#সংসার
পর্ব ৩৭
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নাজলীকে খুব ভালো মতো শিক্ষা দিতে তিতির বদ্ধপরিকর। এতো জুনিয়র একটা মেয়ে কিভাবে এতো নির্লজ্জ, লোভী, প্রতারক হতে পারে? কিভাবে দুর্বল চরিত্রের পুরুষদের ঠিকঠাক চিনে নেয়? কি সুনিপুণ ভাবে শিকারকে বঁড়শীতে গেঁথে নেয়? কোনভাবে ছাড়া যায়না নাজলী,তার পরিবারকে। কঠিন শাস্তি দিতে হবে নাজলী, তার বাপ-মা-খালা সবাইকে। নাজলীদের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কি গ্রামে আর কি শহরে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত,ধনী-গরিব সব শ্রেণিতে নাজলীরা দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমাজে চরিত্রহীন পুরুষ আর চরিত্রহীন নারীর অনুপাত সমান।
তিতির কখনোই কোন আত্মীয় -বন্ধুকে কাজ আদায়ের মাধ্যম বানায়নি।নাজমুল, নিশাত, তাঁদের তিন সন্তান কারোর স্বভাবে এই ত্রুটি নেই। কিন্তু এবারে তিতির তার আইজি মামার প্রভাবকে কাজে লাগালো। নাজলী যে আরও কয়েকজন অধ্যাপককে নিয়মিত শোষণ করে যাচ্ছে তা মামাকে জানিয়ে দিলো। পুলিশ সেইসব ডাক্তারদের গোপনে জিজ্ঞাসাবাদ করলো। তাঁরা স্টেটমেন্ট দিলেন। একজন প্রফেসরকে নাজলী মেডিকেলের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী থাকা অবস্থায় নিজের ফাঁদে ফেলে।তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের অজস্র ভিডিও আছে নাজলীর নিজের আর তার মা-খালার মোবাইলে। প্রতিটা ভিডিও এতো নিপুণ ভাবে করা ! নাজলীর মুখ কোথাও বুঝা যায়না কিন্তু সাথের পুরুষগুলোর মুখ খুব পরিষ্কার বোঝা যায়। ভিডিও গুলো চূড়ান্ত রকমের অশ্লীল। এই ভিডিওগুলো ভাইরাল হওয়ার ভয়ে চারজন অধ্যাপক কেঁচো হয়ে থাকতেন।তদন্ত করে দেখা গেলো, নাজলী -তার মা-খালা-বাবা -ভাইয়ের নামে অনেক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, নামে -বেনামে ফ্ল্যাট,জমি,প্লট, নানা রকমের ব্যবসা। এই মেয়ের ডাক্তারি পড়ার কি দরকার ছিলো যখন পতিতাবৃত্তি তার নেশা ও পেশা? অবশ্য ডাক্তার হওয়ার জন্য বেশি পড়তে হয়নি মেয়েটাকে।আরামসে প্রতি পরীক্ষায় পাশ করে গেছে স্যারদের সৌজন্যে।
তিতির পুলিশের অনুমতি নিয়ে নাজলীর সাথে দেখা করলো।নোংরা মেয়েটাকে দেখে ঘৃণায় তার গা গুলিয়ে বমি এলো। তিতির শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে মেয়েটার গালে প্রচণ্ড জোরে এক চড় কষালো। কোথা থেকে এমন অসুরিক শক্তি ভর করেছিলো তিতিরের শরীরে কে জানে! “ও মা!” বলে ধপাস করে পড়ে যাওয়া মেয়েটার শরীরে তিতির সজোরে লাথি দিলো।মহিলা পুলিশরা ওকে টেনে আনার সময় ও মুখ ভরে থুথু ছুঁড়ে মারলো নাজলীর মুখে।
