#সংসার
পর্ব ৫৬
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
তিতিরের একটা ডায়েরি উদ্ধার হয়েছে। সযত্নে অতি গোপনে রাখা। নিজের আলমারিতে, কয়েকটা শাড়ির নিচে। ওকে ডায়েরি লিখতে দেখেনি কেউ। বাসায় যখন কেউ থাকতোনা, দরজা বন্ধ করে গোপনে লিখতো।
ডায়েরির প্রথম দিকের হাতের লেখা বেশ সুন্দর। একটু সৌখিনতার ছাপ আছে। কখনো নীল কালি দিয়ে এক প্যারা, তারপরে আবার লাল কালির ব্যবহার। লাল,নীল,সবুজ, বেগুনি, কালো নানারকম কালিতে সুন্দর করে লেখা ডায়েরির প্রথম ভাগ।তারপরে ধীরে ধীরে রঙের বৈচিত্র্য কমে এসেছে, অক্ষরগুলো এবড়োখেবড়ো হতে হতে একসময় পড়ার প্রায় অযোগ্য হয়ে এসেছে। মৃত্যুর দিনও ডায়েরি লেখা হয়েছে, বোঝা যায়, কোন অবস্থায় ডায়েরি লেখা একদিনের জন্য বন্ধ করেনি তিতির।অজস্র মনের কথা, প্রিয়জনদের উদ্দেশ্য করে চিঠি লেখা আছে ডায়েরিতে। বুবুনকে লেখা একটা বড় চিঠি আছে, এক বসায় শেষ করেছে তিতির বোঝা যায়।
আদরের বুবুন সোনা, লক্ষী সোনা, চাঁদের কণা, ময়না পাখি,জানবাচ্চা,
কেমন আছিস বাবা? জানি আমি, ভালো নেই তুই। কিন্তু তোকে যে সুস্থ হতে হবে। কি করে তোকে সুস্থ করি? তুই আমার সাথে কথা বলিসনা। তোর বুবু আর তিতলী আম্মু বেশ কয়েকবার আমার কথামতো তোকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলেছে। তুই তাদের কথা উড়িয়ে দিয়েছিস। পাগল ছেলে আমার, সত্যি সত্যি তোর মধ্যে যে কিছু অস্বাভাবিকতা ঢুকে পড়েছে। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক, আমি বুঝি। তোর মধ্যে দ্বৈত স্বত্তা। একটা স্বত্তা তোকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, আরেকটা স্বত্তা আমার জন্য কাঁদে, ভীষণ কষ্ট পায়,ছটফট করে, আমার সাথে তোকে সহজ হতে বলে, ঠিক আগের মতো। ঐযে মাথায় ভূত চাপলেই আমাকে পাঁজাকোলা করে এই ঘর ঐ ঘর করতিস, কোলের মধ্যে শুয়ে থাকতিস, মুখে তুলে খাইয়ে দেওয়ার বায়না ধরতিস, আমাকেও প্রায় মুখে তুলে খাইয়ে
দিতিস, টিউশনির টাকা থেকে আমার জন্য আইসক্রিম, বাদাম, বুট ভাজা, সূতির শাড়ি, সালোয়ার কামিজের কাপড় নিয়ে আসতিস, যখন তখন জড়িয়ে ধরতিস, তোর মন এখনও সেগুলো করতে চায়। সেটাই চায়। কিন্তু আরেক সত্ত্বা তখন বাধ সাধে। তোকে আড়ষ্ট করে দেয়, তো মধ্যে গনগনে রাগ,অভিমানকে উস্কে দেয়, আমার থেকে তোকে দূরে থাকতে বলে, আমাকে আঘাত করতে বলে।
