাওয়া দাওয়ায় রাত পার করে দিয়েছিলো। অরণ্য -অরণী সুযোগটার ইঞ্চি ইঞ্চি সদ্ব্যবহার করেছে। দুইজনে বাপ মায়ের শোয়ার ঘরে এসি দিয়ে লাইট অফ করে কমফোর্টারের তলায় ট্যাব নিয়ে প্রাণপণে খেলেছে। এমন সুযোগ দশ বছরেও একবার আসবে কিনা সন্দেহ। ভোর পাঁচটায় বাপ -মা ঘরে ঢোকার পরে তারা ভালো মানুষের মতো ঘুমের অভিনয় করে পড়ে ছিলো ঠিকই কিন্তু ঘুম আর আসছিলোনা। তারপরেতো বিছানা থেকে উঠে পড়া, স্কুল যাওয়া। স্কুলে ঘুমে পড়ে যাচ্ছিলো দুই ভাই বোন। তিতিরমনির বাসায় এসেও। ওদের ঘুমে লাল হয়ে যাওয়া চোখ দেখে তিতিরমনি এক প্লেটে ভাত মাখিয়ে দুই ভাইবোনকে খাইয়ে দিলো। তারপরে লুম্বিনী আপুর ঘরে দুই ভাইবোন ঘুমিয়ে পড়লো। এমন ঘুম যে এতো কিছু হয়ে গেছে বেচারারা কিছু টের পায়নি। বাবা এসে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়েছে। এখন খালার অবস্থা দেখে দুই ভাইবোন কেঁদে আকুল।
তিতিরের চেহারা কখনোই সুশ্রী নয়। কিন্তু আজ তাকে ভীষণ কুৎসিত লাগছে। ভয়াবহ মুখখানা দেখে আমেনাসহ সবার বুক মুচড়ে যাচ্ছে। আদনানের কষ্ট তেমন না হলেও সে হতভম্ব হয়ে গেছে।একজন শুধু ঘৃণায় ঐ মুখের দিকে তাকাতে পারছেনা। আসিফ।
“শোনো।”
আসিফ নিরুত্তর। অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
” শোনো। তুমি ঘুমাচ্ছ না। জেগে আছো।এদিকে ফিরো।মুখোমুখি হতে হবে যে।”
আসিফ পাশ ফিরলো, ” কি হয়েছে? ”
“নাজলীর সাথে সম্পর্ক আর আছে? ”
“রাত দুপুরে ফালতু জিনিস নিয়ে কথাবার্তা ! ঘুমাতে দাও।”
“যা বলবো, তাতে তোমার ঘুম উড়ে যাবে। তার আগে বলো, তোমার আর নাজলীর সম্পর্কের বর্তমান স্ট্যাটাস কি? সত্য বলো, বোল্ডলি বলো।”
“কোনো সম্পর্ক নেই। ”
“তাহলে নাজলী কয়েকদিন আগে কেন বুবুনকে তোমাদের আপত্তিকর ছবি দেখালো, বললো তোমরা বিয়ে করেছো এবং নাজলী প্রেগন্যান্ট। কেন?”