একের পর এক প্রতারণা, হুমকি-ধামকির জন্য নাজলীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলো। গোপন ভিডিও এবং তার ভিত্তিতে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য ডিজিটাল আইনে মামলা হলো। তার বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন বাতিলের আবেদন করলো তিতির।
নোমানরা এখনো ঘটনা জানেনা। নিশাত নিষেধ করেছেন নোমানকে জানাতে। কি হবে জানিয়ে? আসিফের এতো বড় অপরাধের পরেও তাকে ঘৃণা করতে পারছেননা নাজমুল -নিশাত। বড় জামাই তাঁদের খুবই আদরের। জামাইয়ের সাথে তাঁদের অনেক সুখ স্মৃতি। আসিফ প্রথম প্রথম কিছুটা তার ভাই বোনদের মতো ছিলো, কিন্তু পরে সে তার সুন্দর আচরণ, কর্মদক্ষতা, দায়িত্বশীলতা,নম্রতা, ভদ্রতার জন্য শ্বশুরকূলে তুমুল জনপ্রিয় ছিলো।সবচেয়ে বড় কথা, তিতিরকে সে আগলে রাখতো সবসময়। তিতিরের সুবিধা -অসুবিধার খুব খেয়াল রাখতো। বাচ্চাদের পাগলের মতো ভালোবাসে আসিফ। নিজের বাচ্চাদেরতো বটেই, ইরফান-আয়মান,অরণ্য -অরণীকে সন্তান স্নেহ দিয়েছে আসিফ। শ্বশুর -শাশুড়িকে নিজের বাবা-মায়ের মতো সম্মান,যত্ন করেছে। নোমান-তিতলীকে আপন ভাইবোনের মতো ভালোবেসেছে । এসব কথা কি করে ভুলবেন নাজমুল -নিশাত? কিন্তু নষ্ট মেয়েটার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে গেলো আসিফ, এটা বড় যন্ত্রণার। চরিত্রগত দোষ কখনোই ছিলোনা আসিফের। কেন সংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ হারালো সে? পাপের চোরাবালিতে একবার পা রেখেই ডুবে যাচ্ছিলো আসিফ।হাজার চেষ্টা করেও উঠতে পারেনি।দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় গত এক বছর সে হিংস্র হয়ে উঠেছিলো তিতিরের উপর।এতো চাপ আর নিতে পারছিলোনা।
তিতিরের মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ যদিও সে বুঝতে দেয়না কাউকে। কোনভাবে আসিফকে ঘৃণা করতে পারছেনা সে। বরং আসিফের শুকিয়ে যাওয়া মুখ সারাক্ষণ তিতিরের চোখে ভাসতে থাকে আর বুক ফেটে কান্না আসে। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে তিতিরকে সবসময় সযত্নে আগলে রাখতো আসিফ, যতোটুকু সম্ভব। তিতিরকে অনেক ভালোবেসে আগলে রেখেছিলো আসিফ। রাজের মৃত্যুর পরে আসিফ ভেঙে পড়া তিতিরকে বাবার মতো ভালোবাসায়, স্বামীর মতো প্রেমে-মমতায়, পরম বন্ধুর মতো যত্নে ঘিরে রেখেছিলো। তিতিরের চুল বেঁধে দিতো, মুখে তুলে খাওয়াতো, সারারাত তিতিরের মতো আসিফও জেগে থাকতো, তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো,ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, বাপ-মায়ের সেবা করা, অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির ভাইবোনদের প্রতি যত্ন নেওয়া, রোগীদের অকাতরে সর্বোচ্চ সেবা দান