সংসার পর্ব-৫৪+৫৫

0
41

#সংসার
পর্ব ৫৪
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

বুবুনের বিয়ের পরের দিন দুপুর। আগামীকাল ভোরে দেশে রওনা হওয়ার ফ্লাইট। ছেলের বিয়ের প্রোগ্রাম শেষ করে আসিফ ফোন দিয়েছিলো তিতিরকে। নো রেসপন্স। হয় রাগ দেখিয়ে ধরছেনা, নয়তো ঘুমাচ্ছে। নাজমুল সাহেব, নিশাত মেয়েকে ফোন করতে গেলে তিতলী বললো, “আপাকে ফোন করেছিলাম। মাথাব্যথা হচ্ছে দেখে তেমন কথা বলেনি। হয়তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। আমাকে বললো সুস্থ হয়ে নিজেই ফোন করবে।”

“সে তো বেশ আগের কথা। এখন আবার ফোন করি, মাথা ব্যথা কমলো কিনা। ঘুম থেকে উঠলো কিনা, কিছু খেলো কিনা।”

নিশাত ফোন করতে গেলেন, তখনই আসিফের মোবাইলে ফোন আসলো। তন্দ্রার নম্বর হতে। আসিফ বললো, “তন্দ্রা আপার ফোন। মা,আগে শুনে নিই কি খবর। আপনার মেয়েকে পরে ফোন করেন। ”

ফোন নিয়ে আসিফ ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

“হ্যালো।”

” ডঃ আসিফ বলছেন? ” অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ।

“বলছি। আপনি কে? ”

” আমি আপনার থানার ওসি। আপনি কি এখনো কানাডায়? ”

” ইয়েস। আগামীকাল ভোরে ফ্লাইট। কিন্তু ঘটনা কি? ”

” স্যাড নিউজ ডঃ আসিফ। Your wife is no more. আনুমানিক ১৬-১৭ ঘন্টা আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বাসায় যাঁরা ছিলেন, ডেডবডি আবিস্কার করতে তাঁরা অনেক দেরি করেছেন। কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়ে আমরা এসেছি।”

আসিফের হাত পা কাঁপছিলো। সে বারান্দায় রাখা সোফায় বসে পড়লো।

“ডঃ আসিফ? ”

“বলুন।”

“আপনার ওয়াইফের নাক কান দিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। মেঝেতে বমি । ওষুধের পাতা,ওষুধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পোস্ট মর্টেম না করে উনার মৃত্যুর কারণ বলা যাচ্ছে না। আপনি কোনোভাবে আজকের ফ্লাইটের টিকেট ম্যানেজ করে চলে আসতে পারবেন? বডি মর্গে নিবো, যদি পারমিট করেন। মরচুয়ারির ফ্রীজে রেখে দিবো, আপনারা কেউ আসলে পোস্ট মর্টেম হবে। ”

আসিফ কিছু বলতে পারছিলোনা। তিতির নেই? তিতির যে কোনো সময় নেই হয়ে যেতে পারে, হঠাৎ হঠাৎ আসিফের এমন যে মনে হয়নি, তা নয়। বিশেষ করে হার্টে স্টেন্টিং করার সময়। কিংবা হঠাৎ হঠাৎ কোটরাগত দুটি অনুজ্জ্বল চোখ, শুকিয়ে ছোটো হয়ে যাওয়া ভাবলেশহীন মুখ দেখে মনে হতো, এভাবে চললে তিতির আর বেশিদিন নেই। ওই মনে হওয়া পর্যন্ত ই। কিন্তু তিতির নেই? এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন?

“ডঃ আসিফ। আমি আপনাকে পারসোনালি খুব ভালো করে চিনি। আমার মায়ের রেকটাল ক্যান্সারের অপারেশন আপনি করেছিলেন। সাত বছর আগে। আমার মা এখনো ভালো আছেন আল্লাহর রহমতে, আপনার অসাধারণ হাতের যাদুতে, আপনার পরামর্শে। আমার ওয়াইফের হাইডাটিড সিস্ট আপনি অপারেশন করেছিলেন। আমার ক্লোজ রিলেটিভদের সাতজনের অপারেশন আপনার হাত দিয়ে হয়েছে। অল ইজ ওয়েল।আপনার ব্যবহারেও আমরা সবাই হাইলি স্যাটিসফাইড।শুধু আমরা কেন, সারা দেশের মানুষ চেনে আপনাকে। আমরা মিডিয়াকে কিছু জানতে দিইনি বা দিবোনা। স্যার, ম্যাডামের বডি এভাবেতো রাখা যাবেনা।আপনারা না পৌঁছানো পর্যন্ত আমরা ম্যাডামকে ঢাকা মেডিকেল বা পিজির মর্গে রাখি। Control yourself, sir. ”

আসিফ বোধশূন্য হয়ে পড়েছিলো। কাঁধে কার হাত পড়লো।আদনান।

” কি হয়েছে দুলাভাই? আপা কেমন আছেন? ”

আসিফ আদনানের হাত আঁকড়ে ধরলো, ” আদনান, তিতির নেই। তিতির মরে গেছে।”

“What? Are you joking? ”