“তোমার বড় ছেলে বেশি পেকে গেছে। সে নাজলীকে হুমকি দিয়েছিলো কেন? ”
” বাহ্! নাজলীকে আমার ছেলে ধমকি ধামকি করেছে, সেটা তুমি জানলে কেমন করে? নাজলীর কাছ থেকে? ”
” হ্যাঁ। নাজলী আমাকে ফোন করে বললো, স্যার, আপনার ছেলে আমাকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে, আমি বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছি। ”
” তখন তুমি কি স্টেপ নিলে? বুবুনকে ডেকে সব বললে ও বুঝালে? ”
“ছেলের সাথে আমি এসব নিয়ে কথা বলবো কেন? ”
“নাজলী তোমার ছেলেকে সব জানিয়ে দিয়েছে এবং এরজন্য বুবুনের এই নার্ভাস ব্রেকডাউন, এটা কি জানো? ”
আসিফ হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, ” এতো কৈফিয়ত আমি মা,ছেলেকে দিবোনা। দিতে বাধ্য নই। আমারটা খেয়ে, আমারটা পরে আমার সাথেই চোটপাট করা? না পোষায় তো চলে যাও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে।”
“আমার জানা দরকার, তুমি নাজলীকে বিয়ে করেছো কিনা এবং সে প্রেগন্যান্ট কিনা।”
“হ্যাঁ করেছি। সে প্রেগন্যান্ট এবং এই প্রেগ্ন্যাসি সে টার্মিনেট করবে।”
“কেন? তোমার চাপে? ”
“আমাদের দু’জনেরই এই ইচ্ছা। ”
“বাচ্চা না নিয়ে দু’জনেই বিভিন্ন ফুলে মধু খেয়ে বেড়াবে? ”
“জাস্ট স্টপ।”
” তুমি আর তোমার স্ত্রী আমার কাছে ক্ষমা চেয়েও সম্পর্ক চালিয়ে গেছো, বিয়ে করেছো।তুমি এককালে মিথ্যাবাদী ছিলে,তোমার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো। মাঝখানে ঠিক হয়ে গিয়েছিলে। আমি ভাবিনি, তোমার মধ্যে মিথ্যাচারিতা আবার ফিরে আসবে, এতোটা মারাত্মক ভাবে। তোমার অনেক দোষ থাকা স্বত্বেও তোমাকে কখনো চরিত্রহীন ভাবতে পারিনি। তোমার ভালো গুণগুলোর জন্য , একসময় আমার সাথে,আমার পরিবারের সাথে অনেক কেয়ারিং থাকার জন্য , আমার চার বাচ্চার বাবা হওয়ার জন্য, দীর্ঘকাল পাশাপাশি থাকার জন্য তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। ব্যক্তি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু তোমার ব্যক্তিত্ব আমার ভালোবাসার যোগ্য হতে পারলোনা কোনদিন। বাচ্চাদের মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তোমার ব্যাভিচারকেও ক্ষমা করে দিয়েছি এবং গোপন রেখেছি তোমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য , তোমার ভালোমানুষি ইমেজ নষ্ট না করার জন্য। এখন দেখলাম, তোমার কোন লজ্জাই নেই। ”
“শোন, নিজের চেহারা দেখো আয়নায়? তোমার মতো মেয়েকে বিয়ে করায় আমার ফ্যামিলির সবার কাছে কম নাজেহাল হয়েছি আমি? তোমার সৌভাগ্য, আমি তোমার সাথে ঘর সংসার করছি। কি করেছো তুমি আমার জন্য ? তুমি যা আমাকে দিতে পারোনি কখনো, নাজলী আমাকে তা দিয়েছে। আজকে তোমার মুখের দিকে যারা যারা তাকিয়েছে , তারা সবাই বমি চাপার চেষ্টা করেছে। ”
” এতো লুকোচুরির কি ছিলো? নাজলীকে বিয়ে করতে চাইলে আমাকে বলতে, আমাকে ডিভোর্স দিতে, নাজলীকে শরীয়তমতে বিয়ে করতে।ব্যাভিচারের মতো নোংরা জিনিসে পা ডুবালে কেন? ”
“এখন তো ব্যাভিচার না।এখন বৈধ সম্পর্ক। ”
“বৈধ সম্পর্ক প্রকাশ্যে আনো। খামোকা বেচারিকে সামাজিক ভাবে সামনে আনছোনা কেন? ”
” That’s none of your business. আমি কি করবো, আমার ব্যাপার।”
“তাহলে বাচ্চাটা রেখে দাওনা। আমি মানুষ করবো ওকে। প্লীজ। ”
“ন্যাকামি করবেনা and let me sleep. ”
“তোমরা আসলে বিয়েই করোনি, অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছো। ছিঃ! ”
আসিফ চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ” আলবৎ বিয়ে করেছি। মগবাজার কাজী অফিসে, মার্চের দুই তারিখে। বিশ্বাস হয়না, এই দেখো কাবিননামা। এখন চুপচাপ থাকো, যে ভাবে চলছিলে, সেভাবে চলো। এর অনথ্যা হলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও। ”
