#সংসার
৫৮ তম পর্ব (শেষ পর্ব)
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
দশ বছর পরের কথা
……………………………
“রাজেশ্বরী আরোগ্য নিকেতনের ” গাইনি ওটির সামনে বেশ ভীড়। সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, উৎকন্ঠিত। অজন্তার সিজারিয়ান অপারেশন হচ্ছে। বিয়ের দশ বছর পরে প্রথম সন্তান। স্বামী -স্ত্রী কারোর সমস্যা না থাকলেও বেবি হচ্ছিলোনা। আল্লাহর রহমতে আট মাস আগে জানা গেলো অজন্তা অন্তঃসত্ত্বা। নির্ধারিত সময়ের আগেই আজ পানি ভেঙে গেলো, পেইন উঠলো ভীষণ। ইমারজেন্সি ওটির ব্যবস্থা করা হলো।
বুবুন কাঁপছিলো একটু একটু। অজন্তা বা বেবির জন্য তার কোনো টেনশন হচ্ছিলোনা, তার মন বলছিলো মা ও বাচ্চা দু’জনেই সুস্থ থাকবে। সমস্যা হলো, ছেলে না মেয়ে হবে? বুবুনের দৃঢ় বিশ্বাস, তাদের তিন ভাইবোনের সন্তানদের মধ্যে প্রথম যে মেয়েটি হবে, নিশ্চিত ভাবে সে তিতির, তাদের মা। মায়ের জন্ম হবে তাদের কন্যাশিশুর মধ্য দিয়ে।পুণর্জন্ম বিশ্বাস করেনা বুবুন, কিন্তু এই ক্ষেত্রে তার মন কোন যুক্তি মানেনা। তার মনে হয়, তাদের দুঃখী ভাইবোনদের কাছে আল্লাহ আবার মা’কে উপহার দিবেন।অদ্ভুত ভাবে, একই আশা আসিফ,লুম্বিনী, তুতুনের। যদিও তারা এটাও খুব ভালো জানে, এটা সম্ভব না। একই মস্তিষ্ক দ্বৈত ভূমিকা পালন করে।
বুবুন আর কানাডায় ফিরে যায়নি। অজন্তাও না। দু’জনেই এম. এস করা ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু ডক্টরেট করা হলোনা। অজন্তার মা অনেক অনুনয় করেছিলেন, বকেছিলেন, কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, অজন্তা যায়নি। বুবুনকে ছয়মাস থাকতে হয়েছিলো অত্যাধুনিক হোমে, সুইজারল্যান্ড থেকে আসা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দম্পতি হোমটি খুলেছেন,
মানবতাবোধ হতে, কোন প্রাপ্তির আশায় নয়। খুব দরদ দিয়ে চিকিৎসা করেছিলেন তাঁরা বুবুনের, সাইকোথেরাপি-ফিজিওথেরাপি খুবই উন্নতমানের ছিলো। হোমের ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট, নিউট্রিশনিস্ট সবাই সুইডিশ। তাঁদের বিশ্বমানের চিকিৎসা, সেবা, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায়, মনোরম পরিবেশে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলো বুবুন। তার সমস্যা ছিলো, সে বর্তমান একেবারে ভুলে গিয়েছিলো। সে তার কিশোরবেলায় বাস করতো যেখানে তার মা,বাবা, তিনটা ছোট্ট ভাইবোন আছে, নানা-নানি, মামা-খালা, তাদের পরিবার আছে। ময়না খালা আর আমেনা বুবু আছে।ও সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে।তাদের বাসায় শুধু হাসি আর আনন্দ। তারা একসাথে খেতে বসে,একসাথে বেড়াতে যায়। চার ভাইবোনই মায়ের কাছাকাছি থাকার জন্য পাল্লা দেয়, তারমধ্যে ভাই দুটো বেশি, বোন দুটো বাবার বেশি ভক্ত। বুবুন মায়ের কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে সটান শুয়ে পড়ে, মা তার চুলে বিলি কেটে দেয়। রাতে মা কয়েকবার তার ঘরে আসে। গায়ের কাঁথাটা ঠিক করে দেয়, কপালে গালে হাত রাখে। পড়ায় বেশি ব্যস্ত থাকলে মা মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। ও আর মা প্রতি বিকালে পার্কে হাঁটে। মা,মা, মা।বুবুনের ভুবন তখন মা ময়। অজন্তাকে পর্যন্ত চিনতে পারতোনা।