” পুলিশ তিতিরকে মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেডি। তিতির বাসা থেকে বের হয়ে যাবে চিরকালের জন্য তার নিজের বাড়ি হতে, বিদায় দেওয়ার জন্য আমরা কেউ নেই। আদনান, I’m feeling very sick. আমার মাথায় কিছু আসছেনা। আমার ছেলেমেয়েগুলোকে জানাবো কিভাবে? ”

হতভম্ব আদনান দেখলো দুলাভাই ঘামছেন খুব। এই ঠান্ডাতেও। মুখ ফ্যাকাসে। দুলাভাইয়ের আবার কোনো সমস্যা না হয়। আদনান আসিফের হাত ধরে বললো, “I will manage everything. আপনি শান্ত হন। আপনার রুমে শুয়ে পড়ুন। কাউকে আপনার কিছু বলার দরকার নেই। ”

আদনান আসিফকে তার রুমে পৌঁছে দিলো। তিতলীকে ডেকে বললো, “দুলাভাই খুব অসুস্থ বোধ করছেন। আমি উনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি। তুমি এখান থেকে এক পা’ও নড়বেনা। ”

লবিতে যেয়ে আদনান সবাইকে বললো, ” আপার সাথে কথা হয়েছে। ভালো আছেন মোটামুটি। বাসায় অনেকে আছেন। আপার প্রপার কেয়ার হচ্ছে। আপাকে নিয়ে চিন্তা করেননা। দুলাভাই আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খুব। আমি হোটেল অথোরিটিকে ইনফর্ম করতে যাচ্ছি। আপনারা দুলাভাইয়ের দিকে খেয়াল রাখেন। ”

লুম্বিনী, তুতুন, ইরফান প্রায় দৌড় লাগালো আসিফের রুমের দিকে। নাজমুল সাহেব আর নিশাতও অস্হির হয়ে রওনা হলেন আসিফকে দেখার জন্য। আদনান নোমান -তমাকে আটকালো। প্রথমে গেলো হোটেল অথোরিটির কাছে। উনারা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করলেন। আসিফকে নিয়ে আদনান, নোমান, তমা রওনা হলো একটা প্রাইমারি ক্লিনিকে। বুবুন -অজন্তা বাসায়।ওদের কিছু জানানো হলোনা। আসিফের ভাইবোনেরা গেছে শহরে ঘুরতে।

ইসিজি করা হলো, দরকারী পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো। প্রেশারটা বেশ হাই, যদিও আসিফের হাই প্রেশার ছিলোনা, পাল্স দ্রুত, হার্টে অল্প ইশকেমিক চেঞ্জ আছে। ওটা ঢাকা যেয়ে এভালুয়েট করা যাবে। মেজর কিছু না। এখন দরকার কমপ্লিট রেস্ট।

ওহ্, শান্তি। নোমান -তমা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আর ফেরার পথে আদনানের মুখে শুনলো সেই ভয়ংকর সংবাদ।

আসিফের চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি পড়ছিলো। নোমান পাথর হয়ে গেলো শোকে। তমা কাঁদছিলো।

আদনান বললো, ” যতো কষ্ট হোক, এখন আমাদের এই চারজনকে শক্ত থাকতে হবে। বাবা-মা’কে খবরটা জানাতে হবে খুব সাবধানে এবং ডাক্তার হাসপাতালের ব্যবস্থা করে। ওদের তিন ভাইবোনকে ট্যাকল করতে হবে খুবই সাবধানে, বিশেষ করে তুতুনকে। তিতলী এবারে কাউকে সামলাতে পারবেনা, বরং ওকে সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। ও বোনকে পাগলের মতো ভালোবাসে। ”

নোমান মূর্তির মতো বসেছিলো। আদনানের কথা শুনে বললো, “তিতলী বোনের শোক সামলাতে পারবেনা, আমারও কি বোন মরে যায়নি?আমার কোন দুঃখ -কষ্ট বোধ নেই, তাইতো? ”

” ভাইয়া, আপনার উপরে এখন অনেক দায়িত্ব। আপনাকে কাবু হলে চলবেনা। আমরা সবাই ব্যাকুল হয়ে গেলে আরও ধাক্কার জন্য তৈরি থাকুন। বাবা-মা-তুতুন। বাংলাদেশে না পৌঁছানো পর্যন্ত কেউ যেন কিছু জানতে না পারে।”

নোমান হুহু করে কাঁদছিলো। তিতির এখন মর্গে? ওহ্,কি কষ্ট।

বাবার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছে বুবুন -অজন্তা। অজন্তার বাবা মাও এসেছেন। আদনান বললো, “ভয়ের তেমন কিছু নেই। তবে এখন কমপ্লিট রেষ্টের দরকার। ঘুমের দরকার দুলাভাইয়ের। আমরা বরং দুলাভাইকে ঘুমাতে দিই। ইরফান, আমি, তিতলী পালা করে পাহারা দিবো।” নাজমুল -নিশাতও জামাইয়ের ঘরে বসে থাকলেন অনেকক্ষণ। নিশাত জামাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। আসিফ নিজেকে সংযত রাখার প্রাণপন চেষ্টা করেও পুরোপুরি সফল হলোনা। তার দু’চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