আমি ভাবি,আমার ছেলেমেয়েরা এতো কষ্ট পায় কেন? কেন ডেঙ্গুতে অমানুষিক কষ্ট পেয়ে আমার মেয়েটাকেই মরতে হলো? কেন লুম্বিনী এই শোক নিতে না পেরে এপিলেপ্সির শিকার হলো? কি কষ্টই না পেয়েছে আমার মেয়েটা। দিন নাই, রাত নাই, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বোনের অভাবে অসহ্য কষ্ট ভোগ করেছে, এখনো করে, জানি আমি। সময়ে নাকি সব ক্ষত শুকিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের বেলায় তা হলোনা। তুতুন সোনাটা ছোট্ট থেকেই অস্বাভাবিক পরিবেশ দেখে আসছে। বেচারাকে ভালো করে যত্ন আত্তি করা হয়নি যেটা তোরা বাকি তিন ভাইবোন ছোটো বেলায় পেয়েছিস। তোর নার্ভাস ব্রেক ডাউন হতো একটুতেই। যে বয়সে ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্ত মনে আনন্দের সাথে জীবন কাটায়, সেই বয়সে আমার বাচ্চাদের কাউকে মরতে হলো, কেউ মেন্টাল ট্রমা থেকে আর বের হতে পারলোনা, কারোর মৃগী হলো, আর তিনজনকেই হাসিবিহীন,খুশিবিহীন, আনন্দবিহীন, জটিল, অন্ধকার পরিবেশে বড় হতে হলো। আমার বাচ্চাদের জীবন এতো দুঃখের কেন হলো? আল্লাহ আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন?
বুবুন সোনা, মনে হয় আমি বেশিদিন বাঁচবো না।শরীর বড় দুর্বল লাগে। বড় দুর্বল। খেতে ইচ্ছা করেনা একদম। যখন ক্ষুধায় বুক পেট খুব জ্বলতে থাকে, তখন বাধ্য হয়ে খাই।খাওয়াটা আমার জন্য ভীষণ কষ্টের। পানিটাও ভালো লাগেনা।
সেদিন তোর বাবা, লুম্বিনী, তুতুন নিত্যকার মতো খুব পিড়াপিড়ি করছিলো খাওয়া নিয়ে। আমার আচমকা কি যে হলো! আমি চিৎকার করে তোর বাবার উদ্দেশ্যে কয়েকটা হাবিজাবি কথা বললাম, আর টেবিল থেকে সব থালাবাসন, খাবারদাবার মেঝেতে ফেলে দিলাম।সব। ময়না খালা তাড়াতাড়ি খিচুড়ি রান্না করে ডিম ভেজে সবাইকে ডাকলো, কিন্তু তোর বাবা,লুম্বিনী এমনকি তুতুনও কিছু খেলোনা। আমার এতো খারাপ লাগছিলো, এতো অপরাধ বোধ হচ্ছিলো, তাও ওদেরকে এ ব্যাপারে স্যরি বলতে পারিনি আজ পর্যন্ত , কিসের যেন এক বাধা। আর এই বাধাটাই তোর মধ্যে কাজ করে বুবুন সোনা, আমার ক্ষেত্রে।
তোকে বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে বুবুন। কতোদিন তোকে দেখিনি! তবে চাতক পাখির মতো তোর গলা শুনি যখন তুই লুম্বিনী, তুতুন, ময়না খালার সাথে ভিডিও কলে কথা বলিস।
বুবুন, আমাকে যদি জীবিত দেখতে না পাস, অনুশোচনা করিসনা। তোর যে কেমন কষ্ট হবে ভাবলেই আমি কাঁদতে থাকি।কিন্তু আমার অনুরোধ, নির্দেশও বলতে পারিস, নিজেকে একদম দায়ী ভাববিনা।কারণ তুই সত্যি দায়ী নস।কেউই দায়ী নয়। তোর বরং অনেক ভালোবাসা, মমতা, যত্ন, সবচেয়ে বড় কথা চিকিৎসার দরকার। তুই মানসিক রোগী হয়ে গেছিস।কিন্তু সেটা তুই বুঝতে পারছিসনা। এমনকি তোর বাবাসহ অন্যরাও সেভাবে বুঝতে পারছেনা। সবাই তোকে বাবা-মায়ের প্রতি দারুণ অভিমানী, রাগী,জেদি ছেলে ভাবছে।সবাই আমার প্রতি তোর ঘৃণা আর মুখ ফিরিয়ে নেওয়া দেখতে পাচ্ছে , কিন্তু আমার জন্য তোর কান্নাটা দেখতে পাচ্ছে না। তোর মধ্যে যে মাতৃভক্ত শিশু বুবুন লুকিয়ে আছে, এটা কেউ বুঝতে পারছেনা।আমি পারছি। তোর সমস্যা আমি খুব ভালো করে ধরতে পেরেছি।