করা আসিফ কেমন করে এই নর্দমায় ঢুকে পড়লো? একজন সচ্চরিত্র হৃদয়বান স্বামী, একজন মাত্রাতিরিক্ত স্নেহশীল বাবা, একজন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী স্বনামধন্য প্রবল জনপ্রিয় চিকিৎসক কেমন করে নিজের ব্যক্তিত্ব,চরিত্র, শিক্ষা, রুচি বিসর্জন দিলো? ফাঁদে সে পা রাখলো কেন? কিসের অভাব ছিলো তার? মমতাময়ী স্ত্রী, লক্ষী ফুটফুটে তিনটা বাচ্চা। হিসাব মেলাতে পারেনা তিতির। হায়! আসিফের ভবিষ্যত কি? জেল,জরিমানা। তারপর? জেল থেকে বের হওয়ার পরে কি করবে, কোথায় মুখ লুকাবে আসিফ? আসিফের জন্য কষ্টে তিতিরের দমবন্ধ হয়ে আসে।খাঁটি মায়া মমতা বড় শক্ত জিনিস। ভালোবাসা খুব বেশি থাকলে সেখানে ঘৃণা , অবহেলা হাজার চেষ্টাতেও ঘাঁটি গাড়তে পারেনা। আসিফকে যে তিতির বড্ড ভালোবাসে।
বুবুনের চোখেও ঘুম আসেনা। এইটুকু জীবনে কম কষ্ট পায়নি বুবুন। রাজেশ্বরীর মৃত্যুর পর এতো বছর পার হয়ে গেলো, কিন্তু মনের ক্ষত এখনো কাঁচা রয়ে গেছে। ঐ ভয়ংকর রাতটার প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি এখনো কাঁদায় বুবুনকে। অডিটরি হ্যালুসিনেশন হয়,
“ভাইয়া, খুব শীত লাগছে,গায়ে আরেকটা কাঁথা দিয়ে দে।”
মৃত রাজেশ্বরীকে মা গভীর মনোযোগের সাথে নেইলপলিশ দিয়ে দিচ্ছে, কপালে টিপ,ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দিচ্ছে, দুই হাতের কনুই পর্যন্ত চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে , ছোট্ট দুটি পায়ে পরাচ্ছে সোনার নূপুর ,, এই মর্মান্তিক ও অদ্ভুত দৃশ্য জীবনেও ভুলতে পারবেনা বুবুন। কাফনে মোড়া ছোট্ট শরীর, কবরে নেমেছিলো বাবা আর বুবুন, উপর থেকে মামা নিজের কোল হতে রাজকে দিয়েছিলো বাবার কোলে, কবর ছেড়ে উঠে আসতে একদম রাজি হচ্ছিলোনা বুবুন, রাজের পাশে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, কিন্তু সবাই জোর করে ওকে টেনে তুললো, আরেকবার রাজকে দেখার আগেই বোনটা অদৃশ্য হয়ে গেলো বাঁশ, চটের আড়ালে, বুবুন চোখে অন্ধকার দেখছিলো তখন, কারা যেন বলছিলো, “বুবুন, মাটি দাও। বড় ভাইয়ের হাতের মাটি পাক বাচ্চাটা।” উঃ! কি ভয়ংকর কষ্ট! মায়ের উপরে ফুপুর নোংরা আক্রমণ, মায়ের আত্মহত্যার চেষ্টা। আইসিইউ তে ভেন্টিলেটরে মা, দিনের পর দিন, কি দুঃসহ যন্ত্রণাময় ছিলো দিনগুলো। তারপরে সুখে দুখে একসাথে কাটছিলো সময়, একজন অপরজনের অশ্রু মুছিয়ে দিতো, বিপদে আপদে, আনন্দ বেদনায় একে অপরের ঢাল হয়ে থাকতো সবাই, সেই মায়ার বাঁধনটাও ছিঁড়ে গেলো। মামারা অমন ভাবে চলে গেলো অস্ট্রেলিয়া, নানা-বুবু কেমন জুবুথুবু হয়ে গেলো, আর তারপর বাবার এই ঘটনা। নাজলী নামের মহিলাটার চেহারা সারাক্ষণ চোখে ভাসে আর বুবুনের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, ইচ্ছা হয় লোহার রড দিয়ে মারতে মারতে মেয়েটার হাত-পায়ের হাড়গোড় সব গুঁড়ো করে দিতে। লুম্বিনী আর তুতুনকে এখন অনেক সময় দেওয়া উচিত, বুঝে বুবুন। বুঝেও কিছু করতে পারেনা। নিজের রুমে একলা বসে থাকাতেই যা একটু স্বস্তি। বাবার পক্ষ থেকে এতো ভয়ংকর আঘাত আসবে, কল্পনাও করেনি কখনো বুবুন।