নিশাত উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” কি হয়েছে বাবা? তুমি কাঁদছো? কি হয়েছে? ”

আসিফ ভাঙা গলায় বললো,” আপনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, রাজের কথা মনে পড়লো মা। ”

আদনান অজন্তার বাবা -মা’কে একান্তে ডেকে বললো, ” আপনারা বুবুনের মায়ের অসুস্থতার কথা বিশ্বাস করেননি। তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা আপনারা বলেছেন, রাগী-জেদি -ইগোইস্টিক -অ্যাটেনশন সিকার, ব্লা, ব্লা, ব্লা। বুবুনের মা অসুস্থতাজনিত কারণে মারা গেছেন। ”

অজন্তার বাবা-মা চমকে উঠলেন ভীষণ। আদনান বললো, “আমরা খুব ক্রিটিকাল পিরিয়ডের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা দু’জন যা শুনলেন, সেটা আমরা কাল রওনা হওয়ার আগ পর্যন্ত কাউকে জানাবেননা, আমার এই আবেদন রইলো।”

অজন্তার মা বললেন, ” এই অবস্থায় আরিয়ান -অজন্তার যাওয়ার দরকার নেই। ”

আদনান গলা চড়িয়ে বললো, “কেমন করে এই কথা আপনি বলতে পারলেন? আপনি মেন্টালি স্টেবল তো? ”

“আরিয়ান আর ওর মায়ের সম্পর্ক তো ভালো ছিলোনা। আমার মেয়ে যেয়েই এমন পরিস্থিতিতে পড়বে? ”

“পড়বে।সে এখন আমাদের পরিবারেরও সদস্য। আর আমরা চলে যাওয়ার পরে দয়া করে আপনাদের রিলেটিভসদের অবশ্যই বলে দিবেন, না জেনে কোনো মন্তব্য করতে নেই। বুবুনের মা যে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, মরে তিনি তার প্রমাণ দিলেন।”

আসিফ প্লেনের সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে, চোখ বন্ধ করে। দুঃসহ কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে? বহু বছর এক সাথে থাকার জন্য? তিতিরের প্রতি নিজের গভীর ভালোবাসার কারণে ? ভালোবাসাটার গভীরত্ব আগে বুঝেনি সে। সম্পর্ক শীতল ছিলো শেষের অনেকগুলো বছর, কিন্তু শীতলতা তো তিতিরের পক্ষ থেকে ছিলো। আসিফ কখনো ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি তিতির মরে যাক বা তিতিরের এতোটুকু ক্ষতি হোক। হাসপাতাল, সেমিনার, তিন ছেলেমেয়ের মঙ্গল নিয়ে চিন্তা ও কাজ করা, “রাজেশ্বরী আরোগ্য নিকেতন ” নিয়ে নানা প্ল্যান, আর্কিটেক্ট -ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে মাঝেমধ্যেই মিটিং, এতো কাজের মধ্যে তিতিরকে নিয়ে ভাবার সময় ছিলোনা।ভেবেই বা কি করবে? আসিফের সাথে কথা না বলতে পারলেই যেন তিতির বাঁচে। কম ক্ষমা চায়নি আসিফ তিতিরের কাছ থেকে। পা পর্যন্ত ধরেছে তিতিরের।কাছে টানতে চেয়েছে, তিতির কাছে আসার বদলে আরও দূরে চলে গেছে, দেশে বিদেশে ঘুরতে যাওয়া,বাইরে খেতে যাওয়া, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে যাওয়া…সব অফার ফিরিয়ে দিয়েছে তিতির। আর কি করতে পারতো আসিফ? তবু বুক ভেঙে যাচ্ছে, এতো কষ্ট নিতে পারছেনা আসিফ। নাকি তিন সন্তান বিশেষ করে তুতুনকে কি করে সামলাবে, ছোটো দু’জনকে মানুষ করবে কে, ঘরে কর্ত্রীর অভাব, এই যে যেয়েই মর্গ, পোস্ট মর্টেম, কাফন দাফন নিয়ে দৌড়ানো, এতো কিছুর জন্য মেন্টাল প্রেশারটাকে ভালোবাসা বলে ভ্রম হচ্ছে?

তুতুনের খুব অস্হির লাগছে।অজন্তা সহ সব ভাইবোন একসাথে বসেছে, আড্ডা হচ্ছে , হাসাহাসি হচ্ছে, কিন্তু তুতুনের কিছু ভালো লাগছেনা। সময় যেন যাচ্ছেইনা। কখন মা’কে জড়িয়ে ধরবে তুতুন, তার জন্য অধীর হয়ে আছে ছেলেটা?

