#সংসার
পর্ব ৫১
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
আসিফ কিছুটা অনুশোচনায় ভুগছে, খুব বেশি না। বিয়ের আগে মেয়ের ভদ্রতা, আচার ব্যবহার, মানবিক গুণাবলির গল্প বিভিন্ন দিক দিয়ে শুনে, শালীন সংযত পোশাক দেখে আর মেয়ের আদর্শ চিন্তাভাবনা, কাজকারবারের নমুনা কিছুটা স্বচক্ষে দেখে, তার চেয়েও বড় কথা, মেয়ের বাবার ও বৃহৎ পরিবারের অন্যান্যদের সামাজিক অবস্হান দেখে সে তিতিরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। তিতির বেশ মেধাবী , বাবা-মায়ের মেধা সন্তানরাও জেনেটিক্যালি পাবে, এমন হিসাব নিকাশও করেছিলো। কিন্তু তিতিরের চেহারার জন্য তার মন খুঁতখুঁত করছিলো। কুশ্রী বলা যায়না, আর সুন্দর তো বলাই যায়না। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও তিতিরকে মন থেকে মেনে নিতে বেশ সময় লেগেছিল আসিফের। আশেপাশে কতো সুন্দর মেয়ে। বন্ধুদের গেট টুগেদারের সময় সবচেয়ে কম সুন্দর বৌ নিয়ে আসিফকে অ্যাটেন্ড করতে হয়। শ্যালিকা তিতলী এবং সম্বন্ধীর হবু বৌ তমা দু’জনেই বেশ সুন্দর। শাশুড়ি আম্মা দারুণ সুন্দর। শ্বশুর আব্বা আর সম্বন্ধীও খুবই হ্যান্ডসাম। মাঝখান থেকে তিতির এমন হলো কেন? তিতির সবার নেগেটিভ দিকটা পেয়েছে। দাদির মতো খাটো হয়েছে কিন্তু একঢাল চুল, চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রং, ভুবন ভোলানো হাসি পায়নি। নানির মতো থ্যাবড়া নাক পেয়েছে , যদিও নানির নাক এতোটা চ্যাপ্টা নয়, কিন্তু নানির মতো লম্বা ছিপছিপে সুন্দর ফিগার, কাজল কালো অনিন্দ্যসুন্দর চোখ পায়নি। চোখজোড়া ফুপুর থেকেও কুতকুতে, গায়ের রংটা ফুপুর মতোই চাপা, কিন্তু ফুপুর মতো একমাথা চুল, লম্বা একহারা গড়ন, টিকালো নাক, চেহারার ঢলঢলে লাবণ্য, সেগুলোতো পায়নি তিতির। তারপরও তিতিরদের বৃহত্তর পরিবারে সে ছিলো হিরোইন, সবচেয়ে বেশি আদরের, বন্ধুমহলেও সে কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, তার স্বভাব আর কাজ কারবারের জন্য। আসিফ মানসিক ভাবে তখন কিছুটা দীনহীন ছিলো, তিতিরকে ঠিক তার হজম হতোনা। তাই সে তিতিরের সাথে কিছুটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলতো, সব কাজেই তিতিরের ত্রুটি খুঁজে বের করতো, নিজের মা বোনদের অনেক অনেক গুণের কথা গল্পের ছলে বলতো, লেডি কলিগদের সৌন্দর্য, স্মার্টনেস, সংসার-হাসপাতালে সব জায়গায় তাদের অসাধারণ কর্মদক্ষতার বর্ণনা দিতো। নিজের বাবা-মা,ভাই -বোনেরা যখন তিতিরের সামনে বা পেছনে নানা হাবিজাবি কথা বলতো, বউয়ের রূপগুণ নিয়ে, তখন আসিফ আরো প্রভাবিত হতো। তার উপরে বৌ ঢংঢাং, ছলাকলা কিছুই জানেনা। তারপরে তিতিরের সাহচর্যে থেকে থেকে, তার কাজকর্ম আচার ব্যবহার দেখে, তার জীবন দর্শন বুঝতে পেরে, তার মনের সৌন্দর্য অনুভব করতে করতে আসিফেরও চিন্তাধারা আর মানসিকতায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন হলো। শ্বশুর শাশুড়ির স্নেহে, পুরো পরিবারের প্রসারিত , উদার মন মানসিকতার সান্নিধ্যে থেকে, উচ্চতর ডিগ্রির সময় কয়েকজন টিচারের চিন্তাধারা -জীবন যাপন পদ্ধতি দেখে, বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে বৃহত্তর পরিসরে নানা নির্ভেজাল মানুষের সংস্পর্শে এসে আসিফের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেলো আমূল। তিতিরের সৌন্দর্যহীনতা নিয়ে সে আড়ালে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতোনা। পরিবার, কাজ তার কাছে মুখ্য হয়ে গেলো।তার বড় ইচ্ছা হতো, তার বাবা-মা-ভাই-বোনেরাও এমন সুন্দর চিন্তাভাবনার অধিকারী হোক, চিন্তায় -মননে -কাজে তারাও সমৃদ্ধশালী হোক, সেজন্য কম চেষ্টা করেনি আসিফ, কম বুঝায়নি, কম উদাহরণ দেয়নি। কিন্তু লাভ হয়নি। চেতনার বিকাশ তেমন ঘটেনি আসিফের পরিবারের সদস্যদের। আসিফ সফল হতে সফলতর হতে লাগলো। সংসার নিয়ে তার কোনো চিন্তা করতে হতোনা, সব সামলে নিতো তিতির আর তিতিরের পরিবার। পোস্ট গ্রাজুয়েশনের সময় বা যখন বিদেশে ফেলোশিপ করতে গেলো আসিফ, তিতিরের কথা চিন্তা করার অবকাশই তো ছিলোনা। তবে বুবুন, পরবর্তীতে বুবুনের পাশাপাশি রাজ -লুম্বিনীর জন্য , নিজের বাবা-মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতো আসিফের।
তবে কি তিতিরকে কখনোই তেমন ভালোবাসেনি আসিফ? আসিফের সামনে এটা এখন বড় আত্ম-জিজ্ঞাসা। তিতিরে সে অভ্যস্ত ছিলো নিজের পা পিছলানোর আগ পর্যন্ত। একসাথে খাওয়া,বেড়ানো, এসবই ছিলো অভ্যাস।আর অভ্যস্ততাকে মনে হয়েছে ভালোবাসা। তাছাড়া একসাথে এতো বছর থাকলে কিছু অনুভূতিতো জন্মাবেই।
আসিফকে যখন ক্ষমা করে দিয়ে আবার একসাথে বসবাস শুরু হলো, লুম্বিনীর ঘরে শোয়ার ইচ্ছা ছিলো তিতিরের। নিশাত মেয়েকে বলেছিলেন, “ছেলেমেয়েদের মঙ্গলের জন্য সমঝোতায় এলি। এখন দু’জন দুই ঘরে শুলে বাচ্চাদের ভালো লাগবেনা তিতির। ”