হোম থেকে ফিরে আসার পরও নিয়মিত ফলোআপ করতে যেতে হতো পরবর্তী পাঁচ বছর। সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রায় মা’কে দেখতে পায় বুবুন, এখনও, বাসায় কিংবা রাস্তাঘাটে। একবার এক মহিলাকে পিছন থেকে ধরে ফেলেছিলো রাস্তায়, হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলো,” এখানে কি করছো মা? এতো ডাকলাম, তাও শুনতে পাওনি?” অজন্তা সাথে থাকায় রক্ষা। এখনো সকালে ঘুম ভাঙলে বুবুন মায়ের কথাবার্তা শুনতে পায়, ময়না খালার সাথে সাংসারিক কথা। তখন অদ্ভুত এক আনন্দ আর নিশ্চিন্ত অনুভূতি বুবুনকে ঘিরে রাখে। তারপরে সে একসময় করুণ বাস্তবে ফিরে আসে, মা নেই। তখন বুকটা এতো ভার হয়ে যায় যেন চল্লিশ মণ ওজনের পাথর বসানো হয়েছে বুকের ওপর।
সাইকোথেরাপিটা খুব ইফেক্টিভ ছিলো। এরজন্য আবার ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে বুবুন। সে আর অজন্তা দু’জনেই খুব বেশি মেধাবী , কর্মদক্ষ। বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিতে উঁচু পদে যোগদান করতে এবং পরবর্তীতে উত্তরোত্তর উন্নতি করতে বেগ পেতে হয়নি দু’জনকে।
লুম্বিনী মায়ের শোকে পাগলের মতো করতো কয়েকটা মাস। তাঁর সাইকিয়াট্রিস্ট ম্যাম অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন ওকে। এছাড়া ” ড্রিম অ্যান্ড হোপ” হোমে, বুবুন যেখানে ভর্তি ছিলো, সেখানে নিয়মিত থেরাপি দিতে নিয়ে যাওয়া হতো লুম্বিনীকে। আর গোটা পরিবারতো সাথে ছিলোই। পড়ালেখা ভালো ভাবে শেষ করে লুম্বিনী ভালো চাকরি নিলো সেভ দ্য চিলড্রেনে। চাকরির পাশাপাশি ড্রিম অ্যান্ড হোপে নিয়মিত কাজ করে সে, অবৈতনিক ভাবে। কতো ভালো ভালো প্রস্তাব এসেছে, মেয়ে বিয়েতে রাজিই হলোনা। সে বিয়ে না করার জন্য বদ্ধপরিকর।
তুতুনের জন্য দেবদূতের কাজ করেছেন তার কলেজের প্রিন্সিপাল ফাদার রিচার্ড। প্রতি ভোরে তিনি তুতুনকে নিয়ে হাঁটতে যেতেন, কমপক্ষে এক ঘন্টা। সেই এক ঘন্টায় ছাত্রকে তিনি জীবনের যে বিদ্যা দান করতেন, তা অনেক কাজে লেগেছে তুতুনের। নিজের শোককে বুকের গভীরে চেপে রেখে অন্যের দুঃখমোচনকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। এতেই সে শান্তি ও শক্তি পায়, তার মায়ের আত্মাও শান্তি পায় বলে তুতুনের ধারণা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে তুতুন এখন সাইকিয়াট্রিতে উচ্চতর পড়াশোনা করছে। মায়ের ডায়েরিতে লেখা ছিলো,
তুতুন সোনা, আমার লক্ষী বাবু, মিষ্টি বাবু, পক্ষীছানা,নয়নমনি, ভূতু বাবু,