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৩৮
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তুতুন স্কুল থেকে এসে কিছু খেলোনা। নিশাত, নাজমুল সাহেব,তিতির,ময়না খালা কতো সাধাসাধি করলেন, লাভ হলোনা। তুতুনের ক্ষুধা নেই। ছটফটে তুতুনের মুখটা ফোলা, লালচে। কয়েকদিন ধরে বকবকানি, পাকা পাকা কথা, খলখলপয়ে হাসি, খেলাধুলা সব বন্ধ। অরণ্য বললো, “খালি পেটে দৌড়াবি কি করে, তুতুন বেবি? কিছু একটা ঝটপট খা। নইলে খেলা আরম্ভ হতে না হতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ওঠ্ তুতুন বেবি, ওঠ্। ” তুতুন উঠলোনা। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলো।তিতির ছেলের কপালে, গালে হাত দিলো।জ্বর আসলো নাকি? নাহ্।
“কি হয়েছে বাবাই? মন খারাপ ? ”
মায়ের এই প্রশ্ন শুনে তুতুন বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লো। কি হলো বাচ্চাটার? কেউ কিছু বলেছে? টিচার কী বকা দিয়েছেন কোন কারণে? কাঁদতে কাঁদতে তুতুন বমি করে ফেললো, বমি মানে একটু পানি, খুব সামান্য খাবার। আমেনা জানালো,তুতুনের টিফিন বক্স সেরকমই আছে, কিছু খায়নি বাচ্চাটা। গা গরম হওয়া শুরু হয়েছে।
বুবুন কান্নারত ভাইয়ের মাথায় হাত বুলালো, ” পার্কে যাবি? চল, আজ পার্কে যেয়ে সবাই মিলে বল খেলি।”
তুতুন কান্নাবিকৃত গলায় চিৎকার করে উঠলো, ” আমি বাবার কাছে যাবো।বাবাকে দেখবো। বাবা, তুমি কেন আসোনা? আমি বাবার কাছে যাবো।”
তিতির জমে গেলো। ছেলেমেয়েরা অসম্ভব পিতৃভক্ত। আসিফ চার ছেলেমেয়েকেই বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসে। বাচ্চারাও তাই। শুধু বুবুন প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়ায় বাবার প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসার সাথে মিশে আছে তীব্র ঘৃণা, অসহ্য রাগ। লুম্বিনীও বোঝে অনেক কিছু। ওর উপরে উদাসীনতা ভর করেছে। মনে মনে অনেক কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু তুতুন, অরণ্য, অরণী অনেক ছোটো, ভীষণ সরল। থোপা থোপা চুল,ফোলা ফোলা গাল, মিষ্টি ছোট্ট একটা নাক , অতিরিক্ত সারল্যের জন্য ভাইবোনেরা ডাকে “বেবি তুতুন ” কিংবা “তুতুন বেবি”। ছোট্ট হলেও তুতুনের সবসময় মনে পড়ে, তার একটা বোন ছিলো, তাদের হাসিখুশি একটা ফ্যামিলি ছিলো, তারা হাসতো, বেড়াতে যেতো।