তিতিরকে যখন দু’হাতে কাছে টেনেছিলো আসিফ, কোমল ভাবে হাত দুটো সরিয়ে দিয়ে তিতির শান্ত গলায় বলেছিলো, ” আমাকে স্পর্শ করোনা আসিফ।ভুল ভেবোনা,আমি ঘৃণা করছিনা। কিন্তু এই ছোঁয়া আমাকে খুবই কষ্ট দেবে, অপমানিত করবে। আমি অনেস্টলি বলছি, তুমি যদি জৈবিক কারণে কষ্ট পাও, ভালো ভদ্র পরিবারের ভদ্র কোনো মেয়েকে বিয়ে করো,হতে পারে সে ডিভোর্সি, উইডো, কিংবা কুমারী । তুমি বড় ফ্ল্যাটটায় তাকে নিয়ে থাকবে, সংসার করবে, আমি যাবো, বাচ্চারা যাবে,তোমরা আসবে, সেটাও ভালো। কিন্তু দ্বিতীয় বার ব্যাভিচার করোনা বা নোংরা মেয়ের পাল্লায় পড়োনা। বাচ্চারা বেশি হার্ট হবেনা তুমি আইন মেনে বিয়ে করলে, আমি বুঝিয়ে বললে।”
“অবাস্তব কথা বলছো তিতির। আমি আবার বিয়ে করবো আর বাচ্চারা এবারে সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিবে, এমন হাস্যকর কথা বলোনা। সময় নাও। সময়ের সাথে সাথে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”
স্বাভাবিক হয়নি। তিতিরকে ছুঁলেই সে আলতো করে হাত সরিয়ে দিয়েছে। আসিফেরও তেমন কষ্ট হয়নি। সে চরিত্রহীন ছিলোনা। ছোটো বেলা হতেই মেয়েদের নিয়ে ভাবা, খারাপ আচরণ করা, খারাপ ছবি দেখা, বন্ধুদের মেয়েদের নিয়ে বাজে কথা বলা সে ঘৃণা করতো। কোনো মেয়ের দিকে অশালীন ভাবে তাকায়নি সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের বিশুদ্ধতাকে কি চরম ভাবেই না বিসর্জন দিলো সে। নিজের প্রতি ঘৃণা বোধ হয়। আত্মগ্লানি হয় চরম। পেশাগত বিষয় নিয়ে আরও ব্যস্ত হয়ে গেছে আসিফ। আর তিতির, বুবুন,লুম্বিনী, তুতুন, তুতুনের নানা নানি, মামাখালাদের পরিবার, নিজের ভাইবোন, খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু – এই নিয়ে আসিফের পৃথিবী। আজ সে আবিস্কার করলো, বুবুন-লুম্বিনী-তুতুন আর বহু আগে মরে যাওয়া রাজ ছাড়া আসলে এখন সে কাউকে ভালোবাসেনা। এমন কোনো দিন নেই যেদিন রাজের চেহারা জ্বলজ্বল করে তার সামনে ভাসেনা। সপ্তাহে একদিন হলেও সে রাজের কবর দেখতে যায়। রাজের কলকাকলি,কাজকারবারের স্মৃতিচারণ আসিফের প্রতিদিনের অভ্যাস। রাজের নামে হাসপাতাল বানানোর কাজ চলছে বছরখানিক ধরে। “রাজেশ্বরী আরোগ্য নিকেতন।”
লুম্বিনী, তুতুনকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, ওদের খুশি করা, ওদের হাসি দেখা, ওদের গল্প শোনা আসিফের সবচেয়ে প্রিয় বিনোদন। ওদের বুকে জড়িয়ে সে অপার শান্তি পায়, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়। সবচেয়ে প্রিয় সন্তান বুবুনের সাথে আসিফের বিচিত্র সম্পর্ক। বুবুনকে প্রতিদিন ফোন দেয় আসিফ।ছেলে নিস্পৃহ গলায় টু দ্য পয়েন্ট উত্তর দেয়। একটা বাড়তি কথা বলেনা। ভিডিও কলে বা সামনাসামনি বুবুনের চোখে বাবার জন্য একই সাথে তীব্র ভালোবাসা আর তীব্র ঘৃণা দেখেছে আসিফ বারবার, প্রতিবার।ভালোবাসা আর ঘৃণার সহাবস্থান হতে পারে?
মেডিকেল চেক আপ করাতে চাইলে, দেশে -বিদেশে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার অফার দিলে, একসাথে বাইরে খেতে যেতে চাইলে, এমনকি একসাথে তিতিরের বাপের বাড়ি যেতে চাইলেও তিতিরের উত্তর, “না।” কার্ডিওলজিস্টের কাছে কয়েকবার নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে আসিফ। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিয়েছে। তিতির যায়নি।তিতিরকে রাজি করানো সম্ভব হয়নি। হতাশ ও বিরক্ত হয়ে গেছে আসিফ আর লুম্বিনী। তুতুনও চায় মা সবসময় তাদের সঙ্গ দিক, আগে মন খারাপ করতো, এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
বহুদিন তিতিরের মুখের দিকে ভালো করে তাকানোই হয়নি। আজ আসিফ মন দিয়ে দেখলো।চোখ দুটো গর্তের ভিতরে, দুই চোখের তলায় গাঢ় কালি, দুই গালে অনেক দাগ বেড়েছে, এই দাগ তোলার জন্য লুম্বিনী ভীষণ জেদ করেছিলো মা যেন থাইল্যান্ডে যেয়ে লেজার করে আসে। আসিফও অনুরোধ করেছিলো।তিতির রাজি হয়নি। তার নাকি জার্নি করার শক্তি নেই। লুম্বিনী খুব খেপেছিলো সেবার। তোমার বৃদ্ধা চাচিকে বাসায় এনে দিনরাত সেবা করেছো, মুখে তুলে তিনবেলা খাইয়ে দিয়েছো, দুইদিন পায়খানার চাদর পরিস্কার করেছো, তখন গায়ে শক্তি এসেছে কোত্থেকে? তাও আপন চাচি না।
“চাচা নেই। চাচির একটা মাত্র মেয়ে ছিলো, সেও বাচ্চা হতে যেয়ে মারা গেছে। চাচি কতো আদর করতেন আমাদের। তোমরাও অনেক আদর পেয়েছো। তাহলে এমন করে বলছো কেন, লুম্বিনী? চাচির দুঃসময়ে আমরা দেখবোনা? ”
“কেন, আরও আত্মীয় স্বজন নেই? উনার ভাইবোনের ছেলেমেয়ে নেই? ”
“আমার মৃত চাচিকে নিয়ে আর কথা বলোনা লুম্বিনী, প্লিজ। কে দায়িত্ব পালন করলো, কে করলোনা, এতো বিচার করলে হয়? অন্যরা যেমন দেখতে
পারতো, আমারও তেমন দেখার দায়িত্ব ছিলো। শেষের দুই মাস একটু শান্তিতে কাটলো আমার চাচির। ”