এতো মায়াবী কেন রে তুই? তোর জন্মের পরপর সারা হাসপাতালে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিলো, এতো সুন্দর বাবু নাকি আগে কেউ দেখেনি। আমিও চোখ সরাতে পারছিলামনা।আর গায়ে কি মিষ্টি, বাবু বাবু ঘ্রাণ, ওটা এখনও আমার নাকে ভাসে। বড্ড সহজ সরল তুই আমার তুতুন বাবা। এমনই থাকিস সবসময়। আমার খুব ইচ্ছা কি জানিস? তুই ডাক্তারি পড়। জোর করছিনা মোটেই, এটা আমার গোপন ইচ্ছা। তারপরে খুব ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হ। মনের রোগ খুব জটিল রোগ যার সত্যিকারের চিকিৎসা দিতে পারবে সবচেয়ে সহজ সরল, হৃদয়বান, ভালো মানুষেরা যাদের মনে অনেক মায়া। তুইতো এমনই আমার তুতুন সোনা “……..আরও অনেক কথা লেখা ছিলো ডায়েরির বিভিন্ন পৃষ্ঠায়। মা না থাকলে তুতুন যেন ভেঙে না পড়ে। তুতুন কষ্ট পেলে মা খুব কষ্ট পাবে, তুতুন ভালো থাকলে মা আরও দুই গুণ ভালো থাকবে। তুতুন মায়ের কলিজা।তুতুন যেন ঠিকমতো খায়, ঘুমায়, বন্ধুদের সাথে খেলা করে, হাসিখুশি থাকে। মা অদৃশ্য ভাবে সবসময় তুতুনকে দেখবে।
নাজমুল সাহেব, নিশাত, আসিফ, তিতলী,নোমান, তমা, আদনান, ইরফান আর অজন্তার অশেষ চেষ্টা, ভালোবাসা,মমতা, যত্নে ভাইবোন তিনটা উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। যদিও এমন একটা দিন নেই যেদিন তুতুন, বুবুন মা-বোনের কবর জিয়ারত করেনা, লুম্বিনী ঘুমানোর আগে মায়ের ফটো বুকে চেপে সবাইকে লুকিয়ে চোখের পানি ফেলেনা, রাজেশ্বরীকে স্মরণ করেনা।
অজন্তার মতো মেয়ে বাস্তবে পাওয়া খুবই কঠিন। এতো ভালো পরিবারের মেয়ে। এতো লেখাপড়া জানা স্বত্বেও সে খুবই লক্ষী, মিষ্টভাষী, আত্মীয় ও বন্ধু বৎসল, উদার, হেল্পফুল, খুব সহজে আপন করে নিতে পারে সবাইকে। এমন মেয়ে বর্তমান যুগে খুবই বিরল। অজন্তার প্রশংসা সবার মুখে মুখে।এসব কথা এক কালবোশেখীর সন্ধ্যায় ভাবছিলো আসিফ।তখন হঠাৎ বুকে জোর ধাক্কা লাগলো তার। তিতিরের কি এই সবগুলো গুণ ই ছিলোনা? ছিলো, কিন্তু কেউ প্রশংসা করেনি কোনদিন, তিতিরের গুণের কোন কদর হয়নি। অজন্তা শ্বশুর বাড়ি থেকে অনেক সম্মান, প্রশংসা, আদর,ভালোবাসা, মনোযোগ, উপহার পায়, তিতির কি পেতো? শ্বশুর-শাশুড়ি-দেবর -ননদদের থেকে কটু ও প্যাঁচানো কথা, চেহারা নিয়ে কদর্য বাক্যবাণ, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, সমালোচনা ছাড়া কিছুই পায়নি, একটা শাড়িও উপহার দেয়নি আসিফের বাপ-মা-ভাই -বোনেরা, তারপরও তিতির তার মতোনই ছিলো, অভিযোগহীন,মিষ্টভাষী, মমতাময়ী, দায়িত্বশীল। আসিফের জন্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক ভুগেছে তিতির। তবু নীরবে ক্ষমা করে দিয়েছে বারবার। ভালোবাসায় -মমতায় -যত্নে ভরিয়ে রেখেছিলো আসিফকে। শেষের ছয় সাত বছর শারীরিক সম্পর্ক না থাকলেও তিতিরের ভালোবাসা অনুভব করতে পারতো আসিফ। ঠান্ডা পড়লে আসিফকে ঘুমন্ত মনে করে তার গায়ের কাঁথা কম্বল ঠিক করে দেওয়া, নিয়মিত আসিফের পছন্দ মতো খাবারের ব্যবস্থা করা, আসিফের কাপড় চোপড় সুন্দর করে গুছিয়ে, আয়রন করে রাখা, ঈদে বা কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনেক যত্ন করে আসিফের জামাকাপড়, জুতো স্যান্ডেল কেনা। এগুলো ছাড়াও চোখের দিকে তাকালে আসিফ তার প্রতি তিতিরের ভালোবাসা বুঝতে পারতো। এই দশ বছরে প্রতিটা দিন তিতিরের স্মৃতিচারণ করেছে আসিফ। একবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলো সে, কিন্তু তিন