তোর কষ্টের কথা ভাবলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমাদের দেশের মানসিক রোগীদের বড় কষ্ট। কারণ তাদের অসুস্থতা এতো বিচিত্র রকমের হয় যে সাধারণ মানুষের পক্ষে সেটা সহ্য করা কঠিন ব্যাপার। মানসিক রোগীকে কেউ মনে করে ঘাড় বাঁকা, জেদী, কারোর অসুখটা আবার এমন যে সবাই একবাক্যে বলবে মানুষটা ঢং করছে, রীতিমতো শয়তানি করছে, উদাহরণ হিসাবে হিস্টেরিয়ার কথা বলা যায়। মনের অসুখ শরীরের অসুখের থেকেও অনেক কষ্টের। কিন্তু মানুষ তা বোঝেনা।
আমার মনে হয়, আমরা মানুষেরা কম-বেশি সবাই মানসিক ভাবে অসুস্থ।
বাংলাদেশেরতো বটেই, গোটা পৃথিবীর উচিত সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার নিয়ে আরো রিসার্চ করা, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। এ ব্যাপারে অনেক, অনেক সচেতনতার দরকার, তাই না রে বুবুন?
যা বলছিলাম, আমি মরে গেলে নিজেকে ভুলেও দায়ী ভাববিনা বুবুন, এক মুহূর্তের জন্য না। শোক হবে, কষ্ট হবে, স্বাভাবিক। দরকার হয় চিৎকার করে কাঁদবি। শোককে চেপে না রেখে বের করে দিবি। কিন্তু নিজের এতোটুকু ক্ষতি করবিনা, নিজেকে বা কাউকে দায়ী ভাববিনা, অনুতাপ করবিনা। তোর উপরে আমার কোনো রাগ, অভিমান, অপমানবোধ কিচ্ছু নেইরে বুবুন , তোর উপরে আমার আছে গভীর ভালোবাসা, মায়া, নিরন্তর দোয়া আর প্রবল উৎকণ্ঠা।
নিজেকে ভালোবাসিস বুবুন। সবসময় নিজেকে ভালোবাসবি।শরীরের যত্ন নিবি, মনটার যত্ন নিবি, সাইকিয়াট্রিস্ট -সাইকোথেরাপিস্টের কাছে যাবি, জোরে জোরে হাসবি, এক্সারসাইজ করবি, জীবনকে উপভোগ্য ও অর্থবহ করে তুলবি। দুঃখী মানুষের পাশে থাকবি, অসহায় মানুষদের পাশে থাকবি, কখনো কারো ক্ষতি করবিনা।
একটা আব্দার তোর কাছে। তুই নানা-বুবুর বড় নাতি, অনেক আদরের।আল্লাহ তাঁদের সুদীর্ঘ হায়াত দিন, তুই সবসময় তাঁদের দেখাশোনা করবি, খোঁজ খবর রাখবি। যে কোনো সমস্যায় পাশে দাঁড়াবি। দূরে বাস করেও দরকারে কাজে লাগা যায়, ইচ্ছা থাকলে। আর ইচ্ছা না থাকলে খুব কাছে বাস করেও কিছু করা হয়না। জানি, এতো কথা তোকে বলার দরকার নেই, তুই সবসময়ই নানা-বুবুর খেয়াল রেখেছিস, ভবিষ্যতেও রাখবি, ইনশাআল্লাহ।
বাবার উপরে রাগ,ঘৃণা, অভিমান একদম পুষে রাখিসনা বাবা। যে গাঢ় ভালোবাসা বাবার প্রতি তোর আছে, সেটাকেই ধরে রাখিস। রাগ,ক্ষোভ, ঘৃণা কোনো ভালো কিছু দিতে পারেনা, শুধু মন, আত্মা আর শরীরের ক্ষতি করতে পারে। তাহলে মনে এসব নেতিবাচক অনুভূতি কেন পুষে রাখবি, বল? ভুল, অপরাধ এগুলোতো মানুষই করে, অন্য কোনো জীব তো তা করতে পারেনা, তাইনা? নিঃসন্দেহে তোর বাবা অনেক বড় ভুল ও অপরাধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর অপরাধ বুঝেছেন,জনে জনে সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, প্রচণ্ড অনুতপ্ত হয়েছেন। ভেবে দেখ, তোর দাড়িপাল্লায় কোনটার ওজন বেশি, বাবার অপরাধ -সাময়িক মতিভ্রম নাকি আজন্ম বাবার গভীর ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ, যত্ন, ত্যাগ স্বীকার, দায়িত্ববোধ,আগলে রাখা? বাবার প্রতি এতোটুকু নেগেটিভ ফিলিংস রাখিসনা বাপ।