আজ তিতিরের চোখ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠলো আসিফের। ভাষাহীন ঘোলা দুটো চোখ।কণ্ঠার হাড় দুটো ভারি প্রকট। লম্বা হাতার ব্লাউজ বা কামিজ পরতো তিতির, তাই এতোটা খারাপ অবস্থা বুঝা যায়নি, এখন একটা হাফ হাতা ম্যাক্সি পরা, খসখসে চামড়ার লিকলিকে দুটো হাত বের হয়ে আছে।
সেই রাতেই জোর করে আসিফ তিতিরকে নিয়ে গেলো নিজের হাসপাতালে। মাথার চুল হতে পায়ের নখ পর্যন্ত কোন জায়গার টেষ্ট বাকি রাখলোনা। টেস্টের রিপোর্ট ভয়ংকর। হিমোগ্লোবিন, টোটাল প্রোটিন, অ্যালবুমিন, অন্যান্য নিউট্রিয়েন্টস এতো কম , আসিফ খুবই লজ্জা পেলো। সবাই বুঝে যাবে, আসিফ তার স্ত্রীর এতোটুকু যত্ন করেনা। নতুন করে হার্ট অ্যাটাক হয়নি, তবে যে কোন মুহূর্তে হতে পারে। খুব দ্রুত অ্যানজিওগ্রাম করার দরকার কিন্তু শরীরের এই দুর্বল অবস্হার একটু উন্নতি না করে অ্যাঞ্জিওগ্রাম করাটা খুবই রিস্কি। তিতিরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো।
পরিবারে যে আনন্দধারা বইতে শুরু করেছিলো বুবুনের বিয়েকে কেন্দ্র করে, অনেক সমস্যার সমাধানও হচ্ছিলো যেমন শ্বশুরবাড়ির আর ছোটো ছেলের সাথে সম্পর্কের একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছিলো তমা-নোমানের, নাজমুল সাহেব টুকটাক কথা বলা শুরু করেছিলেন, হাসি-তামাশাও একটু আধটু, নিশাতের রাগ, হতাশা কমে গিয়েছিলো অনেক, ইরফানেরও মাথা ঠান্ডা, মুখে হাসি, সেই আনন্দ ধারায় কিছুটা ভাটা পড়লো।
ইলেকট্রোলাইটস ইমব্যালান্স কারেকশন করার পর অবস্থার সামান্য উন্নতি হলো তিতিরের। রক্ত দেওয়া হয়েছে তিন ব্যাগ।
বুবুন খবর পেয়ে বিচলিত হলোনা। মায়ের চেহারা সে দীর্ঘ দিন দেখেনি, গলাও শোনেনি। উৎকন্ঠিত লুম্বিনী, তুতুন আর নানা-বুবুকে সে উল্টে সান্ত্বনা দিলো, “হার্ট অ্যাটাক অনেক আগে হয়েছিলো,এখনতো হয়নি। এখন নিজে নিজে অসুস্থতাকে আমন্ত্রণ করলে সমস্যা তো হবেই। তিনি খাবেননা, ডাক্তার দেখাবেননা, তাহলে কে কি করতে পারে উনার জন্য? এখন সর্বাধুনিক হাসপাতালে সবার নজরদারিতে আছেন, ঠিক হয়ে যাবেন।তারপরে বাসায় যেয়ে আবার অসুস্থ হওয়ার ট্রাই করবেন। উনার জীবনের দুইটা লক্ষ, সবার অ্যাটেনশন নিজের দিকে রাখা আর তিনি যে কতো ভালো,সর্বংসহা, তা সবাইকে মুখে না বলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়া।”
না,বুবুন এখন দেশে আসতে পারবেনা। অজন্তা বললো, ” আরিয়ান, তুমি খুব অল্প বয়সে বিরাট বিরাট শক পেয়েছো। তোমার নিউরোলজিকাল ডিজঅর্ডারও ডেভেলপ করেছিলো। তুমি অদ্ভুত ধারণা নিয়ে আছো।আমার মনে হয়, তোমাকে নিউরোলজিস্ট দেখাতে হবে। সাইকোথেরাপিও দরকার। যে বাবাকে কেন্দ্র করে মায়ের সাথে এতো সমস্যা, সেই বাবার দেওয়া এতোগুলো ডলার ঠিকইতো হাত পেতে নিলে।”
বুবুন কঠিন গলায় বললো, ” হাত পেতে নিইনি। বাবা জোর করে দিয়েছে।আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি এই ডলার আমি পাই পাই করে শোধ করবো, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। এই শর্তে বাবা রাজি হওয়ার পরে আমি ডলার নিয়েছি। ”
পনেরো দিন হাসপাতালে থেকে তিতির বাসায় ফিরলো। অ্যাঞ্জিওগ্রামের সময় তিনটা স্টেন্ট দিতে হয়েছে। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছে। কিন্তু উনার কাছে নিজের সমস্যা নিয়ে একটা কথা বলেনি তিতির। একটা কথাই ঘুরে ফিরে বলেছে, ” কিছু ভালো লাগেনা।” তিতিরের অনুপস্থিতিতে সাইকিয়াট্রিস্ট আর সাইকোথেরাপিস্টের সাথে দেখা করেছে আসিফ।জানিয়েছে কন্যার অকাল ও করুণ মৃত্যুর কথা, বড় ছেলের সাথে মায়ের মতবিরোধ ও বিশাল দূরত্বের কথা। কিন্তু মতবিরোধের কারণের কথা মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেও বলতে পারেনি। উহ্! তার আর ঐ নষ্ট মেয়েটার জন্য সংসারটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো। এতো অস্বাভাবিক অবস্থা যে প্রথম ছেলের বিয়ে নিয়ে ছেলের মায়ের সাথে আলাপ হয়না, মাও কোন প্রশ্ন করেনা, ছেলে সবাইকে সব জানালো, শুধু মা’কেই জানালোনা। চার বছর মা-ছেলের যোগাযোগ নেই।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৫২
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নাজমুল সাহেবের এখন বড়ই আনন্দের সময়। থরো চেক আপের পরে ডাক্তাররা রায় দিয়েছেন , নাজমুল সাহেবের কানাডা যাত্রায় কোনো অসুবিধা নেই। নিশ্চিন্তে তিনি প্লেনে চড়তে পারেন। ভিতরে ভিতরে দারুণ টেনশনে ছিলেন তিনি। বাই এনি চান্স, ডাক্তাররা যদি বলেন, এতো জার্নি করা যাবেনা, ফ্লাই করা তাঁর জন্য বিপদজনক, তাহলে কি অবস্থা হতো? কোনো নিকটাত্মীয়কে তাঁর কাছে রেখে পরিবারশুদ্ধ সবাই কানাডা রওনা হতো।