লুম্বিনী খুব মজা করেছে এই ক’দিন, এখনো করে যাচ্ছে। এইটুকু জীবনে মেলা কষ্ট দেখে ফেলেছে লুম্বিনী। নিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষ, যার সাথে মায়ের পেটে বেড়ে উঠেছে লুম্বিনী, যে ছিলো চব্বিশ ঘন্টার সঙ্গী, সেই বোনকে হারানোর ব্যথা যে কি দূর্বিষহ ছিলো, তা লুম্বিনীর মতো করে কেউ বুঝেনি। চব্বিশ ঘণ্টা কি দুঃসহ যন্ত্রণা। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। বাড়িতে সবসময় শোকের পরিবেশ। যারা হাসি তামাশা করতো, অভিনয় করতো। ভাবতো,লুম্বিনী তাদের অ্যাকটিং ধরতে পারছেনা। রাজের জন্য এখনো খুব কষ্ট হয় লুম্বিনীর, কিন্তু বোনের কথা মন থেকে জোর করে সরিয়ে রাখে সে। তারপরে গায়ে গরম তেল পড়া, এখনো শরীরের কোন কোন জায়গায় চামড়ায় টান ধরে। আর তখন যে শারীরিক যন্ত্রণা হতো, তা মনে হলেই কেঁপে উঠে লুম্বিনী। মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করে , এমন কষ্ট পৃথিবীর কেউ যেন না পায়। চরম আঘাত আসে বাবার কাছ থেকে। বাবার প্রেম, দ্বিতীয় বিয়ে, ভাইয়ার উন্মত্ত আচরণ, মামলা, কি ভয়ংকর মানসিক চাপ! তখন সবসময় মরে যেতে ইচ্ছা করতো লুম্বিনীর।এখন আর সে কষ্ট করতে চায়না।ভাইয়া দূরে থাকায় কষ্ট লাগে বটে, তবে দিনের মধ্যে কয়েকবার কথা হয় তার সাথে। রইলো বাকি মা। এই মহিলা কিছুতেই আগের মতো হতে পারলোনা। মায়ের কল্যাণে এখনো বাসার মধ্যে দমচাপা ভাব। মা সবসময় একটা দুঃখের বলয়ের মধ্যে থাকতে ভালোবাসে, এটা ভাবেনা, লুম্বিনী আর তুতুনের একটা নির্মল, স্বাভাবিক জীবনের দরকার, বাবা-মা-ভাইবোন সহ একটা আনন্দময় পরিবেশ দরকার। মা’কে আনন্দে রাখার চেষ্টা তারা আর বাবা কম করেনি কিন্তু মা আনন্দে থাকতেও চায়না, রাখতেও চায়না। মায়ের অসুস্থতায় খুবই ভেঙে পড়েছিলো লুম্বিনী। স্টেন্টের নামে শরীর হিম হয়ে আসছিলো। যখন সফল ভাবে তিনটা স্টেন্ট লাগানো হলো, ওষুধ খেলে আর মাঝেমধ্যে ফলোআপ করলে ভয়ের কিছু নেই এ কথাটা শুনলো, মায়ের ক্যান্সার বা অন্য কোন জটিল রোগ নেই এ কথাটা জানলো, তখন থেকে লুম্বিনী নিশ্চিন্ত। এখন আনন্দে থাকতে চায় লুম্বিনী যেটা বাবা,ভাইয়া, তুতুন, নানা,বুবু, ইরফানসহ অন্যান্য কাজিনরা দেয়। বন্ধুদের আড্ডাতেও খুব ভালো লাগে লুম্বিনীর। কতো বিষয়ে গল্প হয়, রাজনীতি -সমাজ -খেলার খবর কিছুই বাদ যায়না। সাইকোথেরাপিস্ট ম্যামের কাছেও খুব শান্তি পায় লুম্বিনী। কতো পজিটিভ কথা বলেন ম্যাম, তাঁর আর বাবার মোটিভেশনাল স্পিচ আর ব্যবহারে আজ লুম্বিনী সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, সুখী। রাজের কাছে অনেক আগেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে লুম্বিনী, ” রাজ, আমাকে হাসতে দেখলে, আনন্দ করতে দেখলে, সাজতে দেখলে মন খারাপ করবিনা কিন্তু।বেঁচে থাকতে হলে আমার আনন্দ দরকার। মৃত্যুকে আমার ভয় লাগেনা। কারণ, মৃত্যু মানে তোর কাছে যেতে পারা।তোকে আগের মতোই ভালোবাসি, যতোদিন বেঁচে আছি, একই ভাবে ভালোবাসবো।” আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে লুম্বিনীর। যত্ন করলে কি না হয়? হালকা ছিপছিপে ফিগার, ঘন আর ভীষণ সিল্কি, স্ট্রেইট লম্বা চুল, চকচকে চামড়া, সবাই লুম্বিনীকে ডাকে “চাইনিজ পরী।” চেহারা নিয়ে শিশুকাল হতে কয়েক বছর আগ পর্যন্ত কম কথা হজম করতে হয়নি লুম্বিনীকে…..কাইল্যা, বাঁইট্টা, চুল নাই, ভোঁতা চেহারা, মেয়ে বিয়ে দিতে বাপকে নিঃস্ব হয়ে যেতে হবে, “দ্ আগলিয়েস্ট গার্ল ইন দ্য ক্লাস,” আরও কতো কিছু। এই অবস্থা থেকে বাবা তাকে উদ্ধার করেছেন, নিউট্রিশনিস্টের কাছে নিয়ে যেয়ে, দেশ বিদেশের বিউটি স্পেশালিষ্টদের সাথে পরামর্শ করে, তাঁদের পরামর্শ মতো কাজ করে।