তুই, লুম্বিনী, তুতুন পৃথিবীসেরা ভাইবোন হবি। যখন তোরা একশ বছর বয়সের বুড়ো থুত্থুড়ে হয়ে যাবি, তখনও যেন তোদের তিনজনের এখনকার মতোই বা এখনকার চেয়েও বেশি ভালোবাসা থাকে। তিনজনই তিনজনকে দেখে রাখবি।
তোর মামা-মামি, তিতলী আম্মু -খালু অনেক ভালো মানুষ। বিশেষত তোদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাদের কোন কার্পণ্য নেই। সবসময় তাদের পাশে থাকিস।আগলে রাখিস আমার ইরফান, আয়মান, অরণ্য, অরণীকে। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার মতো বাঁচিস।
তোর চাচা-ফুপুরা যেমনই হন, তোরা তোদের দায়িত্ব থেকে পিছপা হবিনা। দেখা -সাক্ষাৎ করবি, ভদ্র ব্যবহার করবি, তাঁরা কোনো সমস্যায় পড়লে সাধ্য মতো তাঁদের পাশে থাকবি।
বুবুন, আমাদের এই পরিবারে ময়না খালার বিশাল ভূমিকা। জানি, তোরা প্রত্যেকে তাকে দারুণ ভালোবাসিস। এভাবেই তাকে ভালোবেসে যা, তার থাকা-খাওয়া -চিকিৎসা কোনো কিছুর অবহেলা না হয়, তাকে কখনোই একা ছেড়ে দিবিনা। তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোরা ভালোবেসে তার প্রতি কর্তব্য পালন করিস।
অজন্তার ছবি দেখিনি আমি, আল্লাহ কপালে রাখলে সামনাসামনি দেখবো। ওর অনেক গল্প শুনি সবার কাছে। তোরা দু’জন দু’জনের জীবন ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলিস,কেউ কারো হাত ছাড়বিনা, আল্লাহর কাছে বারবার এই দোয়া করি। আমি মনে করি, আমার বিশ্বাস, অজন্তাকে আল্লাহ তোর কাছে পাঠিয়েছেন আশীর্বাদ হিসাবে। তোর সব দুঃখ, কষ্ট অজন্তার উসিলায় দূর হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।
তোদের বিয়ে হবে , সন্তান হবে। যদি মেয়ে হয়, তাহলে তার নাম রাখিস তিতির।
যে মেয়েটা আমাদের জীবনে বিভীষিকা হয়ে এসেছিলো, যার কথায় ও নোংরামিতে তুই এলোমেলো হয়ে গেলি, যে তোর এতো বড় ক্ষতিটা করলো, সে গত পরশুদিন খুন হয়েছে, খুব নির্মম ভাবে। খুনীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে ভীষণ কষ্ট দিয়ে খুন করেছে মেয়েটাকে। এটা এখন পত্রিকার হট টপিক। তাকেও ক্ষমা করে দে, বাবা।তার কথা আর মাথায় রাখার দরকার নেই।
একটানা অনেক লিখে ফেললাম বুবুন। আজকের মতো বিদায় নিই। কতো যে ভালোবাসা আর দোয়া তোর জন্য , তা শুধু আল্লাহ জানেন আর আমি জানি।
ইতি
বুবুন সোনা, রাজেশ্বরী মা’মনি, লুম্বিনী ময়না পাখি, তুতুন জানবাচ্চার মা।
চলবে।
#সংসার
পর্ব ৫৭