আর পনেরো দিন পরে ফ্লাইট। বিশ দিন পরে বিয়ে। পরিবারটিতে বসন্ত কাল চলছে। ছেলের বাপ-মা-ভাই -বোন -নানা-নানি -মামা-মামি-চাচারা-ফুপুরা, খালা-খালু, ফুপারা-চাচিরা যাবে আর যাবে ইরফান,আয়মান,অরণ্য, অরণী। এতে আসিফের ভাইবোনেরা বেশ হাঙ্গামা করেছে, তাদের ছেলেমেয়েরা কি দোষ করলো? হয় ওদেরকে নিতে হবে নইলে ইরফানদের বাদ দিতে হবে। আসিফের ভাইবোনদের ছেলেমেয়ের সংখ্যা সতেরো, তারমধ্যে পাঁচ ভাগনী বিবাহিত ও বাচ্চা কাচ্চার মা। এতোজনসহ বিদেশ বিভুঁইয়ে অন্যের আতিথেয়তায় যাওয়া যায়? যতোই তাঁরা বুবুনের শ্বশুর শাশুড়ি হন? আর ইরফানদের বাদ দেওয়ার প্রশ্ন উঠেনা। তিতিরদের তিন ভাইবোনের মধ্যে যেমন অতি নিবিড়, নিঃস্বার্থ সম্পর্ক, তাদের সন্তানদের মধ্যেও সেই একই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কয় ভাই বোন প্রশ্ন করলে প্রত্যেকে উত্তর দেয়, “আমরা আট ভাইবোন। ” আর বুবুনদের সাথে তাদের চাচাতো আর ফুপাতো ভাইবোনদের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ নয়, সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। তাছাড়া ছোটো বেলা থেকে বাপ-মায়ের স্বার্থপরতা,আত্মকেন্দ্রিকতা দেখে বড় হয়েছে তারা, তাদের বাবা-মায়েরা যাদের যাদের বাচ্চা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। ভাইবোনের বাচ্চাদের উপর তেমন মমতা নেই, বরং ঈর্ষা আছে। আসিফের বড় বোনের মেয়ের খুব ভালো জায়গায় বিয়ে হলো, মেয়ে ও তার পরিবার থেকে ছেলে,ছেলের পরিবার অনেক উঁচু অবস্হানে, ওমনি মেজ বোন, সেজ বোনের মুখ কালো হয়ে গেলো। আনন্দিত হওয়ার ভানও করতে পারেনি তারা। তাদের মেয়েদের এতো ভালো বিয়ে হয়নি, তাই।বোন বা তার পরিবারের সদস্যদের অনুপস্থিতিতে বাকি ভাইবোনেরা একসাথে হয়েছিলো আসিফের বাসায় কোনো একটা বাহানা করে।ভাইবোন আর কয়েকটা ভাগ্নে ভাগ্নির কথাবার্তা, আচার আচরণ, মানসিকতায় খুবই দুঃখ আর লজ্জা লেগেছিল আসিফের।
সেজ আপা যেমন বলেছিলেন, ” বড় আপার এই মেয়ে ছোটো বেলা থেকেই মহা চাল্লু। পুরুষ ঘেঁষা স্বভাব। ঢঙ্গী। ঢংঢাং , ছলাকলা দিয়ে জামাই বশ করেছে। আমার মেয়েদের ঐভাবে বানাইনি আমি। কোনো জায়গায় ইরিন,তুরিন চোখ তুলেও তাকায়না। আর বড় হয়ে গেলে কি হবে, ওরা এখনো সেই ছোটো মানুষ।জামাকাপড়, জুতা,স্যান্ডেল, এমনকি তাদের ব্রা-প্যান্টি,স্যানিটারি ন্যাপকিন পর্যন্ত আমাকে কিনতে হয়। উনাদের লজ্জা লাগে। ওদের বান্ধবীরা সব লাইন মারে, আর এরা লাইন ঘাট দূরের কথা, কোনো ছেলের দিকে চোখ তুলেও তাকায়না। বড় আপার তিন মেয়েই এসব ব্যাপারে ওস্তাদ। আর ছোটোটা আবার তিন বোনের মধ্যে ফার্স্ট। ”
মেজ আপার গলায় একই সুর, ” বড় আপা নিজেও অমন ছিলো। পুরুষ ধরা। মেয়ে তিনটাও তাই। ছেলে পটাতে ওস্তাদ।আমিতো আমার মেয়েদের বলেই দিয়েছিলাম কখনো যদি প্রেম পিরীতিতে জড়াও, মাছ কাটার বঁটি দিয়ে আমি নিজে তোমাদের শেষ করবো। আর বড় আপার এই মেয়ের সংসার বেশিদিন টিকবেনা, আমার তো ভীষণ টেনশন হচ্ছে। ছেলেকে লুচ্চা লুচ্চা লাগলো।লুবনার দিকে বিশ্রী করে তাকাচ্ছিলো। ছেলের স্বভাব চরিত্র সুবিধার না।সংসার কয়দিন টেকে দেখো। ”
আসিফের চতুর্থ বোন সবজান্তার ভঙ্গিতে বললেন, “টিকবে, টিকবে। পুরুষকে কিভাবে ভেড়া বানিয়ে রাখতে হয়, তা ঐ মেয়ে খুব ভালো জানে। ”
এসব অস্বাস্থ্যকর কথাবার্তা ভাগ্নেভাগ্নি, ভাইপো ভাইঝিদের মধ্যেও চলে। কোনো কাজিনের অনুপস্থিতিতে তার চরিত্রের পোস্ট মর্টেম করা। এহেন মানুষদের সাথে নিজের ছেলেমেয়েদের গায়ে লাগা সম্পর্ক হোক, তা নিজেও চায়নি আসিফ। অলরেডি বুবুনকে নিয়ে তার চাচা-ফুপু আর তাদের ছেলেমেয়েদের জোর চর্চা, বুবুন লিভ ইন করে। বড়লোক বাপের ওভারস্মার্ট ছেলে। অথচ বুবুন থাকে ডরমেটরিতে। লিভ ইন দূরের কথা, একে অন্যের হাত ছুঁয়েছে কিনা সন্দেহ।
আসিফ বলেছিলো, ” আমার ছেলেমেয়েরা ওদের নানি,নানা,মামা,খালাদের কাছেই মানুষ। ইরফানদের ওরা কাজিন না, সিবলিংস মনে করে। নোমান ভাই আর তিতলীর বাচ্চাদের বাদ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনা। ”
ভাইবোনরা বয়কট করেছিলো প্রথমে বুবুনের বিয়েকে। তারপর আসিফের গরজের অভাব দেখে আবার নিজেরাই ফিরে এলো, কানাডাতো মিস করা যায়না। তুলি আহলাদি গলায় ভাইকে বললো, ” ঠিক আছে আমাদের ছেলেমেয়েরা না হয় বড়লোক মামার বড়লোক ছেলের বিয়েতে নাই গেলো, কিন্তু ভাইয়া, আমাদের পাঁচ বোনের আর জামাইদের প্লেন ভাড়া তুমি দিবে। আমরা বোনরা তো কিছুই চাইনি তোমার কাছ থেকে। এইটা আমাদের বোনদের আবদার ভাইয়ের কাছে। ”
ভাই দুটোরও একই কথা। ওদের আর ওদের বৌদের প্লেনের ভাড়া বড়লোক ভাই দিক।
হায়! এই এতোগুলো ভাইবোন, তাদের কাচ্চাবাচ্চার জন্য কম করে আসিফ? যখন আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ ছিলো,তখনো এই স্বার্থপর ভাইবোনগুলোর চাহিদার অভাব ছিলোনা। স্বভাবের উন্নতি হয়নি এতো বছরে, বরং আরো খারাপ হয়েছে।