ছেলেমেয়ের কথা ভেবে নিজেকে অনেক কষ্টে সামলেছিলো আসিফ। বুবুন বড় হয়ে গেলেও ভঙ্গুর অবস্থায় , লুম্বিনীরও আর শোক নেওয়ার ক্ষমতা নেই, তুতুন এখনো অনেক ছোটো, নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি এখনো। এদের অকূল পাথারে রেখে স্বেচ্ছায় আসিফ চলে যেতে পারেনা। অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব এনেছে, এখনও আনছে, কিন্তু আসিফ তিতিরের জায়গায় অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারেনা। রোগীর অসম্ভব চাপ, তিতিরের অগণিত স্মৃতি, অকালে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট রাজ, বাকি তিন ছেলে-মেয়ে -বৌমা, কাছের মানুষদের নিয়ে তরতর করে সময় কেটে যায় আসিফের। একা থাকলে কিংবা ঘুমানোর সময় একরাশ বিষাদ তাকে চেপে ধরে, কতো কথা মনে হয়, তিতির মৃত্যুর সময় কতোটা, কতোক্ষণ মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছে, কাউকে ডেকেছিলো কিনা, কাউকে ঐ মুহূর্তে ভেবেছিলো কিনা, ভয় লাগছিলো কিনা, কিছুই জানার উপায় নেই। বুক হু হু করে, গলাটা টনটন করে ব্যথায়, চোখের কোলে পানি জমে।
বছর দুয়েক ধরে নাজমুল সাহেব নিশাত ছাড়া কাউকে চিনতে পারেননা। নোমান-তমা-তিতলী কাউকে না। কেউ সামনে গেলে, কথা বললে জিজ্ঞেস করেন, “আপনাকে ঠিক চিনতে পারলামনা।” তাঁর প্রাণপ্রিয় নাতি-নাতনিদের কথাও তাঁর মনে নেই। অদ্ভুত ব্যাপার, তিতিরের নাম মনে আছে টনটন করে। নিশাতকে প্রায় জিজ্ঞেস করেন, ” তিতির কি স্কুল থেকে এসেছে? “কিংবা ” তিতির কোথায়? অনেকক্ষণ দেখছিনা যে।” নিশাত জিজ্ঞেস করেন, ” তিতির কে?”
“আমার মেয়ে।”
“তোমার কয় ছেলেমেয়ে? ”
নাজমুল সাহেব একেক দিন একেক উত্তর দেন। তিতলী, নোমান বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “বাবা, এই যে আমি নোমান, তোমার ছেলে। আর এই যে তোমার মেয়ে তিতলী।তুমি আমাদের চিনতে পারছো?”
” চিনতে পারছি, মানে আবছা আবছা কেমন যেন। আপনারা কি জানেন, তিতির কোথায়? ”
নোমান-তমা ভীষণ যত্ন করে নাজমুল -নিশাতকে। বাবা-মায়ের মতো আগলে রাখে। ঘন ঘন বাবা-মা’কে দেখতে আসে তিতলী-আদনান-আসিফ, অজন্তা, নাতি নাতনিরা। তবু নাজমুল সাহেব তিতিরকে খুঁজতে থাকেন, এতো ভর ভরন্ত সংসারকেও নিশাতের খালি খালি মনে হয়।
তিতিরের মৃত্যুর পরের বছর নাজমুল সাহেব নোমান আর তিতলিকে ডেকে বলেন, ” সাভারে আমার এই দশ কাঠা জমি কিনেছিলাম , তখন তোমরা খুব ছোটো, তিতলী হয়নি। এই জায়গার তখন তেমন দামই ছিলোনা। খুব সস্তায় তোমাদের মায়ের নামে কিনেছিলাম। এখন জায়গাটার অনেক চাহিদা। আমার আর তোমাদের মায়ের ইচ্ছা , এই জমিতে তিতিরের শান্তি প্রার্থনা করে ওর নামে একটা ওল্ড হোম বা অরফানেজ হোক। তোমাদের আপত্তি আছে? ”
“একদম না।” সাথে সাথে উত্তর দিয়েছিলো দুই ভাই বোন।
নিশাত বলেছিলেন, ” কিছু টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে, বাকিটা তোমাদের করতে হবে যে।”