প্লেনে অ্যানাউন্স করছে, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে প্লেনটা। বুবুন হঠাৎ টানটান উত্তেজনা অনুভব করলো। মা,মাটি, মাতৃভূমি।

চলবে।

#সংসার
পর্ব ৫৫
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা

ঢাকার প্রচণ্ড জ্যামেও এক সারিতে আছে গাড়িগুলো। তুতুন ব্যকুলভাবে ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, “আংকেল,মা কেমন আছেন? ”

“ম্যাডাম ভালো আছেন বাবা। কি যেন টেষ্ট করার জন্য ম্যাডামকে হাসপাতালে রাখছে, নাইলে এমনিতে ভালো আছেন। ”

নাজমুল সাহেব, নিশাত,নোমান,তুতুন এক গাড়িতে।

নিশাত বললেন, ” তিতির হাসপাতালে কেন? কবে থেকে? কি হয়েছিলো, সত্যি করে বলোতো বাবা? ”

“আম্মা, বিশ্বাস করেন, ম্যাডামের কোন অসুখ নাই এখন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য উনাকে ঢাকা মেডিকেলে রাখছে।”

“আসিফ কিছু বললোনা তো? ”

নোমান বললো, “বলার মতো হলে নিশ্চয় বলতো। এখন অন্য কথা বলো।”

তুতুন আকুল ভাবে বললো, ” মামা, আগে চলো হাসপাতালে যাই। মা’কে দেখে আসি।”

নাজমুল সাহেব, নিশাতের একই মত।

নোমান মোটামুটি ভালোই অভিনয় করে যাচ্ছে, সে বললো, ” মাথা খারাপ।অজন্তাকে বরণ না করে সরাসরি হাসপাতালে যাওয়া যায়? ওকে বরণ করেই আমরা হাসপাতালে চলে আসবো। তিতির আজই ফিরবে, বড়জোর কাল।”

তুতুন তাও মুখ ব্যাজার করে রইলো। এতো অস্হির লাগছে দু’দিন ধরে! নোমান ভাগ্নেকে বললো, ” তুতুন বাবা, এখন বড় হয়ে গেছিসনা? এ লেভেল ক্যান্ডিডেট। এখন এতো মা পাগলা হলে চলে? তুই তো আর দুই এক বছরের মধ্যে চলে যাবি বিদেশে, পড়ালেখা করতে। কোথায় যাবি? আমেরিকা, কানাডা না অস্ট্রেলিয়া? ”

তুতুন বললো, “আমি দেশেই থাকবো। কোথাও যাবোনা।”

আদনান কানাডা থেকে সব ড্রাইভারদের ইনসট্রাকশন দিয়ে দিয়েছিলো, কি বলতে হবে,কেমন আচরণ করতে হবে।

অ্যাপার্টমেন্ট এসে গেলো। মূল গেইট ফুলে ফুলে সাজানো। ফ্ল্যাটের সামনে বিরাট স্পেস। এতো সুন্দর করে সাজানো, অজন্তা মুগ্ধ হয়ে গেলো।ফুল দিয়ে ডেকোরেশন। বরণ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেলো তিতলী,তমা, আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ স্বজন।ড্রাইভার সাহেবদের মারফত সবাই জেনে গেছে তিতির হাসপাতালে, ভয়ের কোন কারণ নেই। তবু সবার মন খারাপ। ছেলের বৌকে মা বরণ করতে পারলোনা। সবাই নিশাতকে ডাকাডাকি শুরু করলো। শরবত, মিষ্টি , কাবাব খাইয়ে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে আদর করে বুবুন -অজন্তাকে বরণ করা হলো। ভারি সুন্দর সাজানো হয়েছে সমস্ত ফ্ল্যাট , বুবুনের ঘর। মৃত্যুর আগের দিন তিতির সব বুঝিয়ে দিয়েছিলো ডেকোরেটরকে।

ময়না খালা বুবুনকে জড়িয়ে হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। বুবুন আসলে কিংবা বুবুনের সাথে ফোনে কথা বলতে গেলে ময়না খালা এমনই কাঁদেন। আজকে অতিরিক্ত, কারণ বুবুন বৌ নিয়ে এসেছে। সবাই এমনটি ভাবলো।

সকালের নাস্তা শেষে আসিফ ছেলে আর বৌকে শরবত খাওয়ালো, বৌয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো বড় একটা গয়নার বাক্স। ধরা গলায় অজন্তাকে বললো, ” এটা আমি তোমার জন্য স্পেশাল ভাবে কিনে রেখেছিলাম, আমাদের প্রথম বৌমা, তিতির-লুম্বিনী-তুতুনকেও জানাইনি।”

বাক্স খুলে দেখা গেলো, দারুণ সুন্দর একটা হার। খুব দামী,ইউনিক ডিজাইন। লুম্বিনী চেঁচিয়ে উঠে বললো, ” ও বাবা, আমারও এমন একটা হার চাই।”