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
নিশাত কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বললেন, ” আমি বাসা ছেড়ে কোথাও যাবোনা। কাউকে সামলানোর অবস্থা, দায়, ইচ্ছা কোনোটা আমার নেই। তোমরা মানুষ? আমার মতো কষ্ট আর কে পাচ্ছে? মরেছেতো আমার মেয়ে। আর আমাকে দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে স্বাভাবিক রাখার? ”
আদনান আর নোমান অনুরোধ করেছিলো নিশাতকে তিতিরের বাসায় কিছুদিন থাকার। শোকাহত তিন ভাইবোন নানিকে পেয়ে যদি একটু স্বান্তনা পায়! তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিশাতের এই আর্তনাদ। এক রাত তিতিরের বাসায় থেকে তিনি নিজের বাসায় চলে এসেছেন। মেয়ে মরার পরে তার বাড়িতে থাকা কি যে কষ্টের, ভুক্তভোগী বাবা-মা ছাড়া আর কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা। বাড়ির প্রতিটা ইঞ্চিতে তিতিরের স্মৃতি। তিতিরের গায়ের ঘ্রাণ। তিতিরের হাতে সাজানো সংসার। তিতিরের ছবি।শুধু তিতির নেই। এতো বড় পৃথিবীর কোথাও নেই। নিশাত-নাজমুল সারাদিন মেয়ের ছোটোবেলার, কিশোরী বেলার, তরুণী কালের, বিয়ের সময়ের অ্যালবামগুলো দেখেন আর অবিরাম কাঁদেন। দু’জনেই তিতিরের বাসায় যাওয়ার নাম শুনলে আঁতকে উঠছেন।
নোমান সাহস করে বললো, ” ঐ বাসায় সবাই আছে।এখানে সারাদিন তোমরা একলা থাকো।সবার সাথে থাকলে তোমরাও একটু শান্তি পাবে, বুবুন -তুতুন -লুম্বিনীও একটা বড় ভরসা আর শান্তির আশ্রয় পাবে।তাই বলছিলাম। ”
নিশাত আর্তনাদ করে বললেন, ” ঐ বাসায় সবাই আছে। আমার তিতির কি আছে? আমার তিতিরকে এনে দে।”
নাজমুল সাহেব আর নিশাতের কাছে অবশ্য নোমানের দুই খালা আর এক চাচাতো বোন থাকছেন।এছাড়া বাসার কাজ করার খালা নূরজাহান খুব ভালো। ময়না খালার মতো অনেকটা।
নোমান-তমাও অফিস -তিতিরের বাড়ি হয়ে রাতে ফিরে আসে বাবা-মায়ের কাছে। মায়ের কথা ঠিক।তিতির ছাড়া তিতিরের বাড়ি একেবারেই শূন্য, যতোই মানুষ থাকুক না কেন।
লুম্বিনী সারাদিন অঝোরে কাঁদে। তার পুরানো রোগ ফিরে আসলো বলে।আসিফ শোকের সুযোগ পাচ্ছেনা। লুম্বিনী আর দুই ছেলের জন্য চিন্তায় সে অস্হির হয়ে আছে। লুম্বিনীর প্রিয় সাইকোথেরাপিস্ট ম্যাম আসিফের অনুরোধে এবং অনেকটা নিজের ইচ্ছাতেই প্রতিদিন কমপক্ষে এক ঘন্টার জন্য তিতিরের বাসায় আসছেন।
দুই ভাই গত দশদিন ধরে একদম নির্বাক। একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি দুই ছেলে। বুবুনের দু’চোখ বেয়ে অবিরল পানি ঝরে, তুতুনের তাও না। তিন ছেলেমেয়ে মোটামুটি অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। দুই ভাই রাত দিন পড়ে থাকে মায়ের কবরের কাছে, সাথে ইরফানও। তাদের পাহারায় পালা করে দুইজন কাছের মানুষ থাকে। ইরফান