সম্মিলিত সিদ্ধান্ত , চেষ্টা ও সহযোগিতার ফলে ঐ জমিতে দাঁড়িয়ে আছে দোতলা, অনেক বড় বৃদ্ধাশ্রম, ” Titir’s dream “, বাস করেন চল্লিশ জন বৃদ্ধ -বৃদ্ধা যাঁরা পরিবারের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন, স্হান পাননি নিজ পরিবারে। সরকার থেকে অনুদান দেওয়া হবে এই বছর থেকে। নাজমুল, নিশাত, নোমান,তমা, তিতলী,আদনান,আসিফ সবার আর্থিক সহযোগিতায় দালানটা গড়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠাতারা ছাড়াও কয়েক বছর ধরে নিয়মিত মোটা অংকের টাকা দেয় বুবুন, অজন্তা, লুম্বিনী, ইরফান। এখন তুতুনও দিচ্ছে নিয়মিত। হাত খুলে দান করেছিলেন তিতিরের মামা,খালা, চাচারা। ময়না খালা তার জমানো টাকা থেকে দিয়েছেন ১ লাখ। তিনি আরও দিতে চেয়েছিলেন, অনেক বুঝিয়ে তাঁকে শান্ত করা হয়েছে।
আজ তিতিরের দশম মৃত্যুবার্ষিকী। বৃদ্ধাশ্রমে আজ আরও ভালো খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে, পোলাও-রোষ্ট-ডিমের কোর্মা -গরুর মাংস দুই বেলা দেওয়া হবে তিনটি এতিমখানায়, প্রতিবারের মতো সকালে একসাথে কবর
জিয়ারত করে এসেছে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা, নাজমুল সাহেবকেও হাত ধরে নিয়ে গেছে আসিফ, রক্ত দিয়ে এসেছে বুবুন-ইরফান -লুম্বিনী -তুতুন-আয়নান-অরণ্য-অরণী আর ইরফানের ভারী লক্ষী বৌ সুমনা, অজন্তা খুব আফসোস করছিলো এবারে রক্ত না দিতে পারার জন্য, তারপরেই ঘটলো এমন ঘটনা।বুবুনের বিশ্বাস আরও গভীর হচ্ছে , মায়ের মৃত্যু দিনে আল্লাহ আবার মা’কে উপহার পাঠাচ্ছেন তার কোলে।
একজন ডাক্তার বের হয়ে এলেন।মুখে হাসির ছটা। আসিফকে সালাম দিয়ে উৎফুল্ল গলায় বললেন, ” মেয়ে হয়েছে স্যার, মা আর বাবু দু’জনেই ভালো আছে।”
আসিফ প্রথমে কোলে নিলো নাতনিকে। রাজ-লুম্বিনীর সাথে কিছুটা মিল আছে বাবুটার। অজন্তার মা কোলে নিতে নিতে বললেন, “বাবা-মা, দাদা-চাচা, নানার বাড়ির কারো মতো হয়নি মেয়ে। লুম্বিনীর সাথে হালকা মিল। আর আমার বেয়ানকে সামনাসামনি দেখিনি, ফটোতে দেখেছি, আমারতো মনে হয় নাতনি আমার দাদির মতো হয়েছে। ”
হৃৎপিণ্ডটা ধ্বক করে উঠলো বুবুনের। চমকে তাকালো লুম্বিনী। একটু দূরে থাকা তুতুন দৌড়ে এসে ঝুঁকে পড়লো বাচ্চার উপরে। তিনজনই ভাবছে, হতেই তো পারে মা ফিরে এসেছে। বৈচিত্র্যময় পৃথিবীর কতোটুকুই বা মানুষ জানে?
বাবুর ওজন একটু কম হওয়ায় পাঁচদিন হাসপাতালে থাকতে হলো। নাজমুল সাহেব -নিশাতকে হাসপাতালে আনা হয়নি। তাঁরা আছেন তিতিরের বাড়িতে। মেয়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এসেছিলেন।আর যাওয়া হয়নি।
বুবুনের মেয়েকে কোলে নিয়ে নিশাত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। অবিকল সেই চেহারা। নোমান বাবার হাত ধরে নিশাতের কাছে এলো,” বাবা, দেখো, আমাদের বুবুনের মেয়ে।” নাজমুল সাহেব উৎফুল্ল গলায় বললেন , ” এই তো তিতির।কোথায় ছিলো এতোদিন? ”
আসিফ ভাঙা গলায় বললো, “হারিয়ে গিয়েছিলো। ফিরে এসেছে।”
অজন্তার বাবা বললেন, ” সাতদিন হয়ে গেলো, কালকে আকীকা।নাম কোনটা ফিক্সড হলো?”
বুবুন, লুম্বিনী, তুতুন একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো, “তিতির। আমাদের এই ছোট্ট মায়ের নাম তিতির। ”
সমাপ্ত।