ঘরে কয়েক মুহূর্ত পিন পতন নীরবতা। রাজের মৃত্যুর পরে লুম্বিনী এই প্রথম বাবার কাছে এভাবে আবদার করলো। সেই ছোট্ট বেলায় যেমন দুই বোন বলতো, ” ও বাবা, আমাদেরও এমন একটা হার চাই।” আসিফ লুম্বিনীকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো।সবাই কান্নার কারণ বুঝতে পারলো, শুধু বুঝতে পারলোনা , এই কান্নার সাথে গোপন গভীর আরেকটা শোক লুকিয়ে আছে।

বুবুনের ঘরে রাজেশ্বরীর বিশাল এক ছবি টাঙানো ছিলো। সেই ছবি তিতির সরিয়ে ফ্যামিলি লিভিং রুমে টাঙিয়েছে। বুবুনের ঘর নতুন করে ডিসটেম্পার করিয়েছে। বুবুন বললো, “রাজের ছবি আমার ঘর থেকে কেন সরানো হলো? ছবিটা আমার তোলা, আমি এনলার্জড করেছিলাম, ওটা আমার ঘরেই থাকবে।”

আসিফ বললো, “আমি এখন তিতিরের কাছে যাচ্ছি। ” তুতুন বাবার হাত আঁকড়ে ধরলো, “আমি তোমার সাথে যাবোই।” নাজমুল -নিশাতও উঠে দাঁড়ালেন, তাঁরা যাবেন। তিতলীও লাফিয়ে উঠেছে। সে যাবে। আসিফ বললো, “বুবুন -অজন্তা,তোমরা? ” অজন্তা ঝট করে উঠে দাঁড়ালো, “জ্বী বাবা, যাবো। ”

এয়ারপোর্টে নেমেই আসিফ ফোন করেছিলো ওসি সাহেবকে।তিনি বলেছেন, ” ম্যাডামকে আমরা উনারই একটা ম্যাক্সি পরিয়ে রেখেছি। উনারই একটা রঙিন বড় ওড়না দিয়ে ঢেকে রেখেছি।আপনি, উনার প্যারেন্টস, বাচ্চারা যেন উনাকে উনার মতো করেই একবার দেখতে পান। আপনাদের দেখার পরপরই পোস্ট মর্টেম শুরু হবে স্যার। ফরেনসিক ডক্টরের সাথে আমি কথা বলে নিয়েছি। পোষ্ট মর্টেমের পরে হাসপাতালেই গোসল করিয়ে কাফন পরানো ভালো স্যার।রিলেটিভস বিশেষত মা,বোন নিজেদের হাতে গোসল করাতে চাইবেন, কিন্তু সেটা ঠিক হবেনা। আপনজনের শরীরের কাটা-ছেঁড়া আর সেলাই দেখা খুব ভয়ংকর ব্যাপার। ”

লুম্বিনী বললো, ” আমি বাসায় থাকি? একটু ফ্রেশ হয়ে নিই? মা’তো ইনশাআল্লাহ আজ বা কাল বাড়ি ফিরবে।”

আসিফ বললো, ” কিন্তু মা তোমাকে দেখতে চাইবে, মামনি।”

এবার আর গাড়ি নয়, ভাড়া করা বিশাল দুইটা মাইক্রোবাস। নোমানের শোক করার অবস্থা নেই। তাকে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করতে হচ্ছে। বাবা-মায়ের জন্য ভয়ংকর দুশ্চিন্তা তাকে জাঁকিয়ে বসেছে। সে বাবা-মায়ের সাথে একই সিটে বসেছে। আসিফ ঢাকা মেডিকেলে একটা ভিআইপি কেবিন বুক করে রেখেছে।

আসিফ শক্ত করে জড়িয়ে আছে তুতুনকে। লুম্বিনী বসেছে ভাই-ভাবির সাথে।

অন্য মাইক্রোতে আদনান, তিতলী, তমা, তিতিরের খালা, তিতিরের নয়নমনি ইরফান, আয়মান, অরণ্য, অরণী। উদ্দেশ্য, তিতলীকে সংবাদ জানানো ও ম্যানেজ করা।

গাড়িগুলো থামলো। মরচুয়ারির সামনে কয়েকটা চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে।

নোমান তার বাবাকে, তমা তার শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরলো। চোখ লাল করে ফেলা তিতলী লুম্বিনীর হাত ধরলো। আসিফ শক্ত করে ধরে আছে তুতুনকে। আদনান দাঁড়ালো বুবুন-অজন্তার পাশে।

নিশাত বললেন, “এটা কোন জায়গা? আমরা এখানে কেন? ” সার্জারী বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এসেছেন। তাঁরা স্নেহার্দ্র হয়ে সবার কাছাকাছি রইলেন।

ফ্রিজারের ড্রয়ার খুলে রাখা হয়েছে। শুয়ে আছে তিতির। বন্ধ চোখের পাতা। শান্ত মুখ। গলার নিচ পর্যন্ত একটা সুন্দর নীলচে ওড়না দিয়ে ঢাকা।

নাজমুল সাহেব ডাকলেন, ” ও তিতির! কেমন আছিস এখন? এটা কি যন্ত্র? কি পরীক্ষা হচ্ছে এখানে? ”