আসিফ দ্বিতীয় বিয়ে সত্যি করেছে কিনা, করলে কোথায়, কবে, এটাই জানার দরকার ছিলো তিতিরের। আর মায়ার বাঁধন নয়, অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেওয়া নয়, ভিত্তিহীন ভয় নয়, যা করা উচিৎ, সেটাই করবে তিতির। বাচ্চারা আঘাত পেলে পাক, একসময় সয়ে যাবে সেটা, কিন্তু তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আর কম্প্রোমাইজ নয়।
কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য আসিফ দুইটা বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, একটা বহুমূল্য গাড়ি, বারিধারায় প্লট তিতিরের নামে কিনেছিল তিতিরের বহু বাধা স্বত্বেও। তিতিরের আয়ের উৎস হিসাবে দেখিয়েছিলো তার প্র্যাকটিস, বিয়ের সময় বাবার বাড়ি , শ্বশুরবাড়ি আর অতিথিদের মিলে দেওয়া ২০০ ভরি গয়না, নগদ দশ লক্ষ টাকা,একসময় চাকরি করতো তিতির, তার বেতন। আসিফ অফিসে যাওয়ার পরে তিতির আলমারী থেকে বাড়ি, জমির দলিল, তার আর বাচ্চাদের নামে যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে সবগুলোর কাগজপত্র, জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের কাগজ সব সরিয়ে ফাইলবন্দী নিজের একটা আলমারিতে লুকিয়ে রাখলো। তারপরে গেলো মগবাজার কাজী অফিসে। সবাই বাধা দিচ্ছিলো বাইরে যেতে, তিতির কারো কথা শুনলোনা।
এর দুইদিন পরে বাসায় পুলিশ আসলো আসিফকে অ্যারেস্ট করতে। প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য। ওদিক দিয়ে গ্রেফতার হলো নাজলি, তার বাবা-মা। হতভম্ব আসিফ কল্পনাও করতে পারেনি, নরম সরম, অতিরিক্ত মায়াবতী তিতির এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং স্বাক্ষ্য -প্রমাণ এক হাতে যোগাড় করতে পারে।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৩৬
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
বাসাটা অনেকক্ষণ নীরব রইলো। ঘটনার আকষ্মিকতায় সবাই স্তব্ধ। অনেকক্ষণ পরে ভাঙা গলায় নাজমুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “তিতির মা! আসিফ আবার বিয়ে করেছে? তাই তুই মামলা করেছিলি? তোর ভুল হচ্ছেনা তো কোথাও? ”
” না বাবা। এটা আজকের ঘটনা নয়।অনেকদিন ধরেই ওদের মধ্যে সব রকম সম্পর্ক। আগেও হাতেনাতে ধরেছিলাম, মাফ চেয়েছিলো দু’জনে, আর কখনো দেখা করবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলো, ওয়াদা রাখেনি।”
” মামলা না করলেও পারতিস, মা। আসিফ তার জীবন নিয়ে থাকতো, তুই তোর মতো বাচ্চাগুলো আঁকড়ে ধরে রাখতিস। এখন তার জেল জরিমানা হবে, চাকরি চলে যাবে, ছেলেমেয়েগুলো কতো লজ্জার মধ্যে পড়বে, মামলা করা উচিৎ হয়নি। ”
“অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হয়, বাবা। প্রথম বার ছেড়ে দিয়েছিলাম।এবারে পারলামনা। সে নিজেই আমাকে বলতে পারতো, সে আমাকে চায়না।ডিভোর্স দিতো। তারপরে দ্বিতীয় বিয়ে করতো।তাহলে আমি সব মেনে নিতাম। কিন্তু এতো লুকোচুরি, লোক ঠকানো কেন? নিজের ইমেজ ঠিক রেখে এখানে বৌ-বাচ্চার সাথে থাকা, অন্যদিকে গোপনে আরেকটা সংসার চালানো? যে মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন , সামাজিক অনুশাসন উপেক্ষা করে, নিজের সব ন্যায় নীতি বিসর্জন দেয়, তার গরাদের পিছনে থাকাই ভালো। ছেলেমেয়েদের ভালো থাকার কথা বলছো? বুবুনের কাছে ঐ মেয়ে এসে রাজ্যের নোংরা কথা বলেছে, আজেবাজে ফটো দেখিয়েছে। আমি যদি স্টেপ না নিতাম, তাহলে আসিফ আর মেয়েটা মিলে ছেলেমেয়েদের জীবন নরক করে তুলতো,বিশেষ করে মেয়েটা। আসিফের টাকা পয়সা সব আত্মসাৎ করে ওকে ছিবড়ে বানিয়ে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতো।মেয়েটার কঠিন শাস্তি দরকার।মেয়েটাকে শাস্তি দিতে গেলে তার পার্টনারকেও শাস্তি পেতে হবে, বাবা। জোর করে আসিফকে আমি সংসারে বেঁধে রাখতে চাইনি। আমাকে তার ভালো না লাগলে আইন মেনে সে নতুন জীবন শুরু করতে পারতো।”