আসিফ স্পষ্ট বললো, ” আমি শুধু আমার ওয়াইফ আর ছেলেমেয়ে দু’জনের খরচ দিবো। শ্বশুর-শাশুড়িরটা দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওঁরা রাজি হলেননা কিছুতেই। তোমাদের যথেষ্ট টাকা পয়সা আছে। যারা যেতে চাও, নিজেদের টাকায় চলো,বাকিরা বাদ। বাংলাদেশে তো বড়সড় প্রোগ্রাম করবোই। ”
অনেক রাগ -গোস্বা দেখিয়ে বুবুনের চাচা-ফুপুরা সবাই রাজি হলো। প্লেন ভাড়াটা দেওয়া লাগবে, ওখানে যেয়েতো আর খরচ নেই। বুবুনের শ্বশুর শাশুড়িকে বলে একটু এদিক সেদিক ঘুরে নেওয়া যাবে। ওরা গোপনে একসাথে হয়ে ঠিক করলো, বুবুন বা তার বৌকে কোনো উপহার দিবেনা তারা, এমনিইতো বিদেশ যেতে কম খরচ হচ্ছেনা ! কাজেই বুবুন আর তার বৌকে বিয়ে-বৌভাতে কোনো উপহার দেওয়া হবেনা।
তমা-নোমানকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছেন নাজমুল নিশাত। আয়মান মোটামুটি স্বাভাবিক। ইরফান খুব দরকার না হলে বাপ-মা বিশেষ করে মায়ের ছায়া এড়ায়না। তমা এখন অনেকটা সংযত। ক্রাইসিসের সময় যে স্বামী-শ্বশুরবাড়িই পাশে থাকবে, বাপের বাড়ি বা বন্ধুবান্ধব অতোটা নয়, এটা সে বুঝে ফেলেছে।শ্বশুর শাশুড়ির পা ধরে ক্ষমা চেয়েছে। এখন সে আর তিতলী অফিস শেষে নিয়মিত বের হচ্ছে মার্কেটে। অজন্তার জন্য কতো কেনাকাটা। ওর বাবা-মা আর বোনের জন্য। এই ফাঁকে নিজেদের জন্যও জম্পেশ কেনাকাটা করছে ননদ ভাবী। নিশাত -নাজমুল, নোমান-আসিফ-আদনান, তিতির, বাচ্চাদের জন্য কেনাকাটা হয়েছে। তিতিরের শরীর আর মনের যে অবস্থা, তাতে তার শপিং করার প্রশ্ন উঠেনা। তবু তার মন রক্ষার জন্য তাকে মার্কেটে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলো সবাই কয়েকবার।অন্ততঃ অজন্তার জিনিসপত্র কেনার জন্য।
“শাশুড়ি বৌয়ের জিনিস পছন্দ করে কিনবে।শাশুড়ি ই তো মেইন ” এমন মন রাখা কথাবার্তা বলা হয়েছে তিতিরকে। তিতির বলেছে, ” আমি চিন্তা করে, গুছিয়ে কোন কাজ এখন করতে পারিনা। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। তোমরা অজন্তাকে দেখেছো ভিডিও কলে অনেকবার, কথাও হয় নিয়মিত, কিসে ওকে মানাবে, ওর কি পছন্দ , তোমরাই ভালো বুঝবে।”
” অজন্তা তোমাকে ফোন করেনা ভয়ে। কিন্তু আমাদের কাছ থেকে রেগুলার তোমার খবর নেয়। ”
“কিসের ভয়ে? আর বাবা-মা’কে, তোমাদের , আসিফকে ফোন করতে তো ভয় পায়না।তাহলে আমাকে ভয় কেন? ”
“শাশুড়ি আম্মা বলে কথা।তুমিওতো ফোন করতে পারো।”
“ছেলে চারটা বছর হলো আমার সাথে কথা বলেনি, আমার মুখ দেখেনি। আমার অপরাধ, আমি তার কথামতো চলিনি, তার বাবাকে তার অর্ডার মতো ডিভোর্স দিইনি, তাকে জঘন্য নোংরা কথা বলা মেয়েটাকে আমি আলাদা করে শাস্তি দিইনি, ওকে কয়টা চড় লাগিয়ে বলিনি যে কেন আমার ছেলেকে এতো কুৎসিত কথা বলে ছেলের মনোজগৎ এলোমেলো করে দিলো। আমি আমার ছেলের কাছে মস্ত অপরাধী। বৌকে নিজ থেকে ফোন করি কি করে? আরেকটা কথা। মেয়ের বাবা-মা একবারও ছেলের মায়ের সাথে কথা বলার দরকার মনে করলেননা? ”
লুম্বিনী খরখরে গলায় বললো, ” তুমিওতো আংকেল-আন্টির সাথে কথা বলতে পারতে।নাকি তুমি ছেলের মা, উনারা মেয়ের মা-বাবা, তাই উনাদেরকে সবসময় নতজানু হয়ে থাকতে হবে? যেখানে তাঁদের জামাই নিজের মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখেনা, সেখানে তাঁরা তোমার সাথে আগ বাড়িয়ে কথা কেন বলতে যাবেন? সারাক্ষণ মানুষের খুঁত ধরো কেন? উনারা স্বয়ং জামাইয়ের সাথে খোলাখুলি সব কথাবার্তা বলেছেন, বাবার সাথে দফায় দফায় কথা বলেছেন, তোমার সাথে আলাদা করে কি বলবেন? ”
তিতির চিৎকার করে লুম্বিনীকে বললো, ” আমার সাথে এমন অভদ্র ভাবে আর একটাবার কথা বলবেনা, বেয়াদব মেয়ে। আসলেই আমি অপদার্থ। ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারিনি।”
ব্যাপারটা এতো আকস্মিক আর এতো অস্বাভাবিক, সবাই কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলো। তিতির যে কাউকে কড়া করে কিছু বলতে পারে, এটাই কারো জানা ছিলোনা,আর সেখানে লুম্বিনীকে?
সবার আগে নিজেকে সামলালো আসিফ। বললো, “তুমি লুম্বিনীর কথায় এতো বাজে রি-অ্যাক্ট করলে কেন? সব ব্যাপারে অশান্তি করা তোমার স্বভাব হয়ে গেছে। মা হিসাবে তুমি তো অপদার্থ ই, সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কতোটুকু খোঁজ রাখো ছেলেমেয়ের? সংসারে কোন অবদান তোমার আছে? সেই আদ্যিকালের কথা টানবেনা। গত কয়েক বছর সংসারের কোন্ ক্ষেত্রে তোমার এতোটুকু কনট্রিবিউশন আছে বলো সবাইকে।অসুখতো তোমার মেহমান, আদর করে ডেকে ডেকে আনো, সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমানো আর বাকি সময় কি হলো না হলো এগুলো নিয়ে ঘোঁট পাকানো ছাড়া আর কি পারো তুমি?”
তিতির আসিফের দিকে তাকিয়ে স্হির ভাবে বললো,” অজন্তার বাবা-মায়ের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দেওয়া তোমার দরকার মনে হয়নি?”