তুতুন বাবার হাত ছাড়িয়ে মায়ের উপরে যেয়ে পড়লো। উফ্, কি ঠান্ডা। তুতুন আর্তস্বরে ডাকলো,”মা,মা, আমরা এসে গেছি। ” নিশাতও এসে হাত দিয়েছেন মেয়ের গালে। হিমশীতল। নিশাত জ্ঞান হারালেন, তমা আর কয়েকজন ডাক্তার তাঁকে ধরে ফেললো। অনেক গোপন গোপন খেলা হয়েছে, নোমান আর পারলোনা। বাবাকে জাপটে ধরে সে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। লুম্বিনীকে বুকে জড়িয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকলো তিতলী। তুতুন তখনো মায়ের উপরে পড়ে আছে আর ভাঙা গলায় ডেকেই যাচ্ছে, “তাকাও মা, আমরা চলে এসেছি। ” ইরফান মাইক্রোবাসে খবর শোনার পর হতেই কাঁদছিলো অঝোরে, মাথা ঠুকছিলো সিটে। সে যেয়ে তার তিতিরপাখির কপালে, দুই গালে চুমু খেলো কয়েকটা।তারপরে তুতুনকে জড়িয়ে ধরলো।

লুম্বিনী স্হির দাঁড়িয়ে ছিলো খালার হাতের বেস্টনীতে। তিতলী কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললো,” লুম্বিনী, তুই কি বুঝতে পারছিস না তোর মা আর নেই? তোর মা মরে গেছে। ” লুম্বিনী তাও নড়লোনা। স্হির হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে।

তুতুন জ্ঞান হারিয়েছে। নাজমুল সাহেবের অবস্থা লুম্বিনীর মতো। স্হির,অপলক ভাবে চেয়ে আছেন মেয়ের দিকে। নোমান আর দুইজন ডাক্তার তাঁকে নিয়ে গেলো কেবিনে। ওখানে নিশাত হেলান দিয়ে বসে আছেন। দুইজন ডাক্তার স্বান্তনা দিচ্ছেন তাঁকে। নিশাতের চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় পানি পড়ছে।একজন ডাক্তার বললেন, “খালাম্মা, জোরে কাঁদেন, চিৎকার করে কাঁদেন। ভিতরের কষ্টটা বের হয়ে যাবে তাহলে।কষ্ট চেপে রাখবেননা।”

তুতুনকে বাইরের চেয়ারে বসিয়ে ধরে আছে আদনান। তুতুনের চুল ভেজা, চোখে -মুখে পানি ছিটানো হয়েছে।

সবার সামনে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে আছে দেশের স্বনামধন্য সার্জন । তিতিরের থেকে ছাড়ানো যাচ্ছেনা তাকে।

অজন্তা বুবুনের হাত ধরে আছে শক্ত করে। তার মুখ কান্নায় ভেজা। তার সামনে শুয়ে থাকা মেয়েটাকে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। মুখটা কি মায়াবী। “মামনি” বলে ডাকবে তাঁকে, ভেবেছিলো অজন্তা। ডাকা হলোনা, জড়িয়ে ধরা হলোনা। তাঁর গলার স্বর শোনা হলোনা। তাঁর নাকি অসম্ভব মায়া। বারবার এই মায়ার কথা অজন্তা শুনেছে নাজমুল সাহেব, নিশাত, তমা, তিতলী, ইরফানদের কাছ থেকে। অজন্তাকে তিনি নাকি খুব মায়া করবেন। ভালোবাসবেন মেয়ের মতো। তাঁর মায়াময় শান্ত মুখখানা দেখে অজন্তারই ইচ্ছা করছে “মা ” বলে তাঁর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।

বুবুন দাঁড়িয়ে আছে স্হির। অপলক দেখছে মা’কে। মনে হচ্ছে , একটা পরী ঘুমিয়ে আছে। একটু পরে মায়ের ঘুম ভাঙবে, উঠে খানিকক্ষণ বসে বসে ঝিমাবে, তারপরে ময়না খালাকে চা দিতে বলবে। বাবা মায়ের গায়ের ওড়নাটা সরিয়েছে। হালকা গোলাপি ম্যাক্সিটা দারুণ তো! পায়ের ছোট্ট পাতাজোড়া বের হয়ে আছে, ওই পাতাজোড়া কতোবার বুকে চেপে ধরতো বুবুন, চুমু খেতো। মা বলতো, “পাগলা ছেলে।” এ কি! মায়ের হাত দুটো কি রোগা হয়ে গেছে।

এখন সবাইকে বের হতে হবে। তিতলী বোনকে জড়িয়ে ধরলো, চুমু খেলো পরম আদরে। লুম্বিনীকে বললো, “মা’কে চুমু দাও,মা।” লুম্বিনী রোবটের মতো ঝুঁকে মায়ের কপালে চুমু খেলো, একটা খাওয়ার পরে আরও খেতে ইচ্ছা হলো। সে মায়ের কপাল,গাল, চোখের বন্ধ পাতা, নাক, ঠোঁট, চিবুক, হাতের আর পায়ের পাতায় চুমু খেতেই থাকলো, তারপরে শোয়ার চেষ্টা করলো মায়ের বুকে।