নিশাত অনবরত কাঁদছিলেন। কোনোমতে বললেন, “আসিফ ক্যারেক্টারলেস, আমি মানতেই পারছিনা। ওর টুকটাক খারাপ দিক ছিলো,সে কার না থাকে, কিন্তু তার ভিতরে এতো মিথ্যাচারিতা, ভণ্ডামী, নোংরামি, আমি কিছুতেই ভাবতে পারছিনা।”
বুবুন, লুম্বিনী, তুতুনের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। লজ্জা,বিস্ময়, ভয়, বাবার প্রতি একই সাথে ভালোবাসা ও ঘৃণা সব মিলেমিশে তিন ভাইবোন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তিতির তাদের বললো, ” বাচ্চারা, শোনো, তোমাদের বাবা খুব ভালো।ভালো মানুষরাও অনেক বড় ভুল করে ফেলে মাঝেমধ্যে। তোমাদের বাবা সেই অন্যায় করে ফেলেছেন। তাই তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাঁকে অনেকদিন জেল খাটতে হবে। জেল না খাটলে ভবিষ্যতে তাঁকে আরও অনেক অন্যায় করতে হতো, অনেক ষড়যন্ত্রের ও বিপদের মধ্যে পড়তে হতো। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে , আমারও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু যখন ভাবছি, তোমার বাবা অনেক বড় বিপদ হতে, পাপ হতে রক্ষা পেয়েছেন , তখন কষ্ট একটু কম হচ্ছে। বাবা যতোদিন শাস্তি ভোগ করবে, আমি তোমাদের বাবা-মা দু’জনের দায়িত্ব পালন করবো। আমি যতোদিন বেঁচে আছি ততোদিনই করবো। তোমরা বা আমি লজ্জা পাবোনা কারণ আমরা কোন দোষ করিনি।মানুষ কিন্তু আমাদের দোষ দিবে, নানা কথা বলে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু সেসব কথা আমরা গায়েও লাগাবোনা কারণ আমরা অপরাধী না। আমরা মাথা উঁচু করে চলবো।আমরা সবসময় সত্য, সৎ, ন্যায়ের পথে চলবো। কথা দিচ্ছো বাচ্চারা? বাবা নিশ্চয় তাঁর ভুল একদিন বুঝতে পারবেন। তোমরা মন দিয়ে পড়ালেখা করো, ভালো কাজ করো, মিলেমিশে থাকো, হাসিখুশি থাকো, আরও সাহসী হও। সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেক পরিবারে এর থেকেও ভয়ংকর ঘটনা ঘটে, অনেক ভয়ংকর। শুধু মাত্র আমাদের বিপদ হয়েছে, তা নয়। বিপদকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করতে হবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে। ”
তিন ছেলেমেয়ে উদাস মুখে বসে রইলো। কয়েকদিন তাদের খাওয়াতে হলো জোরজার করে। লুম্বিনীকে কিছুদিন কোনভাবেই স্কুলে পাঠানো গেলোনা।
মাথার উপরে এখন পাহাড় সমান কাজ আর দায়িত্ব। আসিফের ভাইবোনেরা দলবেঁধে এসেছিলো কয়েকদফা। তিতিরকে নোংরা গালাগালি, ” সম্পদ দখল করার জন্য আমার ভাইকে ফাঁসানো। আমার ভাই যদি খারাপই হয়, তুই তার বাড়িতে বসে আছিস কেন? তাও গুষ্টি সহ? নিজের থেকে বের হয়ে যা নইলে লাথি দিয়ে বের করবো। ”
” খারাপ কথা বলবেনা। বাড়িটা আমার। আমার ফ্ল্যাট ছেড়ে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।আমার সম্পত্তি আমার থাকবে,তোমাদের ভাইয়ের সম্পত্তি তার নামেই থাকবে। কাজেই আমাদের সমস্যার সুযোগ নিয়ে তোমরা কোনো লাভ করতে পারবেনা।”
“ডাইনি, বিচ। আয়নায় চেহারা দেখিসনা? আমার ভাইকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করেছিস। কয়দিন তোর ঐ শুওরের মতো চেহারা সহ্য করবে মানুষ? ”
বুবুন দাঁড়িয়ে ছিলো একই ঘরে, প্রতিবাদহীন অবস্থায়। তিতির ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। ছেলেও কি তাহলে তার বিরুদ্ধে ?