তুতুনের বাবা তুতুনকে ভারি ভালোবাসতো। রাজ-লুম্বিনীর আক্রমনের হাত থেকে বাবা তুতুনকে রক্ষা করতো সবসময়। বুবুন প্রায় ছোট্ট ভাইটার কান মলে দেয়, আদর করে কিংবা শাসনের সময়। বাবা দেখে ফেললে ভাইয়ার উপরে খুব রাগ করতো। দিনে তুতুনকে অন্ততঃ দশটা চুমু খেতো তার বাবা।কোলে নিতো, ঘাড়ে চড়াতো। একটু পরপর বুকে জড়িয়ে ধরতো।বেড়াতে নিয়ে যেতো। তুতুনের পছন্দের খাবার নিয়ে আসতো। সেই বাবাটাকে কয়েকদিন ধরে দেখেনি তুতুন, গলাটা পর্যন্ত শোনেনি। বাবার জন্য মনটা ভীষণ খারাপ থাকে তুতুনের, আজ বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ।
জ্বরগ্রস্ত, ঘুমন্ত তুতুনের মাথা কোলে নিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে তিতির। পাশে নিশাত। বাসায় সুনসান নিস্তব্ধতা। সবার মন ভীষণ খারাপ। তুতুনের কান্নায় সবাই কেঁদেছে আজ।
” মা, আমি ঠিক করেছি, আসিফের এগেইনস্টে মামলা তুলে নিবো।”
“তাই কর মা।আমার আর তোর বাবারও এই ইচ্ছা। জামাইতো খারাপ ছিলোনা রে। কেন তার এই ভীমরতি ধরলো! ”
তিতির চুপ করে রইলো। আসিফের প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসা, মমতা,কৃতজ্ঞতা, রাগ, ঘৃণা , অভক্তি সবই আছে।তবে ঘৃণার চেয়ে ভালোবাসা অনেক বেশি। দেশসেরা সার্জন, নিজের জীবন নষ্ট করলো, স্ত্রী -পুত্র -কন্যাকে ঠেলে দিলো দূর্বিষহ যন্ত্রণাময় জীবনে। এক মুহূর্তের মোহের কি ভয়াবহ পরিণতি।
বুবুন বোধহয় বাবাকে খুব সহজে মাফ করতে পারবেনা। তার সহজ হতে অনেক সময় লাগবে।লুম্বিনীরও বাবাকে মেনে নিতে সময় লাগবে অনেক। কিন্তু তুতুন কিছু বোঝেনা। বাবা ফিরে এলে সে দৌড়ে বাবার কোলে উঠবে,চুমা খেয়ে বাবার গাল ভিজিয়ে দিবে। বাবার অনুপস্থিতি তুতুনের জীবনে আলোড়ন তুলেছে, বাবার কলংক নয়।
আসিফের ওপরে মামলা খুব দ্রুত তুলে নিবে, এটা মামলা করার সময়ই তিতির ভেবেছিলো। জেল থেকে বের হয়ে আসিফ কি করবে? কোথায় যাবে? তার বাড়ি,গাড়ি,অর্থের অভাব নেই, প্রাইভেট হাসপাতালগুলো লুফে নেবে তাকে, কিন্তু কি করবে আসিফ? অন্য ফ্ল্যাটে বাস করবে একা? নাকি আবার বিয়ে করবে? নাজলীকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। নাজলীর ভ্রূণটাও নষ্ট হয়ে গেছে রহস্যময় ভাবে। তাছাড়া এতো সহজে জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নাজলী আর তার পরিবার। ভালো ভাবে ফেঁসেছে ওরা। ওদের ব্ল্যাকমেইলিং এর শিকাররা এখন সোচ্চার হয়ে উঠেছে।কেস করছে একের পর এক।
আসিফ এই ফ্ল্যাটে তিতলী আর সন্তানদের সাথে বাস করতে চাইবে? কোন লজ্জায়? কেউ কারোর মুখের দিকে তাকাতে পারবেনা।বুবুন বিদ্রোহ করতে পারে। বুবুন -লুম্বিনী এড়িয়ে থাকবে বাপকে, কোন সন্দেহ নেই। তিতির কি করবে?