“এতোটুকুও না। এখন সেই যুগ না যে সবার সাথে আলাদা করে কথা বলাতে হবে।”
তিতির আর কিছু বললোনা। লুম্বিনী ঝটকা দিয়ে উঠে অন্য ঘরে চলে যেতে যেতে বললো, ” নাটক দেখতে দেখতে চোখ পচে গেলো।”
মেয়ের উপরে জামাই আর তার মেয়ের আক্রমণ নাজমুল -নিশাতসহ পরিবারের কারোর ভালো লাগছিলোনা।
নাজমুল সাহেব বললেন, ” তিতির অসুস্থ। ওর সাথে আমাদের সবারই বুঝে শুনে কথা বলা উচিৎ। ”
আসিফ উত্তর দিলো, ” আমরা যারা ওর সাথে বাস করি, আমরা বুঝি, ওকে মানিয়ে চলা কতো টাফ। সে কতোটা ইররেসপন্সিবল, ননসেন্স। ”
তিতিরের মাথা ঝিমঝিম করছিলো, সারা শরীরে তীব্র অস্বস্তি আর ক্লান্তি, মনে হচ্ছে একটা আঙুল নাড়ানোরও শক্তি নেই, বুকের মধ্যে অসম্ভব ধড়ফড় করছে, ঘুমে চোখের পাতা ভারি হয়ে যাচ্ছে।
তিতলী উঠে যেয়ে লুম্বিনীকে ধরলো, “মা অসুস্থ, তার সাথে এভাবে কথা না বললে হতোনা? ”
“তিতলী আম্মু, অসুস্থতার জন্য মা নিজে দায়ী। মা’কে সব ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। তারপরও মা যদি হাবিজাবি নানা কথা বলে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে চায়, তাহলে কেমন লাগে, বলো? ভাইয়ার বিয়ে হবে, ভাবিটা মনের মতো হয়েছে, সবাই মিলে কানাডা যাবো, কতো আনন্দ লাগার কথা, কিন্তু আমাদের আনন্দে মায়ের বাগড়া মারা চাই। এখন ভেবেচিন্তে বের করেছে,ভাবি কেন ফোন করলোনা, ভাবির বাপ-মা কেন ফোন করলোনা।খুব জটিল মানুষ। ”
“লুম্বিনী, তোরা একে একে সব মায়ের শত্রু হয়ে যাচ্ছিস। মায়ের আদর,ভালোবাসা, তোদের পাখির বাচ্চার মতো আগলে রাখা এগুলোর কথা একটুও মনে পড়েনা? ”
“সেগুলো সাত বছর আগের কথা। ইতিহাস। অরণ্য -অরণীকে পেলেছে অবশ্য এরমধ্যে। আমাদের জন্য কি করেছে?
তিতলী অনেকগুলো পারিবারিক ছবি পাঠালো অজন্তাকে হোয়াটসঅ্যাপে। বেশির ভাগই তিতির আর বুবুনের ফটো। নবজাতক বুবুন মায়ের কোলে, তিতিরের গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল চেপে প্রাণখোলা হাসি হাসছে শিশু আরিয়ান, একটা মাত্র দাঁত, ছোট্ট বুবুনকে চুমু খাচ্ছে মা, ছেলেকে কোলে নিয়ে, জাপটে ধরে তিতিরের কতো ছবি ; নবজাতক জমজ কন্যারা তিতিরের পাশে আর কোলে সাড়ে আট বছরের বুবুন, তিতিরের কোলে মাথা রেখে বুবুন শুয়ে আছে, দুই পাশ দিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে আছে রাজেশ্বরী-লুম্বিনী, পিছন থেকে মায়ের গলা জড়িয়ে ছোট্ট তুতুন। মায়ায় ভরা সব ছবি।
অজন্তা বুবুনকে দেখালো,” আরিয়ান, তিতলী আম্মু পাঠিয়েছে, দেখো। তোমরা সব ভাইবোন দেখি মায়ের অন্ধ ভক্ত। তুমিতো দেখি চুইংগামের মতো সব ছবিতে মায়ের সাথে সাঁটা। তোমরা চার ভাইবোনতো আছোই, ইরফান,আয়মান,অরণ্য, অরণীরও দেখি আমার শাশুড়ি মা ছাড়া চলেনা। শাশুড়ি মায়ের চেহারায় মা,মা ভাব খুব বেশি। I hope, I will be the happiest lady with her.”
নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়ে বুবুন ছবিগুলোর দিকে তাকিয়েছিলো, তারপরে মোহাবিষ্ট হয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকলো। মন দিয়ে, অনেক সময় নিয়ে। মা। চার বছর পরে এই চেহারাটা দেখলো বুবুন। তাও ছবিতে। প্রতিটা ছবির সাথে কতো গল্প জড়িয়ে আছে। মা’কে এই নীল শাড়িটা পরলে খুব ভালো লাগতো বুবুনের। জমজদের জন্মের পরে কি মা এতোটুকু অবহেলা করেছিলো বুবুনকে? একদমই না। বরং আরও বেশি আদর করতো।এই যে, মায়ের পিঠে নয় বছরের বুবুন, ছোটোখাটো মা ঝুঁকে গেছে, তাও মুখ ভরা হাসি। ঐদিন চেঁচিয়ে উঠেছিলেন নানা-বুবু,” তিতির, মাত্র ছয়মাস আগে সিজার হলো, আর এখন তুই বুবুনকে পিঠে নিয়ে আছিস? তুই ডাক্তার নামের অযোগ্য। তোর বিএমডিসির রেজিষ্ট্রেশন বাতিল করা উচিত।”
মা ভাত মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দিতো, সুযোগ পেলেই মায়ের সাথে ঘুমাতো বুবুন, বাবা বিদেশে গেলে তো কথাই নাই। চার ভাইবোনই চলে আসতো মায়ের কাছে ঘুমাতে। ছোটো তিনটাকে নানাভাবে ম্যানেজ করে মায়ের একপাশে গা ঘেঁষে ঘুমাতো বুবুন। এ কি ! মায়ের গায়ের গন্ধটা স্পষ্ট পাচ্ছে বুবুন। মা হাসপাতালে যাওয়ার সময় এক রকম গন্ধ , ডিউটি শেষে ফেরার পরে আরেক রকম গন্ধ, গোসল সেরে বের হলে আবার আরেক রকম ঘ্রাণ। মা যখন ঘরের সালোয়ার কামিজে বুবুনকে গ্রামার বুঝাতো, সেই ঘ্রাণটা পাচ্ছে বুবুন। শিউলি শিউলি গন্ধ। হঠাৎ করেই মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো বুবুনের।
অজন্তা নরম গলায় বললো, ” আরিয়ান, তুমি আসলে মা’কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো। কিন্তু ওই প্রস্টিটিউটের কথায়-কাজে,বাবার আকষ্মিক অন্য চেহারার পরিচয় পেয়ে, রাগে-ঘৃণায়-কষ্টে তোমার ব্রেইনে জট পাকিয়ে গেছে।অন্য কারোর উপরে রাগ ঝাড়ার সুযোগ ও সাহস তেমন না পাওয়ায় তোমার সব রাগ যেয়ে পড়ে নিরীহ মায়ের উপর।অথচ তোমার মা রাইট ডিসিশন নিয়েছিলেন। দেখো, বাবা- মা আলাদা না হয়ে যাওয়ার জন্য লুম্বিনী, তুতুন এখন কতো আনন্দে আছে। তুমি যতোই মুখ গোমড়া করে রাখো, বাবার ভালোবাসা, মনোযোগ, সাপোর্ট সব পাচ্ছো তুমি। তোমাদের আনন্দ, ভালো থাকার জন্য তোমার মা নিজেকে কোরবানি দিয়েছেন।তুমি সাইকোথেরাপি রেগুলার নাও আরিয়ান।