” দুইদিন সময় দিলাম। দুইদিনের মধ্যে তল্পিতল্পা সহ বের হয়ে যাবি। নইলে তোর লাশ ফেলতে আর গুম করতে আমাদের সময় লাগবেনা। তোর বাচ্চা তিনটাকেও পুঁতে ফেলবো।”
“ওরা তোমাদের রক্ত।যে ভাই আল্লাহর রহমতে তোমাদের প্রত্যেককে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, সেই ভাইয়ের বাচ্চাদের পুঁতে ফেলবে, কেমন করে এ কথা বললে তোমরা? ”
” চুপ বেটি। তোর তিন বাচ্চাও শয়তান। সাপের বাচ্চা সাপ।দুইদিন সময় দিলাম।”
হুমকিধারীরা হলো আসিফের ছোট ভাই, মেজ ভাই, ছোট বোন, সেজ বোন।
এর আগেও এসেছিলো তারা, চিল্লাচিল্লি করেছিলো। তবে আসিফের অ্যারেস্ট হওয়ার চারদিনের মাথায় এই কথাগুলো বলে গেলো।
ওরা চলে যাওয়ার পরে বুবুন এসে তিতিরকে জড়িয়ে ধরলো। বললো,”মা,এখন থানায় যাবে নাকি কাল সকালে? ”
পুরো ঘটনার ভিডিও করেছে বুবুন, তার মোবাইলে। মোবাইলটা খুব কায়দা করে রেখেছিলো একটা কর্ণারে।
রাতেই মা-ছেলে গেলো থানায়। গেলো আইনজীবীর কাছে। নিশাতের আপন চাচাতো ভাই পুলিশের আইজি।এই তথ্য জানা ছিলোনা
আসিফের ভাইবোনদের। তিতির তাঁর বাসাতেও গেলো। পরদিন সকালে গ্রেফতার হলো আসিফের ভাইবোনেরা। খুনের হুমকি দেওয়া, বাসায় ঢুকে সব তছনছ করার অভিযোগে। ভিডিও ক্লিপ দেখানো হলো আসিফকেও।
গ্রেফতার হওয়ার পরপর অনেক হম্বিতম্বি করেছিলো আসিফ, প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে। বলেছিলো,তিতিরের জঘন্য মানসিকতা, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, অহেতুক বিশ্রি ঝগড়াঝাটির জন্য সংসারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো আসিফ। এই সময়ে নাজলীর সাথে কাজের ক্ষেত্রে আসিফের পরিচয় হয়। নাজলীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের চেয়েও অন্তরের সৌন্দর্য অনেক বেশি। আসিফ নাজলীর মধ্যে শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো। তিতিরকে অনেক আগেই সে নাজলীর কথা বলেছিলো।আসিফ তিতিরের কাছ থেকে বারবার ডিভোর্স চেয়েছিলো। এতে তিতির আরো হিংস্র হয়ে যায়। অশান্তির চোটে বাসায় থাকাটা দায় হয়ে যাচ্ছিলো। তিতির আসিফের মৃত বাপ-মা’কে উদ্দেশ্য করে সবসময় গালিগালাজ করতো। তিতিরের ভয়ে আসিফের ভাইবোনেরা নিজেদের ভাইয়ের বাড়িতে আসতে পারেনা। এসব কারণে আসিফ একটু শান্তির আশায় নাজলীর কাছে আশ্রয় খুঁজছিলো।
কিন্তু যত সময় গেছে, আসিফ বুঝতে পারছে কি ভুল আর পাপই না সে করেছে। পাপবোধ আগের থেকেই ছিলো কিন্তু এখন সেটা প্রকট হয়ে গেলো। নাজলীর পাতা ফাঁদে সে পা রেখেছিলো, ফাঁদ থেকে আর বের হতে পারছিলোনা। গোপনে কয়েকটা ভিডিও করেছিলো নাজলী। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত। একটু এদিক ওদিক হলেই ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেয়। নিজের মুখ ভিডিওর সময় আড়ালে রেখেছিলো শয়তান মেয়েটা। মেয়ের সাথে তার মা,খালাও জড়িত আছে এই কাজে। নাজলীর ভিডিওর ভয়ে চুপসে রয়েছে কয়েকজন প্রফেসর। প্রথম বার ভুল করেই যদি তিতিরকে সব বলে দিতো আসিফ! তিতির তাকে ক্ষমা করতো আর যেভাবে হোক, এই চোরাবালি থেকে উদ্ধার করে আনতো। কিন্তু তিতিরকে প্রথম চোটে বলতে পারেনি আসিফ, তাছাড়া তারও নেশা জন্মে গিয়েছিলো । মোহ কাটার পরে যতো বের হওয়ার চেষ্টা করেছে, ততো জালে জড়িয়ে গেছে আসিফ। মেয়ে আর তার পরিবার মিলে বাধ্য করেছে নাজলীকে বিয়ে করতে, সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে আসিফের বেশিরভাগ সম্পত্তি নাজলীর নামে লিখে দিতে। কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলো আসিফ। শেষের দিকে মরিয়া হয়ে গিয়েছিল সে। যা হবার হবে, এমন একটা ভাব। পরিচয় হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ পঞ্চাশ লাখ টাকার উপরে নগদ নিয়েছে নাজলী, গোপন বিয়েতে পনেরো ভরি সোনার গয়না দিতে হয়েছে।
এখন তিতিরের সাথে নিজের ভাইবোনের ব্যবহারের ভিডিও দেখে হাত পা কাঁপতে থাকলো আসিফের। কি অনিরাপত্তা আর অনিশ্চয়তায় সে তিতির আর তার ছেলেমেয়েদের ফেলেছে! বুবুন, লুম্বিনী, দুধের শিশু তুতুন।যে কারোর ভয়ংকর ক্ষতি করতে পারে তার স্বার্থপর ভাইবোনেরা।
সেই রাতে জেলে আসিফ স্বপ্ন দেখলো তার দুই ছেলেকে। বুবুনকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে আসিফের ভাই আর ভাইয়ের ছেলেরা, ছোট্ট তুতুনকে গভীর কুয়োতে ফেলে দিচ্ছে এক মহিলা….. ঘুম ভাঙার পরে আসিফ হুহু করে কাঁদলো। অনেকক্ষণ ধরে। স্বপ্নটা মাথা থেকে সে সরাতে পারছিলোনা। তার কলিজার টুকরোগুলোর কি হবে? ফেলে আসা সংসারটার জন্য কষ্টে আসিফের বুক ফেটে যাচ্ছিলো। তার তিতির, যে জীবনে কারোর অমঙ্গল চায়নি, কারোর বদনাম করেনি, কখনো মিথ্যা বলেনি, কারো ক্ষতি করেনি, আসিফদের পরিবারের বহু মানসিক অত্যাচার মুখ বুজে সে সহ্য করেছে, আসিফের ক্যারিয়ারের পথ এতো মসৃণ, এতো উজ্জ্বল হতোনা তিতির আর তিতিরের পরিবার পাশে না থাকলে। তিতির যে কত ভালো আর নির্ভেজাল একটা মানুষ , আসিফের থেকে ভালো আর কয়জন জানে? সেই তিতিরকে বছরের পর বছর ঠকিয়েছে আসিফ, কত কুকথা বলেছে সেদিন। তিতিরের আহত মুখ দেখে ঘেন্না লেগেছে। বুবুন, লম্বা ছিপছিপে, সুদর্শন তরুণ, মুখ থেকে কিশোরের ভাব যায়নি এখনো। এলোমেলো চুল, কবি কবি ভাব। সরল, সাধাসিধা। এই যুগে এমন ছেলে বিরল। কি হবে তার? নার্ভের রোগ আছে বুবুন -লুম্বিনী দু’জনেরই। এখন এই পাহাড় সমান মানসিক কষ্ট ও চাপ সামলাতে পারবে ওরা? ছোট্ট মিষ্টি তুতুন, মায়াভরা মুখ,মাথায় থোপা থোপা চুল, পাকা পাকা কথা, ওর ভবিষ্যৎ নিজের হাতে কতোটা অন্ধকার করে দিলো আসিফ নিজে। এই ছেলেমেয়েরা আর কখনো তার কাছে আসবেনা, তার মুখ দেখবেনা। অতি ভালোবাসার বাবাকে এখন নিশ্চয়ই তারা প্রবল ঘৃণা করে। যতোদিন যাবে, ঘৃণা ততো বাড়বে, ভালোবাসা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। কি ভাবে বেঁচে থাকবে আসিফ এই ভয়াবহ যন্ত্রণা নিয়ে।
চলবে।