জট পাকিয়ে যাচ্ছে মাথায়। একটু নিশ্চিন্ত ঘুমের দরকার খুব।
তিতির বুবুনের ঘরে গেলো। বুবুন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিলো। মা’কে দেখে চোয়াল শক্ত করে ফেললো।
ছেলেটার চোখ দুটো লাল। মুখ শুকনা। উষ্কখুষ্ক চুল। শেভ না করায় মুখে এলোমেলো কোমল দাড়ি।
তিতির ছেলের কপালে হাত রাখলো। বুবুন মুখ ফিরিয়ে নিলো।
“আমার উপরে রাগ কেনো? ”
বুবুন নিরুত্তর।
” আমার অপরাধ কি তা তোমাকে বলতে হবে। আমার সাথে এমন ব্যবহার করছো কেন? ”
“সারা পৃথিবী আমার লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছা করছে। আমার কাছে কেন আসো? আমাকে একা থাকতে দাও।”
“রাতদিন একা ঘরে পড়ে থাকো। মাস্টার্সের ক্লাসে যাচ্ছোনা। তোমার কষ্ট হচ্ছে, আমার হচ্ছে না? লুম্বিনী -তুতুনের হচ্ছে না? ”
“কেমন ওয়াইফ তুমি? তোমার স্বামী এতোদিন যাবৎ নোংরামি চালিয়ে গেছে, তুমি কিছুই টের পাওনি? কোন দুনিয়ায় বাস করো? কেন তোমার হাসব্যান্ড তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য মেয়ের প্রেমে মজে যায়? কিসের ডেফিসিয়েন্সি তোমার?”
” তুমি আমার সাথে এ ধরনের ব্যবহার করছো, আমাকে দোষারোপ করে কথা বলছো, তাহলে তুমিইতো ভালো বলতে পারবে আমার ডেফিসিয়েন্সি কোথায়। কেন সবাই আমার ভালোবাসার প্রতিদান হিসাবে ছলনা, কটু কথা উপহার দেয়? ”
“আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি , আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি মা।”
“শান্ত হও বুবুন। জীবনে সমস্যা আসতে পারে।এর চেয়েও বড় সমস্যা আসতে পারে,আসবে।ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যাকে ফেস করো, সমাধান খুঁজো। তোমার সাথে আমি কিছু আলোচনা করতে এসেছি।আমি চাই, তোমার বাবা মুক্তি পান। তুমিও কী এটাই চাওনা? ”
“আমি শুধু ঐ মেয়েটাকে খুন করতে চাই। নৃশংস ভাবে খুন করতে চাই।”
বুবুনের ঠোঁটের কোণায় কষ জমা হয়েছে, চোখ আরো লাল হয়ে গেছে, শরীর কাঁপছে একটু একটু।
” বুবুন, বাবা আমার, ওর কথা আর ভেবোনা। ও এখন অতীত। জীবন খুব ছোট। দেখতে দেখতে যাওয়ার সময় এসে যায়। তাহলে এই অতি ক্ষুদ্র জীবনে একটা ঘটনা ঘিরে এতো চিন্তা ভাবনা, কাদা ছোঁড়াছুড়ি, ঘৃণা, মন খারাপ, প্রতিশোধের চিন্তা…. কি দরকার বুবুন ? ঐ মেয়ের কথা আর ভাববেনা। তাকে খুন করে কি হবে? প্রতিশোধ? কি লাভ তাতে? সে মরবে, সেই সাথে তুমি মরবে, আমি মরবো, আমরা সবাই মরবো। এজন্য দুনিয়ায় এসেছি আমরা? যা ঘটে গেছে, ঘটে গেছে। আমরা এখন খুব কষ্টদায়ক পরিস্থিতিতে আছি, সমস্যায় আছি, এই কষ্ট ও সমস্যাকে আমরা পুষবোনা। যতোটুকু সম্ভব , শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধান করবো। গোসল করোনি কয়দিন? ওঠো। শেভ করে গোসল সেরে খেতে এসো। বাবা একটা অপরাধ করেছে, ভয়ংকর অপরাধ করেছে।