অজন্তাকে কখনোই বলেনা বুবুন কতো রাত তার বিনিদ্র কাটে।একদম একা থাকলে তখন চোখে, মনে থেকে থেকে কেবলই মা। ভাবতে না চাইলেও।মায়ের আদর,মায়ের শাসন, মায়ের হাসি, মায়ের কান্না। প্রায় রাতে চোখের লোনা পানিতে বালিশ ভেজে।সবার জন্যই খারাপ লাগে, বিশেষ করে রাজেশ্বরী আর মা। এতো উল্টোপাল্টা, বাজে এবং পাগলামি আচরণ করেছে বুবুন মায়ের সাথে, এখন ইচ্ছা করলেও বোধহয় মায়ের দিকে তাকাতে, মায়ের সাথে কথা বলতে পারবেনা বুবুন। ভীষণ অস্বস্তি লাগে। আবার আচমকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড রাগ হয়, ভয়ংকর রাগ। সেটা নির্দিষ্ট কারোর ওপরে না হলেও ঝাপটাটা একমাত্র মায়ের উপর দিয়েই যায়।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৫৩
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
বুবুনের বিয়ে হয়ে গেলো ধুমধাম করে। তিতিরের অনুপস্থিতিতে। কানাডা যাওয়ার তিনদিন আগে তিতির বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লো। বুকে তীব্র ব্যথা, বমি। হার্টের সমস্যা মনে করে সব পরীক্ষা করা হলো। না, হার্টের সমস্যা নয়। অতিরিক্ত এসিডিটি হয়েছিলো, এ ছাড়া আর কি হতে পারে? নাজমুল -নিশাত থেকে যেতে চাইলেন। আসিফসহ সবাই বললো,” আপনারা থেকে কি করবেন? আপনাদেরই সেবার দরকার। এখানে কোনো একটা সমস্যা হলে আপনারা সামাল দিতে পারবেন,নিজেরাই চিন্তা করে করে বলেন।তাছাড়া বুবুন খুবই হার্ট হবে। সব মিলে পাঁচ দিনই তো মেয়ে ছাড়া থাকবেন। টিকিট কাটা হয়েছে, আপনারা না বলবেননা।”
তিতলী বললো,”আমি থেকে যাই।” সবাই হাঁ হাঁ করে উঠলো।মা যাচ্ছনা, আবার মাতৃসমা খালাও যাবেনা? বুবুন -অজন্তা দু’জনেই গভীর আঘাত পাবে। আসিফ বললো,” প্লিজ, সবাই একটু বুঝার চেষ্টা করুন।সব প্রোগ্রাম সেট হয়ে গেছে। সেট করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে আমাকে। মাত্র পাঁচ দিনের জন্য আমরা যাবো, পাঁচ দিনে কি হবে? শক্তপোক্ত কোনো নিজের লোককে রেখে যাবো, ময়না খালা আছেন, ড্রাইভাররা সারাদিন থাকবে,নেবাররা খুবই ভালো। “যাবোনা “,এই কথাটা দয়া করে কেউ বলেননা।”
একজন ঘাড় শক্ত করে নিজের অবস্হানে অটল রইলো। তুতুন। মা’কে ফেলে সে কিছুতেই যাবেনা। মায়ের ওষুধের দেখভাল সে-ই করে, এতো ওষুধ ! কলেজে যাওয়ার আগে সে মা’কে ওষুধ খাওয়ায় নিজের হাতে, দুপুরের ওষুধগুলো একটা কৌটায় ভরে রেখে যায়, রাতেরটা আবার নিজের হাতে খাওয়ায়। আসিফ আর লুম্বিনী প্রথম থেকেই আড়ালে বলেছিলো তুতুনকে, ” মা নিজেই একজন ডাক্তার।ওষুধ পত্র ভালোই বুঝে। এতোকাল নিজের ওষুধ নিজেই খেয়েছে। তুমি যদি মা’কে বাচ্চাদের মতো মেডিসিন দাও, তোমার মা ভাববে তার বোধহয় দিন শেষ। তাছাড়া নিজের ওষুধ নিজে নিয়ে খেলে সেল্ফ কনফিডেন্স থাকে। তোমার মায়ের বরং অনেক কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকা উচিত, তার শরীরের রোগ যতোটা, তার চেয়ে মনের অসুখ অনেক বেশি। ”
“কিন্তু বাবা, মা প্রায় ওষুধ মিস করে।”
“কেন করবে? সে কি প্যারালাইজড? হাত-পা নাড়াতে পারেনা? তাকে আরও অথর্ব কোরনা তুতুন।”
তবু তুতুন নিজের মতো করে মা’কে ওষুধ দিয়েছে। প্রতিটা দিন কমপক্ষে এক ঘন্টা সে মায়ের সঙ্গে কাটায়। মা অবশ্য কথা বলে খুবই কম,সত্যি বলতে কি, লুম্বিনী -তুতুনের বয়সী কোন বাচ্চার পক্ষে এতো চুপচাপ মানুষের পাশে সময় কাটানো কঠিনই বটে। তবু তুতুন থাকে, তার কলেজের গল্প করে, দুনিয়ায় কতো কিছু হচ্ছে , কোন দেশের সাথে কোন দেশের যুদ্ধ হচ্ছে, ফিলিস্তিনকে রক্ষা করার জন্য কেন জাতিসংঘ উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছেনা, তুতুনের জীবনের লক্ষ্য কি, এসব বিষয় নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলে। এক পাক্ষিক কথা।মায়ের কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে গল্প করে তুতুন, মা চুপচাপ তুতুনের মাথায়, মুখে হাত বুলাতে থাকে।
তুতুন যাবেনা শুনে খুবই অশান্তি সৃষ্টি হলো। আসিফের সব রাগ মায়ের উপরে পড়তে যাচ্ছে দেখে তুতুন যেতে রাজি হয়ে গেলো। ঠিক হলো, তিতিরের খালাতো বোন তন্দ্রা আপা, তাঁর ছেলে আর বৌমা এসে এখানে থাকবে।তন্দ্রা আপা বিধবা হয়েছেন বছর তিনেক হলো, ছেলে গত বছর ডাক্তার হয়েছে, বৌমাও, ইয়ারমেট তারা, এখন ইন্টার্নশিপ চলছে।
বুবুন কতোবার যে মায়ের সাথে কথা বলার জন্য মোবাইল হাতে নিয়েছে। কিন্তু কথা বলতে পারেনি। কি যে মারাত্মক আড়ষ্টতা ! এই মায়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতো বুবুন। অজন্তারও একই অবস্থা। হবু নানা শ্বশুর,নানি শাশুড়ি, শ্বশুর,খালা শাশুড়ি, মামি শাশুড়ি, দেবর ননদদের সাথে টরটর করে কথা বলতে পারলেও নিজের শাশুড়িকে ফোন করতে তার ভারি সংকোচ। কিছুটা ভয়, কিছুটা দ্বিধা। ইনি বুবু,নানাভাই, তিতলী আম্মু, মামিমনির মতো একদমই হাসিখুশি নন, আর কথা প্রায় বলেননা বললেই চলে। ভুল হয়েছে অজন্তার, অজন্তা নিজেই ভাবে।সবার আগে আরিয়ানের মা’কে ফোন করা উচিৎ ছিলো। তাহলে আস্তে আস্তে তিনি হয়তো সহজ হতেন অজন্তার সঙ্গে। এখন কেমন ব্যবহার করবেন, কতোটা শীতল, কে জানে !