নিজে কাঁদে, ভাইদের স্বান্তনা দেয়। বাসা থেকে খাবার আসে। কেয়ারটেকার আর আত্মীয়রা টানাটানি করে দুই ভাইকে, একটু কিছু মুখে দেওয়ার জন্য। বেশিরভাগ দিন লাভ হয়না। গোরস্তানের কেয়ারটেকার বুবুনকে চিনেন রাজের মৃত্যুর পর হতে। প্রতিদিন বোনের কবরের কাছে বসে থাকতো ভাইটা, বিড়বিড় করে কথা বলতেই থাকতো। তুতুন তখন ছিলো ছোট্ট বাবু। বুবুন, তুতুন, ইরফান এদের পরিবারের মোটামুটি সব পুরুষকে চেনেন কেয়ারটেকার। ম্যাডামকেও কয়েকবার দেখেছিলেন তিনি, বড় ঘোমটা থাকায় মুখ অতো ভালো করে দেখা যায়নি।
এখন আসে অজন্তা। স্বামী আর দেবরদের সাথে। কেয়ারটেকার নিষেধ করেন, ” মা, মহিলা মানুষের কবরস্থানে না যাওয়াই ভালো।”
“চাচা, আমি ওযু করে, পাক পবিত্র হয়ে এসেছি। ”
“তবু মা, না যাওয়াটাই ভালো।”
“কোরআন শরীফে লেখা আছে? ”
” তা জানিনা মা। মূর্খ মানুষ। আপনি বরং অর্থ বুঝে পড়েন।”
অজন্তা অফিসরুমের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে আর কোরান শরীফের তর্জমা পড়ে।
তিতলী অফিস থেকে দুই মাসের ছুটি নিয়েছে। অরণ্য -অরণীকে নিয়ে বোনের বাড়িতে থাকে। আগলে রাখে লুম্বিনীকে, বুবুন -তুতুন বাসায় থাকলে জোর করে, কেঁদে কেটে, নানারকম দিব্যি দিয়ে দুই ভাইকে একটু খাওয়ায়, ওদের সাথে কথা বলে, মাথায় গায়ে হাত বুলায়, মায়ের অভাব পূরণ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে তিতলী।
আসিফের ভাইবোনেরাও আসে। তিতিরের অভাব অনুভব করে। তিতিরের করা উপকার, আদর-আপ্যায়ন এটাকে অস্বীকার করার উপায় তো নেই। তারা যেমনই হোক, এখানে এলে তিতিরের সাদর আপ্যায়ন পেতো, এখন কেউ আপ্যায়ন করেনা। নিজের ভাই না, ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা না।অবশ্য সেই অবস্থাও তাদের নেই। শোকে মুষড়ে পড়া এক পরিবার।
বাসা সবসময় গমগম করে মানুষ দিয়ে, কিন্তু লুম্বিনী, তুতুন, বুবুন, আসিফ, তিতলী,নোমান সবার কাছে সবকিছু ফাঁকা লাগে। কোথাও যেন কেউ নেই। সমস্ত পৃথিবীটাই ফাঁকা।
অজন্তার বাবা-মা -বোন এসেছেন। তীব্র কষ্ট বুকে চেপে তাঁদের আতিথেয়তা করে আসিফ,আদনান,তিতলী,তমা,নোমান।নতুন বেয়াই -বেয়ানের কোনো অপমান, অবহেলা যেন না হয়। অজন্তার বাবা-মা শুধু অজন্তাকে নয়, বুবুনদের তিন ভাইবোনকে অপার স্নেহ দেন, কাছে থাকেন, দেখা করতে যান তিতিরের বাবা-মায়ের সাথে। কয়েকদিন থাকার পরে তাঁদের যাওয়ার প্রশ্ন উঠে। তাঁরা সবার সামনেই বুবুন -অজন্তাকে জিজ্ঞেস করেন, কানাডায় কবে ফিরছে ওরা? শীঘ্রি ফেরা উচিৎ। বুবুন চুপ করে থাকে। অজন্তা বলে, ” আর কটা দিন থাকি, মা।”
“এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি কেন, অজন্তা? এখানে তোমাদের কিছু করারও নেই। ”