তারমানে এই নয় যে তাকে সারাজীবন আমরা অপরাধী হিসেবে দেখবো, তাকে কখনো ক্ষমা করা যাবেনা।তার ভালো দিকগুলো মনে করো।তোমার জন্ম থেকে এই পর্যন্ত বাবা তোমাকে যে আদর -ভালোবাসা দিয়েছে, নিজের সাধ্যের বাইরে যেয়ে হলেও তোমাদের লাইফ স্মুথ করার চেষ্টা করেছে, তোমাদের সামান্য হাঁচি কাশি হলেও অস্হির হয়ে যেয়ে তোমাদের দেখাশোনা করেছে, পৃথিবীর সমস্ত বিপদ থেকে তোমাদের সবসময় বুক দিয়ে আগলে রেখেছে, সেসব কথা স্মরণ করো। নিজের শরীর-মনের যত্ন নাও বুবুন। তুমি বাড়ির বড় ছেলে।তুমি এতোটা আপসেট হলে চলবে? ”
” তুমিতো মামলা তুলে নিচ্ছো।একটা কথা বলোতো মা, মোয়েটার নাম,ছবি,কাহিনী, গুষ্ঠির ঠিকুজি কুলুজি সব পেপারে আসলো, কিন্তু তোমার হাসব্যান্ড আর অন্যান্য গুণধর ডাক্তারদের নাম আসলোনা কেন?”
“সাংবাদিকদের জিজ্ঞেস করো।”
“আমার মনে হয়, তোমার অবদান আছে এতে। ”
“না বাবা,এতো ক্ষমতা নেই আমার। ভুল ভাবছো।যদি ক্ষমতা থাকতো, তাহলে নিশ্চয় আমি চেষ্টা করতাম তোমার বাবার নাম যেন না ওঠে। তোমার বাবা চরম পাপ করেছে ঠিকই , কিন্তু সে পেশাদার পাপী না।মেয়েটা পেশাদার পাপী। দু” জনের মধ্যে পার্থক্য আছে। ”
” তুমি লোকটাকে ডিভোর্স দিবে?”
” সিদ্ধান্ত নিইনি।আরেকটু ভাবতে হবে।”
“তোমার জায়গায় অন্য কোন মহিলা হলে অনেক আগেই ডিভোর্স দিয়ে দিতো। তুমি ডিভোর্স দিবেনা কারণ তোমার আত্মসম্মান জ্ঞান নেই। তুমি ভীতু। পরনির্ভরশীল। এই সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম আয়েশকে উপেক্ষা করার সাহস তোমার নেই। কাজের বুয়ারাও কিন্তু সংসারে লাথি মেরে চলে আসে।সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, বাচ্চাও পালে।তোমার সেই সাহস,শক্তি, সেল্ফ রেসপেক্ট কিচ্ছু নেই। ”
প্রচণ্ড রাগ, কষ্ট, অপমান, লজ্জা বুবুনকে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ করে দিয়েছে। নির্লজ্জ মেয়েটা ওর সামনে চূড়ান্ত অশ্লীল কথা বলায়, নোংরা ভাবভঙ্গি করায় এবং বাপের সাথে নিজের অতি অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবিগুলো দেখায় রাগে -ঘৃণায় উন্মাদ হয়ে গেছে বুবুন।তাই ছেলের কথাতে রাগ হলোনা তিতিরের, তবে কষ্ট হলো খুব। হয়তো ঠিকই বলেছে বুবুন। তিতির আত্মমর্যাদাজ্ঞানশূন্য। কিন্তু গভীর ভালোবাসা , মমতার বিশেষ শক্তি আছে। তাই খুব ভালোবাসার মানুষদের আমরা ক্ষমা করে দিতে পারি, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ অন্ততঃ দিতে পারি।
চলবে।