শেষে দু’জন মিলে ঠিক করলো, আর এখন ফোন কটার দরকার নেই, মা তো আসছেনই। অজন্তা প্রথম থেকেই শাশুড়ির দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিবে। যদিও অজন্তার মা বলেছেন, ” সবাইকে সম্মান করবে, কথাবার্তা বলবে, তবে মেপে মেপে। আদিখ্যেতা করবেনা একদম। আর তোমার শাশুড়ি মানুষটাকে আমার সুবিধার মনে হচ্ছেনা। ক্রিটিকাল ক্যারেকটার। হাম্বড়া ভাব নিয়ে থাকলে তুমিও তাঁকে এড়িয়ে চলবে। ”
অজন্তা বলেছিলো,” আরিয়ানের মা খুবই ভালো।সবাই বলে? ”
“কারা বলে? ”
” আরিয়ানের নানা-নানি, খালা, কাজিনরা।”
“হাসালে অজন্তা। উনারা উনাদের মেয়ের সম্পর্কে খারাপ কথা বলবেন? তাও হবু বৌকে? আর অজন্তা, আবারও বলছি, ক্যারিয়ারের সাথে কোনো আপস না। সাতদিন বাংলাদেশে থাকার কথা ঠিক সাতদিনই থাকবে।কারোর কোনো রিকোয়েস্ট শুনবেনা। এমনিতেই সাত দিনে রিসার্চের অনেক ক্ষতি হবে। আরিয়ানাকে সামলানোর দায়িত্ব তোমার। তাকেও যথাসময়ে ফিরে আসতে হবে। ”
অজন্তার মা ভীষণ ক্যারিয়ারিস্ট ছিলেন। অজন্তার ছোটোবেলায় শ্বাসকষ্ট ছিলো। ওরা বড় হয়েছে চাইল্ড কেয়ার হোমে। স্কুলের সাথেই হোম। ভোরে সেখানেই সাড়ে চার বছরের অজন্তা বর আড়াই বছর বয়সী ছোটো বোনটাকে রেখে আসতেন কোনোদিন বাবা, কোনোদিন মা। ওখান থেকেই স্কুল আসা যাওয়া করতো অজন্তা। রাত নয়টায় আবার বাবা বা মা এসে তাদের নিয়ে যেতেন বাসায়। সকাল আর রাতে দোকানের খাবার খেতে হতো। দুপুরে আর বিকেলে চাইল্ড কেয়ারের হোম মেড ফুড। রবিবার অনেক বেবি আসতোনা হলি ডে বলে, কিন্তু অজন্তাকে বোনসহ যেতে হতো।
একবার কি কারণে যেন মায়ের ভার্সিটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন মা দুইবোনকে। গাড়িতে দুই মেয়েকে লক করে রেখে মা চলে গেলেন তাঁর কাজে। কিছু শিশুতোষ বই আর খেলনা রেখে গেলেন গাড়িতে।এক ঘন্টার মধ্যে আসার কথা, দুই ঘন্টা কেটে গেলো,মায়ের আসার নাম নেই। বদ্ধ গাড়িতে এতোক্ষণ এসিতে থেকে অজন্তার শুরু হলো শ্বাসকষ্ট। এদিকে গাড়িতে ইনহেলার নেই। বাসাতে একটা আছে, আর চাইল্ড কেয়ার হোমে একটা রাখা আছে।হোমে নিয়ম করে সকালে একবার, সন্ধ্যায় একবার অজন্তাকে ইনহেলার দিয়ে দেয়া হতো। ডাক্তারের নির্দেশ এমনই ছিলো। আজ অজন্তার মনে ছিলোনা, বাবা-মাও মনে করে ইনহেলার দিয়ে দেননি।
অজন্তা ছটফট করতে লাগলো কষ্টে। গাড়ির জানালায় বাড়ি দিতে লাগলো।ইলোরার অনেকক্ষণ ধরে চিৎকার করে কাঁদছে ক্ষুধায়। আল্লাহর অশেষ কুদরত, ঐ সময়ে গ্যারেজে আসলেন এক গার্ড। মায়ের গাড়ি এবং মা’কে চিনেন তিনি। গাড়ির ভিতরের অবস্থা দেখে তিনি দ্রুত ফোন করলেন মা’কে। মা ছুটে এসে যখন গাড়ির দরজা খুললেন, অজন্তা তখন মৃতপ্রায়। সমস্ত শরীর নীল। ভার্সিটির ছোট ক্লিনিকে নিয়ে যেয়ে অক্সিজেন দেওয়া হলো,ইনজেকশন দিতে হলো। অনেক পরে ধাতস্থ হয়েছিলো অজন্তা। লাইব্রেরিতে পড়তে যেয়ে মায়ের নাকি খেয়ালই হয়নি এতোটা সময় কেটে গেছে।
এই গল্প বুবুনের কাছেও করেছিলো অজন্তা। বুবুন খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলেছিলো, ” অনেক কষ্ট করে এই পজিশনে এসেছেন তোমার মা।আই রেসপেক্ট হার স্পিরিট। ”
“আমি যদি মরে যেতাম ! ”
“ধূর বোকা ! মরা এতো সহজ? আচ্ছা, আংকেল তোমাদের দেখাশোনা করতেন?নাকি আন্টি ঘর সংসার, বাচ্চাকাচ্চা, ক্যারিয়ার সব একসাথে সামলাতেন? ”
“কেউই সংসার সামলাতেননা, রান্নার কোনো অপশন ছিলোনা আমাদের বাসায়। সানডে মর্নিং-এ একজন এসে আমাদের সারা বাড়ি, ফার্নিচার ক্লিন করে যেতেন। আমার সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমি আর ইলোরা হোমে থাকতাম, যেমন তোমাকে বলেছি। সাতের পরে ওখানে থাকা যায়না। তখন স্কুল শেষে আমি স্কুল বাসে বাসায় ফিরতাম। আমাকে আলাদা চাবি দেওয়া হয়েছিলো। বাসায় আমি একা রাত নয়টা -দশটা পর্যন্ত একা থাকতাম। ক্ষুধা লাগলে ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে খেতাম কর্নফ্লেক্স দিয়ে, কিংবা ব্রেড-বাটার। এই তো! এইভাবে আমাদের দুই বোনের লাইফ কেটেছে। স্বজনহীন,বন্ধুহীন অবস্থায়। বাবা-মা আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতেননা কোথাও, বাসায় গেস্ট আসা পছন্দ করতেননা, আমার নানা-নানু সবসময় বড় খালার কাছে থেকেছেন, দাদা-দাদুকে থাকতে হয়েছে মেজ চাচুর কাছে। কারোরই এখানে মাসে একবার আসার সাহসও হতোনা।পৃথিবীর সব ডিগ্রি যখন তাঁরা নিয়ে ফেললেন, তখন আমরা নরমাল লাইফ পেলাম।”
” এমন না করলে তাঁরা এই পজিশনে আসতেন কি করে? ”
“এই পজিশনে এসে না হয় আমাদের জন্ম দিতেন। আমি কিন্তু পিএইচডি শেষ করার পরে বাচ্চাকাচ্চার কথা ভাববো। আমরা দুইবোন যে কষ্ট পেয়েছি, তা আমাদের বাচ্চাদের দিবোনা।”
অজন্তার শ্বশুর -শাশুড়ির সমস্যার জন্য এখন বৌভাত হবেনা। তাঁরা এখন দেশে যেতে পারবেননা। শীত পরলে যাবেন। ছয়মাস পরে, তাঁদের আত্মীয় স্বজনসহ। এবারে দেশে ফেরার দুইদিন পরে বুবুনের রিসেপশন। সব আত্মীয় স্বজন,বন্ধু, প্রতিবেশি, কলিগ, প্রায় পাঁচ হাজারের জন্য আয়োজন।
বরযাত্রীদের রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে স্বয়ং বর এসেছে, বুবুন। আরও এসেছেন অজন্তার বাবা-মা-বোন –
চলবে।