” এতো তাড়াতাড়ি আমি যাবোনা মা। নানা,বুবু, আরিয়ান, লুম্বিনী, তুতুন, বাবা এদের জন্য আমাকে আরও থাকতে হবে। ”
আসিফ বললো,”আমাদের কথা চিন্তা করোনা। যেটা দরকার মনে করো, সেটাই করো।”
“বাবা, আমি এখানে থাকাটা বেশি দরকার মনে করছি।”
অজন্তার মা রাগ চেপে বললেন, ” কতোদিন? আরও সাত দিন, দশ দিন না কতো দিন? একটা ধারণা দিতে হবেতো। আরিয়ান, তুমি কি বলো? ”
যথারীতি বুবুন চুপ করে রইলো।
“আরে বাবা, একটা কিছু বলো। তোমরা দু’জনেই পিএইচডি প্রোগ্রামে অ্যাডমিশন নিয়েছো। সেটা নিয়ে ভাবতে হবেনা? এখন এখানে থেকে কি করবে? ক্যারিয়ারে ফোকাস করো।”
এতোদিন পরে নীরবতা ভঙ্গ করলো বুবুন। গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বের হচ্ছে। অজন্তাকে বললো, ” তুমি উনাদের সাথে চলে যাও।আমি এখন যাবোনা।”
” কবে যাবে? এখানে কি কাজ বাকি? ”
বুবুন শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” আমি যাবোনা। আমার এখন যাওয়ার মতো মনের অবস্থা নয়।”
“কেন? মায়ের সাথে তোমার তো এমন কোন মানসিক সংযোগ ছিলোনা যে এতোদিনেও তোমার মন ঠিক হয়নি? ছোট ভাইবোনদের দেখার জন্য অনেকে আছেন। তুমি বরং রিসার্চ শুরু করলে, ডক্টরেটটা কমপ্লিট করলে ফ্যামিলি মেম্বারস খুশি হবেন। অজন্তা একা কেন যাবে? ও তোমার ওয়াইফ।ওর প্রতিও তোমার রেসপনসিবিলিটি আছে। ওরও তো পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে অনেক। বেয়াই কি বলেন? ”
আসিফ বললো, ” ওরা অ্যাডাল্ট। ওদের ডিসিশন ওরাই নিক।”
“না, গার্জিয়ান হিসাবে আমাদেরও কর্তব্য আছে। ”
বুবুন স্পষ্ট গলায় বললো, ” আমি যাবোনা। অজন্তার কোনো ডিসিশনে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আমি এখন যাবোনা।”
“ওকে! অজন্তা, গেট রেডি। আমরা পরশুর পরের দিনের ফ্লাইট ধরছি, তুমি সব গুছিয়ে নাও।”
“না মা, আমি আরিয়ানকে এ অবস্থায় রেখে যেতে পারবোনা। ”
“আরিয়ানের কি অবস্থা ? আরিয়ান ঠিকই আছে। ওর মাতৃশোক নেই , মায়ের জন্য ওর টান একেবারেই ছিলোনা। বাপ, ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্বের জন্য আর কিছুদিন থাকতে চাচ্ছে। যদিও বেয়াই সাহেবসহ অন্য বেয়াই বেয়ানরা খুব ভালো সামাল দিচ্ছেন। আরিয়ানের না থাকলেও চলে।কিন্তু পরের ছেলের ওপরতো জোর করতে পারিনা। নিজের মেয়ের ওপর পারি। অজন্তা আমাদের সাথে চলো, পরে আরিয়ান আসবে।”
কি বললেন মহিলা? মায়ের জন্য বুবুনের শোক হচ্ছেনা? মায়ের জন্য ওর টান একেবারেই ছিলোনা? অথচ মা ডায়েরিতে কি নিখুঁত ভাবে বুবুনের অবস্থা তুলে ধরেছে।শতভাগ সত্য তুলে ধরেছে। মা বুবুনকে ভুল বুঝেনি। মা অন্তর্যামীর মতো বুবুনের সব সমস্যা, অনুভূতি ঠিকঠাক বুঝে নিয়েছে। এমন দরদী বুবুনের জন্য কে আছে এই এতোবড় দুনিয়ায়? কে বুবুনের সব ব্যথা-বেদনা মায়ের মতো করে অনুভব করবে?