সবাই বের হয়ে গেছে। শুধু বুবুন আর অজন্তা দাঁড়ানো। আসিফ অজন্তাকে বললো,” যাও মা, বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।” অজন্তা বের হয়ে গেলে আসিফ ছেলের হাত ধরে টানলো, “চলো, বাবা।”

বুবুন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।চোখ মায়ের দিকে।কয়েকজন মিলে ধরে ধরে বুবুনকে বাইরে আনলো। বুবুন ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে লাগলো।মা অদৃশ্য হওয়া মাত্র সে আবার সেখানে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হলোনা।

আসিফ, আদনান, আসিফের কয়েকজন কলিগ রয়ে গেলো মর্গে।

নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে হঠাৎ ঝটকা মেরে তিতলীর হাত ছাড়িয়ে লুম্বিনী হরিণের মতো ছুটলো সিঁড়ি বেয়ে। ওর পিছনে দৌড়ালো আরও কয়েকজন।ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার আগ মুহূর্তে ইরফান তাকে জাপটে ধরলো। তমা-তিতলীও পৌঁছে গেছে। ওরাও শক্ত করে ধরলো লুম্বিনীকে।কিন্তু লুম্বিনীর গায়ে তখন অসুরের শক্তি। বহু কষ্টে তাকে নেওয়া হলো বাসায়।

বহুবার বহুজনকে তিতির বলেছিলো, মৃত্যুর পরে ওকে যেন রাজের কবরে দাফন করা হয়। আশেপাশে নয়, একেবারে রাজের কবরেই। একদল চলে গেলো গোরস্থানে।

আসিফের মাঝেমধ্যে সন্দেহ হচ্ছিলো তিতির আত্মহত্যা করেছে কিনা, প্রাথমিক ভাবে জানা গেলো ব্রেইন হেমোরেজ। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে।

শেষ বিকেলে অ্যাপার্টমেন্টের গেট দিয়ে ঢুকলো “লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স “। সামনের সিট থেকে নামলো বিধ্বস্ত আসিফ। কাঁচের ভেতর দিয়ে তিতিরকে এখন ভালো বুঝা যাচ্ছেনা।মুখের খুব সামান্য অংশ দেখা যাচ্ছে। নাজমুল সাহেব আর নিশাতের আর্তনাদে , তিতলী-তমা -নোমানসহ অন্যান্যদের বাঁধভাঙা কান্নায় চারিদিক ভারি হয়ে গেলো।ভীড় আর ভীড়। তিতিরের এতো আত্মীয় স্বজন, বন্ধু, গুণগ্রাহী !

মাগরিবের নামাজের পরে এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তিতিরের চির প্রস্হান ঘটলো সবাইকে কাঁদিয়ে। আসিফ চেয়েছিলো তিতিরকে একটাবারের জন্য বাসায় নিয়ে যেতে।কিন্তু ঈমাম সাহেবসহ অনেকেই নিষেধ করলেন।

দেশে এলে বুবুন রাজের কবর আগে জিয়ারত করে।আজও ইচ্ছা ছিলো, দুপুরের আগেই রাজেশ্বরীকে দেখতে আসবে সে। দুপুরে হলোনা, আসতে রাত হয়ে গেলো।

আজ পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। আকাশ ভরা তারা। ছাতিম ফুলের তীব্র ঘ্রাণ। সুন্দর, ফুরফুরে বাতাসে গাছগুলো দুলছে।

নোমান নামলো কবরে। সবাই বললো, ” বড় ছেলে নামুক।” আসিফ ছেলের হাত ধরে বললো, “বাবা, নামো। মা’কে কোলে নিয়ে আদর করে শুইয়ে দাও।”

পুতুলের মতো বুবুন পিতৃ আজ্ঞা পালন করলো। ফ্লাড লাইট জ্বলছে, চার্জার আছে, সব ছাপিয়ে চাঁদ তার সমস্ত আলো ঢেলে দিচ্ছিলো তিতিরের উপরে।

নাজমুল সাহেব, ইরফান, তিতিরের দুই মামা মিলে তুলে ধরলেন তিতিরকে। পরম ভালোবাসায় সোপর্দ করলেন নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নোমান ও বুবুনের হাতে।

কাজ শেষে নোমান বললো, “আয় বাবা, উপরে উঠি।”

বুবুন চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সবার ডাকাডাকিতেও সে অনড় রইলো যেমনটা করেছিলো রাজের বেলায়।

নোমান উঠলো, জোর করে উঠানো হলো বুবুনকে। মুহূর্তে তিতির আড়াল হয়ে গেলো সারি সারি বাঁশের তলায়। নাজমুল সাহেব এক মুঠো মাটি দিলেন চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে। ডাক পড়লো মৃতার দুই পুত্রের। মূর্তির মতো এসে দাঁড়ালো দুই ভাই। আরিয়ান, আরহাম।মায়ের আদরের বুবুন, তুতুন। মূর্তির মতোই মাটি দিলো কবরে। তারপরে ঝপাঝপ মাটি পড়ার শব্দ। মাটির নিচে শুরু হলো বুঝি মা-মেয়ের লাল-নীল সংসার।

চলবে।