আচমকা সবাইকে হতচকিত করে বুবুন চিৎকার করে কেঁদে উঠলো।বাঁধ ভাঙা কান্না। “মা, মা, তুমি কোথায়? আমাদের ফেলে কেন চলে গেলে মা? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। ” বুবুনের হাহাকার আর আর্তনাদ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। সবাই ছুটে এলো। জড়িয়ে ধরলো বুবুনকে। অজন্তার মা অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন। কি যেন ব্যাখ্যা করতে গেলেন, অজন্তা থামিয়ে দিলো মা’কে, “মা, না বুঝে কারোর অনুভূতিতে আঘাত করবেনা।তুমি জানো ওর মা ওর কাছে কতোটুকু? ”
অজন্তার মা অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, ” শুধু আমি কেন, কেউই জানেনা আরিয়ানের মায়ের প্রতি এতো টান আছে। যা দেখেছি, শুনেছি, তাই বলেছি।”
বুবুন কাঁদছে। বুক খালি করে কান্না। লুম্বিনী কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘর থেকে ছুটে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই জড় হয়েছে, কেবল তুতুন নেই। তিতলী বুবুনের পাশ থেকে উঠে গেলো নিঃশব্দে। বুবুনের আর্ত চিৎকার তুতুনের শুনতে না পাওয়ার কথা নয়।
আপার রুম অন্ধকার। জানালা খোলা। পর্দা উড়ছে। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ। তুতুন শুয়ে আছে মায়ের খাটে। মায়ের বালিশে মুখ চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।কেঁপে কেঁপে উঠছে পিঠটা। দেওয়ালে ফ্রেমবন্দী অবস্থায় আপা তাকিয়ে আছে বোকা ছেলেটার দিকে, হাসিমুখে।
তিতলী নিঃশব্দে খাটের ঐপাশের কিনারায় যেয়ে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।আপা শুয়ে শুয়ে কি দেখতো? আকাশে মস্ত এক চাঁদ, একটা নারকেল গাছ, সারি সারি অ্যাপার্টমেন্টে। তিতলী মেঝেতে বসে তুতুনকে জড়িয়ে ধরলো,ফিসফিস করে বললো, “বাবাই।” তুতুন ধড়ফড় করে উঠে বসলো, তিতলীকে দেখে তার মুখের আলো নিভে গেলো।
তিতলী কান্নাভেজা গলায় বললো, ” কি ভেবেছিলি? মা এসেছে? ”
তাই ভেবেছিলো তুতুন। সত্যি সত্যিই তাই ভেবেছিলো। আল্লাহর কাছে একটানা মা’কে চাইলে একবারের জন্য হলেও মা তুতুনের কাছে আসবে।
তুতুন তিতলীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো, ” মা এমন কেন করলো তিতলী আম্মু? না জানিয়ে চলে গেলো কেন? মা কিভাবে এমন করতে পারলো? ”
তিতলী বললো, ” আরো জোরে কাঁদো বাবা। চিৎকার করে কাঁদো। যতোক্ষণ পারো, কাঁদো। কষ্ট চেপে রাখিসনা বাবা। ”
বেডরুমের লাইট জ্বলে উঠলো। বুবুন আর লুম্বিনী এসে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। তিন ভাইবোন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকলো মায়ের জন্য। আর দুষ্ট মা’টা দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেম হতে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলো তার বাচ্চা তিনটার দিকে।
চলবে।